পিতা পুত্রকে – ১৩

তেরো

চাঁদপুর থেকে খুলনা বন্দর হয়ে গঙ্গা পর্যন্ত প্রবাহিত যে নদী তার নাম একটি নয়, দুটি। নদী কোথায় কী কারণে নাম বদলায় ভৌগোলিকরা তা বিশেষভাবে জানেন। আমার কাছে চিরবিস্ময়, গঙ্গা কেন পদ্মা হলো? মেঘনা হলো ভৈরব? মেঘনার মেঘছায়া জল পেরিয়ে জাহাজ যখন ভৈরবের স্বচ্ছ স্থির জলে পৌছল, আমি তখন নিদ্রিত। আমার ডেকের মেঘের ওপর বিছানো সতরঞ্চির ওপর, বিছানার বাকি অংশকে বালিশ তৈরি করে নিয়ে। গণেশপুর ছাড়বার সময় জ্যেঠামশাই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, নিজের মালপত্রের ওপর সর্বদা নজর রাখবি। স্টিমারে সর্বদা চুরি হয়। মালপত্র ছেড়ে কোথাও যাবি নে।

আমি অবশ্য সে উপদেশ মানি নি। আমার পার্শ্ববর্তী মধ্যবয়সী স্বামী-স্ত্রী তাঁদের বিছানা করে নিয়েছিলেন। আমিই এগিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। আশ্বস্ত হয়েছিলাম জানতে পেরে যে এঁদের গন্তব্যস্থানও খুলনা। আমি সদ্য স্কুল পাস করে কলকাতা যাচ্ছি কলেজে পড়তে। পথে পিতৃদেবের সঙ্গে খুলনায় কয়েকটা দিন থাকব জেনে এঁরা খুশি হয়েছিলেন। আমার বাবাকে এঁরা চিনতেন না, কিন্তু খুলনা বালিকা বিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ভদ্রলোক খুলনা মিউনিসিপ্যালিটিতে কাজ করেন। এঁদের গ্রামীণ দেশ পালং।

ভদ্রলোকের নাম বিপিন সরকার। স্ত্রীকে সম্বোধন করেন, “ওগো, শুনছ?” ইত্যাদি বলে। অতএব আমার কাছে মহিলার নাম “ওগো, শুনছ!”

বিপিন সরকার মহাশয়ের মাথাজোড়া টাক, কানের ওপর, ঘাড়ের ওপর সামান্য কয়েক হাজার কাঁচাপাকা চুল। সরু কপাল, ক্ষুদ্র চোখ গভীর গর্ত থেকে জ্বলজ্বল করে তাকায়। যেন দুটি অনির্বান জোনাকি। গাল চুপসে গেছে। গালের হাড় চোয়ালের হাড়ের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। পাঁচফুট ছ’ইঞ্চির বেশি লম্বা নন। শরীর জানিয়ে দিচ্ছে মহাশয়ের পেটের গোলমাল। সরু সরু হাড়াল হাতের আঙ্গুলের গ্রন্থিগুলোতে গুচ্ছ গুচ্ছ ধূসর চুল।

“ওগো শুনছ” কিন্তু বেশ ভারী মহিলা। স্বামীর চেয়ে দৈর্ঘ্যে কিঞ্চিৎ বেশি। দেহ বিপুল, তাই বেঁটে দেখায়। গোলগাল মুখখানার বড় অলংকার সোনার নাকছাবি নয়। সরল বহমান হাস্য। কথা বলতে গেলে হাসেন মহিলা। সে হাসি পরকে কাছে টেনে নেয়। দুহাতে মোটা সোনার বালা, দু’গুচ্ছ সোনার চুড়ি, গলায় সোনার হার ও কানে বড় বড় সোনার মাকড়ি। দেখে মনে পড়ল গণেশপুরে ফেলে আসা আমার মার হাতে শুধু একজোড়া শাঁখা ও একটা লোহা, তাঁর যেটুকু বিয়েতে পাওয়া গয়না ছিল, চোরের হাতে তার সবটুকু গেছে।

মনে পড়ল, মাকে আমি বলেছিলাম, মা, আমি বড় হয়ে তোমাকে নতুন গয়না করে দেব।

এখন মনে পড়ছে আমি তা করিনি। মাকে কোনো গয়না তৈরি করে দিইনি আমি।

সরকার দম্পতির সঙ্গে আমার খুব সহজে আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল। মহিলা আমাকে মা-ছাড়া কাতর একটি তরুণ যুবক হিসেবে দেখে ফেললেন। আমার সঙ্গে তখনও রাত্রের আহার লুচি-তরকারি ছিল। একরকম জোর করেই সদ্য তৈরি ‘মাসিমা’ আমাকে তরকারি, বেগুনভাজা ও রসগোল্লা খাওয়ালেন। বললেন, তিনি বরিশালের গ্রামের মেয়ে। এখনও দু-তিন বছরে একবার বাপের বাড়ি যান স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে। ‘মাসিমা’র বাবা প্রয়াত হয়েছেন, কিন্তু বৃদ্ধা মা এখনও জীবিত, দুই ভাই ও তাদের সংসার রয়েছে। পাঁচ ভাইপো ভাইঝি স্কুল কলেজে পড়ে। বাপের বাড়িতে এখন তাঁর প্রচুর আদর। ‘মাসিমা’ এও বলে ফেললেন তাঁর নতুন তৈরি বোনপোকে, বিয়ের সময় তাঁর আশা ছিল স্বামী একদিন বড় অফিসার হবেন, অনেক টাকা মাইনে পাবেন। খুব সচ্ছল অবস্থায় জীবন কাটবে তাঁর ঘরভরা কোলভরা ছেলেমেয়ে নিয়ে। ভাগ্যে না থাকলে আমগাছও নিষ্ফল হয়ে যায়। তাঁর স্বামীর যোগ্যতার অভাব ছিল না মোটেই বিএ পর্যন্ত পাস করেছিলেন। কিন্তু মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের কুনজরে পড়ে কেরানিই রয়ে গেলেন। রিটায়ার করার সময় বড়জোর হেডক্লার্ক হবেন। ভগবানের আশীর্বাদ না থাকলে জীবনে কিছুই পাওয়া যায় না। ভগবানের ইচ্ছে, তাই তাঁকে নিঃসন্তান থাকতে হয়েছে। সারাদিন একা একা ঘরকন্না করতে করতে মাঝে মাঝে জীবনে ঘেন্না ধরে যায়।

সব দুঃখের কথা বলবার সময়ও ‘মাসিমা’র মুখের হাসি নিভে যায়নি। সন্তানহীনতার কথা বলবার সময় চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল, কিন্তু মুখের হাসিটি মিলিয়ে গেল না।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আমি বললাম, “আমি ওপরে গিয়ে সারেঙ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসছি। উনি বলেছেন, কী করে নদীর বুকের ওপর দিয়ে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে হয় বুঝিয়ে দেবেন। আপনি আমার বিছানার ওপর একটু নজর রাখবেন, মাসিমা? আমি বেশি দেরি করব না।”

মাসিমা বললেন, “ওপরে যাবে? ভয় করবে না? চারদিকে তো শুধু জল আর গভীর অন্ধকার। সারেঙ ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই।”

আমি হেসে বললাম, “না, মাসিমা, ভয় করবে না। সারেঙের নিমন্ত্রণেই যাচ্ছি।”

সরকার মশাই দেখলাম খুব কম কথা বলেন। এতক্ষণ কথাবার্তা হচ্ছিল ‘মাসিমা’ আর আমার মধ্যে। সরকার মশাই শুনছিলেন কিনা তাও বুঝতে পারছিলাম না। যখন ‘মাসিমা’ তাঁর স্বামীর পদোন্নতির অভাব ও সন্তানহীনতা নিয়ে দুঃখ করছিলেন তখনও তাঁকে উদাসীন মনে হচ্ছিল।

এবার তিনি মুখ খুললেন।

“তুমি ভবিষ্যতে কী হবে? ম্যাট্রিকে কেমন রেজাল্ট করেছ?”

আমি বললাম, “মন্দ নয়, ভালোই বলতে হবে। প্রথম বিভাগে পাস করেছি।”

“লেটার টেটার কিছু পাওনি?”

“পেয়েছি। তিনটে বিষয়ে।”

“জিলা স্কলারশিপ পেয়েছ? ‘স্টার’ পেয়েছ?”

“না, দুটোর একটাও পাইনি।”

“ভবিষ্যতে কী করবে? মাস্টারি, না ওকালতি?”

আমি বললাম, “জানি না। সে তো অনেক দূরের ব্যাপার। কোনো আইডিয়া নেই আমার।”

“তোমার বাবা তো স্কুলের মাস্টার?”

“আজ্ঞে, হ্যাঁ।”

“কত আর মাইনে পাবেন। চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা হবে!”

আমি চুপ করে রইলাম।

“একটা পরামর্শ তোমাকে দিয়ে রাখি, ভারত সরকারের সেক্রেটারিয়েটে অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের জন্য পরীক্ষা হয় প্রতি বছর। পঞ্চাশ থেকে একশো চাকরি খালি থাকে। খুব ভালো চাকরি। আমি ঐ পরীক্ষা না দিয়ে যে বোকামি করেছি তার ফল সারাজীবন ভোগ করছি। তুমি নিশ্চয়ই অ্যাসিস্ট্যান্ট পরীক্ষা দিয়ো। ফেডারেল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা নেয়। লেখাপড়ায় ভালো, তোমার হয়েও যেতে পারে।”

আমি বললাম, “মনে থাকবে আপনার উপদেশ, মেশোমশাই।” সরকার মশাই বললেন, “তোমার মাসিমা দশ মিনিটের মধ্যে গভীর নিদ্রায় ডুবে যাবেন। আমি জেগে থাকব। আমার নিদ্রা আসে না সহজে। আমি নজর রাখব তোমার বিছানার ওপর। তুমি সারেঙের কাছ থেকে ঘুরে এসো। সাবধানে কথাবার্তা বোলো। সারেঙরা সাধারণত চট্টগ্রাম, নোয়াখালির লোক। ওদের দেহে পর্তুগিজরক্ত। যাকে আমাদের দেশে বর্গী বলা হয়। এ সারেঙটা ভাগ্যক্রমে হিন্দু। বেশিরভাগই ওরা মুসলমান। খুব চড়া মেজাজ। খুন খারাবিতে পরোয়া নেই। বেশিক্ষণ থেকো না। চলে এসো তাড়াতাড়ি।”

আমি “যে আজ্ঞে” বলে সরু লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলাম। সত্যিই জাহাজের প্রকাণ্ড ছাদের চারদিকে কেবল জল আর গভীর অন্ধকার। হঠাৎ মনে হলো, জল ও অন্ধকারের সঙ্গে আমি মিশে গেছি, হারিয়ে গেছি, আকাশ স্বচ্ছ, অসংখ্য তারা তাকিয়ে দেখছে বসুন্ধরাকে। কেউ মিটমিটে চোখে, কেউ বা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে। মেঘনা পেরিয়ে কখন জাহাজ ভৈরবে পড়েছে জানতে পারিনি। ভৈরব নদী পদ্মার তুলনায় অনেক সরু, দু’পাশের গাছগুলো অন্ধকারে গা ঢেকে জাহাজের চোখের ওপর পিছে সরে যাচ্ছে। নদীর জল ও গাছপালার মিশ্রিত গন্ধ উঠে আসছে বাতাসের সঙ্গে। তরঙ্গহীন ভৈরব। শুধু জাহাজের জল কাটার শব্দ নিঃশব্দ স্তব্ধ অন্ধকারের সঙ্গে সখ্যতার আলাপ করছে। ভৈরবে পদ্মার মতো নদী ও জাহাজে লড়াই নেই। বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ‘এক বাণী মধুর অর্থ ভরা’।

জাহাজের ছাদে সারেঙের ঘর। আমি দরজার সামনে দাঁড়াতেই সারেঙ সাহেব ভেতর থেকে আহ্বান করলেন, “আসুন, আসুন, মাই ইয়ং ফ্রেন্ড।”

ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলাম প্রথমে সারেঙের কম্পাস ঘর। বড় কম্পাস, একটা লোহার থামের ওপর বসানো, অনেকটা মোটরগাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের মতো দেখতে। তখণ পর্যন্ত আমি মোটরগাড়ি দেখিনি, স্টিয়ারিং হুইল তো দূরের কথা। কাপ্তান চক্রটাকে ডাইনে —বাঁয়ে ঘুরিয়ে জাহাজের ভারসাম্য রাখছে, গতিপথে ধরে রেখেছে জাহাজকে। ঘরটা ছোটই, কম্পাসের পেছনে কাপ্তানের জন্য একটা চেয়ার, আর বাড়তি বেতের চেয়ার একটা। দুটি লোহার চেয়ার, গায়ে জং পড়ে গেছে। বেতের চেয়ারে বসরবার আসনে বেত গেছে ছিন্নভিন্ন হয়ে। দেওয়ালে মহাদেব ও গণেশের ছবি, কাপ্তানের চোখের বরাবর দেওয়ালে মা-কালীর পট।

কম্পাস ঘরের সংলগ্ন আর একটি ছোট ঘর। সারেঙ সাহেবের বেডরুম। লোহার ফ্রেমের বেড, তোষক, চাদর, বালিশ সবই আধময়লা। দুটো বসবার চেয়ারও রয়েছে শয়নঘরে। দেওয়ালের সঙ্গে ছোট্ট একটি টেবিল, তার ওপর যে আয়না তাতে মুখচ্ছবি ঘোলাটে জলের মতো আবছা। পিতলের কলসে পানীয় জল, ঢাকনার ওপরে পেতলের গেলাস। ঘরখানার একমাত্র জানলার ওপর রংচটা কালো পর্দা। জানলার এক কপাট ও দেওয়ালে ঢোকানো একটা পেরেক : এই দুইয়ের মধ্যে সেতু বেঁধেছে এক পাটের দড়ি। তার ওপর কাপ্তানের গেঞ্জি লুঙ্গি, গামছা, একটা শার্ট ও একখানা চাদর।

সারেঙ, আগেই বলেছি, চাঁটগার হিন্দু। আমাদের গ্রামে চাঁটগা, নোয়াখালি ও কুমিল্লার বৈদ্যদের ‘নিচু’ বৈদ্য বলা হতো। অগত্যা হলে তাদের সঙ্গে বিক্রমপুর, বরিশাল ঢাকার বৈদ্যদের বিয়ে শাদি হতো না। ‘বিক্রমপুর’ ছিল পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতির প্রধান অঞ্চল। ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার কিছুটা অংশ নিয়ে বিক্রমপুর। বিক্রমপুরে আবার উত্তরাংশের সমাজ দক্ষিণাংশের থেকে উঁচু। আগেই বলেছি মাদারীপুর মহকুমার বেশিরভাগের ওপর বরিশালের প্রভাব। গণেশপুর ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরের মধ্যে। ‘আসল’ বিক্রমপুরের মধ্যে বিখ্যাত গ্ৰাম সমষ্টির নাম ছিল সোনারগঞ্জ। আবার খুলনা জিলার যশোহর ও ইতনার ছিল আরও সামাজিক উচ্চতা। আমার কাকিমা ছিলেন সোনারপুরের মেয়ে। তাঁর সামাজিক কৌলিন্য আমার মার নোয়াখালির অনভিজাত্যকে বেশ একটু মালিন্য লাগিয়ে রাখত।

আমার কিন্তু চাটগাঁর সারেঙকে তৎক্ষণাৎ ভালো লেগে গেল। টুপি খুললে মাথার ঠিক মাঝখানে গোল টাক, মেদহীন দীর্ঘ শরীরের মাংসপেশি মজবুত। হাতের অঙ্গুলিগুলো বেঁটে। কারিগরি কাঠিন্যে সবল। কপালে অনেকগুলো কুঞ্চিত রেখা। সামান্য চ্যাপ্টা ছোট নাকের দু’পাশে তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ। তারা কথাবার্তার মধ্যেও সব সময় কম্পাস সম্বন্ধে সজাগ।

সারেঙ দেওয়ালে আটকানো ম্যাপের নদীপথের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। তিনটে স্টেশনে থেমে সকাল আটটা নাগাদ জাহাজ ‘খুলনা’ বন্দরে পৌছবে। খুলনা তখনও পূর্ববঙ্গের নদীপথের অন্যতম প্রধান জংশন। এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বন্দর, চট্টগ্রামের পরেই খুলনা। সারেঙ আমাকে বলল, খুলনা সমুদ্রের তীরবর্তী নয়, তার প্রাধান্য নদ-নদীবাহী বাণিজ্যে। খুলনায় সারাদিন জাহাজ বিশ্রাম নেবে। নাবিকদের কিছু রদবদল হবে। খুলনা থেকে হুগলি যাবার সময় মাঝে মাঝে সারেঙও বদল হয়। এ জাহাজে হবে না, কারণ কোম্পানির কয়েকজন সারেঙ অন্য একটা নতুন স্টিমার কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে সারেঙের অভাবে।

কম্পাস ঘুরিয়ে কী করে জাহাজের গতিপথ বদলাতে হয় তাও দেখবার সুযোগ পেলাম যখন নদীপথ কিছুটা বেঁকে পশ্চিম থেকে উত্তরমুখী হলো।

এক ঘণ্টারও বেশি গল্প হলো সারেঙের সঙ্গে। তার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে একান্নতে পড়েছে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল লোকটি। “তার আগে চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি একটা ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজে ঢুকে পড়ি। প্রথম কাজ ছিল জাহাজের মেঝে ধোওয়া-মোছা, জল তোলা, ডেকের রেলিং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, এককথায় ‘সাফাই বয়’। একটু একটু করে, নানা রকমের কাজ শিখতে পেরেছিলাম, ইঞ্জিনঘরের কাজ পর্যন্ত। নোঙর ফেলা ও তোলায় হাত লাগানো, কেবিনের যাত্রীদের আরাম-বিরামের কাজে অংশ নেওয়া। আমি নিজেকে নাবিক বলেই মনে করতাম সেই ছোট্ট বেলা থেকে। তাই যুদ্ধ যখন বাধল, আমি ব্রিটিশ নেভীতে ঢুকে যেতে আমার বিশেষ পরিশ্রম করতে হলো না।”

আমি জানতে চাইলাম, “আপনার ঘর-সংসার নেই?”

সারেঙ বলল, “হতে পারত, কিন্তু হলো না। চাঁদপুরের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু বছরের মধ্যে এগারো মাস নদীতে বাস করলে বউ ঘরে রাখা যায় না। আমার বউ-ও চলে গিয়েছিল। তারপরে আর ওদিকে পা বাড়াইনি।”

একটু পরে সারেঙ আরও বলল, “আপনারা যারা মাটির ওপর বাস করেন তারা বুঝতেই পারেন না জলের কী প্রকাণ্ড টান, কী বিপুল রহস্য। রবিঠাকুর বলেছেন না, “অতল জলের আহ্বান” সে আহ্বান যে কী মধুর, কী গভীর তা বোধহয় তিনিও জানতেন না। যুদ্ধের চার বছর আমি ভূমধ্যসাগর, ভারত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরে কাটিয়েছি। সমুদ্র যে কী ভীষণ আকর্ষণীয় তা মাটির মানুষ জানবে কী করে? মাটির মানুষ সমুদ্রতীরে রৌদ্রস্নান করে, তটের কাছাকাছি জলে সাঁতার কাটে। সমুদ্রের অপার রহস্য তার বুকের মধ্যে। সে রহস্য একবার আপনাকে দখল করে নিলে আর রেহাই নেই আপনার। শুনেছি ফাইটার পাইলটরা আকাশে মহাশূন্যে উড়ে তারাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে রাত্রির অন্ধকারে এক সম্পূর্ণ অনুভূতির সন্ধান পায়। আমি তা পুরোপুরি বিশ্বাস করি। সমুদ্র দিনেরাত্রে বারবার রং বদলায়। ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে হয় তারও পরিবর্তন। ঠিক যেন প্রকৃতি। সমুদ্র মানুষকে যেভাবে ভালোবাসবে, নদী ও মাটির তা সাধ্যের বাইরে। যুদ্ধ শেষ হবার পরও আমি ব্রিটিশ নেভীতে ছিলাম। বন্দর আমার একেবারে ভালো লাগত না। নাবিকরা বন্দরে নামে বেশ্যাপাড়ায় ফুর্তি করতে, মদ খেতে, কেনাকাটা করতে। আপনি এখন ছেলেমানুষ, আমার কথার মানে বুঝবেন না। বড় হলে বুঝতে পারবেন। মেয়েমানুষের খপ্পরে পড়া মানে পুরুষের জীবন থেকে অ্যাডভেঞ্চার চলে গেল। ঘর সংসার বাড়ি জমি ছেলে মেয়ের বেড়ায় চিরজীবনের জন্য আপনি বন্দী হয়ে গেলেন। সমুদ্রের সঙ্গে হয়ে গেল আপনার ছাড়াছাড়ি, ডাইভোর্স। নাবিকরা এত খারাপ অসুখে ভোগে কেন? বন্দরে বন্দরে বেশ্যা বাড়ি যাবার জন্য। কী আছে বেশ্যাদের? এই যাঃ, আপনি তো বালক? কী সব বলে যাচ্ছি আপনার কাছে!”

সারেঙ আমাকে ড্রিঙ্ক করতে আহ্বান করেছিল। পরে নিজেই বলেছিল, “না, না, আপনার জন্য এ সব নয়। আমি অবশ্য আপনার বয়সেই র‍্যাম খেতে শুরু করেছি। এক কাপ চা খাবেন? আমার তৈরি করতে কোনো কষ্ট হবে না।”

আমি বলেছিলাম, “আমি এখনও চা খাইনি কোনোদিন। একদিন গ্রামের এক বন্ধুর বাড়িতে আধ পেয়ালা চা খাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার বমি এসে গেল।”

সারেঙ গলা ছেড়ে হেসে উঠেছিল। তার হাসি নদীর বাতাস ও জলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছিল আমাদের ছোট্ট আসরে।

সারেঙ বলেছিল, “আমি একটু পান করলে আপত্তি নেই তো?”

আমি কাউকে মদ্যপান করতে দেখিনি। আমার জানা ছিল মদ খেলে লোকে মাতাল হয়, মাতালের কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। সরকার মশাই’র সতর্কবাণী মনে পড়ল আমার। বুঝতে পারছি ভয় পাচ্ছি। বুকের মধ্যে দুরু দুরু আনন্দ হচ্ছে। হাতের তালুতে ঘাম অনুভব করছি।

তবু বললাম, “না, আপত্তি হবে কেন?”

আমার গলা সম্ভবত ভয়কে ফাঁস করে দিয়েছিল।

সারেঙ বলল, “ভয় পাবেন না। খুব ধীরে আস্তে পান করব আপনার কাছে। আমাদের মাতাল হওয়া একবারেই বারণ। জাহাজ চালাবার সময় মাথা পুরোপুরি ঠান্ডা রাখতে হয়।”

সারেঙ তার নিজের কথায় ফিরে এল।

“সমুদ্রের পর নদী—দুধের বদলে ঘোল। নদীর সে গুরুগম্ভীর ভীষণ সুন্দর, ঐশ্বর্য কোথায়? নদী ঘরের বউ, সমুদ্র দুরন্ত প্রেমিকা।”

গ্লাসে চুমুক দিয়ে, “তবু জল তো! নদীও তো জল! বহমান, তরঙ্গিত, উচ্ছল জল। পদ্মা বর্ষাকালে সমুদ্রের ছোট বোন। এই যে ভৈরব, দেখতে তো বড় গাঙের মতো, এতেই শ্রাবণ-ভাদ্রে ঝড় উঠলে জল তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দেয়। মেঘনাকে আমি উর্বশী হতে দেখি প্রত্যেক ঘোর বর্ষায়। নদীর যে মাতন আছে, মাটির তা নেই। নদী জীবনের মতো চলে, আর নাচে, আর বলে।”

আমি গভীর বিস্ময়ে শুনে যাচ্ছিলাম। এ লোকটা এত সুন্দর করে সমুদ্র-নদীর কথা বলতে পারছে কী করে? চৌদ্দ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিদেশি জাহাজে চাকরের কাজ শুরু করেছিল। স্কুলেও পড়েনি নিশ্চয়ই। কলেজ তো দূরের কথা! এত সব বুঝল জানল কী করে?

সারেঙ আবার বুঝতে পারল আমি কী ভাবছি।

বলল, “আমার কথা শুনে আপনি অবাক হচ্ছেন, মাই ইয়ং ফ্রেন্ড। আমি স্কুল কলেজে পড়িনি। কিন্তু ভাববেন না আমি অশিক্ষিত। নিজের চেষ্টায় অনেক কিছু শেখা যায়। জাহাজের সারেঙরা আমার উৎসাহ দেখে ইংরেজি শিখতে সাহায্য করেছে আমাকে। বন্দরে বন্দরে জাহাজ দীর্ঘকাল নোঙর রাখলে আমি খুঁজে লাইব্রেরি বার করেছি। বইয়ের দোকান থেকে বই কিনে পড়েছি। অনেক বই আছে আমার। দেখবেন? আসুন আমার সঙ্গে।

শয্যাঘরের সংলগ্ন ছোট্ট একটা ঘর। দরজা এমনভাবে বন্ধ যে দেওয়াল থেকে তাকে প্রভেদ করতে পারিনি আমি। দরজা খুলে সারেঙ আমাকে সেই ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেল। চার-দেওয়ালে কাঠের তাক, প্রত্যেকটা বইয়ে ঠাসা। বই ছড়িয়ে রয়েছে মেঝেয়। বেশিরভাগই সমুদ্র ভ্রমণের কাহিনি। যুদ্ধের ইতিহাস ও বর্ণনা। বড় বড় যোদ্ধার জীবনী। কলম্বাস, ভাস্কো-দা-গামা, ড্রেক, সিসিল রোডস, রবিনসন ক্রুশো, এগুলো এখনও আমার মনে আছে। নেপোলিয়ন, নেলসন, ক্রমওয়েল, জর্জ ওয়াশিংটন থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বড় বড় প্রধান সেনাপতি, স্থল, জল, আকাশবাহিনী সৈন্যদের সেনাপতির জীবনী সাজানো রয়েছে সারেঙের পড়ার ঘরে। হিন্ডেনবার্গ, ফার্দিনান্দ এঁরা সব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বড় বড় যোদ্ধা। এখনও মনে পড়ছে দেখতে পাচ্ছিলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি ইতিহাস।

আছে অনেক বাংলা বইও। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জলধর সেন, আরও অনেক বঙ্গ সাহিত্যের রথী মহারথী সারেঙ সাহেবের সঙ্গে দিনের পর দিন পূর্ববঙ্গের নদীপথে যাতায়াত করছেন। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মডার্ন রিভিউর সংখ্যাগুলো, সংখ্যা ও সন ক্রমে বাঁধাই। রেকসিন চামড়ার স্পাইনের (spine) ওপর, সোনার জলে তাদের নাম ও বর্ষ খোদাই।

আমি সারেঙকে বিস্মিত করে প্রশ্ন করেছিলাম, “এইসব বই আপনি পড়েছেন?”

সারেঙ একটু বিষণ্ন হাসির সঙ্গে জবাব দিয়েছিল, “নো মাই ইয়ং ফ্রেন্ড, অনেক বই পড়তে পারিনি। নিজের হাতে নিজেকে শিখিয়েছি বাংলা ও ইংরেজি। সে শিক্ষায় যেটুকু বিদ্যালাভ হয়েছে তা নিয়ে এসব বই পড়ে হজম করা সহজ নয়। আমি তো শিক্ষিত ভদ্ৰলোক নই। আমি জাহাজের সারেঙ।”

আমরা দুজনে আবার কম্পাস ঘরে ফিরে এসেছি। সারেঙ বলল, “ভৈরব নদী এখান থেকে সংকীর্ণ হতে শুরু করেছে। এখন আর বড় নদী নয়, ঢেউয়ের আছালি-পাছালি শুনতে পাবেন না। দেখুন, জাহাজ একটু একটু কাঁপছে, চলতে চলতে। আমরা উজান বেয়ে চলছি। নদীর স্রোতের বিপরীত। চেয়ে দেখুন আকাশ কী ভয়ানক গভীর অন্ধকার। মেঘ জমেছে আকাশে। তারা দেখতে পাচ্ছেন না একটাও। না, এ মেঘ ঝড় তুফান তুলবে না, শুধু নদীর তরঙ্গগুলোকে কিছুটা উন্মত্ত করে দেবে। ঢেউ নেচে নেচে একটা অন্যটার গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। গভীর প্রেমে গলাগলি হয়ে চুমোচুমি হয়ে নেচে চলেছে। এই অন্ধকার রাত্রে ভৈরব যেন ভৈরবী হয়ে ওঠে। আমি দেখতে পাই তার মূর্তি হঠাৎ চঞ্চল অন্তরে। বৃষ্টি হবে বেশি রাত্রে।। ঝড় উঠবে না। শুধু বৃষ্টি। গোধূলি বেলায় আকাশে কালোয় সোনায় মেঘের কোনায় কোনায় উছলে পড়া আলোর খেলা দেখেছিলেন তো! এখন দেখুন, নদীর বুকে থমথমে জমজমাট অন্ধকারের পূর্ণ প্রকাশ অনুভব করুন। মনে হচ্ছে না কি যে আপনি সৃষ্টির পূর্বেকার মুহূর্তগুলোকে একত্র করে এক মহাপ্রশান্ত পরিপূর্ণ নীরবতার মধ্যে ধ্যানমগ্ন মহাদেবের মতো বসে আছেন।”

“আপনি তো এখনও তরুণ এ উপলব্ধি আপনার এখন হবার কথা নয়। আমি প্রতি রাত্রিতে নদীর বুকে সৃষ্টির নতুন চেহারা দেখতে পাই। নদী অনেক কথা বলে, কোনো কথা না বলেও বলে যায় কথার পর কথা। তার ভাষা কখনো বুঝি, কখনো রয়ে যায় অবোধ্য। জীবনের মতো। আমার কিছুটা জীবনের মর্মকথা আমি জানি, কিছুটার কিছুই জানি না, বুঝি না। আমি চাঁটগাঁয়ের জনৈক সারেঙ বৈ তো কেউ নই! তবু জানেন, আমার দুর্বল ভাষায় নদী ও অন্ধকারের উচ্চারিত অনুচ্চারিত অনেক কথা আমি লিখে রাখি। পড়বে শুধু একজন, যতদিন তার পড়বার ক্ষমতা আছে। সে চাটগাঁয়ের জনৈক সারেঙ। আপনি পড়তে চান? আমার হস্তাক্ষর এমন কুৎসিত যে একবর্ণও পড়তে পারবেন না। আমাকে পড়তে হবে, শুনতে পাবেন আপনি। এ যাত্রায় নয়, এখন রাত দুপুর হয়ে এসেছে। নিচে নেমে গিয়ে বিছানায় শুলে ঘুম এসে যাবে আপনার। হয়তো নদী ও অন্ধকার স্বপ্নে আপনাকে কিছু বলবে। হয়তো কিছুই বলবে না। প্রভাত হবার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ খুলনা বন্দরে পৌঁছবে। আপনার সঙ্গে আবার যদি এই জাহাজে দেখা হয়, এক পথের যাত্রী হতে পারি। পড়ে শোনাব আপনাকে আমার ভাষায় নদীর কলরব, তরঙ্গের কোলাহল, বাতাসের হাহাকার, মেঘের ও বৃষ্টির সংগীত, ঝড় তুফানের হুংকার। যদি আবার কোনোদিন দেখা হয়…”

আমি নিচে নেমে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ছি, শুনতে পেলাম সরকার মশাইয়ের কণ্ঠ, “এতক্ষণ কী করছিলে সারেঙের সঙ্গে? আমার তো বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছিল।”

আমি বললাম, “কিছু করছিলাম না, নদী ও অন্ধকার দেখছিলাম।”

“কী করছিলে?”

আমি আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লাম। মা একটা রংচটা বেডকভার সঙ্গে দিয়েছিলেন। “জাহাজে ঠান্ডা লাগবে দেখিস।”

সত্যিই তাই। আমি বেড কভারটা গায়ে জড়িয়ে চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আমাকে গভীর স্নেহে জড়িয়ে ধরল।

ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শুনতে পেলাম জোর বৃষ্টি পড়ছে নদীতে। জাহাজের ছাদে। গগন থেকে মাদল বাজছে, “গুরু গুরু গুরু…।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *