রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

২২. দুর্যোগের মেঘ

দুর্যোগের মেঘ

ফটিকচাঁদ ভয়ে ভয়ে সত্যি কথাই বললে।

বললে, কিশোরীমোহন আর জগন্নাথই তাকে এখানে সুধীর সাজিয়ে এনেছে। তাদের সঙ্গে কথা ছিল যতদিন না সত্যিকারের পরিচয়টা তার প্রকাশ হয়ে পড়ে—মধ্যে মধ্যে যা পারে হাতিয়ে দেবে তাদের এখান থেকে।

হুঁ-আজ পর্যন্ত কত দিয়েছে?

তা হাজার তিন-চার টাকা ও গহনায় হবে।

শশাঙ্কমোহন ফটিকচাঁদকে আর ঘটালেন না।

তবে থানায় অশোকের হেফাজতে পাঠিয়ে দিলেন।

 

পানু নিজেই পর দিন যেচে এসে শ্ৰীলেখার সঙ্গে ভাব করলে। শ্ৰীলেখা নিজের ঘরে একটা উলের কী বুনছিল। পানুকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে ও মুখ তুলে চাইল।

তোমার নামই বুঝি শ্ৰীলেখা? পানু জিজ্ঞাসা করল।

হ্যাঁ–

বেশ নামটি তোমার। তুমি তো বয়সে আমার সমানই। বড় ইচ্ছা ছিল মনে মনে একটি বোনের। ভাই ফোটার দিনটা এমন বিশ্ৰী লাগত। দাদার তো এই বোন না থাকার জন্য অভিযোগের অন্ত ছিল না।

দাদা কে? শ্ৰীলেখা জিজ্ঞাসা করল।

পানু সুনীলের সব কথা তখন শ্ৰীলেখার কাছে আগাগোড়া বললে, শেষের দিকে তার চোখে জল এসে গেল এবং চেয়ে দেখলে শ্ৰীলেখার চোখেও জল। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনার খুব ভাব হয়ে গেল।

 

পাথুরিয়াঘাটার একটা এঁদো গলির মধ্যে বহুদিনকার একটা পুরাতন বাড়ি।

তারই একটা স্বপ্নালোকিত ঘরে বসে কয়েকজন লোক কী সব গোপন পরামর্শে রত। ঘরের এক কোণে একটা ভাঙা হ্যারিকেন। আলোর চাইতে ধূমোগ্‌দীরণই হচ্ছে বেশী।

চুনবালি খসা চিত্ৰ বিচিত্র দেওয়ালের গায়ে হ্যারিকেনের ক্ষীণ অস্পষ্ট আলোর ছায়া কী এক ভৌতিক বিভীষিকায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। বাইরে যেন দরজার গায়ে শব্দ হলো খট্‌খট্‌। একজন উঠে দরজাটা খুলে দিল।

খোলা দরজা দিয়ে ভিক্ষুকবেশী কে একটা লোক ঘরে এসে প্রবেশ করল। লোকটার পরণে এক শতছিন্ন ময়লা নোংরা ধূতি। মাথার চুলগুলি রূক্ষ্ম এলোমেলো। একটা চোখ ন্যাকড়া দিয়ে বাঁধা। পায়েও একটা পট্টি জড়ান।

দলের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি খবর সর্দার?

খবর ভাল, লোকটা চাপা গলায় বললে। তারপর মাথায় পরচুলটা খুলতে খুলতে দলের একজনকে বললে, আলোটা একবার এদিকে নিয়ে আয়ত সোনা।

একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ায় বাঁধা কী একটা বস্তু লোকটা গিঁট খুলে বের করতে লাগল।

এক টুকরো কাগজ। তাতে কয়টি কথা লেখা। সকলে লেখাটার দিকে ঝুঁকে পড়ল।

সর্দার তাড়াতাড়ি কাগজটা সকলের চোখের দৃষ্টি থেকে সরিয়ে নিল, কি দেখছিস সব হাঁ করে? যা ভাগ।

বলে সর্দার কাগজটা ভাঁজ করে ট্যাকে গুঁজে রাখল।

তারপর কিছুক্ষণ ধরে সকলে মিলে কি সব পরামর্শ করল। রাত্রি যখন দেড়টা তখন সকলে একে একে বিদায় নিল। শুধু সর্দার গেল না। শরীরটা আজ তার বড় ক্লান্ত। সারা সকাল দুপুর যা দৌড় ঝাঁপ গেছে।

সর্দার দরজাটায় খিল তুলে দিয়ে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ল।

রাত্রি তখন অনেক গভীর। বিশ্ব চরাচর নিস্তব্ধ নিঝুম।

দরজায় গায়ে শব্দ শোনা গেল, টক্‌টক।

সর্দারের ঘুমটা ভেঙে গেল, কে? সর্দার গভীর গলায় প্রশ্ন করলে।

উত্তর এল চাপা গলায়, সর্দার, সোনা।

সর্দার উঠে দরজাটা খুলে দিল, এতরাত্রে কি খবর?

সোনা টলতে টলতে মাটির উপর শুয়ে পড়ল।

বড্ড ঘুম পেয়েছে সর্দার, পথেই ছিলাম, বাড়ি যাইনি। বড় সর্দি লেগেছে। কোন মতে কথাটা জড়িয়ে বলে সোনা চুপ করলে।

সর্দার ও আর বাক্য ব্যয় না করে আবার শুয়ে পড়ল এবং দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে নাক ডাকতে শুরু করে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *