দ্য পিকউইক পেপার্স – ১৬

ষোলো

সূর্যকরোজ্জ্বল অথচ ঠাণ্ডা একটি দিন হিসেবে সূচনা হলো বড়দিনের। জম্পেশ নাস্তার পর গোটা দলটা গেল গির্জায়। বিকেলে মি. ওয়ার্ডল সুপারিশ করলেন ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে আসবেন কাছের একটি জমাটবদ্ধ হ্রদে। দল ভারী করল অ্যারাবেলা অ্যালেনের ভাই মি. বেন অ্যালেন ও তার বন্ধু বব সয়্যার। দুজনেই ফুর্তিবাজ, মেডিকেল ছাত্র। বব সয়্যারকে অ্যারাবেলার প্রতি তাঁরই মত আগ্রহী দেখে বড্ড ক্ষুণ্ণ হলেন মি. উইঙ্কল, মনে আরও চোট পেলেন ওর ভাইটিকে এ ব্যাপারে উস্কানি দিতে দেখায়। এসব নিয়ে জট পাকাচ্ছেন মনে এসময় মি:

ওয়ার্ডল তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।

‘আপনি স্কেট করেন নিশ্চয়ই, উইঙ্কল?’ জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।

‘হুঁ-হ্যাঁ, ওহ নিশ্চয়ই,’ জানালেন মি. উইঙ্কল। ‘অ-অনেকদিন অবশ্য প্র্যা- প্র্যাকটিস নেই।’

‘আপনাকে কিন্তু স্কেট করতে হবে!’ আবদারের সুরে বলল কাজলচক্ষু অ্যারাবেলা। ‘আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।’

ওর কথায় সমর্থন যোগাল আরও জনা তিনেক বান্ধবী।

‘স্কেটিং করতে তো আমারও ভাল লাগে,’ বললেন মি. উইঙ্কল, কিন্তু কি করব, স্কেট আনিনি যে।

মুহূর্তে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। মি. ট্রান্ডল দু’জোড়া স্কেট এনেছেন কাজেই মি. উইঙ্কলকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে হলো, যদিও মুখটা তাঁর বেজার দেখা গেল।

মি. ওয়ার্ডল নেতৃত্ব দিয়ে একটি বরফ-হ্রদের কাছে নিয়ে এলেন সঙ্গীদের। অ্যারাবেলার ভাই ও তার বন্ধু বব তখুনি পায়ে গলাল স্কেট। প্রথমে বাঁ পায়ে তারপর ডান পায়ের ওপর চক্কর কাটতে লাগল তারা। বরফে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে চমৎকার সব নকশা কাটল দু’জনে, বাহবা কুড়াল দর্শকদের। তরুণীরা তো রীতিমত মুগ্ধ, মি. পিকউইকও উৎসাহ যোগাচ্ছেন।

শেষ অবধি, স্যামের সহায়তায় মি. উইঙ্কলের পায়ে আঁটা হলো স্কেট এবং শূন্যে উত্তোলিত হলেন তিনি।

‘যান, স্যার,’ উৎসাহে টগবগ করছে স্যাম, ‘দেখিয়ে দিন খেলা কাকে বলে!’

‘দাঁড়াও, স্যাম, দাঁড়াও!’ কাঁপতে কাঁপতে বললেন মি. উইঙ্কল, ডুবন্ত মানুষের মত আঁকড়ে ধরেছেন স্যামের বাহু। ‘এত পেছল কেন, স্যাম!’

‘বরফ তো, স্যার, পিছলা হবেই,’ বলল স্যাম। ‘নিন, এবার দাঁড়ান!’

‘এই স্কেটগুলো এত বিটকেল কেন, স্যাম?’ টাল সামলাতে চেষ্টা করে বললেন মি. উইঙ্কল।

‘কি বলব, স্যার, একজন আনাড়ি খেলোয়াড় যে পরেছেন ওগুলো,’ জবাব দিল স্যাম।

‘কই, উইঙ্কল,’ হাঁক ছাড়লেন মি. পিকউইক। ‘চলে এসো! মেয়েরা তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে!’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ বীভৎস দেখাল ভদ্রলোকের হাসিটা। এই তো, আসছি। একটু ধরবে আমাকে, স্যাম? হ্যাঁ, ঠিক আছে। বেশি জোরে না, স্যাম, আস্তে!’

স্যামের সাহায্য নিয়ে বিদঘুটে ভঙ্গিতে ভাঁজ খেয়ে রয়েছে মি. উইঙ্কলের দেহ, এমনিসময় তীর থেকে মি. পিকউইকের চিৎকার ভেসে এল। ‘স্যাম! এদিকে একটু এসো তো!’

‘ছাড়ন, স্যার,’ বলল স্যাম মি. উইঙ্কলকে। ‘যেতে দিন!’ একরকম জবরদস্তি করেই, অসহায় মানুষটির হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁকে ঠেলা দিল স্যাম। হতভাগ্য ভদ্রলোকটি বরফের ওপর দিয়ে হড়কে গেলেন, অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শনরত বব সয়্যারের উদ্দেশে। পরক্ষণে প্রচণ্ড সংঘর্ষের ফলে দু’জনেই মুখ থুবড়ে পড়লেন বরফে। বুদ্ধিমান মি. উইঙ্কল অবশ্য আর ওঠার চেষ্টা করলেন না।

চারধার থেকে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন আসছে- শুধু মি. পিকউইক নীরব। খেপে বোম হয়ে গেছেন ভদ্রলোক। স্যামকে কঠোর কণ্ঠে নির্দেশ দিলেন, ‘ওর স্কেট খুলে নাও।’

মি. উইঙ্কল টু শব্দটি না করে স্যামকে কাজটা সারতে দিলেন।

‘তোলো ওকে,’ বললেন মহান নেতা। আদেশ পালিত হলো।

বন্ধুকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন মি. পিকউইক এবং অনুচ্চ, পরিষ্কার কণ্ঠে এই কথাগুলো বললেন, ‘তুমি একটা আস্ত আহাম্মক!’ তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে গেলেন অন্যদের কাছে।

ওদিকে স্যাম ও মি. ওয়ার্ডলের কুমড়োপটাশটা বরফে নানা ভেল্কি দেখাতে লেগেছে। দাঁড়িয়ে থেকে ঠাণ্ডা মেরে গেছেন মি. পিকউইক, পাইডারদের রীতিমত হিংসে হচ্ছে তাঁর। ‘গা গরম করার দারুণ খেলা, কি বলো,’ মি. ওয়ার্ডলকে বললেন।

সায় জানালেন ভদ্রলোক। ‘তুমিও খেলো না কেন।’

‘প্লীজ, মি. পিকউইক,’ কলকণ্ঠে বলে উঠল তরুণীরা।

‘তোমাদের আনন্দ দিতে পারলে খুব ভাল লাগত,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘কিন্তু গত তিরিশ বছরে পাইডিং করিনি যে।’

‘তাতে কি,’ বলে স্কেট খুলে ফেললেন মি. ওয়ার্ডল। ‘এসো, আমার সঙ্গে এসো।’ খোশমেজাজী ভদ্রলোক প্রায় স্যামের সমান গতি তুলে ছুটে গেলেন। মি. পিকউইক থমকে দাঁড়ালেন, কি যেন ভাবলেন, তারপর দস্তানা খুলে হ্যাটে গুঁজলেন; দু’তিনবার ছোট দৌড় দিয়ে শেষ পর্যন্ত আরেকবার দৌড়ে নিয়ে ধীর, মসৃণ গতিতে পাইড করে চললেন। তাঁর খেলা দেখে চারদিক থেকে ভেসে এল হর্ষোৎফুল্ল দর্শকদের চিৎকার।

একে একে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন মি. স্নডগ্রাস, স্যাম, মোটা ছেলেটি ও অন্যান্য যুবকরা।

খেলা যখন তুঙ্গে, পাইডিং যখন দ্রুততম, হাসাহাসির শব্দ জোরালতম, এসময় হঠাৎ ফাটল ধরার একটা তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা গেল। তীরের দিকে দ্রুত ধাবমান সবাই, আর্তচিৎকার জুড়েছে মহিলারা! বরফের মস্ত একটা চাঁই গায়েব হয়ে গিয়ে পানির বুদ্বুদ ছাপিয়ে উঠেছে।

সার্ফেসে ভাসছে মি. পিকউইকের হ্যাট, দস্তানা ও রুমাল, কিন্তু এছাড়া তাঁর আর কোন চিহ্ন নেই।

মুহূর্তে হতাশা ও বিষাদ গ্রাস করল সবাইকে। মহিলাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে। মি. স্নডগ্রাস ও মি. উইঙ্কল পরস্পরের হাত চেপে ধরে তাঁদের মহান নেতার অন্তর্ধান স্থানটির দিকে বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে রয়েছেন। মি. টাপম্যান, তাৎক্ষণিক সাহায্য দানের জন্যে, মাঠ-ময়দানের ওপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন, ‘আগুন! আগুন!’

মি. ওয়ার্ডল ও স্যাম ওয়েলার গহ্বরটার দিকে তখন সাবধানী পায়ে এগোচ্ছেন, একটি মুখ, মাথা ও একজোড়া কাঁধ পানির নিচ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখতে পেলেন। মুখমণ্ডল ও চশমা জোড়া মহান নেতা মি. পিকউইকের বলে চেনা গেল।

‘এক মুহূর্তের জন্যে একটু ওঠো- মাত্র এক মুহূর্তের জন্যে, অনুনয় করলেন মি. স্নডগ্রাস।

‘হ্যাঁ, মিনতি করছি আমি- আমার খাতিরে একটু উঠুন,’ চিৎকার করে বললেন মি. উইঙ্কল। এই মিনতির কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ আর কারও খাতিরে উঠতে অস্বীকৃতি জানালেও নিজের খাতিরে ঠিকই উঠতে চাইতেন মি. পিকউইক।

‘তুমি কি থই পাচ্ছ?’ প্রশ্ন করলেন মি. ওয়ার্ডল।

‘হ্যাঁ,’ শ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করছেন ভদ্রলোক। ‘চিত হয়ে পড়েছিলাম। প্রথমটায় উঠতে পারছিলাম না।

হোঁতকা ছেলেটির সহসা মনে পড়ে গেল এখানে পানি মাত্র পাঁচ ফিট গভীর, এবং পরক্ষণে বিপুল বিক্রমে মি. পিকউইককে উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হলো। সে কি সাহস সবার! রাজ্যের পানি ছিটিয়ে, রীতিমত যুদ্ধ করে ডাঙায় তোলা হলো ভদ্রলোককে।

‘ইস, বেচারা ঠাণ্ডায় জমে মরবে,’ বলল অ্যারাবেলা।

নিমেষে ডজন খানেক শাল এগিয়ে এল। চাদর মুড়ি দিলেন মি. পিকউইক এবং মি. ওয়ার্ডলের পরামর্শে, বাড়ি পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা একবারও না থেমে দৌড়ে এসে, বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়লেন। স্যাম ঘরে আগুন উস্কে দিয়ে তাঁর ডিনার নিয়ে এল। পরে পানশ আনা হলো এবং তাঁর ফাঁড়া কাটার খুশিতে বড়সড় এক পার্টির আয়োজন করা হলো। বন্ধুবর ওয়ার্ডল তাঁকে বিছানা থেকে নড়তে দেবেন না বলে সবাই এসে চারপাশে জড় হলো। বিছানায় জবুথুবু হয়ে বসে রইলেন ভদ্রলোক, আরও দু’বার পানশ গলাধঃকরণ করলেন। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে আগের মত ঝরঝরে বোধ করলেন তিনি, প্রমাণ হলো ঠাণ্ডার মহৌষধ হচ্ছে গরম পানশ- অবশ্য যথেষ্ট পরিমাণে সেবন করলে তবেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *