দ্য পিকউইক পেপার্স – ১১

এগারো

তিন দিন পরের কথা। মি. পিকউইক হাঁটতে বেরোবেন এমনিসময় স্যাম ওয়েলার একটা কার্ড নিয়ে এল। ওতে লেখা: মিসেস লিও হান্টার, দ্য ডেন, ইটানসউইল।

‘একজন অপেক্ষা করছেন,’ বলল স্যাম।

নিচে ড্রইংরুমে গেলেন মি. পিকউইক। তাঁকে দেখে গোমড়ামুখো এক লোক লাফিয়ে উঠে গভীর শ্রদ্ধায় বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই মি. পিকউইক?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটু হ্যান্ডশেকের সুযোগ দিলে বাধিত হতাম, স্যার।

‘নিশ্চয়ই,’ বললেন মি. পিকউইক।

করমর্দন করে আগন্তুক বলে চললেন, ‘আমরা আপনার নাম অনেক শুনেছি, স্যার। আপনার খ্যাতির কথা মিসেস লিও হান্টার- মানে আমার স্ত্রীর কানেও পৌঁচেছে, স্যার। উনি বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে গর্ববোধ করেন। আপনি অনুমতি দিলে পিকউইক ক্লাবের মহান সদস্যদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিতাম।’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ জবাব দিলেন মি. পিকউইক।

‘কাল সকালে আমরা বিখ্যাত ব্যক্তিদের উদ্দেশে একটা পাবলিক ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছি, স্যার। দ্য ডেনে আপনারা যদি, স্যার, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেন- ‘

‘খুশি মনে,’ বাধা দিয়ে বললেন মি. পিকউইক।

‘মিসেস লিও হান্টার অনেকবারই এমনি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করেছেন, স্যার। উনি আবার কবিতার খুব ভক্ত। তাঁর লেখা ‘মুমূর্ষু ব্যাঙের কাব্য’ শুনেছেন আশা করি, স্যার?’

‘ঠিক মনে পড়ছে না। ‘

‘বলেন কি, স্যার!’ তাজ্জব বনে গেলেন ভদ্রলোক। ‘সাড়া পড়ে গেছিল চারদিকে। শুরুটা হলো,

‘তোমাকে দেখেছি আমি চিৎপটাং ব্যাঙ,
হাঁফাচ্ছ আকাশে তুলে দিয়ে ঠ্যাং;
মুমূর্ষু দশা দেখে দিল ফেটে যায়,
ওগো, ব্যাঙ, তুমি যে গো মরণাপন্ন প্রায়!’

‘অপূর্ব!’ মন্তব্য করলেন মি. পিকউইক।

‘হ্যাঁ, তুলনা হয় না,’ বললেন মি. লিও হান্টার। ‘কিন্তু মিসেস লিও হান্টারের কণ্ঠে অনেক বেশি ভাল শোনায়। শুনে নেবেন, স্যার, কাল সকালে উনি স্বরচিত কবিতাটি আবৃত্তি করবেন। মনে হবে বুঝি গ্রীক দেবী মিনার্ভা পড়ে শোনাচ্ছে।’

‘বাহ্!’

‘ওহো, একটা কথা তো ভুলেই গেছি- এটা ফ্যান্সি-ড্রেস ব্রেকফাস্ট, স্যার।’

‘রক্ষে করো,’ বলে উঠলেন মি. পিকউইক, নিজের দেহটি এক ঝলক দেখে নিলেন। ‘কিন্তু আমার তো মনে হয় না…’

গোমড়ামুখো এক মুহূর্ত কি যেন ভেবে তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, স্যার, আপনার মত বিখ্যাত মানুষ স্বাভাবিক পোশাকে আসলেই বোধ করি সবাই খুশি হবেন।’

‘তবে তো কথাই নেই,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আসছি আমরা।’

পরদিন সকালে মি. টাপম্যানকে ডাকাতের সাজে হাজির হতে দেখা গেল। মি. স্নডগ্রাসও কম গেলেন না। তিনি পরেছেন মধ্যযুগীয় সঙ্গীতজ্ঞের রোমান্টিক পোশাক। ওঁরা রাস্তায় নেমে এলে পথকলির দল হৈ হৈ করে স্বাগত জানাল। মি. উইঙ্কল সরাইখানা থেকে স্পোর্টসম্যানের উজ্জ্বল লাল কোট পরে বেরোতে চিৎকারে কান পাতা দায় হলো। বলতে নেই, ভদ্রলোককে আসলে ডাকপিওনের মতন দেখাচ্ছিল। সবার শেষে দেখা দিলেন মি. পিকউইক, উল্লাসে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস। অন্ধকার যুগের প্রাচীন সুট তাঁর পরনে।

দ্য ডেনে আয়োজনের ব্যবস্থা তুলনারহিত। মাঠগুলো লোকে লোকারণ্য। ইটানসউইলে এহেন সৌন্দর্য, ফ্যাশন ও খ্যাতিমান ব্যক্তির সমাহার আগে কখনও দেখা যায়নি। সর্বোপরি মিসেস লিও হান্টার তো রয়েছেনই, মেহমানদের সাদরে বরণ করছেন এবং গর্বে বুকের ছাতি ফুলে উঠছে তাঁর।

‘মি. পিকউইক,’ জনৈক ভৃত্য ঘোষণা করতে, ভদ্রলোক ডাকাত ও সঙ্গীতজ্ঞের দু’বাহু ধরে গ্রীক দেবীটির উদ্দেশে অগ্রসর হলেন।

‘কি? কোথায়?’ আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন দেবী।

‘এই যে,’ বললেন মি. পিকউইক।

‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি!’ সে কি উচ্ছ্বাস ভদ্রমহিলার।

‘জ্বী না, ম্যাডাম,’ বললেন মি. পিকউইক, যতটা সম্ভব নিচু হয়ে বাউ করলেন।

‘মি. পিকউইক,’ বললেন মিসেস লিও হান্টার, ‘কথা দিতে হবে সারাদিন আমার পাশ থেকে নড়বেন না। কয়েকশো লোককে আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আগে আমার ছোট্ট মেয়ে দুটোর সঙ্গে পরিচিত হোন। ওদের কথা ভুলেই গেছিলাম প্রায়,’ বললেন দেবী, দায়সারা ভঙ্গিতে ইঙ্গিত করলেন দু’জন যুবতীর প্রতি। একজনের বয়স বিশের কোঠায়, আরেকজন বছর কয়েকের বড়, খুকীর সাজে সেজে রয়েছে তারা।

পরিচয় পর্ব, গান-বাজনা ও মিসেস হান্টারের ‘মুমূর্ষু ব্যাঙের কাব্য’ থেকে বার দুয়েক আবৃত্তির পর অবশেষে খুলে দেয়া হলো ব্রেকফাস্ট রুম। দুদ্দাড় করে সম্মানিত অভ্যাগতরা ওখানে ঢোকার লড়াইয়ে সামিল হলেন।

মি. লিও হান্টার, এসব অনুষ্ঠানে যাঁর দায়িত্ব দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্বাগত জানানো, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন। ‘ডিয়ার, মি. চার্লস ফিটজ-মার্শাল এসেছেন।’

‘যাক বাবা, এলেন শেষ পর্যন্ত!’ বললেন মিসেস লিও হান্টার. ‘সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। ওঁকে এখানে আসতে বলো, ডিয়ার, কিছু বকুনি পাওনা হয়েছে তাঁর।

‘আসছি, আসছি,’ বলে উঠল একটি কণ্ঠ, ‘যত শিগগির পারা যায়- মানুষের ঢল- ঘর ভর্তি- কঠিন কাজ–ভীষণ।’

ছুরি-কাঁটাচামচ পড়ে গেল মি. পিকউইকের হাত থেকে। কান খাড়া হয়ে উঠেছে।

‘আহ!’ পথ করে নিয়ে এগোনোর ফাঁকে চেঁচিয়ে বলল কণ্ঠস্বরের মালিক। ‘যেন ম্যাঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি- কোটের একটা ক্রিজও বাঁচবে না- বিরক্তিকর- ভীষণ।’

ভাঙা বাক্যগুলো উচ্চারণ করতে করতে, নৌবাহিনীর অফিসারের পোশাক পরা এক যুবক টেবিলের কাছে এসে উপস্থিত হলো। বলাবাহুল্য, শ্রীমান আর কেউ নন, স্বয়ং মি. আলফ্রেড জিঙ্গল। মি. পিকউইক তো হতভম্ব।

বেচারা আগন্তুক মিসেস লিও হান্টারের হাতটা ধরার সময় পেয়েছে কি পায়নি, মি. পিকউইককে ঘৃণাভরা চোখে চেয়ে থাকতে দেখল।

‘আরি!’ বলে উঠল জিঙ্গল। ‘যাহ, একদম ভুলে গেছি- ড্রাইভারটাকে কিছুই বলে আসিনি- এক্ষুণি আসছি।’

‘কোন চাকর-বাকর কিংবা মি. হান্টারই বলে দেবে, চিন্তা করবেন না, মি. ফিটজ-মার্শাল,’ বললেন মিসেস হান্টার।

‘না-না- আমিই যাচ্ছি— এই এলাম বলে,’ জবাবে বলল জিঙ্গল, দ্রুত মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে।

‘আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি এই ভদ্রলোক কে এবং কোথায় থাকেন?’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত মি. পিকউইক বললেন।

‘উনি একজন ধনী যুবক, একটু অপেক্ষা করুন পরিচয় করিয়ে দেব,’ বললেন মিসেস লিও হান্টার।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, কিন্তু উনি থাকেন কোথায়?’

‘এমুহূর্তে বারি সেন্ট এডমন্ডসের অ্যাঞ্জেল ইনে আছেন। কিন্তু আপনি এত শিগগিরি চলে যাবেন নাকি?’

মি. পিকউইক ততক্ষণে হাঁটা ধরেছেন ভিড় ঠেলে; বাগানে মি. টাপম্যানের দেখা পেলেন তিনি।

‘লাভ নেই,’ বললেন মি. টাপম্যান। ‘ও সটকে পড়েছে।’

‘আমি যাব ওর পেছন পেছন।’

‘কোথায়?’

ঠিকানা, বললেন মি. পিকউইক। ওর জারিজুরি বন্ধ করা দরকার, নইলে আরও অনেকের অনেক ক্ষতি করবে।

তর্ক করে লাভ নেই। মি. পিকউইক মনস্থির করে ফেলেছেন। মি. টাপম্যান বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন, এবং একটি নাচ ও এক বোতল শ্যাম্পেন দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে মি. আলফ্রেড জিঙ্গল ওরফে মি. চার্লস ফিটজ-মার্শালের সমস্ত স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেললেন। ওদিকে, মি. পিকউইক স্যামকে নিয়ে কোচে চেপে তখন ছুটে চলেছেন বারি সেন্ট এডমন্ডসের উদ্দেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *