রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

০৪. অদ্ভুত চিঠি

অদ্ভুত চিঠি

দিন দুই পরের কথা।

দুপুরের দিকে কিরীটী তার শয়ন ঘরে চুপচাপ বসে আছে।

দুআঙ্গুলের ফাকে ধরা একটা জ্বলন্ত সিগ্রেট।

জংলী এসে ঘরে ঢুকলো, বাবু একটা চিঠি।

জংলী, এককাপ চা আন তো। কিরীটী চিঠিটা হাতে নিতে নিতে বলে।

জংলী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। চিঠিখনি উল্টে পাল্টে কিরীটী দেখতে লাগল। চিঠির উপরে ছাপা বড়বাজার পোস্ট অফিসের।

সযতনে খাম ছিঁড়ে কিরীটী চিঠিটা টেনে বের করলে।

চিঠিটা ইংরাজীতে টাইপ করা। চিঠিটা পড়তে পড়তে ঘন অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা আশার আলোর হঠাৎ ঝালকানি দেখতে পায়।

একবার দুবার তিনবার চিঠিটা পড়ল, তারপর প্রসন্ন মনে, চিঠিটা সযতনে পকেটে ভাঁজ করে রেখে কিরীটী চিন্তা সাগরে ডুব দিল।

জংলী এসে চা দিয়ে গেল, কোন খেয়াল নেই। হাতের সিগ্রেটটা শুধু মুখের কাছে তুলে নিয়ে মাঝে মাঝে টান দিচ্ছে।।

সুব্রত এসে ঘরে প্রবেশ করল। কি একটা বলতে গিয়ে সহসা কিরীটীর দিকে নজর পড়তেই চুপ করে গেল। সে জানত কিরীটী যখন চিন্তা করে তখন হাজার ডাকলেও সাড়া পাওয়া যায় না, অতএব সে একটা সোফায় বসে সেদিনকার দৈনিকটায় মন দিল।

একসময় কিরীটীরই খেয়াল হতে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সুব্রত—কতক্ষণ–

অনেকক্ষণ-তারপর শ্ৰীপুর হত্যা রহস্যের কোন আলোক সম্পাত হলো—

আলোক সম্পাত?

হ্যাঁ–

না-তেমন কিছু না, তবে একটা চিঠি পেয়েছি কিছুক্ষণ পূর্বে।

চিঠি!

হ্যাঁ।

সুব্রত প্রশ্ন করে, কার চিঠি?—

শোন–

কিরীটী পকেট থেকে চিঠিটা বের করে খুলে পড়তে লাগলো-ইংরাজীতে লেখা, তবে চিঠিটার বাংলা তর্জমা করলে এই দাঁড়ায়।–

প্রিয় কিরীটীবাবু

শুনলাম। আপনি শ্ৰীপুরের চৌধুরী বাড়ির পুরানো ভৃত্য করালীর হত্যা রহস্যের মীমাংসার ভার নিয়েছেন। সেই কারণেই কর্তব্য বোধে আপনাকে কয়েকটা প্রয়োজনীয় কথা জানাতে চাই ঐ চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কে। অর্থাৎ এই চৌধুরী পরিবার সম্বন্ধে।

জমিদার অনঙ্গমোহন চৌধুরীর একমাত্র পুত্র হচ্ছে শ্ৰীপুরের বর্তমান জমিদার শশাঙ্কমোহন চৌধুরী। অনঙ্গ চৌধুরীর জীবিতকালে তার পুত্র শশাঙ্কমোহনের কোন সন্তান হয়নি—যাই হোক অনঙ্গ চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার উইলে দেখা গেল।–লেখা আছে-তাঁর মৃত্যুর পর মানে অনঙ্গ চৌধুরীর মৃত্যুর পর যদি শশাঙ্কমোহনের ছেলে হয় তবে তার সমস্ত সম্পত্তি সেই ছেলে পাবে। আর ছেলে না হয়ে যদি মেয়ে হয় তবে তার মৃত্যুর পর অর্ধেক সম্পত্তি পাবে সেই মেয়ে আর বাকী অৰ্দ্ধেক পাবে তার খুল্লতাত পুত্ৰ মৃগাঙ্কমোহন বা ঐ মৃগাঙ্কমোহনের পুত্র বা তাঁর পরবর্তী ওয়ারিশগণ। সে আজ ১৮ বছর আগের কথা।

তারপর সবাই জানল অনঙ্গমোহনের মৃত্যুর দু-বছর পরে শশাঙ্কমোহনের একটি কন্যা সন্তান জন্মাল অর্থাৎ ঐ শ্ৰীলেখা। কিন্তু আমি জানি আসল সত্য তা নয়, শশাঙ্কমোহনের ছেলেই একটি জন্মেছিল আজ থেকে ষোল বছর আগে এক দুর্যোগের রাত্রে এবং আতুড় ঘরেই শশাঙ্কমোহনের নবজাত পুত্ৰ চুরি যায়। এবং যারা চুরি করে তারাই সেই ছেলের বদলে মেয়েকে রেখে যায়। আপনার কাছে আমার এই অনুরোধ যে, সেই চুরি যাওয়া ছেলেকে আপনার খুঁজে বের করে দিতে হবে এবং যদি বের করে দিতে পারেন বা বর্তমানে সে কোথায় আছে সে সন্ধানটুকুও এনে দিতে পারেন তাহলে আপনাকে নগদ দশ হাজার টাকা দেবো। আপনি যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত থাকেন তাহলে দয়া করে আপনার বাড়ির দরজায় ‘হ্যা’ অক্ষরটি খড়ি দিয়ে লিখে রাখবেন এবং আমি আপনাকে পরদিনই পারিশ্রমিকের পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম পাঠিয়ে দেবো। বাকী কাৰ্য উদ্ধারের পর পাবেন।

একটা কথা-জন্মের সময় শিশুর ডান ত্রুর ঠিক উপরেই একটা লাল জরুল (১ ইঞ্চি পরিমাণ) ছিল।

আমি কে, তার পরিচয় আপনাকে আমি দিতে চাইনা। শুধু জেনে রাখুন আমি চৌধুরীদের একজন পরম শুভাকাঙ্খী–বর্তমানে কোন কারণে পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক। নমস্কার,

ইতি অপরিচিত।

চিঠিটা পড়ে শেষ করল কিরীটী।

আশ্চর্য তো! সুব্রত বলে।

এখন দেখছিস করালীর হত্যা ব্যাপার যতখানি সহজ ভেবেছিলাম আসলে ঠিক ততখানি নয়। মানে অগাধ জল। কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।

চিঠিটার ওপরে পোস্ট অফিসের ছাপটা কোথাকার?

সুব্রতর প্রশ্নের জবাবে কিরীটী বলে, আছে অবিশ্যি একটা পোস্ট অফিসের ছাপ কিন্তু তাতে তার কোন মুশকিল আশান হবে না–

কেন?

কারণ যে আতখানি সতর্কতা অবলম্বন করতে পেরেছে, ওটুকু বুদ্ধি তার কাছে থেকে আমি আশা করি।

তারপর একটু থেমে বলে, চিঠিতে বড়বাজার পোস্ট অফিসের ছাপ রয়েছে—কিন্তু অপরিচিত বন্ধু আমার যত চালাকিই খেলুন গলদ একটু বেরিয়ে পড়েছে। তবে তার জন্য তাকে দোষ দিই না। মানুষ সব সইতে পারে, পারে না শুধু সইতে নিজের স্বার্থে আঘাত। তখন তার হিতাহিত জ্ঞানটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়ে যায় এমন দৃষ্টান্তেরও এ-দুনিয়ায় অভাব নেই।

সুব্রত এবারে প্রশ্ন করে, কে ঐ চিঠিটা লিখেছে বলে তোর মনে হয় কিরীটী?

নিঃসন্দেহে কোন interested party অর্থাৎ যার এ ব্যাপারে স্বার্থ রয়েছে। এবং সে হয়ত স্বার্থ থাকলেও কোন কারণে সামনা সামনি এসে আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু সে যাই হোক-করালীচরণের ব্যাপারটা যে হত্যাই সেটাও যেমন এখন সুনিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে তেমনি সেই হত্যার মূলে একটা গভীর রহস্যও আছে বলে মনে হচ্ছে।

তা হলে?

তঃপর কিরীটী সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললে, ব্যাপারটা একটু বেশী রকম প্যাচ খেয়ে গেল আর সেই প্যাচ খুলতে একটু বেগ পেতে হবে। তা হোক, তার জন্য আমি ভয় পাইনা। আপাততঃ অপরিচিত বন্ধুটির কথাই সত্যি বলে মেনে নিয়ে আমরা কাজে অগ্রসর হবো।

কিভাবে শুরু করবি ভাবছিস? কালই জলে নেমে প্রথম ডুব দেবো। দেখি কতদূর কি হ’ল?

সুব্রত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, কোথাকার জলে? সাগরের, না গঙ্গার?

কিরীটী হেসে ফেললে, না ভাই সাগরের জলে ডুব দিতে সাহস নেই। শোনা যায়। তার নাকি তল নেই। আর মা গঙ্গা? অতি পুণ্য কি আর আমার মত পাপীর সইবে? তার চাইতে দেখি শ্ৰীপুরের এঁদো পুকুরে একটা ডুব দিয়ে। ধনরত্ন না মিলুক দু’চারটে শামুক বা গুগলি-ও তো হাতে ঠেকতে পারে।

দেখিস, শেষে কাদা ঘটাই যেন না। সারা হয়।

দেখি।

ইতিমধ্যে মৃগাঙ্কমোহনের তার পেয়ে জমিদার শশাঙ্ক চৌধুরী শিলং থেকে শ্ৰীপুরে ফিরে এসেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *