চব্বিশ
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ। মিসেস বারডেল ও তার ছেলে টমি, হ্যাম্পস্টীডের বিখ্যাত সরাইখানা দ্য স্প্যানিয়ার্ডস টী গার্ডেনে মিসেস ক্লাপিনস ও মিসেস স্যান্ডার্সের সঙ্গে বসে আছে। মহা ফুর্তিতে রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে, এসময় আগুয়ান চাকার শব্দ শোনা গেল। মহিলারা মুখ তুলে চাইতে, বাগানের গেটে একটা কোচ থামতে দেখলেন।
‘আরে, মি. জ্যাকসন না? ডডসন অ্যান্ড ফগের কর্মচারী!’ চেঁচিয়ে উঠল মিসেস বারডেল।
মোটা লাঠি হাতে, মলিন পোশাক পরিহিত এক লোকও নেমেছে তার সঙ্গে কোচ থেকে, লোকটির সঙ্গে অল্প কিছু কথা বলতে দেখা গেল জ্যাকসনকে।
‘কি খবর? নতুন কিছু হলো?’ সে এগিয়ে আসতে ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন করল মিসেস বারডেল।
‘না, ম্যাডাম,’ জানাল জ্যাকসন। ‘কেমন আছেন আপনারা? আমাকে ক্ষমা করবেন- কিন্তু আইন তো আইনই। শহরে এখুনি আপনাকে যেতে বলেছেন মি. ডডসন ও ফগ, মিসেস বারডেল।’
‘বলেন কি!’ চেঁচিয়ে উঠল মহিলা।
‘হ্যাঁ,’ বলল জ্যাকসন। ‘খুব জরুরী, যেতেই হবে। কোচটা সেজন্যেই ধরে রেখেছি।’
মহিলাদের চোখে অস্বাভাবিক লাগলেও ব্যাপারটার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারলেন তাঁরা। বিশেষ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া এভাবে লোক পাঠাবে কেন ডডসন ও ফগ?
সবাই গিয়ে কোচে উঠলেন। ‘ইনি মিসেস বারডেল, আইজ্যাক, ‘ লাঠিওয়ালাকে বলল জ্যাকসন। একটু পরই যাত্রা শুরু হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রা এসে গেল তিন বান্ধবীর। অনেকক্ষণ বাদে কোচ থামতে চটকা ভাঙল মিসেস বারডেলের।
‘আপনাদের অফিস এসে গেছে?’ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল মহিলা।
‘অতদূর যাওয়ার দরকার হবে না,’ বলল জ্যাকসন। ‘দয়া করে নেমে আসুন।’
ঘুমের ঘোরে নির্দেশ পালন করল মিসেস বারডেল। জায়গাটা কেমন অদ্ভুত: মধ্যখানে একটা গেট নিয়ে প্রকাণ্ড এক দেয়াল, ভেতরে একটা গ্যাস-লাইট জ্বলছে।
মিসেস বারডেল জ্যাকসনের বাহুতে ভর দিয়ে, ছেলের হাত ধরে বারান্দায় প্রবেশ করল। অনুসরণ করলেন অন্যরা।
যে ঘরটিতে তারা এসে ঢুকল সেটি বারান্দাটার চাইতেও উদ্ভট। এক গাদা লোক দাঁড়িয়ে চারদিকে! তাকিয়ে রয়েছে হাঁ করে!
‘কোথায় নিয়ে এলেন আমাদের?’ থমকে দাঁড়িয়ে জবাব চাইল মিসেস বারডেল।
‘ঘাবড়াবেন না, এটাও আমাদের একটা অফিস,’ বলল জ্যাকসন, একটা দরজা দিয়ে তাকে তাড়া লাগিয়ে ঢোকাল। ‘জলদি, আইজ্যাক। ‘
‘কুছ পরোয়া নেহী,’ লাঠিওয়ালা বলল। পেছনে ভারী দরজাটা লেগে গেলে ক’ধাপ নিচে নামল ওরা।
‘যাক, আসা গেল শেষ পর্যন্ত। মিসেস বারডেল, সব ঠিক চোদ্দ শিক।’ বলে নিজের চারধারে বিজয়ীর দৃষ্টি বুলিয়ে নিল জ্যাকসন।
‘মানে? কি বলছেন কি আপনি?’ শিউরে উঠে বলল মিসেস বারডেল।
‘বলছি, ভয়ের কিছু নেই, মিসেস বারডেল,’ বলল জ্যাকসন। ডিডসন সাহেবের মত এত নরম মনের মানুষ ত্রিভুবনে জন্মায়নি, আর ফগ সাহেব তো রীতিমত ফেরেস্তা। পিকউইকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ যখন আদায় হলোই না তখন ওঁদের খরচাটা দেবে কে শুনি? তাই আপনাকে এখানে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না, ম্যাডাম। খরচাটা দিয়ে দিলেই বেরিয়ে যেতে পারবেন। এর নাম ফ্লীট, ম্যাডাম। আমি আসি, কেমন? চলি, টমি সোনা। টা টা।’
জ্যাকসন পা চালিয়ে চলে গেলে, চাবি হাতে আরেকজন লোক হতবিহ্বল মহিলাটিকে আরও ক’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে একটা দোরগোড়ায় নিয়ে এল। মিসেস বারডেল তারস্বরে চেঁচাতে লাগল; হাউমাউ করে আহাজারি করছে টমি; আতঙ্কগ্রস্তা মিসেস ক্লাপিনস ও মিসেস স্যান্ডার্স কালবিলম্ব না করে সটকে পড়লেন।
ওদিকে মি. পিকউইক তখন সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়েছেন, সঙ্গে স্যাম ওয়েলারও রয়েছে। মিসেস বারডেলকে এখানে দেখে কৃত্রিম শ্রদ্ধায় হ্যাট খুলল স্যাম, তার ক্রুদ্ধ মনিব পত্রপাঠ পেছন ফিরে হাঁটা ধরেছেন।
‘মহিলাকে জ্বালাতন কোরো না,’ স্যামকে বলল ওয়ার্ডেন। ‘মাত্র এসে পৌঁছেছে।
‘বন্দী!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠে হ্যাট পরল স্যাম। ‘কি কারণে?’
‘ডডসন আর ফগ,’ জবাব দিল লোকটা। ‘ওদের খরচ না দেয়া পর্যন্ত আটক থাকতে হবে।
‘এই, জব, জব!’ চেঁচাতে চেঁচাতে প্যাসেজ ধরে ছুট দিল স্যাম। ‘শিগির মি. পার্কারের কাছে যাও। নিয়ে এসো তাঁকে। জব্বর মজা! হুররে!’
.
সারাটা পথ দৌড়ে গ্রেজ ইনে এসে পৌঁছল জব, কিন্তু ততক্ষণে অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। মি. পার্কারের কেরানীকে অবশ্য কাছের এক সরাইখানায় পাওয়া গেল।
‘আর কারও কেস হলে,’ বলল কেরানী, ‘বাসায় গেলে রাগ করতেন মি: পার্কার। কিন্তু কেস যেহেতু মি. পিকউইকের একটা ক্যাব ভাড়া নিয়ে চলে যাই, পরে অফিস থেকে টাকাটা নিয়ে নেব।’
মি. পার্কারের বাড়িতে জব স্যাম ওয়েলারের খবরটা পৌঁছে দিল। সব শুনে ভদ্রলোক তো থ। কথা দিলেন পরদিন সকাল দশটায় ফ্রীটে পৌছে যাবেন।
কাঁটায় কাঁটায় দশটায় মি. পার্কার মি. পিকউইকের দরজা নক করলেন। ‘বসি আসুন, আপনার সঙ্গে মিসেস বারডেলের কেসটা নিয়ে আলোচনা আছে। মি. পিকউইককে অভিবাদন জানিয়ে বললেন মি. পার্কার।
‘আমি ওই কেসের নামই শুনতে চাই না,’ জবাবে বললেন মি. পিকউইক। ‘আমার সামনে ওই নাম আর নিয়ো না, পার্কার।
‘ও কথা বললে কি হয়?’ ফাইলের ফিতে খুলতে খুলতে বললেন উকিল সাহেব। ‘নাম না নিয়ে উপায় আছে? মিসেস বারডেল যে এখন চার দেয়ালের মধ্যে।’
‘জানি।’ জবাব মি. পিকউইকের।
‘বেশ, তা না হয় জানলেন। এখন বলুন দেখি, স্যার, মহিলা এখানে থাকবে নাকি থাকবে না।’
‘থাকাথাকির আমি কি জানি!’ বলে উঠলেন মি. পিকউইক। ‘এসব জানে ডডসন আর ফগ।’
‘ভুল বললেন, স্যার,’ দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন মি. পার্কার। ‘ডডসন আর ফগের ওপর এটা নির্ভর করে না। এটা নির্ভর করে সম্পূর্ণ আপনার ওপর। মহিলার সঙ্গে দেখা করে তারপর এ ঘরে এসেছি আমি। তার খরচা দিয়ে দিলেই আপনি নিঃশর্ত মুক্তি পেতে পারেন, ক্ষতিপূরণের কোন বালাই থাকবে না। মহিলা লিখিতভাবে স্বীকার করেছে পুরো প্ল্যানটাই ডডসন আর ফগের মাথা থেকে বেরিয়েছে আপনাকে হাঙ্গামায় জড়ানোর জন্যে সে ক্ষমাও চেয়েছে।’
‘তোমার কথা শেষ হয়েছে?’
‘আরেকটু বাকি,’ বললেন মি. পার্কার। ‘এই দেড়শো পাউন্ড আপনার জন্যে কিছুই না। অথচ এর বিনিময়ে বন্ধুরা ফিরে পাচ্ছে আপনাকে, মুক্তি পাচ্ছে আপনার অনুগত সহকারী স্যাম, তাছাড়া ওই মহিলাকে মুক্ত করে উচিত শিক্ষা দিতে পারছেন। আপনার মহানুভবতাই যথেষ্ট, আর কোন শাস্তির প্রয়োজন পড়বে না তার। এতগুলো ভাল কাজের সুযোগ কি, স্যার, ছেড়ে দেয়া উচিত হবে; মাত্র দেড়শো পাউন্ড দুই হতচ্ছাড়ার পকেটে যাবে বলে?’
মি. পিকউইক উত্তর দেয়ার আগে দরজার বাইরে সম্মিলিত কণ্ঠের বিড়বিড়ানির এবং পরক্ষণে টোকার শব্দ শোনা গেল
‘তোমার সাথে এখন কথা বলতে পারব না, স্যাম,’ ও ঘরে ঢুকতে বললেন মি. পিকউইক।
মাফ করবেন, স্যার,’ বলল স্যাম। ‘কিন্তু এক ভদ্রমহিলা যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন!’
‘কোন্ ভদ্রমহিলা?’
স্যাম দরজাটা হাট করে খুলে দিতে, মি. নাথানিয়েল উইঙ্কল মিস অ্যারাবেলা অ্যালেনের হাত ধরে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলেন ঘরে।
‘আরে, মিস অ্যালেন যে!’ বিস্ময়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন মি. পিকউইক।
‘ভুল হলো,’ জানালেন মি. উইঙ্কল। ‘মিসেস উইঙ্কল, বন্ধু আমার।’
মি. পিকউইক নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। কিন্তু হাস্যরত স্যাম, সুন্দরী হাউজমেইড মেরি ও মি. পার্কার তো আর ভুল দেখছেন না!
‘আপনি কিছু মনে করেননি তো, মি. পিকউইক?’ অনুচ্চ স্বরে বলল অ্যারাবেলা, যেন নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করতে ভয় পাচ্ছে। ‘এভাবে হুট করে বিয়েটা হয়ে গেল?’
মি. পিকউইক চশমা খুললেন, তারপর তরুণীটির দু’হাত ধরে ক্রমাগত তাকে চুম্বন করলেন। এবার মি. উইঙ্কলকে, ‘সাহস আছে বটে জোয়ান কুকুরটার,’ বলে পিঠ চাপড়ে দিলেন।
‘বাছা আমার, অ্যারাবেলাকে বললেন মি. পিকউইক, ‘এত সব ঘটল কিভাবে? বসো, বসো, সব শুনতে চাই আমি। কতদিন হলো বিয়ের?’
‘এই সবে তিনদিন।’ লজ্জাবতী নব বধূটির হয়ে জবাব দিলেন জামাই বাবাজী।
‘মাত্র তিনদিন? তাহলে গত তিনমাস ধরে কি করছিলে, অ্যাঁ?’
‘আসলে হয়েছে কি.’ বললেন মি. উইঙ্কল, ‘অ্যারাবেলাকে পালানোর ব্যাপারে রাজি করাতে অনেক সময় লেগে গেছে। আর রাজি হওয়ার পরও মেরির সাহায্য ছাড়া কাজটা সম্ভব ছিল না।’
‘তোমার ভাই জানে?’
‘না, না,’ বলে উঠল অ্যারাবেলা। ‘ওকে কিন্তু আপনার জানাতে হবে। ও ওর বন্ধুর ব্যাপারে এত বেশি আগ্রহী ছিল যে শুনলে রেগে আগুন হয়ে যাবে। একমাত্র আপনিই পারবেন ওকে শান্ত করতে।’
‘কিন্তু তুমি, বাছা, ভুলে যাচ্ছ, আমি এখানে বন্দী হয়ে আছি,’ নম্র সুরে বললেন মি. পিকউইক।
‘না, ভুলে যাইনি,’ বলল অ্যারাবেলা। ‘কিন্তু এটুকু আশা করছি, আপনি অন্তত আমাদের সুখের জন্যে জেলখানা ত্যাগ করবেন- জানি নিজের জন্যে হলে কিছুতেই করতেন না। আমার বিশ্বাস আমার ভাই আপনার মুখ থেকে পুরো ব্যাপারটা জানলে, আমাকে ক্ষমা করে দেবে। এই দুনিয়ায় আপনজন বলতে একমাত্র ওই ভাইটাই আছে আমার, আপনি তার সঙ্গে কথা না বললে তাকেও হয়তো হারাতে হবে আমার।’
মি. পিকউইক মহাফাঁপরে পড়লেন। এবার মি. পার্কার যোগ করলেন, মি. উইঙ্কলের বাবাকেও বিয়ের কথাটা জানানো বাকি।
অগত্যা মি. পিকউইক ও স্যাম ওয়েলারের কারাভোগের পাট চুকাতেই হলো। বেলা তিনটের দিকে মি. পিকউইক তাঁর ছোট্ট কামরাটা শেষবারের মত দেখে নিয়ে, দেনাদারদের ভিড় ঠেলে মুক্ত পৃথিবীর উদ্দেশে পা বাড়ালেন। ঋণখেলাপীরা তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে রীতিমত হুলস্থুল বাধিয়ে দিল লজ গেটের কাছে এসে থেমে পড়লেন মি. পিকউইক। ‘পার্কার,’ বললেন, হাতছানি দিয়ে ডাকলেন এক যুবককে। ‘একে তো চেনোই তুমি। জিঙ্গল। মনে নেই?’
‘থাকবে না আবার?’ পাল্টা বলে, কঠোর চোখে বন্দীকে জরিপ করলেন উকিল সাহেব। ‘আপনার জন্যে কাল আসব আমি। স্যার, আর কিছু?’
‘না,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন, মাই ফ্রেন্ডস!’
মি. পিকউইককে জনতা সগর্জনে বিদায় জানাল। কেউ কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ল আবারও করমর্দন করতে, পার্কার সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কারাগার ত্যাগ করলেন মি. পিকউইক।