৯-১০. বাঘের গুহায় ইতু

০৯. বাঘের গুহায় ইতু

মুশকিল আসান যখন ইতুর হদিশ জানালেন, রাত তখন বারোটা। বাড়ির সবাই রাতের খাওয়া সেরে তাঁর চারপাশে গোল হয়ে বসেছিলো। পাড়ার কয়েকজন মহিলা কৌতূহলী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। জেঠিমা মিষ্টি হেসে শক্ত গলায় ওদের বিদায় করেছেন। রিমকিদের নানি অবশ্য সন্ধ্যার পরই চলে গিয়েছিলেন।

মুশকিল আসান অনেকক্ষণ ধরে ধূপ পোড়ালেন। ধূপের ঝাঁঝালো গন্ধভরা ধোঁয়ায় গোটা বারান্দা অন্ধকার হয়ে গেলো। তাঁর সামনে একটা আয়না রাখা। আয়নার ওপর ভুসোকালি মাখানো। তার চোখ দুটো বোজা ছিলো। কখনো বিড়বিড় করে। কখনো শব্দ করে কী সব আরবি দোয়া পড়েছিলেন।

ঠিক বারোটার সময় তিনি বাংলা কথা বললেন, বাঘের গুহায় আটকা পড়েছে। পালানোর কোনো পথ নেই।

ইতুর মা কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, বাঘের গুহা কোথায়, সুন্দরবনে?

একটা ঘরের মধ্যে আছে। কোনো জানালা নেই, দরজায় ডবল তালা দেয়া। বাইরে পাহারাও আছে। বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে।

এখান থেকে কতদূরে জায়গাটা?

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আয়নার ভেতর কী যেন দেখার চেষ্টা করলেন মুশকিল আসান। তারপর চিন্তিত গলায় বললেন, রাস্তাটা মা চেনা যাচ্ছে না। পুরোনো একটা গলি। বাড়িটাও পুরোনো। গলির মাথায় সাদা গম্বুজওয়ালা মসজিদ দেখতে পাচ্ছি।

রাস্তা চেনা না গেলে বাছার কাছে যাবো কীভাবে? বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ইতুর মা।

উতলা হবে না বেটি। সবর করো, আল্লাহকে ডাকো। আমার পোষা জিনকে পাঠিয়ে সঠিক খবর আনতে হবে। খবিসটাকে ও ছাড়া আর কেউ শায়েস্তা করতে পারবে না।

জেঠিমা বললেন, আপনার পোষ জিন বসে আছে কেন হুজুর? ওকে বলুন না এখনই গিয়ে ইতুকে নিয়ে আসুক।

ও তো এখন এখানে নেই মা। সফরে গেছে। কাল বাদ এশা ফিরবে। তার আগে কিছুই বলা যাবে না।

মেজো ফুপি বললেন, দুখির মা বজ্জাতটা কোথায় আছে, জানার কোনো উপায় নেই হুজর?

নিশ্চয়ই আছে। একটু অপেক্ষা করো–বলে আবার চোখ বুজে ধ্যানে বসলেন মুশকিল আসান।

ছোটদের ভেতর মিতু আর রন্টু, ঝন্টু খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। ধূপের ঘন সাদা ধোঁয়ার ভেতর লম্বা চুলদাড়িওয়ালা মুশকিল আসানকে মনে হচ্ছিলো এ-পৃথিবীর বাসিন্দা নয়। তিনি কথাও বলছিলেন টেনে টেনে, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে তাঁর গলা। ছোটন লক্ষ্য করলো, বড়দি, ভূপালী জেঠিমা আর দিদা ছাড়া বাড়ির সবাই বারান্দায় বসে আছে। এমনকি ছোটকাও ভালো মানুষের মতো মুখ নিয়ে বসে আছে বড়দার পাশে, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।

অনেকক্ষণ বিড় বিড় করার পর মুখ খুললেন মুশকিল আসান–মেয়েটা খুব ভয় পেয়েছে। পালাচ্ছে গ্রামের পথে। বাঁশবনের ভেতর ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। সঙ্গে আরো দুজন আছে।

দুখি আর দুখির বাপ। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন মেজো জেঠিমা–পালিয়ে কোথায় যাচ্ছে বলা যাবে না হুজুর?

এখনো তো ওরা পথে। কোথাও না যাওয়া পর্যন্ত কী করে বলি কোথায় যাচ্ছে!

মুশকিল আসানের আসর ভাঙতে রাত একটা বাজলো। তাও ভাঙতো না, যদি না তিনি জোর করে সবাইকে উঠিয়ে দিতেন। বললেন, ফজর পর্যন্ত তিনি হালকায়ে জিকিরে বসবেন। এ সময় কারো কাছে থাকা চলবে না।

মিতু, রন্টু, ঝন্টু ওদের ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লো। বাড়ির অন্য সবাই যে যার ঘরে গিয়ে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। ঘুম আসছিলো না ছোটনের। বিছানায় শুয়ে শুধু ছটফট করলো। ইতু কোথায় আছে, কীভাবে আছে, যারা ওকে আটকে রেখেছে তারা ওকে খেতে দিচ্ছে কিনা, মারধোর কি বেশি করেছে–এসব কথা সারাক্ষণ দাপাদাপি করছিলো ওর মাথায়।

অনেকক্ষণ ধরে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে শেষে উঠে বসলো ছোটন। ঝন্টু বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলো। অন্ধকারে বিছানা থেকে উঠে ছাদে গেল ছোটন।

চাঁদ ডুবে গেছে অনেক আগে। দমকল অফিসের পেটাঘড়িতে এরই ভেতর দুটোর ঘণ্টা বেজেছে। চাঁদ না থাকলেও সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো হীরের কুচির মতো তারার মেলা। তারার আবছা আলোয় ফিনফিনে কুয়াশার ভেতর গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে ছোটন ছাদের ওপর পায়চারি করতে লাগলো। মুশকিল আসান যে বলেছেন রাতে কেউ ঘর থেকে বেরোবে না, বেরোলে ভয়ানক বিপদ হতে পারে–ওসব কথা ছোটনের মনেই নেই। হাঁটতে হাঁটতে একসময় ছাদের পশ্চিম কিনারে এসে দাঁড়ালো। তখনই ওর চোখে পড়লো গলির মোড়ে বাকের চাচার পান-দোকানের সামনে তেরপল ঢাকা তিনটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। কুয়াশার ভেতর বোঝা গেলো না ট্রাক থেকে মাল নামানো হচ্ছে না তোলা হচ্ছে। লাইটপোস্টের মিটমিটে আলোয় মনে হলো ও বুঝি কোনো নির্বাক বায়স্কোপ দেখছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কালো কালো কয়েকটা মানুষ ট্রাকের চারপাশে শুধু বাক্স মাথায় আনাগোনা করছে। একবার ভাবলো কাছে গিয়ে দেখবে, পরে ইতুর কথা মনে হলো। ইতুকে ছাড়া একা কোনো এ্যাডভেঞ্চারের কথা ওর ভাবতে ইচ্ছে করলো না।

.

পুরো তিরিশ ঘণ্টা পর ইতুর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ওর চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। প্রথমে মনে হলো ওদের চিলেকোঠার খাটে বুঝি শুয়ে আছে ও, হাত বাড়ালে ছোটনকে ছুঁতে পারবে। কথাটা মনে হতেই দিব্যি ঘুমিয়ে যাচ্ছিলো। ঘুম আসার ঠিক আগে মনে পড়লো ও জেগেছিলো পানি খাওয়ার জন্য। তেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ওর ঘুমঘুম ভাবটা চলে গেলো। উঠে বসতেই টের পেলো এটা ওদের জাজিম বিছানো খাট নয়। শক্ত কাঠের তক্তপোষের ওপর একটা কম্বল বিছানো। বালিশটাও শক্ত আর তেলতেলে। মাঝারি আকারের বদ্ধ ঘরের ভেতর ভ্যাপসা একটা গন্ধ। ঘরের কোনো জানালা নেই। দুটো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ইতু এখানে এলো কী করে? ভাবতে গিয়ে ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো। কয়েক মুহূর্ত চোখ বুজে রইলো। তারপর ধীরেধীরে ওর সব কথা মনে পড়লো।

সন্ধ্যেবেলা বর্মণদের দোকানে বসে ইতু তাকিয়েছিলো ওদের গলির মুখের দিকে। ভাবছিলো কাজের লোকদের কেউ যদি সন্দেহজনকভাবে গলি থেকে বেরোয় তাহলে তাকে লুকিয়ে অনুসরণ করবে। অনেকক্ষণ পর বনমালীকে বেরোতে দেখে ইতুর চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। রাস্তার এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে কী যেন খুঁজলো বনমালী। তারপর রাস্তা পেরিয়ে বাকের চাচার পান-দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। দোকানের খদ্দের বিদেয় না হওয়া পর্যন্ত বনমালী দাঁড়িয়ে রইলো। এর ভেতর কয়েকবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে যেন খুঁজলো। ইতুর মনে পড়লো পিকনিকের দিন ওদের বাড়িতে অসুস্থ ভূপালী জেঠিমা আর দুখির মা ছাড়া অন্য কেউ ছিলো না। হতে পারে, দুপুরে খেয়ে দেয়ে জেঠিমা ঘুমিয়েছেন আর দুখির মার তো রোজ দুপুরে দুঘণ্টা না ঘুমোল নাকি পেটের ভাত হজম হয় না। সেই ফাঁকে বনমালী গিয়ে যদি হীরের নেকলেসটা চুরি করে, ধরার কারো সাধ্য নেই। বনমালী জানে বাড়িতে যে মুশকিল আসান এসেছেন–ভূপালী জেঠিমা বলেছেন চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর নাকি তিনি চুরি-যাওয়া হারের সন্ধান দিতে পারবেন। বনমালী নিশ্চয়ই বুঝেছে হারটি বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয়। রাত পোহাবার আগেই ওটা কোথাও পাচার করে দিতে হবে। এত দামী হার চট করে তো বিক্রিও করা যাবে না। খোঁজখবর নিয়ে বিক্রি করতে এক-দুমাস লেগে যেতে পারে।

বাকের চাচাকে একা পেয়ে বনমালী নিচু গলায় কী যেন বোঝাচ্ছিলো। তাকে বাকের চাচা বারবার মাথা নেড়ে বারণ করছিলো। তবে কি বাকের চাচা হারটা রাখতে রাজি হচ্ছে না? ইতু মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিল বনমালী এরপর যেখানে যাক ওকে অনুসরণ করবে। বনমালী আর বাকের চাচা নিবিষ্ট মনে কথা বলছিলো।

বর্মণদের দোকানে বসে থাকতেও অস্বস্তি লাগছিলো ইতুর। এর ভেতর বর্মণদের ম্যানেজার রহমতউল্লাহ দুবার ওকে জিজ্ঞেস করেছে, কি ইতুমিয়া, সাইজের কালে এইহানে একলা বয়া বয়া মাক্ষি মারতাছ কেলা? পরে আবার বলেছে–রাইত ওইয়া গেল, বাড়িত যাও না ক্যান, কেউ বকা-উকা দিছে?

বনমালী আর বাকের চাচা তখনো কথা বলছিলো। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার শব্দে শোনার কোনো উপায় নেই–ওরা কী নিয়ে কথা বলছে। বনমালী গলি থেকে বেরোবার আধঘণ্টা পরে ইতু দেখলো মীর্জা এহতেশামের লম্বা সাদা গাড়িটা গলির মুখে এসে থেমেছে। গাড়ি চালাচ্ছিলো ড্রাইভার। ইতু ধরে নিয়েছিলো এহতেশাম ভাইয়া ওদের বাড়িতেই যাচ্ছে। কিন্তু না, ওদের গলিতে ঢোকার বদলে এহতেশাম মোড়ের ডিস্পেন্সারিতে গিয়ে ঢুকলো। বর্মণদের লোহার দোকান থেকে ডিস্পেন্সারির ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যায়। মীর্জা এহতেশাম ডিস্পেন্সারির মালিকের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললো। একসময় তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো। মালিককে কিছু বোঝাতে চাইছে, ও বুঝতে চাইছে না, বিরক্ত হচ্ছে–কথা শোনা গেলেও হাত আর মুখ নাড়া থেকে ইতু এটুকু বুঝতে পেরেছিলো। শুধু বুঝতে পারছিলো না কী এমন ঝামেলায় পড়েছে মীর্জা এহতেশাম।

ইতুর হঠাৎ মনে হলো এহতেশামের কোনো বিপদ হতে পারে। বনমালীর কথা ভুলে গিয়ে ও তাকিয়ে রইলো ডিস্পেন্সারির দিকে, যেখানে আরো উত্তেজনাকর দৃশ্যের অভিনয় হচ্ছিলো। মালিককে মনে হল খুবই রেগে গেছে। এহতেশামকে আঙুল তুলে শাসালো কয়েকবার। তারপর ইতু যা দেখলো–ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। পকেট থেকে এহতেশাম ছোট্ট একটা পিস্তল বের করে মালিককে কী যেন বললো। ভয় পেয়ে মালিক দুহাত ওপরে তুলেছিলো, এহতেশামের ধমক খেয়ে আবার হাত নামালো। তারপর ভয়ে ভয়ে ডিস্পেন্সারি থেকে বেরিয়ে এসে ঝাঁপ নামিয়ে বন্ধ করে দিলো। মনে হলো সুযোগ পেলেই ও ঝাঁপিয়ে পড়বে এহতেশামের ওপর। আড়চোখে এহতেশামের দিকে তাকাতে তাকাতে ওর ফোর্ড গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো। এহতেশাম ওর পিস্তলটা মালিককে একবার দেখিয়েই পকেটে পুরে ফেলেছিলো। মালিকের পেছন-পেছন এহতেশাম গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।

ইতু সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিল বনমালীকে নয়, এই মুহূর্তে এহতেশামকেই অনুসরণ করা উচিত। হীরের নেকলেসের চেয়ে বড়দির কথাই ভাবলো। মনে হলো ডিস্পেন্সারির মালিকটা নিশ্চয় খারাপ লোক, এহতেশামকে কোনো ব্যাপারে ঠকিয়েছে। আজ কায়দা-মতো পেয়ে ওকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে কোথায়? উল্টো কোনো বিপদে পড়বে না তো? আর কদিন বাদে বাদির সঙ্গে মীর্জা এহতেশামের বিয়ে। যদি ওর কোনো বিপদ হয়–ভাবতেই শিউরে উঠলো ইতু।

নিতাইকে ডেকে চাপা গলায় ইতু বললো, তোর সাইকেলটা নিচ্ছি। কাল ফেরত পাবি।

নিতাই কী যেন বলতে যাচ্ছিলো, ওকে কোনো সুযোগ না দিয়ে ইতু সাইকেল চালিয়ে অনুসরণ করলো এহতেশামের সাদা ফোর্ড গাড়িটাকে। এদিকের রাস্তাঘাট বেশ সরু। রাত তখন সাড়ে আটটা হলেও রাস্তায় রিকশা, ঘোড়াগাড়ি, সাইকেল আর পথচারী খুব কম ছিলো না। সাইকেলে করে ফোর্ড গাড়ি অনুসরণ করতে ইতুর কোনো অসুবিধে হলো না।

দুতিনটে রাস্তা পেরিয়ে ফোর্ড গাড়িটা ফরাশগঞ্জ এসে দিলীপদের পুতুলওয়ালা বাড়ির পাশে দাঁড়ালো। এই রাস্তা, এই বাড়ি ইতুর অচেনা নয়। দিলীপ আর ও এক ক্লাসে পড়ে। ক্লাস ফাঁইভ-সিক্সে থাকতে যখন ও স্বপনকুমার সিরিজ পড়তো তখন প্রায়ই দিলীপের বাসায় আসত বই বদলাবার জন্য।

দিলীপদের বিশাল জমিদারবাড়ির বাঁ-পাশ দিয়ে সরু অন্ধকার একটা গলি চলে গেছে ভেতরের দিকে। ইতু আগে কখনো এ গলিতে ঢোকে নি। অবাক হয়ে ও দেখলো ডিস্পেন্সারির মালিক আর মীর্জা এহতেশাম গাড়ি থেকে নেমে ওই গলির ভেতর ঢুকলো। ইতু সাইকেলটা দিলীপদের দারোয়ানের কাছে রেখে পায়ে হেঁটে অনুসরণ করলো ওদের।

গলিটা বেশ অন্ধকার। আশেপাশের বাড়ির জানালা থেকে আসা সামান্য আলোয় কালো পথটুকু শুধু দেখা যাচ্ছিলো। দিলীপদের ছটা বাড়ি পরে বড় আঙিনাওলা একটা পুরোনো বাড়িতে ঢুকলো মীর্জা এহতেশাম আর ডিস্পেন্সারির মালিক। বাড়িটার চেহারা এমন যে পূর্ণিমার আলোয় রীতিমতো ভুতুড়ে বাড়ির মতো দেখাচ্ছিলো। ভূতের ভয় না থাকলেও ওদের পেছন পেছন বাড়ির আঙিনায় পা রাখতেই ইতুর শিরদাঁড়া বেয়ে সরসর করে ঠাণ্ডা রক্তের স্রোত বয়ে গেলো। মনে হলো সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ! দোতালার দুটো কামরায় শুধু আলো জ্বলছে, সারা বাড়ি অন্ধকার। জানালা থেকে একটুকরো আলো আঙিনায় এসে পড়েছে। গুণ্ডাদের আস্তানা হওয়ার জন্য এরকম হানাবাড়ি আদর্শ জায়গা।

বাড়ির আঙিনায় ঢোকার পর এহতেশামকে বেশ নার্ভাস মনে হচ্ছিলো। কয়েকবার আশেপাশে তাকালো, পেছনেও তাকালো। আঙিনার আলোয় দাঁড়িয়ে তাকিয়েছিলো বলে গলির অন্ধকারে ইতুকে দেখতে পেলো না। ইতুর মনে হলো মীর্জা এহতেশাম এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে একা গুণ্ডাদের আস্তানায় এসে বোকামি করেছে। এসে যখন পড়েছে পালিয়েও যাওয়া যাবে না। এটা ভেবে একরকম মরিয়া হয়েই সে ভেতরে ঢুকলো। ইতু যথারীতি অনুসরণ করলো ওকে, এহতেশাম ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না।

দোতালায় ওঠার সিঁড়ির কাছে এসে ইতু টের পেলো বাড়িতে আরো লোকজন আছে। দোতলায় কয়েকজনের গলা শোনা যাচ্ছিলো। কাঠের সিঁড়ির ওপর পা রাখতেই কাঁচ করে একটা শব্দ হলো। ভীষণ ঘাবড়ে গেলো ইতু। সব কটা সিঁড়ি যদি ওর পায়ের ভারে শব্দ করে তাহলে বাড়িসুদ্ধ সবাই টের পেয়ে যাবে। দ্বিতীয় সিঁড়িতে খুব সাবধানে পা ফেললো। কোনো শব্দ হল না। ইতুর বুকের ভেতর ঢিবঢিব করছিলো। চুপচাপ দোতালায় উঠতে না পারলে ওর দশাও নির্ঘাত মীর্জা এহতেশামের মতো হবে। ওর কপাল ভালো, মাঝের একটা সিঁড়ি ছাড়া আর কোনো সিঁড়িতে শব্দ হলো না।

দোতালায় উঠে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ইতু। সামনে টানা-বারান্দা, ডান দিকটা খোলা, বাঁ-দিকে ঘরের দরজাগুলো সব বন্ধ। শেষ মাথায় ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক করা। সেই ঘরেই আলো জ্বলছিলো। বারান্দায় দরজার ফাঁক দিয়ে সরু একচিলতে আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। পা টিপে টিপে সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো ইতু।

ঘরের ভেতর চাপা উত্তেজিত গলায় কারা যেন কথা বলছে। ইতু আরো কাছে যেতেই একটা কথা পরিষ্কার শুনতে পেলো বাঘের গুহায় পা দিয়ে কেউ জান নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। কথাটা যে মীর্জা এহতেশামকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, বুঝতে অসুবিধে হল না ওর। ইতু কী করবে, ঘরের ভেতর ঢুকবে না দৌড়ে পুলিসে খবর দেখে? কথাটা ভাবতে না ভাবতেই পেছন থেকে সড়াশির মতো শক্ত দুটো হাত ওকে জাপ্টে ধরলো। চমকে উঠে ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে টের পেল ওকে যে ধরেছে তার গায়ের জোর ওর চেয়ে দশগুণ বেশি। ঠিক তখনই আরেকজন ভেজা একটা রুমাল ওর নাকে চেপে ধরল। ক্লোরোফর্মের গন্ধে ও জ্ঞান হারাবার আগে মীর্জা এহতেশামের কথা শুনেছিলো। কথাটা ছিল চমকে ওঠার মতো, ইতু অন্ধকার ঘরে শক্ত তক্তপোশে বসে মনে করতে পারলো না এহতেশাম কী বলেছিল।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো ইতু। বন্ধ দরজার পাশে টেবিলের ওপর হারিকেন আর একটা টিনের থালা রাখা রয়েছে। হারিকেনের আলোটা কমিয়ে রেখেছে। কাছে গিয়ে দেখল থালায় শুকনো দুখানা আটার রুটি ছাড়া আর কিছু নেই। পাশে ময়লা তোবড়ানো জগে পানিও রয়েছে। কোনো কিছু না ভেবে ইতু অর্ধেকটা পানি খেয়ে ফেললো। এতক্ষণ ধরে যে অস্বস্তিটা ছিলো সেটা খানিকটা কাটলো। রুটি দেখে মনে হলো ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। একটুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে দিলো। বাসি শুকনো আটার রুটি যে খেতে এত উপাদেয় এটা ওর আগে জানা ছিলো না। আস্তে আস্তে দুটো রুটির সবটাই খেয়ে ফেললো ও। জগ থেকে আরো পানি খেলো। তারপর তক্তপোশের ওপর বসে ভাবলো এটাই তাহলে বাঘের গুহা। বাড়ির কথা মনে হলো ওর। ছোটনরা কী করছে এখন? কতক্ষণ এখানে আটকে আছে ও? বাড়িতে নিশ্চয় হইচই শুরু হয়ে গেছে। মুশকিল আসান যদি লুকোনো নেকলেসের কথা বলতে পারেন ওর সন্ধানও দিতে পারবেন।

কোথাও কোনো শব্দ নেই। বোঝার কোনো উপায় নেই বাইরে এখন রাত

দিন। এটা কি দিলীপদের পাশের গলির সেই হানাবাড়ি না অন্য কোথাও কিছুই বুঝতে পারলো না ইতু। শুধু এটুকু বুঝলো যারা আটকে রেখেছে তারা ওকে এখনই মেরে ফেলবে না। কারা এরা, ছেলেধরা গুণ্ডা না অন্য কিছু? ভাবতে গিয়ে ইতুর আবার ঘুম পেলো।

.

১০. সব ভালো যার শেষ ভালো

ছোটন যখন ঘুমিয়েছে তখন বাড়ির মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছিলো। ঘুম ভাঙল দিদার ডাকে। চাপা গলায় দিদা ওকে বলছিলেন, ওরে ছোঁড়া ওঠ না, আর কত ঘুমোবি?

চোখ মেলে তাকাতেই দিদা বললেন, এক্ষুনি নাশতা করে নে, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি।

ঝন্টু, রন্টু আর মিতু আগেই উঠে গেছে। দিদাকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো। ছোটন বললো, ইতুর কোনো খোঁজ পেয়েছে দিদা?

কোনো কথা নয়। চাপা গলায় দিদা বললেন, যা বলছি তাই কর। নাশতা করে আমার ঘরে আয়।

নিচে এসে ঝটপট মুখহাত ধুয়ে নাশতা করে ছোটন দিদার ঘরে এলো। পরনের কাপড় বদলে গায়ে শাল জড়িয়ে তিনি ওর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, রিমকিদের বাসায় চল, ডাক্তার ছোঁড়ার সঙ্গে জরুরী কথা আছে।

ছোটনদের হাত ধরে দিদা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ছোটন অবাক হয়ে বললো, কী হয়েছে দিদা, কিছু বলছে না কেন?ছোটকা কি হীরের নেকলেসটা বেচে দিয়েছে?

আঃ চুপ চুপ! নেকলেস নিয়ে কোনো কথা নয়!

বাইরের রোয়াকে বসেছিলো রন্টু, ঝন্টু আর মিতু। দিদা আর ছোটনকে বেরোতে দেখে ওরা কোরাসে জানতে চাইলো–কোথায় যাচ্ছো দিদা?

ছোটন দিদার মুখের দিকে তাকালো। দিদা অসহায় গলায় বললেন, রিমকিদের বাড়িতে।

আমরাও যাব।

আস্তে বল্। চাপা গলায় ধমক দিলেন দিদা–যেতে চাইলে যাবি। ডাক্তারের সঙ্গে আমার প্রাইভেট কথা আছে। ওখানে কারো থাকা চলবে না।

ওরা তিনজন অবাক হয়ে দিদা আর ছোটনের সঙ্গী হলো। রিমকির নানিও কম অবাক হলেন না দিদাকে দেখে। বললেন, কোনো বিপদ হয় নি তো বুবু?

কাষ্ঠ হেসে দিদা বললেন, মাথার ওপর পাহাড় সমান বিপদ। কোন্ বিপদটা হতে বাকি আছে বোন? আগে আমি একটা প্রাইভেট টেলিফোন করবো। তারপর ডাক্তারের সঙ্গে কিছু কথা বলবো।

ওপর থেকে ওদের দেখে রিমকি-সিমকি নেমে এসেছে। রিমকির নানি দিদাকে নিয়ে গেলেন। রিমকি অবাক হয়ে বললো, দিদা কেন এসেছেন? ইতুর কিছু হয় নি তো?

ছোটন বললো, ইতুর খবর পাই নি। সাইফ ভাইর সঙ্গে দিদা কী প্রাইভেট কথা বলবেন তাও জানি না।

দিদার চেহারা দেখে মনে হলো সাংঘাতিক কিছু একটা তিনি জেনে ফেলেছেন। বিজ্ঞের মতো বললো রিমকি।

কী জেনেছেন? জানতে চাইল ঝন্টু।

ইতু কিংবা নেকলেস চুরির কোনো ব্যাপার।

ছোটন চিন্তিত গলায় বললো, আমি ভাবছি বাড়িতে টেলিফোন থাকতে দিদা এখানে কেন ফোন করতে এলেন?

তোমাদের টেলিফোন খারাপও তো হতে পারে।

তা না হয় হলো, প্রাইভেট কথা কার সঙ্গে বলবেন?

সবজান্তার মতো রিমকি বললো, মনে হচ্ছে দিদা কোনো প্রাইভেট ডিটেকটিভের সঙ্গে কথা বলতে চান।

রন্টু বললো, এহতেশাম ভাইয়ার সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। তাঁর নাকি ওপর মহলের লোকজনদের সঙ্গে ভারি খাতির।

ছোটনরা কথা বলছিলো রিমকিদের বসার ঘরে। ছোটন যেখানে বসেছিলো সেখান থেকে দোতালার ওঠার সিঁড়ি দেখা যায়। রিমকিদের সঙ্গে কথা বলার সময় ও লক্ষ্য রাখছিলো দিদা কখন নিচে নামেন।

খুব বেশি হলে পনের মিনিট দোতালায় ছিলেন দিদা। তারপর রিমকির মা আর সাইফকে নিয়ে নিচে নামলেন। ছোটন বুঝলো দিদার প্রাইভেট কথা শেষ হয়েছে। সাইফের সঙ্গে কথা বলছিলো দিদা। শুধু ওঁর শেষ কথাটাই ওদের কানে এলো–সাবধান, কাকপক্ষীটিও যেন টের না পায়।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন দিদা। যেভাবে বলেছেন সবকিছু সেভাবেই হবে। এই বলে সাইফ কাউকে আর কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

ছোটনদের ওপর চোখ পড়লো দিদার। মুখ টিপে হেসে বললেন, এরই মধ্যে আড্ডায় জমে গেছিস মনে হচ্ছে!

সিমকি পুট করে বললো, আমরা কি এখন ক্যারাম খেলতে পারি দিদা?

খুব পারিস। তবে ক্যারাম খেলতে নিশ্চয় পাঁচজন লাগে না! ছোটন আমার সঙ্গে আয়।

ক্যারাম খেলতে ছোটনেরও ইচ্ছে ছিলো না। ওর মনে হল দারুণ উত্তেজনাকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে বাড়িতে। দিদার সঙ্গে আসতে পেরে ও খুশিই হলো।

ঘরে এসে দিদা সবেমাত্র পানের বাটা নিয়ে বসেছেন–হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন ভূপালী জেঠিমা। বললেন, বহুৎ মসিবত হয়ে গেল চাচিজান। আপনি ছিলেন না। একটু আগে ভূপাল থেকে জরুরি টেলিফুন আসল। আপনার ভান্‌জার তবিয়ৎ বহুৎ খারাপ আছে। আমাকে তুরন্ত যেতে বলেছে।

দিদা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, সে কি রাঙা বউ! কী হয়েছে আশফাকউদ্দিনের?

ভূপালী জেঠিমা কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন, মালুম না আছে চাচিজান। আমাদের এক পড়োসান বলল, বহুবিবি জলদি চলা আও, ভাইসাব কি তবিয়ৎ নামাজ হ্যাঁয়। তারপর টেলিফুন লাইনটা কেটে গেল।

একবার কি তুমি ট্রাঙ্ককল করবে?

না চাচিজান। দো রোজ লেগে যাবে লাইন পেতে। আমার বহুৎ পেরেশান লাগছে। আপনি মেহেরবানি করে কাউকে বলুন আমার টিকেটটা আজ নয়তো কালকের করিয়ে দিতে।

ওটা করা যাবে রাঙাবউ। কিন্তু জাহানারার বিয়েতে তুমি থাকবে না, ভাবতেই যে খারাপ লাগছে আমার।

আমি খাসদিল থেকে দোয়া করব জাহানারা বিটিয়াকে। ও বহুৎ আচ্ছা লাড়কি আছে চাচিজান। মীর্জা এহতেশামের সাথে শাদি হলে ও হামেশা খুশ থাকবে।

ঠিক আছে রাঙাবউ । তোমার এতবড় বিপদ জেনে আর বিয়ে খেতে বলবো না। টিকেটটা দাও, আমি কলিমউদ্দিনকে পাঠাচ্ছি এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে।

টিকেট ভূপালী জেঠিমার হাতেই ছিলো। ওটা ছোটনকে দিয়ে দিদা বললেন, কলিমউদ্দিনকে নিয়ে এক্ষুনি যা। আজকের সিট পেলেই সবচেয়ে ভালো হয়।

কলিমউদ্দিন মানে ছোটকা। হীরের নেকলেসের ঘটনা জানার পরও দিদা কেন ছোটকাকে নিয়ে যেতে বলছেন কিছুই বুঝতে পারলো না ছোটন। ভূপালী জেঠিমার ট্রাঙ্ককল আসা মানে বাড়ির টেলিফোন ঠিকই আছে। তবু দিদা ফোন করতে কেন গেলেন রিমকিদের বাড়িতে? কার সঙ্গে দিদা এমন কী কথা বলেছেন যা নিজেদের টেলিফোনে বলা যেতো না? মাঝেমাঝে দিদার আচরণ বাড়ির সবার কাছেই রহস্যময় মনে হয়।

এয়ার ইন্ডিয়ার সন্ধ্যার ফ্লাইটে একটাই সিট খালি ছিল। কাউন্টারের মহিলাটি মিষ্টি হেসে বললেন, আপনদের কপাল ভালো। একঘণ্টা আগে এলেও পেতেন না। একটু আগে একজন জানিয়েছেন, তিনি যেতে পারবেন না।

বাড়ি ফেরার পথে ছোটকা একগাল হেসে ছোটনকে বললেন, আমাদের কেন কপাল ভালো হতে যাবে? কপাল ভালো ভূপালী জেঠিমার। ওঁর এবাদত-বন্দেগির কী রকম তেজ দেখেছিস! আজ যেতে চাইলেন, অমনি একজন প্যাসেঞ্জার টিকেট বাতিল করলো। কথা বলার সময় ভঙ্গিতে ছোটকার গলা গদগদ করছিলো।

সেদিন নেকলেস নিয়ে ওঁকে স্বর্ণকারের দোকানে যেতে দেখার পর থেকে ছোটন ওঁর সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারছিলো না। কিন্তু বাড়িতে সবাই ছোটকার এই কথায় খুব গুরুত্ব দিলো। গম্ভীর হয়ে বড় ফুপি বললেন, হবে না কেন, কত বড় পীর বংশের মেয়ে!

ভূপালী জেঠিমা চলে যাচ্ছেন–এ-খবর পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকজন বয়স্ক মহিলা ওঁকে ঘিরে বসে আছেন। দুখির মা পালিয়ে যাওয়ার পর সকাল থেকে কাজে লেগেছে বদনার মা। দফায় দফায় চা দেয়ার জন্য দোতালায় উঠলেও ওর মুখে হাসি মাখানো ছিলো। সকালে এসেই ও শ্বশুরের বাতের জন্য তেল পড়িয়ে নিয়েছে ভূপালী জেঠিমার কাছ থেকে। এ-সুযোগ গিরিবালা ধোপানিও ছাড়ে নি। ভূপালী জেঠিমা ঘন ঘন রুমালে চোখ মুছছেন, পাড়ার গরিব মানুষদের আনা ঘটির পানি আর বাটির তেলে দোয়া পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন। পাড়ার মহিলারা দুঃখী মানুষের জন্য ওঁর দয়াময়া দেখে অভিভূত হয়ে গেলো।

ছোটনকে দিদা বললেন, আজ সারাদিন কেউ চিলেকোঠার ঘরে যাবি না।

কেন দিদা? অবাক হলো ছোটন।

এখানে লোকজনের হইচই বেশি। মুশকিল আসান ওখানে বসেছেন। রাতে ওঁর পোষা জিন আসবে। তাই নিরিবিলি জায়গা দরকার।

খবরটা শোনামাত্র ছোটন ছুটলো রিমকিদের বলার জন্য। সিমকি উত্তেজিত হয়ে বললো, তার মানে, পোষা জিন আজই ইতুকে নিয়ে আসবে!

ঝন্টু শুকনো গলায় বললো, দিদার মাথায় কি কোনো বুদ্ধি নেই? কোন্ আক্কেলে মুশকিল আসানকে আমাদের ঘরে পাঠালেন পোষা জিন আনার জন্য? বাড়িতে আর কোনো ঘর ছিলো না?

রিমকি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, পোষা জিন নিশ্চয় তোমার ঘাড় মটকাতে আসবে না। ওটা আসবে ইতুকে আনার জন্য।

ছোটন ফোড়ন কাটলো–ইতুর জন্য ওর কোনো দরদ থাকলে তো!

হুঁ, যত দরদ সব তোরই আছে! মুখ কালো হয়ে গেলো ঝন্টুর।

ছোটন একটা শক্ত কথা বলতে যাচ্ছিলো, তখনই রিমকির নানি আর মা এসে ঘরে ঢুকলেন। নানি ছোটনকে বললেন, হ্যাঁরে, গিরিবালার কাছে শুনলাম তোদের ভূপালী জেঠি নাকি আজই চলে যাবেন?

মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ছোটন বললো, ঠিকই শুনেছেন। সন্ধ্যে ছটার ফ্লাইটে যাচ্ছেন। ভূপালী জেঠুর নাকি খুব অসুখ করেছে।

রিমকির মা বললেন, মা চলো, এ বেলা গিয়ে ওঁর দোয়া নিয়ে আসি।

চল্ বাছা। হতাশ হয়ে নানি বললেন, হাঁপানির জন্য আমাকে একটা তাবিজ দিতে চেয়েছিলেন। সেটা বুঝি আর কপালে জুটলো না।

ওঁরা দুজন বেরিয়ে যাওয়ার পর ছোটন রিমকিকে জিজ্ঞেস করলো, সাইফ ভাইকে দিদা কোথায় পাঠিয়েছেন কিছু জানতে পেরেছো?

ফিক করে হেসে সিমকি বললো, ছোটপা গিয়েছিলো মাকে জিজ্ঞেস করতে। ধমক খেয়ে ফিরে এসেছে। মা বলেছে বড়দের ব্যাপারে ছোটদের নাক গলানো মোটেই ভালো নয়।

রিমকির গম্ভীর চেহারা দেখে ছোটনের মায়া হলো। বলল, পৃথিবীর সব খারাপ কাজ বড়রাই করে। হীরের নেকলেসটা তো ছোটরা নেয় নি, বড়দেরই একজন সরিয়েছে ওটা।

ছোটনের এক কথায় রিমকির মন ভালো হয়ে গেলো। উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলো, কে নিয়েছে ওটা?

ছোটন বললো, ইতু ফিরে আসুক। সব জানতে পারবে।

রিমকি বললো, আমার মন বলছে ইতু আজই ফিরে আসবে।

ছোটরা অনেক কিছুই আগে থেকে বুঝতে পারে, বড়রা যা পারে না। দিদা যে বলেন–ঘোটরা হল ফেরেশতা, সে তো মিছে কথা নয়। ইতু ঠিকই ফিরে এলো সন্ধ্যার পর।

বিকেলে ভূপালী জেঠিমা বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কাঁদিয়ে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছেন। কাঁদেন নি শুধু দিদা। বড় ফুপি আড়ালে গিয়ে রিমকির নানিকে বলেছেন, হীরের নেকলেস চুরির শোকে নাকি দিদা পাথর হয়ে গেছেন। ছোটরা অবাক হয়েছিলো ভূপালী জেঠিমা চলে যাচ্ছেন, অথচ মীর্জা এহতেশামের কোনো খবর নেই! সেই সকালে বেরিয়ে সাইফও লাপাত্তা হয়ে গেছে।

ভূপালী জেঠিমা চলে যাওয়ার পর রিমকির মা আর নানিও চলে যাচ্ছিলেন। দিদা ওদের আটকে রেখেছেন এই বলে–রাতে মুশকিল আসানের পোষা জিন ইতুকে আনবে। না দেখে চলে যাওয়া কি ঠিক হবে?

অগত্যা থেকেই যেতে হলো ওঁদের। ইতু ফিরে আসবে জেনে রিমকি-সিমকির আনন্দ উত্তেজনাও কম নয়।

ঠিক ছটার সময় সাইফ এলো ইতুকে নিয়ে। সঙ্গে এসপি আমিন আহমেদ। ইতুর মা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন উস্কখুস্ক চেহারার ইতুকে। দিদা সাইফের থুতনি নেড়ে আদর করে বললেন, এটা বুঝি মুশকিল আসানের পোষা জিন! দেখলেই যে আদর করতে ইচ্ছে করে!

বাড়ির সবাই তখন বাইরের বসার ঘরে। কেউ সোফায় বসা, কেউ চেয়ারে, কেউ মাটিতে, কেউ দাঁড়িয়ে। বড় জেঠু অবাক হয়ে একবার এসপিকে বললেন, কোথায় পেলেন ইতুকে? আরেকবার সাইফকে বললেন, তুমি কবে থেকে মুশকিল আসানের পোষা জিন হলে?

সাইফ দিদার দিকে তাকালো, মুখে মিটিমিটি হাসি। দিদা ওকে চোখ টিপলেন–যা জানো বলে ফেলো বাপু ঝটপট। সব কথা না শুনে বৌমারা এখান থেকে নড়বে না। তোমাদেরও চা-নাশতা জুটবে না। সারাদিন ধকল তো কম যায়নি!

সাইফ বললো, ইতুকে উদ্ধার করার ব্যাপারে আমার কিংবা আমিন ভাইর তেমন কোনো ভূমিকাই নেই। কৃতিত্বটা ষোলআনা দিদার।

দিদা চোখ মটকে সাইফকে বললেন, আমাকে কেন তেল দিচ্ছো বুঝতে বাকি নেই বাছা!

বড় জেঠু এমনই উত্তেজিত ছিলেন যে দিদাকেই ধমক দিয়ে বসলেন–আহ্ মা, কথার মাঝখানে কথা বোলো না তো!

দিদাকে এভাবে কেউ ধমক দিতে পারে দেখে ফুপি, জেঠিমা, কাকিমাদের মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। শুধু দিদা হাসি চেপে বললেন, ঠিক আছে বাপু, এই আমি মুখে কুলুপ আঁটলাম। শেষে আমায় কিছু বলতে পারবে না।

সাইফ মৃদু হেসে বললো, সকালে দিদা এসে বললেন, ইতুকে মীর্জা এহতেশাম কিডন্যাপ করেছে। ও কাল রাতে এসেছিলো ভূপালী জেঠিমার কাছে। বাড়ির সবাই তখন মুশকিল আসানকে নিয়ে ব্যস্ত। ও সোজা ভূপালী জেঠিমার ঘরে ঢুকে তাকে নিচে ডেকে নিয়ে বললে, ছোঁড়াটাকে নিয়ে খুব বিপদ হচ্ছে। অনেক কথা জেনে ফেলেছে। দলের সবাই চাইছে মেরে ফেলতে। ভূপালী জেঠিমা ওকে বলেছেন, কিছুদিন লুকিয়ে রাখো। তোমাদের বিয়েটা আগে হয়ে যাক। তারপর যা ভালো মনে করো করবে। দিদা আড়ালে থেকে ওদের কথা শুনে যা বোঝার ঠিক বুঝে নিলেন। সকালে আমাকে বললেন, এক্ষুনি এসপিকে গিয়ে বলো মীর্জা এহতেশামকে এ্যারেস্ট করতে। ধরে পিটুনি দিলেই বলে দেবে ইতুকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। আমার কাছে সব শুনে আমিন ভাই নিজেই ফোর্স নিয়ে এহতেশামের বাড়িতে গেলেন। ওকে এ্যারেস্টের কথা বলাতে প্রথমে কী হম্বিতম্বি। নাকি আইজিকে ফোন করবে, মিনিস্টারকে ফোন করবে। এস পির চাকরি খাবে। থানায় নিয়ে জেরা করে কথা বের করতেই বিকেল হয়ে গেলো। তারপর ওকে নিয়ে ফরাশগঞ্জের একটা বাড়ি রেইড করে ইতুকে উদ্ধার করেছি। এহতেশামের ছিল নকল ওষুধের কারখানা। যে-বাড়িতে ইতুকে ওরা লুকিয়ে রেখেছিলো সেটা ছিলো ওদের গুদাম। ওর লোকজনদের ধরার জন্য আরো কয়েকটা জায়গা রেইড করতে হয়েছে।

সাইফের কথা শোনার সময় কারো চোখের মণি ঠিকরে বেরিয়ে আসার দশা। হলো, কারো চোয়াল ঝুলে গেলো। ওর কথা শেষ হওয়ার পর কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বললো না। সবাই ইতুর দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিলো যেন ও ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। বড় জেঠু ভাঙা গলায় ওকে বললেন, তুই কী করে জানলি এহতেশামের নকল ওষুধের কারখানা আছে?

আমি তো নেকলেস চোর ধরার জন্য বসেছিলাম বর্মণদের দোকানে। লাজুক হেসে ইতু ওর অভিযানের ঘটনাটা খুলে বললো। হানাবাড়িতে ক্লোরোফর্মের গন্ধে জ্ঞান হারাবার আগে যে কথাটা শুনে ও চমকে গিয়েছিলো, পরে ওর মনে পড়েছে। সেটা ছিল এহতেশামের গলা, কাকে যেন বলছিলো–তোমার কোনো কথা শুনবো না। এবার নকল ওষুধের লেবেল আমরা বড় প্রেস থেকে ছেপেছি। লেবেল দেখে কেউ ধরতে পারবে না। কোষ্টা আসল কোষ্টা নকল।

ছোটন উত্তেজিত গলায় বললো, কাল মাঝরাতে গলির মোড়ে ট্রাক থেকে। মাল ওঠানামা করতে দেখেছি। ওগুলো নির্ঘাত এহতেশামের ট্রাক ছিলো।

ছোটনের মা রেগে গিয়ে বললেন, মাঝরাতে তুই ছাদে গেলি কোন্ সাহসে? হুজুর বলেন নি এশার নামাজের পর সব খারাপ জিনরা ঘুরে বেড়ায়?

ছোটন শুকনো গলায় বললো, ইতুর জন্য খুব খারাপ লাগছিলো মা। ঘুম আসছিলো না। জিনের কথা তখন মনে ছিলো না।

ছোটনের কথা শুনে ইতুর বুকের ভেতর কেমন যেন করতে লাগলো। বললো, কিসের জিনের কথা বলছেন সেজো কাকিমা? ওটা হচ্ছে মুশকিল আসানের বুজরুকি। ও এহতেশামের দলের লোক। জিনের কথা বলেছে–রাতে যেন কেউ ঘর থেকে না বেরোয়। ওতে মাল সাপ্লাই দিতে সুবিধে হয়।

সাইফ দিদাকে বললো, হীরের নেকলেস কীভাবে উদ্ধার করলেন, এ-কথা কিন্তু সকালে আমার জানা হয় নি। আমিন ভাইও কিছু জানেন না।

বড় জেঠু চোখ কপালে তুলে বললেন, হীরের নেকলেস কোথায় পেলে মা, কিছু তো বলো নি?

মুখ টিপে হেসে দিদা বললেন, একটু আগে আমাকে ধমক খেতে হল কথা বলার জন্য। কোন্ মুখে আবার কথা বলি বাছা!

বড় জেঠু লজ্জা পেয়ে বললেন, তুমি যে কি মা! ছোটদের সামনে আমাকে এভাবে জব্দ করা ঠিক হচ্ছে?

ইতু ছুটে এসে দিদাকে জড়িয়ে ধরে বললো, বড় জেঠুকে না বললেও আমাকে বলতে হবে। তোমার নেকলেসের জন্য গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে আর একটু হলে জানটা যেতো।

ইতুকে আদর করে চুমু খেয়ে দিদা বললেন, তোর শরদের জান যাক। তুই একশ বছর বাঁচবি। তবে গোয়েন্দাগিরিতে ছোটন পাস করবে কিনা সন্দেহ!

ছোটন অবাক হয়ে বললো, ওটা যে ছোটকা নিয়েছে তোমাকে বলি নি বুঝি?

ছোটকা আরো অবাক হয়ে বললেন, তুই বলছিস কি ছোটন! হীরের নেকলেস আমি নিয়েছি?

তুমি বুঝি পরশু রাতে ওটা বিক্রি করার জন্য স্বর্ণকারের দোকানে যাও নি? মরিয়া হয়ে বললো ছোটন।

ছোটকা অসহায় গলায় বললেন, হায় আল্লাহ্, এ ছোঁড়া বলে কি মা?

মৃদু হেসে দিদা ছোটনকে বললেন, কলিমউদ্দিনকে আমিই পাঠিয়েছিলাম স্যাকরার দোকানে। ভূপালী বউ জাহানারাকে যে জড়োয়া সেটটা দিতে চেয়েছিলো, সেটা খাঁটি না মেকি যাচাই করে দেখার জন্য।

বড় ফুপি অবাক হয়ে বললেন, ওটা কি মেকি ছিল?

হ্যাঁ বাছা। সায় জানিয়ে দিদা বললেন, তখনই আমি বুঝলাম হীরের নেকলেসটা ভূপালী বউই সরিয়েছে।

কীভাবে সরালো মা? প্রশ্ন করলেন মেজো ফুপি।

যেদিন আমরা পিকনিকে গেছি সেদিনই সরিয়েছে। এহতেশাম ওকে সাহায্য করেছে। ও তো নিজেই বলেছিলো দুপুরে এহতেশাম আসবে।

তুমি সেটা উদ্ধার করলে কীভাবে?

অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। গোবিন্দ মিস্ত্রিকে এনে লুকিয়ে ওর ট্রাঙ্কের চাবি বানিয়েছি। কাল রাতে ও যখন এহতেশামের সঙ্গে নিচে বসে শলা করছিলো তখন ট্রাঙ্ক খুলে ওটা উদ্ধার করেছি। জিনিসটা যখন পাওয়াই গেছে তখন আমি চাই নি এ নিয়ে আত্মীয়-কুটুম্বদের ভেতর কথা উঠুক। তাই ওকে তড়িঘড়ি পাঠিয়ে দিলাম।

ছোটন অবাক হয়ে বললো, তার মানে সকালে তুমিই রিমকিদের বাসায় বসে ভূপাল থেকে জেঠিমাকে ফোন করেছিলে?

একগাল হেসে দিদা বললেন, ঠিক ধরেছিস! আমিই ওর পড়োসান হয়ে ফোন করেছিলাম। অবশ্য চোরাই নেকলেস হারাবার দুঃখে ও এমনিতেই চলে যেতো। যখন ও দেখেছে ওটা ট্রাঙ্কে নেই তখনই বুঝে নিয়েছে ওর চালবাজি শেষ। বিয়ের আগে এহতেশামের পাকাপাকিভাবে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার খবর পেলে ও হার্টফেলও করতে পারতো। তাই ওকে পাঠিয়ে দিতে হলো।

এসপি আমিন আহমেদ দিদাকে বললেন, মুশকিল আসানটাকে ঠিকমতো আটকে রেখেছেন তো?

দিদা হেসে বললেন, দরজার বাইরে তালা দিয়েছি। ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মরতে না চাইলে ওকে ঘরেই পাবে। যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।

বড় জেঠু কী বলতে যাবেন তখনই ঘরে ঢুকলো সূত্রাপুর থানার দারোগা। মোটাসোটা মানুষটা হাঁসফাঁস করে দিদাকে বললো, বলি নি বজ্জাত বেটি আমার চোখে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না! ঠিকই ধরে ফেলেছি ফতুল্লা থেকে।

দারোগার পেছনে দাঁড়িয়ে ফোঁৎফোৎ করে কাঁদছিল দুখির মা। দিদা ছুটে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–আর কাঁদিস না বাছা! কাল থেকে তোর কথা ভেবে মনটা পেরেশান হয়ে আছে। পালিয়েছিলি কেন, ভূপালী বউয়ের কথায়?

হ বড়মা। দিদার আদর পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো দুখির মা–রাঙা বিবি আমারে কয় খবিস জিনডার নজর বলে আমার উপরে পড়ছে। এ-বাড়ির দশ মাইলের ভিতরে থাকলে আমার বাচন নাই, গুষ্টি সুদ্দা মরণ লাগব। এই কথা কাউকে কইলেও বলে জিন লাইগা যাইব। হেই ডরে আমি পুলিসেরও কিছু কই নাই গো। হাউ হাউ হাউ!

মেজো ফুপি বললেন, তোকে এসব কথা বলার কারণটা কী? তুই কি নেকলেস সরাতে দেখেছিলি?

দেখতেও পারতো। দিদা সোফায় বসে শান্ত গলায় বললেন, সেদিন ও কিছু দেখেছে কিনা ভূপালী বউ তো জানে না। ওর ভয় ছিলো দুখির মাকে নিয়ে। ওকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে পুলিসের জেরায় যেন ও বেস কিছু বলে না ফেলে। তাছাড়া ও পালালে নেকলেস চুরির দায়টাও ওর কাঁধে ফেলা যাবে।

কী সাংঘাতিক! এতক্ষণ পর মুখ খোলেন রিমকির নানি–ভাগ্যিস জাহানারার বিয়ের আগে এদের শয়তানিটা ধরা পড়ল।

জাহানারার বিয়ের তারিখ কিন্তু ঠিকই থাকছে। মুখ টিপে হেসে দিদা রিমকির নানি আর সাইফকে দেখলেন। তারপর বললেন, শুধু বরের নামটা কার্ডে পাল্টানো হবে।

জেঠিমা, কাকিমারা সবাই হইচই করে উঠলো–এসব কী মা! আমরা তো কিছুই জানি না! বরের জায়গায় কার নাম বসবে?

জাহানারা দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। ওর বিয়ে নিয়ে বড়দের এ-ধরনের হইচই করতে দেখে লজ্জা পেয়ে পালালো। দিদা বললেন, বৌমারা যতক্ষণ মিষ্টি না খাওয়াচ্ছে, বিয়ের ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা নয়। তারপর ছোটনদের দিকে তাকালেন–তোরাও এখন পালা। বড়দের বিয়ের কথায় থাকতে নেই। মিষ্টির ভাগ ঠিকই পাবি। সেজো বউ ইতুকে আগে একগ্লাস দুধ দাও।

জেঠিমা, কাকিমাদের পেছন-পেছন ছোটরাও সবাই বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সাইফকে বসে থাকতে দেখে দিদা বললেন, তুমি তো বাছা তোমার ছাত্রীর ঘরে যেতে পারো। নিজের বিয়ের কথা কি নিজের কানে না শুনলে নয়?

দিদার কথায় জেঠুরা, কাকারা সবাই ঘর ফাটিয়ে হাসলেন। বেচারা সাইফ তখন লাল-টাল হয়ে পালাবার পথ খুঁজে পায় না। দোতালায় সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে রিমকি ইতুর কানে কানে বললো, খুব খুশিখুশি লাগছে না ইতু?

ইতু মৃদু হেসে রিমকির হাত ধরলো।