দ্য পিকউইক পেপার্স – ৩

তিন

বাতাসের ঝাপটায় একটা ক্যারিজের চাকায় গিয়ে হ্যাটটা সেঁটে যেতে হা-ক্লান্ত মি. পিকউইক ছুটে গিয়ে তুলে নিলেন ওটা; এখানে একসারে আরও কটি ক্যারিজ দাঁড়িয়ে দেখা গেল। হ্যাটটা যথাস্থানে চাপিয়ে দম নেবার ফুরসত পেলেন মি. পিকউইক। আধ মিনিট পরে নিজের নাম শুনতে পেলেন তিনি। মুখ তুলে চাইতে একটি দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে ও আনন্দে ভরে উঠল তাঁর অন্তর। খোলা ক্যারিজে নীল কোট পরা শক্তপোক্ত এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, স্কার্ফ ও ফেদার পরা দু’জন যুবতী, এক যুবক, স্পষ্টতই যুবতীদের যে কারও একজনের প্রেমিক, বয়স্কা এক ভদ্রমহিলা, যুবতীদের ফুফু-খালা কিছু একটা হবেন- এবং মি. টাপম্যান, তাঁর সহজ-স্বচ্ছন্দ ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এই পরিবারেই বুঝি জন্মেছেন ভদ্রলোক। ক্যারিজের পেছনে অতিকায় একটা ঝুড়ি- এমনি ধরনের ঝুড়ি দেখলেই সুস্বাদু সব খাবার আর ওয়াইনের বোতলের ছবি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়- এবং চালকের আসনে লালমুখো হোঁতকা এক ছেলে, ঘুমিয়ে কাদা।

‘পিকউইক— পিকউইক,’ হাঁক ছাড়লেন মি. টাপম্যান। ‘উঠে এসো! শিগিরি!’

‘আসুন, স্যার, আসুন, বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমন্ত্রণ জানালেন। ‘জো— জ্বালাও ছোঁড়াকে, আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে- জো, সিঁড়িটা নামিয়ে দাও তো।’ মোটা ছেলেটা বক্স থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে নেমে, সিঁড়ি লাগিয়ে ক্যারিজের দরজা মেলে ধরল। মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কলও এসে জুটলেন এসময়।

আপনাদের সবার জায়গা হয়ে যাবে,’ বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। ‘দু’জন ভেতরে একজন বাইরে। আসুন, স্যার।’ মি. পিকউইক ও মি. স্নডগ্রাসকে টেনে তোলা হলো ক্যারিজে। মি. উইঙ্কল চালকের আসনটা ভাগাভাগি করলেন মোটা ছেলেটার সঙ্গে- তখুনি তখুনি ঘুমিয়ে পড়েছে সে।

‘কেমন আছেন, স্যার,’ শুধালেন শক্তপোক্ত ভদ্রলোক। ‘আপনাকে পেয়ে খুব খুশি হলাম। আপনাদেরকে আমি খুব ভাল করে চিনি, যদিও আপনারা হয়তো ভুলে গেছেন আমাকে। গত শীতে বেশ কিছু সন্ধ্য। ক্লাবে কাটিয়েছিলাম আমি। মি. টাপম্যানকে সকালে দেখতে পেয়ে কি যে খুশি লেগেছে। এই যে, এরা আমার মেয়ে- এমিলি আর বেলা। আর উনি আমার বোন, মিস র‍্যাচেল ওয়ার্ডল। ইনি আমার বন্ধু, মি. ট্রান্ডল। এখন সবাই সবাইকে চেনেন কাজেই অস্বস্তি বোধ করার কোন কারণ নেই।’ মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা চিনতে পারলেন ভদ্রলোককে।

প্রত্যেকে ক্যারিজে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড দেখছেন। অদ্ভুত দৃশ্য। একপক্ষ অপর পক্ষের মাথার ওপর দিয়ে গুলি করে দৌড়ে চলে যাচ্ছে এবং দ্বিতীয় পক্ষও সেই একই কাজ করছে। ওরা স্কয়্যার তৈরি করে দেয়াল বাইছে- নামছে এবং অসমসাহসিকতায় দেয়াল ধসিয়ে দিচ্ছে। এবার বন্দুকের গর্জনে ও নারীদের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। দুই বোন এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে একজনকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য হলেন মি. ট্রান্ডল, মি. স্নডগ্রাস অপরজনকে সাহায্য করলেন। মি. ওয়ার্ডলের বোন এমনই নার্ভাস হয়ে পড়লেন, তাঁর কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখতে হলো মি. টাপম্যানকে। মোটা ছেলেটি বাদে আর সবাই মহা উত্তেজিত, কিন্তু সে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে যেন কামানের গর্জন তার নিত্যকার ঘুমপাড়ানি গান।

‘জো-জো,’ বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, দুর্গ দখলের পর সৈন্যরা একসঙ্গে ডিনারে বসলে। জ্বালাও ছোঁড়াকে, ফের ঘুম! ওর পায়ে একটা চিমটি কাটুন দেখি, স্যার। আর কিছুতে ঘুম ভাঙে না ওর ধন্যবাদ- ঝুড়িটা খোলো, জো।’

আসন থেকে আবারও গড়িয়ে নামল হোঁদল কুতকুত এবং ঝুড়িটার বাঁধন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় খুলে ফেলল।

সুস্বাদু একটা পিকনিক উপভোগ করল সবাই ক্যারিজে পাশাপাশি বসে। হাসি-ঠাট্টায় পরস্পরকে আরও ভালভাবে চেনার সুযোগ পাওয়া গেল। মি. টাপম্যান ও মিস র‍্যাচেল যথেষ্ট অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেন ইতোমধ্যে।

খাওয়ার পর্ব ফুরোল অবশেষে। মি. ওয়ার্ডল জোরাল গলায় ডাক দিলেন জোকে। ‘জ্বালাও ছোঁড়াকে,’ বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, ‘আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।’

‘বড় অদ্ভুত ছেলে,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘ও কি সব সময়ই এভাবে ঘুমায়?’

‘ঘুম!’ বললেন বৃদ্ধ। ‘ও চব্বিশ ঘণ্টাই ঘুমাচ্ছে। ঘুমের ঘোরেই সব কাজ করে আর খাবার সার্ভ করার সময় নাক ডাকে।’

‘কী আজব কথা!’ মি. পিকউইকের বিস্ময়।

‘হ্যাঁ, আজবই বটে,’ জবাবে বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। ‘আমি ওর জন্যে গর্ব বোধ করি- ওকে হাতছাড়া করতে চাই না- মানুষের কৌতূহল জাগাতে ওস্তাদ। * এই জো, জো, এগুলো সরিয়ে নাও আর আরেকটা বোতল খোলো- শুনতে পাচ্ছ?’

মোটা ছেলেটি উঠল, চোখ খুলল, ঘুমিয়ে পড়ার আগে যে পাইটা খাচ্ছিল তার শেষ টুকরোটা মুখে পুরল, এবং আস্তে আস্তে মনিবের আদেশ পালন করল।

সৈন্যরা তাদের কার্যক্রম আবার আরম্ভ করেছে। বন্দুকের শব্দে মহিলাদের পিলে চমকে গেল ফের- তারপর বিকট শব্দে একটা বোমা বিস্ফোরিত হলে সবার সে কি ফুর্তি! বোমার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী ও জনতাও মিলিয়ে যেতে শুরু করল।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক ও মি. পিকউইক গল্প করছিলেন। ‘ভুলে যাবেন না,’ করমর্দন করে বললেন প্রথমজন, ‘কাল আপনারা আসছেন।’

‘অবশ্যই,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘ঠিকানা আছে তো?’

‘ম্যানর ফার্ম, ডিংলি ডেল,’ বললেন মি. পিকউইক

‘হ্যাঁ। এক সপ্তার আগে কিন্তু ছাড়ব না। কথা দিচ্ছি খারাপ লাগবে না আপনাদের। জো— জ্বালাও ছোঁড়াকে, আবার ঘুম দিয়েছে! জো, টমকে বলো ঘোড়া জুততে।’

জোতা হলো ঘোড়া, বিদায় নিয়ে রওনা হলেন মি. ওয়ার্ডল। পিকউইকবাহিনী শেষবারের মত ক্যারিজটার দিকে চাইতে, মোটা ছেলেটির মুখে সূর্য ঝলসাতে দেখল। বুকের কাছে নুয়ে পড়েছে চিবুক, ঘুমের রাজ্যে ডুব মেরেছে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *