পিতা পুত্রকে – ২৩

তেইশ

স্কটিশ চার্চ কলেজে বিদ্যাচর্চার পরিবেশ সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে অভ্যর্থনা দেবার উপলক্ষে ছাত্রদের দীর্ঘকালীন ধর্মঘট প্ৰায় পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছিল! কলেজের কর্তৃপক্ষ শেষ পর্যন্ত একটা আধা সরকারি অভ্যর্থনার অনুমতি দিয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ থেকে যিনি উপস্থিত ছিলেন ও সংক্ষিপ্ত এক ভাষণ দিয়েছিলেন, তাঁর নাম মার্কাস ডি. গ্রে। স্কটল্যান্ডের লোক, কেম্ব্রিজের ট্রাইপস্ ও চার্চ অব স্কটল্যান্ডের পাদরি। চার্চ অব স্কটল্যান্ডের পাদরিদের বিবাহিত জীবন যাপন করার অনুমতি মিলত। অধ্যাপক তাঁর পত্নী মেরিকে নিয়ে টমোড়ি হোস্টেলে তিনখানা ঘরের একখানা স্যুইটে বাস করতেন। টমোড়ি হোস্টেল বাদুরবাগান স্ট্রিটের একটি পল্লির মধ্যে অবস্থিত। পঞ্চাশটি ছাত্রের নিবাস, তাদের উপদ্রবে পল্লিতে কিছু কিছু পরিবারের মধ্যে অসন্তোষ লেগেই থাকত। অ্যাসিস্টেন্ট সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন বনবিহারী ঘোষ— তাঁকে এ সব উপদ্রব মেটাতে হতো। এই সুবাদে পল্লির অনেক পরিবারে তাঁর যাতায়াত ছিল। আমার মনে আছে বনবিহারীবাবু, একদিন অধ্যাপক গ্রে সাহেবের কাছে নালিশ করেছিলেন, হোস্টেলের ছেলেরা রাত্রিবেলায় একটি ঘরে মিলিত হয়ে এক পরিবারের সদ্যবিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর কার্যকৃতি অবলোকন করে। অধ্যাপক গ্রে’র অফিসে আমিও উপস্থিত ছিলাম। গ্রে জবাব দিয়েছিলেন, বনবিহারী, ছেলেদের সঙ্গে আমি কথা বলব। কিন্তু পঞ্চাশটি যুবক একসঙ্গে বাস করে পাড়ার মেয়েদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ও নিস্কৌতূহল থাকবে, তুমি এটা সম্ভব বলে মনে কর? এদেশের ছাত্ররা তো অত্যন্ত সভ্য। আমাদের দেশ হলে অনেক কিছু ঘটত এবং তা নিয়ে পিতামাতারা হোস্টেলের কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করতেন না।

কলেজে পড়াশুনার তেমন পরিবেশ না থাকলেও জীবনের গতিতে কিছুটা তরঙ্গ ছিল এবং সারা কলেজেই একটা জীবন্ত ভাব দেখা যেত। অধ্যাপকদের মধ্যে বিখ্যাত বলা যায় এমন খুব কমই ছিলেন। সাহেব অধ্যাপকদের মধ্যে একমাত্র ময়োআট সাহেবের নাম ছিল। ইনি সেক্সপিয়র পড়াতেন। গ্রে পড়াতেন বার্নাডশ’র ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’। ক্লাসে একক কণ্ঠে নাটকীয় পদ্ধতিতে বইটি পড়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। অধ্যাপক সুশীল মুখার্জী, যিনি সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন, ছিলেন ছাত্রদের কাছে সব থেকে জনপ্রিয়। আর ছিলেন এক মেমসাহেব অধ্যাপক, মিস রুবি, যিনি ক্লাসে আসার সঙ্গে সঙ্গে হল্লা পড়ে যেত। বাংলা ভাষায় অনেক সময় অশ্লীল কথা বলে যেত ছাত্ররা, ধরে নিত মিস রুবি তার এক বর্ণও বুঝতে পারেন না। উদাহরণ মনে পড়ছে : হঠাৎ দুটি ছাত্র চেঁচিয়ে উঠল, এরে দেখ দেখ সাদা পা দেখা যাচ্ছে, আর কয়েকটি ছাত্র হৈ হৈ করত। মিস রুবি নির্বিবাদে ইংরেজি পদ্য পড়িয়ে যেতেন। একদিন অন্য এক সুবাদে তিনি পরিষ্কার বাংলা ভাষায় এক ছাত্রকে বললেন, “আপনারা এত গোলমাল করলে আমি পড়াই কী করে?” সমস্ত ক্লাসে লজ্জিত শঙ্কিত নীরবতা নেমে এল। সব ছাত্র অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে রইল। মিস রুবিকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্যের সেদিনই সমাপ্তি।

বেশিরভাগ অধ্যাপককেই ছাত্ররা পড়াতে দিত না। দক্ষিণ ভারতের ম্যাকেসন সাহেব নাকী-সুরে ইকনমিক্স পড়াতেন। তাঁর একটানা নিরাকর্ষক নির্জীব বক্তৃতা ও ছাত্রদের অবিরাম কোলাহল মিলেমিশে যে আবহাওয়া তৈরি করত তাকে অধ্যয়নিক বলঅ যায় না। পলিটিক্স পড়াতেন অধ্যাপক নির্মল বসু। তাঁর ক্লাসে বিশেষ গোলমাল হতে পারত না। কিন্তু যে ক্লাসে এতটুকুও গোলমাল হতো না এবং ছাত্ররা গভীর মনোযোগে অধ্যাপকের বক্তৃতা শুনতেন, সামান্য অভদ্রতা দেখালে তৎক্ষণাৎ ক্লাসরুম থেকে বহিষ্কৃত হতে হতো— তাঁর নাম সুধাংশু দাশগুপ্ত। ইনি বাংলা পড়াতেন। আমার পক্ষে এঁর স্মৃতি আরও সুখকর এইজন্য যে প্রতি মাসে ক্লাস পরীক্ষায় লিখিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে আমার লেখা প্রবন্ধ প্রায়ই তিনি সারা ক্লাসকে পাঠ করে শোনাতেন। ঠিক উল্টো ছিলেন বাংলার আর এক অধ্যাপক বিপিনবাবু। পাঠ্যপুস্তক যেমন ‘দেবী চৌধুরাণী’ অথবা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’, তিনি প্রথম থেকে শেষ অক্ষর পর্যন্ত মুখস্থ বলে যেতেন। আমার উপরে একবার বিপিনবাবু ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ছাত্রদের ‘দেবী চৌধুরানী’ সম্বন্ধে একটি ছোট সমালোচনা লিখতে বলেছিলেন। আমার সমালোচনায় একটা বড় অপরাধ হয়ে গিয়েছিল। ব্রজেশ্বরকে আমি ‘দুর্বল পুরুষ’ বলে সনাক্ত করেছিলাম। দেবী চৌধুরানির সুসজ্জিত বজরায় যখন ব্রজেশ্বর জানতে পারল যে তার সামনে দণ্ডায়মান ‘সামান্য বস্ত্র’ পরিহিতা, ‘হাতে কেবল একখানি মাত্ৰ অলঙ্কার’ নারী আর কেউ নয়, তারই স্ত্রী প্রফুল্ল, তখন সে কী করেছিল? ‘ব্রজেশ্বর দেখিতে পাইলেন প্রফুল্লর ‘দু-গাল বাহিয়া অশ্রু ঝরিতেছে, সেই অশ্রু মোছাতে গিয়ে, কিছু না বুঝিয়া— কেন জানি না দেবীর কাঁধে হাত রাখিল, অপর হাতে মুখখানি তুলিয়া ধরিল—বুঝি মুখখানা প্রফুল্লর মতো দেখিল। বিবশ বিহল হইয়া সেই অশ্রু নিষিক্ত বিম্বাধারে—আঃ ছিঃ ছিঃ! ব্রজেশ্বর! আবার! তখন ব্রজেশ্বরের মাথায় যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িল—কী করিলাম! এ কী প্রফুল্ল? সে যে দশ বছর মরিয়াছে। ব্রজেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিয়া একেবারে ছিপে গিয়ে উঠিল।” এই অংশটি উদ্ধৃত করে আমি লিখেছিলাম, “বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে ব্রজেশ্বর ঠিক পুরুষ হিসেবে তৈরি হয় নাই। সে তৈরি হয়েছে ভীরু বাঙালি জমিদার পুত্র হিসেবে। তার মধ্যে পৌরুষ—ব্যক্তিত্বের নিদারুণ অভাবে।”

বিপিনবাবু আমার আলোচনার এই অংশটি ক্লাসে পাঠ করে আমাকে ‘সংযমহীনতার’ অভিযোগ তিরস্কার করেছিলেন। সারা ক্লাস সহাস্যে সেই তিরস্কার উপভোগ করেছিল। ক্লাসে জনাদশেক মেয়ে ছিল, তাদেরও মুখে আঁচল দিয়ে হাসতে দেখেছিলাম। আমার মনে আছে আমি দাঁড়িয়ে উঠে বলেছিলাম, আপনার তিরস্কার মানছি কিন্তু বিতর্ক করতে চান তো তৈরি। সারা ক্লাসে আবার হাসির হল্লা পড়ে গিয়েছিল।

স্কটিশ চার্চ কলেজে কো-এডুকেশন। মানে হাজার দুই ছাত্র, শ’খানেক ছাত্রী। ছাত্রীরা অধ্যাপকের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসে ঢুকত। তাদের বসবার জন্য সামনের দুটি বেঞ্চি সংরক্ষিত ছিল। অধ্যাপক ক্লাস ত্যাগ করার আগেই ছাত্রীরা চলে যেত। ছাত্রীদের আলাদা কমনরুম ছিল। ছেলেদের চিরকুট নিয়ে কোনো পেয়াদা নির্দিষ্ট ছাত্রীর হাতে দিলে সে বেরিয়ে এসে কথা বলত। মেয়েদের আলাদা হোস্টেল ছিল। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে ডান্ডাস হোস্টেল। সেখানেও ছেলেরা মেয়েদের সঙ্গে চিরকুট পাঠিয়ে দেখা করতে পারত। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মেলামেশা বন্ধুত্ব ছিল না। তবু শোনা যেত কারও কারও মধ্যে প্ৰেম চলছে। কদাচিৎ কোনো যুগলকে হেদুয়ার পুকুর পাড়ে বেঞ্চিতে বসে গল্প করতে দেখা যেত। ছাত্রছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি একত্রিত হতো কলেজের কাছাকাছি বীডন স্ট্রিটের উপরে। একটা রেস্টুরেন্টে। স্কটিশ কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রেওয়াজ ছিল। পেশাদারি মঞ্চ ভাড়া করে ছাত্ররা অভিনয় করত। স্ত্রী ভূমিকায় ছাত্রীদের অভিনয় আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু সংগীত অনুষ্ঠানে ছাত্রীরা গান করত। তাদের মধ্যে একজন, শোভা সাহা অথবা কুণ্ডু, সেতারে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।

সময় স্মৃতিচোর হিসেবে বিখ্যাত। আজ পরিণত বয়সে অতীতের বন্ধুদের অনেকের নাম মনে নেই; তিন চারটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল, তাদের মধ্যে দুজনের নাম মনে আছে। একজন প্ৰতিভা চালিহা, আসামের খাসিয়া মেয়ে। সে শাড়ির সঙ্গে ভিন্ন রঙের একটি ওড়না গায়ে দিত। দেখতে ভারি সুন্দর লাগত। খাসিয়া মেয়ে বলেই প্রতিভা চালিহা ছিল সপ্রতিভ, বাংলা ভাষায় যাকে ন্যাকামি বলে, তাতে তার বিন্দুমাত্র দখল ছিল না। সুধা নামে আর একটি মেয়ে ছিল, যার সম্বন্ধে অনেক ছেলের যথেষ্ট উৎসাহ; আমারও যে ছিল না তা নয়, কিন্তু গ্রামীণ যুবকদের কাছে তাকে খুব দেমাগি মনে হতো। যার সঙ্গে আমার খানিকটা সহজ সম্পর্ক ছিল সে পরে বিখ্যাত অভিনেতা কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিবাহ করে।

দক্ষিণ কলকাতা অর্থাৎ বালীগঞ্জ সম্পর্কে উত্তর কলকাতার যুবকদের কৌতূহলের সীমা ছিল না। তারা নাকি রাস্তায় দাঁড়িয়েই ডাবের জল পান করে, ছেলেদের সঙ্গে লেকে বেড়াতে যায়, অভিনয়ে অংশগ্রহণ করে, এমনকি এগিয়ে এসে আলাপ পর্যন্ত করে। কিন্তু হায়, উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।

স্কটিশে পড়বার সময় আমার জীবনে যে পরিবর্তন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হলো মার্কসিস্ট রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ। আমাদের সহপাঠী ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তখনই তার প্রথম কবিতার বই বেরিয়ে গেছে ‘কমরেড, বিপ্লব আনবে না?’ এই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করে সুভাষ বিখ্যাত। আমি তখন কলেজের বইপত্র ছেড়ে দিয়ে ইতিহাস ও রাজনীতি শাস্ত্র পড়ছি। রাজনীতি শাস্ত্র মানে মার্কসিস্ট লিটারেচর। স্ট্রাচির “দি কামিং স্ট্রাগল ফর পাওয়ার’, মরিস হিন্ডাসের ‘মাদার রাশিয়া’, সিডনি ও বিয়েট্রিস ওয়েবের ‘দি সোভিয়েট ইউনিয়ন’, ‘এ নিউ সিভিলাইজেশন’, আমার নিত্য সঙ্গী। কমিউনিস্ট পার্টি তখন বেআইনি। অতএব তার সঙ্গে খানিকটা দূরস্থ সম্পর্কের একটা উত্তেজনক ষড়যন্ত্রের কিছুটা উত্তাপ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভালো ছাত্রদের’ ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন নেতারা। ‘দাদাদের’ অনুরোধ পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি স্কটিশ কলেজের ছাত্র ফেডারেশনের প্রাইমারি কমিটির প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হয়ে গেলাম। কলেজের সঙ্গে এই কমিটির কোনো অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ছিল না, অর্থাৎ প্রাইমারি কমিটি কলেজের স্বীকৃতি পায়নি। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যে মিটিং করতাম তাতে কিন্তু কর্তৃপক্ষ বাধা দিতেন না। পার্টির সঙ্গে আমার কখনো কোনো সাক্ষাৎ যোগাযোগ হয়নি। আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না, কিন্তু সমাজবিজ্ঞান ক্ষেত্রে মার্কাস-এনজেলস লেনিন আমার মন ও মস্তিষ্ক অনেকখানি দখল করে নিয়েছিলেন

পরবর্তী জীবনেও রাজনীতির বিচার বিশ্লেষণে আমি মার্কসিস্ট চিন্তাধারাকে সম্মান দিয়ে এসেছি। কোনো মানুষই আমার কাছে সর্বজ্ঞানী আইকন নন। কারও কাছে দণ্ডবতের অভ্যাস আমার নেই। সেজন্যে জীবনে আমি দীক্ষিত হইনি, গুরু গ্রহণ করিনি। সবটুকু দুর্বলতা ও বলিষ্ঠতা নিয়ে স্বাধীনভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার অধিকার গণতান্ত্রিক রাজ্যেল নাগরিক হিসেবে অতিশয় মূল্যবান। বিপ্লব কথাটার মধ্যে এখন একটা বুক কাঁপানো গা-শিরশির-করা রক্তের—প্রবাহ-বাড়িয়ে তোলা উত্তেজনা আছে, তা প্রতিটি বিপ্লবী মানুষ ও বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ব্যক্তি বিলক্ষণ জানেন। আমিও সে উত্তেজনার তাপ সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলাম। রজনীকান্তের রক্ত আমার ধমনীতে প্রবাহিত। ছাত্রদের প্রশাসনে যোগ দিতে উত্তেজনা বোধ করতাম। গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিতে ভালো লাগত। কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ ছাত্রদের বক্তৃতা শুনতাম মন দিয়ে। গোপন মিটিং হলে উত্তেহজনা আরও বাড়ত। প্রবোধ সান্ন্যাল, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, জলি কাউল, মোহন কুমারমঙ্গলম, ফারুকী—এঁরা ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় নেতা। পার্টির পত্রিকা গোপনে বিক্রি করা, দলিলপত্র গোপনে সামলানো ছিল উত্তেজক বিপ্লব আরাধনা। নিজেকে কমিউনিস্ট বলতে, রক্ত গরম হতে, সে উত্তাপ আমি উপভোগ করতাম। আমার কাছাকাছি হওয়ায় খুড়তুতো ভাই বাদলও ‘কমিউনিস্ট’ হয়ে গেল।

চল্লিশের দশক ভারতের পক্ষে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। চলছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। তার একের পর এক পৃথিবী কাঁপানো ঘটনা ভারতবাসীকে করেছে কম্পিত, বিস্মিত। একটা বিরাট তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে ইংরেজের সুদূর প্রাচ্য সাম্রাজ্য। একদিন মহা ঐতিহাসিক ভ্রমে হিটলার আক্রমণ করে বসেছে সোভিয়েট রাশিয়া, জানতে পারেনি তার ভাগ্য হবে নেপোলিয়নের মতো। কিন্তু প্রথম তিনটে বছরে অর্থাৎ ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত জার্মান নাৎসি বাহিনীর দাপটে সারা পশ্চিম ইউরোপ পরাজিত ও নতশির। এসব ঘটনা সময়ের দূরত্ব থেকে কিতাবে পড়তে এক রকম লাগে; ঘটনাবলির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ভারতবর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়নি, যেভাবে পড়েছিল সমগ্র ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকার অনেকখানি, শুধু প্রাচ্য থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ স্থলভূমি। ভারত শুধু যুদ্ধের রশদ যুগিয়ে এসেছে। ইংরেজ সাম্রাজ্যের সৈন্যরাও লড়েছে বিভিন্ন রণক্ষেত্রে এবং সাধারণ মানুষের মুখের অন্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছে মিত্রশক্তির ভরণপোষণের জন্য। কলকাতার যুদ্ধ অভিজ্ঞতা শেষোক্ত স্তরের অন্তর্গত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্রপক্ষের সামরিক প্রধান কেন্দ্র সিংহলে, এখন যাকে বলা হয় শ্রীলঙ্কা, প্রধান সেনাপতি অ্যাডমিরাল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন, ইংরেজ রাজ-পরিবারের রক্ত তাঁর দেহে। সারা উত্তর-পূর্ব ভারতের রশদ যুদ্ধের প্রয়োজনে এক রকম বন্ধক দেওয়া।

কলকাতায় জাপানি বিমান আক্রমণের আতঙ্কে সিভিল ডিফেন্সের নামে বড় বড় রাস্তার এখানে ওখানে বাফেল ওয়াল উঠেছে। পার্কে পার্কে মাটি খুঁড়ে ইট পেতে তৈরি হয়েছে ‘আত্মরক্ষা’র সেন্টার। বাফেল ওয়ালগুলো প্রকৃতপক্ষে বাফেল করেছে কলকাতার মানুষকে। সেন্টারগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে যারা দিনের পর দিন রাজপথ জনপথে জীবন কাটায়। এআরপি প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে সাইরেন বাজিয়ে কলকাতাবাসীকে সতর্ক করে; আদেশ দেওয়া হয়েছে রাত্রে ঘরের আলোগুলোকে কালো কাপড়ে ঢেকে রাখতে হবে, জানালায় লাগাতে হবে পর্দা এবং জানালার কাচে আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে তাদের করতে হবে মজবুত। রাস্তার আলোগুলো কালো পোশাকে অবগুণ্ঠিত, রাত্রিতে যানবাহন বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত। বাস-ট্রাম-মোটরগাড়ির আলো কালো রঙে অর্ধেক লুক্কায়িত। সব ব্যাপারটাই ইতিহাসের বিরাট নিষ্ঠুর অট্টহাসি, অথবা চাবুক মারা বিদ্রূপ। যারা সত্যিকারের যুদ্ধ এলাকায় বাস করছে তারা জানত এসব ‘রক্ষা’ ব্যবস্থা নিতান্ত হাস্যকর। কিন্তু ইংরেজ সরকারকে দেখাতে হয়েছে তারা ভারতবাসীকে পেটে মেরে দুর্ভিক্ষের কঙ্কাল করে দিতে পারে, কিন্তু তাদের ‘সংরক্ষণ’ বিষয়ে সম্রাটের মনোযোগের অভাব নেই।

সোভিয়েট রাশিয়া হিটলার কর্তৃক আক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর চোখে প্রায় তিন বছরের পুরোনো এক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হঠাৎ রাতারাতি গণযুদ্ধে পরিণত হলো। এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদী প্রশ্ন আমাদের মতো কমিউনিস্ট ছেলেমেয়েদের মনে একেবারই আসেনি। আমরা দাদাদের কাছ থেকে শুনে নিশ্চিত বিশ্বাস করে নিয়েছি যে বিশ্বব্যাপী গণযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয় প্রত্যেক প্রগতিশীল মানুষের অনিবার্য কর্তব্য, এ পরাজয় সাম্রাজ্যবাদকেও পিছু হটতে বাধ্য করবে। অন্যান্য উপনিবেশগুলোর সঙ্গে ভারতও পাবে মুক্তি। এই বিশ্বাসকে হাতিয়ার করে আমরা “বিপ্লবী” সংগ্রামে হাত দিয়েছি, আমাদের বিপ্লবী কাজ গোপনীয় পুঁথিপত্র লুকিয়ে রাখা, একস্থান থেকে অন্যস্থানে পাচার করা এবং সভাসমিতিতে বক্তৃতা করা।

বিশ্বযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে তার বেআইনি বন্ধন থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সে এখন একই সঙ্গে ইংরেজ শক্তির মিত্র ও শত্রু : তার প্রধান শত্রু জাতীয় কংগ্রেস ও সুভাষ বসুর আইএনএ। ১৯৪১ সালে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস আপস মিশন নিয়ে দিল্লিতে উপস্থিত। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের আমন্ত্রণে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতারা ক্রিপসের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত। আমরা বড় ক্ষুদে কমিউনিস্টরা এ জন্যে জাতীয়তাবাদী নেতাদের উপর ক্রুদ্ধ, কারণ তখনও হিটলার সোভিয়েট রাষ্ট্র আক্রমণ করেনি। এক বছর পরে মহাত্মা গান্ধী যখন ইংরেজকে ‘ভারত ছাড়’ হুঙ্কার দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ‘শেষ সংগ্রাম’ ঘোষণা করে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে কারাগারে সংরক্ষিত, তখন সাধারণ মানুষ এই ‘শেষ সংগ্রাম’কে বাস্তবে পরিণত করার জন্য ইট-পাটকেল, ছোরা, কিছু কিছু বন্দুক—অর্থাৎ যা কিছু ‘অস্ত্র’ তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব তা নিয়ে এখানে ওখানে সাম্রাজ্যবাদীদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ভারতবর্ষে চলছে এক বিরাট হাস্যকর সাম্রাজ্যবাদী লড়াই। কমিউনিস্ট নেতারা, আমাদের মতো তাদের শত শত নিঃসন্দেহ সমর্থকরা এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে তিরস্কার করছি, প্রগতি বিরোধী হিসেবে গালাগালি দিচ্ছি গান্ধী-নেহেরু-সুভাষ-প্যাটেল-মৌলানা আজাদকে। আমাদের দাদারা অনেকেই এ.আর.পি-তে যোগ দিয়েছেন। আমরা যেখানে পারি সভা করে বঙ্গবাসীকে “গণযুদ্ধে” সহায়তার আহ্বান করছি, বলছি, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংগ্ৰাম আপাতত স্থগিত রাখাই জনগণের মুক্তির পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়।

পরবর্তী জীবনে, সময়ের সদয় ব্যবধানে, ভারতবর্ষের সমগ্র জাতীয় রাজনীতি যুদ্ধের সময় ও পরে এক অতিশয় বিকট ও নকল অভিনয় ছাড়া আর যে কিছু নয় তা বোঝা অনেকের মতো আমার পক্ষেও সম্ভব ছিল। কমিউনিস্টদের পক্ষে এটুকু বলা যায় যে অক্ষশক্তিকে পরাস্ত করে মিত্রপক্ষের জয়ের পরে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ হয়ে পড়বে এত দুর্বল যে মার্কিন সাহায্য ছাড়া তার অস্তিত্ব সম্ভব হবে না, এই ঐতিহাসিক সত্য তারা বুঝতে পেরেছিল।

যুদ্ধ শেষ হবার পরেই ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা ইন্দোচিনে সাম্রাজ্য পুনঃস্থাপিত করতে গিয়ে অচিরে যুদ্ধের ভার আমেরিকার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলো। ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ্ সাম্রাজ্যবাদীরাও আমেরিকার সাহায্য নিয়ে লড়াকু জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হলো। সব সাম্রাজ্যবাদীদের অগ্রগামী ইংরেজ, তার বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যে একশো বছর সূর্যাস্ত হয়নি; রাজনৈতিক বিচার বুদ্ধিতেও সে সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তারও উপর ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস। তাছাড়া বিধাতার নিষ্ঠুর হাত সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রধান নেতা উইনস্টন চার্চিলের গর্ব উন্নত শিরে যুদ্ধ শেষ হবার ঠিক আগেই যে আঘাত করলেন তার জন্যেও ভারতবাসী প্রস্তুত ছিল না। পোটস্দাম শহরে মিত্রশক্তির ঐতিহাসিক বৈঠকের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচনে ব্রিটেনের জনসাধারণ চার্চিলকে বনবাসে পাঠিয়ে লেবার পার্টির হাতে শাসনভার তুলে দেয়। লেবার পার্টি শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু রেখে ভারত সাম্রাজ্য থেকে কী করে বিদায় নেওয়া যায় তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করে। এই জল্পনা কল্পনা থেকে এক ঐতিহাসিক ঘটনা স্রোত প্রবাহ পেল, যাকে ইংরেজি ভাষায় বলা হয় ডিকলোনাইজেশান, বাংলায় অনুবাদ করলে হবে : সাম্রাজ্য পরিত্যাগ। এই স্রোতের প্রবাহে প্রথম মুক্তি পেল বার্মা। তারপর শুরু হলো মানুষের সমগ্র ইতিহাসে সবচেয়ে বিশাল ও দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রস্থান পর্বের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার স্মৃতি আমার প্রজন্মের ভারতবাসীর মনে এখনও সজীব।

লর্ড ওয়াভেল বিদায় নিলেন। নতুন বড়লাট হয়ে এলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন, তাঁর লক্ষ্য, ভারতবাসীকে ‘স্বাধীনতা’ দেওয়া। অর্থাৎ যে পথে ইংরেজ এসেছিল নিজেদের অস্ত্র ও রাজনীতির দাপটে, সে পথেই তারা বিদায় নেবে মাথা উঁচু রেখে গর্বের সঙ্গে দুনিয়ার কাছে ঘোষণা করে—যে একদিন যেমন তারা সাম্রাজ্য ঘোষণা করেছিল অন্য দিন অন্য পৃথিবীতে অন্য জামানায় সাম্রাজ্য থেকে সসম্মানে প্রস্থান করার মতো সুবুদ্ধি ও মানসিকতা তাদের ছিল। আমরা ভারতবাসীরা একদিকে লেবার সরকার দ্বারা প্রেরিত ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে বিভিন্ন দলীয় ও বিভক্ত আলোচনায় যোগ দিলাম, মুসলিম লীগ পাকিস্তান পাওয়ার জন্য সারা দেশ জুড়ে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধিয়ে দিল, তার সবচেয়ে তীক্ষ্ণ আঘাত পড়ল কলকাতার বুকে। শেষ পর্যন্ত ভারত বিভক্ত হলো। সৃষ্টি হলো নতুন একটি দেশ। পাকিস্তান। সঙ্গে সঙ্গে দু’টুকরো হলো পাঞ্জাব ও বঙ্গ। আমি পূর্ববঙ্গের সন্তান। যে উপনিবেশ অপসরণ স্রোতের কথা একটু আগে বলেছি তার আশীর্বাদে ও অভিশাপে কোটি কোটি পূর্ব বঙ্গবাসীর মাতৃভূমি হয়ে গেল এক সদ্যজাত দুশমনি দেশের শিথিলতম অংশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *