দ্য পিকউইক পেপার্স – ২২

বাইশ

পরদিন সকালে চোখ মেলতে, একটা কালো রঙের ছোট্ট ট্রাঙ্কের ওপর স্যামকে বসে থাকতে দেখলেন মি. পিকউইক। মি. স্ম্যাঙ্গলের মহিমান্বিত দেহটির দিকে কঠোর চোখে চেয়ে সে। মি. স্ম্যাঙ্গল আধো উদোম গায়ে বসে রয়েছে খাটে।

‘আমাকে আবার দেখলে চিনতে পারবে তো?’ ভ্রূ কুঁচকে জবাব চাইল মি. স্প্যাঙ্গল।

‘এ জন্মে আর ভুল হবে না,’ খোশমেজাজে বলল স্যাম। ‘ভদ্রলোকের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না, না?’

‘কেন জানব না,’ বলল স্যাম। ‘উনি আগে উঠুন দেখবেন ভদ্রলোকের সঙ্গে কত ভদ্র ব্যবহার করছি।’

পরোক্ষভাবে মি. স্ম্যাঙ্গলকে অভদ্র বলাতে রেগে গেল সে।

‘মিভিনস,’ বলল সে। ‘কে এ?’

‘আমিও তোমাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম,’ চাদরের নিচ থেকে আলসে চোখে চেয়ে বলল মিভিনস। ‘এখানে ওর কাজটা কি?’

কে জানে,’ বলল স্ম্যাঙ্গল।

‘তাহলে এক ঘুসিতে নিচতলায় পাঠিয়ে দাও ওকে, পড়ে থাকুক আমি গিয়ে লাথানো না পর্যন্ত।’

যুদ্ধের দামামা বেজে উঠছে দেখে দ্রুত হস্তক্ষেপ করলেন মি. পিকউইক।

‘স্যাম, দাও আমার কাপড় দাও,’ বললেন তিনি।

ট্রাঙ্ক খুলতে মি. স্ম্যাঙ্গলের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটল। ভেতরের জিনিসগুলো তাকে মি. পিকউইক ও স্যাম সম্পর্কে নতুন করে ভাববার অবকাশ দিল। মুহূর্তে উথলে উঠল তার ভক্তি-শ্রদ্ধা। ‘আমি কি কাজে আসতে পারি বলেন, স্যার।’ বলল স্ম্যাঙ্গল। ‘ধোপার কাছে কাপড়-টাপড় কিছু পাঠাবেন? আমার চেনা ধোপা আছে, হপ্তায় দু’বার করে আসে। বলেন তো আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতে পারি, স্যার। একজনের সুবিধা-অসুবিধা যদি আরেকজন না দেখে তবে আর মনুষ্যত্ব রইল কোথায়?’

কান পর্যন্ত হাসি উপহার দিয়ে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের হাত বাড়াল লোকটা।

নাস্তার পর মি. পিকউইক গেটে গেলেন ভবিষ্যৎ কামরার বিষয়ে আলাপ করতে। প্রথমটায় মনে হলো তাঁকে বুঝি আরও তিনজন বন্দীর সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করতে হবে। কিন্তু শেষমেশ হপ্তায় বিশ শিলিং কড়ারে ছোট্ট একটা নিজস্ব কামরার ব্যবস্থা করা গেল। আরেক বন্দীর টাকায় ঘাটতি পড়ায় ঘরটা ভাড়া দিতে রাজি হয়েছে সে। শীঘ্রিই কার্পেট, ছটা চেয়ার, টেবিল, বিছানা, চায়ের কেতলি, ও অন্যান্য ছোট-খাট জিনিসপত্রে ঘরটা সুসজ্জিত হয়ে উঠল, এসব বাবদ ভাড়া গুনতে হবে হপ্তায় সাতাশ শিলিং ছয় পেন্স করে।

‘আর কিছু চাই আপনার?’ শুধাল ওয়ার্ডার।

‘হ্যাঁ,’ বললেন মি. পিকউইক, এতক্ষণ গভীর চিন্তামগ্ন ছিলেন। ‘মানে ফুট- ফরমাশ খাটার মত লোক কি পাওয়া যাবে এখানে? যে আরকি বাইরে-টাইরে যেতে আসতে পারবে।

‘জ্বী, পাওয়া যাবে,’ বলল ওয়ার্ডার। ‘অভাবীদের এলাকায় এক লোকের সঙ্গে আছে বেচারা। পাঠাব?’

‘হ্যাঁ,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘না, থাক। অভাবীদের এলাকা বললেন না? আমি একটু দেখতে চাই নিজের চোখে। আমি নিজেই যাব।’

ঋণখেলাপীদের কারাগারে অভাবীদের এলাকায় বাস করে সবচাইতে দুর্দশাগ্রস্তরা। ভাড়া টানতে হয় না এখানে বন্দীকে, ফলে পরিবেশও কহতব্য নয়। কিছু দানশীল ব্যক্তির দয়ায় এক মুঠো খাবার হয়তো জোটে তাদের। একটা সময় তো দ্য ফ্লীট কারাগারের বাইরের দেয়ালে একটা লোহার খাঁচা থাকত, বুভুক্ষু বন্দীরা ওখানে বসে পয়সার বাক্স ঝাঁকিয়ে ভিক্ষে চাইত পথচারীদের কাছে। দুঃস্থ বন্দীদের মাঝে বাটোয়ারা হত সে পয়সা, তারা পালা করে বসত খাঁচায়।

খাঁচা পরে বন্ধ করে দেয়া হলেও দুরবস্থা কাটেনি বন্দীদের। সহবন্দীরা সাহায্য না করলে প্রতি হপ্তায় বেশ কিছু বন্দী অনাহারে মারা পড়ত।

স্বচক্ষে বন্দীদের করুণ দশা লক্ষ করে মনে মনে ক্রমেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগলেন মি. পিকউইক। ওয়ার্ডার নির্দেশিত ঘরটিতে এমুহূর্তে প্রবেশ করেছেন তিনি। আগুনের পাশে বসে থাকা লোকটিকে দেখামাত্র মেঝেতে হ্যাট পড়ে গেল তাঁর, স্থাণু হয়ে গেলেন বিস্ময়ে।

হ্যাঁ, ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় পরনে লোকটার, চেহারা ছাপিয়ে নেমেছে চুলের জটা, অনাহারক্লিষ্ট মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে- এ আর কেউ নয় সেই এক ও অদ্বিতীয় মি. আলফ্রেড জিঙ্গল ওরফে মি. চার্লস ফিটজ-মার্শাল। পেছনে কার যেন দ্রুত পদশব্দ শুনে ঘুরে চাইলেন মি. পিকউইক। ধুরন্ধর জব ট্রটার।

‘মি. পিকউইক?’ চেঁচিয়ে উঠল জব।

‘এহ?’ বলে লাফিয়ে উঠল জিঙ্গল। মি—! তাই তো- বিচিত্র স্থান- অদ্ভুত কাণ্ড— আমার উপযুক্ত জায়গা- একদম।

মি. পিকউইক নরম চোখে জিঙ্গলকে জরিপ করে বললেন, কথা আছে তোমার সঙ্গে। একটু বাইরে আসবে?’

‘নিশ্চয়ই,’ বলল জিঙ্গল। মি. পিকউইককে জেলে দেখে থ হয়ে গেছে ও। ভদ্রলোকের কাছ থেকে জেনে নিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এখানে তাঁর আগমনের প্রেক্ষাপট।

‘কোট নিতে ভুলে গেছ,’ সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে কোটবিহীন জিঙ্গলকে বললেন মি. পিকউইক।

‘এহ?’ বলল জিঙ্গল। ‘দিয়ে দিয়েছি— ঘনিষ্ঠ আত্মীয়- টম চাচা – উপায় ছিল না- খেতে তো হবে, তাই না?’

[টম চাচা: একজন বন্ধকী কারবারী। জিঙ্গল তার কাছে কোট বন্ধক রেখেছে। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা ইংল্যান্ডে ‘চাচা’ বলে পরিচিত কয়েক শতাব্দী ধরে।]

‘মানে?’

‘গেছে, স্যার- শেষ কোট— রাখা গেল না। একজোড়া বুট— দুই হপ্তা চলেছি। সিল্কের ছাতা- হাতির দাঁতের হাতল- এক হপ্তা খেলাম ওটা ভেঙে- মিথ্যে বলছি না- জবকে জিজ্ঞেস করুন- সব জানে।’

‘তিন হপ্তা কাটিয়েছ একজোড়া বুট আর হাতির দাঁতের হাতলওয়ালা সিল্কের ছাতা খেয়ে?’ মি. পিকউইক তো রীতিমত তাজ্জব, এ ধরনের কথা একমাত্র কোন জাহাজডুবির পরই শুনেছেন তিনি।

‘সত্যি,’ বলল জিঙ্গল। ‘বন্ধকীর দোকান- অল্প টাকা- শয়তানের হাড়।

‘ও, তাই বলো, জিনিসপত্র বন্ধক রেখেছ!’

‘সব- জবেরও— সব শার্ট গেছে- যাকগে— ধোয়ার পয়সাটা তো বাঁচছে। এখন শুধু— শুয়ে থাকা- অনাহার- মৃত্যু- সব খতম- যবনিকাপাত।’

জীবনের লক্ষ্য নানারকম হাসির মুখভঙ্গি করে বর্ণনার চেষ্টা করল জিঙ্গল, কিন্তু বাস্তবে মি. পিকউইক ওর চোখ পানিতে ভিজে উঠতে লক্ষ করলেন।

‘আপনি ভালমানুষ, স্যার,’ বলে তাঁর হাত চেপে ধরল জিঙ্গল। ‘কান্নাকাটি ছেলেমানুষী ব্যাপার- কিন্তু মন যে মানে না- খারাপ জ্বর- দুর্বল- অসুস্থ- খিদা উচিত সাজা- কিন্তু বড্ড ভুগছি, ভাই- ভীষণ।’ এবার আর মুখে হাসি ফুটাতে ব্যর্থ হলো জিঙ্গল, সিঁড়িতে বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢাকল; তারপর বাচ্চা ছেলের মত কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

ওর কাঁধে হাত রাখলেন মি: পিকউইক। ‘কেঁদো না, জিঙ্গল, আমি তো আছি। সব জেনেশুনে আমি কি চুপ করে থাকতে পারি? এই, জব! কোথায় তুমি?’

‘এই যে, স্যার।’ কানের কাছে চিৎকার করে উঠল জব।

‘এদিকে এসো।’ বললেন মি. পিকউইক, মুখের চেহারায় কঠোরতা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করলেন। ‘এটা রাখো।’

কি রাখবে? মি. পিকউইকের পকেটে পয়সার মতন কিসের শব্দ যেন শোনা গেল, এবার সেগুলো চলে গেল জবের তালুতে।

মি. পিকউইক ঘরে ফিরে দেখেন স্যামও ফিরে এসে আসবাবপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে।

‘কি হে, স্যাম,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘তোফা আয়োজন, কি বলো?’

‘সত্যি, স্যার,’ বলে চারদিকে সমালোচনার ভঙ্গিতে দৃষ্টি বুলাল ও।

একটুক্ষণ ইতস্তত করলেন মি. পিকউইক। ‘কিছু কথা আছে, স্যাম।’

‘বলে ফেলুন, স্যার।’ উদ্‌গ্রীব স্যাম বলল।

‘প্রথম থেকেই অনুভব করছি,’ বলছেন মি. পিকউইক, কণ্ঠস্বর থমথমে। ‘ছেলে-ছোকরাদের জন্যে এ জায়গা নয়।’

‘বুড়োমানুষদের জন্যেও নয়, স্যার।’

‘ঠিকই বলেছ, স্যাম,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘কিন্তু বুড়োরা এখানে হয়তো নিজেদের অসাবধানতার কারণে আসে আর তরুণরা আসে তাদের মনিবদের স্বার্থপরতায়। তাই তরুণদের এখানে বেশি থাকা উচিত না। কি বলছি বুঝতে পারছ তো, স্যাম?’

‘জ্বী, স্যার। কিন্তু, স্যার, যদি কিছু মনে না করেন তো বলব, আপনার সঙ্গে আমি একমত না।’

‘তারমানে তুমি ঠিকই বুঝতে পেরেছ,’ বললেন মি. পিকউইক। কিন্তু আমি চাই না তুমি এমন একটা বাজে জায়গায় বছরের পর বছর ধরে আসা-যাওয়া করো। আমার সঙ্গে থেকে কেন কষ্ট করবে তুমি? তোমাকে আপাতত চলে যেতে হবে, স্যাম।’

‘আপাতত, স্যার?’ আশান্বিত স্যাম বলে উঠল।

‘হ্যাঁ, আমি যতদিন এখানে থাকছি আরকি। তোমার বেতন ঠিকই পেতে থাকবে- আর এখান থেকে কখনও যদি বেরোই,’ আরও বললেন মি. পিকউইক, ‘তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে আনিয়ে নেব।’

‘এবার আমার কিছু কথা শুনুন, স্যার,’ বলল স্যাম। ‘আপনি যা বললেন তা মোটেই সম্ভব না। কাজেই এ ব্যাপারে আমরা আর সময় নষ্ট করব না, ঠিক আছে, স্যার?’

‘আমি মনস্থির করে ফেলেছি,’ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন মি. পিকউইক।

‘সত্যি, স্যার?’ জানতে চাইল স্যাম। ‘ঠিক আছে, তাহলে জেনে রাখুন আমিও মনস্থির করে ফেলেছি।’

সযত্নে মাথায় হ্যাটটা চড়াল স্যাম, তারপর গটগট করে ঘর ত্যাগ করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *