চার
পরদিনটা ছিল ঝকঝকে ও মনে ফুর্তি জাগানিয়া। মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা তোফা ব্রেকফাস্ট সাঁটিয়ে চিন্তা করতে বসলেন ডিংলি ডেলে তাঁরা যাবেন কিভাবে। কোচের ব্যবস্থা নেই। বড়জোর ছোট একটা ক্যারিজ পাওয়া যেতে পারে, তাতে জায়গা হবে তিনজনের, এবং চতুর্থ জনের ভাগে পড়বে একটা স্যাডলহর্স।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে হবেন চার নম্বর? আবার কে, মি. উইঙ্কল। পিকউইকবাহিনীতে তিনিই তো একমাত্র স্পোর্টসম্যান। ‘উইঙ্কল, তুমি যাবে নাকি ঘোড়ায় চেপে?’ জানতে চাইলেন মি. পিকউইক।
আসলে মনের গহীনে, অশ্বচালক হিসেবে নিজের দক্ষতা সম্বন্ধে রীতিমত সন্দিহান তিনি। কিন্তু কেউ যাতে সন্দেহ করতে না পারে তাই সোল্লাসে বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই! দারুণ মজা হবে!’ মি. উইঙ্কল ছুটে গিয়ে নিজের নিয়তিকে বরণ করে নিলেন। এখন ফেরার রাস্তা বন্ধ।
এগারোটা নাগাদ ক্যারিজ ও ঘোড়া হাজির হয়ে গেল। ক্যারিজে পেছনে বসতে পারবেন দু’জন আর একজনকে বসতে হবে চালকের আসনে। অতিকায় এক বাদামী রঙের ঘোড়া টানবে ওটাকে। পাশে আরেকটা প্রকাণ্ড ঘোড়ায় স্যাডল চাপানো, মি. উইঙ্কলের জন্যে।
ক্যারিজটা দেখে নিলেন মি. পিকউইক। ‘হায় খোদা!’ চেঁচিয়ে উঠলেন প্রায়। ‘এ তো ভাবতেই পারিনি! চালাবে কে?’
‘ওহ, তুমি ছাড়া আর কে,’ বললেন মি. টাপম্যান।
‘সে আর বলতে,’ সমর্থন জানালেন মি. স্নডগ্রাস।
‘আমি?’ আঁতকে উঠলেন মহান নেতা।
‘ভয়ের কিছু নেই, হুজুর,’ বলল হসলার। ‘ও এত লক্ষ্মী যে একটা দুধের বাচ্চাও ওকে চালাতে পারবে।’
কাজেই মি. টাপম্যান ও মি. স্নডগ্রাস ভেতরে ঢুকলেন আর মি. পিকউইক গিয়ে উঠলেন চালকের আসনে। লাগাম আর চাবুক তুলে দেয়া হলো তাঁর হাতে। ‘হোয়া!’ বিশালকায় ঘোড়াটা পেছনে, সরাইয়ের জানালামুখো হাঁটা দিতে চাইলে চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক।
‘এই একটু দুষ্টুমি করছে আরকি,’ বলল সহিস, লাগাম চেপে ধরেছে। সহকারীর হাতে ওগুলো গুঁজে দিয়ে মি. উইঙ্কলকে সাহায্য করতে ছুটল, তিনি উল্টো পাশ থেকে তখন ঘোড়ায় চাপছেন। ‘ওদিক দিয়ে না, হুজুর।’ স্যাডলে তো না যেন পাশ থেকে যুদ্ধজাহাজে চড়ার সমান বেগ পেতে হলো মি. উইঙ্কলকে।
‘ঠিক আছ তো?’ শুধালেন মি. পিকউইক, মন কিন্তু কু ডাক দিচ্ছে তাঁর।
‘আছি,’ আবছা শোনা গেল কি গেল না মি. উইঙ্কলের কণ্ঠ।
‘ওদের যেতে দিন,’ চেঁচিয়ে বলল সহিস- এবং সরাইখানার ভৃত্যদের খুশির সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে রওনা দিল ক্যারিজ ও স্যাডল-হর্স।
‘ওটা অমন বাঁকা হয়ে চলছে কেন?’ মি. স্নডগ্রাস ক্যারিজের নিরাপদ আশ্রয় থেকে জিজ্ঞেস করলেন মি. উইঙ্কলকে।
‘খোদা মালুম,’ জবাব দিলেন মি. উইঙ্কল। বিদঘুটেতম ভঙ্গিতে রাস্তা ধরে চলেছে তাঁর ঘোড়া- একপেশে হয়ে, মাথাটা, কাত হয়ে আছে রাস্তার একদিকে এবং লেজটা অন্যদিকে।
মি. পিকউইক ক্যারিজ চালনায় বুঁদ হয়ে আছেন বলে ঘটনাটা লক্ষ করার ফুরসত পেলেন না। ক্যারিজের ঘোড়া সামলাতে জানটা বেরিয়ে যাচ্ছে তাঁর। অদ্ভুত আচরণ জানোয়ারটার, রাস্তার কিনারে বলা নেই কওয়া নেই দৌড়ে যাচ্ছে, তারপর থমকে পড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ফের সামনে তেড়ে যাচ্ছে। মি. পিকউইক ও তাঁর সওয়ারীরা বড্ড মুসিবতের মধ্যে আছেন। এমনি বিটকেল ভঙ্গিতে বেশ কিছুক্ষণ ভ্রমণ করলেন তাঁরা।
‘হোয়া!’ আচমকা মি. পিকউইকের হুঙ্কার। ‘চাবুকটা পড়ে গেছে!’
‘উইঙ্কল,’ ডাকলেন মি. স্নডগ্রাস। বেচারা তখন হ্যাট দিয়ে কান ঢেকে, টগবগ করে ঘোড়া ছোটাচ্ছেন আর ঝাঁকুনির চোটে যেন ছত্রখান হওয়ার প্রহর গুনছেন। ‘চাবুকটা তুলে দাও না, প্লীজ।’
মুখে কালসিটে না পড়া তক লাগাম টেনে গেলেন মি. স্পোর্টসম্যান। শেষ অবধি থামতে পেরে নামলেন ঘোড়া থেকে, মি. পিকউইককে চাবুক হস্তান্তর করে ফের ঘোড়ায় চাপতে তৈরি হলেন। মস্ত ঘোড়াটা বোধহয় একটু মশকরা করতে চাইল তাঁর সঙ্গে; কিংবা হয়তো ভাবল এই পদের চালক ছাড়া একাই যাত্রা শেষ করতে পারবে সে। কারণ যা-ই হোক, মি. উইঙ্কল পিঠে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই যত দূরে সম্ভব সরে গেল ওটা।
‘বেচারা,’ বললেন মি. উইঙ্কল। ‘বেচারা বুড়ো ঘোড়া। কিন্তু এসব কথায় তুষ্ট হলো না ‘বেচারা বুড়ো ঘোড়া’। মি. উইঙ্কল এক পা এগোন তো ওটা দু’পা সরে যায়। পাক্কা দশটা মিনিট পরস্পরকে ঘিরে ঘুরপাক খেল অশ্ব ও তার আরোহী। খেলা শেষ হতে দেখা গেল অবস্থা যে কে সেই।
‘কি করব?’ চেঁচালেন মি. উইঙ্কল। ‘কি করা উচিত? চড়তে তো পারছি না।’
‘ওটাকে বরং টেনে নিয়ে চলো, তারপর দেখা যাবে কেউ সাহায্য করতে পারে কিনা,’ সমাধান দিলেন মি. পিকউইক।
‘কিন্তু ও তো নাগালের মধ্যে আসছে না,’ গর্জালেন মি. উইঙ্কল। ‘আপনি এসে ধরে দিন না।
মি. পিকউইক মানবতা ও দয়ার অবতার। নিজের ঘোড়াটার পিঠের ওপর লাগাম ছুঁড়ে মেরে, আসন থেকে নামলেন বন্ধুর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে। মি. স্নডগ্রাস ও মি. টাপম্যান রয়ে গেলেন ক্যারিজে
কিন্তু মি. পিকউইককে চাবুক হাতে এগিয়ে আসতে দেখে গোল বাধল, ঘুরপাক বন্ধ করে এবার পিছু হটতে শুরু করল মি. উইঙ্কলের ঘোড়া। মি. উইঙ্কল এবার লাগাম চেপে ধরে ওটার সঙ্গে সঙ্গে ছুট দিলেন। মি. পিকউইক এগিয়ে এলেন তাঁর সাহায্যে। কিন্তু তিনি যত জোরে ছোটেন ঘোড়া তত দ্রুত পিছে দৌড়ায়। অবশেষে মি. উইঙ্কল লাগাম দিলেন ছেড়ে। থেমে দাঁড়াল ঘোড়া, চাইল, মাথা ঝাঁকাল, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্তচিত্তে পা বাড়াল রচেস্টারের দিকে। মি. পিকউইক ও মি. উইঙ্কল হতাশ চোখে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পেছনে একটা ঘর্ঘর শব্দে ঘুরে দাঁড়াতে হলো তাঁদের।-
‘হায় খোদা!’ আর্তনাদ ছাড়লেন মি. পিকউইক। ‘ওটাও পালিয়ে যাচ্ছে যে!’
কথাটা খাঁটি সত্যি! ক্যারিজ টেনে ছুটে চলেছে ঘোড়াটা। সংক্ষিপ্ত দৌড়টা তেমন জমল না। মি. টাপম্যান ক্যারিজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঝোপে এবং মি. স্নডগ্রাস তাঁকে অনুসরণ করলেন। ঘোড়াটা একটা সেতুর সঙ্গে ধাক্কা খাইয়ে দফারফা করে ছাড়ল ক্যারিজটার, এবং থেমে দাঁড়িয়ে নিজের অপকর্ম অবলোকন করতে লাগল।
মি. পিকউইক ও মি. উইঙ্কল তাঁদের হতভাগ্য বন্ধুদের আগে উদ্ধার করলেন ঝোপ থেকে। কাপড় ছেঁড়া আর সামান্য কাটাকুটি ছাড়া গুরুতর কোন ক্ষতি হয়নি দেখে হাঁফ ছাড়লেন সবাই। এবার ঘোড়াটাকে সরঞ্জামমুক্ত করার পালা। একটু পরে ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে মন্থর গতিতে পা বাড়ালেন ওরা, পেছনে পড়ে রইল ভাঙা ক্যারিজ।
ঘণ্টা খানেক পর ছোট্ট একটা সরাইখানায় এসে পৌঁছলেন যাত্রীরা। লাল চুলো এক লোক ব্যস্ত ছিল বাগানে।
‘এই যে, শুনছেন!’ ডাকলেন মি. পিকউইক।
লোকটি মি. পিকউইক ও তাঁর বাহিনীর দিকে শীতল চোখে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল। ‘বলুন,’ কথা ফুটল শেষ পর্যন্ত।
‘ডিংলি ডেল কদ্দূর?’
‘সাত মাইলের কিছু বেশি।
‘রাস্তা ভাল?
‘না।’ নিজের কাজে লেগে পড়ল লোকটা আবার।
‘আমরা ঘোড়াটা এখানে রেখে যেতে চাই,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘আপনি কি বলেন?’
‘এই ঘোড়াটা রেখে যাবেন বলছেন?’ কঠোর চোখে জানোয়ারটাকে পরখ করে বলল লোকটা।
‘হ্যাঁ,’ বললেন মি. পিকউইক।
‘ম্যাগী!’ লালচুলো চেঁচাল। ‘ম্যাগী!’
দীর্ঘাঙ্গী, হাড্ডিসার এক মহিলা বেরিয়ে এল। তার কানে কানে কি যেন বলল লালচুলো।.
‘না,’ শেষতক বলল মহিলা। ‘আমার এসবে ভয় করে।’
‘ভয়!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘মহিলা ভয় পাচ্ছে কিসে?’
‘গতবার বিপদ হয়েছিল,’ বলে ঘুরে দাঁড়াল মহিলা। ‘আমি পারব না।’
‘আ-আমার মনে হচ্ছে,’ ফিসফিসিয়ে বললেন মি. উইঙ্কল, ‘ওদের ধারণা ঘোড়াটা আমরা চুরি করে এনেছি।
‘কি!’ রাগে ফেটে পড়েন আরকি মি. পিকউইক। ‘এই যে আপনারা, কি ভেবেছেনটা কি? আমাদের দেখে আপনাদের ঘোড়া চোর মনে হয়?’
‘তা নয়তো কি,’ মৃদু হেসে বলল লোকটা। বাড়ির ভেতর গিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।
‘স্বপ্ন দেখছি না তো,’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘দুঃস্বপ্ন! বিটকেল এক ঘোড়া নিয়ে দিনভর হেঁটে মরছি, খসাতে পারছি না!’ অসন্তুষ্ট পিকউইকবাহিনী প্রকাণ্ড ঘোড়াটাকে পেছনে নিয়ে ফিরে চলল, অবলা (!) জানোয়ারটার প্রতি অন্তরের অন্তস্তলে ঘৃণা তাঁদের।
ম্যানর ফার্মে শেষ বিকেল নাগাদ পৌঁছতে পারলেন চার বন্ধু ও তাঁদের ঘোড়া। কেমন হতশ্রী দেখাচ্ছে তাঁদের ভাবনাটা মাথায় আসলেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকের। ছেঁড়া কাপড়, মুখে আঁচড়ের দাগ, নোংরা জুতো এবং, সর্বোপরি ঘোড়া বাবাজী! ওহ, মি. পিকউইকের মত ভালমানুষও কী ভয়ঙ্কর অভিশাপটাই না দিয়ে চলেছেন নিরীহ ঘোড়াটাকে! শান্ত (!) প্রাণীটার দিকে ঘৃণা ও বিদ্বেষের চকিত চাহনি হানতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে বারবার। এটাকে নিকেশ করতে কিংবা দুনিয়ার বুকে ছেড়ে দিতে পারলে শান্তি পেতেন তিনি! রাস্তার বাঁকে দু’জন লোকের সঙ্গে সহসা দেখা হয়ে যাওয়াতে ছেদ পড়ল তাঁর ভয়ঙ্কর সব চিন্তা- ভাবনায়। মি.ওয়ার্ডল ও তাঁর বিশ্বস্ত ভৃত্য, সেই মোটা ছেলেটি দাঁড়িয়ে ছিল।
‘এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনারা?’ অতিথিপরায়ণ বৃদ্ধ ভদ্রলোক শুধালেন উদ্বেগের সুরে। ‘সারাদিন ধরে অপেক্ষা করে বসে আছি। আরে! কাটল কিভাবে? অ্যাক্সিডেন্ট? এসব রাস্তায় অবশ্য অ্যাক্সিডেন্ট হরহামেশা ঘটছে। জো— দেখো দেখি, আবার ঘুমিয়ে পড়েছে!- জো, ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে যাও তো।’
যাত্রীদের নিয়ে যাওয়া হলো কিচেনে; ব্র্যান্ডি, সূচ-সুতো, তোয়ালে আর পানি শীঘ্রিই তাঁদের উদ্দীপনা ও হাল ফিরিয়ে দিল। প্রাচীন কিচেনটা যেমনি বিশাল তেমনি চমৎকার, মেঝেটা লাল ইঁটের আর চিমনিটা ইয়া লম্বা। ছাদ থেকে ঝুলছে হ্যাম, বেকন আর পিঁয়াজের রশি। দেয়ালগুলো পুরানো স্যাডল আর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। বীভৎস ভ্রমণের পর পিকউইকবাহিনীর সদস্যরা সন্তুষ্টচিত্তে চারধারে নজর বুলোতে লাগলেন।
‘রেডি?’ অতিথিরা ধাতস্থ হলে পর জানতে চাইলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক।
সায় জানালেন মি. পিকউইক।
‘তাহলে ম্যানর ফার্মে আপনাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছি!’ বললেন নিমন্ত্রণকর্তা, পার্লারে গেলেন ওঁরা সবার সঙ্গে মিলিত হতে।