৩-৪. জ্বীনর আলো নয়–ওটা আলেয়া

০৩. জ্বীনর আলো নয়–ওটা আলেয়া

দুপুরের পর রাতুলদের লঞ্চ বরিশাল ছেড়েছে। তুষখালি আসতে আসতে সন্ধে পেরিয়ে গেলো। দুপুরের পর থেকে রাতুল আর রবি ডেকে বসে যে গল্প শুরু করেছে টেরও পায় নি কখন সূর্য ডুবে গেছে। সূর্য ডোবার পরই সাদা কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা পড়েছে বলেশ্বরী নদী, তীরের গাছপালা আর ঘরবাড়ি । মাঝখানে বেনুদা ওদের ভেতরে ডেকেছিলো চায়ের জন্য। চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্য ছোড়দি টিন থেকে ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট বের করে দিয়েছিলো। ঝটপট চায়ের পাট চুকিয়ে দিয়ে আবার ডেকে রাখা চালের বস্তার ওপর বসেছে ওরা।

তুষখালি নামেই ঘাট। আশেপাশের জন-মানুষের কোন সাড়াশব্দ নেই। বেনুদা বললো, হাটের দিন ছাড়া লোকজন থাকে না।

ওদের চারজনকে জনশূন্য ঘাটে নামিয়ে দিয়ে খকখক করে কাশতে কাশতে বুড়ো লঞ্চটা সাঁঝরাতের অন্ধকার আর কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেলো। একটু পরে সেই কাশির শব্দও মিলিয়ে গেলো।

ছোড়দি বললো, লোকজন না থাক, একটা কুকুর-বেড়ালও কি থাকতে নেই!

বেনুদা কাষ্ঠ হাসলো–লোকজন না থাকলে কুকুর-বেড়াল আসবে কোত্থেকে! শুনলাম কদিন ধরে ডাকাতিও নাকি বেড়েছে।

রবি বললো, বেনুদা, এই রাতে বাড়ি না গিয়ে ডাকবাংলোয় থেকে গেলে হয় না! মা তো সবসময় বলে ঘাটে সন্ধ্যে হয়ে গেলে যেন ডাক বাংলোয় থেকে যাই।

আমিও ভাবছি। লঞ্চটা আজ এক ঘন্টা দেরি করেছে, জোয়ারের উল্টোদিকে আসতে হয়েছে বলে। এই বলে বেনুদা ছোড়দির দিকে তাকালো–কি বলো, থাকবে নাকি ডাকবাংলোয়? এখান থেকে দশ মিনিটের পথ।

ছোড়দি বললো, তোমাদের বাড়ি এখান থেকে কদ্দুর?

মাইল তিনেকের মতো হবে। ঘন্টাখানেক লাগবে যেতে।

মোটে তিন মাইল? তাই বলো! এক ঘন্টার পথ গল্প করেই চলে যেতে পারবো।

বেনুদা কাষ্ঠ হেসে বললো, যেতে পারলে তো ভালোই।

আমরা যে যার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে রওনা হবো এমন সময় কুয়াশা ফুড়ে, আগাগোড়া চাদর মুড়ি দিয়ে মাঝবয়সী একটা লোক হারিকেন হাতে উপস্থিত। খসখসে গলায় বললো, বড়মো আইয়া পড়ছো নিহি। মুই তো দুইবার ঘুইরা দেইহা গেছি। লঞ্চ দেরি করছে মনে হয়!

লোকটাকে দেখে বেনুদার দুশ্চিন্তা কেটে গেলো–এই যে বনমালি, তোমাকে না দেখে আমরা তো বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছিলাম।

বনমালি আঁতকে উঠলো–হেইয়া কি কও বড়মো! ব্যাগাম সাবে হুনলে মোরে জানে মাইরা ফালাইবে। লও ডাকবাংলায় যাই। সুটকিডা মোরে দ্যাও দেহি।

এই বলে বেনুদার হাত থেকে সুটকেসটা নিয়ে বনমালি হাঁটতে শুরু করলো।

বেনুদা একটু অপ্রস্তুত হয়ে ছোড়দিকে বললো, এ হচ্ছে ডাক বাংলোর চৌকিদার। চলো, রাতটা এখানে থেকে যাই। সকালে গরুগাড়ি পাওয়া যাবে।

বলো কি! আঁতকে উঠলো ছোড়দি, আমি গরুগাড়িতে উঠবো? মরে গেলেও না। একবার চড়ে আমার সারাজীবনের শিক্ষা হয়ে গেছে।

বেনুদা শুকনো গলায় বললো, দিনের বেলা তুমি হেঁটে যাবে কি করে? মা শুনলে আস্ত রাখবেন না আমাকে। গ্রামের লোকজন সবাই আমাদের বাড়ির নতুন বউকে দিনের আলোয় দেখবে–এটা মা কখনো পছন্দ করবেন না।

সেজন্যেই বলছি রাতেই চলে যাই। গরুগাড়িতে উঠতে ডাক্তার আমাকে বারণ করেছে, মাকে বুঝিয়ে বললেই হবে। এই বলে ছোড়দি মুখ টিপে হাসলো।

বনমালি এতোক্ষণ চুপ করে ছিলো। ছোড়দির কথা শুনে কাঁচুমাচু করে বললো, মুই একটা কথা কই মা জননী, কিছু মনে কইরো না। গরুগাড়িতে উঠতে অসুবিধা হইলে মুই পালকির ব্যবস্থা করমুহনে। রাইতে এই গেরামে পুরুষমানুষই বাইর হয় না, মাইয়ামাইনষের তো কতাই ওডে না। কষ্ট কইরা রাইতটুকু ডাকবাংলায় থাহেন। মুই হগল ব্যবস্তা কইরা দিমু।

রাতুল বেনুদাকে বললো, আপনি কি আমাদের ভূতের কথা বিশ্বাস করতে বলছেন? এ কথা মেজদারা শুনলে কি বলবে!

বেনুদা আগের মতো শুকনো গলায় বললো, আমি কাউকে কিছু বিশ্বাস করতে বলছি না। আমি শুধু বলতে চাই, যেখানে যে নিয়ম, সে নিয়ম মেনে চলা উচিত।

রাতুলের মতো ছোড়দিও ডাক বাংলোতে থাকতে রাজি নয়। বললো, নিয়ম তো আমরাই বানাই। ও নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। তুমি তো জানো আমার শরীর বেশি ভালো নয়। এক ঘন্টার জায়গায় দুঘন্টা হাঁটতে হলেও আমি বাড়ি যাবো। গরুগাড়ির চেয়ে পালকিতে সফোকেশন বেশি হবে। প্লীজ, চলো দেরি না করে বাড়ি যাই।

বেনুদা কাষ্ঠ হেসে বললো, ঠিক আছে, চলো।

বনমালি হাউমাউ করে উঠলো–ও বড়মেঞা, তোমার মাতাডা খারাপ হইছে নিহি। হেইয়া কও কি তুমি! মোরে ব্যায়াম সাবে কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দেবো। মোর কতা হোন ভাইডি। নতুন বউয়ের সর্বনাশ কইরো না। কথা বলার সময় বনমালি বারবার ভয়ে শিউরে উঠলো।

বেনুদা ওর পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলো,–ঠিক আছে বনমালি, মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। তুমি যে মানা করেছে সেটাও বলবো। বউয়ের শরীর বেশি ভালো নয়। ডাক বাংলোয় ওর দেখাশোনা করার অসুবিধে। তুমি মন খারাপ কোরো না।

বনমালি তবুও ফোঁপাতে লাগলো–বেয়ানে দারোগা সাবে আইবো আনে। নাইলে মুই তোমাগ লগে যাইতাম আনে। রাইতে একলা আইমু কেমনে?

তোমাকে আসতে হবে না। বেনুদা ওকে আশ্বস্ত করলোআমরা চারজন। আছি। তুমি বাংলোয় ফিরে যাও।

বনমালি দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বললো, দুগ্‌গা, দুগ্‌গা।

আকাশে চাঁদ উঠেছে। কুয়াশার জন্য ঘোলাটে মনে হচ্ছিলো চাঁদের আলো। এতো ঘন কুয়াশা যে দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছিলো না। ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছিলো ওরা চারজন। বেনুদা আর ছোড়দি সামনে। বেনুদার হাতে ছোড়দির সুটকেস। পেছনে রাতুল আর রবি। ওদের গায়ে গরম কোট, কোটের নিচে পুলোভার, পরনে গরম প্যান্ট। মাঝে মাঝে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস চোখে-মুখে সুঁচ ফোঁটাচ্ছিলো।

উঁচু রাস্তার দুপাশে ন্যাড়া ধানক্ষেত। অল্প দূরে ছড়ানো-ছিটানো আবছা বাড়িগুলোকে কুয়াশার সমুদ্রে ভেসে থাকা ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হচ্ছিলো। কুয়াশাভেজা চাঁদের আলোয় গোটা পরিবেশটা রীতিমতো ভৌতিক হয়ে উঠেছে। দিনের আলোয় রবির সব কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও রাতুলের মনে হলো এমন পরিবেশে ভূত, জ্বীন, অশরীরী সবকিছুই থাকতে পারে।

অনেকক্ষণ পর ছোড়দি বললো, এতোটা পথ এলাম, একটা মানুষের মুখও দেখলাম না।

বেনুদা কাষ্ঠ হাসলো, দেখা না হলেই বাঁচি।

ছোড়দি অবাক হয়ে বললো, ও কথা বলছো কেন?

এ গাঁয়ের একটা বিশেষ ধরনের ব্যাপার আছে। রাতে মানুষজন কেউ পথে বেরোয় না।

কেন বেরোয় না? ভয়ের কথা রাতুল জানলেও ছোড়দিকে কেউ বলে নি।

বেনুদা শুকনো গলায় বললো, চোর-ডাকাতের ভয় তো আছেই। তাছাড়া–

রবি বাধা দিয়ে বললো, এসব কথা এখানে বলার কি দরকার বেনুদা? বাড়ি গিয়েও তো বলা যাবে।

বেনুদা একটু অপ্রস্তুত হলো–ঠিক আছে। বাড়ি গিয়ে তোর ভাবীকে সব খুলে বলিস।

রাতুল বললো, বেনুদা যে একটু আগে লোকজনের কথা বললেন, দেখা না হলেই বাঁচি, আপনি কি চোর-ডাকাতের কথা বলছিলেন?

বেনুদা বললো, চোর-ডাকাত বাড়িতে লুকিয়ে চুরি করতে পারে। কদিন আগে করেছেও। সামানা-সামনি আমাদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস ওদের হবে না।

তবে কার কথা বলছিলেন?

রবি বললো, লঞ্চে আসার সময় তোকে বলেছি না? তেনারা অনেক কিছুর রূপ ধরতে পারেন।

ঠিক তখনই রাতুলের মনে হলো চৌদ্দ-পনেরো হাত সামনে একজন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। রবিকে ফিসফিস করে বললো, দ্যাখ, কে যেন যাচ্ছে?

রবি সঙ্গে সঙ্গে রাতুলের একটা হাত আঁকড়ে ধরে বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলো। আর কি আশ্চর্য, কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেই লোকটা কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেলো।

ছোড়দি প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, যাই বলো, আমার কিন্তু হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। কতদিন গ্রাম দেখি নি!

বেনুদা এবার স্বাভাবিক গলায় বললো, শীতকালে এসেছে বলে হাঁটতে ভালো লাগছে। বর্ষাকালে কাদায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যায়।

একটু ভয়ভয় করলেও হাঁটতে রাতুলেরও ভালো লাগছিলো। তবে এটাও বুঝতে পারছিলো, এভাবে আসাটা রবি, বেনুদা কেউ পছন্দ করে নি। ওদের ভয়টাকে অবশ্য একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিলো রাতুল আর ছোড়দির। তবে এ নিয়ে বেনুদারা কথা বলতে চায় না বলে ওরা চুপ করে ছিলো।

মাইল দুয়েকের মতো হাঁটার পর ওরা একটা মস্তবড় বটগাছ পেরুলো। বটগাছের তলায় পাথরের মতো জমাট বাঁধা কালো অন্ধকার। বটগাছটার কাছাকাছি আসার পরই রবি ফিসফিস করে রাতুলকে বলছিলো, মনে মনে সুরা এখলাস, নয় সুরা ইয়াসিন পড়। উল্টোপাল্টা কোনো কথা বলিস না।

রবি নিজেও বিড়বিড় করে সুরা পড়ছিলো। বটগাছের তলায় এসে রাতুলের মনে হলো পৃথিবীর বাইরের কোনো জগতে বুঝি পা দিয়েছে। এতো জমাটবাধা অন্ধকার মনে হয় ধাক্কা না দিয়ে সরালে বুঝি হাঁটা যাবে না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো সেই অন্ধকার।

বটগাছের তলা থেকে আবার খোলা জায়গায় এসে হাঁপ ছাড়লো রাতুল। বুকের ওপর ভারি পাথরের মতো জমাট বেঁধে বসেছিলো সেই কালো ছায়া। ঠিকমতো যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলো না। রাতুলের মতো রবিও খোলা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিলো। আর ঠিক তখনই শুনলো সেই শব্দ।

ওদের পায়ে চলার শব্দ ছাড়া এতোক্ষণ আর কোনো শব্দ ওদের কানে যায় নি। এমনকি কুকুর কিংবা কোনো নিশাচর পাখির ডাকও নয়। ওরা কান খাড়া করে শুনলো, কাপড়ের খসখস শব্দ আর জুতো পায়ে হাটার শব্দ ছাড়াও পরিষ্কার আলাদা এক শব্দ। মনে হচ্ছে ঘষটাতে ঘষটাতে কিছু-একটা যেন ওদের অনুসরণ করছে। রাতুল একবার পেছনে তাকিয়েছিলো। কিছুই দেখা গেলো না। রবি ভয়-পাওয়া যায় চাপা গলায় বললো, পেছনে তাকাবি না। সুরা পড়।

ছোড়দি বেনুদাকে বললো, কিসের যেন শব্দ হচ্ছে, শুনতে পাচ্ছো?

বেনুদা বললো, কথা বোলো না। ও কিছু নয়।

ছোড়দি কি যেন বলতে গিয়েও বললো না। রাতুল আর রবি বেনুদার কাছাকাছি হাঁটছিলো। রাতুলের একবার মনে হলো, সুন্দরবনের এতো কাছে বাঘ কিংবা কোনো বন্যজন্তু বেরোয় নি তো? রবি আর বেনুদা সত্যি সত্যি ভীষণ ভয় পেয়েছে। একনাগাড়ে বিড়বিড় করে সুরা পড়ছে রবি। এক হাতে খামছে ধরেছে রাতুলের হাত। রীতিমতো কাঁপছিলো ওর হাত। রাতুলের মনে হলো ঘামছেও। বেনুদা হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদেরও একইভাবে জোরে হাঁটতে হচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে মনে হলে শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। বেনুদার হাঁটার গতি স্বাভাবিক হলো। রবি বিড়বিড় করে বললো, একটা ফাড়াকাটলো।

রাতুল অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কিসের ফাঁড়া?

বাড়ি গিয়ে শুনিস কিসের ফাঁড়া। একথা কাউকে বলিস না।

বেনুদা এক ঘন্টার কথা বলেছিলো। রাতুল ওর হাতঘড়ি দেখলো, এক ঘন্টা পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। রবিকে বললো, আর কতদূর?

রবি স্বাভাবিক গলায় বললো, আর বেশি দূর নয়। মিনিট পনেরোর পথ।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কিছুটা হালকা হলো। চাঁদের আঁলোয় অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো। বেশ দূরে কোথাও কুকুরের ডাক শোনা গেলো। শব্দ শুনে মনে হলো কুকুরটা কাঁদছে। কাঁপা কাঁপা শব্দটা বাতাসে গুমরে মরছে। ডেকেই চলেছে একটানা। দূরে তাকিয়ে দেখলো রাতুল উঁচু টিলার মতো কি যেন। রবিকে বললো, উঁচু মতো ওটা কি-রে।

ওটাই আমাদের পুরোনো বাড়ি। সেই রাজবাড়ি, যার কথা তোকে বলেছি।

রবির কথা শুনে রোমাঞ্চ হলো রাতুলের। ভালো করে তাকাতেই হঠাৎ চোখে পড়লো একটা আলো দুবার দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেলো। চাপা উত্তেজিত গলায় রবিকে বললো, দেখেছিস?

রবি শক্ত করে রাতুলের হাত আঁকড়ে ধরে ভয়-পাওয়া গলায় বললো, ওটা জ্বীনের আলো। মাঝে মাঝে দেখা যায়। গ্রামের অনেকে দেখেছে।

কি করে বুঝলি ওটা জ্বীনের আলো?

আমার দাদা বলেছিলেন।

তোর দাদা কি করে বুঝলেন?

তোকে বলি নি দাদা খুব এবাদত-বন্দেগী করতেন? দাদা তেনাদের চিনতেন। পরে তোকে সব বলবো।

জ্বীনেরা আলো দিয়ে কি করবে?

জানি না। এসব কথা এখন থাক না! বললাম তো পরে বলবো।

রাতুল কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো, তোদের পুরোনো বাড়ির আশেপাশে কোনো পুরোনো জলা আছে?

বিল আছে একটা। অনেক পুরোনো। আগের দিনে ডাকাতরা মানুষ মেরে লাশটা ওটার ভেতর ডুবিয়ে দিতো।

রাতুল মৃদু হেসে বললো, ওটা জ্বীনের আলো নয়। ওটা আলেয়া।

.

০৪. কে চোর আর কে ভূত বলা কঠিন

বেনুদার মা অতো রাতে সবাইকে দেখে মহা হৈচৈ জুড়ে দিলেন-যার ন’বছরের হয় না, তা নব্বইতেও হয় না। তোকে না হাজারবার বললাম, রাতে বাংলোতে থাকিস। বনমালিকে বলে আমি রান্নার ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। দেখো তো কান্ড নবুর মা। বউয়ের এক গা গয়না। গেলো বিষবারে বাড়িতে এমন একটা ডাকতি হয়ে গেলো। বেনুটার মাথায় যদি একটুকু বুদ্ধি থাকতো!

একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছিলেন বেনুদার মা। এরই ফাঁকে ছোড়দি টুপ করে ওর পা ছুঁয়ে সালাম করলো। পেছন পেছন রাতুলও। বেনুদার মা ছোড়দিকে বুকে নিয়ে সমানে বলে চললেন, থাক, থাক, বেঁচে থাকো বউমা! কতোদিন ধরে বসে আছি তোমাকে দেখবো বলে। বেনুর বউ দেখার জন্য আল্লা আমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। এটি কে? কী সুন্দর ছেলে। তোমার ভাই বুঝি? কী নাম?

নাম শুনেই, ভারি সুন্দর নাম রাতুল। বেঁচে থাকো বাবা। তোমার কথা রবি। সবসময় লেখে। তুমি না থাকলে ওর কী যে হতো! কই-রে, তোরা সব গেলি কোথায়! গোসলখানায় গরম পানি দে। ওরা সব হাত-মুখ ধোবে। এতোটা পথ এসেছে। দেখে তো বেনুর কাণ্ড!–কথা বলতে বলতে বেনুদার মা ভেতরে চলে গেলেন।

রবি একটু হেসে বললো, মা একটু বেশি কথা বলে।

ছোড়দি ওকে আস্তে করে বকুনি দিলো–ছিঃ, বড়দের কথার খুঁত ধরতে হয় না।

কথা বলতে বলতে বেনুদার মা আবার এলেন। তাঁর সমবয়সী একজনকে বললেন, তোমাকে বলি নি নবুর মা, বেনুর কোনো কথা খেয়াল থাকে না। কি করে যে ও একবারে ডাক্তারি পাস করেছে এখনো আমি ভেবে পাই না।

রাতুলের ভীষণ হাসি পেলো। ও জানে ডাক্তারি পরীক্ষায় বেনুদার রেজাল্ট খুবই ভালো ছিলো। বেনুদার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে যেই হাসতে যাবে, ছোড়দির রামচিমটি খেয়ে চেপে গেলো।

নবুর মা গোলগাল চেহারার মোটাসোটা মানুষ। বেনুদাকে বললেন, যাই বলো বেনু, কাজটা তুমি ভালো করো নি। তুমি তো সবই জানো । ডাকাতের কথা বাদই দাও না। রাত-বিরেতে তেনাদের নাম নিতে নেই। নজরে পড়তে কতোক্ষণ! তার ওপর পরীর মতো দেখতে বউ। এই বলে তিনি পাশের বুড়োমতো একজনকে বললেন, অ খালা, আমার তো ওজু নেই। সিন্দুকের তাকে মাজারের তাগা তোলা আছে। দোয়া পড়ে বউয়ের গলায় একখানা বেঁধে দিও।

নে, আর সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বউমাকে ঘরে নিয়ে যা। রবি, রাতুলকে তোর ঘরে নিয়ে যা। আবেদালিকে বল দোতলার গোসলখানায় পানি দিতে। কাপড় বদলে মুখ-হাত ধুয়ে নিচে খেতে আয়। কি আক্কেল তোদের! বেনুদা আর রবিকে ধমক লাগিয়ে বেনুদার মা বোধ হয় রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

রবি বলেছিলো নতুন বাড়ি। দেখে মনে হলো বাড়িটার বয়স আশির কম হবে না। দোতলা বাড়ি, উঁচু ছাদ, সিলিঙে মোটা মোটা বরগা আর কড়িকাঠ। দেয়ালে সুড়কির পলেস্তারার ওপর চুনকাম করা। দেয়ালগুলোও কম মোটা নয়। বড় বড় দরজা-জানালা। জানালায় মোটা লোহার শিক বসানো।

এতোক্ষণ ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলছিলো। রাতুলরা আসাতে কে যেন হ্যাঁজাক বাতি জ্বালিয়েছে। তাতেও নিচের বড় ঘরটার সবটুকু আলো হয় নি। কোণায় অন্ধকার জমে রইলো। রবি রাতুলকে বললো, আমার ঘর দোতালায়। চল ওপরে যাই।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে টানা বারান্দার শেষ মাথায় রবির ঘর। রাতুলকে। ঘরে বসিয়ে ও নিচে গেলো। শীতের জন্য জানালাগুলো বন্ধ ছিলো। পুরোনো দিনের কাঠের শাটার্সওয়ালা বড় জানালা। রাতুল উঠে দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলো। ঘরের এক কোণে এততক্ষণ একটা হারিকেন সামান্য আলো দিচ্ছিলো। জানালা খুলে দিতেই চাঁদের ঠাণ্ডা নোম আলোয় ঘর ভেসে গেলো। চাঁদের আলোয় রাতুল দেখলো জানালার কাছে মস্ত বড় সেকেলে চেহারার মেহগিনি কাঠের পালঙ্ক। মোটা জাজিমের ওপর তোষক, তার ওপর সাদা চাদর বিছানো। বিছানায় বসে বাইরে তাকাতেই ওর টা ভরে গেলো। আকাশের কুয়াশা কেটে গেলেও নিচের সব কিছু সাদা কুয়াশার ফিনফিনে চাঁদরে ঢাকা পড়েছে। দূরের গাছগুলোকে মনে হচ্ছে কুয়াশার সমুদ্রে দ্বীপের মতো ভাসছে।

নিচের তলায় লোকজন ব্যস্ত গলায় এ ওকে ডাকাডাকি করছে, হারিকেন হতে ছোটাছুটি করছে। নিজেদের রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো রাতুলের। ওদের জন্য সারা বাড়িতে ব্যস্ততার ঢল নেমেছে।

বেনুদার মা বলেছিলেন রাতে নাকি রাতুলদের জন্য ডাকবাংলায় খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ঘন্টা দেড়েক পর খেতে বসে ওর মনে হলো এ বাড়িতে বুঝি সকাল থেকে ওদের জন্য রান্নার আয়োজন শুরু হয়েছে। কয়েক পদের মাছের রান্না, মুরগি, ডাল, ভাজি সব মিলিয়ে দশ-বারোটা আইটেম তো হবেই। রাতুলের খাওয়া দেখে নাদুখালা চোখ কপালে তুললেন, পাখির বাচ্চার মতো খুঁটে-খুঁটে কী খাচ্ছো?–বলে ওর প্লেটে বড় রুই মাছের আস্ত মুড়ো তুলে দিলেন–না, না বললে তো শুনবো না। বেয়ান শেষে বলুক হাভাতের দেশে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি! এক মাসে আমাদের নবুর মতো শরীর বানিয়ে দেবো।

রাতুল কিছুই বলতে পারলো না। ওর করুণ মুখ দেখে রবির মায়া হলো। হেসে বললো, ঠিক আছে আমি অর্ধেক নিচ্ছি, বাকিটা তুই খা। নইলে খালার মন খারাপ করবে।

ওই অর্ধেকটুকু খেতে গিয়ে রাতুলের খাবি খাওয়ার দশা। সবশেষে পায়েশ খেতে গিয়ে ও রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। বললো, কিছুতেই খেতে পারবো না। পেটে এক ফোঁটা জায়গা নেই। বেনুদা তখন ওকে রক্ষা করলেন–থাক মা, এখনো লজ্জা কাটে নি। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। একদিনে এতো বোঝা চাপিও না।

রাতুলের মনে হলো, অতি উপাদেয় খাওয়ার ব্যাপারটাও কখনো নিরানন্দের হতে পারে। রবি আর বেনুদাকে বলতে হবে, এরকম জবরদস্তি চালানো হলে ও দুদিনেই কেটে পড়বে।

খাওয়ার পর ভারি শরীরটা টেনে দোতলায় নিয়ে গিয়ে রবির বিছানার ওপর বসে রাতুল বললো, তুই তো জানিস রবি, বাড়িতে আমি কতটুকু খাই। সবার সঙ্গে তুইও অমন করলি!

রবি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, নাদুখালা সবার সঙ্গে ওরকম করেন। মাকে আমি বলে দেবো। এমনটি আর হবে না।

না হলেই বাঁচি। এতোক্ষণ পর রাতুলের মুখে হাসি ফুটলো।

বেনুদা বলেছিলো বটে ঘাট থেকে ওদের বাড়ি তিন মাইল। রাতুলের মনে হলো পাঁচ-ছমাইলের কম হবে না। পা দুটো রীতিমতো টনটন করছে। একটানা এতোটা পথ আগে কখনো হাঁটে নি।

রাতের পোশাক পরে রাতুল শুতে যাবে–এমন সময় দেখে মুশকো একটা লোক মস্ত বড় কাঁচের গ্লাসে করে দুগ্লাস দুধ এনেছে। দেখেই ও আঁতকে উঠলো–রবি, আমি যদি হার্টফেল করে না মরি তাহলে আত্মহত্যা করবো। এই বলে চোখের পলকে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।

রবি হেসে বললো, আজ রাতে দুধ খাবো না আবেদালি। কাউকে বলার দরকার নেই। দুগ্লাসই তুমি খেয়ে ফেলো।

একগাল হেসে চলে গেলো আবেদালি। বিছানায় উঠে রবি বললো, দুধ খাওয়ার ব্যাপারে আবেদালি কখনো আমার সঙ্গে বেইমানি করে নি। যখনই বলি খেয়ে নেয়। কি স্বাস্থ্য দেখেছিস?

লেপের তলা থেকে মুখ বের করে রাতুল বললো, তোদের আবেদালির মতো ভালো মানুষ পৃথিবীতে মনে হয় খুব কমই আছে।

হঠাৎ খোলা জানালার দিকে চোখ পড়লো রবির, জানালা খুললি কেন? কিভাবে শীত আসছে টের পাচ্ছিস না?

রাতুল হেসে বললো, শীতের চেয়ে বেশি আসছে ভয়। কথাটা পষ্ট করে বলতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?

রবি সত্যি সত্যি লজ্জা পেলোআসলে তুই না থাকলে আমি নবুকে বলতাম থাকতে। আগে সবসময় নবু থাকতো আমার সঙ্গে।

নবু কে?

নাদুখালার ছেলে। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়। খালু মারা যাবার পর নবু আর নাদুখালাকে মা এখানে নিয়ে এসেছেন। মার খুব ভালো বন্ধু নাদুখালা।

আর নবু তোর বন্ধু? ওর কথা তো আগে বলিস নি?

কে বললে নবু আমার বন্ধু! আমার চেয়ে এক-দেড় বছরের বড় হবে। এবার ক্লাস নাইনে ওঠার কথা, বাবু পরীক্ষায় ফেল মেরে বসে আছেন।

মনে হলো অনেক লোক থাকে তোদের বাড়িতে?

অনেক লোক আর কোথায়! নবুরা ছাড়া মার এক দূর সম্পর্কের খালা থাকেন, আমরা ডাকি কুঁচি নানী। আর থাকে পুষ্পদি। বিয়ের পর বুজি খুলনা চলে গেছে। কালেভদ্রে আসে। বাকি সব তো কাজের লোক।

তোর মা তখন তোদের বাড়িতে ডাকাতির কথা কি বলছিলেন যেন। সত্যি সত্যি ডাকাত পড়েছিলো?

তোকে তো বলাই হয় নি। উত্তেজনায় শোয়া থেকে উঠে বসলো রবি। গত বিদ্যুত্বারে ডাকাত এসেছিলো আমাদের বাসায়। বেনুদা ছিলো বরিশালে। প্রথম কেউ টের পায় নি। নতুন বউয়ের জন্যে মা ট্রাঙ্কে দুসেট গয়না তুলে রেখেছিলেন। একটা ছিলো জড়োয়ার সেট। তার ওপর এক ট্রাঙ্ক শাড়ি। ট্রাঙ্কসুদ্ধো নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় কিসের শব্দে নাদুখালার ঘুম ভেঙে গেছে। তাকিয়ে দেখেন কালো কালো কতোগুলো ভূতের মতো মাথায় কি নিয়ে যেন উঠোনে চলাফেরা করছে। দেখেই উনি ফিট হয়ে গেছেন। কাউকে ডাকতেও পারেন নি।

পুলিসে খবর দেয়া হয় নি?

সে তো দিয়েছেই। দিলেইবা কি। পুলিস কবে চোর-ডাকাত ধরেছে বল!

তোর নাদুখালার অতোবড় শরীর। ডাকাত দেখে স্রেফ ফিট হয়ে গেলেন?

ফিট হয়েছিলেন বলে জানে বেঁচেছেন। চেঁচিয়ে জান খোয়াবেন নাকি? ওগুলো সত্যিকারের ডাকাত হলেও রক্ষা ছিলো না।

সত্যিকারের ডাকাতই ছিলো ওগুলো। জ্বীনরা নতুন বউয়ের গয়না চুরি করেছে, এ কথা যদি ওদের কানে যায়, তাহলে তোকে আর ওরা আস্ত রাখবে না।

শুকনো গলায় রবি বললো, সব জ্বীন ভালো, তোকে কে বলেছে? খাবিস জ্বীনও আছে! ওরা সব সময় মানুষের অনিষ্ট করার ফিকিরে থাকে।

তুই দেখছি রীতিমতো জ্বীনবিশারদ হয়ে গেছিস। তোদের রাজবাড়ি না হানাবাড়ির ভালো জ্বীনদের বল না, গয়নাগুলো কে নিয়েছে ধরিয়ে দিতে।

তুই ঠাট্টা করছিস। আগের দিন হলে ঠিকই ওদের বলা যেতো। তোকে বলি নি আমার বড়দাদুর কাছে দুটো জ্বীন পড়তো।!

কি পড়তো? বাংলা, ইংরেজি না অঙ্ক?

তুই জ্বীনদের নিয়ে ঠাট্টা করিস না। ওরা বাংলা, ইংরেজি পড়তে যাবে কেন? ওরা পড়তে কোরান শরীফ। বড়দাদুর মতো কোরান শরীফের তফসীর কেউ করতে পারতো না।

পড়াশোনা শেষ করে কি করলো ওরা? নিশ্চয় চাকরি-বাকরি খুঁজতে বেরোয় নি।

ওদের চাকরির দরকার হবে কেন! ওরা তো সবসময় আল্লার এবাদত-বন্দেগী করে। তবে বড়দাদুর কাছে যারা পড়তো, ওরা পড়া শেষ না করেই চলে গিয়েছিলো।

কেন, ছাত্র হিসেবে বুঝি সুবিধের ছিলো না? খুলেই বল না!

কি যে বলিস! কাষ্ঠ হেসে রবি বললো, আসলে বড়দাদুর কাছে অনেক দূর থেকে তালেব এলেমরা আসতো কোরানের তফসীর শোনার জন্য। আমাদের বাড়িতেই থাকতো। আমার দাদা তখন ছোট ছিলেন। জ্বীন দুটোকে নিজ চোখে দেখেছেন। ধবধবে ফর্সা ছিলো গায়ের রঙ। চামড়া ছিলো মাখনের মতো মোলায়েম। বড়দাদু প্রথমটায় বুঝতে পারেন নি ওরা যে জ্বীন। জানেন দূরে কোথাও থেকে এসেছে। অন্য সবার চেয়ে পড়াশোনার দিকে মন বেশি। একদিন আর সবাই চলে গেছে। বড়দাদু আর ওরা দুজন বসে কথা বলছে। বড়দাদু কি কার জন্য একটা তাবিজ লিখতে বসলেন। লিখতে লিখতে বললেন, পাশের ঘর থেকে কোরান শরীফটা এনে দাও তো। সঙ্গে সঙ্গে কোরান শরীফ এসে গেলো। বড়দাদুর কেন যেন মনে হলো ওদের কেউ বসা থেকে ওঠে নি। লেখার কাজ শেষ করে আবার বললেন, যাও, রেখে এসো। এই বলে আড়চোখে তাকিয়ে দেখেন, ওরা বসেই আছে। একজনের হাতখানা লম্বা হয়ে গেলো। বসে থেকেই। পনেরো হাত দূরে তাকের ওপরে কোরান শরীফ রাখলো। তারপর আবার হাত খানা আগের মতো। বড়দাদু কাজ শেষ করে বললেন, তোমাদের একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, আশা করি সত্যি জবাব দেবে। ওরা বললো, আমরা মিছে কথা বলি না হুজুর! বড়দাদু বললেন, তাহলে সত্যি করে বলো তোমরা কে। তোমরা তো মানুষ নও। ওরা বললো, হুজুর, আমরা জ্বীন। বড়দাদু বললেন, এতোদিন নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলে কেন? কাঁচুমাচু করে জ্বীন বললো, আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের পরিচয় জানলে আপনি পড়াবেন না।

বড়দাদু বললেন, পরিচয় যখন জেনেছি তখন সত্যি সত্যি তোমাদের পড়াতে পারবো না। ওদের তখন সে কি কাকুতি-মিনতি। বড়দাদু ছাড়া আর কারো কথা ওদের জানা নেই। বললো, কোনো বেয়াদবি করবে না। বড়দাদু তবুও রাজি হলেন না। বললেন, দেখ বাপু, আমি জানি তোমাদের গা-ভর্তি রাগ। আল্লাহতালা তোমাদের আগুন দিয়ে বানিয়েছেন। আমার এখানে আদমের। আওলাদরা সব পড়ে। ওদের কে কখন বিনা ওজুতে থাকে, না জানি কি বেয়াদবি করে, তোমরা সহ্য করতে পারবে না। ঠিক মেরে ফেলবে। না বাছা, তোমরা চলে যাও। ওরা তো কিছুতেই যাবে না। বড়দাদুর পা ধরে পড়ে রইলো। শেষে বড়দাদু বললেন, ঠিক আছে, তোমরা পুরোনো বাড়িতে গিয়ে থাক। সবার সঙ্গে তোমাদের পড়াবো না। রাতে মসজিদে আমি যখন একা থাকবো তখন গায়েবী শরীরে এসো। যা পড়তে চাও পড়িয়ে দেবো। তবে তোমাদের ততোটুকু পড়াবো, যতোটুকু তোমাদের জানা উচিত। তোমরা তো জানো, কোরান শরীফের সবটুকু তোমাদের পড়ানো যাবে না। ভালোই করেছো পরিচয় দিয়ে। নয়তো অন্য সবার সঙ্গে তোমাদের কি না কি পড়িয়ে দিতাম, পরে আল্লাহপাকের কাছে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হতো। এরপর অবশ্য বেশিদিন ওরা পড়ে নি। তবে দাদুর কাছে শুনেছি কারা নাকি মাঝে মাঝে উঠোনে অসময়ের আর অচেনা সব ফল রেখে যেতো। দাদু পরে বুঝেছেন এসব জ্বীনদের কাজ।

বিশ্বাস না হলেও রবির গল্প শুনে রাতুলের রোমাঞ্চ হলো। কললো, হারে, এতো সুন্দর বলিস তুই, গল্প লিখিস না কেন?

রবি মৃদু হাসলো, এ-সব কথা বহুবার আমরা দাদুর কাছে শুনেছি। এ বাড়ির সবাই জানে।

খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আসছিলো। তবে ভারি লেপের তলায় শীত ঢোকার কোনো রাস্তা ছিলো না। চাঁদ পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। চাঁদের আলো না থাকলেও জানালা দিয়ে আসা আবছা আলোয় ঘরের জিনিসপত্রের কালো অবয়ব বোঝা যাচ্ছিলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাতুলের মনে হলো, সত্যি যদি কোনো জ্বীন লম্বা হাত বাড়িয়ে দেয়! কথাটা মনে হতেই রবিকে বললো, জানালা দিয়ে কেউ যদি লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে তুই কি করবি, বল তো?

রবি লেপ টেনে মুখ ঢেকে বললো, মিছেমিছি ভয় দেখাবি না বলে দিচ্ছি। কাল নবু এলে তোকে একা পাশের ঘরে শুতে পাঠাবো। তখন বুঝবি কেমন লাগে!

রাতুল গম্ভীর হয়ে বললো, তোকে ভয় দেখাবার জন্য বলছি না। সেদিন একটা বইয়ে পড়েছি, চোরেরা বাঁশের গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে, মাথায় একটা হুক বেঁধে জানালা দিয়ে ঘরের জিনিসপত্র সব বের করে নেয়। একজন সাহস করে বাঁশটা ধরে চিৎকার দিতেই, চোর বাঁশ ফেলে দৌড়। এমন যদি হয় কখনো চাঁচাবি না। বাইরে গিয়ে চুপিচুপি জাপটে ধরতে হবে চোরটাকে।

তোর সাহস থাকে তো তুই ধরিস।

তুই অতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ভূতের কথা বলছি না। বলছি চোর ধরার কথা। সেদিন তোদের বাসায় এতো বড় চুরি হলো, ফের যদি আসে?

আমাদের এখানে কারা চোর, কারা ভূত একথা কেউ হলপ করে বলতে পারবে না।

তুই কি বলতে চাস ভূত চুরি করে?

ওদের যখন যা ইচ্ছে তখন তাই করে। নিকেরিরা বলে, রাতে পাহারা না দিলে ওদের সব মাছ মেছোভূত চুরি করে নিয়ে যায়।

কেন, চোর-ডাকাতের বুঝি মাছ খেতে ইচ্ছে করে না?

সারা রাত বকবক না করে ঘুমোতে দে।–

রবি পাশ ফিরে শুলো। রাতুল ওর বুকের ঢিবটিব শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো। মনে হলো রবিদের গোটা বাড়িটাকে কেউ যেন ভয়ের কালো আলখাল্লা দিয়ে মুড়ে দিয়েছে।