৫-৬. একমাত্র সাহসী ছেলে নবুর সঙ্গে পরিচয়

০৫. একমাত্র সাহসী ছেলে নবুর সঙ্গে পরিচয়

রবিদের গোটা বাড়িতে রাতুল একমাত্র সাহস দেখলো নবু নামের ছেলেটার। রবি ওর কথা যতোটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিলো, ওকে দেখার পর রাতুলের ধারণা পাল্টে গেলো। বয়সে সামান্য বড় হবে, চমৎকার পেটানো শরীর। আর রবিদের বড় পুকুরটা আধঘন্টার ভেতর সাঁতার কেটে দুবার এপার-ওপার করে। কাঠবেড়ালির মতো তরতর করে নারকেল গাছ বাইতে পারে। নৌকা চালায় ঝড়ের মতো।

ওর সঙ্গে রাতুলের দেখা হলো এ বাড়িতে আসার দুদিন পর। নবু মঠবাড়িয়া গিয়েছিলো ফুটবল খেলতে। সন্ধেবেলা এলো সারা গায়ে ধুলো-কাদা মেখে। রাতুলকে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো। সঙ্গে সঙ্গে রাতুলেরও ওকে ভালো লেগে গেলো।

গত দুদিন ধরে রোজ সন্ধেবেলা দোতলার বারান্দায় বসে নাদুখালা পান চিবুতে চিবুতে ভূতের গল্প শোনান। যেদিন নবু এলো সেদিনও রাতুলরা বারান্দায় মাদুর পেতে ভূতের গল্প শুনছিলো। আস্ত একটা পান মুখে ফেলে খানিকটা চিবিয়ে ঢক করে পিকটুকু গিলে ফেলে নাদুখালা বললেন, তোমরা হলে শহরের ছেলে। তেনাদের দেখবে কি করে। গাঁয়েও কি সবাই দেখে নকি! দেখেছিলেন নবুর দাদা। এক রাতে ঘাটে বসে এশার নামাজের ওজু করছেন। আকাশে ফকফকে জোছনা ছিলো। হঠাৎ দেখেন পুরোনো গোরস্থানের ভেতর একজন মানুষ হাঁটছে। ভাবলেন অন্য গাঁয়ের কেউ হবে, পথ ভুলে সেখানে চলে গেছে। নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। এ গাঁয়ের কেউ রাতে পুরোনো গোরস্থানে যায় না। নবুর দাদা ঘাটের ওপর উঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে গো, কোত্থেকে এসেছে, যাবে কোথায়? লোকটা কোনো কথা না বলে রাজবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো। সাহস ছিলো বটে নবুর দাদার। বদনী হাতে লোকটার পিছু নিলেন। বারবার বললেন, তুমি কথা কও না কেন? ওদিকে কেন যাচ্ছো? লোকটা তবু কথা বলে না। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পুরোনো বাড়ির কাছে যখন এসেছে তখন নবুর দাদার ভারি রাগ হলো। পা চালিয়ে কাছে গিয়ে বললেন, তুমি চোর না ডাকাত! রা করো না কেন? এমন সময় মানুষটা ফিরে তাকালো। আল্লা গো! তিনি তখন দেখেন লোকটার কোনো চোখ নেই। চোখের জায়গাটা সমান। লোকটা মাথা নোয়ালো। নবুর দাদা পষ্ট দেখলেন, মাথা ভর্তি অনেকগুলো চোখ জুলজুল করছে। সে কি চাহুনি! নবুর দাদাকে যেন গিলে খাবে। বদনাটা লোকটার দিকে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে তিনি বাড়ির দিকে ছুটলেন। ঘরের দরজার ওপর এসে বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। সবাই ধরাধরি করে বিছানায় এনে শোয়ালো। তিনি সেই যে বিছানা নিলেন আর উঠলেন না। দুবছর পর বেহেশতে চলে গেলেন।

গল্প শেষ করে মস্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাদুখালা আরেক খিলি পান মুখে দিলেন।

আমাদের সঙ্গে গল্প শুনতো আবেদালি। রবিদের অনেকগুলো গরু ছিল। সেই গরুদের দেখাশোনা করতো আবেদালি। বিরাট দশাসই শরীর। গায়ে ভীষণ জোর। দাঁত দিয়ে নারকেল ছিলতো, ঘুষি মেরে কাঁচা ডাব ফাটাতো। সেই লোকটা ভূতের গল্প শুনে এতো ভয় পেতো যে, দেখে রাতুলের মায়া হতো। গল্প শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ওর মনে হতো এই বুঝি আবেদালি ভির্মি খাবে। বুকে থুথু ছিটিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতো। কখনো ও নিজেই বলতো রাজবাড়ি আর পুরোনো গোরস্থানের ভূতের গল্প। গল্প শেষ হতেই বলতো, মুই আর কইতে পারুম না। নাদুখালা আপনেই কন।

সেদিন এমনি এক জমজমাট গল্পের আসরের মাঝখানে এলো নবু। নাদুখালা বেনুদার মার মতো নবুকে নিয়ে পড়লেন–রাত-বিরেতে না এলে বুঝি ঘুম হতো না। যে চুলোয় দুরাত থাকা হয়েছে, সেখানে কি তিনরাত থাকা যেতো না! তোকে এতোবার বলেছি সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরবি না, একদিনও কি আমার কথা কানে তুলতে নেই?

নবু আড়চোখে একবার রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কিছু হবে না মা। তুমি মিছেমিছি ভয় পাও।

ফের তর্ক করিস? তোকে আমি খড়মপেটা করবো। তোর জুলপি ছিঁড়ে ফেলবো। ফুটবলটাকে বটি দিয়ে কুচি কুচি করে কাটবো। তবে যদি আমার রাগ যায়।

তাতেও রাগ যাবে না। ওসব কাজ পরে কর। আগে খেতে দাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে। এই বলে নবু আমাদের সঙ্গে বসলো।

নাদুখালা গজগজ করতে করতে উঠে গেলেন। রাতুলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো নবু। বললো, তুমি নিশ্চয়ই রাতুল। খালাকে রবি যতোগুলো চিঠি লিখেছে, সবগুলোতে তোমার কথা আছে।

রবি মুখ গোমড়া করে বললো, আমার চিঠি তোকে কে পড়তে দিয়েছে শুনি? মাকে বলে তোকে যদি মার না খাওয়াই।

নবু হাসলো–মার খাওয়া যে আমার জন্য ডালভাত, তুই ভালো করেই জানিস। এরপর নবু গম্ভীর হয়ে বললো, শহরে গিয়ে তুই গ্রামের কথা একেবারে ভুলে গেছিস রবি একটা চিঠিতেও আমার কথা জানতে চেয়ে লিখিস নি।

রবি অপ্রস্তুত হয়ে বললো, তোর কথা জানতে চাওয়ার আগেই তো মা সব লিখে জানিয়ে দেন। এই যে তুই পরীক্ষায় ফেল করলি–মা গত চিঠিতেই লিখেছিলেন।

ফেলের কথা শুনে নবুর অপ্রস্তুত হওয়ার পালা–আমাকে কতো কাজ করতে হয় জানিস? ঠিকমতো পড়ার সময় পেলে তো!

কাজ তো শুধু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। কার আছাড় খেয়ে কোমর ভেঙেছে, সদরে নিয়ে যাও। কার মামলার তারিখ পড়েছে, সদরে নিয়ে যাও। কোথায় জমি নিয়ে মারপিট হবে, লাঠি নিয়ে যাও। সারা বছর এসব করলে পড়ার সময় পাবি কখন?

নবু গম্ভীর হয়ে বললো, তুই ভালো করেই জানিস, মানুষের আপদে-বিপদে কেউ ডাকলে আমি না গিয়ে পারি না।

রবি ফোড়ন কাটলো, পৃথিবীর সব আপদ যদি তুই দুর করবি–ফেল করার জন্যে দুঃখ করিস কেন?

রাতুল এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। রবি যেভাবে নবুকে খোঁচাচ্ছিলো, ওর ভালো লাগছিলো না। রবিকে বললো, তুই কিন্তু নবুর কথা আগে কখনো আমাকে বলিস নি। তারপর নবুকে বললো, এ বাড়িতে এসে অব্দি ভূতের গল্প শুনতে শুনতে হয়রান হয়ে গেছি। তোমার খেলার খবর বলো। জিতলে না হারলে?

নিজের বাড়িতে নবু এই প্রথম এমন একজনের দেখা পেলো, যে ওর খেলার খবর জানতে চেয়েছে। ভাবলো, রাতুলের মতো আমার যদি একটা বন্ধু থাকতো! সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ওরা শহরের ছেলে, ওর মতো গেঁয়ো ছেলেকে পছন্দ করবে কেন? রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সেও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদু হেসে বললো, ফুটবলে আমাদের তুষখালিকে হারাবে এ তল্লাটে কেউ আছে নাকি! খেলতে গেছি মঠবাড়িয়ায়। সেখানেও রাজবাড়ির ভূত। ওদের গেম টিচারকে বলতে শুনেছি, আমার ওপর নাকি রাজবাড়ির ভূত সওয়ার হয়েছিলো। নইলে ডবল হ্যাঁট্রিক করলাম কি করে!

রবি রাতুলকে বললো, নবু তোর মতো, জ্বীন ভূত বিশ্বাস করে না।

আবেদালি এতোক্ষণ ওদের কথা শুনছিলো। রবির কথা শুনে ওর রাগ হলো–তেনাগো নিয়া মশকরা হরণ ভালো না। যেদিন অপঘাতে মরবে হেইদিন নবুদাদা বুজবেহেনে। এই বলে সে উঠে চলে গেলো।

আবেদালির কথার ধরন দেখে নবু আর রাতুল কোরাসে হাসলো। রবিও হাসলো, যদিও ওর মোটেই হাসি পাচ্ছিলো না। মনে মনে ও কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছিলো এই দুই অবিশ্বাসীকে নিয়ে। নবু একা হলে নাদুখালাকে বলে শায়েস্তা করা যেতো। রাতুলকে কিছু বললে বেনুদা আস্ত রাখবেন না। তাছাড়া ও এ বাড়ির মেহমান। মনে মনে ও রাজবাড়ির জ্বীনের উদ্দেশ্যে বললো, আপনাদের নিয়ে আমি কখনো হাসি-ঠাট্টা করি নি। আমার ওপর আপনারা রাগ করবেন না।

নবু রাতুলকে উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে বিকেলের ফুটবল ম্যাচের কথা বলছিলো। এমন সময় বেনুদা এসে বললো, মুন্সিবাড়িতে রাতে মিলাদের দাওয়াত। আমাদের নেমন্তন্ন করেছে।

মিলাদে যাওয়ার কথা শুনলে রাতুলের গায়ে জ্বর আসে। মুখ কালো করে বললো, আমারা না গেলে হয় না বেনুদা? শরীরটা বেশি ভালো লাগছে না।

বেনুদা মৃদু হাসলো, বুঝেছি। তোমার ছেঁড়াদিও যাচ্ছে না। রবি তৈরি হয়ে নে। এরপর কৈফিয়তের সুরে বললো, আমাদের পীরের বংশ। কারো বাড়ির মিলাদে না গেলে গ্রামে দশ কথা উঠবে।

রাতুল ব্যস্ত গলায় বললো, না না, ঠিক আছে। আপনারা যান। নবুও যাবে নাকি?

নবুর অবশ্য মিলাদে যেতে আপত্তি নেই। তবে রাতুল যাবে না শুনে ও বেনুদাকে বললো, রাতুল বাড়িতে একা থাকবে। আমি কি যাবো?

তুই থাক তাহলে। এই বলে বেনুদা রবিকে নিয়ে চলে গেলো।

নাদুখালা উঠে যাওয়ার পরই গল্পের আসর ভেঙে গেছে। রবি চলে যাওয়ার পর দোতালার বারান্দায় রাতুল আর নবু ছাড়া আর কেউ রইলো না। রাতুল বললো, মিলাদের উপলক্ষটা কি?

নবু হাসলো, এ গাঁয়ে মিলাদ পড়ানোটা রুটিন। খাবিস জ্বীনের আসর থেকে বাঁচার জন্য যাদের সামর্থ্য আছে তারা ফি হপ্তায় মিলাদ পড়ায়। আমাদের মসজিদের হুজুর ইমামতি করে যা পান, সারা মাস মিলাদ পড়িয়ে তার চেয়ে বেশি পান।

রবিদের সদর পুকুর পাড়ের মসজিদে এশার নামাজের আজান পড়লো। নিচের তলা থেকে নাদুখালা ডাকলেন, নবু, রাতুলকে নিয়ে খেতে আয়।

নবুর সঙ্গে খেতে বসে রাতুলের মুখে হাসি আর ধরে না। নাদুখালা যতোবার ওর পাতে খাবার তুলে দেন, রাতুল লুকিয়ে সেগুলো নবুর পাতে পাচার করে দেয়। নবুর পাতের দিকে নাদুখালার মোটেই নজর নেই। জানেন, ওকে তুলে দিতে হয় না। খাওয়ার পর নাদুখালা মুখ টিপে হেসে বললেন, এ্যাদ্দিনে রাতুলকে খাইয়ে সুখ পেলাম।

নবু হাসতে গিয়ে বিষম খেলো। নাদুখালা ওর মাথায় থাবড়া মারতে মারতে বললেন, অসময়ে কোন মুখপোড়া তোর কথা মনে করলো! খবরদার, রাতুলরা যদ্দিন আছে কোথাও যাবি না।

নবুর বিষম খাওয়ার কারণ রাতুলের জানা থাকলেও, মুখখানা এমন ভালো মানুষের মতো করে রাখলো, যেন ও কিছুই জানে না।

খেয়ে উঠে ওরা দোতলার ছাদে গিয়ে বসলো। নবু বললো, রবি আসার আগে নিচে নেমে যেতে হবে। রাতে ছাদে উঠেছি জানলে মা আমাকে আস্ত রাখবে না।

নবুর মার খাওয়ার কথা রবিও কয়েকবার বলেছে। ওর জন্য রাতুলের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বললো, তোমাকে বুঝি নাখালা খুব মারেন?

বারে, কথা না শুনলে মারবে না! পরীক্ষায় খারাপ করেছি বলে বেনুদা কি কম মেরেছে?

পরীক্ষায় ভালো করলে না কেন নবু?

রাতুলের সমবেদনাভরা কথা নবুর মন ছুঁয়ে গেলো। বললো, রবি কি বললো, শোন নি?

শুনেছি। মানুষের বিপদে তুমি সাহায্য করো, এটা খুবই ভালো কথা। তবে লেখাপড়া শিখে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তখন অনেক বেশি সাহায্য করতে পারবে।

রাতুলের কথা শুনে ম্লান হাসলো নবু। বললো, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে বলেই বলছি রাতুল। রবিদের বাড়িতে আমরা আশ্রিতের মতো আছি। বেনুদা, রবি শহরে থাকে। এ বাড়ির খাজনা, কাঁচারি, মামলা সব কাজ নিয়ে আমাকেই সদরে দৌড়াতে হয়। পরীক্ষার কদিন আগেও তিনদিন সদরে গিয়ে থাকতে হয়েছিলো। কাজ করতে আমার এতোটুকু কষ্ট হয় না। তবে পড়ার সময় ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায় না। এবার অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন শুনি নিকেরিপাড়ায় কলেরা লেগেছে। ওরা বললে আসবে না, তই গঞ্জে গিয়ে আমাকেই ডাক্তার আনতে হলো। এ গায়ে লেখাপড়ার চল মাত্র চার-পাঁচটা বাড়িতে আছে। যারা লেখাপড়া করে তারা সবই হয় বরিশাল, নয় ঢাকায় গিয়ে থাকে। রবিকেই দেখ না। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার আগেই গা ছেড়ে চলে গেলো।

রাতুল বললো, তোমার ইচ্ছে করে না শহরে গিয়ে পড়াশোনা করতে?

ইচ্ছে তো করেই। ম্যাট্রিকে ভালো করতে পারলে ডাক্তারি পড়বো আমি। তবে বেনুদার মতো শহরে চাকরি করবো না। গাঁয়েই থাকবো। আমার তো বেশি পয়সা কামানোর দরকার নেই। মা আর আমি–মাত্র দুজন। এই বলে একটু ইতস্তত করলো নবু। তারপর বললো, তুমি যদি কিছু মনে না করো আমি একটা সিগারেট খাবো। বাড়িতে লুকিয়ে খেতে হয়।

রাতুল হেসে বললো, খেতে পারো। মনে করার কি আছে। একবার আমি বড়দার কৌটো থেকে একটা টেনে দেখেছিলাম।, ভালো লাগে নি।

নবু সিগারেট ধরিয়ে বললো, রবিকে আবার বলে দেবে না তো?

আমাকে তোমার ওরকম মনে হয় নাকি!

না না, এমনি বললাম।

রবি কিন্তু জানে তুমি যে সিগারেট খাও!

তোমাকে বলেছে বুঝি! কি জানি, কখনো আড়াল থেকে দেখেছে হয়তো।

ও তো বাড়িতে বলে দিতে পারে।

এমনিতে বলবে না। আমি ওর কোনো কথা না শুনলে বলতে পারে। আর বললেই বা কি। একটু পিটুনি খেতে হবে। ওসব আমার গা-সহা হয়ে গেছে।

না খেলেই তো পারো।

আসলে কি জানো, সারাক্ষণ আমাদের কাদা-পানিতে থাকতে হয়। তাই একটু বিড়ি-তামাক না খেলে শরীরে জুত লাগে না। গাঁয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে আমার বয়সী তুমি একজনও পাবে না, যে বিড়ি-তামাক খায় না।

নবু বুঝতে পারলো ওর সিগারেট খাওয়াটা রাতুলের পছন্দ হয় নি। তাই … একটু পরে হেসে বললো, যখন শহরে যাবো, তখন সিগারেট খাওয়া ছেড়ে … দেবো।

রাতুলের খুব ভালো লাগলো, ওর পছন্দ-অপছন্দকে নবু গুরুত্ব দিচ্ছে বলে। হাত বাড়িয়ে হেসে বললো, কথা দিচ্ছো তাহলে।

রাতুলের হাতে হাত রেখে নবুও হেসে ফেললো–কথা দিলাম।

দুদিনের ভেতর রাতুলের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে গলো নবু।

.

০৬. রবিকে জব্দ করার ষড়যন্ত্র

নবুর সঙ্গে রাতুলের বেশি মেলামেশা রবির মোটেই ভালো লাগে নি। ওর ভয় নবু রাতুলকে সিগারেট খাওয়া শেখাবে, নিকেরিপড়ায় নিয়ে গিয়ে আজেবাজে লোকের সাথে মিশবে, খারাপ খারাপ কথা বলবে, রাজবাড়ির জ্বীনদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে। এসব ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠলো রবি। রাতুলের যদি কিছু-একটা হয়ে যায়, ওদের বাড়ি গিয়ে মুখ দেখানো যাবে না।

নবু যখন ছিলো না, আবেদালি রাতুলকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যেতো, বিকেলে নৌকায় করে বেড়াতে নিয়ে যেতো। বলা ছিলো আবেদালি যেন সব সময় রাতুলের সঙ্গে থাকে। নবু আসার পর আবেদালি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। ওর কাজগুলো মহা আনন্দে নবু নিজের ঘাড়ে তুলে নিলো। রবি বহুদিন পরে বাড়ি এসেছে। ওকে প্রায় আত্মীয়-স্বজন কিংবা প্রতিবেশীদের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যেতে হয়। রাতুল মাত্র দুরাত গিয়েছিলো, তাও ছোড়দির বকুনির পর।

যেদিন রবিদের চরের জমি নিয়ে কি-এক পুরানো মামলার শুনানির জন্য ও আর বেনুদা দুদিনের জন্য বরিশাল গেলো–নবু-রাতুলকে পায় কে! রবি অবশ্য রাতুলকেও নিয়ে যেতে চাইলো। বললো, তোর কোনো অসুবিধা হবে না। কাকাদের বিরাট বাড়ি রয়েছে বরিশালে। একবয়সী ছেলেমেয়েও পাবি। মেজকাকার মেয়ে আছে একটা। ক্লাস এইটে পড়ে। ভীষণ সুন্দর দেখতে, চমৎকার গান গায়। চল, পরিচয় করিয়ে দেবো।

রাতুল তবু যায় নি। বলেছে, তোদের বাড়িতে যে কদিন আছি সাঁতার আর নৌকা চালানোটা ভাল করে শিখতে চাই। তাছাড়া সবাই চলে গেলে ছোড়দি একা হয়ে যাবে।

শুনে রবির ভারি রাগ হলো। মনে মনে বললো, ছোড়দির চিন্তায় যে ঘুম হচ্ছে না সে তো ভালো করেই জানি। আল্লা জানে দুই শয়তান মিলে কি অঘটন ঘটায়!

রবি চলে যেতেই রাতুল আর নবু হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়লো। নবু বললো, দুদিন মন খুলে কথা বলা যাবে। রাতুল বললো, যা খুশি তাই করা যাবে।

নবু বললো, এতোদিন খালে নৌকা বেয়েছি। আজ চলো নদীতে যাই।

বেশ তো চলো। নবুর কোনো কথাতেই রাতুল গর-রাজি নয়।

দুপুরে খেয়েই ওরা দুজন বেরিয়ে পড়লো। রবিদের বাড়ি থেকে মাত্র দশ মিনিটের পথ মরাখাকি খাল। আবেদালির কাছে রাতুল শুনেছে এই খালের পাড়ে হিন্দুদের শ্মশানঘাট ছিলো। এখান থেকে অবশ্য বেশ দূরে। যারা গরিব, ভালোমতো পোড়াতে পারতো না, আধপোড়া করে খালে ভাসিয়ে দিতো। মড়া খাওয়ার জন্য নদী থেকে কুমির চলে আসতো খালে। তখন থেকে এই খালের নাম মরাখাকি। একবার নিকেরিদের জালে ধরা পড়েছিলো একটা বুড়ো কুমির। এখন অবশ্য শ্মশানঘাট সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেশ্বরীর তীরে।

পৌষের শেষে ভরদুপুরেও রোদের এতোটুকু তেজ নেই। দুপাশে ন্যাড়া ধানক্ষেতের ভেতর খালটা নদীতে গিয়ে মিশেছে। নবুই বৈঠা বাইছিলো। রাতুলের হাতের ব্যালেন্স মোটামুটি ঠিক হলেও বৈঠা মারার কায়দা এখনো পুরো রপ্ত করতে পারে নি। বৈঠা বেশি ডুবিয়ে ফেলে বলে অল্পক্ষণের ভেতর ওর হাঁপ ধরে যায়, নৌকাও চলে আস্তে।

আধঘন্টার মধ্যে ওদের নৌকা বলেশ্বরীতে এসে পড়লো। বেশ চওড়া নদী। ঢাকার বুড়িগঙ্গার চারগুণ হবে।

নবু বললো, সুন্দরবন এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

রাতুল বললো, রবি যে বলছিলো, নদীর ওপারেই সুন্দরবন?

ঠিক ওপারে নয়। নবু মৃদু হেসে বললো, এখান থেকে নৌকায় এক ঘন্টা ভাটির দিকে যেতে হবে।

রাতুল বুঝলো, রবির একটু বাড়িয়ে কথা বলার স্বভাব আছে। বললো, ওদের রাজবাড়িটা কি নদী থেকে দেখা যায়?

এখনো কিছুটা যায়। মাথা নেড়ে সায় জানালো নবু। শুনেছি যখন ওটা বানানো হয়, তখন নাকি নদীর ওপরই ছিলো।

একবার যাবে ওখানে?

নবু মুখ টিপে হেসে বললো, ভয় পাবে না তো!

কেন, কিসের ভয়!

রবি তোমাকে বলে নি জ্বীন থাকে ও-বাড়িতে!

তুমি জ্বীন-ভূত বিশ্বাস করো?

নবু আগের মতো হেসে বললো, আল্লাকে যখন মানি, জ্বীন অবিশ্বাস করি কি করে! জ্বীনের কথা কোরানেও আছে।

তুমি কি মনে করো রাজবাড়িতে জ্বীন আছে?

আমি কখনো কিছু দেখি নি। কয়েকবার গিয়েছিলাম ওদিকটায়।

নৌকা নিয়ে চলো না, গিয়ে দেখি।

ওদিকেই যাচ্ছি। তবে নামতে পারবে না। নদীর ধারটায় অসম্ভব কাঁটাঝোঁপ। সাপের ভয়ানক উৎপাত।

রবি তো বলে ওগুলো সাপ নয়, জ্বীন। জ্বীনরা নাকি সাপের চেহারা ধরে রাজবাড়িতে থাকে।

লোকজন ওরকমই বলে। তবে যে যাই বলুক, সাপের জাতটাকে আমি বিশ্বাস করি না। গত বর্ষায় দুটো গোখারো মেরেছি।

তুমি কি কোনো কিছুকেই ভয় পাও না নবু?

কে বললে পাই না? হেসে নবু বললো, অঙ্ক ভীষণ ভয় পাই। অঙ্কের স্যারকে আরো বেশি।

নবুর কথার ধরন দেখে রাতুলও হো হো করে হেসে উঠলো। নদীর তীরে কাদার মধ্যে কয়েকটা বক একপায়ে দাঁড়িয়ে মাছ ধরার ধ্যানে মগ্ন ছিলো। ওদের হাসির শব্দে ওগুলো ঝটপট ডানা মেলে উড়ে গেলো। রাতুল মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।

একটু পরে নবু বললো, রাজবাড়ি দেখতে পাচ্ছো? বাঁ দিকের তালগাছগুলোর ওপাশে দেখো।

ঘন গাছগাছালির জন্য ভালোমতো দেখা যাচ্ছিলো না। আট-দশটা তাল গাছ খুব কাছাকাছি বেড়ে উঠেছে। সেগুলোর ডানপাশ দিয়ে যাতোটুকু দেখা গেলো, সেটাকে রাজবাড়ি না বলে কোনো প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ বলা ভালো।

নবু বললো, দক্ষিণ পাশটা একেবারেই ধসে গেছে। উত্তর দিকের অংশে ওপরে নিচে কয়েকটা ঘর এখনো অক্ষত আছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়েছে প্রায় দেড়ঘন্টার মতো হবে। রাতুল বললো, এবার নৌকা ফেরাও নবু। বাড়ি যেতে যেতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে।

দুপুরবেলা বেরিয়েছিলো বলে ওরা কেউ গরম কাপড় আনে নি। আকাশে রোদ থাকলেও নদীর কনকনে বাতাসে বেশ শীত করছিলো। নৌকো খালে ঢুকিয়ে নবু বললো, কিছুক্ষণ বৈঠা বাও, শীত লাগবে না।

নবু একটা বৈঠা হালের মতো ধরে রইলো। রাতুল বৈঠা বাইলো। আধঘন্টার মধ্যে শীত কোথায় পালালো! রীতিমতো ঘেমে উঠলো রাতুল। নবু বললো, বৈঠা মারার কায়দা রপ্ত করতে আরে কদিন লাগবে।

সূর্য ডোবার আগেই ওরা বাড়ি ফিরলো। তবু নাদুখালার বকুনি খেতে হলো–গরম কাপড় নিয়ে বেরোয় নি বলে। নবুকে বললেন, জানি, তোকে আজরাইলে নেবে না। শহরের কচি ছেলেটাকে কেন ঠাণ্ডার ভেতর তোর মতো সূতির জামা একটা পরিয়ে ঘোরাতে নিলি?

রাতুল বললো, আমার একটুও শীত করছে না নাদুখালা।

তা তো বলবেই। নবুর পাল্লায় যখন পড়েছে তখন খালিগায়ে থাকলেও শীত করবে না। মুখ-হাত ধুয়ে ওপরে যাও। তোমাদের চা-নাশতা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বেনুদারা নেই। সন্ধ্যে না হতেই সদর দরজায় খিল পড়েছে। রাতুলকে বেনুদার মা আর নাদুখালা বারবার বলে দিয়েছেন সন্ধ্যের পর মুহূর্তের জন্যেও একা যেন বাড়ির বাইরে না যায়। এমনকি খিড়কির পুকুর ধারে যাওয়াও বারণ। আবেদালি ঘরে ঘরে দুটো করে হারিকেন জ্বেলে দিয়েছে। নিচে ছোড়দিকে দেখার জন্য রবিদের কোন আত্বীয়-কুটুম্ব এসেছে। বাড়িটা বেশ ভরা ভরা লাগছিলো, যদিও ওপরে ওরা দুজন মাত্র। রাতে অবশ্য সিঁড়ির পাশের ঘরে আবেদালি আর কামলা সালাম থাকে। রাতুলের যদি কিছু দরকার হয় তাই এই ব্যবস্থা। নইলে আবেদালিও নিচে থাকে।

খাওয়ার জন্য শুধু রাতুলদের নিচে নামতে হয়। সেদিন রাতে ওরা তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘরে এসে ভারি লেপের তলায় ঢুকলো। হঠাৎ করে শীত বেড়ে গেছে। রাতুল বললো, সাইবেরিয়া থেকে আসছে এই বাতাস।

নবু বললো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জাহাজে করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অজানা সব দেশে ঘুরি।

রাতুল বললো, কি আশ্চর্য, আমারও তো তাই ইচ্ছে করে! রবি তো বলেছে বড় হলে ও জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে।

নবু গম্ভীর হয়ে বললো, না না, রবির জাহাজে ওঠা যাবে না। ও যা ভীতু! নির্ঘাত আমাদের ডুবিয়ে মারবে।

রাতুল ওর কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়লো।

বেনুদারা যে দুদিন বরিশাল ছিলো, সময় যে কিভাবে হুট করে ফুরিয়ে গেলো রাতুল টেরই পেলো না। পরদিন নবু ওকে নিকেরিপাড়ায় নিয়ে গিয়েছিলো। নবুর সঙ্গে রাতুলকে দেখে ওরা ভারি খুশি। রাতুল ওদের মাছ ধরা দেখলো। আসার সময় বড়বাড়ির কুটুম্বের জন্য জোর করে মস্তবড় এক ভেটকি মাছ দিয়ে দিলো। মাছ দেখে নাদুখালাও খুশি।

এর পরদিন বিকেলে এলো রবি আর বেনুদা। রবি মহা উত্তেজিত–কাকাদের বাড়িতে ছেলেমেয়েরা সবাই নাকি নাটক করেছে। বললো, ভাবী এসেছে শুনে সবাই বেনুদাকে ধরেছে সামনের সপ্তায় লঞ্চ রিজার্ভ করে আসবে। এখানে এসে নাটক দেখাবে।

এতোবড় উত্তেজনার খবর শুনে রাতুল মোটেই উত্তেজিত হলো না। রবির মান রাখার জন্য শুধু বললো, তোর জন্য পার্ট রাখবে না?

শুনে রবি আরো উত্তেজিত–আমার পার্ট আমি লিখে নিয়ে এসেছি। কলকাতা থেকে মেজকাকার ছেলে মণিদা ডি এল রায়ের শাহজাহান নাটক এনেছে। ওটাই করা হবে।

নবু বললো, ওসব হচ্ছে বড়লোকী নাটক। গত শীতে আমরা আমাদের স্কুলে শরৎচন্দ্রের মহেশ করেছিলাম।

রবি টিটকিরি মেরে বললো, মহেশের পার্ট নিশ্চয়ই তুই করেছিলি?

নবু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, কি যা তা বলছিস! আমাদের বাংলার স্যার ওই গল্পটাকে নাটক বানাতে গিয়ে অনেক বাড়িয়েছিলেন। আমি করেছিলাম কারখানার শ্রমিকের পার্ট।

মণিদাদের নাটক দেখলে তোর চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।

ঠিক আছ দেখা যাবে, বলে মুখ টিপে হেসে নবু নিচে নেমে গেলো।

গত দুদিনে রাতুল আর নবুর অন্ধুত্ব কতো গম্ভীর হয়েছে, রাতে টের পেলো রবি। ও যখন ছিলো না, তখন নবু ওপরে রাতুলের সঙ্গে থেকেছে, এমনিতে নবু নিচে থাকে। খেয়ে উঠে ওরা তিনজন রবির ঘরে এসে বসলো আড্ডা দেয়ার জন্য। রবি ভেবেছিলো শোয়ার সময় হলে নবু নিচে চলে যাবে। তার আগে রাতুল ওকে বললো, রবি, নবু আমাদের সঙ্গে থাকুক না। এতোবড় খাট, চারজনও শুতে পারবে।

রবি মনে মনে বিরক্ত হলেও বললো, থাক না, অসুবিধে কি! তবে নাদুখালা, নিচে একা থাকবেন।

নবু বললো, মাকে তাহলে বলে আসি। আমি যখন তোকে পাহারা দেয়ার জন্য ওপরে থাকি, তখন যে পুষ্প বুজি মার কাছে থাকে, ভুলে গেছিস বুঝি!

নবু আসার সময় ওর লেপ নিয়ে এলো। রবি বললো, জানালা খোলা থাকলে আমি ঘুমোতে পারবো না। নবু, জানালা বন্ধ করে দে।

গত দুদিন রাতুল জানালা খুলে শুয়েছিলো। রবির কথা শুনে নবু রাতুলের দিকে তাকালো। রাতুল বললো, ঠিক আছে, বন্ধ করে দাও। রবির যখন এতো ভয়, কি করা যাবে।

রবি বললো, কাল থেকে কেমন শীত পড়েছে টের পাচ্ছিস না?

নবু জানালা বন্ধ করে খাটের এক কিনারে এসে শুলো। মাঝখানে শুলো রাতুল। হঠাৎ ওর মনে পড়লো, রবি যে রাজবাড়ির গুপ্তধনের কথা বলেছিলো, সে কথা নবুকে বলা হয় নি। এ দুদিন একবারও মনে হয় নি কথাটা। নবুকে বললো, রাতে কখনো পুরোনো গোরস্থানে গিয়েছো?

নবু বললো, রাতে যাবার কথা কখনো ভাবি নি। তবে দিনে অনেক গেছি। শেয়াল আর ভাম ছাড়া কিছু দেখি নি।

রবি বললো, নাদুখালা যে বলে তোর দাদা ভূত দেখেছিলো?

দাদা রাতে এমনিতেই চোখে কম দেখতো। নবু বললো, চোর-ছ্যাচড় কিছু দেখেছিলো হয়তো।

রাতুল আবার নবুকে প্রশ্ন করলো, কখনো রাজবাড়ি গিয়েছো?

ভেতরে ঢুকি নি। বাইরে থেকে দেখেছি। একেবারেই জঙ্গল হয়ে গেছে জায়গাটা। এতোটুকু পা ফেলার জায়গা নেই।

আমার কিন্তু যাওয়ার ইচ্ছে করছে!

কেন বল তো?

রবি বলছিলো ও-বাড়িতে খুঁজলে নাকি গুপ্তধন পাওয়া যাবে। ওদের পূর্বপুরুষেরা নাকি পুঁতে রেখে গেছে।

রবি শুকনো গলায় বললো, আসলে পুঁতে যেমন রেখেছে, তেমনি ওদের পোষা জ্বীনরা বসে বসে পাহারা দিচ্ছে। আমাদের এক পূর্বপুরুষ তান্ত্রিকের পাল্লায় পড়ে একটা ছেলেকে মেরে যখ বানিয়েছিলো দেয়ালের ভেতর লুকানো মোহরর ঘড়া পাহারা দেয়ার জন্য। কেন, নবু শুনিস নি?

নবু হাই তুলে বললো, যখের কথা জানি না। তবে পুরোনো জমিদার বাড়িতে ওসব থাকাটা বিচিত্র কিছু নয়। তার ওপর তোরা আবার ডাকাতের বংশ।

রাতুল ওদের ঝগড়া থামানোর জন্য বললো, যাই বলো নবু, আমার কিন্তু পুরোনো রাজবাড়িটা দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।

ওরা তিনজন টেরও পায় নি কখন আবেদালি ওদের জন্য তিনগ্লাস দুধ এনে দাঁড়িয়ে আছে। নাদুখালা নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, রোজ শোয়ার আগে সবাইকে একগ্লাস করে দুধ খেতে হবে। রাতুলের কথা শেষ হতেই টেবিলের ওপর ঠকাস করে দুধের গ্লাসের ট্রে নামিয়ে রেখে আর্তনাদ করে উঠলো আবেদালি–রাতুল দাদা, আপনে কও কি? রাজবাড়িতে কোনো মানুষ যাইতে পারে।

সমর্থন পেয়ে রবি তড়বড় করে বললো, আমিও তো তাই বলি আবেদালি । ওখানে যে যখ আছে এ কথা কে না জানে!

নবু গম্ভীর হয়ে বললো, শুধু যখ কেন, আরো অনেক কিছু থাকতে পারে।

আবেদালি ভয়-পাওয়া শুকনো গলায় বললো, তোমরা গেরামের মানুষ। তোমরা ঠিহিই বুইজবে। রাতুল দাদারে বুজায়ে কও। শেষে কোলাম জানডা খোয়াইতে হইবেহেনে।

রাতুল বুঝলো কথা বাড়তে দিলে এটা গোটা বাড়িতে মস্ত আলোচনার বিষয় হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি বললো, বোঝাতে হবে না আবেদালি। আমি এমনি ঠাট্টা করছিলাম। আমার কি জানের ভয় নেই? ভূত না হোক সাপখোপ তো কম নেই। কে যাবে ওর ভেতর মরতে। তার চেয়ে তুমি বরং আমাদের মাছের চার বানিয়ে দিও। কাল সকালে আমরা মাছ ধরবো। বিকেলে নৌকা বাইবো।

হেয়া ওইবে নে। তয় কতা ওইলো তেনাগো নিয়া মশকরা হরণ ভালো । এই বলে আশ্বস্ত হয়ে চলে গেলো আবেদালি।

ওকে কাটাতে পেরে রাতুল খুব খুশি। নবু আস্তে করে ওকে চিমটি কেটে গোপনে জানিয়ে দিলো, রাতুল ভালো বলেছে।

রবি বললো, জানিস, আমাদের মসজিদের হুজুরও জ্বীন দেখেছেন। একদিন মাগরেবের নামাজের সময় ওজু করে তিনি মসজিদে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন পুরোনো গোরস্থানের ভেতর দুটো লোক হাঁটছে। নবুর দাদার কথা হুজুরের জানা ছিলো। তাই তিনি আর ওদের পেছনে যান নি। হঠাৎ ওর চোখের সামনেই ভোজবাজির মতো লোক দুটো বাতাসে মিলিয়ে গেলো। একটু পর শোনেন ফেস ফোঁস শব্দ। তাকিয়ে দেখেন দুটো সাপ তার দিকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন।

রাতুল মুখ টিপে হেসে বললো, তোদের এই ভয়-পাওয়াদের দলে একখানা হুজুরও আছে তাহলে? তবে আর কি, জুজুর ভয়ে গর্তে লুকিয়ে থাক।

রাতুলের টিটকিরি শুনে রেগে গেলো রবি–সাহস থাকে তো যা না । ভালোর জন্য বলছি–শুধু শুধু ইয়ার্কি! এই বলে ও পাশ ফিরে শুলো।

একটু পরেই রবি ঘুমিয়ে গেলো। নবু ফিসফিস করে রাতুলকে ডাকলো, রাতুল, ঘুমিয়ে পড়েছো?

রাতুল বললো, না।

চলো, বাইরে গিয়ে বসি। বলে উঠে বসলো নবু।

দুজন দুটো নরোম কাঁথা গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে বসলো। নবু একটা সিগারেট ধরিয়ে বললো, রবিকে আর মানুষ করা গেলো না। এতো ভয় নিয়ে ও কি করে যে সংসারে চলবে, ভেবে পাই না।

রাতুল বললো, বেনুদা পাস করা ডাক্তার হয়ে যদি জ্বীনভূত বিশ্বাস করে, রবির কি দোষ বলো?

বিশ্বাসের সঙ্গে ভয়ের কি সম্পর্ক? জ্বীন তো আমিও বিশ্বাস করি। তাই বলে ওদের মতো ভয় পাই নাকি!

তুমি কখনো জ্বীনভূতের পাল্লায় পড়েছিলে?

একেবারে পড়ি নি বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। একটু ভেবে বললো নবু–গত বর্ষায় একটা মেয়েকে জব্দ করার জন্য খিড়কি পুকুরে নেমেছিলাম। ভেবেছিলাম ডুব-সাঁতার দিয়ে ঘাটে এসে ওকে ভয় দেখাবো। সাঁতার যে আমি ভালো পারি সে তো দেখেছো। পুকুরের মাঝামাঝি এসেছি, হঠাৎ মনে হলো পাটা কে টেনে ধরেছে। যতো ছাড়াতে যাই, আর ছাড়ে না, টেনে নিচের দিকে নিয়ে যেতে চায়। আমি জানি, মাথা গরম করলেই বিপদ। মনে মনে তিনবার কুলহুয়াল্লা পড়ে উল্টো দিকে সাঁতার দিতেই পাটা ছুটে গেলো। এ কথা কাউকে বলি নি। মেয়েটাও জানে না।

রাতুল রহস্যভরা গলায় বললো, মেয়েটা কে জানতে পারি?

নবু লজ্জা পেলো–না, মানে-পুষ্প বুজির ননদ। নাম হচ্ছে পারুল। পাশের গ্রামে থাকে। ক্লাস এইটে পড়ে। ভালো গান জানে। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো। সেবারই প্রথম আলাপ।

তারপর নিশ্চয়ই আরো কয়েকবার ওদের বাড়ি গেছো! রাতুলের গলায় তখনো রহস্যের ছোঁয়া।

নবু হেসে ফেললো–কি করে বুঝলে?

প্রথম আলাপে কি জানা যায়, কোন মেয়ে কি রকম গান গায়?

না, মানে–আসলেই ভালো মেয়েটা!

আহ, আমি কি বলেছি খারাপ! ছোড়দিকে দেখার জন্য নিশ্চয়ই আসবে?

আসবে না আবার! খালা তো দুনিয়ার যতো আত্মীয়-কুটুম্ব আছে সবাইকে দাওয়াত পাঠানো শুরু করেছে। আর মাত্র তিনদিন বাকি।

আমি তখন বলে দেবো তুমি ওকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলে।

ভালো হবে না বলছি। রাতুলের পিঠে থাপ্পড় মেরে নবু বললো, তোমার মতলবটা কি শুনি?

রাতুল নিরীহ গলায় বললো, আমার কোনো খারাপ মতলব নেই। তোমার পারুল তোমারই থাকবে। আমি ভাবছি অন্য কথা।

কি?

রবিকে একবার ভয় দেখালে কেমন হয়?

ও হার্টফেল করবে।

না, সে রকম সিরিয়াস কিছু নয়। ওর ভয় ভাঙাবার জন্য। ও যাতে বুঝতে পারে, চোখে দেখার ভুলে অনেকে অনেক কিছু দেখে।

ভালো বলেছো তো! তুমি কিছু ভেবেছো? উৎসাহিত হয়ে উঠলো নবু।

ভেবেছি। বললো রাতুল।

বাইরে কুয়াশাভেজা ম্লান চাঁদের আলো। হু হু করে বইছে ঠাণ্ডা বাতাস। টানা বারান্দার এক কোণে কাঁথা গায়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রাতুল নবুকে বললো ওর পরিকল্পনার কথা। ঘরের ভেতরে কিছুই টের পেলো না রবি।