দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৫

পনেরো

পিউইকবাহিনী বাইশে ডিসেম্বর, মাগলটনের ব্লু লায়ন সরাইখানার উঠনে জড় হলেন ডিংলি ডেল অভিযানের জন্যে।

মি. পিকউইকের কোটে হঠাৎ আলতো টান পড়ল। এদিক সেদিক চাইতে সেই মোটা ছেলেটিকে আবিষ্কার করলেন।

‘আহা!’ বললেন ভদ্রলোক ওর দিকে চেয়ে। ‘তোমার মুখটা তো, বাছা, বেড়ে দেখাচ্ছে, একেবারে গোলাপরাঙা!’

‘আগুনের সামনে ঘুমোচ্ছিলাম কিনা,’ জবাবে বলল হোঁতকা। ‘আমার মালিক কার্ট দিয়ে পাঠিয়েছেন আপনাদের মালপত্তর নিয়ে যাওয়ার জন্যে। কয়েকটা ঘোড়াও পাঠাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে ভাবলেন যা ঠাণ্ডা আপনারা হাঁটতেই বেশি পছন্দ করবেন!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ!’ বলে উঠলেন মি. পিকউইক, ডিংলি ডেলে ঘোড়ায় চেপে যাওয়ার সুখকর (!) স্মৃতি মনে পড়তে। ‘হ্যাঁ, আমরা বরং হেঁটেই যাব! এই, স্যাম! মালগুলো ওকে নিয়ে কার্টে তুলে ফেলো তো। তোমরা রওনা হয়ে যেয়ো, আমরা গেলাম।’

মি. পিকউইক ও তাঁর বন্ধুরা পা বাড়ালেন, পরস্পর অপরিচিত স্যাম ও মোটা ছেলেটিকে পেছনে রেখে। ছেলেটিকে পরম বিস্ময়ে লক্ষ করে দ্রুত লটবহর কার্টে তুলতে লেগে গেল স্যাম। ওদিকে ছেলেটি ঠায় দাঁড়িয়ে কেবল দেখে যাচ্ছে।

‘কি হে, তিন মণ,’ কাজ সেরে বলল স্যাম, ‘কোন্ গুদামের চাল খাও, ভাই?’ ছেলেটিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফের বলল, ‘তবে চীজ বটে, ভাই, তুমি একখান!’

‘ধন্যবাদ,’ বলল কুমড়োপটাশ।

‘তোমার কোন ব্যাপারেই কোন মাথাব্যথা নেই মনে হচ্ছে?’

‘নাহ্ ‘

‘শুনে খুশি হলাম। তা, পানি-টানি কিছু খাও?’

‘চিবোতে বেশি ভাল লাগে আমার,’ বলল ছেলেটি।

‘ওহ,’ বলল স্যাম, ‘আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার। মানে বলছিলাম কি, গা গরম করতে কিছু পান-টান করবে? অবশ্য তোমার তো কখনোই ঠাণ্ডা লাগার কথা না, যেভাবে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছ।’

‘মাঝেসাঝে দু’এক ফোঁটা অবশ্য মন্দ লাগে না,’ বলল ছেলেটি।

তো দু’জনে সামান্য ড্রিঙ্ক করে কার্টে চেপে বসল।

‘চালাতে পারেন?’ মোটুর প্রশ্ন।

‘পারি বলেই তো মনে হয়,’ বলল স্যাম।

‘ধরুন তবে,’ বলল হোঁতকা, ওর হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে একটা রাস্তার দিকে আঙুল দেখাল। ‘একদম নাক বরাবর চলে যান; ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।’

কথাগুলো বলেই ঘুমে তলিয়ে গেল কুমড়োপটাশ।

কাজেই স্যাম ওয়েলার কার্ট চালনার দায়িত্ব গ্রহণ করল।

ওদিকে, পিকউইকবাহিনী খোশমেজাজে গল্পগুজব করতে করতে চলেছেন। একটা গলিতে প্রবেশ করতে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর কানে বাজল এবং অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যদের দেখতে পাওয়া গেল। সে কি আন্তরিক আতিথেয়তা! মি. ওয়ার্ডল ওখানে রয়েছেন, কী খুশিই না দেখাচ্ছে তাঁকে, রয়েছে বেলা ও তার বিশ্বস্ত প্রেমিক ট্রান্ডলও, কাল তাদের বিয়ে; আরও রয়েছে এমিলি, তার প্রিয় বান্ধবী, মিস অ্যারাবেলা অ্যালেন ও তাদের সমবয়সী জনা দশেক প্রাণোচ্ছল তরুণী।

দু’মিনিটের মধ্যে তরুণীদের সঙ্গে খোশ আলাপ জমিয়ে ফেললেন মি. পিকউইক, তাঁদের হাসি-তামাশায় মনে হলো যেন কত বছরের পরিচয়! সে রাতে আগুন ঘিরে বসে নানা ধরনের খেলা খেললেন সবাই মিলে। বিছানায় গেলে মি. স্নডগ্রাসের স্বপ্ন জুড়ে রইল শুধু এমিলি ওয়ার্ডল, ওদিকে মি. উইঙ্কল সারারাত মিস অ্যারাবেলা অ্যালেনের কাজল কালো চোখজোড়ার স্বপ্ন দেখলেন।

পরদিন হৈচৈ ও ধুপধাপ পদশব্দ শুনে ভোর নাগাদ ঘুম ভেঙে গেল মি. পিকউইকের; মোটা ছেলেটির পক্ষেও এরপর আর ঘুমানো সম্ভব হত কিনা সন্দেহ। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বিবেচনা করে বাছাই করা পোশাক পরে নিচে ব্রেকফাস্ট রূমে নেমে এলেন তিনি।

বাড়ির সমস্ত চাকর-বাকর, নয়া পোশাক পরে চারদিকে ছোটাছুটি করছে মহা ব্যস্ততায়। কনের দাদী ব্রোকেড গাউন পরেছেন, যেটি বিশ বছর অন্তত আলোর মুখ দেখেনি। মি. ট্রান্ডলের উদ্দীপনার শেষ নেই, যদিও স্বভাবতই তাঁকে কিছুটা নার্ভাসও দেখাচ্ছে। মি. ওয়ার্ডল খুশিয়াল ও নিরুদ্বিগ্ন ভাব দেখাতে চেষ্টা করে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছেন। সাদা মসলিন পরিহিতা তরুণীদের চোখে জল।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন ডিংলি ডেল গির্জার বৃদ্ধ যাজক। মি. পিকউইক কনেকে সবার আগে স্বাগত জানালেন, তার গলায় বহুমূল্য একটি চেনঅলা সোনার ঘড়ি পরিয়ে। এরপর প্রাচীন গির্জাটির ঘণ্টা যতখানি সম্ভব হর্ষধ্বনি করলে নাস্তা করতে ফিরে এল সবাই। কনের দাদী গর্বিত ভঙ্গিতে বসে রইলেন টেবিলে। তাঁর সদ্য বিবাহিতা পৌত্রী একপাশে ও মি. পিকউইক অন্যপাশে বসলেন। বৃদ্ধা পুরো এক গ্লাসভর্তি ওয়াইন পান করলেন মি. পিকউইকের সঙ্গে, অতিথির দীর্ঘজীবন ও সমৃদ্ধি কামনা করলেন। এবার কাটা হলো কেক। তরুণীরা কেকের টুকরো বাঁচাল বালিশের তলায় রাখার জন্যে; এর ফলে রাতে হবু স্বামীদের স্বপ্নে দেখবে তারা। এ ব্যাপার নিয়ে মজা করতে লজ্জায় সে কি অবস্থা মেয়েগুলোর!

ডিনারে সবাই একত্রিত হলো আবার। মি. ওয়ার্ডলের পরামর্শে ইতোমধ্যে পুরুষদের অবশ্য পঁচিশ মাইল রাস্তা হাঁটাহাঁটি করে আসতে হয়েছে। নাস্তার টেবিলে পান করা ওয়াইনের প্রভাব কাটাতে নাকি খুব উপকার দেবে পরিশ্রমটুকু। ভূরিভোজের পর বেল বাজল।

ম্যানর ফার্মের সেরা বৈঠকখানাটি যেমনি প্রকাণ্ড তেমনি আরামদায়ক; মস্ত একটা ফায়ারপ্লেস রয়েছে ঘরটিতে। এক প্রান্তে দু’জন বেহালাবাদক ও এক বীণাবাদক সুরলহরীর জমজমাট আসর বসিয়েছে।

সুর মূর্ছনায় সবাই মুগ্ধ এমনিসময় বেরসিকের মত কে একজন চিৎকার করে উঠল; ‘থামুন, থামুন। অ্যারাবেলা অ্যালেন কোথায়?’

‘আর উইঙ্কল?’ মি. টাপম্যান যোগ করলেন। ‘এই যে এখানে,’ সুন্দরী সঙ্গিনীকে নিয়ে কোণের দিক থেকে এগিয়ে এলেন মি. উইঙ্কল। কার মুখে লালিমা বেশি ছড়িয়েছে বলা মুশকিল- তাঁর নাকি রূপসী তরুণীটির? বেহালা, বীণা বেজে উঠল ফের। মি. পিকউইক মি. ওয়ার্ডলের মাকে নিয়ে ঘরময় নেচে বেড়াতে লাগলেন। তাঁর দেখাদেখি জোড়া বেঁধে অন্যরাও। এরপর সাপারের পর্ব।

পরদিন। চব্বিশে ডিসেম্বর। কাল বড়দিন। ডিংলি ডেলের প্রথা অনুসারে এদিন কিচেনে খেলাধুলোর আয়োজন করা হলো। কিচেনের ছাদ থেকে নিজ হাতে মিসলটৌ গাছের একটা ডাল ঝুলিয়ে দিলেন মি. ওয়ার্ডল। নিয়ম হলো সবাইকে চুম্বন বিনিময় করতে হবে ওটার নিচে। মি. পিকউইক বন্ধুর বৃদ্ধা মাকে আন্তরিকতার সঙ্গে চুমো খেলেন। বৃদ্ধা মহিলাটিও অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চুম্বন গ্রহণ করলেন। কিন্তু তরুণীদের কথা আলাদা। তাদের দেখা গেল ছোটাছুটি করে বেড়াতে, কিছুতেই চুমো খেতে দেবে না; আবার ঘর ছেড়েও নড়বে না। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলল তারা। কিন্তু ক’জন পুরুষ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে, তরুণীরা অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেরাই যেচে পড়ে চুমো গ্রহণ করল। মি, উইঙ্কল চুমো খেলেন অ্যারাবেলাকে, মি. স্নডগ্রাস এমিলিকে ও মি. স্যাম ওয়েলার সবকটা কাজের মেয়েকে। ধনী আত্মীয়, গরীব স্বজন, কাজের লোক ভেদাভেদ ভুলে সবাই মিলে অনুষ্ঠান উপভোগ করল। মি. ওয়ার্ডল আগুনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সন্তুষ্টচিত্তে সমস্তটা উপভোগ করলেন। মোটা ছেলেটি মওকা বুঝে, কার জন্যে জানি আলাদা করে তুলে রাখা সুস্বাদু এক টুকরো পাই মেরে দিল।

তরুণীরা একে একে মি. পিকউইককে চুম্বন করল। তারপর রুমালে চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলার আয়োজন করল। ভদ্রলোক টলমল পায়ে এক কোণে গিয়ে একজন খেলুড়েকে জাপটে ধরলে সে কি ফুর্তি সবার!

খেলা ফুরোলে সবাই মিলে ফায়ারপ্লেসটা ঘিরে গোল হয়ে বসল।

‘এবাড়ির নিয়ম হলো বারোটা বাজলে বড়দিনকে বরণ করা,’ বললেন মি. ওয়ার্ডল। ‘বাবা, আগুনটা একটু উস্কে দাও তো,’ জামাইকে বললেন ভদ্রলোক।

খড়ি নাড়ানো হলে উজ্জ্বল ফুলকি ছুটল আগুনের। ঘরটির কোণে কোণে পৌছে গেল আগুনের গনগনে দীপ্তি। সবার মুখের চেহারায় এখন ছড়িয়ে পড়েছে আশ্চর্য সুন্দর এক আভা।

বাইরে তুষারপাত হচ্ছে, শোঁ শোঁ বইছে দুরন্ত বাতাস, কিন্তু তাতে কি, ঘরের ভেতর মাঝরাত অবধি গান-বাজনা, গল্প-গুজব, হাস্য-কৌতুক চলল- এরপর মাত্র ক’ঘণ্টার জন্যে বিছানায় গেল সবাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *