সাত
দৈব ঘটনা হলেও একথা সত্যি, ম্যানর ফার্মে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মি. জিঙ্গল সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে কুমারী ফুফুর মন জয় করবে। তার স্বভাব-ব্যবহার পছন্দ করেছে ফুফু বুঝতে বেগ পেতে হয়নি, এবং মহিলার নিজস্ব মাল-পানি আছে এতেও কোন সন্দেহ নেই। প্রতিদ্বন্দ্বীকে ত্বরিত অপসারণ করা জরুরী উপলব্ধি করে সে কাজে নেমে পড়ল তৎক্ষণাৎ।
বাসায় ফিরে ফুফুকে পার্লারে একা পেল ও। গলা খাঁকরাল জিঙ্গল। মুখ তুলে চেয়ে স্মিত হাসলেন ফুফু। জিঙ্গলের চরিত্রে কোন ইতস্তত ভাব নেই। সে ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল।
‘মিস ওয়ার্ডল,’ বলল আকুল স্বরে। ‘মাফ করবেন- সামান্য পরিচয়- আনুষ্ঠানিকতার সময় নেই— সব জানাজানি হয়ে গেছে!’
‘স্যার!’ বললেন ফুফু, মি. জিঙ্গল পাগল কিনা বুঝতে চাইছেন।
‘আস্তে!’ ফিসফিস করে বলল জিঙ্গল। ‘মোটা ছোঁড়া- গোল মুখো- অপোগণ্ড!’ সে মাথা ঝাঁকাতে শিউরে উঠলেন ফুফু
‘জোসেফের কথা বলছেন?’ শান্ত হতে চেষ্টা করে বললেন মহিলা।
‘হ্যাঁ, ম্যাম- ছোঁড়া বদের হাড্ডি! বিশ্বাসঘাতক- আপনার মাকে সব বলে দিয়েছে- ভদ্রমহিলা রেগে আগুন- হিংস্র- উন্মাদিনী- আর্বার- টাপম্যান- জড়াজড়ি- চুমোচুমি- জানাজানি।
‘মি. জিঙ্গল,’ বললেন ফুফু, ‘আপনি এখানে আমাকে অপমান করতে এসেছেন?’
‘ছি ছি- কি বলেন- সবই শুনলাম- আপনাকে সাবধান করতে এলাম- সাহায্য করতে- ঝামেলা থেকে বাঁচাতে…’
‘কি করব আমি?’ ফুফু বেচারী বললেন, ভেঙে পড়লেন কান্নায়। ‘আমার ভাই জানলে আমাকে আস্ত রাখবে না!’
‘তা তো ঠিকই; বলল জিঙ্গল। ‘বলে দেবেন ছোঁড়া স্বপ্ন দেখেছে। এটা বলাই সবচেয়ে সোজা- বদমাশ ছোঁড়া- অপূর্ব মহিলা- মোটা ছোঁড়ার পিঠে বেত- আপনার কথায় সবার বিশ্বাস- সব ঝামেলা খতম- সব ঠিকঠাক।
সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর মওকা পেয়ে বেশি খুশি হয়ে উঠলেন মহিলা- নাকি জিঙ্গলের মুখে ‘অপূর্ব মহিলা’ শুনে ঠিক জানা নেই আমাদের। লাজরাঙা মুখখানি তুলে কৃতজ্ঞচিত্তে জিঙ্গলের দিকে চাইলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস পড়ল জিঙ্গলের, ফুফুর মুখে দু’মুহূর্ত দৃষ্টিনিবদ্ধ রেখে হঠাৎ চোখ সরিয়ে নিল।
‘আপনাকে অসুখী মনে হচ্ছে, মি. জিঙ্গল,’ বললেন ফুফু। ‘কারণটা জানতে পারি?’
‘হা!’ বলে উঠল জিঙ্গল। ‘কারণ? যাকে আপনি মন দিলেন সে-ই কিনা এখন আপনার আপন ভাতিজির পেছনে লেগেছে- কিন্তু না! ও আমার বন্ধু। ওর কেলেঙ্কারির কথা বলা উচিত না আমার। মিস ওয়ার্ডল- আসি!’ চোখে রুমাল চাপা দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল জিঙ্গল।
‘দাঁড়ান, মি. জিঙ্গল!’ পিছু ডাকলেন ফুফু। ‘আপনি মি. টাপম্যানকে ইঙ্গিত করলেন! কি বলতে চান খুলে বলুন, প্লীজ!’
‘না, তা হয় না!’ নাটুকে ভঙ্গিতে বলে উঠল জিঙ্গল। ‘কক্ষনো না!’ আর কোন প্রশ্ন করা হোক চায় না বোঝাতে একটা চেয়ার টেনে ফুফুর কাছ ঘেঁষে বসল।
‘মি. জিঙ্গল,’ বললেন ফুফু, ‘আমি মিনতি করছি— অনুরোধ করছি! মি. টাপম্যান সম্পর্কে কিছু জানা থাকলে আমাকে বলুন, প্লীজ!’
‘আমি দেখতে পাচ্ছি,’ ফুফুর মুখে চোখ রেখে বলল জিঙ্গল, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি- সুন্দরী নারী- লোভের কাছে- আত্মদান করছে।’ ক’মুহূর্ত লাগল তার আবেগ চাপা দিতে, তারপর অনুচ্চ, ভারী স্বরে বলল, ‘টাপম্যান- শুধু আপনার- টাকাকে ভালবাসে।’
‘ইতর!’ ঘৃণায় কুঁচকে গেল ফুফুর মুখ।
‘আরও আছে,’ বলল জিঙ্গল, ‘সে আরেকজনকে ভালবাসে- আপনার ভাতিজি এমিলিকে।
সাময়িক বিরতি। কুমারী ফুফুটির কাছে সে মুহূর্তে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম মানুষটি হচ্ছে তাঁরই আপন ভাতিজি এমিলি। রাগে লাল হয়ে মাথা ঝটকা মারলেন মহিলা।
‘মিথ্যে কথা! আমি বিশ্বাস করি না!’
ওদের ওপর চোখ রাখুন,’ বলল জিঙ্গল।
‘রাখব।’
‘টেবিলে দেখবেন ও এমিলির পাশে বসবে
‘বসুক।’
‘ওকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে।’
‘বলুক।’
‘আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবে।’
‘করুক!’ বলে ফেলে পরক্ষণে আর্তনাদ ছাড়লেন ফুফু। ‘দুর্ব্যবহার? আমার সঙ্গে?’ রাগে, হতাশায় কাঁপতে লাগলেন।
‘আপনি ভেঙে পড়বেন না তো?’ থমথমে গলায় প্রশ্ন করল জিঙ্গল।
‘না।’
‘ওকে বিয়ে করবেন?’
‘কক্ষনো না!’
‘আর কাউকে গ্রহণ করবেন?
‘নিশ্চয়ই।’
‘করবেন?’ মি. জিঙ্গল ধপ করে নতজানু হলো, পাঁচটা মিনিট রইল তেমনিভাবে, উঠে যখন দাঁড়াল তখন সে মিস ওয়ার্ডলের বরণ করা প্রেমিক- এই শর্তে যে, টাপম্যানের বিশ্বাসঘাতকতা প্রমাণিত হতে হবে।
মি. আলফ্রেড জিঙ্গল সেদিনই ডিনারের টেবিলে প্রমাণ উপস্থাপন করল। ফুফু নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারলেন না। মি. ট্রেসি টাপম্যান এমিলির পাশে বসে সত্যিই গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করছেন আর কেবল থেকে থেকে হাসি উপহার দিচ্ছেন। কাল রাত অবধি যে মহিলা তাঁর মনের মণিকোঠায় ছিলেন তাঁর সঙ্গে না একটা কথা না একবার চাহনি বিনিময়।
‘হতচ্ছাড়া ছোঁড়া,’ ভাবলেন মি. ওয়ার্ডল, মার কাছ থেকে কাহিনীটা জেনেছেন তিনি। ‘ও নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছে!’
‘বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান!’ ভাবলেন মিস ওয়ার্ডল। ‘ভালমানুষ মি. জিঙ্গল আমাকে মিথ্যে বলেননি। ওফ! মানুষ এত নীচ, এত ছোটলোক হতে পারে!’
নিচের আলোচনাটুকু পাঠ করলে, পাঠকরা মি. টাপম্যানের রাতারাতি এহেন অদ্ভুত আচরণের একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পেলেও পেতে পারেন।
সেদিন সন্ধেয় বাগানে হাঁটতে গেলেন মি. টাপম্যান ও মি. জিঙ্গল।
‘কেমন করলাম?’ শুধালেন মি. টাপম্যান।
‘ওহ, দারুণ- আমি নিজেও অত ভাল অভিনয় করতে পারতাম না- কালও চালাবেন- প্রত্যেক সন্ধ্যায়।’
‘র্যাচেল এখনও চাইছে?’
‘নিশ্চয়ই- পছন্দ করে না- কিন্তু করতেই হবে- ভাইয়ের ভয়ে অস্থির- আর তো মাত্র কটা দিন- তারপর আর কোন চিন্তা নেই
‘ও কোন খবর পাঠিয়েছে?’
‘ভালবাসা- অন্তরের গভীরতম ভালবাসা- চিরন্তন প্রেম-
‘বন্ধু আমার,’ বললেন সরলমনা মি. টাপম্যান, ‘ওকেও আমার বুকচেরা ভালবাসা পৌঁছে দেবেন— কতটা কষ্ট হচ্ছে আমার বুঝিয়ে বলবেন- কিন্তু এ-ও বলবেন আজ সকালে ওর যে প্ল্যানটা আপনি আমাকে জানিয়েছেন সেটা যে কতখানি জরুরী তাও বুঝতে পারছি। বলবেন, ওকে একান্ত আপনার করে পাওয়ার জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে চলেছি।’
‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আর কিছু বলতে হবে?’
‘ওহ, বন্ধু আমার,’ সঙ্গীর হাত চেপে ধরে বললেন বেচারা মি. টাপম্যান, ‘আপনার সহযোগিতার জন্যে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। কোনদিন কি শোধ করতে পারব এই ঋণ, বন্ধু আমার?’
‘আমাকে লজ্জা দেবেন না,’ বলল মি. জিঙ্গল। থেমে পড়ল ও, যেন হঠাৎ একটা কিছু মনে পড়ে গেছে। ‘আচ্ছা, ইয়ে…মানে দশটা পাউন্ড ধার দিতে পারেন? খুব জরুরী প্রয়োজন- তিন দিনের মধ্যে ফেরত দেব।’
‘মনে হয় পারব,’ কৃতজ্ঞ মি. টাপম্যান বললেন। ‘তিন দিন বললেন তো?’
‘মাত্র তিন দিন- ঝামেলা চুকে যাবে- অসুবিধে থাকবে না।’
পকেটস্থ করল টাকাটা জিঙ্গল। বাড়ির দিকে ফেরার সময় ফিসফিসিয়ে বলল ও, ‘সাবধান থাকবেন। ভাতিজির দিকে যেন মন থাকে খেয়াল রাখবেন- ফুফুটাকে পাত্তাই দেবেন না- এ ছাড়া ওঁর ভাই আর মার চোখকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব নয়।’
‘সে আর বলে দিতে হবে না, বন্ধু,’ জোরাল স্বরে বললেন মি. টাপম্যান। ‘বুঝবে মজাটা,’ মনে মনে বলল জিঙ্গল।
সেদিন সন্ধেবেলা সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটল- এবং তার পরের তিন দিনও। মি. ওয়ার্ডলের খুশির অন্ত রইল না, কারণ তিনি স্থির নিশ্চিত মি. টাপম্যানের বিরুদ্ধে মোটা ছেলেটির অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাকবাকুম করছেন মি. টাপম্যানও, জিঙ্গল তাঁকে আশ্বাস দিয়েছে শীঘ্রিই একটা হিল্লে হবে তাঁর প্রেমের। জিঙ্গল আর মিস ওয়ার্ডলও মহাখুশি, তার কারণ বর্ণিত হবে পরবর্তী অধ্যায়ে।