পঁচিশ
অধ্যাপক গ্রে, আগেই বলেছি, আমার যৌবনের সবচেয়ে প্ৰধান পরিবর্তনের পুরোহিত। খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে যে অনেকখানি ঔদার্য রয়েছে, যিশুর জীবন যে পাপী-তাপীদের জন্যই ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিল, এসব কাহিনি আমি মার্কাস গ্রে-র মুখে শুনেছিলাম। পুরোনো ও নতুন টেস্টামেন্ট এর মধ্যে বিভেদ ও তফাত ক্রিশ্চিয়ানিটি ও জুডাইজ্ম কেন অনেক মিল সত্ত্বেও পারস্পরিক দ্বন্দ্বে আবদ্ধ, বিশ্বের একই অঞ্চলে জন্ম নিয়েও ক্রিশ্চিয়ানিটি ও ইসলাম কেন একে অপরের দুশমন, তাঁর কাছে প্রেরণা না পেলে আমার এসব ধর্মীয় ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় হতো না। ইউরোপের মধ্যযুগ পেরিয়ে, রেনেসাঁসে পদক্ষেপ, রেনেসাঁস থেকে মডার্ন অথবা আধুনিক সভ্যতায় উত্তরণ, শিল্পবিপ্লব, সমাজগঠন ও সাম্রাজ্য নিয়ে প্রতিযোগিতার ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ শিক্ষাও আমি তাঁর কাছে পেয়েছিলাম। এসব ছাপিয়ে যে শিক্ষা পেয়েছিলাম যা আমি সম্যক গ্রহণ করতে পারিনি, তা হলো মানসিকতা।
আমাদের হিন্দু মনের কাছে ক্রিশ্চানরাও অনেক সময় বোকা বোকা দেখান। সহপাঠী ছিল একটি পাঞ্জাবী হিন্দু ছেলে, পরবর্তী জীবনে যে বড় পুলিশ অফিসার হয়েছে। মাঝেমধ্যেই গ্রে সাহেবের কাছে গিয়ে চোখের জলে গাল ভাসিয়ে ‘পাপ’ স্বীকার করত এবং দশ বিশ পঞ্চাশ এমনকি একশো টাকা নিয়ে ঘরে ফিরত, যার ব্যবহার হতো আমাদের সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া ও দুই-এক খানা বই কেনাতে। একদিন আমি অধ্যাপক গ্রে-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পাঞ্জাবী ছেলেটির সব পাপ স্বীকার করাকে আপনি বিশ্বাস করেন কিনা। গ্রে অকপটে জবাব দিয়েছিলেন, “নিশ্চয়ই করি, পাপ না করেও যদি কেউ পাপ স্বীকার করে সেটাও তো পাপ স্বীকারই।” বাক্যটির মধ্যে যে জীবন দর্শন ছিল তা আমি হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
একদিন মার্কাস গ্রে’র ঘরে আমার ডাক পড়ল। গিয়ে দেখলাম তাঁর অফিস ঘরে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তিনি, পাশে একখানা চেয়ারে উপবিষ্ট মেরীর মুখ থমথমে। আমি ঘরে ঢুকতেই গ্রে বললেন, “এই চেয়ারটায় বসো।”
বসলাম। গ্রে বললেন, “মেরীর সঙ্গে জীবনে আমার প্রথম বড় ঝগড়া ঘটেছে। তোমাকে ব্যাপারটা শুনতে হবে।”
আমি বিব্রত চকিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে অপেক্ষমাণ দৃষ্টি নিয়ে বসে রইলাম।
গ্রে বললেন, “আমাদের বেশ কিছু টাকা জয়েন্ট স্টক কোম্পানির শেয়ারে বিনিযুক্ত আছে। এই কোম্পানিগুলো ক্যাপিটালিস্ট এবং গরিবদের শোষণ করে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি যদি প্রকৃত ক্রিশ্চান হয়ে থাকি, তাহলে এইসব স্টকগুলো বিক্রি করে টাকাপয়সা যা পাওয়া যায় তা চার্চে দিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। মেরী বলেছে, আমি নিছক বোকামি করছি। কোম্পানিদের অর্থে অনেক ভালো কাজও হয়ে থাকে। এবার তুমি বল আমি ঠিক বলছি, না মেরী?”
আমি বেশ সপ্রতিভ স্বরে হিন্দু নীতি অনুসরণ করে বললাম, “তোমরা দুজনেই।”
বলতে ভুলে গেছি আমি অধ্যাপক গ্রে ও তাঁর পত্নীকে প্রথম নামে ডাকতাম। অর্থাৎ ছাত্র হলেও আমাকে তাঁরা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
গ্রে উচ্চস্বরে হেসে উঠে বললেন, “ঠিক হিন্দুর মতো বলেছ। এটাও হয়, ওটাও হয়। সব পথই নিয়ে যায় ঈশ্বরের দিকে। অতএব হিন্দুদের কোনোকিছুই বেছে নিতে হয় না, জলে নামে কিন্তু গা ভেজে না।”
মেরীও হেসে উঠল।
আমি হেসে বললাম, “কিন্তু এটা তো সত্যি যে কোম্পানির টাকায় একদিকে যেমন দরিদ্র বঞ্চিতদের শোষণ করা হয়, অন্যদিকে উৎপন্ন হয় দ্রব্যসম্ভার, তৈরি হয় রাস্তাঘাট বন্দর যানবাহন।”
গ্রে বললেন, “তুমি কমিউনিস্ট?”
“আমি কমিউনিস্ট হিসেবে তোমার প্রশ্নের জবাব দেইনি। তুমি তো শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলছ না।”
গ্রে বললেন, “আমি শ্রেণি সংগ্রাম বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি সব মানুষের সংগ্রামে। আমাদের পুত্র-কন্যা নেই। দুজনেই আমরা জীবন চার্চ অব স্কটল্যান্ডের হাতে উৎসর্গ করেছি। যতদিন বেঁচে থাকব চার্চ আমাদের ভরণ-পোষণ করবে। আমরা করব চার্চের সেবা। এখানে আমাদের নিজস্ব সম্পত্তির স্থান কোথায়? এটা কি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ হচ্ছে না?”
এমআরএ-র সেই সভায় পাপ স্বীকার করে আমার মনে এতটা জোর এসে গিয়েছিল যে, যা সত্যি মনে হতো বলতে বেশি কষ্ট হতো না, ভয়টা অনেকখানি চলে গিয়েছিল।
আমি মেরীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “মার্কাস যা বলছে তা যে সত্যি, এটা তুমি নিশ্চয়ই মানো।”
মেরীর চোখ ভিজে এসেছিল। বলল, “তুমি তো জান না কত কষ্টে আমাকে এই টাকাগুলো বাঁচাতে হয়েছে। চার্চ আমাদের বিলাসিতার জীবন দেয় না। ঠিক যেটুকু প্রয়োজন তাই দেয়।”
আমি বললাম, “তাহলে, মেরী, এই ত্যাগটা তোমার পক্ষে হবে আরও মহান।”
অধ্যাপক গ্রে তাঁর সব শেয়ার বেচে দিয়েছিলেন। সব সঞ্চয় ত্যাগ করে তিনি যে কতখানি শক্তির সন্ধান পেয়েছিলেন তার প্রমাণ ক’বছর পরেই পাওয়া গেল।
বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ভারতে নিবাসী ইংরেজদের সামরিক কাজকর্মে অংশ নিতে বলা হয়েছে। অধ্যাপকদের মধ্যে যাঁদের বয়স চল্লিশের নিচে তাঁরা একে একে অফিসার পদে সৈন্য, নৌ, বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর যাঁদের বয়স তাঁরা যানবাহন, কমিউনিকেশন, প্রপাগাণ্ডা ইত্যাদিতে যোগ দিচ্ছেন।
মার্কাস গ্রে সৈন্য বিভাগে যোগ দিলেন সাধারণ সৈনিক হিসেবে, যাকে বলে আদার র্যাঙ্কা। ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতায় বেশ কিছু আলোড়ন ঘটেছিল। কলেজের সাহেবরা, বিশেষ করে প্রিন্সিপ্যাল ক্যামেরন গ্রে-র কাজ মোটেই পছন্দ করেননি। কিন্তু কারও কথায় কান দিলেন না অধ্যাপক গ্রে। ভর্তি হয়ে গেলেন ইংরেজ সৈন্যবিভাগে একজন সাধারণ সিপাহি হিসেবে। সবাকার প্রশ্নের উত্তরে তাঁর মুখে শুধু এক কথা, যদি শত্রুর সঙ্গে লড়তে হয় লড়ব সাধারণ মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাত মিলিয়ে অফিসারি করব না।
ঘটনার কতকগুলো পাতা এগিয়ে গিয়ে গ্রে-র কাহিনি শেষ করা যাক। এমএ পড়ার সময় বঙ্গের দুর্ভিক্ষ সারা পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছে। আমাকে টিউশনি করে পড়ার খরচ দিতে হচ্ছে। পিসিমার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়েছে টিউশনির মাইনের এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ দশ টাকার বিনিময়ে। বাবা খুলনা থেকে লিখেছেন, সংসার আর চলছে না, একমণ চালের দাম চল্লিশ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, আমার পিতৃদেবের এক মাসের পুরো মাইনে। আমি পড়াশোনা ছেড়ে চাকরির সন্ধান করছি। এই সময় পিসিমার বাড়ির ঠিকানা এল একখানা চিঠি, লেখক মার্কাস ডি গ্রে। অনেক কষ্ট করে নাকি আমার ঠিকানা পেয়েছেন। জানতে চাইছেন আমি কী করছি, কী করতে চাই।
একটা দুর্বোধ্য সাঙ্কেতিক ঠিকানা ছিল চিঠিটার ওপরে, পরিষ্কার বুঝলাম সামরিক ঠিকানা। পরের দিনই জবাব দিলাম নিজের অবস্থা জানিয়ে। লিখলাম, স্টেটসম্যানের সম্পাদক মিস্টার ইয়ান স্টিফেন্স তো তোমার কেম্ব্রিজের সহপাঠী বন্ধু। টমোড়ি হোস্টেলে তোমার বাড়িতে কয়েকবার আসতে দেখেছি। তোমার পক্ষে কি সম্ভব তাকে লেখা, আমি বুক রিভিউ, ছোটখাটো রিপোর্ট বা প্রবন্ধ লিখে কিছু রোজগার করতে পারি? তাহলে আমার পড়াটাও হয়, বাবাকেও কিছু সাহায্য করা যায়।
দু-সপ্তাহের মধ্যে মার্কাস গ্রে’র জবাব এসে গিয়েছিল। লিখেছিলেন, “ইয়ান স্টিফেন্সকে আমি তোমার কথা লিখেছি, একদিন গিয়ে দেখা কর। যুদ্ধের চাপে কাগজের পৃষ্ঠা খুব কমে গেছে। কিছু করতে পারবে কিনা সেই তোমাকে বলবে।”
স্টেটসম্যানে আমার চাকরি জীবন শুরু, মার্কাস ডি. গ্রে’র দাক্ষিণ্য—সমৃদ্ধ বন্ধুত্বে। এ ঘটনার বিবরণ একটু পরে আসছে।
আমি তখন স্টেটসম্যানের কনিষ্ঠতম সাব-এডিটর। নিউজ রুমে বসে কাজ করছি উত্তীর্ণ অপরাহ্নে। এক পেয়াদা এসে একটি চিরকুট হাতে দিল। তাতে লেখা মার্কাস ডি.গ্রে। আমি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দেখতে পেলাম হলে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক গ্রে। পরিধানে খাঁকি পোশাক, দেহ অনেক শীর্ণ, আগের তুলনায় অনেক মজবুত।
আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “খুব খুশি হয়েছি তুমি এখানে কাজ পেয়েছ। স্টিফেন্স তো মনে হলো তোমার কাজকর্মে মোটামুটি সন্তুষ্ট। যদি সাংবাদিক হতে চাও তো শর্টহ্যান্ড, টাইপরাইটিং তোমাকে শিখতেই হবে। ইংরেজিটা শুনলাম তোমার এখনও বাঙালি বাঙালি। মাঝে মাঝে বানান ভুল কর। এগুলো সামলে নিও। ভবিষ্যতে তোমার ভালোই হবে।”
কথা আমার গলায় জড়িয়ে যাচ্ছিল, বললাম, “তোমার চিঠিতে এই বিরাট দুর্গের দ্বার খুলেছে আমার মতো একটি সাধারণ বাঙালি ছেলের জন্য। ধন্যবাদ দিয়ে তোমায় অপমান করব না। কিন্তু কখনো যা বলিনি আজ তা বলছি, কারণ জীবনে হয়তো তোমাকে আর দেখব না। তুমি আমার জীবনকে বাঁচবার মতো করে দিয়েছ। তোমার কাছ থেকে সততা, নির্ভরতা ও পরিষ্কারভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা পেয়েছি। চেষ্টা করব তোমার চিন্তা ও আদর্শকে সামনে রেখে চলতে।”
দেখলাম অধ্যাপক গ্রে ভীষণ বিব্রত হয়ে গেছেন। চট করে কথা পাল্টে বললেন, “মেজর ম্যাকেভেল কেমন আছেন?”
“তিনি তো যুদ্ধক্ষেত্রে। তাঁর খবর তো রাখবে তুমি!”
“যা বলছি তা শুনে অবাক হয়ো না। মেজর ম্যাকভেল যে কোম্পানির অধিনায়ক আমি তাতেই সার্জেন্ট। আমার দুটো প্রমোশন হয়েছে। মেজর ম্যাকভেলকে দেখামাত্র আমাকে স্যালুট করতে হয়। সাধারণ স্যালুট নয়, সামরিক স্যালুট।”
দু’পায়ের গোড়ালি সশব্দে একত্র করে স্যালুট দিয়ে দাঁড়ালেন মার্কাস গ্রে। আমরা দুজনে হেসে উঠলাম। জন ম্যাকভেল লন্ডন ইউনিভার্সিটির বি.এ.। ‘স্টেটম্যানে’ ভাগ্যক্রমে নিউজ এডিটর হতে পেরেছিলেন। মার্কাস গ্রে কেম্ব্রিজের ট্রাইপস। বিদ্যায় ব্যক্তিত্বে স্টেটসম্যানের এডিটরের সমকক্ষ।
আমি জানতে চাইলাম, “মিস্টার ম্যাকভেল তোমাকে কী বলে সম্বোধন করে?”
“মিস্টার ম্যাকভেল নয়, মেজর ম্যাকভেল। তার কাছে আমি সার্জেন্ট গ্রে।”
মার্কাস ডি. গ্রে’র সঙ্গে আমার এই শেষ দেখা। বহু বছর পরে ইংরেজ সরকার দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়ে ব্রিটেন ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়ে আমি অনুরোধ করেছিলাম মার্কাস ডি. গ্রে’র সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গিয়েছিল। সত্তর বছরের বৃদ্ধ মার্কাস গ্রে এডিনবরার তিরিশ মাইল দূরে একটি গ্রামীণ গির্জার পুরোহিত। তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি।