বিশ
পরদিন প্রতিটি সম্ভবপর মুহূর্ত স্যাম মি. উইঙ্কলকে চোখে চোখে রাখল। এক পলকের জন্যেও মি. উইঙ্কলকে চোখের আড়াল হতে দিল না ও। কোন সন্দেহ নেই, মি. পিকউইক ত্বরিত তাদের চিঠির জবাব না দিলে, মি. উইঙ্কলকে সে হাত-পা বেঁধে বাথে নিয়ে যেত। সেদিন রাত আটটার দিকে মি. পিকউইক স্বয়ং দ্য বুশের কফিরূমে প্রবেশ করলেন। মি. ডাউলার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে।
‘নিজে আসাই ভাল মনে করলাম,’ বললেন মহান নেতা। ‘এই ব্যাপারে স্যামের জড়িয়ে পড়ার আগে আমার জানা দরকার সত্যিই তুমি ওই মেয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস কিনা?’
‘সিরিয়াস মানে! আমি কতখানি সিরিয়াস আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না!’ থরো থরো আবেগের সঙ্গে বললেন ভদ্রলোক।
বেন অ্যালেনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বিষয়টা খুলে বললেন নেতাকে। তাঁর এখন ইচ্ছা, মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে ভালবাসার কথা বলবেন। তিনি স্থির নিশ্চিত, ব্রিস্টলের কাছাকাছি কোন গ্রামে বন্দিনী অবস্থায় আছে সে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরদিন সকালে স্যাম মেয়েটির খোঁজ বের করার কাজে লাগল। খুবই শক্ত একটা কাজ। রাস্তায় রাস্তায় অনেক ঘুরল স্যাম, কিন্তু মেয়েটির হদিস দিতে পারে এমন কিছু বা কাউকে পেল না।
শেষ পর্যন্ত, দুরন্ত বাতাসের প্রতিকূলে মাঠ-ময়দান ঠেঙিয়ে এক জায়গায় এসে পৌঁছল সে। ছোট ছোট বেশ কিছু ছিমছাম বাসাবাড়ি রয়েছে এখানে। ক্লান্ত দেহটি এলিয়ে একটা পাথরে জিরিয়ে নিতে বসল ও, বাড়িগুলোর গেটের কাছে। ও বসে রয়েছে, এসময় একজন কাজের মেয়ে গেট খুলে, রাস্তায় এসে কার্পেট ঝাড়তে লাগল।
স্যাম নিজের চিন্তায় এতই মশগুল ছিল যুবতীর দিকে হয়তো দৃষ্টিক্ষেপই করত না। কিন্তু ভারী কার্পেটটা ঝাড়তে মেয়েটির কষ্ট লক্ষ করে তার পৌরুষ বোধ জেগে উঠল। পাথর ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে গেল ও।
‘আপনার অত সুন্দর কোমরটা নষ্ট হয়ে যাবে। দিন, আমার কাছে দিন,’ বলল।
যুবতী ঘুরে দাঁড়াল— আগন্তুকের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবে পত্রপাঠ। কিন্তু স্যামকে দেখে সে ক’কদম পিছে সরে তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার করে উঠল। স্যামও কম অবাক হয়নি। এই মেয়ে যে তার পূর্ব পরিচিতা!
‘আরে, মেরি যে!’ বলে উঠল ও।
‘হায় খোদা,’ বলল মেরি। ‘তুমি এখানে?’
‘তোমার জন্যে, তোমার খোঁজে,’ জানাল স্যাম, আবেগে ভেসে গেল মিথ্যেটুকু।
‘কিন্তু আমি এখানে জানলে কিভাবে?’
তাই তো, জানলাম কিভাবে?’ পাল্টা রহস্য করে বলল স্যাম।
‘নিশ্চয়ই রাঁধুনী বলেছে,’ বলল মেরি।
‘এই তো ধরে ফেলেছ,’ বলে হাঁফ ছাড়ল স্যাম। ‘আচ্ছা, মেরি, কাজের কথায় আসি। খুব একটা সমস্যায় পড়ে গেছি, বুঝলে? আমার মনিবের এক বন্ধু- মি. উইঙ্কল- তাঁকে মনে আছে তোমার?’
‘সবুজ কোট তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ।’
‘উনি প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন।’ এবার সবটা খুলে বলল স্যাম। ‘তাই ভাবলাম, তোমাকেও একনজর দেখে যাই, আবার ওই অ্যারাবেলা অ্যালেনের খোঁজটাও নিয়ে যাই, বুঝলে না?’ বলে শেষ করল স্যাম।
‘কি নাম বললে?’ হতচকিত মেরি শুধাল।
‘মিস অ্যারাবেলা অ্যালেন।’
‘হায় খোদা!’ পাশের বাসার বাগানটা আঙুলের ইশারায় দেখাল মেরি। উনি তো ওই বাসায় আছেন, মাস দেড়েক ধরে।’
‘ভাল,’ বলল স্যাম, ‘কপাল আর কাকে বলে! সারাদিন ঘুরে মরছি যার খোঁজে সে আছে তোমাদের পাশের বাসায়।’
‘কিন্তু বিকেল ছাড়া ওঁর সঙ্গে দেখা হবে না, বলল মেরি। ‘বিকেলে বাগানে হাঁটতে বেরোন। এছাড়া একা আর কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই।’
স্যাম ক’মুহূর্ত ভেবেচিন্তে একটা বুদ্ধি আঁটল। বিকেলে এখানে ফিরে আসবে ও। মেরি তার বাগানে ওকে ঢুকতে দেবে, ও নাশপাতি গাছটায় চড়ে দেয়ালের ওপারে খবর পৌঁছে দেবে অ্যারাবেলাকে; এবং বলে রাখবে মেয়েটির পক্ষে সম্ভব হলে কাল সন্ধেয় মি. উইঙ্কলকে নিয়ে এসে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করবে। মেরির সঙ্গে আলাপটুকু সেরে এবার কার্পেট ঝাড়াইয়ে হাত লাগাল স্যাম।
সেদিন বিকেলে পরিকল্পনা অনুযায়ী নাশপাতির ডালে চড়ে বসল স্যাম, অ্যারাবেলা তখন বাগানে পায়চারি করছে। মেয়েটি গাছের তলে আসতে না আসতেই বিদঘুটে শোরগোল পাকিয়ে তুলল স্যাম। ঝট করে মুখ তুলতে ওকে দেখতে পেল অ্যারাবেলা। ‘কে ওখানে?’ জিজ্ঞেস করল। ‘কি চাই?’
‘আস্তে,’ বলল স্যাম, ‘আমি, মিস, আমি।’
‘আরে, মি. স্যামের গলা না!’
‘ঠিক ধরেছেন, মিস,’ বলল স্যাম। ‘মি. উইঙ্কল আপনার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।’
‘হ্যাঁ?’ বলে দেয়ালের কাছে চলে এল মেয়েটি
‘হ্যাঁ, মিস,’ বলল স্যাম। ‘গত রাতে তো মনে হচ্ছিল বেঁধে রাখতে হবে। মাথা কুটে মরতে বাকি শুধু। বলছেন আগামীকাল রাতের মধ্যে আপনাকে দেখতে না পেলে নাকি নদীতে ডুবে মরবেন।’
‘ওহ, না, না, মি. স্যাম,’ বলে উঠল অ্যারাবেলা, হাত চেপে ধরেছে ওর।
‘উনি তো তাই বলছেন, মিস,’ জানাল স্যাম। আপনি বরং শিগিরি ওঁর সঙ্গে দেখা করুন।’
‘কিন্তু কিভাবে? কোথায়?’ শুধাল অ্যারাবেলা। ‘আমার তো বাড়ি ছেড়ে বেরনোর উপায় নেই। আমার ভাইটা যা কড়া!’
কিছুক্ষণ ধরে দেখা করতে ক্রমাগত অস্বীকৃতি জানিয়ে গেল অ্যারাবেলা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার যেন পায়ের শব্দ শুনে পরদিন সন্ধের জন্যে সায় দিতে বাধ্য হলো। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে তড়িঘড়ি সরে পড়ল মেয়েটি।
দেয়াল থেকে নেমে এল স্যাম, বলাবাহুল্য, মেরির সঙ্গে খানিকক্ষণ হৃদয়ের ভাষা বিনিময় করতে ভুল করল না; তারপর ফিরে গেল দ্য বুশে।
‘আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে,’ স্যামের কথা শুনে বললেন মি. পিকউইক। ‘আমাদের নিজেদের জন্যে নয়, ওই মেয়েটার কথা ভেবে। খুব হুঁশিয়ার থাকতে হবে আমাদের।
‘আমাদের?’ মি. উইঙ্কল হতভম্ব।
‘হ্যাঁ, আমি যাব তোমার সঙ্গে।’
তো, পরদিন সন্ধেয় মি. পিকউইক, প্রেমিকপ্রবর মি. উইঙ্কল ও স্যাম ওয়েলার কোচে চেপে অ্যারাবেলাদের গলিতে এসে হাজির হলেন। বাড়ি থেকে সিকি মাইল দূরে কোচ ছেড়ে পায়ে হেঁটে পথটুকু পাড়ি দিলেন তাঁরা। অন্ধকার রাস্তায় পথ দেখাচ্ছে মি. পিকউইকের লণ্ঠন।
খোলা গেট দিয়ে পা টিপে টিপে তিনজনে প্রবেশ করলেন বাগানে।
‘মিস অ্যালেন কি বাগানে এসেছে, মেরি?’ উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মি. উইঙ্কল।
‘বলতে পারব না,’ জানাল মেইডটি। ‘তবে আমার মনে হয়, মি. ওয়েলার আপনাকে যদি গাছে তুলে দেন আর মি. পিকউইক রাস্তায় চোখ রাখেন সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে। আরে, ওটা কি?
‘ওই লণ্ঠনটাই আমাদের খাবে,’ খেপে উঠল প্রায় স্যাম। ‘কি করছেন একটু ভেবে দেখুন, স্যার। পেছনের জানালায় আলোকসজ্জা তৈরি করছেন আপনি।’
‘ওহ হো! কাঁচুমাচু স্বরে বলে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘ভুল হয়ে গেছে।’
‘আলো এখন পাশের বাসাটায় পড়ছে, স্যার!’ প্রতিবাদ জানাল স্যাম।
‘অ্যাঁ,’ বলে ঘুরে গেলেন আবার মি. পিকউইক।
‘লোকে ভাববে এবার আস্তাবলে আগুন লেগেছে,’ বলল স্যাম। ‘ওটা নেভানো যায় না, স্যার? ওই যে, পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হয় মিস এসে গেছেন। যান, মি. উইঙ্কল, স্যার। উঠে পড়নগে!’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও,’ বলে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘আগে আমি কথা বলব। ওহে স্যাম, আমাকে একটু ধরো দেখি।
স্যাম দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে পিঠ পেতে দিল। ‘উঠে পড়ুন, স্যার।
‘তুমি যে ব্যথা পাবে হে,’ বললেন মি. পিকউইক।
‘কিছু হবে না, স্যার। ওঁকে একটু ধরুন, মি. উইঙ্কল। নড়বেন না, স্যার, নড়বেন না। হ্যাঁ, এই তো।’
মি. পিকউইক এমুহূর্তে স্যামের পিঠে চড়ে, দেয়ালের ওপারে চশমা গলাতে পেরেছেন।
‘মাই ডিয়ার,’ বললেন ভদ্রলোক, ওপাশে অ্যারাবেলাকে দেখে। ‘ভয় পেয়ো না। আমি, আমি।
‘ওহ, প্লীজ চলে যান, মি. পিকউইক,’ বলল মেয়েটি। ‘সবাইকে চলে যেতে বলুন। ভীষণ ভয় করছে আমার।’
‘ভয়ের কিছু নেই, আমরা তো আছি।’
‘আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি, স্যার।’ অ্যারাবেলা আরও কিছু বলতে যাবে কিন্তু স্যাঁত করে গায়েব হয়ে গেল মি. পিকউইকের মাথা, স্যামের কাঁধে তাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ধরণীতে পতন ঘটে গেছে মহাপুরুষটির। তখুনি অবশ্য উঠে
পড়লেন তিনি, মি. উইঙ্কলকে নির্দেশ দিলেন ছুটে গিয়ে গলিতে নজর রাখতে।
কিন্তু অত্যুৎসাহী মি. উইঙ্কল সে মুহূর্তে গাছ বেয়ে উঠে, অন্তরের গভীরতম
ভালবাসার কথা জানাতে ব্যস্ত অ্যারাবেলাকে।
হঠাৎ পায়ের আওয়াজ পেয়ে গলির দিকে ছুট দিলেন মি. পিকউইক, তাঁর পেছন পেছন মি. উইঙ্কল ও স্যাম। আর অ্যারাবেলা দৌড়ে গিয়ে ঘরে দোর দিল। বাগানের গেট আটকে, পাঁই পাঁই ছুটছে তিন অভিযাত্রী, এমনিসময় কাউকে অন্য একটি বাগানের গেট খুলতে শোনা গেল।
‘এক মিনিট,’ ফিসফিসিয়ে বলল স্যাম। ‘একটু আলো দেখান, স্যার।’
মি. পিকউইক আলো জ্বালতে দু’ফিটের মধ্যে এক লোকের মাথা উঁকি দিতে দেখল স্যাম। বাগানের গেটে মুণ্ডুটা ঠুকে দিয়ে, চোখের পলকে মি. পিকউইককে পিঠে তুলে নিল স্যাম; তারপর অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় মি. উইঙ্কলকে অনুসরণ করল।
মি. উইঙ্কলের নাগাল পেতে মনিবকে নামিয়ে দিল স্যাম। ‘আসুন, স্যার। আমাদের মাঝখানে চলে আসুন। আর অল্প একটু বাকি। মনে করুন, দৌড়ের মেডেল জিতছেন, স্যার। নিন, পা চালান।’
মি. পিকউইকের ভোঁ দৌড় দেখে বিস্ময়ে সঙ্গীদের মুখ হাঁ হয়ে গেল। কোচ অপেক্ষা করছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই দলটা ঝড়ের বেগে দ্য বুশে এসে হাজির হলো।
‘এখুনি ঘরে চলে যান, স্যার,’ মনিবকে নামতে সাহায্য করে বলল স্যাম। এমন ব্যায়ামের পর ঠাণ্ডায় বাইরে থাকা ঠিক না। কিছু মনে করবেন না, স্যার, মি. উইঙ্কল নামতে তাঁকে বলল, ‘সব ঠিকঠাক মত হয়েছে তো, স্যার?’
মি. উইঙ্কল স্যামের হাত চেপে ধরে কানে কানে বললেন, ‘বিলকুল, স্যাম, বিলকুল!’ এবার চোখ টিপে, খুশিমনে কোচের দরজা লাগিয়ে দিল স্যাম।