৩-৪. সোনার খনি আর অতৃপ্ত প্রেতাত্মা

সোনার খনি আর অতৃপ্ত প্রেতাত্মা

স্ক্যাটরার ঘেউ ঘেউ আর অনেকগুলো হাঁসের প্যাকপ্যাক ডাকে আমাদের ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে দেখি বাবু ততক্ষণে উঠে বসেছে। জানালার বাইরে আলো ঝলমল সমুদ্র। বাবু ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে নরোম হাসলো। বললো, কী মনে হচ্ছে আবির?

আমিও হেসে বললাম, ভূমধ্যসাগরের কোনো জলপাই দ্বীপ।

মুখ ধুয়ে নিচে এসে দেখি ললি টুনি আগে থেকেই রাশান মাশকা পুতুলের মতো সেজেগুজে বসে আছে। বাবু বললো, হা-ই টুনি।

টুনি ওকে জিব দেখালো। ললি ফিক করে হেসে ফেললো। বাবু ভুরু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসলো। নেলী খালা সবার রুটিতে মাখন আর জেলি লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবু বললো, নেলী খালা কাল বলেছিলেন না আপনার ঘরগুলো সাজাতে হবে?

নেলী খালা হেসে বললেন, তাই বলে এক্ষুনি লেগে যেতে হবে না।

বাবু বললো মেয়েরা আপনাকে ঘরের কাজে সাহায্য করবে। আমি আর আবির সোনার খনি খুঁজতে যাবো।

আমি হেসে ফেললাম। ললি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, টুনির মুখ-ভেংচি খেয়ে সব মেয়ের ওপর ক্ষেপে গেলে দেখছি। আমি তো কিছু করি নি বাবু।

বাবু গম্ভীর হয়ে বললো, তুমি টুনির কান টেনে দেয়ার বদলে হেসেছে।

টুনি তড়বড় করে বলে উঠলো, দেখা যাবে কে কার কান টানে। ললিপা, আমরা আলাদা বেরুবো। বয়েই গেছে ওদের সঙ্গে যেতে।

নেলী খালা মুখ টিপে হেসে বললেন, আজ কাউকেই বেরুতে হবে না। ঘরের কাজ মেয়েরা করবে আর ছেলেরা করবে বাইরের কাজ। এই বলে নেলী খালা সারা দিনের কাজের ফিরিস্তি দিলেন-দোতালার দুটো ঘর গোছাবে ললি, টুনি, আমি দুটো সাইনবোর্ডে রং লাগাবো, আর আবির, বাবু মালীকে গোলাপের বেডে সাহায্য করবে। আমি কিছু বসরাই গোলাপের কাটিং এনে রেখেছি।

আমি বললাম, এখানে বসরাই গোলাপ কোথায় পেলে?

নেলী খালা একটু লাজুক হেসে বললেন, মেজর জাহেদ আহমেদের বাড়ি থেকে এনেছি। তোমাদের তো বলা হয় নি, এখানে একটা গোপন আর্মি ক্যাম্প আছে। কদিন ধরে বর্ডারে স্মাগলিং খুব বেড়ে গেছে। তাছাড়া এ বর্ডারে কয়েকটা কুখ্যাত ডাকাত দল রয়েছে। পুলিস কিছু করতে পারে নি। মেজর জাহেদ এই বেটার কমান্ডে আছেন। সাবধান, কারো সঙ্গে ওঁর ব্যাপার নিয়ে আলাপ করো না।

আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ খেলাম। নেলী খালা কেবলই আমাদের ভাবিয়ে তুলছেন। দরজায় গরগর শব্দ হতে চেয়ে দেখি হেলেদুলে বেশ চিন্তিত মুখে স্ক্যাটরা এসে ঘরে ঢুকে নেলী খালার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। নেলী খালা ওর মুখে একটা টোস্ট ধরিয়ে দিলেন। সকালে হাঁসদের তাড়া করেছিলো বলে ওকে খুব বকেছি। এখন দেখতে এসেছে আমার রাগ কমেছে কিনা–এই বলে নেলী খালা ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন–যাও আর দুষ্টুমি কোরো না।

স্ক্যাটরা তখন বেশ রাজকীয় ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ওর কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা হেসে বাঁচি না। ওর জন্য নেলী খালাকেও বেশ গর্বিত মনে হলো। বললেন, স্প্যানিয়েল আর গ্রে হাউন্ডের ক্রস। এতো সস্তায় পেয়েছি যে বলার কথা নয়। কক্সবাজারের মিসেস ডিক্রুজের কাছ থেকে গত বছর মাত্র সাড়ে তিন শ টাকায় কিনেছি।

গরম কোকো খেতে খেতে নেলী খালাকে বললাম, এবার তোমার সোনার খনির কথা বলো নেলী খালা।

নেলী খালা লাজুক হাসলেন–আমার বলছিস কেন? তোদের তাহলে খুলেই বলি। আমাদের বাড়ি থেকে দু ফার্লং দূরে একটা পাহাড়ী নদী আছে। নাম হচ্ছে সোনাবালি নদী। আমি মাঝে মাঝে ওখানে মাছ ধরতে যাই। পানির রং এতো স্বচ্ছ যে, নিচের বালি পর্যন্ত দেখা যায়। মাছ লুকিয়ে থাকতে পারে না। এক দিন লক্ষ্য করলাম বালির রঙগুলো বেশি চকচকে, আর মাঝে মাঝে কেমন যেন সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। কিছু বালি তুলে এনে ভালো করে পরিষ্কার করে দেখি, বালিতে সোনার গুঁড়ো রয়েছে। কদিন তো বেশ উত্তেজনার ভেতর কাটলো। রোজ কাঠের বারকোশে বালি তুলে পরিষ্কার করি আর ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সোনার গুড়ো বার করি। অবশ্য পরিমাণে খুবই সামান্য। সব মিলিয়ে আমি মাত্র কয়েক রত্তি সোনা পেয়েছি। তবে মনে হয় এ নদী কোথাও কোনো সোনার খুনির পাশ দিয়ে বইছে। আমি পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে জিওলজিক্যাল সার্ভে আর মিনারেল ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশনকে দুটো চিঠি দিয়েছি। আশা করি দু-এক দিনের মধ্যে জবাব পেয়ে যাবো।–এই বলে নেলী খালা মিষ্টি করে হাসলেন–চিঠির জবাব পেলে সবাই মিলে আমরা সোনার খনি খুঁজবো।

টুনি বাচ্চাদের মতো হাততালি দিয়ে বললো, কী মজা, আমরা তাহলে একটা সোনার খনির মালিক হয়ে যাবো।

আমি হেসে বললাম, ভেবেই সুখ। সোনার খনি পেলে ওটা যে গভমেন্টের হবে, তাও বুঝি জানো না!

তাতে কী! একটু চুপসে গিয়ে টুনি বলল, আমরা আবিষ্কার করেছি বলে কয়েক তাল সোনাও পাবো না?

নেলী খালা বললেন সোনা পাবে কিনা জানি না, তবে খবরের কাগজে আবিষ্কারকদের ছবি উঠতে পারে।

ললি আস্তে আস্তে বললো, সেটা আরো মজার হবে।

খাবার পর আমরা বাইরে এলাম। নানু লনে একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়ছেন। আমি বললাম, নানু, নাস্তা খান নি যে?

নানু একটু হেসে বললেন, আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমাকে সব সময় ঘড়ি ধরে খেতে হয়। রাতে তোমাদের ভালো ঘুম হয়েছিলো তো?

বাবু বললো, রীতিমতো নাক ডেকে ঘুমিয়েছি।

বাগানে যেতে যেতে আমি বললাম, নিজের নাক ডাকা বুঝি শোনা যায় কখনো?

বাবু বললো, তোমারটা শুনে বুঝেছি আমারও নিশ্চয় ডেকেছিলো।

কক্ষনো আমার নাক ডাকে না। আর তোমার ডাকলেও আমি শুনতে পেতাম।

বাবু হেসে ফেললো আমি তো এমনি বলেছি। চটছো কেন?

আমিও হাসলাম–মনে হয় খুব ফুর্তিতে আছো!

বাবু অবাক হয়ে বললো, কেন, থাকারই তো কথা! তোমার কি ভালো লাগছে না?

আমি বুঝি তাই বলেছি? আমি তোমাকে টুনির কথা জিজ্ঞেস করেছি।

বাবু শুধু বললো, চমৎকার!

আমি বললাম, ললিও খুব ভালো মেয়ে। আসলে এরকম মেয়েদের সঙ্গেই আমাদের বন্ধুত্ব হওয়া উচিত।

বাগানে গিয়ে দেখি বুড়ো মালী বেচারা একগাদা গোলাপের কাটিং নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আমরা যখন বললাম আমরাও ওর সঙ্গে কাজ করবো, তখন মালী আমাদের হাতে নিড়ানিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, তোমরা দুদিনের জন্যে এসেছো, তোমরা কেন মিছেমিছি কষ্ট করবে।

আমি বললাম, দুদিন নয় মালী, দুমাস।

ওই হলো। দুমাস হলেও তো আমাদের অতিথ বটে।

আমি আর বাবু সুতো ধরে গোলাপের বেডের জায়গা ঠিক করে নিলাম। সারের গাদা থেকে সারও এনে দিলাম। নেলী খালা দুটো গরু পুষছেন। দুধের সঙ্গে সঙ্গে সারের জন্যেও ভাবতে হয় না। মাটি পরিষ্কার করতে করতে মালী বললো, তাও ভালো, দুমাস থাকবে। বাড়িটা যেন এ্যাদ্দিন মিত্যুপুরী হয়ে ছিলো। যেখানেই যাই, লোকে বলে এটা নাকি ভূতের বাড়ি। আমার বাপু দম আটকে আসছিলো। জেনেশুনে কেউ এমন বাড়ি কেনে!

আমি বললাম, ভূতের বাড়ি কেন বলে মালী?

ঠোঁট উল্টে খুরপি নেড়ে মালী বললো, কি জানি বাপু! লোকে বলে, তাই আমিও বলি। বিবিজির মাথা খারাপ না হলে কক্সবাজারের অমন বাড়িটা বেচে দেয়! বড়ো হুজুরকে কতো বোঝালাম। পাত্তাই দিলেন না। তবে এও তোমাদের বলে রাখি বাপু, কাঙালের কথা বাসি হলে কাজে দেয়।

বাবু হেসে বললো, মনে হচ্ছে এটা সত্যি সত্যি ভূতের বাড়ি হলেই যেন তুমি খুশি হও।

মালী বিরক্ত হয়ে বললো, তা কেন হবো বাপু! কক্সবাজারের বাড়িটা আরো ভালো ছিলো, তাই বলছি। নইলে আমার কি! কত্তারা যেখানে নেবেন সেখানেই যাবো। বুড়ো বয়েসে মানুষের দোরে ফিরবো নাকি!

আমি জানতে চাইলাম, লোকে কেন এটাকে ভূতের বাড়ি বলে, তুমি কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করো নি?

মালী আবার হাতের কাজ থামিয়ে খুরপি নেড়ে বললো, তা আর করি নি ভেবেছো? হাজার বার করেছি। এই যে ধরোগে হাটের লোকগুলোন। ওরা বলে আগে নাকি এ বাড়িটা লালমুখো হার্মাদদের আড্ডাখানা ছিলো। ওরা নাকি ডাকাতি করে কে কটা খুন করলো মানুষ কেটে মুণ্ডুখানা সঙ্গে নিয়ে আসতো। এ পাহাড়টাকে অনেকে মুখালি পাহাড় বলে। হার্মাদরা সেই মুণ্ডু বস্তায় ভরে পুঁতে রাখতো। আর সেই মুণ্ডু খোঁজার জন্যে তেনাদের আত্মারা এখনো নাকি এ বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে নাকি দেখেছে পুণিমার রাতে সাদা কাপড় পরে নদীর কিনার ধরে হেঁটে হেঁটে সমুদুরে গিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। তেনাদের গা থেকে আলো বেরোয়। এই দেখে তো এই নেই। হঠাৎ কী মনে পড়াতে মালী ব্যস্ত হয়ে কাজ শুরু করে দিলো, আমি বাপু তোমাদের এসব কথা বলি নি। বিবিজি জানতে চাইলে বোলো হাটের লোকগুলোন বলেছে। আর এও বলি বাপু, জঙ্গলে যদি কখনো যাও, তাহলে মড়ার খুলি আঁকা কোনো গাছের নিচে যেয়ো না।

বাবু বললো, জঙ্গলে আবার মড়ার খুলি আঁকা গাছও আছে নাকি?

নেই আবার! মালী উত্তেজিত হয়ে বললো, আমি নিজ চোখে দেখেছি। বিবিজির যখন নদীর কাদামাটি ঘটার বাই উঠলো, তখন তো আমিই সঙ্গে যেতাম। একদিন দেখি পুরোনো এক সেগুন গাছের গায়ে কিসের যেন আঁকিবুকি। কাছে গিয়ে দেখি মড়ার মাথার খুলি আঁকা। চারপাশে তাকিয়ে দেখি মাটির ভেতর থেকে একটি খুলি আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি তখন দোয়া পড়তে পড়তে কেনো রকমে পালিয়ে বাঁচি। বাথিনও আমাকে ওসব গাছের কাছে যেতে বারণ করেছে।

আমি বললাম, তুমি তো বড়ো ভাবিয়ে তুললে মালী!

বিচক্ষণ লোকের মতো মাথা নেড়ে মালী বললো, ভাববার কথাই বটে। বিবিজিকেও বলেছি। তিনি তো কানেই তোলেন না। বলেন, কোনো পাজি লোক ওসব করেছে। আমি বাপু এ তল্লাটে কোনো পাজি লোক দেখি নি। হাটের লোকগুলোন দেখা হলেই সুখ-দুঃখের খবর নেয়, বাড়ির অবস্থা-টবস্থা জিজ্ঞেস করে। কবে থেকে মোটেল খুলবো জানতে চায়। বলে–শহরে গেলে ওরা বলবে, এখানে ভালো মোটেল আছে।

আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, তবে এটাও বলে যে বাড়িটা ভালো নয়, ভূতের আড্ডা এটা। এখানে থাকা উচিত নয়। তাই না মালী?

মালী বুঝলো, কথাটা আমি অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছি। তাই বিরক্ত হয়ে বললো, ভালো লোক বলেই সাবধান করে দেয়। নইলে ওদের কী দায় পড়েছে? এই তো সেদিন পাকড়াশীদের চাকরটা আমাকে এক গণ্ডা সাদা পাতা দিয়ে বললো, এখানে তেনাদের যা দৌরাত্ম্য, ওর নাকি মন টিকছে না। ও নিজ চোখে দেখেছে। বলে, মাইনেটা পেলেই কেটে পড়তো। নেহাৎ মনিবটি এতো ভালো বলে থেকে গেছে।

বাবু বললো, পাকড়াশীটা আবার কে?

মালী বললো, নিকুঞ্জ পাকড়াশী। হাটের পুব দিকে ওনার একটা পাহাড় আছে। ওখানেই থাকেন। ভারি দয়ার শরীল গো। এখানে নতুন এসে ওনার সঙ্গে যখন দেখা করতে গেলাম আমাকে দশ টাকা বকশিশ দিলেন। আরো কতো খোঁজখবর নিলেন। এতো পয়সা ওনার, একটুও দেমাক নেই। ধরতে গেলে। একেবারে মটির মানুষ।

বাবু হঠাৎ আমার কানে কানে বললো, নেলী খালা যে সোনা খুঁজতেন, মালী কি সেটা জানে না? ও যে বললো, কাদামাটি ঘাঁটতেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে মালীকে বললাম, জানো মালী, নেলী খালা বলেছেন, তোমাদের এই নদীটার কোথাও নাকি সোনার খনি আছে। নদীর বালিতে সোনা পাওয়া যায়।

মালী ঠোঁট উল্টে বললো, বিবিজি কথাটা আমাকেও বলেছিলেন। এ আমার পেত্যয় হয় নি। আমি পাকড়াশী বাবুকে বলেছিলাম বটে। শুনে তিনি হেসে বাঁচেন না। বললেন, তাহলে তো তোমরা কোটিপতি হয়ে গেলে হে। এখন থেকে দেখি বুঝে-সমঝে কথা বলতে হবে। আমি তখন লজ্জায় মরি আর কি!

আমি বললাম, নেলী খালা যে কিছু সোনা পেয়েছেন, তুমি দেখো নি?

মালী বললো, তোমাদের বুড়িগঙ্গার নদ্দমাতেও কাদা ঘেঁটে ওরকম সোনা পেতে আমি দেখেছি। সেটাকে তো আর খনি পাওয়া বলে না।

বাগানে কাজ করতে করতে দিনের আলোয় বাড়িটাকে ভালো করে দেখলাম। কাঠামো দেখে মনে হয় কয়েক শ বছরের পুরোনো হবে। নেলী খালা যাদের কাছ থেকে কিনেছেন, অর্থাৎ তালুকদাররা নাকি কয়েক পুরুষ ধরে এ বাড়িতে থেকেছেন। যত্ন নিয়েছেন যে বোঝা যায়। কবেকার লাগানো সারি বাঁধা কৃষ্ণচূড়া, আর রাধাচূড়ার গাছগুলো লাল আর হলদে ফুলে ফুলে রঙের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। গাছের তলায়, পথের ওপর সোনার গুঁড়োর মতো রাধাচূড়া ফুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চমৎকার নকশা এঁকেছে। তালুকদারদের পূর্বপুরুষের রুচির প্রশংসা করতে হয়। পয়সাও যথেষ্ট ছিলো বলতে হবে। নইলে এতো বড়ো বাড়ির বাড়ির না বলে প্রাসাদই বলা উচিত; যত্ন করা চাট্টিখানি কথা নয়। আশেপাশের পাহাড়গুলো থেকে এ পাহাড়টাই বেশি উঁচু। পুব দিকের পাহাড়গুলো বর্ডার পেরিয়ে বার্মায় গিয়ে মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে। উত্তরে পাহাড়, দক্ষিণে কিছু দূর পাহাড়, তারপর সমুদ্র আর পশ্চিমে শুধু সমুদ্র। সারাক্ষণ সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। এমন বাড়িকে ঘিরে যদি রহস্যের পাহাড় না জমে, তবে কি আমাদের রূপলাল লেনের এঁদো গলির ঘিঞ্জি বাড়িটা রহস্যময় হবে? এ বাড়ি হার্মাদদের আড্ডা হতে পারে। এ বাড়ির চারপাশে অসংখ্য অতৃপ্ত আত্মা অষ্টপ্রহর ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়াতে পারে। এ পাহাড়টায় হার্মাদদের পুঁতে রাখা কঙ্কাল থাকতে পারে। এমনও তো হতে পারে, সোনার খনি খুঁজতে গিয়ে আমরা হার্মাদদের এক বিশাল গুপ্তধন পেয়ে গেলাম–চিলেকোঠায় বসে অলস দুপুরগুলোতে আমি যার স্বপ্ন দেখতাম। ভাবতে ভাবতে আমার লোম-টোম সব খাড়া হয়ে গেলো। বাবুকে বললাম, চলো, বাকিটুকু মালী সারতে পারবে। আমরা আরো বড়ো কিছু নিয়ে মাথা ঘামাবো।

বাবু হাত ঝেড়ে আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বললো, সোনার খনির ব্যাপারে তুমি কি খুব সিরিয়াস??

আমি বললাম, শুধু সোনার খনি নয়, আরো অনেক কিছু নিয়ে আমি ভাবছি। দুপুরের পর ললি টুনিকে নিয়ে আমরা একটা প্ল্যান করবো।

আমাদের আসতে দেখে নেলী খালা ডাকলেন, আবির, বাবু, দেখে যাও। আমার সাইনবোর্ড তৈরি হয়ে গেছে।

এরই মধ্যে হয়ে গেলো! আমরা দুজন থামঅলা গেটের কাছে ছুটে গেলাম। চমৎকার লিখেছেন নেলী খালা–

সী ভিউ প্যালেস
অবকাশ যাপনের একটি
মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ।

আমাদের স্কুলে ক্যান্ডি লেটারিং শিখিয়েছিলেন ব্রাদার হবার্ট। নেলী খালা সী ভিউ প্যালেসটা ক্যান্ডি হরফে লিখেছেন। বাংলায় যে ক্যান্ডি লেখা হতে পারে, আর সেটা এতো সুন্দরভাবে আমার ধারণাই ছিলো না। আমি হেসে বললাম, তোমার এতো সুন্দর লেখার প্রশংসা করার লোক খুব কমই পাবে।

নেলী খালা লাজুক হেসে বললেন, তুমি বুঝি সেই কমের দলে! আমার এখানে সব গেঁয়ো লোকেরা আসবে, এটা ভাবছো কেন আবির?

বাবু বললো, বরং শহরের সৌখিন লোকেরাই শুধু এখানে থাকতে চাইবে। কী বলেন নেলী খালা?

নেলী খালা তেমনি হেসে বললেন, তোমাদের মতো সৌখিন ফুলবাবুরা। প্রশংসা শুনলে নেলী খালা লাল হয়ে যান।

আমি বললাম, মোটেই আমরা ফুলবাবু নই। বাগানে গিয়ে দেখা গে কতো কাজ করেছি আমরা।

নেলী খালা আদর করে আমাদের কপালে চুমো খেয়ে বললেন, এবার তাহলে নাইতে যাও। বাথিন টবে পানি তুলে রেখেছে।

দুপুরে খাবার পর বাবু ললি টুনিকে ডেকে বললো, আমরা দারুণ একটা কাজে হাত দিতে চাই। তোমরা যদি যোগ দিতে চাও, তাহলে আমাদের ঘরে চলে এসো।

ললি আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, ঘরে চলো, সব খুলে বলবো।

ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। আমার মনে হলো, জীবনে এই প্রথম একটা রোমাঞ্চকর কাজে হাত দিতে যাচ্ছি। সেগুন কাঠের পালিশ করা মেঝের ওপর আমরা চার জন বসলাম। ওদের মুখের দিকে তাকালাম। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে টুনি। আমি গলাটা ঝেড়ে বেশ গম্ভীরভাবেই বললাম, তোমরা কি কেউ এ বাড়ির অভিশাপটা নিয়ে ভেবেছো?

বাবু ললি টুনির দিকে তাকালো। টুনি ঢোক গিলে বললো, আমার মনে হয় এখানে ভূত-টুত থাকতে পারে।

ওসব বাজে কথা। আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, ভূত বলে কিছু নেই।

টুনি বললো, তবে যে বুড়ো মুৎসুদ্দি বললো, এটা ভূতুড়ে বাড়ি?

বাবু বললো, মুৎসুদ্দি তো ভালোই বলেছে। মালীটা যা বললো, তার ছটাকও যদি সত্যি হয়, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে বিরাট রহস্য আছে কোথাও।

ললি অবাক হয়ে বললো, মালী কী বলেছে?

মালীর সব কথা ললি টুনিকে খুলে বললাম। শুনে ললি টুনি অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। ললি বললো, কী আশ্চর্য, ঠিক এ কথাগুলোই যে বাথিন আমাদের বলেছে। ওকে নিয়ে যখন আমরা ঘর সাজাচ্ছিলাম, তখন এসব বললো। কাউকে বলতেও বারণ করেছে।

এবার আমার আর বাবুর অবাক হবার পালা। আমার মনে হলো, এমন তো হতে পারে যে, দুজনেই হাট থেকে এসব কথা শুনেছে। এ্যাদ্দিন বলার মতো কাউকে পাচ্ছিলো না। এখন পেয়ে সব কথা হুড়মুড় করে বলে ফেলছে। আমি কী বলবো, মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে বললাম, দেখো, এসব কথার ভেতর থেকে একটা ব্যাপারই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে আমাদের থাকাটা কেউ পছন্দ করছে না, সেজন্যে ভয় দেখিয়ে তালুকদারদের মতো তাড়িয়ে দিতে চাইছে। নেলী খালা বললেন, তালুকদাররা নাকি ভূতের ভয়ে কেটে পড়েছে। এর দুটো কারণ আমার মনে হয়েছে। এক হলো, নেলী খালার কথা মতো এখানে কোনো সোনার খনি আছে। হয়তো সেটা এই পাহাড়েই হতে পারে। কারো হয়তো ইচ্ছে আছে আমরা সবাই নেলী খালারা সুদ্ধো যদি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, তাহলে মনের সুখে লুকিয়ে লুকিয়ে সোনা তুলতে পারবে। আরেকটা হতে পারে বলে আমি একটু ঢোক গিলে বললাম, ওরা যখন বলছে, আগে এটা হার্মাদদের আস্তানা ছিলো, তখন এখানে কোথাও মাটির নিচে লুকোনো গুপ্তধন থাকাটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। হয়তো এ বাড়ির কোথাও একখানা নকশা লুকোনো আছে। সেই গুপ্তধনের লোভে কেউ চাইছে, আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। আর সেজন্যেই এসব আত্মা আর ভূতের আজগুবি গপ্পো ছড়াচ্ছে।

টুনি বললো, তবে যে বাথিন বললো, মড়ার খুলি আঁকা গাছের নিচে এখনো মানুষের হাড়গোড় পাওয়া যায়?

আমি বললাম, সেটা আরো সন্দেহের ব্যাপার। এখানে স্মাগলার আছে, সে কথা তো নেলী খালাই বললেন। ওদের ভেতর তো ডাকাতও থাকতে পারে, যারা এখনো মানুষ খুন করে মাটির নিচে পুঁতে রাখে।

আমার কথা শুনে টুনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আপনি মিছেমিছি ভয় দেখাচ্ছেন কেন? বাথিন বলেছে হার্মাদরা খুন করতো।

বাবু বিরক্ত হয়ে বললো, আহ টুনি, নাকী কান্নার সময় নয় এটা। হাড়গুলো কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করালেই বোঝা যাবে ওগুলো কবে পুঁতেছিলো। তবে আবির মনে হয় একটু বেশি ভেবে ফেলেছে।

ললি আস্তে আস্তে বললো, তোমার কি সত্যিই মনে হয় আবির, এখানে কোনো গুপ্তধন লুকোনো আছে?

আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, কথাটা অস্বাভাবিক নয়। আমি অনেক বইয়ে পড়েছি, এরকম বাড়িতেই গুপ্তধন থাকে। গুপ্তধন না পেলেও লুকোনো এমন কোনো জিনিস তো আমরা পেতে পারি, যা জাদুঘরঅলারা লুফে নেবে।

ললি গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো। বললো, কাজ কীভাবে শুরু করতে চাও?

আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটা ভেবে দেখতে হবে।

ললি বললো, আজ সকালে পাশের ঘরগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে অনেক জিনিসপত্র দেখেছি। থালা, বাসন, ফুলদানি, ঝাড়বাতি এসব। আমার মনে হয় নকশা-টকশার জন্যে আমরা সবগুলো ঘর খুঁজে দেখতে পারি। এখনো বেশিরভাগ ঘরেরই তালা খোলা হয় নি।

টুনি ফিক করে হেসে বললো, ললিপা বুঝি এই সুযোগে ওদেরকে দিয়ে ঘরগুলো পরিষ্কার করিয়ে নিতে চাইছো!

এবার ললি টুনিকে ধমক লাগালো–হাসির কী হলো টুনি! দেখছো না, একটা গুরুতর ব্যাপার নিয়ে আমরা কথা বলছি? এরপর তাহলে আমাদের কথার সময় তোমাকে ডাকা হবে না।

বোঝা গেলো আমার আইডিয়াটা ললির খুব পছন্দ হয়েছে। টুনি অবশ্য গাঁইগুই করে বলতে লাগলো, গুরুতর না ঘোড়ার ডিম। ওরা প্ল্যান করে আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে।

বাবু বললো, তুমি তাহলে কেটে পড়তে পারো। শোনো আবির, ডাকাত যদি থেকে থাকে, তাহলে আমাদের আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে জানানো উচিত। নেলী খালা তো বললেন ওরা নাকি নতুন এসেছে, এসব নাও জানতে পারে। মেজরের সঙ্গে মনে হয় নেলী খালার ভালোই আলাপ আছে। আমাদের অসুবিধে হবে না।

ললি মাথা নেড়ে জানালো–কথাটা মন্দ বলো নি বাবু। তবে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি এসব কথা নেলী খালাকে বলবেন, আর শেষে সবাই মিলে হাসাহাসি করবে। বড়োরা কখনো আমাদের প্ল্যান মতো কাজ করবে না।

আমি বললাম, প্ল্যানের কথা মেজরকে না বললেই হয়। আমরা তার কাছে গিয়ে জায়গাটা সম্পর্কে খোঁজখবর নেবো। সেই সঙ্গে হাটের লোকজনকে একটু বাজিয়ে দেখা যাবে। আমার তো মনে হয় শত্রু পক্ষের কোনো চর নিশ্চয় হাট থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে।

শত্রু পক্ষের কথাটা শুনে ভেবেছিলাম টুনি হেসে ফেলবে। কিন্তু দেখলাম, টুনিও বেশ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শেষ পর্যন্ত শুনলো।

.

০৪. রহস্যময় অতিথি

দুপুরের পর এক ঘন্টারও বেশি সময় আমরা আলোচনার জন্যে খরচ করেছিলাম। শেষে বাবু যখন হাই তুলে বললো, আমার ঘুম পাচ্ছে–তখন ললি টুনি ওদের ঘরে চলে গেলো। বাবু কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। আমি খাটের গায়ে হেলান দিয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে রবিনসন ক্রুসোর দ্বীপে চলে গেলাম।

নেলী খালা কখন যে চুপি চুপি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, টেরও পাই নি। আমার কাঁধে আলতোভাবে হাত রেখে বললেন, কিরে, বাবু ঘুমোচ্ছে, তুই যে জেগে আছিস?

আমি একটু চমকে উঠে নেলী খালাকে দেখলাম। সাদা শাড়ি পরা নেলী খালাকে মার মতো পবিত্র মনে হলো। নেলী খালা আস্তে খাটের উপর বসলেন, যেন বাবুর ঘুম না ভাঙে। তারপর কোমল গলায় বললেন, হ্যাঁরে, অপুর কোনো খবর পেয়েছিস?

আমি গত মাসে পাওয়া চিঠির কথা বললাম। নেলী খালা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, কক্সবাজারে একদিন অপুর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

আমি অবাক হয়ে বললাম, সে কি নেলী খালা! তুমি ভাইয়াকে চিনলে কী করে?

নেলী খালা আগের মতো হেসে বললেন, বোকা ছেলে! চিনবো না কেন? অপু যে বার ম্যাট্রিক দিলো, সেবার যে আমি তিন দিনের জন্যে তোদের বাড়িতে এসেছিলাম, ভুলে গেছিস নাকি?

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, ভাইয়ার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে নেলী খালা? ভাইয়া কী করছে এখন?

নেলী খালা শান্ত গলায় বললেন, অনেক কথা হয়েছে। তোর মাকে অবশ্য চিঠিতে কিছুই লিখি নি। ওর রঙটা শুধু কালো হয়ে গেছে। শরীর আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কী করছে, সব কথা তো আর তোকে বলা যাবে না। এটুকু জানলেই চলবে, অপু দেশের জন্যে কাজ করছে। ওর জন্যে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত।

নেলী খালা আমাকে এখনো ছোট্ট ছেলে ভাবেন বলে দুঃখ পেলাম। বললাম, জানো নেলী খালা, আমারও ইচ্ছে হয় ভাইয়ার মতো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। ভাইয়ার সঙ্গে কখনো দেখা হলে আমি বলবো, আমাকে যেন সাথে নেয়।

নেলী খালা মৃদু হেসে বললেন, পাগল ছেলে, তুই এখনো একেবারে ছোট্টটি রয়ে গেছিস। অপুর মতো হতে চাইলে তোকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ভাইয়াকে দারুণ স্বার্থপর মনে হলো। কী হতো আমাকে সব কথা বললে! নেলী খালাকে যে-কথা বলা যায়, সে-কথা কি আমাকে বলা যায় না?

দূরে কয়েকটা সমুদ্রে পাখি ডাকছিলো। নেলী খালা কান পেতে সেই ডাক শুনলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, কাউকে বলিস না আবির। অপুর কথাতেই আমি তো এই বাড়িটা কিনেছি। ও বলেছে মাঝে মাঝে ওর বন্ধুরা এসে থাকবে। আমি তো সারা জীবন দেশের কোনো কাজেই লাগলাম না।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম সত্যি বলছো নেলী খালা! তাহলে ভাইয়ার সঙ্গে নিশ্চয় এখানে দেখা হতে পারে?

নেলী খালা মৃদু হেসে বললেন, হতে পারে। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়েছিলো প্রায় দেড় মাস আগে। তবে ও বলেছে, এলে খবর দিয়ে আসবে। এখানে এসেই আমি জাহেদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছি। দেখ না, ওকেও ঠিক দলে ভিড়িয়ে ফেলবো।

আমি অবাক হয়ে বললাম, সে কি নেলী খালা, তুমিও কি ভাইয়াদের দলে আছো?

নেলী খালা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, এসব কথা কখনো তোর বন্ধুদের বলবি না। বাবু ললি টুনিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তোর আর কোনো কাজ নেই। অপুর কথা তোর মার সঙ্গে দেখা হলে বলবো।

নেলী খালা উঠে চলে গেলেন। আমি মনে মনে ভাবলাম, এক দিন ঠিকই ভাইয়ার মতো ঘরবাড়ি সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে যাবো। ভাইয়ার আলমারির বাংলা বইগুলো পড়ে শেষ করতে নিশ্চয়ই বেশি দিন লাগবে না।

বিকেলে আমরা লনে গিয়ে কিছুক্ষণ পাজি রাজা খেলোম। টসে বাবু রাজা হয়ে ভালো রকম নাকানি-চোবানি খেলো। খেলতে গিয়ে স্ক্যাটরার সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেলো। টেনিস বলটা দূরে গড়িয়ে গেলে স্ক্যরা ছুটে গিয়ে ওটা মুখে করে তুলে আনছিলো। কাছে এসে ছুঁড়ে দিচ্ছিলো। নেলী খালা বললেন, কদিন ওর সঙ্গে আমি খেলার সময় পাই নি বলে বেচারার ভারি মন খারাপ করেছিলো।

খেলার পর নেলী খালাকে বললাম, আমরা চারপাশে একটু ঘুরে দেখবো নেলী খালা। তুমি যে আর্মি ক্যাম্পের কথা বললে, ওটা কোন দিকে?

নেলী খালা বললেন, হাট থেকে সরু যে-রাস্তাটা ডানদিকে নেমে গেছে, সেই রাস্তা ধরে কিছু দূরে গেলেই বাঁ পাশে দেখতে পাবে। হাটে গিয়ে আবার আর্মি ক্যাম্প কোন দিকে বলে গলাবাজি কোরো না।

বাবু বললো, আমাদের অতো বোকা ভাবছেন কেন?

নেলী খালা হেসে বললেন, যেখানে যাও, রাত কোরো না। আর জাহেদকে বোলো ওদের ওখানে যদি কোনো কাঠের মিস্ত্রি থাকে, কাল সকালে যেন পাঠিয়ে দেয়।

টুনি বললো, জাহেদ কে নেলী খালা?

একটু অবাক হয়ে নেলী খালা বললেন, কেন, মেজর জাহেদের কথা বলি নি তোমাদের? কোন ক্যাম্পে যাচ্ছো তাহলে?

বাবু বললো, সেখানেই যাবো নেলী খালা। তারপর টুনির দিকে তাকালো–কাল রাতে খাবার টেবিলে টুনি কানে কুলুপ এঁটে বসেছিলো।

টুনি চটে গিয়ে আমাকে বললো, আবির, আপনার বন্ধুকে বলুন সব সময় যেন আমার পেছনে লাগতে না আসে। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।

বাবু বললো, খারাপ হলেই বাঁচি।

টুনি ওকে মারার জন্যে ছুটে এলো। বাবু তার আগেই ছুটলো। ওদের দুজনের পেছনে স্ক্যাটরাও ছুটলো। আমি আর ললি পাহাড়ী পথ বেয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম।

ললিটা সব সময় বড়ো বেশি গম্ভীর থাকে। আমি চাই, ললি অন্তত আমার সঙ্গে একটু বেশি কথা বলুক। এটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, ললি আমার এক জন ভালো বন্ধু হবে। বাবু জানলে হয়তো মন খারাপ করতে পারে। ও টুনির সঙ্গে ভাব জমাক না; আমি কিছু মনে করবো না।

আমি এক সময় বললাম, তুমি এতো গম্ভীর থাকো কেন ললি? কথাটথা বলো।

ললি একটু হেসে বললো, মাঝে মাঝে তুমিও তো আমার চেয়ে বেশি গম্ভীর হয়ে যাও। মনে হয় অনেক কিছু যেন ভাবো।

আমি বড়দের মতো বিষণ্ণ গলায় বললাম, নিজেকে কখনো খুব একা মনে হয় ললি। তখন হয়তো চুপচাপ থাকি।

ললি বললো, একা কেন মনে হবে? বাবু আছে তো!

বাবু তো দুমাস পরেই চলে যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর ললি আস্তে আস্তে বললো, আমাকে এখন থেকে তোমার বন্ধু ভেবো। তাহলে আর একা মনে হবে না।

আমি একটু হেসে বললাম, আমি ভাবলে তো আর হবে না। তোমাকেও ভাবতে হবে।

ললি একটু লজ্জা পেলো। তারপর বললো, যখন নেলী খালার কাছে তোমার সব কথা শুনেছি, তখন থেকেই তোমাকে আমি বন্ধু ভেবেছি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ললি বললো, আসলে আমি তোমার চেয়েও বেশি একা। টুনি ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসে না।

এর পর আমি চুপ করে রইলাম। বুকের ভেতর কেমন যেন শিরশির করে উঠলো। ললির কাঁধে হাত রাখলাম। ও কোনো কথা বললো না। সামনের মোড়টা পেরোতে দেখি, বাবু আর টুনি স্ক্যাটরাকে নিয়ে পথের পাশে ঘাসের ওপর বসে আছে।

টুনি বললো, এতো আস্তে হাঁটছো কেন তোমরা? যেতে যেতেই তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে।

ললি বললো, তুমি তো জানো টুনি, ডাক্তার আমাকে জোরে হাঁটতে বারণ করেছেন।

আমি অবাক হলাম—কেন ললি?

ললি খুব আস্তে করে বললো, আমার বুকের ভেতর একটা অসুখ আছে।

আমি ললির মুখের দিকে তাকালাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, ওর বুকের ভেতর অনেক দুঃখ জমে আছে। অনেক দিন ধরে যে দুঃখগুলো জমে জমে অসুখ হয়ে গেছে। কাউকে যন্ত্রণা পেতে দেখলে আমার কষ্ট হয়। মনে মনে ভাবলাম, বড় হয়ে যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবো, তখন সবার দুঃখ দূর করে দেবো।

পাহাড়ের বিকেলগুলো যে এতো সুন্দর হয়, আগে আমি ভাবতেই পারি নি। সমুদ্রের বাতাসে পথের ওপর ঝুরঝুর করে রাধাচূড়ার হলদে পাপড়ির বৃষ্টি ঝরছে। দূরের পাহাড়গুলো লাল, গোলাপি, বেগুনি মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। পুরোনো ঢাকার এক সরু গলির কথা মনে পড়লো। সেখানে কোনো দিন এতো বড়ো আকাশ দেখি নি।

আমরা হাটে এসে দেখি দোকানপাট সব বন্ধ। বাবু বললো, আজ বোধ হয় হাটবার নয়। গ্রামে শুনেছি হপ্তায় এক দিন নয় দুদিন হাটের দোকান খোলা থাকে।

আমি বললাম, কাজ নেই হাটে। চলো ক্যাম্পে যাওয়া যাক।

নেলী খালার কথা মতো ডান পাশের সরু রাস্তায় মোড় ঘুরতেই দেখি একটা বন্ধ দোকানের চালের নিচে লরেল হার্ডির মতো দুজন ভদ্রলোক একটা বেঞ্চে বসে আছে। সিনেমার লরেল হার্ডির কথা বললাম বটে, তবে ওদের প্যান্ট-শার্ট পরা দেখে যাত্রা দলের সং-এর মতো মনে হচ্ছিলো। কাছে যেতেই মোটা লোকটা আমাকে মোলায়েম গলায় বললো, এই যে খোকা, এদিকে শুনলাম একটা মোটেল নাকি আছে। কোন এক বিলেতি মেম চালান ওটা? কোন পথে যাবো বলতে পারো?

লোকটা আমাকে ললি টুনির সামনে থোকা বলাতে যেমন রাগ হলো, আবার নেলী খালাকে বিলেতি মেম বলাতে হাসিও পেলো। এরই ভেতর টুনি ফিক ফিক করে হাসতে শুরু করেছে।

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, এ পথ ধরে সোজা চলে যান।

স্ক্যাটরা ওদের দিকে ভয়ানক সন্দেহের চোখে তাকিয়ে গরগর করছিলো। লরেলের মতো সরু লোকটা দেখতে পেয়ে মিহি গলায় বললো, কামড়ে-টামড়ে দেবে না তো! কুত্তোটা সামলে রেখো বাপু। এই বলে বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে সঙ্গীকে বললো, চল ফতে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এই প্রাণীটাকে আমি দু চোখে দেখতে পারি না। ওরাও আমাকে পছন্দ করে না।

লোক দুটো চোখের আড়ালে যেতেই আমরা সবাই হেসে কুটোপাটি। স্ক্যাটরাকে মোটেলে দেখলে ওদের যে কী অবস্থা হবে, বিশেষ করে ওই রোগা লিকপিকে লোকটার-যতোবার ভাবলাম ততোবারই শুধু হাসি পেলো। ললি বললো, নেলী খালার প্রথম গেস্ট হিসেবে রীতিমতো মনে রাখার মতো।

নেলী খালা বলেছিলেন আর্মি ক্যাম্প, কিন্তু আমরা কোনো ক্যাম্প অর্থাৎ তাঁবু-টাবু দেখতে পেলাম না। তার বদলে সেখানে রয়েছে চমৎকার এক বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। আর পেছনে টালির ছাদঅলা একটা লম্বা ঘর। বোঝা গেলো এটাকেই নেলী খালা ক্যাম্প বলেছেন। গেটের কাছে দারোয়ানের মতো একটা লোক ঘুরঘুর করছিলো। ওকে গিয়ে বললাম, মেজর জাহেদ আহমেদ কি এখানে থাকেন?

কথাটা শুনে লোকটা খেঁকিয়ে উঠলো–এখানে আবার মেজর আসবে কোত্থেকে। আমাদের সায়েব রবারের চাষ করেন আর শিকার করেন।

লোকটা হয়তো আমাদের তাড়িয়েই দিতো। কিন্তু স্ক্যাটরা ওর দিকে যেভাবে গরগর করছিলো, তাতে সাহস পেলো না। তার বদলে আমার দিকে এমন কটমট করে তাকালো যে, মনে হলো আমরা বিদেয় হলেই সে খুশি হয়। এমন সময় বাংলার বারান্দা থেকে এক জন ভদ্রলোক নেমে এসে–কী হয়েছে বনমালী, বলে আমাদের দিকে তাকিয়েই আরে এসো এসো, আমার ক্ষুদে প্রতিবেশীরা। নেলীর কাছে তোমাদের কথা শুনে শুনে সবার চেহারা পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে গেছে।

এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, তুমি হচ্ছো আবির। আর এ হচ্ছে আমেরিকান বাবু–তারপর ললির দিকে তাকিয়ে বললেন, শান্ত মেয়েটি যে ললি, সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না। বাকি থাকলো শুধু টুনি। জিব না দেখলেও ওকে চেনা যায়।

টুনি ওর অভ্যেস মতো ফিক করে হেসে ফেললো। মেজর জাহেদের মতো চমৎকার চেহারার ভদ্রলোক আমি শুধু টিভির বিদেশী ছবিগুলোতেই দেখেছি। টুনিও দেখলাম হা করে তাঁকে দেখছে। স্ক্যাটরার সঙ্গে তার আগেই পরিচয় ছিলো। স্ক্যাটরা–বলে নরোম গলায় যখন তিনি ডাকলেন, তখন স্ক্যাটরা তাঁর সাদা ট্রাউজার আর নীল গেঞ্জিতে ধুলোটুলো মাখিয়ে নাক-মুখ সব চেটে একাকার করে ফেললো। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, ওরে থাম থাম। সুড়সুড়ি আর আদরের বহরে হাসতে হাসতে আমার দমটা বেরিয়ে যাবে। তারপর আমাদের বললেন, চলো ঘরে যাই।

মেজর জাহেদ বাবুর্চিকে মিল্ক চকোলেট বানাতে বলে সবাইকে একগাদা ক্যান্ডি বের করে দিলেন। স্ক্যাটরাও বাদ পড়লো না। আমরা সবাই বাংলোর বারান্দায় বসে কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিলাম। বড়ো বড়ো কাপে করে গরম মিল্ক চকোলেট না আসা পর্যন্ত কে কি করি, তার ফিরিস্তি দিতে দিতেই সময় কেটে গেলো। এখানে আসার পর কী ঘটেছে তাও বললাম। বাবু আর টুনিই বেশি কথা বলছিলো। তিনি শুধু মিটিমিটি হাসছিলেন।

আমরা চকোলেটের কাপে চুমুক দেবার জন্যে যখন কথা থামালাম, তখন বনমালী নামের সেই খিটখিটে লোকটা এসে মেজরের কানে কানে কি যেন বললো। মেজর শুধু একটু হেসে ওকে ইশারায় চলে যেতে বললেন। টুনি বললো, আপনার এ লোকটাকে আমার একদম পছন্দ হয় নি।

মেজর হেসে বললেন, ও নিশ্চয়ই বলেছে, মেজর জাহেদ আহমেদ বলে এখানে কেউ থাকে না। নেলী কি তোমাদের বলে নি, আমরা সবাই এখানে গোপনে ছদ্মবেশে আছি? এখানে যিনি থাকেন–

তাঁকে বাধা দিয়ে হেসে ফেলে আমি বললাম, তিনি শুধু রবারের চাষ করেন, আর মাঝে মাঝে শিকার-টিকারে বেরোন।

সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলো। স্ক্যাটরা কী বুঝলো কে জানে, ছুটে গিয়ে আরেক দফা মেজরের গাল-টাল চেটে দিলো। মেজর বললেন, শিকারের জন্যে এসেছি বটে, তবে এই এলাকায় তেমন সুবিধে করতে পারছি না। শিকারগুলো বড়ো বেশি বেরসিক। সব সময় নাগালের বাইরে চলাফেরা করে।

তারপর মেজর বললেন, এ অঞ্চলে যে একটা বড়ো রকমের স্মাগলারের দল কাজ করছে, সে রিপোর্ট আমাদের আছে। বর্ডারে সব রকম কড়াকড়ি করা হয়েছে। কিন্তু বার বার পাখি ঠিকই উড়ে যাচ্ছে।

আমি বললাম, নেলী খালা বলছিলেন, এখানে নাকি সোনার খনি থাকতে পারে। আপনার কি মনে হয় কোনো পাজি লোক সোনার খনি খোঁজার জন্যে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে?

মেজর একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, সোনার খনির ব্যাপারে আমার সে রকম ধারণা নেই। নেলী অবশ্য জিওলজিক্যাল সার্ভে অফিসে চিঠি পাঠিয়েছে। সোনার খনি এখানে না হলে বার্মাতেও হতে পারে। তবে আমার মনে হয়, কেউ হয়তো নেলীর বাড়িটা সস্তায় কিনে নিতে চায়। সে জন্যে হয়তো ভয় দেখাচ্ছে। আসল কথা হলো, তোমাদের বোধ হয় এখানকার কেউ পছন্দ করছে না। আমি নেলীকে বলেছি, আমরা যতক্ষণ আছি ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমাদের এখানে এক কোম্পানি সৈন্য আছে–আপাতত যারা রবারের চাষ করছে। এই বলে মেজর মুখ টিপে হাসলেন।

বাইরে তখন সন্ধে ঘনিয়ে আসছিলো। সূর্যটা অনেক আগেই সামনের পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। ঠাণ্ডা তাজা বাতাস বইছে। বাংলোর ঝুল বারান্দার থাম বেয়ে দুটো লতা গোলাপের ঝাড় ওপরে উঠে গেছে। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছ দুটো। মিষ্টি একটা গন্ধ বাতাসে ভাসছে। ললি বললো, এ জায়গাটা ভারি সুন্দর!

মেজর একটু হেসে বললেন, হু, সুন্দরের ভেতরই অসুন্দর বাসা বাঁধে।

হঠাৎ মনে পড়লো, মেজরকে নেলী খালার কথা বলা হয় নি। বলতেই তিনি হেসে উঠলেন–কাঠের মিস্ত্রি এখানে কোথায় পাবো? নেলীর যদি খুব দরকার হয়, আমার পুরোনো বিদ্যে কিছু জাহির করতে পারি। ওকে বলল আমি কাল সকালে যাবো।

সন্ধ্যের আগে ফিরে যেতে হবে। মেজরকে বললাম, আমরা চলি তাহলে। কাল সকালে দেখা হবে।

তিনি হেসে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আড়চোখে বনমালীর দিকে তাকিয়ে দেখি, ওর মুখের সেই খিটখিটে ভাবটা আর নেই। স্ক্যাটরা অবশ্য ওকে দেখে গরগর করে যেন বললো, তোমাকে বাপু পছন্দ হয় নি। আমাকে কখনো ঘটাতে এসো না।

পথের পাশে একটা ঝোঁপের ভেতর বুনো লিলি ফুটেছিলো। মিষ্টি হলেও গন্ধটা ভারি ঝাঁঝালো। টুনি ললিকে বললো, ললিপা এসো, নেলী খালার জন্যে কিছু ফুল নিয়ে যাই।

ললি টুনির সঙ্গে ফুল তুলতে গেলো। বাবু এক বার আমার মুখের দিকে তাকালো। তারপর গুটিগুটি ললি টুনিদের কাছে চলে গেলো। আমি ঘাসের ওপর বসে আকাশে রঙের খেলা দেখছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, ডান পাশের পাহাড়ে একটা আলো এক বার জ্বলে উঠেই নিভে গেলো। তারপর ভালো করে চারদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। এমন সময় স্ক্যটরা হঠাৎ গরগর করে উঠলো। আলোটা যেখানে দেখেছিলাম, তার অল্প দূরে তাকিয়ে দেখি একটা মানুষ। দেখে আমার গায়ের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা ধুপধুপ করতে লাগলো। মানুষ বললাম বটে তবে মানুষ যে কখনো এতো লম্বা হতে পারে না, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। আগাগোড়া সাদা আলখাল্লা পরা সেই মানুষটা অথবা অন্য যা কিছু হোক পাহাড়ের প্রায় অন্ধকার গাছের তলায় হাঁটছিলো। ইচ্ছে করলেই অবশ্য ওটা আমাদের কাছে আসতে পারবে না, কারণ দুই পাহাড়ের মাঝখানে যে ঢাল জায়গা, সেটা এতো গভীর যে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। তবে একেবারে নিচে বিকেলে একটা রূপোলি ফিতের মতো সরু নালা দেখেছি। পাহাড়ে এরকম প্রায়ই থাকে। কেউ ওটা পেরিয়ে এখানে আসতে চাইলে কম করে হলেও তিন-চার ঘন্টা লেগে যাবে, ততোক্ষণে আমরা ঘরে ফিরে খেয়ে-দেয়ে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়বো; কিন্তু যদি মানুষ না হয়–কথাটা মনে হওয়া মাত্র আমার গলা-টলা সব শুকিয়ে গেলো। আর তখনই স্ক্যাটরা ওটার দিকে তাকিয়ে এতো জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো যে বাবু, ললি, টুনি সবাই কী হয়েছে বলে ছুটে এলো। ততোক্ষণে ওই আজগুবি মানুষটা একটা ঝাকড়া ছাতিম গাছের আড়ালে বাতাসের মতো মিলিয়ে গেছে।

ওদের সবার হাত ভর্তি বুনো লিলি। বাবু বললো, স্ক্যাটরা ও রকম চাঁচালো কেন?

আমি একবার টুনির দিকে তাকালাম। তারপর বললাম, ও কিছু নয়। ইঁদুর-টিদুর কিছু দেখেছে বোধ হয়। স্ক্যাটরা পাহাড়ী ধেড়ে ইঁদুর দুচোখে দেখতে পারে না।

বাবু কথাটা বিশ্বাস করলো কিনা জানি না। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, চলো, রাত হয়ে গেছে।

আমাদের দেখে নেলী খালা বললেন, তোমাদের আরো আগে ফেরা উচিত ছিলো। তারপর ফুলগুলো দেখেই লুফে নিলেন–কী চমৎকার লিলি! অনেক দিন আমার ইচ্ছে হয়েছে কিছু তুলে আনি। কোনোদিন আর আনা হয় নি।

টুনি বললো, আজ আমার ইচ্ছে হলো–।

বাধা দিয়ে বাবু বললো, তাই আমরা সবাই তুলে আনলাম।

নেলী খালা হেসে বললেন, থাক, এখন আর ঝগড়া করতে হবে না। আমাদের দুজন গেস্ট এসেছে।

টুনি বললো, লরেল হার্ডি তো? ওদের তো আমরাই পাঠালাম।

নেলী খালার চোখ দুটো গোল হয়ে গেলো–লরেল হার্ডি কোথায় পেলে। মিষ্টার ফতেউল্লা আর শ্রী গোবর্ধন নিয়োগী এসেছেন। চাটগাঁয়ে শুঁটকির কারবার আছে। যাবেন সেন্ট মার্টিনসে। এই এলাকায় সুবিধে মতো শুঁটকি পাওয়া যায় কিনা দেখবেন। যাও, বেশি হৈচৈ কোরো না। তোমাদের ঠিক নিচের ঘর দুটোই ওঁরা নিয়েছেন।

ললি বললো, ওগুলো যে সাজানো হয় নি নেলী খালা!

নেলী খালা কাঁধ ঝাঁকালেন–বলেছিলাম দোতালায় যে কোনো ঘরে থাকতে। ওঁরা রাজি হলেন না। বললেন, সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করতে নাকি কষ্ট হয়। শ্রী গোবর্ধনের হাঁপানির রোগ আছে। তাই বড়িবি আর বাথিন মিলে তাড়াহুড়ো করে রুম দুটো কোনো রকমে গুছিয়ে দিয়েছে। ঘরে বেশি দাপাদাপি কোরো না। কাঠের মেঝেতে শব্দ হয় খুব।

আমরা কি কচি খোকা যে দাপাদাপি করবো? নেলী খালা যেন কথা আর খুঁজে পেলেন না। বোঝা গেলো প্রথম গেস্ট পেয়ে নেলী খালা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। আমরা চার জন একে অপরের দিকে তাকালাম। তারপর পা টিপে টিপে দোতালায় উঠলাম। ললি টুনিকে বললাম, খাবার পাটটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলে আমরা আবার কনফারেন্সে বসবো। জরুরি কথা আছে।

টুনি বললো, খবরদার, কোনো ভূতের গপ্পো শোনাতে পারবে না।

বাবু বললো, তুমি তাহলে একলা ও-ঘরে থাকতে পারো। আমরা ললিকে নিয়েই প্ল্যান করবো।

টুনি এগিয়ে এসে বাবুর পিঠে নরোম একটা কিল মেরে আদুরে গলায় বললো, আমাকে ভয় দেখালে ভালো হবে না বলছি।

বাবু বললো, আমরা কি বলেছি তোমাকে ভয় দেখাবো?

বাবু টুনির মিষ্টি ঝগড়াগুলো আমার আর ললির কাছে বেশ মজাই লাগলো। ললি বললো, আমরা কি গেস্টদের সঙ্গে খাবো?

আমি বললাম, আমরা থাকলে কি লরেল হার্ডির খাওয়ার অসুবিধে হবে?

ললি হেসে বললো, আমরা থাকলে হবে না। স্ক্যাটরা থাকলে হবে।

অসুবিধেটা খাবার টেবিলে আমরা সবাই রীতিমতো উপভোগ করলাম। নেলী খালা চীনে হাঁসের রোস্ট করেছিলেন। লিকপিকে শ্রী গোবর্ধন এতো প্রশংসা করছিলো যে নেলী খালা বার বার লাল হয়ে শুধু ধন্যবাদ, কী যে বলেন বলছিলেন। আর শ্রী গোবর্ধনও এক টুকরো মাংস গিলেই মাইরি বলছি দিদি, এমন ফাস্টো কেলাস রান্না আমার বাপের জন্মে খাই নি–এসব বলছিলো।

শ্রী গোবর্ধনের প্রশংসার বহর দেখে বাবু আর প্রশংসা করার সুযোগ পেলো না। অবশ্য প্রশংসা না করলেও আমি ওকে খাবার ঠিকই তুলে দিচ্ছিলাম। এমন সময় হেলেদুলে স্ক্যাটরা এসে নতুন মানুষদের একটু শুঁকে দেখবার জন্যে ওদের দিকে এগিয়ে গেলো। শ্রী গোবর্ধনের মুখে তখন হাঁসের একখানা আস্ত বুকের মাংস। স্ক্যাটরাকে দেখে ওই অবস্থাতেই তার চোখ দুটো আলুর মতো গোল হয়ে কপালে উঠে গেলো। শুধু আঁ আঁ করতে লাগলো। নেলী খালা তখনো স্ক্যাটরাকে দেখেন নি। অবাক হয়ে শ্রী গোবর্ধনকে দেখছিলেন। শ্রী গোবর্ধন হাত নাচিয়ে কোনো রকমে মুখ কালো করে বললো, দিদি–!

বলার সঙ্গে সঙ্গে মাংসের টুকরোটা মিস্টার ফতের কোলের উপর ছিটকে পড়লো। আর স্ক্যাটরা এগিয়ে এসে আড়চোখে এক বার নেলী খালাকে দেখে মিস্টার ফতের কোল থেকে মাংসের টুকরোটা তুলে নিলো।

শ্রী গোবর্ধন ততোক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। নেলী খালা গম্ভীর হয়ে বললেন, শরীর খারাপ করেছে? বাথরুমে যাবেন?

বেরসিক লোকটার কাণ্ডকারখানা দেখে স্ক্যাটরা ততোক্ষণে ধমক খাবার ভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। শ্রী গোবর্ধন লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে ধপ করে বসে পড়ে বললো, জল।

নেলী খালা তাড়াতাড়ি পানি ভর্তি জগটা এগিয়ে দিলেন। শ্রী গোবর্ধন পানিটা গ্লাসে না ঢেলে জগের মুখেই খেতে শুরু করলো। সবাই প্রাণপণে হাসি চাপলেও টুনিটা ফিক করে হেসে ফেললো। নেলী খালা শুধু গম্ভীর মুখে একবার টুনির দিকে তাকালেন। টুনি সঙ্গে সঙ্গে চুপ।

ঢকঢক করে জগের আদ্ধেক খালি করে সে হাঁপাতে লাগলো। নেলী খালা বললেন, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?

হাঁপাতে হাঁপাতে শ্রী গোবর্ধন বললো, কালো কুত্তোটা। এই ছোঁড়াদের সঙ্গে সেই যে সন্ধেবেলা দেখেছিলাম।

নেলী খালা পেছনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না। শ্রী গোবর্ধন বললো, আরেকটু হলেই প্রাণ-পাখিটা বেরিয়ে যেতো। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এই প্রাণীটাকে

আমি দু চোখে দেখতে পারি না।

নেলী খালা বললেন, কোথায় দেখলেন?

শ্রী গোবর্ধন তেমনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, চলে গেছে।

মিস্টার ফতেকে দেখলাম মহা বিরক্ত হয়ে কটমট করে শ্রী গোবর্ধনের দিকে তাকালো। শ্রী গোবর্ধনের সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। তখন আমি পষ্ট করে ছাড়বে না।তের কথাগুলো ডেকে বললেন

শুনতে পেলাম, মিষ্টার ফতে বিড়বিড় করে বলছে, ওস্তাদ যে কেন এমন কাজে এসব ভীতুর ডিমগুলোকে সঙ্গে দেয়, বুঝি না। গোবরটা দেখছি একটা কেলেঙ্কারি না করে ছাড়বে না।

অন্য কেউ অবশ্য মিস্টার ফতের কথাগুলো খেয়াল করে নি। সবাই শ্রী গোবর্ধনকে দেখছিলো। নেলী খালা তখন বড়িবিকে ডেকে বললেন, খাবার সময় স্ক্যাটরাকে কেন এদিকে আসতে দিয়েছো? এই বলে শ্রী গোবর্ধনের দিকে তাকালেন–ওটা আমার কুকুর স্ক্যাটরা। ভয় পাবার কিছু নেই।

কি ক্যাটরা? শ্রী গোবর্ধনের কথার ভঙ্গিতে হাসি চাপা দায় হলো।

স্ক্যাটরা। নেলী খালা বললেন, বড়ো ভালো কুকুর।

শ্রী গোবর্ধন ততোক্ষণে খাবারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। প্লেট থেকে আরেকখানা মাংস তুলে নিতে নিতে বললো, কুত্তো যে কখনো ভালো হয়, আপনার কাছে এই প্রথম শুনলাম।

কথাটা নেলী খালার পছন্দ হলো না। তিনি গম্ভীর মুখে খেতে লাগলেন। মিস্টার ফতে আরেক বার কটমট করে শ্রী গোবর্ধনের দিকে তাকালো। ভাগ্যিস নানু আমাদের আগেই খেয়ে নিয়েছিলেন। নইলে নেলী খালার গেস্টদের এ ধরনের ব্যবহার যে তিনি বিন্দুমাত্র পছন্দ করতেন না, এ কথা হলপ করে বলা যায়। এর পর খাবার পর্বটুকু নির্বিঘ্নেই শেষ হলো। আমরা সবাই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলাম।

নানু স্টাডিতে বসে বই পড়ছেন। একটু পরে দুধ খেয়ে ঘুমোতে যাবেন। নেলী খালাও আর দোতালায় উঠবেন না। আমরা নিশ্চিন্ত মনে আলোচনায় বসলাম।

প্রথমেই ওদের সন্ধেবেলা দেখা সেই ঘটনাটা খুলে বললাম। আলো জ্বলে নিভে যাওয়া থেকে শুরু করে মানুষ না কি যেন তার বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছু শুনতে শুনতে টুনি একেবারে বাবুর গা ঘেঁষে বসেছে। বাবু বললো, টুনি সরে বসো। তোমার চুল আমার ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

আমি বললাম, এই লোক দুটোকে তোমাদের কী মনে হয়? মিস্টার ফতেউল্লা আর শ্রী গোবর্ধন নিয়োগীকে?

টুনি বললো, বেশ মজার লোক। লরেল খাবার টেবিলে যা করলো–বলে ও একচোট হেসে নিলো, নেলী খালার ধমকের ভয়ে তখন যে হাসিটুকু এতোক্ষণ চেপে রেখেছিলো।

আমি তখন ফতের বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো ওদের বললাম। শ্রী গোবর্ধনকে ফতে গোবর বলেছে শুনে টুনি আবার হেসে উঠলো। ললি তখন টুনিকে ধমকে দিলো–হেসো না টুনি, এটা হাসির কথা নয়।

বাবু বললো, তোমার কী মনে হয়?

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, শুঁটকির ব্যবসায়ীদের যে সাহসী হতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। ফতের কথাগুলো লক্ষ করো। ও বলেছে, ওস্তাদ কেন যে এমন কাজে–কথা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কখনো ওস্তাদ থাকে বলে আমার জানা নেই। মালিক মহাজন থাকতে পারে। কিন্তু ওস্তাদ কথাটা আমি বইয়ে পড়েছি চোর-ডাকাতের দলের লোকেরাই বলে। আর এমন কাজ মানেটা কী? তাছাড়া কুকুরকে এরকম ভয় পেতে আমি কোনো ভালো লোককে কখনো দেখি নি। চোর-ডাকাতেরাই কুকুর ভয় পায়। এই ভয় চেপে রাখতে পারে নি বলেই ফতে বলেছে, গোবরটা দেখছি কেলেঙ্কারি না করে ছাড়বে না।

তাই তো! বেশ চিন্তিত গলায় বাবু বললো, লোকগুলোকে তো সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না। পাহাড়ের ওটা না হয় কাল সকালে গিয়ে দেখা যাবে। কিন্তু এ দুটো কে?

ললি বললো, আমাদের সাবধানে থাকা উচিত।

বাবু বললো, ডাকাত দলের কেউ নয় তো? রাতে ডাকাতি করে পালিয়ে যাবে?

আমি বললাম, রাতে কিছু করতে পারবে না, স্ক্যাটরা আছে।

ললি বললো, ওদের ওপর নজর রাখতে হবে।

টুনি হাই তুলে বললো, আমার ঘুম পাচ্ছে।

বাবু বললো, ঠিক আছে। চলো, তোমাদের ঘরে পৌঁছে দিই। ছিটকিনিটা লাগাতে ভুলো না যেন।

কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে সারাদিনের ব্যস্ততার কথা ভাবতে ভাবতে আমরা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।