তেইশ
সরাইখানার ছোট্ট এক ঘরে, পরদিন সকালে কোচযাত্রার জন্যে তৈরি হচ্ছে স্যাম ওয়েলারের বাবা। তার সামনে টেবিলে এক পাত্র এল, ঠাণ্ডা গরুর মাংসের রোস্ট ও মস্ত একটা পাউরুটি বসে আছে। পাউরুটির বড়সড় একটা টুকরো কাটতে না কাটতে কে একজন প্রবেশ করল ঘরে। মাথা তুলতে স্যামকে দেখতে পেল সে।
‘কি রে, স্যামি, কেমন আছিস?’ শুধাল বাবা।
গুণধর পুত্র বিনাবাক্যব্যয়ে টেবিলের কাছে এসে, এলের পাত্রে লম্বা এক চুমুক মেরে প্রত্যুত্তর দিল।
‘বাহ, তোর শোষণ ক্ষমতা তো দারুণ রে,’ আধখালি পাত্রটা দেখে মন্তব্য, করল পিতা।
‘এবার চর্বণ ক্ষমতাটাও দেখে রাখো,’ বলে গরুর রোস্টের বেশিরভাগটা মুখে চালান করে দিল স্যাম। তারপর সংক্ষেপে মি. পিকউইকের সঙ্গে ওর কথোপকথনের ব্যাপারটা বাবাকে জানাল।
‘বেচারা একা একা থাকবে ওখানে!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল বাবা। ‘সাহায্য করার কেউ থাকবে না কাছে? এ হতে পারে না, স্যামুয়েল, এ হতে পারে না!’
‘তা তো পারেই না,’ বলল স্যাম। ‘কিন্তু ওঁর দেখাশোনা করা যায় কিভাবে কোন বুদ্ধি দিতে পারো?
‘মাথায় তো এ মুহূর্তে কিছুই আসছে না,’ চিন্তিত মুখে বলল ‘বাবা। ‘আর তোকে ওখানে থাকতে না দিলে আর কিভাবেই বা?’
‘আমি বাতলে দিচ্ছি,’ বলল স্যাম। ‘আমাকে পঁচিশটা পাউন্ড ধার দেবে?’
‘তাতে কি হলো?’
‘আগে শোনোই না,’ বলল স্যাম। ‘পাঁচ মিনিট পর টাকাটা ফেরত চেয়ো; আমি বলব দেব না। এখন বলো, তুমি নিষ্ঠুর বাপ কি নিজের ছেলেকে দ্য ফ্লীটে পাঠাবে?’
বুড়ো ওয়েলার পাথুরে সিঁড়ির একটা ধাপে বসে পড়ে, বেদম হাসিতে ফেটে পড়ল। আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই! মি. ওয়েলার সানন্দে আপন পুত্রকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে রাজি।
মি. ওয়েলারের এক অভিজ্ঞ বন্ধু সব বন্দোবস্ত করে দিল। পরিকল্পনামাফিক পঁচিশ পাউন্ড স্যাম ফেরত দিতে রাজি না হওয়ায় রিট জারী করা হলো তার বিরুদ্ধে। সেদিন বিকেলে মি. ওয়েলার ও তার বন্ধু-বান্ধবরা রীতিমত উৎসব করে, দ্য ফ্লীটের ওয়ার্ডেনের হাতে তুলে দিল স্যামকে।
স্যাম সিধে তার মনিবের ঘরে গিয়ে নক করল।
‘ভেতরে এসো,’ বললেন মি. পিকউইক।
স্যাম ঘরে প্রবেশ করে, হ্যাটু খুলে বিজয়ীর উদ্ভাসিত হাসি হাসল।
‘আহ, স্যাম, বাছা আমার,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘কাল তোমাকে আমি মনে আঘাত দিতে চাইনি। বসো, আমি ব্যাপারটা তোমাকে বুঝিয়ে বলি।’
‘পরে বুঝালে হয় না, স্যার?’
‘কেন হবে না,’ বলে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘কিন্তু এখন অসুবিধাটা কিসের?’
‘অসুবিধা তেমন কিছু না, স্যার,’ বলল স্যাম মুচকি হেসে, ‘কিন্তু আমি আগে শোয়ার ব্যবস্থাটা করতে চাইছিলাম।
‘মানে!’ মি. পিকউইক হতভম্ব।
‘আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, স্যার,’ গম্ভীর সুরে বলল স্যাম। ‘দেনার দায়ে জেলে দিয়েছে আমাকে। আর এই অপকর্মটির যে হোতা সে জীবনেও আমাকে ছাড়াবে না, যদি না আপনি নিজে তার কাছে যান, স্যার।’
‘রক্ষে করো!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘কি বলতে চাইছ তুমি?’
‘বলতে চাইছি, স্যার,’ বলল স্যাম, ‘আপনি চল্লিশ বছর জেলে কাটালে আমাকেও তাই করতে হবে এবং আমি খুশিমনে তাই করব।’
স্যামের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা আপ্লুত করল মি. পিকউইককে; এহেন বেয়াক্কেলে কথা বলার জন্যে ধমক দেয়াটা সে মুহূর্তে সমীচীন মনে করলেন না তিনি। তবে স্যামের পাওনাদারের নামটি শুধু তিনি জানতে চাইলেন। কিন্তু স্যাম তাঁকে গোমর ফাঁস করলে তো!
‘জেনে কোন লাভ হবে না, স্যার,’ বারবার আওড়ে গেল স্যাম। ‘লোকটা ভয়ানক নির্দয়, নিষ্ঠুর, ঘৃণ্য, প্রতিশোধপরায়ণ। তার পাষাণ হৃদয় কোনমতেই গলবে না, স্যার।
‘কিন্তু ভেবে দেখো, স্যাম,’ মি. পিকউইক পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ‘টাকাটা এতই অল্প যে সহজেই শুধে দেয়া যায়।’
‘অজস্র ধন্যবাদ, স্যার,’ ভারিক্কি চালে বলল স্যাম, ‘কিন্তু ওই জঘন্য শত্রুর কাছ থেকে কোন রকম করুণার আমার প্রয়োজন নেই।’
‘সে তার প্রাপ্য টাকা ফেরত পাবে এতে করুণার কি আছে?’ মি. পিকউইক নাছোড়বান্দা।
‘মাফ করবেন, স্যার,’ বলল স্যাম। ‘ওর মত ইতর লোককে টাকা ফেরত দিয়ে কেন সাহায্য করব আমরা? নীতির প্রশ্নে আমিও আপনার মত অটল থাকতে চাই, স্যার। দোয়া করবেন সারাজীবন তাই যেন থাকতে পারি, স্যার।’
শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন ভদ্রলোক। আরেক বন্দীর কামরায় নিজের মাদুর নিয়ে গেল স্যাম, এবং পরিস্থিতির সঙ্গে এত দ্রুত খাপ খাইয়ে নিল যেন জেলের ভাত খেয়েই বড় হয়েছে সে।
পরদিন সকালে দর্শনপ্রার্থী এল মি. পিকউইকের কাছে। মি. টাপম্যান, মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কলকে দেখে মন খুশি হয়ে উঠল মি. পিকউইকের।
একটু পরে স্যাম এসে অভিবাদন জানাল তাঁদের।
‘এই বোকাটা,’ ওকে দেখিয়ে বন্ধুদের বললেন মি. পিকউইক, ‘আমার কাছে কাছে থাকার জন্যে ইচ্ছে করে গ্রেপ্তার হয়েছে।’
‘অ্যাঁ!’ সমস্বরে উচ্চারণ করলেন তিন বন্ধু।
‘হ্যাঁ,’ বলল স্যাম। ‘আমিও এখন একজন বন্দী।’
‘বন্দী!’ অস্বাভাবিক উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন মি. উইঙ্কল
‘কি ব্যাপার, স্যার?’ স্যাম জানতে চাইল।
‘আমি আশা করেছিলাম, স্যাম·–না, না, কিছু না,’ দ্রুত বললেন মি. উইঙ্কল। ভদ্রলোকের মনোভাব লক্ষ করে জিজ্ঞাসু নেত্রে অপর দুই বন্ধুর দিকে চাইলেন মি. পিকউইক।
‘আমরা কিছু জানি না,’ নীরব প্রশ্নটার সরব জবাব দিলেন মি. টাপম্যান। ‘গত দু’দিন ধরে কেমন উত্তেজিত দেখছি ওকে। জিজ্ঞেসও করেছি, কিন্তু স্বীকার করে না।
‘না, না,’ লাজরাঙা মুখে বলে উঠলেন মি. উইঙ্কল। ‘ব্যাপারটা তেমন কিছুই না। ব্যক্তিগত কাজে অল্প সময়ের জন্যে একটু শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে, ভেবেছিলাম স্যামকেও নিয়ে যাব। কিন্তু এখন দেখছি তা সম্ভব না। কাজেই, একা একাই যেতে হবে আমাকে।’
রাজ্যের গল্প-গুজবে সাত তাড়াতাড়ি কেটে গেল সকালটা। দুপুরে রোস্ট করা খাসির পা, প্রকাণ্ড একটা মাংসের পাই, নানা পদের সব্জী আর এল পরিবেশন করল স্যাম। এরপর এল উঁচুমানের দু’বোতল ওয়াইন আর চা। এসব পান করতে করতে জেলখানা ত্যাগের ঘণ্টা বেজে গেল।
.
ক’দিন পর এক সকালে মি. পিকউইক স্যামকে বললেন, ‘চলো হে, জেলখানাটা এক পাক ঘুরে আসি।’
বেরিয়েছেন দু’জনে এ সময় দেখা হয়ে গেল একজন পরিচিতের সঙ্গে। জিঙ্গলকে আগের চাইতে সুস্থ দেখাচ্ছে খানিকটা, পরনে তার বন্ধকীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনা পুরানো সুট। লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াল ও, মুখের চেহারায় ক্লান্তিতে ও দারিদ্র্যে ভোগার ছাপ স্পষ্ট। তার পায়ে পায়ে এল জব ট্রটার।
‘বেশ, বেশ,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘জব আসুক স্যামের সঙ্গে। জিঙ্গল, তোমার সাথে কথা আছে আমার। কি, একা হাঁটতে অসুবিধা হবে না তো?’
‘না, না, স্যার- পারব- বেশি তাড়াতাড়ি না- পা কাঁপে- মাথা ঘোরে- বনবন- ভূমিকম্পের মতন— ভীষণ।’
‘তোমার হাতটা দাও,’ বললেন মি. পিকউইক, ওকে হকচকিয়ে যেতে দেখে নিজে থেকেই অসুস্থ লোকটির বাহু ধরে হাঁটা দিলেন।
স্যাম বাক্যহারা, ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে ফটকাবাজ মনিব ও তার সহকারীর দিকে।
‘এসো, স্যাম,’ পেছনে চেয়ে বললেন মি. পিকউইক।
‘আসছি, স্যার,’ বললেও জবের ওপর থেকে চোখ সরাল না স্যাম।
‘কেমন আছেন, মি. ওয়েলার?’
‘আ-রে-!’ বলে উঠে শিস দিল স্যাম।
‘অনেক বদলে গেছি আমি,’ বলল জব, ‘এখন আর ধোঁকাবাজি করি না। কোটের হাতা গুটিয়ে বাহু দেখাল ও, সামান্য স্পর্শেই ভেঙে যাবে যেন ওটা
‘খাওয়া-দাওয়া করো না?’ আঁতকে উঠেছে স্যাম।
‘কপালে জুটলে তো,’ করুণ মুখে জানাল জব।
অতঃপর স্যাম ওকে পাকড়াও করে কারাগারস্থিত এলের দোকানে নিয়ে গেল। এবার ওর জন্যে এলের অর্ডার দিল
‘এখন কেমন বোধ করছ?’ জব পাত্রটা নিঃশেষ করতে শুধাল স্যাম।
‘অনেকটা ভাল, স্যার। গায়ে বল পাচ্ছি মনে হচ্ছে।’
‘আর কি খাবে বলো।
‘আর কিছু না, স্যার,’ বলল বিনীত জব। ‘আপনার মহান মনিবের কল্যাণে খাসির পা আর আলু খেয়েছি পেট ভরে।’
‘কি! উনি কি তোমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, স্যার, দেখা হওয়ার পর থেকেই,’ জানাল জব। ‘আমার মনিব যখন খুব অসুস্থ ছিলেন তখন একটা ঘরের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন নিজের পয়সায়। রাতের বেলা গোপনে আমাদের খোঁজ-খবর নিতে আসেন। মি. ওয়েলার,’ চোখে জীবনে এই প্রথমবার সত্যিকারের কান্না মেখে বলল জব, ‘ওনার জন্যে খাটতে খাটতে ওনার পায়ের কাছে যদি পড়ে মরতে পারতাম!’
‘খামোশ!’ ধমকে উঠল স্যাম। ‘ওটি হচ্ছে না! আমি বেঁচে থাকতে আর কোন লোক ওঁর সেবা করার সুযোগ পাচ্ছে না।’
দোকান থেকে ফিরতে মি. পিকউইককে জিঙ্গলের সঙ্গে গভীর আলোচনায় মগ্ন দেখতে পেল ওরা। ‘আচ্ছা,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আগে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো আর এরমধ্যে আমার পরামর্শটা ভেবেচিন্তে দেখো। এখন ঘরে চলে যাও। এই শরীরে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা ঠিক না।’
মি. আলফ্রেড জিঙ্গল তার স্বভাবগত কথার ফুলঝুরি না ছুটিয়ে, নিচু হয়ে বাউ করল এবং বিনাবাক্যব্যয়ে মন্থর গতিতে হেঁটে চলে গেল।
.
দীর্ঘ তিনটি মাস সারা দিনমান ঘরে বসে কাটালেন মি. পিকউইক, রাতে শুধু হাওয়া খেতে বেরোলেন। স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটছে তাঁর, কিন্তু পার্কার ও বন্ধুদের শত অনুনয়-বিনয় এবং স্যাম ওয়েলারের মুহুর্মুহু সতর্কবাণী ও তিরস্কার গায়ে না মেখে নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন তিনি।