দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৪

চোদ্দ

‘স্যাম, আমি এক্ষুণি মি. পার্কারের অফিসে যাব,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘সবার আগে ওখানেই যাওয়া উচিত ছিল, স্যার,’ বলল স্যাম।

‘যাব,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘কিন্তু তার আগে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি আর গরম পানির দরকার।’

কোথায় যেতে হবে জানা আছে স্যামের। মনিবকে নিয়ে একটা পানশালায় প্রবেশ করল ও। শীঘ্রিই ব্র্যান্ডি ও গরম পানি এসে গেল টেবিলে।

স্টেজ কোচোয়ানদের সংখ্যাধিক্য এখানে, মদ ও ধূমপান করছে তারা। এদের মাঝে একজন শক্তপোক্ত, লালমুখো লোককে পাইপে কষে ফুঁক দিতে দেখা গেল। প্রথমে স্যাম ওয়েলার ও পরে মি. পিকউইকের দিকে চাইল সে। শেষমেশ, পাইপ থেকে ধোঁয়ার ঘন মেঘ তৈরি করার পর, লোকটার মাথা ঢাকা প্রকাণ্ড শালটার নিচ থেকে একটি রুক্ষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ‘আরে, স্যামি না?’

‘লোকটা কে, স্যাম?’ জিজ্ঞেস করলেন মি. পিকউইক।

‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, স্যার,’ চোখ ছানাবড়া করে বলল স্যাম। ‘এ লোক বুড়ো হাবড়া!’

‘তা তো ‘দেখতেই পাচ্ছি,’ বললেন মি.. পিকউইক। ‘কিন্তু বুড়ো হাবড়াটা কে?’

‘আমার বাবা, স্যার,’ জবাব দিল স্যাম ওয়েলার, ‘কেমন আছ, আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ো?’

‘ওরে, স্যামি রে,’ বলল বাপজান, ‘প্রায় দু’বছর পর দেখা।’

‘হ্যাঁ, তা সত্মা ভাল আছে তো?’

‘আর বলিস না, বাপ। তোর সত্মার মত ভাল বিধবা আর দুটি চোখে পড়েনি আমার- কী মিষ্টি ব্যবহারই না ছিল,’ বলল বুড়ো ওয়েলার। ‘কিন্তু এখন? ওরেব্বাপ, একদম বদলে গেছে। বিধবা হিসেবেই ভাল ছিল সে।’

‘তাই?’ স্যাম প্রশ্ন করল।

মাথা ঝাঁকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল বুড়ো। তবে আর বলছি কি? শোন্ বাপ, আমার দুরবস্থা তো দেখলি, সারাজীবন বিধবাদের একশো হাত দূরে থাকবি।’

স্যাম এবার মি. পিকউইকের পরিচয় দিল বাপের কাছে। ‘মাফ করবেন, স্যার,’ বলে হ্যাট খুলল মি. ওয়েলার। ‘স্যামি ঠিকমত কাজ-কাম করছে তো?’

‘চমৎকার,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘শুনে খুব খুশি হলাম, স্যার,’ বলল বুড়ো। ‘পড়াশোনা নিয়ে খুব জ্বালিয়েছে আমাকে, স্যার; তাই ছেলেবেলাতেই খুঁটে খাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এছাড়া বুদ্ধি খোলেও না ছেলেপিলেদের।

‘বেশ কঠিন সিদ্ধান্ত বলতে হয়,’ মৃদু হেসে বললেন মি. পিকউইক।

‘তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ,’ আরও বলল স্যাম। ‘প্রায়ই ঠক খেতে হয়েছে আমাকে।’ জব ট্রটার কিরকম ভেল্কি দেখিয়েছে ওকে সংক্ষেপে বাবাকে জানাল।

‘খুব দুঃখ লাগল মনে,’ সব শুনে বলল বাপ। ‘ছ্যা ছ্যা, আমার ছেলে হয়ে কিনা ওই লোকের কাছে তুই ঘোল খেলি? ওয়েলার পরিবার বোকা বনতে পারে কখনও ভাবতেই পারিনি, কখনও না।’ আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল বাপের কণ্ঠস্বর।

‘চালটা ধরতে পারিনি!’ কাঁচুমাচু মুখে বলল স্যাম।

‘চালটা ধরতে পারিনি!’ ভেংচে উঠল বাপ, দুম করে এক কিল মেরে বসল টেবিলে। ‘এমন ছেলেদেরও চিনি যারা তোর অর্ধেক কেন সিকিভাগও লেখাপড়া শেখেনি— এমনকি ছয় মাসও রাস্তায় ঘুমায়নি- তারাও লজ্জা পাবে তোর গাধামি দেখে!

‘এখন আর ওসব বলে লাভ কি,’ মুখ গোঁজ করে বলল স্যাম, ‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এবার আমার পালা, বুড়া মিঞা, একবার খালি বাগে পেয়ে নিই ওই ট্রটার ব্যাটাকে, কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে ছাড়ব।

‘দেখিস আবার ভুল করিস না যেন,’ জবাবে বলল বাপ, বংশের মুখে যে চুনকালি মাখিয়েছিস যত তাড়াতাড়ি পারিস মোছার ব্যবস্থা কর। যাই, কোচে মাল তোলা হলো কিনা দেখি।

মি. পিকউইকের কাছ থেকে সবিনয়ে বিদায় নিল ওয়েলার। একটু পরে উকিল মি. পার্কারের কাছে গেলেন মি. পিকউইক। ঠিক হলো, তিনি ডিংলি ডেলে বড়দিন উদযাপন করতে গেলে, তাঁর কেস দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করবেন মি. পার্কার।

ডিংলি ডেলে রওনা হওয়ার আগে আরেকটি কাজ সমাধা করতে হবে। মি. পিকউইক মিসেস বারডেলের বাসা থেকে নিজের জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে মনস্থ করেছেন। স্যামকে তিনি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বললেন, এর ফলে বকেয়া ভাড়া মিটানোও হবে আবার তাঁর প্রতি ভদ্রমহিলার সত্যিকার অনুভূতিও যাচাই করা যাবে।

নটা বাজে প্রায় এসময় গসওয়েল স্ট্রীটে পৌঁছল স্যাম। গোটা দুয়েক মোমবাতি জ্বলছে সামনের পার্লারে এবং জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একজোড়া লেডিস ক্যাপ। মিসেস বারডেল তারমানে একা নন। স্যামের টোকার জবাব দিল মহিলার ছেলে। সে মাকে গিয়ে জানাল মি. পিকউইক লোক পাঠিয়েছে।

মিসেস বারডেল তার দুই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, মিসেস ক্লাপিনস ও মিসেস স্যান্ডার্সের সঙ্গে তখন একান্ত ঘরোয়া সাপারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মিসেস ক্লাপিনস বেঁটে খাটো, সদাব্যস্ত গোছের মানুষ, এবং মিসেস স্যান্ডার্স হচ্ছেন স্থূলকায়া, ভারী মুখের অধিকারিণী। তিন মহিলাই হকচকিয়ে গেল, বুঝে উঠতে পারছে না মি. পিকউইকের লোকের সঙ্গে কথা বলবে কিনা। স্পষ্টতই খবরটা আনার জন্যে তাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল বুধো অর্থাৎ ছেলেটার ওপর, এত লোক থাকতে দরজা খুলে কেন স্যামকেই দেখতে পেল ও? কাজেই, মায়ের হাতে ধোলাই খেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগল ছেলেটা।

‘এই, চেঁচাবি না, শয়তান কোথাকার,’ শাসাল মিসেস বারডেল।

‘হ্যাঁ, তোমার মাকে আর জ্বালিয়ো না,’ বললেন মিসেস স্যান্ডার্স।

‘জানোই তো, টমি, এমনিতেই তোমার মায়ের মন কত খারাপ,’ বললেন মিসেস ক্লাপিনস।

‘এখন কি করব?’ শুধাল মিসেস বারডেল।

‘আমি বলি কি দেখা করো,’ বললেন মিসেস ক্লাপিনস। ‘কিন্তু অন্তত একজন সাক্ষী রেখো।

‘আমার মনে হয় দুজন সাক্ষী হলে আরও আইনসঙ্গত হয়,’ বললেন মিসেস স্যান্ডার্স, তিনিও কৌতূহলে ফেটে পড়ছেন।

স্যামকে ডাকা হলে সে তার আগমনের হেতু জানাল। ভাড়ার টাকা মেটানো হলে, মিসেস বারডেল কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে গেল, রশিদ লেখার জন্যে।

স্যাম ভাল করে জানে, চুপ করে থাকাই শ্রেয়, যা বলার মহিলারাই বলবেন। তাই নীরবে বসে রইল ও।

‘আহা বেচারী!’ বললেন মিসেস ক্লাপিনস।

‘ওর দুঃখ দেখে বুকটা ভেঙে যায়!’ মিসেস স্যান্ডার্স।

‘সারাক্ষণ বেজার মুখে বসে থাকে- শুধু বান্ধবীরা সান্ত্বনা দিতে এলে মনটা একটু হালকা হয়,’ চুলোর দিকে এক ঝলক দেখে নিলেন মিসেস ক্লাপিনস। মজাদার সাপার রান্না হচ্ছে। ‘খুব দুঃখজনক!’

‘লোচ্চা!’ বললেন মিসেস স্যান্ডার্স।

‘এই যে তুমি! কি কাজটা করল তোমার মনিব? তার তো টাকার অভাব নেই, বিয়েটা করলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত শুনি! লোকটা কেন বিয়ে করছে না ওকে?’ ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ল অসহায় স্যামের ওপর।

‘প্রশ্নটা তো সেখানেই,’ বলল স্যাম।

‘কিন্তু জবাব কই,’ চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস ক্লাপিনস। ‘তবে বাছাধন ছ’মাসের মধ্যেই টের পাবে অসহায় মহিলাদের জন্যেও দেশে আইন আছে, আদালত আছে।’

‘ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে; কোন সন্দেহ নেই!’ ভাবল স্যাম। মিসেস বারডেল এসময় রশিদ নিয়ে ফিরল।

ওয়াইন ঢেলে স্যামকে আপ্যায়ন করল সে এবং অনিবার্যভাবে সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গটি উঠল।

‘এভাবে সবার সামনে নিজেকে হাজির করা একটা লজ্জার ব্যাপার. মি. ওয়েলার, বলল মিসেস বারডেল। ‘কিন্তু এছাড়া কোন উপায়ও তো দেখছি না। মি. ডডসন আর মি. ফগ বলেছেন আমার হাতে যে সব প্রমাণ আছে তাতে সাফল্য নিশ্চিত।

‘বহু লোক যাবে কোর্টে, তাই না?’ বললেন মিসেস ক্লাপিনস।

‘সে আর বলতে!’ বললেন মিসেস স্যান্ডার্স।

‘আর কেসে জিততে না পারলে মি. ডডসন আর মি. ফগ বোধহয় পাগলই হয়ে যাবেন,’ যোগ করলেন মিসেস ক্লাপিনস, ‘ফটকা খেলার মতন নিয়েছেন যেহেতু ব্যাপারটাকে।’ (ডডসন ও ফগ মিসেস বারডেলকে কেসটা ঠুকে দিতে প্ররোচিত করেছে, যাতে তারা মি. পিকউইকের কাছ থেকে আদায় করা ক্ষতিপূরণের একটা অংশ হাত করতে পারে।)

‘তা তো বটেই!’ বললেন মিসেস স্যান্ডার্স

‘আচ্ছা,’ বলল স্যাম, গ্লাস নামিয়ে রেখে উঠে পড়ল। ‘চলি তাহলে। আপনি যাতে ন্যায্য বিচার পান সেই কামনাই করি।’

‘ধন্যবাদ, মি. ওয়েলার,’ কৃতজ্ঞচিত্তে বলল মিসেস বারডেল।

মহিলাদের কাছ থেকে বিদায় নিল স্যাম। জর্জ অ্যান্ড ভালচার ইনে ফিরে এল ও। মি. পিকউইক ওখানে উঠেছেন, তাঁকে খুলে জানাল ডডসন ও ফগের ষড়যন্ত্রের কথা।

পরদিন মি. পার্কারের সঙ্গে আলোচনায় সত্যতা নিশ্চিত হলো স্যামের বক্তব্যের। তো, মি. পিকউইক বড়দিন উদযাপনের জন্যে রওনা দেয়ার আগে জেনে গেলেন, বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে, কোর্ট অভ কমন প্লীজে, দু’তিন মাসের মধ্যে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে তাঁকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *