পাঁচ
মি. ওয়ার্ডলের পার্লারে, সম্মানের আসনে আসীন দেখা গেল উঁচু ক্যাপ ও সিল্কের গাউন পরিহিতা এক বধির বৃদ্ধাকে। তিনি মি. ওয়ার্ডলের মা। ফুফু, দুই যুবতী ও মি. ওয়ার্ডল বৃদ্ধার দেখাশোনায় সর্বক্ষণ ব্যস্ত রয়েছেন। তাঁর ওপাশে, আগুনের ধারে, সদয় চেহারার এক হাসিখুশি বৃদ্ধ বসেছেন- ডিংলি ডেলের ধর্মযাজক। মি. ওয়ার্ডলের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবরাও উপস্থিত ছিলেন, ফলে নানা খেলাধুলোয় আর জম্পেশ সাপারে চমৎকার কাটল সন্ধেটা। খাওয়া শেষে, আগুন ঘিরে বসার সময় যে সুখ অনুভব করলেন মি. পিকউইক তেমনটা কোনদিন করেননি
‘বন্ধুরা,’ বললেন এবার মি. ওয়ার্ডল। মায়ের হাত তাঁর হাতে। ‘আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো কেটেছে এই পুরানো ফায়ারপ্লেসটার কাছে। আমার মা ওই ছোট্ট টুলটায় বসতেন তিনি নিজেও যখন ছোট, তাই না, মা?’
গোটা দলটা আয়েশ করে বসে রইল ওখানে অনেক রাত অবধি- গল্পগুজব হলো, গান গাওয়া, খেলাধুলো চলল। ফলে নিজের ঘরে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমে তলিয়ে গেলেন মি. পিকউইক। জানালার কাঁচ ভেদ করে পরদিন সকালে রোদ এসে পড়লে ঘুম ভাঙল তাঁর। এক লাফে উঠে পড়লেন বিছানা ছেড়ে, খুলে দিলেন জানালা। খেত থেকে খড়ের মিষ্টি সুগন্ধ এসে লাগল নাকে। নিচের ছোট্ট বাগানটা থেকে ভেসে এল নাম না জানা কত ফুলের সুবাস। ভোরের রোদ্দুর মেখে ঝিকমিক করছে সবুজ প্রান্তর, কী এক আশ্চর্য অনুপ্রেরণায় গান গাইছে পাখিরা
‘কি, ঘুম ভাঙল?’ বাগান থেকে প্রশ্ন করলেন মি. ওয়ার্ডল। ‘সকালটা দারুণ, তাই না? শিগির নিচে নেমে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।’
দশ মিনিটে তৈরি হয়ে নেমে এলেন মি. পিকউইক। মি. ওয়ার্ডলের হাতে বন্দুক দেখা গেল, তাঁর পাশেও পড়ে রয়েছে একটা। ‘কি ব্যাপার?’ মি. পিকউইকের প্রশ্ন।
‘আপনার বন্ধু উইঙ্কল আর আমি নাস্তার আগে রুক শিকারে যাচ্ছি,’ বললেন মি. ওয়ার্ডল। ‘বন্দুকে দারুণ হাত তার, ঠিক না?’
‘তাই তো বলে সে,’ জবাবে বললেন মি. পিকউইক। তবে আমি কোনদিন দেখিনি।’
হোঁতকা জোকে পাঠানো হয়েছে মি. উইঙ্কলকে ডেকে আনতে। কাকে ডাকার কথা বলা হয়েছে বোঝেনি বলে তিনজনকেই ডেকেছে সে। শীঘ্রিই মি. টাপম্যান, মি. স্নগ্রাস ও মি. উইঙ্কলকে নিয়ে হাজির হলো মোটা ছোঁড়া।
‘চলে আসুন,’ মি. উইঙ্কলের উদ্দেশে হাঁক দিলেন মি. ওয়ার্ডল। আপনার মত উৎসাহী শিকারীর অনেক আগেই উঠে পড়া উচিত ছিল!’
মি. উইঙ্কল মলিন হেসে ঘাস থেকে বন্দুকটা তুলে নিলেন। তাঁর অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো হতভাগ্য এক রুক বুঝি তিনি নিজেই। হয়তো সত্যিই উৎসাহী তিনি, কিন্তু মুখের চেহারায় তার লক্ষণ দেখা গেল না, বরঞ্চ বড্ড করুণ তাঁর হাবভাব’।
দীর্ঘ এক সার গাছের মাথায়, খানিকটা তফাতে রুকদের নীড়। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা দুই কিশোর মগডালে উঠে ভয় দেখাতে লাগল পাখিগুলোকে।
‘শুরু করব?’ শুধালেন মি. ওয়ার্ডল।
‘আপনার ইচ্ছা,’ বললেন মি. উইঙ্কল, যে কোনভাবে দেরি করতে পারলেই যেন খুশি তিনি।
‘তাহলে সরে দাঁড়ান!’
একটি ছেলে চিৎকার ছেড়ে ডাল ঝাঁকাল। গোটা ছয়েক তরুণ রুক উড়ে বেরোল ঘটনা কি জানার জন্যে। চোখের নিমেষে গুলি করলেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। পড়ল একটা, পালাল বাকিগুলো।
‘এবার আপনার পালা,’ বলে নিজের বন্দুক রিলোড করতে শুরু করলেন বৃদ্ধ।
মি. উইঙ্কল সামনে এগিয়ে তাক করলেন বন্দুক। মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা পিছে সরে গেলেন, যাতে রুকের বর্ষণ থেকে মাথা বাঁচে। ধপাধপ কয়টা না জানি পড়বে! মি. টাপম্যান একটা গাছের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে রইলেন। গর্জন ছাড়ল ছেলেটি। উড়াল দিল চারটে পাখি। গুলি চালালেন মি. উইঙ্কল। যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ- কিন্তু কোথায় রুক! পরোপকারী মি. টাপম্যান অনেকগুলো নিরীহ পাখির জীবন বাঁচালেন গুলিটা নিজের বাঁ বাহুতে ধারণ করে।
এরপর যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলো তা বর্ণনাতীত; চরম ক্রোধে মি. পিকউইক গুণধর মি. উইঙ্কলকে ‘অপদার্থ!’ বলে সম্বোধন করলেন; মি. টাপম্যান হাত-পা ছড়িয়ে ভূমিশয্যা নিলেন; তাঁর পাশে হাঁটু গেড়ে বসলেন আতঙ্কগ্রস্ত মি. উইঙ্কল; মি. টাপম্যান উন্মাদের মতন এক মহিলার নাম ধরে চেঁচাতে লাগলেন, প্রথমে একটি তারপর আরেকটি চোখ খুললেন; তারপর পটাপট দুটোই বুজে ফেললেন।
খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর, রুমালে বেঁধে দেয়া হলো তাঁর বাহু এবং বন্ধুদের কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িমুখো হলেন তিনি
মহিলারা বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের জন্যে। ভয়ের কিছু নেই!’ তাঁদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন মি. ওয়ার্ডল।
‘কি হয়েছে?’ মহিলাদের তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার।
‘মি. টাপম্যান সামান্য আহত হয়েছেন।
খবরটা শোনামাত্র ফুফু চিৎকার করে ভাতিজিদের বাহুতে ঢলে পড়লেন।
‘পানি ঢালো ওর মাথায়,’ বললেন মি. ওয়ার্ডল।
‘না- না,’ দুর্বলকণ্ঠে বললেন ফুফু। ‘ঠিক আছে। উনি কি খুব গুরুতর আহত? উনি কি মারা গেছেন? উনি কি-?’ আর্তনাদ করে উঠলেন ভদ্রমহিলা।
‘শান্ত হোন,’ বললেন মি. টাপম্যান, অতিকষ্টে কান্না চাপলেন। ‘প্রিয়, প্রিয় ম্যাডাম, শান্ত হোন।
‘ওঁর গলা,’-চেঁচিয়ে উঠলেন ফুফু। ‘তারমানে আপনি মারা যাননি! ওহ, নিজের মুখে একবার শুধু বলুন আপনি বেঁচে আছেন!’
‘বোকার মত কোরো না তো, র্যাচেল,’ ধমক দিলেন মি. ওয়ার্ডল, আবেগঘন দৃশ্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হলো তাঁর বেরসিক আচরণে। ‘ওঁকে নিজের মুখে বলতে হবে কেন?’
‘আমি মরিনি, আমি মরিনি,’ বলে উঠলেন মি. টাপম্যান। ‘আমি শুধু আপনার সাহায্য চাই। আমাকে দয়া করে একটু ধরুন।’ ফিসফিসিয়ে আরও বললেন, ‘ওহ, মিস র্যাচেল!’ উদ্বেগাকুল ভদ্রমহিলা তাঁকে নিয়ে গেলেন ব্রেকফাস্ট রূমে এবং ভদ্রলোক সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরলেন তাঁর একটা হাত। একাকী এখানে ওঁরা।
চোখ বুজলেন মি. টাপম্যান, পাক্কা বিশ সেকেন্ডের জন্যে। ঘুমিয়ে পড়েছেন!’ ফিসফিস করে বললেন ফুফু। ‘আহা বেচারা, মি. টাপম্যান! প্রিয়, প্রিয়, মি. টাপম্যান!’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন মি. টাপম্যান। ‘কি-কি বললেন? ওহ, প্লীজ, আরেকবার বলুন ওই কথাগুলো!’
বিস্মিত দেখাল ভদ্রমহিলাকে। ‘আপনি শুনে ফেলেছেন?’ লাজরাঙা মুখে শুধালেন।
‘হ্যাঁ, ফেলেছি,’ বললেন মি. টাপম্যান। ‘আবার বলুন। আপনি আমাকে সুস্থ দেখতে চাইলে আবার বলুন।’
‘এই, চুপ!’ মৃদু আদুরে ধমক। ‘আমার ভাই এসে পড়েছে।’
ডাক্তার নিয়ে এসেছেন মি. ওয়ার্ডল। বাহু পরখ করে জখমে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়া হলো, আঘাত নাকি খুবই সামান্য। গোটা দলটা এবার খুশি মনে ব্রেকফাস্টে বসল। মি. পিকউইক একা নীরব রইলেন। মি. উইঙ্কলের ওপর থেকে তাঁর আস্থা টলে গেছে- মারাত্মকভাবে- সকালের ঘটনায়।
নিমন্ত্রণকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে অবশ্য তাঁর চেষ্টার ত্রুটি রইল না, এবং স্থানীয় ক্রিকেট মাঠে যাওয়ার কথা উঠতে সানন্দে রাজি হলেন তিনি। মি. টাপম্যানকে মহিলাদের কোমল হাতে সঁপে দিয়ে বাকিরা চলল ময়দান দাপাতে।