দ্য পিকউইক পেপার্স – ২৬

ছাব্বিশ

পিকউইকের কামরায় যখন এসব আলোচনা চলছে, তখন একজন বেঁটে মত বৃদ্ধ, ভদ্রলোক সরাইখানায় পৌঁছে ঘর ভাড়া নিলেন। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি মিসেস উইঙ্কল নামে কেউ এখানে উঠেছে কিনা। ওয়েটার হ্যাঁ বাচক উত্তর দিল।

‘সে কি একা আছে?’

‘মনে হয়, স্যার,’ বলল ওয়েটার। ‘আপনি বললে, স্যার, তাঁর সঙ্গে যে মেইডটা আছে তাকে ডাকতে পারি…’

‘না, মেইডকে দরকার নেই আমার, ত্বরিত বললেন বৃদ্ধ। ‘আমাকে ওর ঘরটা দেখিয়ে দাও।’ ওয়েটারের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে তার হাতে পাঁচটা শিলিং গুঁজে দিলেন ভদ্রলোক।

‘কিন্তু, স্যার,’ আপত্তির সুরে বলল ওয়েটার, ‘কাজটা কি ঠিক হবে….

‘আহ, অযথা সময় নষ্ট কোরো না তো,’ উষ্মা প্রকাশ পেল বৃদ্ধের কণ্ঠে। ‘দেখতেই পাচ্ছি দেখিয়ে দেবে তুমি।

ওয়েটার এবার পয়সাগুলো পকেটে ফেলে, তাঁকে ওপরে নিয়ে গেল সুড়সুড় করে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক টোকা দিলেন দরজায়।

‘আসুন,’ বলল অ্যারাবেলা।-

‘বাহ, গলাটা তো ভারী মিষ্টি,’ আওড়ালেন বৃদ্ধ, ‘কিন্তু তাতে কি?’ দরজা খুলে গটগট করে প্রবেশ করলেন ভেতরে। অচেনা মানুষ দেখে দাঁড়িয়ে গেছে অ্যারাবেলা।

‘উঠতে হবে না,’ বললেন আগন্তুক। ‘মিসেস উইঙ্কল তো?’

বাউ করল অ্যারাবেলা।

‘বার্মিংহামের এক বুড়োর ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে যার?’ বলে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আগন্তুক।

অ্যারাবেলা আবার বাউ করল।

আগন্তুক এবার বসে পড়ে চশমা পরলেন। অ্যারাবেলার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে সংকোচ বোধ করতে লাগল মেয়েটি।

‘তোমার সবে বিয়ে হয়েছে তো?’

‘জ্বী।’

‘স্বামীকে একবারও বলেছিলে এ ব্যাপারে তার বাপকে জানানো উচিত, যার উপর সে নির্ভরশীল?’

‘ভুলটা আমারই, স্যার।’ বিনীত কণ্ঠ অ্যারাবেলার।

‘স্বামীকে সাহায্য করার মত তেমন কোন সহায়-সম্পত্তি কি আছে তোমার?’

ছেলেবেলায় মা-বাপ হারানো এতিম অ্যারাবেলা তার অসহায়ত্ব ও অজ্ঞানতার কথা তুলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

‘কাজটা মোটেই ঠিক হয়নি,’ মৃদু স্বরে বললেন বৃদ্ধ।

‘সব দোষ আমার, স্যার, সব দোষ আমার,’ ফোঁপাচ্ছে অ্যারাবেলা।

‘ধুর বোকা,’ আদুরে ধমক দিলেন বৃদ্ধ। ‘ও তোমার প্রেমে পড়লে তোমার কি দোষ? অবশ্য কেন ও নিজেকে সামলাতে পারল না সেজন্যে তোমাকে দোষ দেয়া যায় বৈকি।’ মুচকি হাসি বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে।

প্রশংসাটুকু শুনে কান্নার মাঝেই হাসি ফুটল অ্যারাবেলার মুখে।

‘তোমার স্বামী কোথায়?’

‘একটু বাইরে গেছে। এখুনি ফিরবে,’ বলল অ্যারাবেলা। ‘জোর করে ওকে হাঁটতে পাঠিয়েছি। বাবার কাছ থেকে কোন খোঁজ-খবর না পেয়ে বড্ড মুষড়ে পড়েছে বেচারা।’

‘ঠিক হয়েছে! যেমন কর্ম তেমনি ফল!’

বুড়ো একথা বলতে না বলতেই ঘরে প্রবেশ করলেন মি. উইঙ্কল।

‘বাবা, তুমি!’ হতচকিত মি. উইঙ্কল বলে উঠলেন। অ্যারাবেলা তো থ, হাসবে না কাঁদবে বুঝে উঠতে পারছে না।

‘জ্বী, স্যার,’ বললেন খাটোকায় বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি। ‘তা, স্যার, আমাকে কিছু বলার আছে আপনার? নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন আশা করি?’

মি. উইঙ্কল স্ত্রীর বাহুতে বাহু জড়ালেন। ‘মোটেই না, আমি কোন ভুল করিনি।’

‘বেশ, বেশ,’ চেঁচিয়ে উঠলেন বৃদ্ধ।

‘তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি খুবই দুঃখিত, বাবা,’ বললেন মি. উইঙ্কল। ‘কিন্তু একই সঙ্গে এও বলব তোমারও উচিত ছেলের বউকে মেনে নেয়া।’

‘তোর হাতটা দে, নাথানিয়েল,’ গলার সুর পাল্টে গেছে বুড়োর। ‘বউ মা, এসো, আমার কাছে এসো। তোমাকে আমার- খুব পছন্দ হয়েছে, মা!’ অ্যারাবেলার বুকটা ভরে গেল খুশিতে। অনাথা মেয়েটা এতদিনে একজন সত্যিকার মুরুব্বী পেল।

মি. উইঙ্কল ছুটলেন মি. পিকউইককে ডেকে আনতে। তিনি এলে দুই ভদ্রলোক একটানা পাঁচ মিনিট পরস্পরের হাত ঝাঁকিয়ে গেলেন।

‘মি. পিকউইক, আপনি আমার ছেলের হয়ে কথা বলতে গিয়ে অপমানিত হয়েছিলেন,’ বললেন বৃদ্ধ মি. উইঙ্কল। ‘আসলে তখন আমি ভীষণ আপসেট ছিলাম। পরে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে গিয়ে নিজের ওপরই রাগ হলো। আমি আপনার কাছে কোন্ মুখে ক্ষমা চাইব, মি. পিকউইক?’

‘এসব কি বলছেন আপনি!’ বলে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘এই শুভ মুহূর্তে এসব কথা কেন? আপনি ছেলেকে মাফ করে দিয়েছেন, ছেলের বউকে গ্রহণ করেছেন এর চাইতে সুখের আমার কাছে আর কি হতে পারে?’

.

বৃদ্ধ মি. উইঙ্কল পৌছনোর পর থেকে পরবর্তী এক হপ্তা, সারা দিন বাইরে বাইরে কাটালেন মি. পিকউইক স্যামকে নিয়ে। কি এক রহস্যের ও গাম্ভীর্যের নির্মোক পরে রয়েছেন দু’জনে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তলে তলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটছে। মি. পিকউইকের বন্ধুরা অতিষ্ঠ হয়ে শেষ অবধি ঠেসে ধরলেন তাঁকে, ব্যাখ্যা দাবি করলেন এ হেন আচরণের।

মি. উইঙ্কল বন্ধু-বান্ধবদের ডিনারের দাওয়াত দিয়ে প্রসঙ্গটা তুললেন। ‘আমরা জানতে চাই,’ বললেন তিনি, ‘আমরা কি এমন অন্যায় করেছি যে আপনি আমাদের ছেড়ে এভাবে বাইরে বাইরে থাকছেন?’

‘অবাক কাণ্ড,’ বললেন মি. পিকউইক, ‘আমি নিজেই আজ সব খুলে বলব ঠিক করেছিলাম। আসল ঘটনা হলো, আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের জীবনধারায় যেহেতু পরিবর্তন আসছে আমারও তাই নতুন করে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে। ভেবে দেখলাম, লন্ডনের কাছাকাছি কোন একটা শান্ত, নিরিবিলি এলাকায় অবসর কাটানো দরকার। সেজন্যে ডালউইচে একটা বাগানবাড়িও কিনে ফেলেছি। স্যাম যাচ্ছে আমার সাথে, আরও লোকজনও নেব। আমার ইচ্ছে ছোট্ট একটা অনুষ্ঠান করে বাড়িটার উদ্বোধন করব। আমার বন্ধু ওয়ার্ডল আপত্তি না করলে আমি চাই তার মেয়ের সঙ্গে স্নডগ্রাসের বিয়ের উৎসবটা আমার বাড়িতেই হোক।’ বলাবাহুল্য, মি. ওয়ার্ডল সানন্দে রাজি হলেন।

কথাগুলো বলে গ্লাস ভরে নিয়ে ওয়াইন পান করলেন ভদ্রলোক, এবং বন্ধুরা উঠে দাঁড়িয়ে অন্তর থেকে তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করলেন।

চারদিন পর বিয়ে। বর উঠেছেন মি. পিকউইকের বাসায়। নির্ধারিত দিনে ডালউইচ গির্জায় আনুষ্ঠানিকতা সুসম্পন্ন হওয়ার পর মি. পিকউইকের বাড়িতে সবাই ফিরলেন ব্রেকফাস্টের জন্যে।

সুসজ্জিত বাড়িটা উৎফুল্ল মানুষ-জনের উপস্থিতিতে সরগরম। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন মি. পিকউইক। আজ যেন তাঁর আনন্দের বাঁধ ভেঙেছে; একই লোকের সঙ্গে বারবার করে করমর্দন করছেন ভদ্রলোক।

কিছুদিন পর মি. উইঙ্কল, তাঁর বন্ধুর খুব কাছাকাছি একটা বাড়ি কিনে উঠে পড়লেন। ভদ্রলোক ইদানীং খেলোয়াড়ী পোশাক বর্জন করে ইংরেজ ভদ্রলোকের জন্যে মানানসই ড্রেস পরতে শুরু করেছেন। এতে করে তাঁকে পুরোমাত্রায় ভদ্রস্থ দেখায় এখন।

মিস্টার ও মিসেস স্নডগ্রাস একটা ফার্ম কিনে ডিংলি ডেলে বাস করছেন। মি. টাপম্যান লজিং নিয়েছেন রিচমন্ডে। গরমকালে প্রায়ই নদীতীরে হাঁটতে যান ভদ্রলোক। হাসিখুশি, প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর তাঁকে দেখে অনেক বয়স্কা কুমারী পটে বসে থাকলেও বিয়ের কথা আর ভুলেও মুখে আনেন না তিনি।

স্যাম ওয়েলার তার কথা রক্ষা করেছে, দু’বছর বিয়ে করেনি। এরপর মি. পিকউইক আর কোন ওজর-আপত্তি কানে তোলেননি। ক’বছর পর থেকে দুটো নাদুসনুদুস বাচ্চাকে প্রায়ই বাড়ির পেছন গেটে দেখা যেতে লাগল। লোকে বোঝে, ও, তারমানে স্যাম আর মেরি চুটিয়ে সংসার করছে!

মি. পিকউইক নতুন বাড়িতেই বাস করছেন। প্রায়ই একত্রিত হন পুরানো বন্ধুরা। মি. পিকউইক শরীরে শক্তি পান না আর আগের মত, কিন্তু তাই বলে উৎসাহ-উদ্দীপনার কোন কমতি নেই তাঁর। প্রায়ই হাঁটতে বেরোন তিনি, স্যামের বাচ্চাদের ভীষণ ভালবাসেন, তারাও তাঁকে অসম্ভব ভালবাসে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে চমৎকার সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন ভদ্রলোক। প্রতি বছর মি. ওয়ার্ডলের পারিবারিক পার্টিতে হাজির থাকেন তিনি। বলাবাহুল্য, যথারীতি এখানেও তাঁর ছায়াসঙ্গী বিশ্বস্ত স্যাম ওয়েলার। তাঁদের মধ্যে যে আন্তরিকতা, যে বোঝাপড়া তাতে চিড় ধরানোর সাধ্য মৃত্যু ছাড়া আর কারও নেই।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *