৩-৪. ভূপালী জেঠিমার আগমন

০৩. ভূপালী জেঠিমার আগমন

রিমকি সিমকিদের সঙ্গে মেশা যাবে না–দিদার এই ভয়ঙ্কর কথা শুনে ছোটনদের পৃথিবীটা মরুভূমি হয়ে গেলো। লুকিয়ে নিশ্চয় দেখা করা যায় কিন্তু দিদার সঙ্গে ওরা কেউ মিথ্যে কথা বলে না। ধরা পড়লে কী জবাব দেবে! পরদিন সকালে ছোটনরা চিলেকোঠার ঘরে বসে এ নিয়ে অনেক কথা বলেও দিদাকে নরম করার কোনো পথ খুঁজে পেলো না। পাওয়া সম্ভবও ছিলো না, দুদিন পর হঠাৎ করে যদি ভূপালী জেঠিমা ওদের বাড়িতে বেড়াতে না আসতেন।

ওদের এক জ্যাঠা সেই কোকালে বিএ পরীক্ষায় ফেল করে বাড়ি থেকে পালিয়ে ভূপালে গিয়ে কিসের যেন ব্যবসা করে বড়লোক হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়েও করেছিলেন জাঁদরেল এক পীর বংশে। ছোটদের বাবা-কাকারা গিয়েছিলেন সেই বিয়েতে। ফিরে এসে ভূপালী জেঠিমার রূপের আর গুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কলকাতায় থাকতে এই রূপসী বউটি ওদের বাড়িতে বার-দুই এসেছিলেন, ঢাকা আসার পর একবারও আসেন নি। ছোটরা শুধু ওঁর নামই শুনেছে, চোখে দেখে নি।

সকালে দিদার হাঁকডাক শুনে বাবা, কাকা, জ্যাঠারা যেভাবে ছুটোছুটি করছিলেন, ইতুরা বুঝে ফেলল গুরুত্বপূর্ণ কেউ বাড়িতে আসছেন। দিদাকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, তোদের ভূপালী জেঠিমা আসবে বিকেলের ফ্লাইটে। ভীষণ বড়লোক ওরা। ঘরবাড়ি নোংরা করবি না, ভাববে সহবৎ শিখিস নি।

দোতালায় ঝুলবারান্দার পাশে সবচেয়ে সুন্দর ঘরটা নতুন করে সাজানো হয়েছে ভূপালী জেঠিমার জন্য। দাদুর বিয়ের সময়কার আঙ্গুরলতার নকশাকাটা জমকালো পালঙ্কে নতুন জাজিম আর চাদর বিছানো হয়েছে। জানালায় ধবধবে সাদা পর্দা ঝোলানো হয়েছে, যেগুলো মাড় দিয়ে শক্ত করে ধুয়ে ভাঁজে ভাঁজে কড়া ইস্তিরি করেছে গিরিবালা ধোপানির বড় ছেলে। বড় একটা কাঠের আলমারি এ-ঘরে আগে থাকতেই ছিলো। একটা আয়না-বসানো টেবিল আর খানতিনেক চেয়ার আনা হয়েছে। সবকিছু বার বার মুছে আয়নার মতো চকচকে করে ফেলেছে দুখির মা।

ছোটন বললো, ভূপালী জেঠিমা আসছেন, কী মজা, তাই না রে!

ইতু ভুরু কুঁচকে বললো, জানি না, শুনি না–কোনোদিন চোখেও দেখি নি। মজা কিসের শুনি!

জেঠিমা যে কদিন থাকবেন দিদার হাবভাব দেখে মনে হয় ওঁকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন। কে কোথায় যাচ্ছে সে-সব খবর রাখার সময় নিশ্চয় তার হবে না। বলতে গিয়ে ছোটনের গলায় আনন্দ উপচে পড়লো।

ইতু বললো, আমার তো মনে হচ্ছে বাবা-জ্যাঠাদের সঙ্গে দিদা আমাদেরও ফুট-ফরমাশ খাঁটিয়ে মারবেন। দিনের ভেতর পঞ্চাশবার বাজারে পাঠাবেন, নইলে পাঠাবেন কাউকে ডাকতে। ওসব বড়লোকদের মেজাজও বড়লোকি হয়!

ঝন্টু ঝাঁঝাল গলায় বললো, তুই সবসময় খারাপটাই আগে দেখিস।

ভূপালী জেঠিমাকে আনতে তেজগাঁ এয়ারপোর্ট গিয়েছিলেন বাবা, কাকা, জ্যাঠা সবাই। ছোটকার অফিসের একটা হুডখোলা জিপ ছিলো। বন্ধুর কাছ থেকে এনেছেন মস্ত এক ফোর্ডগাড়ি। জেঠিমাকে নিয়ে ঘরে ফিরতে সন্ধে গড়িয়ে গেলো।

ঝলমলে ঘারারা কুর্তা পরনে, এক গা হীরেমুক্তোপান্নার গয়না নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন ভূপালী জেঠিমা। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসলেন। বিশাল শরীর নিয়ে হাঁসফাঁস করে এগিয়ে গেলেন দিদার দিকে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললেন, আপনি কেমুন আছেন চাচিজান! কত্তো বরস্ পর মোলাকাত হল! বহুবিটিয়ারা সব ভালো আছো তো?

ভূপালী জেঠিমার কথায় উর্দু টান–ছোটনরা শুনে খুব মজা পেলো। ধবধবে ফর্শা গায়ের রঙ, পানখাওয়া ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল, গোলগাল হাসিহাসি নিষ্পাপ মুখ, দুচোখে স্নেহ-ভালোবাসার অথৈ সমুদ্র।

দিদাকে সালাম করে উঠতেই তিনি ওঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–আমার হিসেব আছে ভূপালী বউ। তোর সঙ্গে আঠার বছর পর দেখা হলো।

আগে থেকে দিদা বলে দিয়েছেন–মা, কাকী, জেঠিরা সবাই দিদার ভূপালী বউ-এর পা-ছুঁয়ে সালাম করলেন। সিংদরজার বাইরে রাস্তার লোকজন উঁকি দিচ্ছিলো নতুন অতিথির সাজের বহর দেখে।

মা কাকিমারা একবাক্যে স্বীকার করলেন, বয়স যদিও ষাটের কাছে–ভূপালী বুবুকে মনে হয় না পঞ্চাশ পেরিয়েছেন। আর কী টকটকে গায়ের রঙ, যেন গা দিয়ে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে! দিদা ভাবলেন, পাশের বাড়ির ওদের একবার এনে দেখাতে হবে রূপ কাকে বলে।

ভূপালী জেঠিমার সঙ্গে এসেছে মস্ত বড় দুটো ট্রাঙ্ক। ঘরে গিয়ে যখন খুললেন তখন সবার চোখ ছানাবড়া। সবার কথা মনে করে জিনিসপত্র এনেছেন তিনি। দিদা থেকে শুরু করে সবার ছোট রন্টু ঝন্টু কেউ বাদ পড়লো না। লম্বা একটা ফর্দ বের করে সবার নাম মিলিয়ে উপহার বিলি করলেন। কাজের বুয়া দুখির মার জন্য কিছু আনার কথা নয়–ওকে দিলেন এককৌটো সুগন্ধি জর্দা। দুখির মা বলে দুবেলা ওর ভাত না খেলেও চলে কিন্তু পান ছাড়া ওর একদণ্ডও চলে না। ইতুদের বাড়িতে আসার এক ঘণ্টার ভেতর ভূপালী জেঠিমা সবার মন জয় করে ফেললেন।

পরদিন সন্ধেবেলা সবাইকে নিয়ে টানা-বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন তিনি। দিদা ছাড়া সবাই আসর জমিয়ে বসেছিলো। দিদা সকাল থেকে সেই যে রান্নাঘরে ঢুকেছেন। বেরোবার নাম নেই। ইতুরা রান্নাঘরে শতরঞ্জি পেতে খায়। খাওয়ার সময় একবার খালি দিদার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তারপর ওরা সারা বিকেল কাটিয়ে এসেছে রিমকি-সিমকিদের বাড়িতে। মা, কাকিমারা সবাই ভূপালী জেঠিমাকে নিয়ে ব্যস্ত। ছোটন আর ঝন্টু ঠিকই বলেছিলো, ভূপালী জেঠিমাকে নিয়ে বাড়ির সবাই যে-ভাবে মেতে আছে, ওরা কী করছে কোথায় যাচ্ছে সেদিকে কারো খেয়ালই নেই।

বারান্দায় বসে জেঠিমা ভূপালের গল্প করছিলেন। সামনে রাখা পানদান থেকে বড় দুখিলি পান মুখে ফেলে তিনি বললেন, আমার দাদাজানের ছোটভাই ছিলেন মস্ত কামেল পীর। আমরা তিনাকে ডাকতাম ছোড়দাদু বলে। তোমাদের ইয়াদ আছে তো–আমার দাদাজানের আব্বাহুজুর বাঙ্গাল মুলুক থেকে ভূপাল গিয়েছিলেন। তিনিও বহুৎ বড়া বুজুর্গ আদমি ছিলেন। তিনার ওফাতের সময় ছোড়দাদুকে গদ্দিনশিন করে যান। বেশুমার মুরিদ ছিলো তিনাদের। দিন নাই, রাত নাই–কাহা কাহাঁ মুলুক থেকে যে ওরা আসত তার হদিস কেউ জানত না। ছোড়দাদুর কাছে শুনেছি, ওদের বেশিরভাগ ছিলো জিন। তিনি ছাড়া দুসরা কেউ বনিআদম আর জিনের ভিতর ফারাক করতে পারতো না। জানো তো, আল্লাপাক জিনদের বানিয়েছেন আগুন দিয়ে।

গল্প বলার সময় ভূপালী জেঠিমা জানেন কখন একটু বিরতি দিতে হয়। রুপোর পিকদানিতে পিচিক করে পানের পিক ফেলে তাঁর দিকে তাকিয়ে-থাকা নানা বয়সী আগ্রহী মুখগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, ছোড়দাদু একদিন খেতে বসে দেখেন পাতের কাছে ক্ষিরসাপাতি আম। ডিসেম্বর মাসে আমাদের ভূপালে কেন মালদাতেও তোমরা আম পাবে না। দাদুর ছিলো চার বিবি। বড় বিবি দাদুকে ডেকে বললেন, বড়িবি আম এল কোত্থেকে? বড় বিবিদাদু বললেন, বাদ মাগরেব আপনার দুজন নয়া মুরিদ এসে একঝুড়ি আম দিয়ে গেছে। শুনে দাদু আর কিছু বললেন না। যা বোঝার বুঝে নিয়ে গম্ভীরমুখে খানা খতম করে তার খাস কামরায় গিয়ে এবাদতে বসলেন। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বড় বিবিদাদুকে দেখেছি। বুড়ো হয়েছিলেন জরুর, লেকিন দেখতে ছিলেন হুরপরিদের মতো। দুধের মধ্যে জাফরান দিলে যে-রকম দেখায় সে-রকম ছিলো তিনার গায়ের রঙ। নাক, চোখ, ঠোঁট–সব ছবির মতো আঁকা। আমরা ভারি ভয় পেতাম। ছোড়দাদুর মঝলি বিবি বলতেন, বড়িবির কাছে কখনো যাস নে। ও মানুষ নয়, জিনের পয়দায়েশ। কখন কী বেআদবি করবি তার কি কোনো ঠিক আছে!

দোক্তা নেয়ার জন্য ভূপালী জেঠিমা যখন থামলেন, ইতুদের মেজো ফুপি প্রশ্ন করলেন, আপনার মেজো দাদিআম্মা বুঝি খুব হিংসুটে ছিলেন?

ছিলেন হয়তো। একগাদা দোক্তা মুখে ফেলে কাষ্ঠ হেসে ভূপালী জেঠিমা বললেন, তবে কথাটা যে তিনি ঝুট বলেন নি সেটা আমরা হরবখত টের পেতাম।

বলো কি গো রাঙা বউ! চোখ কপালে তুলে বড় ফুপি বললেন, তোমরা যে জিনের বংশ তাতো জানতাম না?

এ-কথা শুনে যারা ভূপালী জেঠিমার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে গল্প শুনছিলো তারা একটু সরে বসলো। ভেতরের বারান্দায় আলো থাকলেও ঝুলবারান্দার ওপরটা ছিলো অন্ধকার। ভেতর থেকে আসা আবছা আলোতে মোটাসোটা, টকটকে ফর্শা চুমকি বসানো জমকালো শাড়ি আর এক গা গয়না-পরা জেঠিমাকে একটু অন্যরকমই লাগছিলো। তার ওপর মাঝেমাঝে গা কাঁপিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো ঠাণ্ডা হিমভেজা উত্তুরে বাতাস।

রাঙা জেঠুর চেয়ে ফুপির বয়স বেশি বলে জেঠিমা তাঁর কথায় রাগতে পারলেন না বটে, তবে মনঃক্ষুণ্ণ হলেন ঠিকই। শুকনো গলায় বললেন, বড়বু যে

কী বলেন। আমাদের খানদান হল ভূপালের সবচে রইস খানদান। এক ডাকে সবাই চেনে, ইজ্জত করে। বড় বিবিদাদুর তো কোনো ছেলেমেয়েই ছিলো না, বংশ আসবে কোত্থেকে! তাছাড়া ছোট বাচ্চাদের তিনি নফরত করতেন কাপড় নোংরা করে দেয় বলে। সারাক্ষণ ওজু আর ইবাদতের মধ্যে থাকতেন। তুলোর মতো নরম তুলতুলে ছিল হাত-পা। গলার আওয়াজ ছিলো ভারি মিঠা। বাড়ির মেয়েদের তিনিই কোরান শরিফ পড়াতেন। অসময়ের আনার, আম, আনারস, আপেল, মোসাম্বি এনে দিতেন। বলে দিয়েছিলেন এ নিয়ে কেউ যেন কোনও কথা না বলে।

একটু থেমে খানিকটা চুন মুখে দিয়ে ভূপালী জেঠিমা বললেন, শুধু কি এই! মেয়েদের অসুখবিসুখ হলে কোনোদিন ডাক্তার হেকিম ডাকা হয় নি। বড় বিবিদাদুর পানিপড়ার চেয়ে ভালো দাওয়াই আর কিছু ছিলো না। ছেলেরা খেতে ছোড়দাদুর পড়া পানি।

শুধু পানি খেয়ে সব অসুখ সেরে যেত?

ভিড়ের ভেতর কে প্রশ্ন করলো ভূপালী জেঠিমা ঠাহর করতে পারলেন না। শক্ত গলায় বললেন, শুধু পানি নয়, দোয়াদরুদ পড়া পানি। আর হায়াত মউত সব আল্লাপাকের হাতে। তিনি যাকে উঠিয়ে নিতে চান কোন্ ডাগদারের ক্ষেমতা আছে তাকে ধরে রাখে!

ইতুর মেজদি সদ্য ঢুকেছে মেডিক্যাল কলেজে। চাপা গলায় পাশে বসা মামাতো ভাই রবিকে বললো, তাহলে যে দেশ থেকে মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতাল সব তুলে দিতে হয়!

ভাগ্যিস ভূপালী জেঠিমা কানে একটু কম শোনেন। বললেন, ভূপালে আমাদের যে তিনমহলা বাড়ি–একমাসে সব কাজ শেষ হলো, দরজা-জানালার রং-চুনকাম কিছুই বাকি থাকলো না। লোকে শুনে এখনো অবাক হয়।

ইতু চাপা গলায় ফোড়ন কাটলো, মিস্ত্রিগুলো পানিপড়া খেয়ে সব সুপারম্যান হয়ে গেছিলো।

একটু থেমে জেঠিমা আবার বললো, কারিগরদের ভেতর মানুষ আর কজনই বা ছিলো? বেশিরভাগ ছিলো জিন। ছোড়দাদুর কাজ বলে একপয়সা মজুরি নেয় নি। দরজা জানালায় কাঠের কাজ দেখলেই বোঝা যায় ওসব মানুষের মুরোদে কুলোবে না।

এরপর তিনি শুরু করলেন বাড়ির জিনিসপত্রের গল্প–কার্পেট সব কাশ্মীর থেকে আনা। দরজা-জানালার পর্দা তখন থেকেই জয়পুর থেকে আনা হতো, এখনো তাই। নইলে বংশের ইজ্জত থাকে না।

নিরীহ গলায় ছোড়দি জানতে চাইলো, এখানে কি জিনরা পর্দা, কার্পেট এনে দেয়?

তা কেন হবে? ভূপালী জেঠিমা একটু বিরক্ত হলেন–ছোড়দাদুর আমলেই তো আরও তিনটে বাড়ি বানানো হয়েছে। জমি-টমিও কম কেনা হয় নি। এই বলে একটু থেমে মুখ টিপে হাসলেন–ওঁরা যে একেবারেই আসেন না তাই বা বলি কেন! মাঝে মাঝে আসেন। ছোটদাদুর ওফাতের দিন যে ওরস হয়, বেশুমার মুরিদরা আসে। রান্নাবাড়া আর সব কাজকম্মো ওঁরাই সামলান। আমার দুই চাচেরা ভাই সেই যে দেশান্তরি হলেন তারপর বংশে বলতে গেলে একা আমিই আছি। ওঁদের মদদ না পেলে আমার পক্ষে এত কিছু করা কি সম্ভব?

ভূপালী জেঠিমা কয়েকদিনের ভেতর পাড়ার মেয়েমহলে সবার মন জয় করে ফেললেন। বাড়ি বাড়ি তার ট্রাঙ্কভরা শাড়ির গল্প, বনেদি প্যাটার্নের গয়নার গল্প–তাছাড়া বাড়ির লোকজনের বাইরে পাড়ার যে-সব মহিলা নিয়মিত গল্পের আসরে আসতেন, ওঁদের এটা-সেটা উপহার দিয়ে রীতিমতো ভক্ত বানিয়ে ফেললেন। সবাই খুব খুশি হলো যখন শুনল তিনি ঢাকাতে একমাসের জন্য বেড়াতে এসেছেন। দুখির মার বড় ছেলের জ্বর ছাড়ে না সাতদিন। ওষুধপত্রও খাইয়েছে চেয়েচিন্তে এনে, কিছুই হয় নি; সেই ছেলে ভূপালী জেঠিমার পানিপড়া খেয়ে দিব্যি ভালো হয়ে গেলো। দুখির মা পারলে সারাদিন ওঁর পায়ের ওপর পড়ে থাকে।

জেঠিমা অবশ্য পানিতে ফুঁ দেয়ার আগে অনেক মানা করেছিলেন–আমার পানিপড়া কাজে লাগবে কেন দুখির মা! আল্লার গুনাহগার বান্দি আমি। এসব করলে গুনাহ্র খাতা ভারি হবে। দুখির মা সে-সব আধ্যাত্মিক কথা বুঝলো না। হাউমাউ করে কেঁদে বললো, গরিব দুখি মানুষ বইলা গিন্না কইরেন না গো। পোলাড়া আমার মইরা যাইব গো। আপনের পানিপড়া কামে না লাগলে আর কারটা লাগব? কত বড় পীর বংশের ঝিয়ারি আপনে…। দুখির মার বিলাপে বাধ্য হয়েই পানিতে ফুঁ দিতে হলো তাঁকে। বললেন, খাবিস এক জিনের নজর লেগেছে।

ইতুর মেজদি বলতে গিয়েছিলো আমি যে দুটো এ্যাসপো খাওয়ালাম! –কথা শেষ করার আগেই মেজ ফুপির ধমক খেয়ে চুপ মেরে গেলো। দুখির মার ছেলে ভালো হয়েছে খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এল গিরিবালা ধোপানি। সেদিন ছিলো বুধবার, ওর আসার তারিখ নয়। দিদা অবাক হয়ে বললেন, আজ কী মনে করে আসা হলো?

গিরিবালা বললো, আমি পাপীতাপী মানুষ বড়মা। কুনদিন পুণ্যিবান মাইনষের পায়ের ধুলা লইতে পারি নাই। আপনেগো বাড়িতে গোপাল না কোনপালের এক অতিথ আইছে। হ্যাঁর এটু পায়ের ধুলা লমু গো বড়মা।

দিদা মুখ টিপে হেসে বললেন, বুঝেছি তোর মতলব। এইবেলা তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, এসব গল্প বাইরে করবি না। তোদের জ্বালায় না ভূপালী বউকে শেষে পালাতে হয়!

গিরিবালার ছিলো কাপড়ের মোট বওয়ার একজোড়া গাধা। দুদিন ধরে ছেলে গাধাটা কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। আশেপাশের বাড়িঘর, সরকারি খোয়াড়—সবই খোঁজা হয়েছে, কোথাও পাজিটাকে পাওয়া যায় নি। ভূপালী জেঠিমাকে গিরিবালা বললো, পীরের দরগায় আমি পাঁচসিকার সিন্নি দিমু গো মা। আপনে আমার মুখপোড়া পাজিটার খবর কইয়া দেন।

ভূপালী জেঠিমা বললেন, আমার অত ক্ষমতা আছে? আল্লাপাকের শানে কত গুনার কাজ করেছি। আমার মতো আল্লাহর গুনাহগার বান্দী আর কে আছে? আমাকে দিয়ে এসব কাজ কেন করাতে চাও তোমরা?

গিরিবালাও দুখির মার কায়দায় চোখ মুছতে মুছতে বললো, আমি ছোট লোক বইলা আমারে এটু পানিপড়া দিবেন না গো বড় মাইনষের ঝিয়ারি?

ভূপালী জেঠিমা তাড়াতাড়ি ওকে পানিপড়া দিয়ে বিদেয় করলেন। আর কী আশ্চর্য কাণ্ড, পরদিন সকালে ওর গাধা এসে হাজির!

ছোটনদের কাছে এসব খবর শুনে রিমকিদের মা, চাচি, নানি দুহাড়ি মিষ্টি নিয়ে ভূপালী জেঠিমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন। ইতুদের ভালো লাগলো. দিদাকে হেসে হেসে রিমকির নানির সঙ্গে কথা বলতে দেখে। দিদা খুশি হবেন না কেন! ভেবেছিলেন দশআনি শরিকের অংশ কিনে ওরা বড়লোক দেখাতে এসেছে। ওদের চেয়ে বড়লোক, আর ওদের চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর দেখতে আত্মীয়স্বজন ওঁদের বাড়িতে আসে–এটা কম কথা নয়! সেদিন রিমকির নানিদের দিদা জোর করে রাতে ভাত খাইয়ে ছাড়লেন। রিমকির নানিদের ভক্তি দেখে ভূপালী জেঠিমাও কম খুশি হন নি।

চিলেকোঠার ঘরে বসে ইতুরা নিশ্চিন্তে রিমকি-সিমকির সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিলো। ছোটন বললো, ভূপালী জেঠিমাকে আজই বলতে হবে আমরা দুবাড়ি একসঙ্গে পিকনিকে যাবো।

রিমকি জানতে চাইলো, এবার তোমরা যাচ্ছো কোথায়?

গতবার গিয়েছিলাম তেজগাঁ। জবাব দিলো ইতু–এবার যাবো জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে। পরশু দেখেছি রাজবাড়ির ম্যানেজারের সঙ্গে ছোটকা বসে গল্প করছেন। আগেও একবার গিয়েছিলাম ওখানে।

ছোটন বললো, ছোটকাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তারিখ ঠিক করে ফেলেছে কিনা। সাইফ ভাইর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

রাতেই ওরা সবাই ভূপালী জেঠিমাকে গিয়ে ধরলো। রিমকি বললো, জেঠিমা আপনি দিদাকে বলুন আমরাও পিকনিকে যাবো।

পিকনিকের কথা ভূপালী জেঠিমার কানে এসেছে। বললেন, এটা তো বহুত খুশির খবর বেটি, আমি চাচিজানকে জরুর বলবো। জেঠিমাকে কী যেন বলতে এসেছিলেন দিদা, ছোটদের জটলা দেখে বললেন, তোরা বুঝি ভূপালী বউকে একদণ্ড বিশ্রাম নিতে দিবি না? আজ আর কোনো গল্প নয়।

ভূপালী জেঠিমা একগাল হেসে বললেন, না চাচিজান, ওরা আমাকে বিরক্ত করছে না। আমি বলছিলাম, রুমকিদের সবাইকে বলুন না আমাদের সঙ্গে পিকনিকে যেতে। সদরুদ্দিনকে বলে দেবেন আমার নামে একশ টাকা চান্দা লিখে রাখতে।

ছোটনদের পিকনিকে সবাইকে চাঁদা দিতে হয়। ছোটরা যারা স্কুলে যায় তাদের একটাকা, কলেজ পড়ুয়াদের দুটাকা, আর যারা কামাই করে তাদের গিন্নিদের দশটাকা করে। ছোটরা টিফিনের পয়সা থেকে পিকনিকের চাঁদা বাঁচিয়ে রাখতো। সব মিলিয়ে দেড়শ টাকার মতো চাঁদা ওঠে। তখনকার দিনে পোলাওর চালের সের ছিল একটাকা, দুটাকায় ভালো মুরগি পাওয়া যেতো।

ভূপালী জেঠিমার চাঁদার কথা শুনে দিদা হেসে বললেন, তুমি মেহমান, তোমাকে চাঁদা দিতে হবে না।

না বললে আমি শুনব কেন চাচিজান। জাহানারাকে বলেছি পিকনিকে আমি কবুতরের রোস্ট খাওয়াবো সবাইকে একটা করে। আপনি রিমকিদের বাড়ির সবাইকে বলে দেবেন।

দিদা বললেন, তুমি যখন একশ টাকা চাঁদা দিচ্ছ ওদের আর চাঁদার কথা বলবো না, বরং ওরাই আমাদের মেহমান হোক।

আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছোটন, ঝন্টু আর মিতু ছুটে এসে দিদাকে জড়িয়ে ধরলো। হইচই করে বললো, আমরা কবে যাব পিকনিকে?

মৃদু হেসে দিদা বললেন, কেন সদরুদ্দিন বলে নি বুঝি? সামনের রোববারেই তো যাচ্ছি! এবার আহ্লাদ থামিয়ে নিচে খেতে আয়। অনেক কাজ পড়ে আছে।

ভূপালী জেঠিমা কী যেন বলতে এসেছিলেন–মনে করতে না পেরে দিদা আবার নিচে নেমে গেলেন।

বাড়ি যেতে যেতে রিমকি বললো, রোববারে গেলে ভাইয়ার পিকনিকে যাওয়া হবে না।

কেন হবে না? জানতে চাইলো ইতু।

কাল চিটাগাং যাবেন জরুরি কী কাজে।

সিমকি বললো, ভাইয়া না গেলে কী হবে, আমরা যাবো।

রাতে ছোটনরা অনেক রাত পর্যন্ত ভূপালী জেঠিমার সাথে গল্প করছিলো।

ইতু বললো, এ-রকম মানুষ আর হয় না।

ছোটন বললো, দিদার মতো রাগী মানুষকে কীরকম পটিয়ে ফেলেছেন দেখেছিস? ভূপালী জেঠিমা না এলে রিমকিদের সঙ্গে এ-জন্মে আর পিকনিক করতে হতো না।

পিকনিক দূরে থাক, মেশা পর্যন্ত বারণ হয়ে গিয়েছিলো–সেদিন শুনিস নি!

ঘুমোতে যাওয়ার আগে সবাই মনে মনে ভূপালী জেঠিমাকে চিয়ার্স জানালো।

.

০৪. পিকনিকে ঝকমারি

পিকনিকের চাঁদা তোলার ভার থাকে ইতুদের বড় জেঠুর ওপর। সেজকার দায়িত্ব হচ্ছে গাড়ির ব্যবস্থা করা। ছোটকা আর বড়দার কাজ বাজার করা। ফর্দ মিলিয়ে বাজার বুঝে নেন বড় ফুপি আর মেজো জেঠিমা। ইতুরা চাঁদা তোলার ব্যাপারে বড় জেঠুকে সাহায্য করে। কাজটা যেহেতু ওদের নয়, বাজার করে পয়সা বাঁচলে বড় জেঠু এটা-সেটা কিনে দিয়ে ওদের পুষিয়ে দেন। গতবার ওদের পাঁচজনকে যেমন ঘুড়ি আর মাঞ্জা দেয়ার সুতো কিনে দিয়েছিলেন। আগেরবার বেশি পয়সা বাঁচে নি, ওদের সবার ভাগে পড়েছিলো একটা করে গাবের লাটিম। ইতুরা ফাও যা পায় তাতেই খুশি। তবে ছোটকা আর বড়দার সঙ্গে পিকনিকের সময় প্রত্যেকবার বড় জেঠুর একটা ঝগড়াঝাটি হবেই।

গণ্ডগোল হয় বাজার করা নিয়ে। মা, কাকী, জেঠিদের সঙ্গে পরামর্শ করে বড় জেঠু পিকনিকের মেনু ঠিক করে ছোটকার হাতে ফর্দ আর টাকা যখন ধরিয়ে দেন তখন থেকেই শুরু। ফর্দের ওপর চোখ বুলিয়ে আঁতকে ওঠেন ছোটকা–এটা একটা ফর্দ হলো বড়দা? টাকা দিয়েছ দেড়শ ফর্দ দিলে তিনশ টাকার–বাকি টাকার জন্য কার পকেট কাটতে যাবো শুনি!

ইজি চেয়ারে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে বড় জেঠু বলেন, পয়সা যদি একটু কম মারো ওতেই সব হবে।

প্রত্যেকবার তুমি এক কথা বলো বড়দা। আমি টাকা মারলে মেজদাকে কেন দাও না? তুমি নিজে কেন যাও না? দরকার নেই আমার পিকনিক করে।

আগের মতো শান্ত গলায় বড় জেঠু বলেন, তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস ছোট। কাজটা তোর, তোকেই করতে হবে। ছোট মুখে বড় কথা মানায় না। মেজোর অনেক কাজ আছে, তোর মতো বেকার খাতায় চিরদিনের জন্য নাম লেখায় নি।

বি এ পাশ করে পাঁচ বছর ধরে ঘরে বসে আছেন ছোটকা। এ নিয়ে কেউ কিছু বললে ওঁর মন খারাপ হয়ে যায়। বড় জেঠুর কথা শুনে গাঁইগুঁই করে করে বলেন, ঠিক আছে, বাজারে এই দামে যা পাবো তাই কিনবো। শেষে বলতে পারবে না আলু পচা কেন, মুরগির গায়ে মাংস নেই কেন–ওসব আমি শুনতে পারবো না।

শেষপর্যন্ত ছোটকা জিনিস সবই আনেন, ভালো জিনিসই কেনেন, তবু বড় জেঠুর ধারণা ছোটকা আর বড়দা মিলে সিনেমা দেখার পয়সা নাকি ঠিকই বাঁচান।

এবার অবশ্য টাকার পরিমাণ বেশি দেখে ছোটকা তেমন কিছু বললেন না। শুধু মাথাপিছু একটি কবুতর শুনে সামান্য আপত্তি করলেন–ছোটদের আর মেয়েদের আধখানা করে দিলেই তো হয় বড়দা, পয়সা যদি না কুলোয়!

ছোটনরা কাছেই ছিলো। খাওয়ার ব্যাপারে মিতু একটু পেটুক বলে বদনাম আছে। বললো, ভূপালী জেঠিমা হিসেব করে টাকা দিয়েছেন ছোটকা। অন্য কোনো ফন্দি যদি করো দিদা আর জেঠিমা দুজনকেই বলে দেবো।

দিদাকে ভীষণ ভয় পান ছোটকা। পারতপক্ষে ওঁর সামনে যান না। ভালো করেই জানেন ছোটদের তিনি কীরকম আস্কারা দেন। শুকনো গলায় বললেন, ভারি বদ হয়েছিস তো ছোঁড়া! সবকথা মাকে কেন বলতে হবে শুনি!

আস্ত রোস্ট পেলে বলবো না এই বলে ছোটনরা সরে গেল সামনে থেকে।

পিকনিকের মাত্র আর একদিন বাকি, সেজকা এসে এক দুঃসংবাদ দিলেন–রোববারের জন্য গাড়ি পাওয়া যাবে না।

প্রত্যেক বছর সেজকা তার অফিস থেকে গাড়ি ম্যানেজ করেন। তেলের পয়সাটা শুধু দিতে হয়। ড্রাইভার দুজন পিকনিকের ভোজ পেলেই খুশি। দিদা অবশ্য দুজনকে দুটাকা করে বখশিসও দেন। এবার বলা হয়েছিলো তিনটে গাড়ি লাগবে। ভূপালী জেঠিমা আছেন, রিমকিদের বাড়ি থেকেও সাত-আটজন যাবে–বড় জেঠু পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, তিনটে গাড়ির কমে হবে না সেজো। কথা বলে দেখ জোগাড় করতে পারবি কিনা, নইলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

সেজকা একগাল হেসে বললেন, অন্য ব্যবস্থা মানে ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে তেজগার বাগানবাড়িতে যাওয়া! গতবারই তো গিয়েছিলাম। পিকনিকের আসল মজা কি ওতে হয়! তুমি কিছু ভেবো না বড়দা। গাড়ি আমি ঠিকই ম্যানেজ করবো।

গাড়ির ব্যাপারে সবাই ষোলআনা নিশ্চিন্ত ছিল। সেজকার কথার কোনো নড়চড় হয় না। অথচ শুক্রবার সন্ধেবেলা তিনি শুকনো মুখে অফিস থেকে ফিরে বড় জেঠুকে বললেন, ঝামেলা হয়ে গেলো যে বড়দা! বিদেশ থেকে এক সার্ভে টিম এসেছে। কাল অফিসের তিনটে গাড়ি নিয়ে বড় সায়েব সিলেট যাচ্ছেন।

আমাকে বললেন, তোমাদের তো ফ্যামিলি পিকনিক, একসপ্তাহ পিছিয়ে দাও।

মা, কাকিমারা সবাই হইচই করে উঠলেন–সে কী, সবাইকে বলা হয়ে গেছে, কেনাকাটাও করা হয়েছে–সাতদিন পেছাবে বললেই হলো!

বড় জেঠু কাষ্ঠ হেসে বললেন, এ-রোববারে যদি যেতে চাও কপালে ঘোড়ার গাড়িই আছে তেজগাঁ পর্যন্ত। কী আর করবে! পিচ্চিগুলোর একটু মন খারাপ হবে–এই যা!

ভূপালী জেঠিমা শুনে বললেন, তোমরা কিছু ভেবো না। আমার এক চাচেরা ভাইর লাড়কা থাকে সেগুনবাগিচায়। ওরা বহুৎ পয়সাওয়ালা আদমি আছে। দাঁড়াও, ওকে বলি দুতিনখানা গাড়ি ব্যবস্থা করে দিতে।

দিদা বললেন, থাক না রাঙাবউ, মিছেমিছি অচেনা মানুষকে বিরক্ত করবে কেন? এমন কোনো তাড়া তো নেই! পরের রোববারে গেলেই হয়।

না চাচিজান, আপনি বাধা দেবেন না। সবাই নিয়ত করে ফেলেছে এই রবিবারে ছোটদের মন ভেঙে যাবে। মীর্জা এহতেশাম আমার চাচেরা ভাইর লাড়কা হলে কী হোবে, এ আমার আপনা আওলাদের চেয়েও বেশি। গত বছর ভূপাল গিয়ে আমাকে বলেছিলো, ঢাকা এলে ওকে স্রেফ একটা খবর পৌঁছাতে।

ভূপালী জেঠিমার আগ্রহ দেখে দিদা আর কিছু বললেন না। ছোটনরা মহাখুশি, টেলিফোনেই ভূপালী জেঠিমা তিনখানা গাড়ি ম্যানেজ করে ফেললেন। সেজকার কথা শোনার পর থেকে ইতু ভেবে পাচ্ছিলো না রিমকিদের কী করে বলবে মাইক্রোবাসের বদলে ঘোড়ার গাড়িতে পিকনিকে যাবে! নিজেরা হলে কথা ছিলো না। রিমকিদের এত আঁক করে বলেছে গাড়িতে করে জয়দেবপুর যাবে–ভূপালী জেঠিমা না থাকলে কী লজ্জার ব্যাপারই না হতো!

পরদিন দিদা ভূপালী জেঠিমার চাচেরা ভাইর ছেলেকে নেমন্তন্ন করলেন দুপুরে খেতে। হোক না আত্মীয়, কোনোদিন তো জানতেন না! ভাবলেন একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত–সেজন্যে এই নেমন্তন্ন।

মস্ত লম্বা ধবধবে সাদা একটি ফোর্ড গাড়ি হাঁকিয়ে এক ভূপালী জেঠিমার চাচেরা ভাইর ছেলে মীর্জা এহতেশাম। বয়স বেশি হলে বছর তিরিশেক হবে। একটু ভারি শরীর, গায়ের রঙ একেবারে বিলেতি সাহেবদের মতো। চোখের রঙও কটা। দুই ঝুড়ি কমলা এনেছে, নাকি ওদের সিলেটের বাগানের। দিদাকে বললো, এটা আমার পিকনিকের চাঁদা। বহুত খায়েশ ছিলো যাওয়ার। জরুরী এক কাজ পড়ে গেছে। সামনের বছর জরুর যাব।

ভূপালী জেঠিমার মতোই কথায় উর্দু টান, তবু ছোটনদের খুবই ভালো লাগলো এহতেশাম ভাইয়াকে। ভূপালী জেঠিমাই ওদের বলে দিয়েছেন এহতেশাম ভাইয়া ডাকতে। এত বড়লোক, অথচ এতটুকু অহঙ্কার নেই। ছোটনদের সঙ্গে বন্ধুর মতো অনেক কথা বললো। কার কী হবি, বড় হলে কে কী হবে–এসব জিজ্ঞেস করলো। ওদের একটা মস্ত বাগানবাড়ি আছে টঙ্গিতে। বলল, ওখানে একদিন গাড়িতে করে সবাইকে নিয়ে যাবে পিকনিকে। বিরাট এক পুকুর আছে–দশ-পনের সেরের রুই কাতলারা সারাক্ষণ লাফালাফি করে সেখানে। ওরা গেলে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে। শীতকালে ওখানে সবরকম সবজির চাষ হয়। কয়েক ঘণ্টার ভেতর ছোটনদের সবাইকে ওর মহাভক্ত বানিয়ে ফেললো।

সন্ধেবেলা রিমকিদের বাগানে বসে ছোটনরা যখন পিকনিকের কথা আলোচনা করছিলো, তখন সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো, এত মজার পিকনিক আগে কখনো হয় নি। মিতু বলল, আস্ত একটা কবুতরের রোস্ট সঙ্গে থাকবে খাসির বিরিয়ানি, মুরগির দোপেঁয়াজি আর সীতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দই। ভাবতে পারিস কী দারুণ এক খাওয়া হবে!

ঝন্টু বলল, এহতেশাম ভাইয়া যে দু ঝুড়ি বাগানের কমলা দিয়ে গেলো, সেটা বাদ দিচ্ছিস কেন?

সিমকি জিজ্ঞেস করল, এহতেশাম ভাইয়া আবার কে?

ভূপালী জেঠিমার চাচেরা ভাই। বলতে গিয়ে হেসে ফেললো মিতু–জেঠিমার মতো উর্দু মেশানো কথা বললে কী হবে, আমাদের বলেছে একদিন ওদের বাগানবাড়িতে নিয়ে যাবে।

রিমকি বললো, ইশ, ভাইয়াটা যদি থাকতো, কী মজাই না হতো।

পিকনিকে যাওয়ার আগে ইতুদের বাড়িতে আরেক খুশির খবর এলো। শনিবার সকালে কলেজে গিয়েছিল বড়দি। দুপুরে এসে লাজুক হেসে বড় জেঠুকে বলল, আজ আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে বাবা। আমি পাশ করেছি।

তাই নাকি! বলে হইচই বাঁধালেন বড় জেঠু–ওরে কে আছিস, মিষ্টি আন এক মণ, পাড়ার সব বাড়িতে খবর দে। তা মা কেমন পাশ হল?

বড়দি বলল, সেকেণ্ড ক্লাস থার্ড। ফার্স্ট ক্লাস এবার কেউ পায় নি।

বড় জেঠুর হাঁকডাক শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এলো। মেজো জেঠি বড়দিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন–আহা, বড়বু যদি কটা মাস দেরি করে পরীক্ষার ফলটা জেনে যেতে পারতেন! এই বলে ফেঁত ফোঁত করে খানিকটা কাঁদলেনও।

বড়দির পরীক্ষার এক মাস আগে বড় জেঠিমা মারা গিয়েছেন। সবাই ধরে নিয়েছিলো বড়দি বুঝি এবার পাশ করতে পারবে না। ইতুর বাবা আর বড় জেঠুও বলেছিলেন এ বছর ড্রপ দেয়ার জন্য। বড়দি কারো কথা শোনে নি।

ভূপালী জেঠিমা বললেন, জাহানারার পাসের মিষ্টি আমি খাওয়াব। জেনানা হয়ে একবারে ডাগদারি ইমতেহান পাশ করে–এমুন কথা আমি শুনি নাই।

পাড়ার বয়স্করা সবাই বড়দিকে দেখতে এলো। খবর পেয়ে এহতেশাম ভাইয়াও এলো মস্ত বড় দুই হাঁড়ি মিষ্টি হাতে নিয়ে। বললেন, পিকনিকের পরের দিন সবাইকে সিনেমা দেখাবেন।

এত রাগী বড়দি–মীর্জা এহতেশামের প্রশংসা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে বললো, মনে হচ্ছে এদেশে কোনো মেয়ে বুঝি আমার আগে ডাক্তারি পাশ করে নি।

এহতেশাম ভাইয়া হা হা করে হেসে বললো, জরুর করেছে। লেকিন আমি হলফ করে বলতে পারি, ওরা কেউ আপনার মতো ভালো রেজাল্ট করে নি।

বড়দি আর কী বলবে, চা আনার ছুতো করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

গণ্ডগোল বাঁধলো সন্ধ্যেবেলা। ঝুলবারান্দায় বসে রোজকার মতো গল্প করছেন ভূপালী জেঠিমা, হঠাৎ ওঁর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। কথাটা বলে তিনি একগ্লাস পানি খেয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

বড়দি ওর ঘরেই ছিলো। খবর পেয়ে ছুটে এসে পাস দেখে, বুকে স্টেথকোপ লাগিয়ে বললো, প্রেসার বেড়েছে, একদম শুয়ে থাকবেন। আগে কখনো প্রেশার এরকম বেড়েছিলো?

কেমুন করে বলবো জাহানারা বিটিয়া! মাঝেমাঝে মাথা চক্কর দেয় জরুর, ভূপালে আমরা এখনো ডাগদারের কাছে যাই না। বংশের বদনাম হবে যে ওতে!

রাতে বড়দি ওর পরিচিত এক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ভূপালী জেঠিমার জন্য ওষুধ আনিয়ে দিলো। বললো, দুদিন পুরো বিশ্রাম। কাল পিকনিক হবে না।

জেঠিমা একটু বিরক্ত হলেন–এ কেমুন কথা বোলছ বিটিয়া? পিকনিক কি স্রেফ আমার জন্য! সবাই যাবে পিকনিকে, আমি বাড়ি পাহারা দেবো।

দিদা শুনে চিন্তিত গলায় বললেন, বাড়ি পাহারা দেয়ার লোক আছে রাঙা বউ। পিকনিকের জন্য এত চাঁদা দিয়েছো তুমি–না গেলে সবারই খারাপ লাগবে।

না চাচিজান, পিকনিক হচ্ছে ছোটদের। আমাদের যাওয়া তো ছোটদের মজাক দেখার জন্য। আমি একদিন বাড়িতে ওদের নিয়ে পিকনিক করে মজাক দেখবো। আমাকে বারবার বলে শরমিন্দা করবেন না।

ছোটদের জন্য ভূপালী জেঠিমার যাওয়াটা অবশ্য বেশি জরুরি ছিলো না। সবাই একটা করে কবুতরের রোস্ট বাড়তি পাবে, এতেই ওরা খুশি।

দিদা মুখে বারবার ভূপালী জেঠিমাকে যেতে বললেও মনে মনে কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছিলেন এই ভেবে যে, বাড়িতে কেউ অন্তত থাকবে! প্রত্যেকবার পিকনিকে যাওয়ার সময় যদিও দশআনির পাহারাদার বনমালীকে বলে যান, তবু মনটা খচখচ করে–চারদিকে চোর-ডাকাত গিজগিজ করছে, বনমালী যদি সামলাতে

পারে! এবার তো আরো চিন্তিত ছিলেন–ও-বাড়িতে রিমকিরা এসেছে, একা দুবাড়ি কি পাহারা দিতে পারবে বনমালী? ভূপালী জেঠিমা বাড়িতে থাকবেন শুনে আশ্বস্ত হয়ে বললেন, তাহলে বৌমাদের কেউ থাকুক তোমার কাছে।

জেঠিমা দিদার হাত ধরে বললেন, চাচিজান, আমার জন্য কেউ পিকনিকে যাবে না, এটা হতেই পারে না। মীর্জা এহতেশামকে বলব দুপুরের পর একবার আসতে। তাছাড়া বললেন না বনমালী না করমালী–সে এসে খোঁজখবর নিয়ে যাবে! আমার কুন অসুবিধা হবে না। আপনারা আমার জন্য পেরেশান না হয়ে ঘুরে আসুন।

পরদিন খুব সকালে মীর্জা এহতেশাম দুটো মাইক্রোবাস আর একটা জিপ পাঠিয়ে দিলো। রুমকির মেজ ভাইয়া তার এক বন্ধুর বড় বুইক গাড়ি এনেছে। ওদের বাড়ি থেকে যাচ্ছে রিমকি, সিমকি, নিমকি, ওদের মেজ আর ছোট ভাইয়া, চাচি, মা আর নানি। রিমকির বাবা-চাচা যাচ্ছেন না, আর সাইফ ভাই যে চট্টগ্রাম গেছেন ফিরবেন আজ রাতে।

বুড়োরা বুইক গাড়িতে, ছোটরা জিপে আর অন্যরা সব মাইক্রোবাসে উঠলো। সঙ্গে হাঁড়িপাতিল আর জিনিসপত্র যা ছিল, মাইক্রোবাসের ছাদে ক্যারিয়ারে ভালোমতো বেঁধে দেয়া হয়েছে। রওনা দিয়েছিলো সাতটারও আগে, জয়দেবপুর পৌঁছতে লাগল পুরো দেড় ঘণ্টা। কথা বলতে বলতে সময় যে কীভাবে কাটলো কেউ টেরও পেলো না।

ইতুরা আগেও একবার এসেছিলো এখানে। জায়গাটা ওদের অচেনা নয়। ওরা জানে রান্নার আয়োজন কোথায় হবে। যে যা পারে হাতে নিয়ে ছুটলো সেদিকে। গোটা পিকনিকে এটুকুই ওদের কাজ। জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রেখে পকেটে একটা করে কমলালেবু নিয়ে পঞ্চপাণ্ডব চুপচাপ কেটে পড়লো। এবার ওদের সঙ্গে রিমকিরাও আছে। বলাই বাহুল্য আনন্দের পাল্লা এতে আরো ভারি হয়েছে।

গতবার ওরা রাজাদের নায়েববাড়ির খিড়কির পুকুরধারে দেশী কুলের গাছ দেখেছিলো। লাল মরিচের গুঁড়ো আর নুন দিয়ে সেই টকমিষ্টি কষটে কুল খেতে দারুণ মজা। কাঁচাপাকা কুল বোঝাই সেই গাছটা খুঁজে পেতে ওদের দেরি হলো না। ডাল ঝাঁকিয়ে ইচ্ছেমতো কুল পাড়লো ছোটনরা, বারণ করার কেউ নেই। তারপর ওরা পকেট বোঝাই করে কুল নিয়ে পুরোনো শিরিষগাছের তলায় বসলো। কিছু কুল খেলো, বাকিটা ইতু আর রিমকি গিয়ে মেজদিকে দিয়ে এলো। বড়দিকে আশেপাশে কোথাও দেখলো না।

দুপুর পর্যন্ত ওরা শালবনের ভেতর লুকোচুরি খেললো। লুকোনোর মজা হচ্ছে নায়েবাড়িতে। বেশির ভাগ ঘরে কখনো সূর্যের আলো ঢোকে না। তার ওপর চারপাশে হেন ফল নেই যার গাছ নেই। একবার রিমকিকে চোর বানিয়ে ওরা গিয়ে উঠলো শিরিষ গাছে। রিমকির মাথায় অত বুদ্ধি নেই যে আগে থাকতে বলবে, গাছে উঠলে খেলা হবে না। সিমকি গাছে ওঠে নি। লুকিয়েছিলো পাশের ঝোপে। ইতুরা গাছের ওপর থেকে দিব্যি দেখছিলো রিমকি কীভাবে ওদের তন্নতন্ন করে খুঁজছে। হঠাৎ চাপা গলায় রন্টু বলল, আরে সাইফ ভাই এলো কখন?

ওর কথায় দূরে ঝোঁপের পাশে সবাই তাকিয়ে দেখলো, সাইফ ভাই আর বড়দি পাশাপাশি বসে আছে। সাইফ ভাই কী যেন বোঝাচ্ছে বড়দিকে। মাথা নিচু করে বড়দি চুপচাপ শুনছে। মিতু বললো, আসার তো কথা ছিলো আজ রাতে!

ইতু বললো, এতে অবাক হওয়ার কী আছে। রাতের বদলে সকালে এসেছে। আমরা রাজবাড়ি এসেছি শুনে বাস ধরে চলে এসেছে।

বয়সে বড় ছোটনের মনে হলো এভাবে লুকিয়ে ওদের দেখা ঠিক হচ্ছে না। বললো, চল, আমরা নায়েব বাড়ির দিকে যাই।

নিচে নামতেই দেখা হলো রিমকি-সিমকির সঙ্গে। মিতু বললো, সাইফ ভাই এসেছে। লুকিয়ে বড়দির সঙ্গে কথা বলছে।

সিমকি লাফিয়ে উঠলো, কী মজা ছোটপা! চল, আমরা ভাইয়াকে নিয়ে স্টোলেন কুকিস গেমটা খেলি।

ছোটন একটু শক্ত গলায় বললো, আমার মনে হয় ওরা কোনো জরুরী কথা বলছে। এখন ওদের ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না।

মিতু বললো, আমার মনে হয় প্রাইভেট কথা বলছে।

ইতু আর ছোটন ভুরু কুঁচকে মিতুর দিকে তাকালো। রিমকি মুখ টিপে হেসে বললো, ঠিক আছে, আমরা আগের জায়গায় খেলবো। এবার মিতু চোর হবে। ওকে আমি আগে দেখেছি।