পঁচিশ
পরের দুটো দিন মহা ব্যস্ততার মধ্যে কাটল মি. পিকউইকের। প্রথমে মি. বেন অ্যালেনকে বোঝাতে হলো তার বোনের বিয়ে মি. উইঙ্কলের সঙ্গে হওয়াতে সবার জন্যেই ভাল হয়েছে, ওরা দু’জন সুখী হবে। প্রথমটায় বেন তো রেগে কাঁই, কিছুতেই মেনে নেবে না এ বিয়ে। কিন্তু পরে যখন জানা গেল, তার বন্ধু বব সয়্যার এ বিয়ের কারণে মোটেই পেরেসান নয় তখন নবদম্পতিকে সে আশীর্বাদ জানাল।
এরপর মি. উইঙ্কলের বাবাকে জানানোর পালা। এখানে অতখানি সফল হতে পারলেন না মি. পিকউইক। টাক ছাড়া অবিকল একই চেহারা বাপ-বেটার। মি. উইঙ্কলের চিঠিটা পৌঁছে দিতে বেঁটে ভদ্রলোক মনোযোগ সহকারে পড়ে ওটা ভাঁজ করে রাখলেন। তারপর চিঠির উল্টো পিঠে জর্জ অ্যান্ড ভালচার, লম্বার্ড স্ট্রীটের ঠিকানা টুকে নিলেন। মি. উইঙ্কল এখন সস্ত্রীক ওখানে অবস্থান করছেন।
‘আর কিছু দেয়ার নেই নিশ্চয়ই, মি. পিকউইক?’ শান্ত স্বরে বললেন ভদ্রলোক।
‘আর কিছু মানে?’ রাগ ও বিস্ময়ের মিশ্র অনুভূতি মি. পিকউইকের কণ্ঠে। ‘আমার বন্ধুর জীবনে এতবড় একটা ঘটনা ঘটল অথচ আপনি সে সম্পর্কে কিছুই বলবেন না? নতুন বউটাকে দোয়াও জানাবেন না? এ কেমন তরো কথা, স্যার!’
‘ভেবে দেখব,’ বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। ‘আপাতত আমার কিছু বলার নেই। আমার ছেলের সঙ্গে পরে যোগাযোগ হবে। আপনি এখন আসতে পারেন, মি. পিকউইক।’
*
শ্বশুরের সঙ্গে মি. পিকউইকের সাক্ষাতের বিবরণ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল অ্যারাবেলা। পিতা-পুত্রের বিচ্ছেদের জন্যে বুঝি সে-ই দায়ী।
‘বাছা আমার,’ সান্ত্বনার সুরে বললেন মি. পিকউইক। ‘এতে তোমার কোন দোষ নেই। কে জানত ভদ্রলোক ছেলের বিয়ের ব্যাপারে এত গোঁড়ামি করবেন? একটু ধৈর্য ধরো, ভদ্রলোককে ঠাণ্ডা মাথায় ভাববার সুযোগ দাও। কটা দিন যাক না, দেখো না উনি ছেলের চিঠির জবাব দেন কিনা। যদি না দেন তখন হাজারটা বুদ্ধি বের করে ফেলব না আমি, ঘাবড়াও মাত।
পরদিন সকালে মি. পিকউইক বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতে গেলেন মি. পার্কারের অফিসে। ভদ্রলোক বসতে না বসতেই দরজায় টোকার শব্দ এবং জিঙ্গল ও জবের প্রবেশ। মি. পিকউইককে দেখে থতমত খেয়ে থমকে গেল ওরা।
‘কি,’ বললেন মি. পার্কার, ‘ওঁকে চেনেন না মনে হচ্ছে?’
‘কি যে বলেন,’ বলে এগিয়ে এল জিঙ্গল। ‘মি. পিকউইক- কি বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব- জীবন রক্ষাকারী বন্ধু- নতুন এক জিঙ্গলের জন্ম দিয়েছেন- দেখে নেবেন, স্যার- পস্তাবেন না কথা দিচ্ছি।’
‘শুনে খুশি হলাম,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘তোমাকে অনেকটা সুস্থ দেখাচ্ছে।
‘সব আপনারই দয়া, স্যার- বিরাট চেঞ্জ- ফ্লীট জেলখানা- অস্বাস্থ্যকর জায়গা— ভীষণ,’ বলল জিঙ্গল, মাথা নেড়ে নেড়ে। সুস্থ এখন সে, পরনে পরিষ্কার পোশাক, পেছনে দাঁড়ানো জব সম্পর্কেও একই কথা খাটে।
মি. পার্কার জানালেন ওরা দু’জন সন্ধেয় লিভারপুল রওনা হচ্ছে, ওখান থেকে জাহাজে চেপে ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাত্রা করবে। মি. পিকউইকের অনুরোধে ওদের সমস্ত দেনা শোধ থেকে শুরু করে যাত্রার খরচ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে কাজের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়েছেন মি. পার্কার। ভদ্রলোক অভিযোগ করলেন, এ বাবদ প্রায় পঞ্চাশ পাউন্ড গচ্চা গেছে মি. পিকউইকের।
‘গচ্চা না,’ ত্বরিত বলল জিঙ্গল। ‘সব শোধ করে দেব- ভদ্রলোকের এক কথা— নগদানগদি- পাই-পয়সা পর্যন্ত- অবশ্য ইয়েলো ফিভার হয়ে গেলে- কিছু করার নেই- আর যদি না হয়-’ এখানটায় বিরতি নিল জিঙ্গল, চোখের ওপর হাত বুলিয়ে বসে পড়ল।
‘আচ্ছা,’ বললেন উকিল সাহেব, ‘এই চিঠিটা লিভারপুলে এজেন্টের হাতে দেবেন। আর একটা সৎ পরামর্শ দিয়ে দিচ্ছি, দয়া করে ওয়েস্ট ইন্ডিজে চালাকিটা একটু কম করবেন। ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে বললেন ভদ্রলোক মি. পিকউইককে, ‘দুটোয় ভাল মিলেছে।’
‘ভাল হোক ওদের এ কামনাই করি,’ বললেন মি. পিকউইক।
দু’বন্ধু এবার মি. ও মিসেস উইঙ্কলের প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। তাঁদের কথোপকথন বাধাপ্রাপ্ত হলো কিছুক্ষণ পর দরজায় দুমাদুম করাঘাতের শব্দে।
‘ও কি হচ্ছে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মি. পার্কার।
‘মনে হয় কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে,’ বললেন মি. পিকউইক, যেন ক্ষীণতম সন্দেহ থাকতে পারে এ ব্যাপারে!
আগন্তুক মি. পার্কারের কথার প্রত্যুত্তরে অবিরাম মারপিট করে চলল দরজাটাকে।
মি. পার্কারের কেরানী তড়িঘড়ি গিয়ে দরজা খুলতে দেখা গেল একটি ছেলে- মাংসের ডিপো বলাই শ্রেয়- দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।
‘এই, কি ব্যাপার?’ প্রশ্ন করল কেরানী।
অনন্যসাধারণ ছেলেটির মুখে কোন কথা নেই। একবার শুধু মাথা নেড়ে মৃদু শব্দে নাক ডাকাতে লাগল।
কেরানী বেচারা তিনবার একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করেও জবাব পেল না, অগত্যা দরজা লাগিয়ে দিতে গেল। এবার আচমকা দপ করে খুলে গেল হোঁতকার চোখজোড়া এবং হাত তুলল ফের দরজাটার ওপর আঘাত হানার জন্যে। কিন্তু ওটা খোলা দেখে বিমূঢ়ের মত চেয়ে রইল হাঁ করে।
‘এভাবে কেউ মানুষের দরজা ধাক্কায়?’ কেরানীর ক্রুদ্ধ জিজ্ঞাসা।
‘কি করব,’ বলল ছেলেটি, ‘মনিব যে বলে দিয়েছেন কিছুতেই থামা চলবে না।’
‘কেন?’
‘পাছে ঘুমিয়ে পড়ি। উনি নিচে আছেন। জানতে পাঠালেন মি. পার্কার অফিসে আছেন কিনা।’
সে মুহূর্তে বৃদ্ধ মি. ওয়ার্ডল নিজেই উঠে এলেন সিঁড়ি ভেঙে; ঢুকে পড়লেন মি. পার্কারের অফিসে
‘পিকউইক!’ চেঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘কেমন আছ, বুড়ো খোকা? গত পরশু মাত্র জানলাম জেলে ছিলে তুমি। পার্কার, তুমি ওকে ওই চুলোয় যেতে দিলে কেন?’
‘ঠেকাতে কম চেষ্টা করিনি, স্যার,’ মৃদু হেসে বললেন মি. পার্কার। ‘কেমন গোঁয়ারগোবিন্দ লোক জানেনই তো।’
‘সে আর বলতে,’ বললেন বৃদ্ধ ভদ্রলোক। ‘আচ্ছা, অ্যারাবেলা কেমন আছে? ওর চিঠি পেয়ে মেয়েরা জানাল পিকউইকের নাকি জেল হয়েছে আর ও নিজে পালিয়ে বিয়ে করেছে। তাই চলে এলাম। কিন্তু এতেই শেষ না। প্রেমের ষড়যন্ত্র আরও চলছে।
‘মানে?’ মি. পিকউইকের চোখ ছানাবড়া। আরও কোন গোপন বিয়ে হতে যাচ্ছে নাকি?’
‘না, না,’ বলে উঠলেন মি. ওয়ার্ডল। ‘মানে আমার মেয়ে এমিলির সঙ্গে তোমার দোস্ত স্নডগ্রাসের চিঠি চালাচালি চলছে, সেই বড়দিনের পর থেকে। পালানোর পাঁয়তারা করছিল ছুঁড়ীটা, কিন্তু পরে আবার কি ভেবে আমাকে জানাল। পাত্র খারাপ না, তাই আর আপত্তি করিনি। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই বিয়েটা হচ্ছে আরকি।’
মি. পিকউইকের আরেক বন্ধু বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন! কিন্তু আরেকটি বিয়ের ব্যাপারেও ভদ্রলোককে জড়িয়ে পড়তে হলো সেদিন সন্ধেয়। স্যামের বাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি কথা পাড়লেন।
‘আপনি তো বিয়ে-শাদীর ঘোর বিরোধী, তাই না?’ বলে আরম্ভ করলেন মি. পিকউইক।
মাথা ঝাঁকাল স্যামের বাবা।
‘আসার সময় নিচে একটা মেয়েকে দেখেছেন?’
সায় জানাল বাবা।
‘ওর নাম মেরি। কেমন লাগল মেয়েটাকে?’
‘খুব নম্র-ভদ্র বলে মনে হলো।’
‘মেয়েটার ব্যাপারে আমি আগ্রহী, মি. ওয়েলার,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘ও আপনার ছেলেকে পছন্দ করে।’
‘খুব স্বাভাবিক,’ বলল মি. ওয়েলার, ‘কিন্তু এতে ভয়েরও কারণ আছে। বাছাকে আমার সাবধান থাকতে হবে।’
‘মানে?’
‘মেয়েটাকে যেন ভুলেও কিছু বলে না বসে, বলল মি. ওয়েলার, ‘কোন দুর্বল মুহূর্তে একটা কথা-টথা দিয়ে বসেছে তো মরেছে। মেয়েরা বড় মারাত্মক জীব, মি. পিকউইক, একবার আপনার ওপর নজর পড়েছে তো আরাম হারাম করে ছাড়বে।’
‘আপনি আমাকে কথা শেষ করতে দিন,’ বললেন মি. পিকউইক। ‘শুধু যে মেয়েটাই আপনার ছেলেকে ভালবাসে তা না, আপনার ছেলেও বাসে।’
মি. ওয়েলার তো প্রথমটায় তার চোদ্দগুষ্টির কারও বিয়ের প্রশ্নেই আগ্রহী হতে নারাজ। কিন্তু মি. পিকউইক নানা যুক্তি-তর্ক দেখালেন- জোর দিয়ে বোঝালেন মেরি বিধবা নয়- ফলে শেষমেশ নিমরাজি হলো মি. ওয়েলার। এবার স্যামকে ডেকে পাঠানো হলো।
‘স্যাম,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘তোমার বাবার সঙ্গে তোমার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল।’
‘তোর ব্যাপারে, স্যামুয়েল, বলল মি. ওয়েলার।
‘আমি চোখ বুজে থাকি না, স্যাম, অনেকদিন ধরেই লক্ষ করছি তুমি মেরির প্রতি আগ্রহী।’
‘কোন ছেলের কোন সুন্দরী, ভদ্র মেয়ের প্রতি আগ্রহী হওয়াটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু না, স্যার?’
‘আমি কি বলেছি সে কথা?’ পাল্টা বললেন মি. পিকউইক।
‘হ্যাঁ, বলেছি?’ কণ্ঠ মেলাল মি. ওয়েলার।
‘তোমার বাবার যেহেতু অমত নেই আমি চাই তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক…’
‘মেয়ে যখন বিধবা না,’ ব্যাখ্যা করল মি. ওয়েলার।
‘তোমাকে এ কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেব আমি,’ মুচকি হেসে বললেন মি. পিকউইক। ‘তুমি যাতে স্বাধীনভাবে রুজি-রোজগার করতে পারো, সংসার চালাতে পারো সে দায়িত্ব আমার। তোমার জন্যে কিছু করতে পারলে আমি রীতিমত গর্ব বোধ করব, স্যাম, গর্ব বোধ করব।’
ক্ষণিকের নিশ্ছিদ্র নীরবতার পর অনুচ্চ, দৃঢ় কণ্ঠ শোনা গেল স্যামের। ‘আপনার প্রস্তাবের জন্যে আমি কৃতজ্ঞ, স্যার, কিন্তু এ অসম্ভব। আপনার কি হবে, স্যার? কে দেখবে আপনাকে?’
‘শোনো, বাছা,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘বন্ধুদের বিয়ে-টিয়ে হয়ে যাচ্ছে আমার জীবনও পাল্টে যাবে। বয়সও হচ্ছে, এখন ছুটোছুটি কমিয়ে একটু শান্তিতে বিশ্রাম নেয়ার পালা।’
‘কিন্তু যদি, স্যার, আপনি মত পাল্টান তখন কি হবে? কে থাকবে আপনার সঙ্গে সঙ্গে?’
‘আমি অনেক ভেবেচিন্তে কথা বলি, স্যাম। দেখো, আমার কথার কোন নড়চড় হবে না। বুঝে গেছি আমার ঘুরে বেড়ানোর দিন ফুরিয়েছে।’
‘ভাল কথা,’ বলল মনিবঅন্তপ্রাণ স্যাম। ‘সেজন্যেই তো আরও বেশি করে একজন সহকারীর দরকার আপনার। তা নাহলে আপনার মন বুঝবে কে, আপনার খেয়াল রাখবে কে? ঠিক আছে, আপনি যদি আমার চাইতে উপযুক্ত কোন সহকারী রাখতে চান রাখুন, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মনে রাখবেন, স্যার, বেতন দেন আর না-ই দেন এই স্যাম ওয়েলার কিন্তু আপনাকে ছেড়ে যাচ্ছে না।’
‘ছেলের কথা শোনো,’ বললেন আবেগাপ্লুত মি. পিকউইক। ‘কিন্তু খালি আমার কথা ভাবলেই চলবে, ওই মেয়েটার কথা ভাবতে হবে না?’
‘ওর কথা ভেবেই বলছি, স্যার। ওর সাথে কথা বলেছি আমি। ওকে বুঝিয়ে বলেছি। ও অপেক্ষা করতে রাজি আছে। আপনি তো আমাকে চেনেনই, স্যার। আমি একবার যখন মনস্থির করে ফেলেছি, তখন হাজার বললেও আর মত পাল্টাচ্ছি না!’