ছয়
ডিংলি ডেলের শান্ত নিস্তব্ধ পরিবেশ, নারীদের উপস্থিতি ও তাঁর স্বাস্থ্যের প্রতি তাদের উৎকণ্ঠা, মি. টাপম্যানের কোমল অনুভূতিগুলোকে চাঙা করে তুলল। তাঁর সমস্ত দুর্বলতা কেন্দ্রীভূত হলো একজনের ওপর। সন্দেহ নেই ভাতিজি দুজন সুন্দরী। কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ, আভিজাত্য ইত্যাদি বিবেচনা করলে তাদের অবিবাহিতা ফুফুর চাইতে আকর্ষণীয় নারী মি. টাপম্যান তাঁর জন্মে দেখেননি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাঁকে যখন বয়ে আনা হচ্ছিল তখন মহিলার উদ্বেগ কি শুধুই নারীসুলভ সহানুভূতি? নাকি তাঁর প্রতি বিশেষ কোন অনুভূতি থেকে উৎসারিত বিশেষ কোন কিছু? সোফায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবনাই ভেবে চলেছেন মি. টাপম্যান। এই সন্দেহগুলোর অবসান ঘটাবেন মনস্থ করেছেন তিনি।
এখন সন্ধে। মি. ট্রান্ডলের সঙ্গে হাঁটতে গেছে ইসাবেলা ও এমিলি। বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা ঘুমোচ্ছেন। মোটা ছোঁড়াটা কিচেনে নাক ডাকাচ্ছে। মি. টাপম্যান ও ফুফু বসে আছেন, স্বপ্ন দেখছেন কেবলই নিজেদের নিয়ে।
‘গাছে পানি দিতে হবে,’ এক সময় বললেন মিস ওয়ার্ডল।
‘চলুন, আমিও যাই,’ বললেন মি. টাপম্যান।
‘আপনার ঠাণ্ডা লেগে যাবে,’ আবেগের সঙ্গে বললেন ফুফু।
‘না, না। বরঞ্চ শরীরটা সারাতে কাজে দেবে। তো, অক্ষত, বাহুটা ধরে বাগানে নিয়ে গেলেন ওঁকে ফুফু।
বাগানের দূর কোণে একটি আর্বার, বাড়ন্ত লতা-পাতায় ছাওয়া। কুমারী ফুফু বড়সড় একটা পানির পাত্র ওখান থেকে নিয়ে আবার ত্যাগ করতে যাবেন, এমনি সময় মি. টাপম্যান তাঁকে পেছন থেকে টেনে ধরে নিজের পাশে বসালেন।
‘মিস ওয়ার্ডল!’ বললেন তিনি 1
কেঁপে উঠলেন কুমারী ফুফু, কেঁপে উঠল পানির পাত্রে নুড়িপাথর।
‘মিস ওয়ার্ডল,’ বললেন মি. টাপম্যান। ‘আপনি সাক্ষাৎ পরী!’
‘যাহ, মি. টাপম্যান!’ ফুফু লাল-টাল হয়ে মুখ লুকালেন।
‘না,’ বললেন এবার পিকউইক ক্লাবের ঝানু বক্তা মি. টাপম্যান। ‘আমি খুব ভাল করে জানি।
পুরুষ মানুষরা সব মেয়েকেই অমন পরী বলে,’ বিড়বিড়িয়ে বললেন ফুফু।
‘কিন্তু আপনাকে আর কারও সঙ্গে তুলনা করা যায় না,’ বললেন মি. টাপম্যান। ‘আপনার মত নারী কখনও কোথাও জন্মেছে বলুন? কোথায় পাব আমি আপনার মত সৌন্দর্য আর অসাধারণত্বের অপূর্ব সমাহার? কোথায় পাব…ওহ!’ ভাষাহারা মি. টাপম্যান বিরতি নিয়ে চাপ দিলেন মহিলার হাতে।
একপাশে মাথা কাত করলেন ফুফু। পুরুষমানুষদের বিশ্বাস নেই, মৃদু ফিসফিসানির সুরে বললেন।
‘ঠিক বলেছেন!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন মি. টাপম্যান। কিন্তু সবাই না! এই পৃথিবীতে এমন একজন আছে যে কোনদিন বদলাবে না- যে আপনার সুখের জন্যে নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করবে- যে বেঁচে আছে শুধু আপনারই চোখের মণিতে- আপনার একটু মিষ্টি হাসি যার হৃৎস্পন্দন- আপনার সামান্য ভালবাসা যার বেঁচে থাকার প্রেরণা!’
‘এমন মানুষ কি পাওয়া যাবে-’ বললেন ভদ্রমহিলা।
‘কেন যাবে না,’ পাল্টা বললেন মি. টাপম্যান। ‘তাকে তো আপনি পেয়েই গেছেন। সে তো এখানেই, মিস ওয়ার্ডল!’ মহিলার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন মি. টাপম্যান।
‘উঠুন, মি. টাপম্যান!’ বললেন র্যাচেল।
‘কক্ষনো না,’ সাহসী উত্তর এল। ‘ওহ, র্যাচেল, একবারটি বলো তুমি আমাকে ভালবাসো!’
‘মি. টাপম্যান,’ বললেন কুমারী ফুফু, লাজুক মুখটা একপাশে ফিরিয়ে। ‘আমি ও কথা বলতে পারব না; কিন্তু- কিন্তু আমি আপনাকে ফীল করি!’
কথাটা শোনামাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন মি. টাপম্যান, তারপর মিস র্যাচেল ওয়ার্ডলকে জড়িয়ে ধরে চকাস চকাস ক্রমাগত চুম্বন করতে লাগলেন। সামান্য প্রাথমিক বাধা দান করার পর মহিলা এত শান্তভাবে ব্যাপারটা গ্রহণ করলেন যে ভদ্রলোক হয়তো চিরদিনই চুম্বন চালিয়ে যেতেন, যদি না ফুফু আচমকা আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘মি. টাপম্যান, আমরা ধরা পড়ে গেছি! দেখে ফেলেছে আমাদের!’
চারদিকে চোখ বুলালেন মি. টাপম্যান। আর্বারে চেয়ে রয়েছে হোঁতকা ছেলেটি— নিথর পাথর যেন, মুখের চেহারা অভিব্যক্তিহীন। মি. টাপম্যান একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ক্রমেই নিশ্চিত হলেন কি ঘটেছে এসম্পর্কে ছেলেটির কোন ধারণাই নেই। ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসীর দেশে রয়েছে ও।
‘এখানে কি চাই তোমার?’ দৃঢ়কণ্ঠে জবাব চাইলেন তিনি।
‘সাপার তৈরি, স্যার!’ জবাব এল।
কটমট করে ওর দিকে ফের চাইলেন ভদ্রলোক। চোখের পলক পড়ছে না মোটকুর। মিস ওয়ার্ডলের বাহু ধরে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা ধরলেন তিনি। অনুসরণ করল ওঁদেরকে মোটা।
‘ও কিছুই দেখেনি,’ ফিসফিস করে বললেন টাপম্যান।
‘কিচ্ছুই না।’
‘ঘুমিয়ে কুল পাচ্ছে না।’
‘হ্যাঁ, কোন সন্দেহ নেই।’
দু’জনেই উৎফুল্ল হাসি হাসলেন।
কিন্তু মি. টাপম্যান মহা ভুল করলেন। মোটা ছেলেটি, জীবনে এই প্রথমবারের মত, ঘুমোচ্ছিল না। জেগে ছিল সে- সমস্ত ঘটনাটা দুচোখ ভরে গিলেছে।
খেলোয়াড়রা মাঠ থেকে ফিরতে অনেক দেরি করলেন। সঙ্গে করে একজন মেহমান নিয়ে এসেছেন তাঁরা। মি. জিঙ্গল নিজে থেকেই হাজির হয়েছিল ক্রিকেট মাঠে এবং অতিথিপরায়ণ মি. ওয়ার্ডলের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ডিংলি ডেলে চলে এসেছে।
খেতে বসে দলের সবার চাইতে দেড় বোতল ওয়াইন বেশি টানলেও, সবচেয়ে স্বাভাবিক দেখা গেল তাকে।
একে একে মি. পিকউইক, মি. স্নডগ্রাস, মি. উইঙ্কল ও মি. ওয়ার্ডলকে ওপরে, তাঁদের শোবার ঘরে বয়ে নিয়ে যেতে হলো। নিচে রইলেন শুধু মি. টাপম্যান, মহিলারা ও মি. জিঙ্গল।
‘কি বিচ্ছিরি ব্যাপার বলুন তো!’ বললেন কুমারী ফুফু।
‘বিরক্তিকর!’ যুবতীদের মন্তব্য।
‘জঘন্য- জঘন্য,’ বলল জিঙ্গল, মুখ হাঁড়ি তার। ‘ভয়ঙ্কর দৃশ্য— ভীষণ।’
‘কি চমৎকার মানুষ,’ ফুফু অনুচ্চ স্বরে মি. টাপম্যানকে বললেন।
‘দেখতেও দারুণ,’ ফিসফিসিয়ে বলল এমিলি।
‘ওহ, ভীষণ সুন্দর!’ বললেন ফুফু।
অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলেন মি. টাপম্যান এবং বাকি সময়টুকু মোটেই ভাল কাটল না তাঁর। আগন্তুকের গপ্পে স্বভাবে ও নম্র আচরণে মহিলারা রীতিমত মুগ্ধ। জিঙ্গলের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে অনুভব করলেন মি. টাপম্যান, তাঁর উপস্থিতি ক্রমে ক্রমে বিস্মৃত হচ্ছে নারীসমাজ।
পরদিন নাস্তার সময়ও সেই একই ঘটনা। মি. জিঙ্গল ও মি. টাপম্যানই শুধু হাজির থাকতে পারলেন পুরুষদের মধ্যে থেকে। আগন্তুক এমনই মাতিয়ে দিল মহিলাদের যে মি. ওয়ার্ডলের বৃদ্ধা মা-ও বলতে বাধ্য হলেন, ‘খুব মজার ছেলে তো।’
প্রতিদিন সকালে আবারে বসার অভ্যেস বৃদ্ধার, মোটা ছেলেটি ওখানে নিয়ে যায় তাঁকে। আজ সকালে তাঁকে বসানোর পরও মোটকুটাকে চলে যেতে না দেখে তাজ্জব বনে গেলেন তিনি। তার বদলে, ছেলেটি চারদিকে চোরা চাহনি হেনে রহস্যময় ভঙ্গিতে ফিরে এল তাঁর কাছে। কাঠ হয়ে গেলেন বৃদ্ধা- অন্যান্য বয়স্কা মহিলাদের মতন তাঁরও মনে হলো ছোঁড়া এই বুঝি হামলা করে বসবে!
‘মিসাস,’ কানের কাছে গর্জাল ছেলেটি।
এখন হয়েছে কি, মি. জিঙ্গল তখন কাছেই কোথাও হাঁটাহাঁটি করছিল। সে ছেলেটির চিৎকার শুনে একটা ঝোপের আড়ালে কান পেতে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
‘মিসাস,’ ফের চেঁচাল মোটকা, ‘আপনি শুনলে ভয় পেয়ে যাবেন।
কথাগুলো বৃদ্ধার কানে খুনীর প্রলাপ মনে হলো, সারও সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন তিনি।
‘কাল রাতে আর্বারে কি দেখেছি জানেন?’ শুধাল ছেলেটি।
‘খোদা বাঁচিয়েছে! কি? চেঁচালেন বৃদ্ধা।
‘ওই নতুন লোকটা- মানে ওই যে লোকটা গুলি খেয়েছে- জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল-‘
‘কাকে, জো? চাকরানীদের কাউকে নয় তো?’
‘তারচেয়েও খারাপ,’ কানের কাছে গর্জে উঠল হোঁদল কুতকুত।
‘আমার কোন নাতনী-টাতনী?’
‘তারচেয়েও খারাপ।
‘তারচেয়েও খারাপ!’ চেঁচিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা, মানুষের শয়তানি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁচেছে বলে মনে হলো তাঁর। ‘ভণিতা না করে বলে ফেলো তো কে ছিল সে? আমি এক্ষুণি জানতে চাই।’
চারধারে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে বুড়ীর কানে বোমা ফাটাল হোঁতকা। ‘মিস র্যাচেল!’
‘আমার মেয়ে!’ আর্তনাদ করে উঠলেন বৃদ্ধা। ‘ও বাধা দেয়নি?’
সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল ছেলেটার। ‘ওনাকেও তো চুমু খেতে দেখলাম!’
গুপ্তস্থান থেকে মি. জিঙ্গল এমনি ধরনের ক্রুদ্ধ বিস্ময়সূচক চিৎকার শুনতে পেল, ‘আমার অনুমতি না নিয়ে!’- ‘এই বয়সে’- ‘আমি মরলে তারপর না হয়…’ আরও অনেক কিছু। এবার মোটা ছেলেটিকে সে বাড়িতে ফিরতে শুনল।