দ্য পিকউইক পেপার্স – ৯

নয়

গসওয়েল স্ট্রীটে মি. পিকউইকের ঘরগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক এবং অবশ্যই তাঁর মত মহান ব্যক্তিত্বের জন্যে মানানসই। তাঁর ল্যান্ডলেডি, মিসেস বারডেল, জনৈক কাস্টমস অফিসারের বিধবা স্ত্রী- সুন্দরী মহিলা, কর্মঠ, অমায়িক ও সর্বোপরি অসাধারণ রাঁধুনি। বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দা বলতে একটি ভাড়াটে পরিবার ও মিসেস বারডেলের শিশুপুত্র।

ডিংলি ডেল থেকে ফেরার ক’দিন বাদে, মি. পিকউইককে একদিন তাঁর সিটিংক্রমে, স্বভাববিরুদ্ধ অস্থিরতায় পায়চারি করতে দেখা গেল। প্রতি তিন মিনিট অন্তর ভদ্রলোক ঘড়ি দেখছেন এবং জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিচ্ছেন বাইরে।

‘মিসেস বারডেল,’ শেষমেশ বললেন ভদ্রলোক, মহিলা তখন তাঁর ঘরের ধুলো ঝাড়ছে। ‘আপনার ছেলে এত দেরি করছে কেন?’

‘ওয়াইট হার্ট কম দূর তো নয়,’ বলল মিসেস বারডেল।

‘তা তো সত্যি কথাই, চুপ মেরে গেলেন মি. পিকউইক আবার। ‘মিসেস বারডেল,’ ক্ষণিক বিরতির পর বললেন, ‘আপনার কি ধারণা, একজনের জায়গায় দু’জনের সংসার হলে খরচ অনেক বেশি বেড়ে যায়?’

‘ওহ, মি. পিকউইক,’ গাল লাল হয়ে উঠল মহিলার, ‘কী দারুণ একটা কথা জিজ্ঞেস করলেন!’

‘কি মনে করেন আপনি?’

‘সেটা নির্ভর করে মানুষটার ওপর,’ বলল মহিলা, ‘সে যদি সঞ্চয়ী হয়, সংসারী হয় তবে বেশি বাড়তে দেবে কেন?’

‘খাঁটি সত্যি কথা,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আর আমি যার কথা ভাবছি তার মধ্যে এসব গুণ আছে; তার ওপর দুনিয়াদারি সম্পর্কে জ্ঞানগম্যিও আছে। আমার খুবই কাজে আসবে সেটা।’

‘ওহ, মি. পিকউইক,’ মিসেস বারডেল যেন লাজুকলতাটি।

‘সত্যি বলতে কি, মিসেস বারডেল,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আমি মনস্থির করে ফেলেছি।’

‘সত্যি বলছেন!’ চাপা চিৎকার মিসেস বারডেলের তরফ থেকে।

‘আপনার কাছে হয়তো অদ্ভুত লাগতে পারে,’ সরলমনা মি. পিকউইক বললেন, ‘আমি কোনদিন এ ব্যাপারে কিছু বলিনি কেন- আর আপনার ছেলেটাকে বাইরে পাঠানোর পরই বা কেন বললাম, তাই না?’

চোখের ভাষায় জবাব দিল মহিলা। দূর থেকে পূজা করে এসেছে সে এতদিন মি. পিকউইককে; আর এখন কিনা সহসা আকাশের চাঁদ নিজেই ধরা দিল তার হাতে। মি. পিকউইক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে যাচ্ছেন- সেজন্যেই ছেলেটাকে বাইরে পাঠিয়েছেন কথাটা পাড়ার জন্যে- কী বিবেচনাবোধ- কত বুদ্ধি!

‘কেমন মনে করেন,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আপনার ঝামেলা অনেক কমে যাবে।’

‘আপনার সুখের জন্যে কোন ঝামেলাই আমার কাছে ঝামেলা না, মি. পিকউইক,’ বলল মিসেস বারডেল। ‘আপনি আমার একাকীত্বের কথা ভেবেছেন, আমি কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব-’

‘একখানে থাকি, কেন ভাবব না,’ বললেন মি.. পিকউইক। ‘আমি শহরে গেলে একজন তো কাছে থাকবে আপনার!’

‘আমি বোধহয় খুব সুখী হব,’ গদগদ কণ্ঠে বলল মহিলা।

‘আপনার বাচ্চাটারও একটা সঙ্গী হবে,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘ওগো আমার প্রাণপ্রিয়!’ বলে উঠল মিসেস বারডেল। আর লাফিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘তুমি এত ভাল!’ ভদ্রলোকের গলা জড়িয়ে ধরল মিসেস বারডেল।

‘হায় খোদা!’ হতভম্ব মি. পিকউইকের বিস্মিত উচ্চারণ। ‘মিসেস বারডেল- একি- কি করছেন কি, মিসেস বারডেল, ছেড়ে দিন আমাকে- কে না কে এসে পড়ে!’

‘আসুকগে!’ বুনো কণ্ঠে বলল মহিলা। ‘আর কোনদিন তোমাকে ছাড়ছি না- কোনদিন না!’ আরও শক্ত করে ঝুলে পড়ল সে- তারপর আচমকা আবেগে জ্ঞান হারাল- ঠিক এসময় তার ছেলে মি. টাপম্যান, মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কলকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

আজব এই দৃশ্য দেখে পিকউইক ক্লাবের সভ্যরা এমনই হতবিহ্বল- এবং মি. পিকউইকের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা- যে চিরকাল হয়তো তাঁরা তেমনই দাঁড়িয়ে থাকতেন, যদি না বারডেলের ছেলেটা এক লাফে আগে বেড়ে, মি. পিকউইকের পায়ে ও নিতম্বে হিংস্র আক্রোশে লাথি মারতে শুরু করত।

‘এই খুদে শয়তানটাকে শিগগির সরাও,’ বেদনার্ত মি. পিকউইক আকুল আবেদন জানালেন। ‘ওর মাথায় ভূত চেপেছে।’

‘ব্যাপারটা কি?’ তিন বন্ধু থই পাচ্ছেন না।

‘জানি না,’ কাতর কণ্ঠে বললেন মি. পিকউইক। ‘আগে ছোঁড়াটাকে সরাও। আর একটু হাত লাগাও, মহিলাকে নিচে নিয়ে যেতে হবে।’

‘না, না ঠিক আছে,’ আবছা স্বরে বলল মিসেস বারডেল। কিন্তু তাকে নিচে নিয়ে গেলেন নারীপ্রেমিক মি. টাপম্যান। মহিলার ছেলেও গেল সঙ্গে।

‘কিছুই মাথায় আসছে না আমার,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘মহিলার হঠাৎ করে হলোটা কি! একটা ফুটম্যান রাখব বলেছি কি বলিনি ঢলে পড়ল আমার গায়ে। তাজ্জব কাণ্ড।

‘ভীষণ,’ তিন বন্ধু সমস্বরে বললেন

‘বারান্দায় এক লোককে দেখলাম,’ বললেন মি. টাপম্যান।

‘এর কথাই তো তোমাদের বলেছি,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘ওকে একটু ডেকে আনো না, স্নগ্রাস।

মি. স্যামুয়েল ওয়েলার একটু পরেই ঘরে এসে একটা চেয়ার দখল করল। বলাবাহুল্য, ইনিই সেই দ্য ওয়াইট হার্টের জুতো পরিষ্কারকারক। একে মি. পিকউইকের মনে ধরায় দেখা করতে বলেছিলেন।

‘আগে বলো, কথা পাড়লেন মি. পিকউইক, ‘যে কাজ এখন করছ তাতে তুমি অখুশি কিনা।

‘তার আগে,’ বলল স্যাম, ‘আমি জানতে চাই আপনারা আমাকে আরও ভাল সুযোগ দিচ্ছেন কিনা।’

‘আমি তোমাকে আমার সহকারী হিসেবে বহাল করব ঠিক করেছি,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘সত্যি?’

মাথা ঝাঁকালেন মি. পিকউইক

‘বেতন?’

‘বছরে বারো পাউন্ড,’ বললেন মি. পিকউইক

‘কাপড়-চোপড়?’

‘দুটো করে সুট।’

‘কাজ?’

‘আমার দেখাশোনা করা আর আমাদের চার বন্ধুর সঙ্গে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করা।

‘আমি রাজি,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল স্যাম। ‘মনিব যেহেতু অবিবাহিত কাজেই শর্তগুলো পছন্দ হয়েছে আমার।’

সেদিন সন্ধেতেই চুক্তি হয়ে গেল এবং স্যাম ওয়েলারকে রুপোর বোতামওয়ালা ধূসর কোট, পালক লাগানো কালো হ্যাট, গোলাপী একটা ডুরে ওয়েস্ট কোট, চোগা, লেগিং ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হলো।

মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুদের, পরদিন সকালে ইটানসউইলে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁদের খর্বাকৃতি উকিল বন্ধু, মি. পার্কার। যাত্রাকালে স্যাম ওয়েলার কোচের বাইরের দিকে, সগৌরবে আসন অলঙ্কৃত করল তাঁদের সঙ্গে।

‘ভাল,’ চড়ে বসে বলল ও। ‘বুঝতে পারছি সব ধরনের কাজই করতে হবে আমাকে। কোই পরোয়া নেহী। দেখার কাজই বেশি করার কাজ কম- এইই তো চাই। কাজেই, জয় পিকউইকবাহিনী!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *