দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৮

আঠারো

‘আপনি কি সত্যিই টাকাটা দেবেন না ঠিক করেছেন?’ পরদিন সকালে মি. পিকউইকের কামরায় প্রশ্ন করলেন মি. পার্কার।

‘হাফ পেনিও না,’ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন মি. পিকউইক। ‘বন্ধুরা বোঝাতে অনেক চেষ্টা করেছে, রাজি হইনি। ডডসন আর ফগ যা খুশি করতে পারে।… যাকগে, গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বের করতে ওদের কতদিন লাগবে আপনার ধারণা?’

‘মাস দুয়েক।’

‘ভেরি গুড,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘ততদিন পর্যন্ত এ নিয়ে আর ভাবতে চাই না আমি। এখন কথা হচ্ছে,’ বলে চারদিকে খুশির মূড়ে চাইলেন ভদ্রলোক, ‘আমরা এবার কোথায় যাচ্ছি?’

বন্ধুরা তাঁর বীরোচিত মনোভাব দেখে লা জবাব, ফলে বৃথাই অপেক্ষা করলেন মি. পিকউইক। ‘বেশ,’ বললেন তিনি, ‘আমার ওপর ছেড়ে দিলে আমি বলব বাথের কথা। আমরা কেউই বোধহয় আগে ওখানে যাইনি।’

সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো ‘প্রস্তাব। স্যামকে তখুনি পাঠানো হলো ওয়াইট হর্স ইনে, পরদিন সকাল সাড়ে সাতটার কোচে পাঁচটা আসন সংরক্ষণের জন্যে।

যাত্রার জন্যে দিনটি তেমন সুখপ্রদ নয়। বৃষ্টি পড়ছে, গুমোট কাটছে না তবুও। মিনিট বিশেক আগে পৌঁছে, পিকউইকবাহিনী ট্রাভেলার্স রূমে আশ্রয় নিতে গেলেন।

ওয়াইট হর্স ইনের ট্রাভেলার্স রুমটির নানা ভাগ একটি অংশ আজ সকালে দখলে রেখেছেন কঠোর চাহনির এক শ্মশ্রুমণ্ডিত মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। মাথায় চকচকে টাক তাঁর, অল্প ক’গাছি চুল দেখা যাচ্ছে কেবল দু’পাশে ও পেছনটায়। মি. পিকউইককে ঢুকতে দেখে কড়া চোখে নাস্তার প্লেট থেকে মুখ তুলে চাইলেন তিনি। তাঁর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কেউ তাঁকে ঠকাবে বলে সন্দেহ করছেন।

‘ওয়েটার,’ বললেন দেড়েল, ‘আরও কটা টোস্ট আনো দেখি।’

‘জ্বী, স্যার।’

‘মাখন টোস্ট,’ আগুন ঝরালেন ভদ্রলোক।

‘এখুনি আনছি, স্যার।’

ভদ্রলোক আগুনের কাছে গিয়ে বুটের দিকে চেয়ে চিন্তামগ্ন হলেন।

‘বাথের কোথায় থামে কোচটা কে জানে,’ মি. উইঙ্কলকে অনুচ্চ স্বরে বললেন মি. পিকউইক।

‘হুম, কি বললেন? বাথে যাচ্ছেন নাকি আপনি?’ অচেনা লোকটির প্রশ্ন।

‘যাচ্ছি, স্যার,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘আর ওরা?’

‘ওঁরাও যাচ্ছেন।’

‘ভেতরে না,’ কঠোর কণ্ঠে বলে উঠল লোকটি। ‘সবার জায়গা হবে না। আমি দুটো সীট নিয়েছি। ওরা ঠাসাঠাসি করতে চাইলে আমি অন্য কোচ তো নেবই ওদের বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকব।’

‘ভেতরে মাত্র দুটো সীট নিয়েছি আমরা,’ বললেন মি. পিকউইক

‘শুনে খুশি হলাম,’ বললেন ভদ্রলোক। ‘এই যে আমার কার্ড। আপনাদের নাম জানতে পারি?’

পরিচয় পর্বটা বন্ধুত্বপূর্ণ হলো এবং জানা গেল ভদ্রলোকের নাম ডাউলার; বাথে বেড়াতে যাচ্ছেন; আগে আর্মিতে ছিলেন; এখন ব্যবসা করছেন; এবং কোচে দ্বিতীয় আসনটি নেয়া হয়েছে মিসেস ডাউলারের জন্যে।

ইতোমধ্যে কোচ এসে গেল। পিকউইকবাহিনী ও মি. ডাউলার সস্ত্রীক বাথের ওয়াইট হার্ট হোটেলে এসে পৌছলেন। বলে নেয়া দরকার, মিসেস ডাউলার একজন আধুনিকা, রূপসী মহিলা।

মি. পিকউইক দু’মাস যেহেতু বাথে বাস করতে চান, তাঁর ইচ্ছে নিজেদের জন্যে প্রাইভেট লজিঙের ব্যবস্থা করবেন। রয়্যাল ক্রিসেন্টে একটি বাড়ির ওপর তলাটা ভাড়া নিলেন তাঁরা। তাঁদের প্রয়োজনের তুলনায় ওটা বড় বলে মি. ডাউলার প্রস্তাব করলেন, তিনি একটি বেডরূম ও একটি সিটিংরূম নেবেন। সানন্দে সায় জানালেন পিকউইকবাহিনীর সভ্যরা।

মিনারেল ওয়াটারের জন্যে বাথ বিখ্যাত। পৌঁছেই মনের সুখে পানি পান করতে লাগলেন মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা। এভাবে কেটে গেল সেদিনটি।

একদিন পরের কথা। মি. পিকউইক একাকী জেগে রয়েছেন, নোট লিখছেন। বন্ধুরা যে যার মত বিছানা নিয়েছেন। দরজায় মৃদু টোকার শব্দ।

‘একটু বিরক্ত করতে এলাম, স্যার,’ বললেন ল্যান্ডলেডি মিসেস ক্র্যাডক। ‘কিছু লাগবে-টাগবে?’

‘না, ধন্যবাদ।’

‘তাহলে এবার শুতে যেতে পারি,’ বললেন ভদ্রমহিলা। ‘মিসেস ডাউলার মহিলাদের কোন্ একটা সভায় গেছেন। মি. ডাউলার তাঁর জন্যে অপেক্ষা করবেন। আমি যাই, স্যার।’

‘বেশ,’ বললেন মি. পিকউইক

আধ ঘণ্টার মধ্যে নোট নেয়া শেষ হলো তাঁর। এবার মোম নিভিয়ে, ওপরে বিছানায় গেলেন। মি. ডাউলারের দরজায় থেমে, নক করে শুভরাত্রি জানালেন।

‘ও,’ বললেন মি. ডাউলার, ‘ঘুমোতে যাচ্ছেন? আমারও চোখ লেগে আসছে কিন্তু কি করব বলুন। ঝড় হবে মনে হচ্ছে, তাই না?’

সায় জানালেন মি. পিকউইক, বিদায় নিলেন।

স্ত্রীর জন্যে আগুনের পাশে বসে রইলেন অনুগত স্বামী মি. ডাউলার। অপেক্ষার প্রহর বড় যন্ত্রণাদায়ক। সভার মহিলাদের ওপর মনে মনে রেগে উঠলেন ভদ্রলোক। তাঁকে ঘুমোতে দিচ্ছে না কি রকম অমানুষ! চেয়ারে বসে ঢুলতে ঢুলতে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি চিন্তা-ভাবনা করবেন–না, না, ঘুমোবেন না।

‘আমার তো আবার কুম্ভকর্ণের ঘুম, শোয়ার পর মনে মনে বললেন তিনি আমাকে যে করে হোক জেগে থাকতে হবে। নইলে টোকার শব্দ পাব না।’ পরমুহূর্তে ঘুমে তলিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।

তিনটের ঘণ্টা পড়তে, মিসেস ডাউলারের সেডান চেয়ার* হাজির হলো। বাহকদের একজন বেঁটে, মোটা ও অন্যজন লম্বা, লিকলিকে। পালকি নামিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তারা, বাইরের দরজায় জোরে নক করল।

[সেডান চেয়ার: পালকি ধরনের বাহন।]

কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরও কোন সাড়া মিলল না।

পালকির ভেতর অস্থির হয়ে উঠলেন মিসেস ডাউলার। ফের খবর দিতে বললেন। ‘আরও দু’তিনবার নক করো, প্লীজ।’

বাঁটকু দুমাদুম কিল-ঘুসি চালাল। ওদিকে লম্বু, রাস্তা থেকে আলো দেখা যায় কিনা দেখতে, জানালার দিকে মুখ তুলে চাইল।

কেউ এল না। চারদিক অন্ধকার, সুনসান।

আবারও তাড়া লাগালেন মিসেস ডাউলার, খানিকটা ভয় পেয়ে গেছেন।

দরজার ওপর হামলে পড়ল পালকি বাহকরা।

শেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙল মি. উইঙ্কলের এবং তাঁর ধারণা হলো কেউ হয়তো দরজা ধাক্কাচ্ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে, কান পেতে আরও দশ মিনিট বিছানায় বসে রইলেন তিনি। গুনে গুনে তেত্রিশবার কিল পড়ার শব্দ শুনে, এক লাফে বিছানা ছাড়লেন ভদ্রলোক, পায়ে চটি গলিয়ে ড্রেসিং গাউন চড়ালেন গায়ে। তারপর মোমবাতি জ্বেলে তরতর করে নেমে এলেন সিঁড়ি ভেঙে।

‘কে যেন আসছে, ম্যাডাম,’ বলল বেঁটে। ‘হুঁশ হয়েছে শেষ পর্যন্ত।’

‘ওর পেছনে সূচের খোঁচা দিতে পারলে বেশ হত,’ লম্বা বিড়বিড় করে আওড়াল।

‘কে ওখানে?’ শিকল খুলে শুধালেন মি. উইঙ্কল।

‘এত কথা কিসের, গর্দভ, লম্বু তাঁকে চাকর-বাকর ভেবে ধমক ছাড়ল। ‘আগে দরজাটা খোলো।

মি. উইঙ্কল দড়াম করে দরজাটা খুলে, বাইরে পা রাখলেন। মোমবাতি মাথার ওপর তুলে আগ্রহী চোখে চাইলেন তিনি। ঠিক সে মুহূর্তে দমকা এক চোট বাতাস ধেয়ে এল। মোমবাতি গেল নিভে এবং মি. উইঙ্কলের পেছনে দরজাটা সশব্দে হয়ে গেল বন্ধ।

‘বিপদে পড়ে গেলেন আপনি,’ বলল বেঁটে লোকটি।

পালকিতে এক মহিলাকে দেখতে পেলেন ভদ্রলোক। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজায় করাঘাত করতে লাগলেন। ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপছেন তিনি, দরজায় বাড়ি দিতে যতবারই হাত তোলেন বেয়াড়া ভঙ্গিতে বাতাসে উড়ে যায় তাঁর ড্রেসিং গাউন। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!

সুবিখ্যাত রয়্যাল ক্রিসেন্ট রাস্তাটিতে তখন ক্রমেই নিকটবর্তী হচ্ছে বেশ কিছু মহিলা। তাদের সঙ্গে পুরুষমানুষও রয়েছে।

‘মহিলারা এসে পড়ল!’ কাতরধ্বনি বেরোল মি. উইঙ্কলের গলা চিরে।. ‘শিগির একটা কিছু দিয়ে ঢেকে দাও আমাকে! দোহাই লাগে, আমার সামনে এসে আড়াল করে দাঁড়াও!’

কিন্তু কে শোনে কার কথা। পালকি বাহকরা তাঁর দুরবস্থা দেখে হেসেই খুন। মি. উইঙ্কল মরিয়ার মতন শেষবার দরজায় কিল মেরে, ছুঁড়ে ফেলে দিলেন নেভা মোমবাতিটা এবং এক লাফে গিয়ে চড়লেন মিসেস ডাউলারের সেডান চেয়ারে।

ওদিকে মিসেস ক্র্যাডক চেঁচামেচি শুনে, মিসেস ডাউলারের জন্যে নেমে এসেছেন নিচে। বৈঠকখানার জানালা খুলতে মি. উইঙ্কলকে পালকিতে লাফিয়ে উঠতে দেখলেন। এ দৃশ্য দেখামাত্র আর্তচিৎকার করে মি. ডাউলারকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন ভদ্রমহিলা, কারণ তাঁর স্ত্রী তো পরপুরুষের হাত ধরে পালকি চেপে পালাচ্ছেন!

তিড়িং করে লাফ মারলেন মি. ডাউলার বিছানা ছেড়ে, তারপর ছুট। নিচের জানালায় তখন তাঁর সঙ্গে মি. পিকউইকও যোগ দিয়েছেন। দু’জনের চোখেই সবার আগে যেটা ধরা পড়ল সেটা হচ্ছে মি. উইঙ্কল পালকিতে চড়াও হয়েছেন।

‘এই কে আছ,’ ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়লেন মি. ডাউলার। ‘জাপটে ধরো ওকে- পেড়ে ফেলো- আমি আসছি- ওর গলা কাটব আমি- একটা ছুরি দিন তো- এক পোঁচে কল্লা নামিয়ে দেব, মিসেস ক্র্যাডক- সত্যি বলছি!’ তারস্বরে চিৎকাররতা ল্যান্ডলেডি ও মি. পিকউইককে পেছনে ফেলে, খেপাটে স্বামীটি একটা ছোট সাপার নাইফ ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে ধেয়ে গেলেন রাস্তায়।

কিন্তু তাঁর জন্যে অপেক্ষা করলে তো মি. উইঙ্কল। মি. ডাউলারের ‘হুমকি কানে যেতে না যেতেই লাফ মেরে পালকি থেকে নেমে রাস্তার ওদিকে ছুট দিয়েছেন তিনি. মি. ডাউলার ধাওয়া দিলেন তাঁকে। আগে আগে পাঁই পাঁই ছুটছেন ভদ্রলোক। মোড় ঘুরে দ্বিতীয়বার ফিরে যখন এলেন বাড়ির দরজা তখন খোলা। বাতাসের মত ভেতরে ঢুকে, ডাউলারের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে, দুদ্দাড় নিজের ঘরে গিয়ে উঠলেন। দরজায় ছিটকিনি দিয়েও নিশ্চিন্ত হলেন না মি. উইঙ্কল, সমস্ত আসবাব দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে রাখলেন। আর সাত সকালে চম্পট দেয়ার জন্যে তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন।

ডাউলার তাঁর কি-হোল দিয়ে নানা হুমকি-ধামকি দিয়ে শেষমেশ ক্ষান্ত হলেন। শাসিয়ে গেলেন কাল মি. উইঙ্কলের গলা নামাবেন। একটু পর সবাই যে যার বিছানায় চলে গেলে শান্ত হয়ে এল পরিবেশ।

পরদিন সকালে মি. পিকউইক গত দিনের চাইতে খানিকটা আগে নিচে গিয়ে বেল বাজালেন।

‘স্যাম,’ সে এলে বললেন ভদ্রলোক, ‘গত রাতে একটা বিশ্রী ঘটনা ঘটে গেছে। তার ফলে উইঙ্কল এখন ভয় পাচ্ছে মি. ডাউলার তাকে খুন করবেন।’

‘শুনেছি, স্যার,’ জানাল স্যাম।

‘সেই ভয়ে,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘উইঙ্কল পালিয়েছে। আমাকে কিছু জানিয়েও যায়নি।

তাঁর উচিত ছিল এখানে থেকে প্রয়োজনে লড়াই করা, স্যার,’ অবজ্ঞা ভরে বলল স্যাম। ‘ওই ডাউলার লোকটাকে কব্জা করা মোটেই কঠিন কোন কাজ নয়।’

‘তোমাকে, স্যাম, উইঙ্কলকে খুঁজে আনতে হবে।

‘নিশ্চয়ই, স্যার।’ স্যাম তখুনি বেরিয়ে পড়ল। দু’ঘণ্টা পর ফিরে এসে খবর জানাল, মি. উইঙ্কলের মত দেখতে এক লোককে নাকি সেদিন সকালে ব্রিস্টলের কোচে চাপতে দেখা গেছে।

‘স্যাম’ ওর একটা হাত ধরে বললেন মি. পিকউইক। ‘ওকে তোমার ফলো করতে হবে। ওকে দেখামাত্র চিঠি দেবে আমাকে। পালাতে চেষ্টা করলে মাথায় বাড়ি দিয়ো কিংবা বন্দী কোরো। আমার পূর্ণ সম্মতি রইল।’

‘আমি খুব সতর্ক থাকব, স্যার।’

‘ওকে বলে দিয়ো, তোমার সঙ্গে না আসলে আমি নিজে গিয়ে ওকে ধরে আনব।

‘বলব, স্যার।’

মি. পিকউইক তাঁর বিশ্বস্ত কাজের লোকটির হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে, তখুনি পলাতকের সন্ধানে ব্রিস্টল রওনা হতে বললেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *