হেমন্তের সাপ

হেমন্তের সাপ

হেমলতাদি আমাদের নেমন্তন্ন করেছিলেন। কয়েক জনকে। সাধারণ নিমন্ত্রণ। এ রকম উনি মাঝে সাঝেই করে থাকেন। কখনো আমাদের, কখনো অন্যদের। আমরা যে যার মতন তাঁর ফুলকুঠিয়ার বাড়িতে গিয়ে জড় হয়েছিলাম। জায়গাটা নিরিবিলি মাঠের পর মাঠ, এখানে ওখানে ঝোপ-ঝাড়। দু পাঁচটা অর্জুন আর বটগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের দিকে। নিরিবিলি এই জায়গায় বাংলো ছাঁচের এক বাড়ি খাড়া করেছিলেন সারখেলসাহেব। বাগান সাজিয়েছিলেন বাড়ির চারদিক ঘিরে। বাড়ি আর বাগান নিয়ে ওঁদের দিন কেটে যাচ্ছিল। ওঁদের মানে, সারখেলসাহেব আর হেমলতাদির। বাড়িতে এই দুটি মানুষ ছাড়া ছিল কাজকর্মের লোক, মালী, আর বুড়ো ড্রাইভার মল্লিক। হেমলতাদির মেয়ে জামাই বিদেশে। কারডিফে। জামাই এঞ্জিনিয়র, মেয়ে ডাক্তার। শুনেছি বাচ্চা-কাচ্চাদের মনের গড়ন-পেটন নিয়ে তার ডাক্তারি। একটি ছেলে ছিল হেমলতাদিদের; সে আর নেই। বছর ছাব্বিশ বয়েসে জিপ উলটে মারা গিয়েছে। আর্মিতে ছিল বেচারি। ছেলেকে হারাবার পর বছর খানেক থম্ মেরে ছিলেন সারখেলরা। শোক আঘাত সামলে আবার যখন পাঁচ জনের মধ্যে ভেসে উঠলেন তখন সারখেলসাহেবের চাকরি ফুরোতে আর দেরি ছিল না। ফুলকুঠিয়ার দিকে বরাবরই নজর ছিল ওঁর। জমি কিনে নিজের ছকে বাড়ি বানাতে বসলেন সারখেলসাহেব। চাকরিও ফুরোলো, বাড়িও শেষ হল।

আমরা জানি, হেমলতাদিরা এখন এতই নিঃসঙ্গ যে, আমাদের মতন চেনাশোনাদের মাঝে মাঝে বাড়িতে পাবার জন্যে ডেকে পাঠান। নেমন্তন্ন উপলক্ষ মাত্র। তার মানে এই নয়, আগে আমাদের ডাক পড়ত না। বরং আগে ডাকাডাকি বেশি ছিল। সে সময় আমরা অনেকেই কাছাকাছি থাকতাম, দু-চার মাইলের মধ্যে; কেউ কোলিয়ারিতে, কেউ কারখানায়। খাওয়া-দাওয়া, গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা তখন বেশিই হত। এখন আমরা ছিটকে ছটকে রয়েছি। ফুলকুঠিয়া দূরই হয়। তবু ডাক পেলে না গিয়ে পারি না। ওঁদের জন্যে আমাদের মনে কেমন এক বেদনা রয়েছে।

নেমন্তন্নটা ছিল শনিবারে। সন্ধেবেলায়। শনিবারটাই সকলের পছন্দ। আমরা ছ’ সাতজন ছিলাম। রবিদা আর তার স্ত্রী মাধবীবউদি; শশধর বাগচি; বেণুপ্রসাদ বলে আমাদের এক বন্ধু; আর আদিত্য। আদিত্য সস্ত্রীক এসেছিল। তার স্ত্রীর নাম রোহিণী। রোহিণী নামটার চল ছিল না আমাদের মধ্যে। তার ডাকনাম ডালিমটাই সকলের মুখে মুখে ঘুরত।

রবিদা ছিল কারখানার লোক। লোহা কারখানার। থাকত মাইল সাতেক দূরে। বুকে একবার ধাক্কা খাওয়ার পর সাবধান হয়ে গিয়েছিল; মাধবীবউদিকে বাদ দিয়ে কোনো সামাজিকতা সারতে যেত না। শশধর বাগচির ছিল এক ক্লে মাইনসের মালিকানা। ব্যবসায় ডুবে হাঁসফাস করত, লোকসানে লোকসানে তার মাথার চুল গিয়েছিল পেকে। সে থাকত শহরে, তার পৈতৃক বাড়িতে। বেণুপ্রসাদ পাটনার লোক, আসল নাম বেণীপ্রসাদ—তার আস্তানা ছিল টিয়াটুকরি কোলিয়ারিতে। কয়লার গুঁড়ো তার ফুসফুসকে কাহিল করে দিয়েছিল। ব্রংকাইটিসে ভুগত; হাঁপানিতে ধরেছিল তাকে। বলত, আই অ্যাম ভেরি ম্যাচ অ্যাফ্রেড অফ মাই ব্ল্যাক চেষ্ট। সেটা যে কী জিনিস আমরা বুঝতাম না।

আদিত্য সান্যাল ছিল তাদের আর জি (কেবলস্) কারখানার সিকিউরিটির মাথা। তাকে খানিক ছোটাছুটি করতে হত। কম্পানির দুটো কারখানা দু জায়গায়। দু তরফই দেখতে হত তাকে। তবে বছরের মধ্যে ন’মাস অফিসঘরে বসেই তার দিন কেটে যেত দেখেছি। কথাটা বললে আদিত্য চটে যেত। বলত, একবার চেয়ারে গিয়ে বসো না; বুঝবে ঠেলা।

হেমলতাদির বাড়িতে আমাদের জমায়েত হতে হতে সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। মাসটা কার্তিকের শেষ, হালকা ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। সারখেলসাহেব তাস নিয়ে বসে পড়লেন। বেণুর সঙ্গে তাঁর জমে ভাল। আদিত্য আর শশধর বসল পার্টনার হয়ে। আমি দর্শক। কাগুজে রাজনীতির ভাষ্যকার হয়ে রবিদা দেশের হালচাল বর্ণনা করতে লাগল।

হেমলতাদির নেমন্তন্নয় কোনো ঘটা থাকে না। তিনি পাকা রাঁধুনি বলে পরিমিত খাদ্য অতি উপাদেয় করে সামনে এগিয়ে দিতে পারেন। আমরা তাঁর হাতের গুণগান এতই গেয়েছি যে, নতুন করে বলার মতন আর কিছু খুঁজে পেতাম না।

ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজলো কি হেমলতাদি আমাদের খাবার টেবিলে ডাকলেন। টেবিলে আমরা বড় সময় নিই। যত কথা, গল্প, হাসি-তামাসা সবই যেন টেবিলে তুফান বইয়ে দেয়। খেতে বসে সারখেলসাহেব হেমলতাদির গল্প বলছিলেন। বাচ্চাকাচ্চারা যেমন নাকে পেনসিল, কানে সেফটিপিন গুঁজে দেয়—দিয়ে চেঁচায়, হেমলতাদিও নাকি সেদিন সেইরকম কানে উলের কাঁটা গুঁজে ডাক ছেড়ে কেঁদেছেন।

আমরা হাসাহাসি করছিলাম। হেমলতাদি মাধবীবউদিকে বোঝাচ্ছিলেন—“উলের কাঁটা নয় গো, চুলের কাঁটা। আজকাল সব প্লাস্টিকের কাঁটা হয়েছে না চুলে গোঁজার, সেই কাঁটা। আমার দু-চারটে পড়ে থাকে। কখনো মাথায় দি এক আধটা, কখনো কান চুলকোই। তোমাদের সারখেলসাহেব কানকে ধান করেন।”

এমন সময় বাইরে গাড়ি এসে থামার শব্দ হল। হর্ন বাজল।

হর্ন শুনেই আদিত্য বলল, “আমার অফিসের জিপ মনে হচ্ছে। তোমরা বসো, আমি দেখছি।”

আদিত্য খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাচ্ছিল, মল্লিক এসে দাঁড়াল—বলল, সান্যালসাহেবের অফিস থেকে লোক এসেছে।”

বেণুপ্ৰসাদ বলল, “সান্যাল, এগেইন দ্যাট নিমিয়াপুর? দোজ মাফিয়াজ?”

“গড নোজ!” আদিত্য তাড়াতাড়ি বেসিনে হাত ধুয়ে বাইরে চলে গেল।

আমরা খাওয়া শুরু করলাম। খানিকটা খাপছাড়াভাবে। অফিস থেকে জিপ নিয়ে ছুটে এসেছে যখন—তখন ব্যাপারটা জরুরি। আদিত্যকে না ছুটতে হয় এক্ষুনি। ওর আর খাওয়া শেষ হল না। হেমলতাদি গজগজ করতে লাগলেন।

একটু পরেই আদিত্য হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এল। বলল, “আমি যাচ্ছি। বেনিয়াডিহি যেতে হবে। কী ব্যাপার ভাল বুঝতে পারলাম না। সিং একলা এসেছে। সারখেলদা, আমি জিপেই চলে যাচ্ছি।” বলে রোহিণী—মানে ডালিমের দিকে তাকাল। “তুমি—তোমাকে কে পৌঁছে দেবে?” আমার দিকেই চোখ ফেরাল, “এই গগন, তুমি তো আমার লেজুড় হতে। তুমিই ওকে পৌঁছে দিও। চাবি রেখে যাচ্ছি।” বলে পকেট থেকে গাড়ির চাবি বার করে টেবিলের একপাশে রেখে দিল। “চলি হেমলতাদি, চলি রবিদা। চলি হে! …এই চাকরি কোনো ভদ্রলোকের নয়। ডালিম, তোমার ঘরের চাবিটাবি সব তোমার কাছে। আমার কাছে কিছু নেই।” আদিত্য টেবিল থেকে গ্লাস উঠিয়ে এক চুমুকে পুরো জলটাই খেয়ে নিল। তারপর আমায় বলল, “একটু সাবধানে চালিয়ো, আসবার সময় দেখলাম ব্রেকটা কম ধরছে। ভয়ের কিছু নেই। জাস্ট বলে দিলাম।”

আদিত্য চলে গেল।

আমরা এক একজন এক একদিকে থাকি। একই জায়গায় অল্পবিস্তর কাছাকাছি আর থাকি না। আগে অনেকেই অনেকটা পাশাপাশি ছিলাম। এখন নয়। রবিদা থাকে মাইল চারেক তফাতে। তাকে যেতে হবে পুবদিকে। রবিদার গাড়ি আছে। কিন্তু তার গাড়ি ডালিমের কাজে লাগবে না। বেণু এসেছে শশধরের সঙ্গে। শশধর মোটর বাইক নিয়েই বেশির ভাগ সময় ঘোরাফেরা করে। বেণু তার পেছন ধরে এসেছে। ফেরার সময়ও একই সঙ্গে ফিরবে। শহরে পৌঁছে বেণু হয় ট্যাক্সি না হয় অটো রিকশা নেবে। তা ছাড়া তাদের রাস্তা আমাদের রাস্তা নয়। ওদের হল উত্তর দিক। আমি আর আদিত্য একই দিকে থাকি। আদিত্য যেখানে থাকে সেখান থেকে মাইল দুই তফাতে আমি। আসার সময় আমি শর্মার গাড়িতে এসেছিলাম, আমায় রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সে দুর্গাপুরের দিকে চলে গিয়েছে। ফেরার সময় আদিত্যের শরণাপন্ন হতাম। আমার মোটর বাইক হপ্তা দুই হল গোপীমিস্ত্রির সারাইখানায় পড়ে আছে। আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে দিচ্ছে না। মিস্ত্রিদের ধরনই এই।

হেমলতাদি বললেন, “তোমরা বাপু তাড়াহুড়ো কোরো না। এখনও ন’টা বাজেনি। সাড়ে ন’টার মধ্যেই সব বেরিয়ে যেয়ো। শীত সবেই পড়ব-পড়ব করছে। চাঁদের আলো আছে। ভাবনার কিছু নেই।”

আমরা জানতাম, উঠতে উঠতে সোয়া নয় সাড়ে নয় হবে।

দুই

রবিদা চলে গেল সোয়া ন’টা নাগাদ। সামান্য পরে শশধর আর বেণু মোটর বাইক হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আমাদের বেরুতে বেরুতে সাড়ে ন’টা বাজল। এই দেরিটুকু ডালিমের জন্যে। হেমলতাদির সঙ্গে তার কীসব কথা শেষ করে নিচ্ছিল।

আমরা বেরোবার সময় সারখেলসাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাইপে তামাক ঠাসছিলেন, বললেন, “শীত এসে গেল, গগন। গরম কিছু নেবে নাকি?”

মাথা নাড়লাম। আমার জামার তলায় পাতলা গেঞ্জি ছিল উলের। মাফলার ছিল গলায়। এই যথেষ্ট।

ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিলেন হেমলতাদি। বললেন, “দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবে। সাবধানে যেও।…ডালিম, কাল এদিকে যদি কেউ আসে—চোখের অষুধের নামটা লিখে পাঠিয়ে দিবি। …আদিত্য কোথায় ছুটলো কে জানে!”

গাড়িতে উঠে আমি ঠাট্টা করে ডালিমকে বললাম, “মেমসাহেব, তুমি যদি দশটার আগে পৌঁছতে চাও—পৌঁছে দিতে পারি।”

ডালিম বলল, “স্বর্গে, না, নরকে?” হালকা করেই বলল, হাসির গলায়।

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বললাম, “একেই কপাল বলে, বুঝলে। আমি এঁচে রেখেছিলাম এক পেট খেয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে তোমাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরব। কে জানত আমায় ড্রাইভারি করতে হবে।”

“বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ো। এখন ড্রাইভারি করো!”

“যো হুকম মেমসাহেব,” বলে আমি গাড়ির বাতি জ্বালিয়ে এগিয়ে গেলাম। হেমলতাদি তখন আর ফটকের সামনে নেই।

ডালিমকে আমি ঠাট্টা করে অনেক সময় মেমসাহেব বলি। এদিককার কেতায় অফিসার-টফিসাররা সবাই সাহেব, আর তাঁদের স্ত্রীরা মেমসাহেব। আদিত্য যদি সান্যালসাহেব হয়, ডালিম কেন মেমসাহেব হবে না!

তবে ঠাট্টাতামাশা না করেও ডালিমকে হয়ত মেমসাহেব বলা যায়। ডালিমের চেহারার আট আনা, বাংলা মতে, মেম-মেম। মাথায় লম্বা ডালিম, গড়ন ছিপছিপে, গায়ের রঙ মাখনের মতন, ধবধবে সাদা নয়। যদি মুখের গড়ন ধরতে হয়, ডালিমের মুখ লম্বা ধাঁচের, চোয়াল সামান্য ভাঙা, টিকলো নাক, চোখের মণি একটু যেন ছাই রঙের। দাঁতগুলো ধবধবে। সুন্দর।

ডালিম আমাদের ভবানীপুরের মেয়ে। যদিও আমার পাড়ার নয়। ওর বাপের বাড়ি, এলগিন রোডে। ডালিমের বাবা ছিলেন জিওলজিস্ট। মা বায়োকেমিস্ট। দু জনেই বইপত্র ঘেঁটে জীবন কাটাতেন। বাবা মারা যান হার্টের রোগে। মা এখনও রয়েছেন। বয়েস হয়েছে। ডালিমের বয়েসও তো কম হল না। চল্লিশ ছাড়িয়ে এসেছে। তার মেয়ে ঝুমুরের বয়েসেই বছর সতেরো। সে কলকাতায় তার দিদিমার কাছে থাকে। বরাবরই। মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় মা-বাবার কাছে আসে। মুখচোরা, শান্ত মেয়ে। কোথাও যেন সামান্য অস্বাভাবিকতা রয়েছে। মেয়েকে নিয়ে আদিত্য আর ডালিমের মধ্যে এক ধরনের রাগারাগি অশান্তি আছে। আদিত্য চেয়েছিল, মেয়ে হয় তাদের কাছে থাকবে, না হয় আদিত্যর মায়ের কাছে। ডালিম রাজি হয়নি। আদিত্যর মা এখন অবশ্য আর নেই।

গাড়ির আলো আমার চোখে কেমন কমজোরি লাগছিল। ফাঁকা রাস্তা দু’পাশে মাঠ, গাছগাছালি। আলো আরও জোর হওয়া উচিত ছিল।

“আলো এত কম লাগছে কেন?” আমি বললাম।

“কী জানি!”

আদিত্য নিজে গাড়ি চালায়, কিছুই খেয়াল রাখে না?”

“সব রাখে না। দরকারেরটা রাখে,” ডালিম বলল। “তোমায় যে কী বলল। ব্রেক…?”

“কম ধরছে। অসুবিধে হবে না। চলে যাবে কোনোরকমে।” হাতের সিগারেট ফেলে দিলাম। “আদিত্যকে বলো, এ দিককার রাস্তা ঘাটে এ-ভাবে গাড়ি নিয়ে ঘোরাফেরা ভাল না। ক’ দিন আগে কী বিরাট অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে শোনোনি।”

“কানে এসেছিল। ভাল করে শুনিনি?”

“ফায়ার ব্রিক্সের এক চ্যাটার্জি, মোহানির লেভেল ক্রসিংয়ের মুখে একেবারে মুখোমুখি ধাক্কা মেরে দিল। মিস্টার আর মিসেস স্পট ডেড। বড় মেয়েটা হাসপাতালে পড়ে আছে। সিরিয়াস কন্ডিশান। ছোট ছেলেটা বেঁচে গেছে। …শুনলাম, ব্রেক ফেল করে গিয়েছিল। ঠিক কী হয়েছিল জানি না।”

ডালিম প্রথমটায় কিছু বলল না। বোধ হয় ঘটনাটা ভাববার চেষ্টা করছিল। পরে বলল, “দেখো, তুমি যেন ব্রেক ফেল করো না।”

ডালিমকে একবার পলকের জন্যে দেখে নিলাম। হালকা রঙের শাড়ি, গায়ে বুঝি রেশমি চাদর, মেয়েলি; এলোমেলা চুলে কানের অর্ধেকটা ঢাকা পড়েছে।

“পা আমার, কিন্তু গাড়ি তোমাদের, তোমরা কী করে রেখেছ ব্রেকের হাল কেমন করে বলবো,” বলে আমি হাসলাম। “দেখা যাক…।”

ডালিম কোনো কথা বলল না।

মাইলটাক পথ পেরিয়ে এসেছি, কিছু বেশিই হবে।

আমাদের রাস্তা সিধেসিধি নয়। মাইল চার পাঁচ রাস্তা নাক বরাবর ছুটতে হবে। তারপর ডাইনে বাঁয়ে পাক খেতে খেতে এগুতে হবে। এ দিককার রাস্তাঘাট কোনো কালেই ভাল নয়। যদিও কথায় বলে পাকা সড়ক, আসলে সড়কের বারো আনা এবড়োখেবড়ো, গর্তে ভরা। পিচ্ উঠে পাথর বেরিয়ে আছে মাঝে মাঝেই। ওরই মধ্যে এই রাস্তাটুকু মন্দের ভাল; পরের দিকে খুবই খারাপ। রাস্তাও পাকা নয়, মানে পাথর ছড়ানো, পিচ পড়েনি।

গাড়ির আলোয় আমার অসুবিধে হচ্ছিল। চোখে ভাল করে কিছু দেখা যায় না। মেটে হলুদ মতন যে আলোটুকু সামনে পড়েছে—তাতে পঁচিশ তিরিশ ফুটের বেশি বড় কিছু নজরে আসে না।

সাবধানেই যাচ্ছিলাম। রাস্তায় দু পাশে হয় ঢালু জমি না-হয় গাছপালা। চাঁদের আলো পরিষ্কার নয়। কার্তিকের শেষদিকে কুয়াশা নামছে ঘন হয়ে। আশপাশের ধুলোধোঁয়া কোথাও কোথাও মাঠের মাথায় বাতাসে জমে আছে। কোলিয়ারির কাছাকাছি জায়গাগুলো বরাবরই এই রকম।

“তোমার নাকি বদলি হচ্ছে?” ডালিম বলল।

ঘার ফিরিয়ে দেখলাম ডালিমকে। এ-বাড়িতে শুনল নাকি কথাটা? বললাম, “শুনছি। গুজব।…আর বদলি করলেই বা কী, দুচার বছর পর পর তো করছেই।”

“এবার কোথায় যাচ্ছ?”

একবার আয়নাটা দেখে নিলাম। আলোর মতন লাগল। “গুজব যদি সত্যি হয়—ভাল জায়গায় যাচ্ছি।”

“জায়গাটা কোথায়?”

“খড়ি বলে একটা নদী আছে শুনেছ? নদী নয়, নালা। বর্ষাকালে বরাকর নদীর জল ঢুকে পড়ে, অন্য সময় খটখটে শুকনো, বালি আর পাথর…।”

“যেখানে মেলা হয় মাঘ মাসে?”

“ঠিক ধরেছ। একদিকে মেলা হয়। আর অন্যদিকে মড়া পোড়ানো হয়। শ্মশান। নাম করা শ্মশান; গইরিবাবার শ্মশান। সেখানে পুড়লে একেবারে স্বর্গবাস?” আমি মজার আমি মজার গলায় বললাম। হাসতে হাসতে।

ডালিম বলল, “শ্মশানে তোমার কী।”

“আমার লাভ বই ক্ষতি নেই, মেমসাহেব। বয়েস অনুপাতে একটু আগে আগে যাচ্ছি। কিন্তু যেতে তো হবেই।”

সামান্য চুপ করে থেকে ডালিম বলল, “ওখানে কোন্ কোলিয়ারি?”

“ওখানে ঠিক নয়, একটু তফাতে। ছোট বেলমাটি।…তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে পড়ে গেলাম। দেখাটেখা ন’ মাসে ছ’ মাসে যদি হয়। হেমলতাদির নেমন্তন্ন আর রাখা যাবে না। …তোমরা যখন সবাই মিলে টেবিলে বসবে, একটা লড়তি প্লেটে আমার নামে এক আধ চামচে করে এটা-ওটা উৎসর্গ করে দিও। শ্রাদ্ধে নাকি দেয়?”

“দেখা যাবে। গাড়ি আসছে পেছনে…।”

পেছনের আলো আগেই দেখেছি। গাড়ি আসছিল। পাশ দিলাম। গাড়িটা চলে গেল। ভ্যান। এই রাস্তায় এ-সময় খুব একটা গাড়ি ছোটে না। তবু এরই মধ্যে কয়েকটা গাড়ি এসেছে গিয়েছে।

মাইল পাঁচেক পথ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। বাঁ দিকে রেললাইনের সিগন্যাল চোখে পড়ছিল। সবুজ হয়ে রয়েছে। কোনো মালগাড়ি আসছে বোধ হয়। এখনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। এদিককার লাইনে মালগাড়িই বেশি চলে।

ডালিম বলল, “সেদিন একটা স্বপ্ন দেখেছি।” বলে চুপ করে থাকল।

“কী স্বপ্ন?”

“তোমাকে নিয়ে।”

“আমাকে নিয়ে।…বলো কি মেমসাহেব? আগে একবার আমাকে স্বপ্ন দেখেছিলে; তোমাদের বাড়ির কুকুর আমায় কামড়ে দিয়েছে…।”

“আঃ, এত বাজে কথা বলো! …স্বপ্ন আমি মাঝে মাঝেই দেখি। বলি না। তুমি দেখো না?”

রাস্তার সামনে গাছের ডালটা চোখে পড়ল। বেয়াড়াভাবে পড়ে আছে আধ শুকনো বোধ হয়, পাতা রয়েছে। পাশ কাটাতেই গর্ত, কিছু একটা লাগল তলায়। আদিত্যর গাড়ি বড় নিচু। এদিককার রাস্তায় অচল।

“আমি স্বপ্ন দেখলাম, তুমি যেন একটা গুহার মধ্যে বসে আছ? গুহা হতে পারে কিংবা ওই রকম এক বড় ফোকর। কালো কালো লাগছিল।”

“বাঃ। এ তো ভালো স্বপ্ন। সাধু সন্ন্যাসীরা গুহায় থাকে। সাধনভজন করে। ধুনি জ্বালায়। কী দেখলে, মেমসাহেব? আমায় কেমন দেখাচ্ছিল? জটা হয়েছে? দাড়ি?”

“না—” মাথা নাড়ল ডালিম। “দেখলাম, তুমি অন্ধ হয়ে বসে আছ। আমায় দেখতে পেলে না, চিনতে পারলে না। শোভা এসে তোমার হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেল।”

আমার চোখের সামনে আলোটা যেন আরও মেটে অস্পষ্ট হয়ে গেল। হতে পারে, ডান দিকে মোড় নেবার সময় ধুলো উড়েছিল বেশি। ধুলোটা ছড়িয়ে গিয়েছিল। পছন থেকে সামনের দিকে উড়ে এসেছে।

“শোভাকে তুমি দেখোনি মেমসাহেব। চিনলে কেমন করে?”

“তোমার বাড়িতে ছবি দেখেছি।”

গাড়ি ডানদিকে মোড় নিয়ে আধ-পাকা রাস্তা ধরেছিল। এই রাস্তাটা বল্লভপুকুর কোলিয়ারির দিকে চলে গেছে। রাস্তার দু পাশে বনতুলসির ঝোপ। মাঝে মাঝে কাঁটা গোলাপ। আর জংলা টুসি। গন্ধ উঠছিল ঝোপঝাড় থেকে। ভারি গন্ধ। অনেকটা তফাতে বুঝি ছোট ছোট ধানক্ষেত। চোখে পড়ছিল না কিছুই। ধুলোয় কুয়াশায় চাঁদের আলোয় মেশামেশি হয়ে সবই ঝাপসা-কালো।

“আমি একটা কথা ভাবি,” ডালিম বলল, গলার স্বর মৃদু, খানিকটা অন্যমনস্ক। “জীবন এমন বেঁকা হয় কেন? সরাসরি চলে গেলে ক্ষতি কী ছিল!” বলে চুপ করে থাকল কয়েক মুহূর্ত। আবার বলল, “তুমি শোভার খোঁজ-খবর করলে পারতে।”

আমি কিছুক্ষণ কোনো কথা বললাম না। পরে বললাম, “করিনি কে বলল?”

“তেমন করে করোনি নিশ্চয়। করলে একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না?”

রাস্তার মাঝখানটা যেন পিঠ উলটোনো নৌকোর মত হয়ে রয়েছে, মাটি আর পাথরের টিবি, সাবধানে ঢিবি টপকালাম। আবার গাড়ির তলায় লাগল। এই রাস্তাটা না-ধরে ঘুর পথের পটারি রোড ধরলে ভাল হত। তাতে খানিকটা ঘুরতে হত ঠিকই, তবে রাস্তাটা মন্দের ভাল।

“তোমরা আসবার সময় এই রাস্তা ধরে এসেছ?”

“হ্যাঁ।”

“ভীষণ খারাপ রাস্তা। শৰ্মা আমাকে পটারি রোড দিয়ে এনেছে।”

“কী জানি। আমি এদিককার রাস্তা ভাল বুঝতে পারি না।” ডালিম বলল। বলেই তার পুরনো কথায় ফিরে গেল। “শোভা যদি কোনোদিন ফিরে আসে? কী করবে?”

“আসবে না।”

“যদি আসে?”

“যে নেই সে আসে না।” আমি কথাটা থামিয়ে দিতে চাইলাম। “আর এলেও স্বপ্নে আসে, যেমন তোমার কাছে এসেছে।”

ডালিম কথা বলল না।

শোভা আমার স্ত্রী। এক সময়ের। এখন আমার বয়েস ছেচল্লিশ। বছর চৌত্রিশ বয়েসে যখন আমি তেজী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, চাকরি ধরি, ছাড়ি, বনিবনা হয় না অনেকের সঙ্গেই, মা শ্রীরামপুরে বাড়ি আগলে পড়ে থাকে, ছোট ভাই চা-বাগানে—তখন খানিকটা আচমকা শোভা বলে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। মেয়েটিকে দেখেশুনে, কিংবা আলাপ পরিচয় করে বিয়ে করিনি। মায়ের পছন্দেই হয়েছিল।

বিয়ের পর শোভা শ্রীরামপুরের মায়ের কাছে কিছুদিন ছিল। তারপর আমার কাছে। আমার কাছে থাকার সময় আমি বুঝতে পারি, শোভা ঠিক স্বাভাবিক নয়। সাধারণভাবে দেখলে প্রথমটায় এসব নজরে পড়ে না। আমারও পড়েনি। সে সুন্দরী ছিল না। সুশ্রী ছিল। তার আচার-ব্যবহার কথাবার্তা ছিল স্বাভাবিক। শান্ত, নরম স্বভাব। সংসারের কাজে অযত্ন ছিল না শোভার। তবে অতি যত্নও নয়। এর চোখ দুটি আমার বড় ভাল লাগত। মনে হত, ভরা বর্ষার মেঘের মতন ঘন ও সজল তার চোখ। হাসিটিও ছিল স্নিগ্ধ। কিন্তু ক্রমশই বোঝা যাচ্ছিল এই শোভা আর ভেতরের শোভা এক নয়। ভেতরের শোভা ছিল নির্লিপ্ত উদাসীন বিষণ্ণ। একা। গভীরভাবে তাকে লক্ষ করতে করতে আমার মনে হল, আয়নার ওপর ভেসে ওঠা ছায়ার মতনই যেন সে। মনে হয় আছে, কিন্তু থাকে না। সে দৃশ্যগোচর, অথচ স্পর্শযোগ্য নয়। অদ্ভুত এক দূরত্ব দিয়ে ঘেরা ছিল শোভা। সে কাছে ছিল, তার সত্তা ছিল না। বিছানায় পাশাপাশি শুয়েও তাকে নিবিড় বলে মনে হত না, মনে হত না সে আমার নিজস্ব। অনেক দিন এমন হয়েছে, ঘুম ভেঙে দেখেছি শোভা পাশে নেই, অন্য কোনো ঘরে বা বারান্দায় গিয়ে চুপচাপ বসে আছে। কখনো কখনো তার আলমারি খুলে শাড়িজামা বার করত, করে টাল করে বিছানায় ফেলে রাখত সারাদিন। কেন, আমি জানি না। বোধ হয় সে বোঝাতে চাইত, আমাদের বিছানায় ও ওর পোশাকের মতনই পড়ে থাকে।

বছর দুই শোভা আমার কাছে ছিল। এই দু বছর তার স্বভাব পালটাল না। বরং আমাদের দূরত্ব বেড়ে গেল। আমি বিরক্ত, অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলাম। এমন কি আমাদের মধ্যে অশান্তিও ঘটত। শোভার মাঝে মাঝে ফিট হতে শুরু হল। ডাক্তার বলল, হিস্টিরিয়া। দেখতে দেখতে তার মধ্যে এক ধরনের ব্যাধি এসে দেখা দিল। বোবা, নিঃসাড়, হয়ে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কাঁদত। একদিন শাড়ির আঁচল খুলে উনুনে ফেলে দিল। দিনুর মা কাছে না থাকলে সেদিন শোভা আগুনে পুড়ে মরত।

শোভা পাগল হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তাকে আমি শ্রীরামপুরে মার কাছে রেখে এলাম। ডাক্তার দেখানো এবং চিকিৎসা দরকার। কলকাতার এক ডাক্তার তাকে দেখতে লাগল।

মাস দুইও পুরো হল না শোভা শ্রীরামপুরের বাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে গেল। মা সন্দেহ করল, গঙ্গায় গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছে সে। জোয়ারের জল তাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কে জানে!

এসব আজ আট দশ বছর আগের কথা। শোভার কী হয়েছে আমি জানি না। সাধারণ মানুষের পক্ষে যতটা খোঁজ করার দরকার আমি করেছিলাম। কোনো ফল হয়নি। সত্যি কথা বলতে কি শোভা আমার কাছে অনেকদিনই মৃত। তার স্মৃতি নিয়ে মালা জপ করার কোনো কারণ আমার নেই। কদাচিৎ তাকে হয়ত মনে পড়ে। মনে পড়লেও ও-সব ভাবনা নিয়ে বসে থাকি না। যা ঘটার ঘটে গিয়েছে। অতীত অতীতই। শোভার একটা ছবি, নাকি দুটো, আমার ঘরে থেকে গেছে এইটুকুই যা তার চিহ্ন। না রাখলেও চলত, তবু রেখে দিয়েছি।

“গগন?” ডালিম আমার কাঁধের কাছে তার হাত ছোঁয়াল, নিশ্বাসচাপা গলায় বলল, “তুমি ভাবছ, তোমার সঙ্গে আমি ঠাট্টা করছি।”

“ভাবছি না। আর ঠাট্টাই যদি করো, অন্যায় কী করছ?”

“সত্যি আমি ঠাট্টা করিনি। স্বপ্ন আমি দেখেছি।……আমি মাঝেমধ্যেই তোমায় স্বপ্ন দেখি।”

রাস্তার দিকেই আমার চোখ। আলো আর ফুটছে না। ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে। কাছাকাছি কোনো এঁদো পুকুর থেকে পাঁকের গন্ধ ভেসে এল। হয়ত পুকুর নয়, জলা ভূমি। দু পাশের ঝোপ গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।

“তুমি আমায় দেখো না?” ডালিম বলল।

“এই তো দেখছি—”

“স্বপ্ন দেখো না?”

“কে না দেখে!…তবে এই বয়েসে স্বপ্নগুলো ধুলোয় ভরা গাছের পাতার মতন। তাই না?”

“কী বলছ? ধুলোও তো ধুয়ে যায়; কখনো কখনো; বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিয়ে যায়।”

আচমকা দেখি কী যেন হয়ে গেল। চোখে কিছু দেখতে পাই না। শুধু অন্ধকার। গাড়ির আলো নিবে গিয়েছে। ব্রেক ধরতে দু মুহূর্ত দেরি হল। গাড়ি থামল। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অন্ধকার থিতিয়ে কুয়াশা জড়ানো ময়লা জ্যোৎস্না ফুটে উঠছিল।

তিন

আলো আর জ্বলল না। নতুন করে স্টার্টও হল না। গাড়িতে একটা টর্চও নেই। আদিত্য এমন বেখেয়ালে কে জানত। এসব দিকের রাস্তায় টর্চ না নিয়ে কেউ রাত্তিরের দিকে বেরোয় না। কোথায় কী হয় কেউ কি বলতে পারে! আদিত্যর গাড়ি হাতড়ে কিছুই পাওয়া গেল না; পুরনো একটা প্লাগ, স্ক্রু ড্রাইভার, গোটা কয়েক নাট, ছেঁড়া এক টুকরো কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই।

আমার মিস্ত্রিগিরি কোনো কাজে এল না। চার চাকাঅলা গাড়ি নিয়ে একসময় ঘোরাঘুরি করলেও এখন দুচাকাই আমার পক্ষে সুবিধের হয় বলে প্রথমটা নিয়ে আর মাথা ঘামাই না। তবু চেষ্টা করলাম। ডালিম আমার লাইটার জ্বালিয়ে আলো দেখাবার চেষ্টা করছিল। কিছুই হল না। আঙুল পুড়তে লাগল ডালিমের। গাড়ি কোনো সাড়াশব্দ করল না।

“এখন কী করবে?” ডালিম বলল।

করার মতন কিছুই দেখছিলাম না। আশপাশে শুধু মাঠ, ঝোপ। কাছাকাছি গাঁ-গ্রামও চোখে পড়ছিল না আমাদের। রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। এসময় এই ধরনের প্রাইভেট রোড দিয়ে গাড়িটাড়িও যাবার কথা নয় তেমন। কোলিয়ারির কেউ যদি গাড়ি নিয়ে এসে পড়ে অন্য কথা।

চার দিকে তাকিয়ে আমি কোনো ভরসা পাচ্ছিলাম না। আদিত্যর ওপর বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। “গাড়িতে একটা টর্চ পর্যন্ত রাখবে না তোমরা? নাও, এখন পড়ে থাকো সারা রাত। মিস্ত্রি ধরে না আনলে কিছু হবে না!”

ডালিম গাড়ির মধ্যে উঠে বসেছিল। আমি তখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে।

“এখানে মিস্ত্রি কোথায় পাবে?” ডালিম বলল।

“এ তল্লাটেই পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তাছাড়া, এই রাত্তিরে করবারও কিছু নেই। একেবারে জলে পড়ে গেলাম।”

ডালিম কিছু বলল না।

সামান্যতে আমি বড় একটা অধৈর্য হই না। উদ্বেগও বোধ করি না। কিন্তু আদিত্যর গাড়ি নিয়ে আধঘণ্টা খানেক ধস্তাধস্তি করার পর আমি অধৈর্য, উদ্বিগ্ন, বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। গাড়িটাকে আর এক পাও এগিয়ে নিয়ে যাবার সাধ্য আমার নেই। রাস্তা আটকে গাড়ি পড়ে থাকল। অন্য কোনো গাড়ি যদি এ-রাস্তায় এসে পড়ে, তার পক্ষে এগুনো মুশকিল। রাস্তা কাঁচা, ছোট, এবড়ো-খেবড়ো। তবু কোনো গাড়ি এসে পড়লে হয়ত ভাল হয়; কোনো রকম সাহায্য পাওয়া যেতে পারে।

ডালিম বলল, “তাহলে আর বাইরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা লাগাচ্ছ কেন? ভেতরে এসে বসো।”

“তাই বসতে হবে।…আদিত্য সমস্ত ব্যাপারে এত কেয়ারলেস কেন আমি বুঝতে পারি না। মোটরগাড়ি গোরুরগাড়ি নয়; গোরু জুতে দিলেই চলে না!…তুমি বলো, নিজেই বলো, খারাপ ব্রেক, ডাউন ব্যাটারি, তাপ্পিমারা তার—এসব নিয়ে কেউ বাইরে বেরোয়? তাও আবার সঙ্গে বউ। আশ্চর্য।”

ডালিম সামান্য চুপচাপ থাকল; তারপর বলল, “আমি কী করব বলো! গাড়ির খবর আমি রাখি, না জানি?”

“না, তোমায় বলছি না!…ভাবছি কী করা যায়? কোনো উপায় দেখছি না, ডালিম।”

“উপায় না থাকলে ভেতরে এসে বসো।” ডালিম বলল, “না হয় চলো দুজনেই হাঁটতে শুরু করি।”

আমি ডালিমের দিকে তাকালাম। জানলার কাচ নামানো। সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।

“তুমি তো দেখছি দিব্যি ঠাট্টা করতে পারছ?…নার্ভাস হচ্ছ না?”

“আর নার্ভাস হয়ে কী করব। তুমি তো রয়েছ।”

“বাঃ!”

ডালিম যেন হাসল। “ভেতরে এসে বসো, ঠাণ্ডা লাগিয়ে লাভ নেই। বাইরে বেশ হিম পড়ছে। দাঁড়িয়ে ছিলাম তো—মাথা ভিজে গেল।…কী রকম কুয়াশা হয়েছে দেখেছ?”

মাঠের ওপর কুয়াশা ঘন হয়ে জমে আছে, এত ঘন যে ধোঁয়ার মতন চাপ হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। চাঁদের আলো এখনও ফুটফুটে হয়ে ওঠেনি, ওঠার কারণও নেই, আলোর সঙ্গে কুয়াশা জড়ানো। ধুলো এবং কোলিয়ারির ধোঁয়াও মাঠেঘাটে প্রচুর জমে থাকে। বড়সড় গাছগুলো মাথা ভরতি অন্ধকার নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে। কালো দেখাচ্ছিল। আকাশের একপাশে মিটমিটে তারা, চাঁদটা যেন ঘুমচোখে চেয়ে আছে।

শীত করছিল। রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে বলে মনে হল না। হিম পড়ছে।

“বাইরে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা খেয়ে তোমার…”

“না; বসছি।” দরজা খুলে আমি গাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। সামনের কাচ অস্পষ্ট দেখাচ্ছিল। হিমে ভিজে যাচ্ছে।

কাশির দমক এল। শুকনো কাশি। “ডালিম?”

“উঁ?”

“আদিত্য তো বাংলোয় ফিরে তোমায় দেখতে পাবে না।”

“যদি ফেরে।…কাজে ডেকে নিয়ে গিয়েছে যখন—চট্‌ করে ফিরতে পারবে না। ফিরতে অন্তত শেষ রাত।”

“ফিরতেও পারে তাড়াতাড়ি।”

“আশা কম। বরং বলতে পারি—কাল সকালের দিকেও হয়ত বাড়ি ফিরতে পারবে না। দেখি তো!”

“তুমি কেবল ঠুকে যাচ্ছ কেন বলো তো।…আমি ভাবছি, আদিত্য যদি তাড়াতাড়ি ফেরে, ফিরে দেখে বউ বাড়ি ফেরেনি, অফিসের জিপ নিয়ে খোঁজ করতে বেরুতে পারে।…তুমি তাহলে বেঁচে গেলে।”

“আমি বাঁচলাম, না, তুমি বাঁচলে?”

ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে কাঁধের কাছে ব্যথা করে উঠল। মাসখানেক আগে বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। ব্যথাটা তখন থেকে। নিজেকে সইয়ে নিতে নিতে সিগারেট ধরালাম। ঠাণ্ডাটা কাটিয়ে ফেলা দরকার।

ডালিম আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল।

“আমার বাঁচার চেয়েও তোমার বাঁচাটা ইমপর্টেন্ট!…তুমি একজন মহিলা। ম্যারেড। বাড়ি ফিরে তোমায় না দেখতে পেলে আদিত্য মাথার চুল ছিঁড়বে।”

“কেন? বউ পালিয়েছে ভাববে?”

“গাড়ি উলটে গেছে ভাবতেও পারে,” আমি তামাশার গলায় বললাম। “আনাড়ির হাতে গাড়ি ছাড়লে লোকে তাই ভাবে।”

“তুমি আদিত্যকে যতটা চেনো তার চেয়ে বেশি চিনি,” ডালিম থেমে থেমে বলল, “এমন তো হতে পারে গাড়িটা তোমায় দিয়ে গেছে ওলটাবার জন্যেই।”

কথাটা কানে লাগলেও আমি গা করলাম না। বরং ডালিমের কথায় যেন মজা পেয়েছি, হেসে বললাম, “কী যে বলছ? এমন জ্বলজ্যান্ত বউ! একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে বউ হাত-পা খোঁড়া হয়ে থাকুক এটা কেউ চায় নাকি?”

ডালিম সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না, সামান্য পরে বলল, “কে কী চায়—সে নিজেই হয়ত সবসময় জানে না।…যাকগে, তুমি বড় দোটানায় পড়েছ! ভাবছ, পরের বউকে নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ির মধ্যে বসে রাত কাটালে তোমার আর মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না।…মুখের বড় ভয় তোমার, তাই না?”

“আমার মুখ—?” আমি হাসবার চেষ্টা করলাম। আমার মুখ একেবারে ভোঁতা। দেখাবার মতন নয় এমনিতেই। কিন্তু মেমসাহেব তোমার মুখ! ওর যে অনেক দাম!”

ডালিম ঘাড় ফেরাল না। তার কানের পাশে চুলগুলো আরও অগোছালো হয়ে গিয়েছিল। ডালিম বলল, “আমার মুখের দাম আমি জানি। ও নিয়ে তোমায় আর ভাবতে হবে না।…তুমি নিজের কথা ভাবো।”

“তুমি বড় সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ, মেমসাহেব।…কী অবস্থায় পড়ে গিয়েছি—, তোমার কোনো ভয়ডর নেই যেন! দুশ্চিন্তাই হচ্ছে না?”

“তোমার মতন ভয় আমার নেই।…আমায় কেউ খুন করতে আসছে না এখানে। ডাকাতি করতে এলেও বড় একটা লাভ হবে না। সোনাদানা না থাকার মতন। যা দেখছ এর বারো আনা নকল।”

“আসল নকল বোঝা যায় না।”

“বুঝতে দিই না, তাই—। তা বলে তুমি যে আমার নকলটা বুঝতে পার না-তা নয় গগন। তুমি সবই বোঝ…।” ডালিম চুপ করে থেকে পরে কী মনে করে একটু হাসল। বলল, “অনেকগুলো বছর এমন করেই কাটিয়ে এলাম। নকল হয়ে। আর ভাল লাগে না। বয়েসটা কত হল জান? বুড়ি হয়ে গিয়েছি।”

“তোমায় দেখে কি সেটা কেউ বুঝবে?” মজা করেই বললাম।

“বুঝবে না? ঝুমু-র বয়েস কত জান?”

“সতেরো আঠারো।”

“আমার ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়েসে ঝুমু হয়েছিল। যার মেয়ের বয়েস সতেরো আঠারো তাকে বুড়ি বলবে না?” ডালিম যেন আমাকে সহজ এক অঙ্ক শিখিয়ে কাঁধের কাছে আলগাভাবে খোঁচা মারল।

আগে চোখে পড়লেও নজর করিনি তেমন করে। রাস্তার পাশে ঝোপের গায়ে জোনাকি উড়ছে একরাশ। ঝিঁঝির ডাক কানে আসছিল। মাঠের গন্ধটা কেমন শুকনো খসের মতন লাগছিল। হেমন্তের রাত যেন সারা মাঠ জুড়ে কিসের সৌরভ ছড়িয়ে। মৃদু অথচ গাঢ়। “ঝুমু কেমন আছে? ক্রিসমাসের ছুটিতে আসছে?”

ডালিম প্রথমে চুপ করে থাকল। পরে বলল, “না, আসছে না। আমি আনছি না। নিজেই আমি কলকাতায় যাব।” ডালিমের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। অন্যমনস্ক, গম্ভীর যেন।

আমি কিছু বুঝলাম না। হেমলতাদির বাড়ি থেকে আসার সময় ডালিম ঝুমুকে নিয়েই কথা বলছিল ওর সঙ্গে। যদিও আমরা কাছাকাছি ছিলাম না—তবু ডালিমকে ডাকতে গিয়ে আমি ঝুমুর নাম শুনেছি।

“তুমি নিজেই এবার বড়দিনে কলকাতা যাচ্ছ?”

“হ্যাঁ। ডিসেম্বরেই যাব।”

“হঠাৎ?”

“ঝুমুর একটা কিছু করতে হবে।…মা অনেকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এক ডাক্তার ঠিক করেছে। ভদ্রলোক বাইরে ছিলেন। বছর দুই হল কলকাতায় এসেছেন। নিউরোলজিস্ট। ঝুমুকে তাঁর ট্রিটমেন্টে রেখে দেখব, কী হয়?”

ঝুমুকে আমি আজ ক’বছরই দেখছি। মাঝে মাঝে ছুটি-ছাটায় মা-বাবার কাছে এলে তাকে দেখি। দেখতে রোগারোগা, খুবই রোগা, গায়ের রঙ তার মায়ের চেয়েও ফরসা। মেয়েটার গায়ের চামড়া এতই পাতলা যে শিরা উপশিরাগুলো পর্যন্ত দেখা যায় যেন। টলটলে চোখ, ফিনফিন করছে ঠোঁট দুটো। মাথায় বেশি চুল নেই, ছেলেদের মতন দেখায় অনেকটা। শান্ত, চুপচাপ মেয়ে। দেখলে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু আমরা জানি ঝুমুর অদ্ভুত এক অসুখ আছে। তার বাঁ পা কিংবা হাতের সামান্য গোলমাল—যাকে “ডিফরমিটি’ বলা উচিত কিনা আমি জানি না—চট্ করে নজরে পড়ে না। শুনেছি, ঝুমুর ওটা জন্মগত ত্রুটি। অসুখটা কিন্তু অন্যরকম। অদ্ভুত অসুখ। শোনা যায় না। আমি অন্তত শুনিনি। মাঝে মাঝে কথা বন্ধ হয়ে যায় ঝুমুর। একেবারে বোবা হয়ে থাকে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না, শুধু একটা শব্দ থাকে গোঙানির! বারো তেরো বছর বয়েস পর্যন্ত এ অসুখ ছিল না। জিবের সামান্য আড়ষ্টতা ছিল। ওই বয়েসের পর হঠাৎ অসুখটা দেখা দেয়। কিছুই বোঝা যায়নি প্রথমে। ডাক্তারও বুঝতে পারেনি। অসুখটা হয়েছিল হঠাৎ, সেরেও গেল নিজের থেকে। তারপর দু-চার মাস অন্তর এই রকম হতে লাগল। আচমকা হয়, সেরেও যায়। দু একদিন ওই বোবা অবস্থায় থাকে, আবার কথা ফিরে আসে। সপ্তাহ খানেকের বেশি কখনো বোবা হয়ে থাকেনি ঝুমু। এটা কেন হয়, কী জন্যে, সারবে কি সারবে না—কেউ বলতে পারেনি। ডাক্তারবদ্যি অনেক হয়েছে, লাভ কিছু হল না।আসলে, ঝুমুকে কলকাতায় নিজের মায়ের কাছে ডালিম রেখে দিয়েছে মেয়ের জন্যেই। মা ওকে সামলাতে পারে, আগলাতে পারে, ডাক্তার ওষুধ করতে পারে।

“তুমি তাহলে কলকাতায় বেশ কিছুদিন থাকবে?”

“তাই ইচ্ছে।…মেয়ে বড় হয়েছে। তুমি বুঝতেই পার—এই বয়েসটা কী রকম। বিশেষ করে মেয়েদের পক্ষে। ঝুমুকে মা যেভাবে আগলে রাখে, আমি পারতাম না। বড় ইমোশন্যাল, কিছু হলেই ঝুমুর ওই রকম হয়ে যাবার ভয় থাকে।…এখানে থাকলে প্রায় ওর ওই রকম হয়। আমি তো ওকে বাঁচাতে পারি না। মা পারে! মা ওকে কত দিক থেকে বাঁচিয়ে রাখে—তুমি জান না?”

“এখন কেমন আছে?”

“ভাল। মা লিখেছে, পরীক্ষার পড়াশোনা করছে মন দিয়ে। সেতার ধরেছে। তাতে বাঁ হাতটার উপকারই হচ্ছে।”

“আদিত্য কী যাচ্ছে তোমার সঙ্গে?”

“না,” ডালিম মাথা নাড়ল। “ও যাবে না। গিয়ে কোনো লাভ নেই।” বলে একটু চুপ করে থেকে বলল, “বাবাকে ঝুমু পছন্দ করে না। বাবাও মেয়েকে দেখলে খুশি হয় না।”

ডালিমকে দেখলাম। তার গায়ের রেশমি কাপড়টায় গলা পিঠ জড়ানো। হালকা রঙ কালচে দেখাচ্ছিল। মেয়েকে নিয়ে আদিত্য আর ডালিমের মধ্যে যে অশান্তি রয়েছে এটা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। খোলাখুলি কোনো আলোচনা করি না। ডালিম হয়ত করে, হেমলতাদির সঙ্গে করতে পারে, আমি জানি না।

“তুমি বড় বেশি বেশি বলছ,” আমি যেন আদিত্যর হয়ে বললাম, “নিজের মেয়ে, তাকে কেন পছন্দ করবে না আদিত্য! সে তো বরাবরই চেয়েছে ঝুমু তোমাদের কাছে থাক।”

ঘাড় ফেরাল ডালিম। রূঢ়ভাবেই বলল, “কাছে রাখতে চাইলেই বুঝি সব হয়ে যায়। মেয়ে কি কুকুর বেড়াল বাড়িতে রেখে দিলেই দায় ফুরিয়ে গেল! তোমাদের আদিত্য মুখে যা বলে কাজে সেটা চায় না। নিজের মান মর্যাদা বাঁচাতে চাইলে মুখে ওটা বলতে হয়। মেয়ের ওপর তার মায়া-মমতা কত আমি জানি।”

ডালিমদের পারিবারিক কথা এভাবে শোনার ইচ্ছে আমার হচ্ছিল না। সামনে তাকিয়ে থাকলাম। হঠাৎ মনে হল, দূরে যেন আলো দেখা যাচ্ছে।

ডালিম, “মেয়েকে ও ঘেন্না করে। বলে, কোথা থেকে এক নুলো গোঙা বোবা মেয়ের জন্ম দিয়েছ! ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকার মতন একটা মেয়েও পেটে ধরতে পারলে না!” বলে ক’ মুহূর্ত চুপ করে আবার বলল, “পেট আমার যে, দোষও আমার!”

কথাটা শুনেও না-শোনার ভান করে বললাম, “একটা আলো দেখতে পাচ্ছি। সামনে দেখো তো, এদিকে আসছে কিনা।”

ডালিম কোনো কথা বলল না।

হিমে ভেজা কাচের আড়ালে ভাল করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। খানিকটা অপেক্ষা করে গাড়ির দরজা খুলে নিচে নামলাম। তাকিয়ে থাকলাম সামনে। একটা আলো ঠিকই, তবে মিটমিটে। গাড়ির আলো বলে মনে হল না। মোটর বাইকের আলো হলে আরও জোর হওয়া উচিত ছিল।

আলোটা সামান্য লাফাচ্ছে। এদিকেই এগিয়ে আসছে বলে মনে হল। রাস্তা ধরেই আসছে বোধ হয়।

“ডালিম, আলোটা এদিকেই আসছে।”

চার

অনেকটা সময় গেল। আমার শীত ধরে গিয়েছিল। গাড়ির মধ্যে এসে বসলাম। সিগারেট ধরালাম। আবার বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। আলোটা ততক্ষণে গাড়ির কাছাকাছি এসে গিয়েছে।

সাইকেল থেকে একটা লোক নেমে দাঁড়াল। ছোট মতন এক লণ্ঠন তার সাইকেলের হ্যাণ্ডেলের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁধা রয়েছে। লোকটার মুখ প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। মাথা কান কপাল জড়িয়ে গামছা আর মাফলার বাঁধা। বোধ হয় একটাতে কুলোয়নি বলে আগে গামছা পরে মাফলার জড়িয়েছে। মুখে খানিক দাড়ি। গায়ে জামার ওপর চাদর জড়ানো। ভূটকম্বলও হতে পারে।

আমি এগিয়ে ওর সামনে যেতেই লোকটা তার সাইকেল গায়ের কাছে টেনে নিয়ে শক্ত হাতে ধরল।

“এই যে ভাই—শোনো, আমরা বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি। গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছে রাস্তায়।”

লোকটা আমায় দেখছিল। “কুথা থেকে আসছেন বটেক?”

“ফুলকুঠিয়া।”

“যাবেন কুথায়?”

“অনেক দূর গো! জামবাটি।”

“জামবাটি।…সে তো পাঁচ ছ ক্রোশ দূর, সাহেব!”

“অনেক দূর। কাছাকাছি কোথাও থাকার জায়গা পাব হে? সকালে না-হয় মিস্ত্রি যোগাড় করা যাবে।”

“গাড়িতে কে আছেন।”

“মেমসাহেব।…আমরা ফুলকুঠিয়া থেকে ফিরছিলাম।”

লোকটা যেন কিছু ভাবল। তারপর বলল, “উই যে উধারে—তফাতে দেখছেন—পলাশ ঝোপ। ঝোপের পাড়ে মণ্ডলবাবার বাসা। উখানে যান ক্যানে—রাতটুকু নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।”

“মণ্ডলবাবা কে?”

“খোঁড়া পাদরি। মণ্ডলবাবার বাসার গায়ে কুঠো পাড়া।”

লোকটা যেন আর দাঁড়াতে চাইছিল না। সাইকেলে ঝুলোনো লণ্ঠনটার আলো বাড়াবার চেষ্টা করল।

“তোমার নাম কী?”

“লিশিথ।”

“তুমি কোথায় যাচ্ছ?”

“আমি আজ্ঞা—” বলে লোকটা একটু হাসল, যেন কী বলবে ভাবল, তারপর বলল, “আজ্ঞা, আমি নুনিয়া পারে যাচ্ছি। মাইলটাক পথ। রাত বেলায় যাওয়া কঠিন গো। পরিবারের বাপকে সাপে কামড়েছে।”

“সাপ? এ সময়?”

“শেষ বেলার সাপ বিষহরিকেও ডরায় না। নিদ্রা যাবার আগে ফণী বিষে জরজর থাকে। ধরণীর ভিতরে বিষ রাখা যায় না গো, উপরে ফেলে দিয়ে যেতে হয়। শাস্ত্রে বলেছে।…আমি যাই, সাহেব।”

“তুমি কি ওঝা?”

“না আজ্ঞা। আমি ছুঁচ দিই।”…বলে লোকটা পকেট দেখাল। আর দাঁড়াবে না সে।

সাইকেল নিয়ে চলে যাবার সময় একটু দাঁড়িয়ে গাড়ির মধ্যে উঁকি মারল নিশীথ। দেখল ডালিমকে।

সাইকেল দু পা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে নিশীথ বলল, “মাঠে থাকবেন না সাহেব, ই সময় দু চারটে শয়তানের বাচ্চা ঘোরাফেরা করে। গাড়িতে থাকুন। হেমন্তের সাপ বড় ভয়ংকর…।”

লোকটা চলে গেল সাইকেলে চেপে।

আমার যেন কেমন এক ভয় এল। পায়ের তলায় সাপ রয়েছে নাকি? গাড়িতে এসে বসলাম।

ডালিম চুপ করে বসে ছিল গাড়িতে।

“লোকটা কী বলল—ভাল বুঝলাম না। বলল, সাপের ইনজেকশান দেয় ও। বোধ হয় কোনো কোলিয়ারি হাসপাতালের কিছু হবে। ওর শ্বশুরকে ইনজেকশান দিতে যাচ্ছে। সাপে কামড়েছে শ্বশুরকে।”

“সাপ?”

“এসময় সাপ বেরুবার কথা নয়। তবু এসব জংলা, ফাটাফুটো মাঠে এখনও বেরোয়। নিশীথ বলল, এখনকার সাপ বড় বিষাক্ত। হেমন্তর সাপ।”

“নিশীথ?”

“লোকটার নাম।…নামও নিশীথ, ঘুরে বেড়ায়ও নিশিকালে।” আমি যেন একটু হালকা গলায় বললাম।

ডালিম কোনো জবাব দিল না। জানলার দিকে মুখ করে বসে থাকল। ওর দিকের কাচ তোলা ছিল।

খানিকক্ষণ চুপচুপ থাকার পর আমি বললাম, “নিশীথ বলল, ওই দিকে একটা পলাশ ঝোপ আছে। ঝোপের ওপারে এক খোঁড়া পাদরি থাকে। মণ্ডলবাবা। তার বাড়ির গায়ে কুঠো পাড়া। মানে দুচার ঘর কুষ্ঠ রোগী থাকে বোধ হয়। কুষ্ঠ হাসপাতালও হতে পারে। ছোট হাসপাতাল! কী জানি।”

ডালিম গায়ের চাদরে গলা ঢেকে নিল। “তুমি বুঝি ভাবছ—ওখানে গেলে রাতটা নির্ভয়ে কেটে যাবে?”

“কী জানি। হয়ত যেত।…কিন্তু কেমন করে যাব? কতটা রাস্তা জানি না। মাঠ ভেঙে যাওয়া কী সহজ? কোথায় সাপ আছে কে জানে! চোখে তো কিছুই ভাল করে দেখা যায় না।”

ডালিম কোনো কথা বলল না। আমিও চুপ করে থাকলাম। ঝোপের গা থেকে জোনাকির দল যেন ফোয়ারার মতন ছিটকে উঠে মাঠের বাতাসে উড়তে লাগল। নাচতে নাচতে আমাদের গাড়ির সামনের কাচে এল, ডালিমের জানলার গায়ে পাক খেতে লাগল।

আমার দিকের জানলার কাচটা আমি ধীরে ধীরে তুলে দিচ্ছিলাম। দিতে দিতে দেখছিলাম, জ্যোৎস্নার সব আলো কুয়াশার গায়ে মাখামাখি হয়ে আছে। যেন নরম নিঃশব্দ বৃষ্টির মতন কুয়াশা সমস্ত কিছুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাঠের পর মাঠ ফাঁকা নিঃসাড়। সেই অদ্ভুত গন্ধ মাঠের গাছপালার, কুয়াশার।

হঠাৎ ডালিম বলল, “তুমি কী ভাবছ?”

“কই! কিছু নয়।”

“তুমি ভাবছ, পাদরিবাবার কাছে গেলে বাঁচা যেত।”

“হয়ত।”

“তাহলে চলো?”

“না। সাপ আছে।”

“কোথায়?”

“মাঠে।…সাপে আমার ভীষণ ভয়।”

“লোকটা তোমার ভয় দেখিয়ে গেল।”

“ভয়।…না, ভয় ধরায়নি। সাবধান করে দিল।…বোধ হয়, ঠিকই বলেছে ও। মাটির তলায় যাবার আগে সব বিষ ওরা বাইরে ফেলে যায়।”

ও কিছু জানে না। “ ডালিম আমার হাত ধরল নরম করে, ধরে থাকল, ধরে থাকল, তারপর কখন হাতটা টেনে তার মুখের কাছে নিয়ে গেল, চেপে ধরল আঙুলগুলো। ডালিমের মুখের মাংসগুলো কাঁপছিল। ওর গাল যেন ঠাণ্ডা, ভিজে ভিজে।

“গগন?”

“বলো?”

“ভয় পাচ্ছ?”

“তুমি পাচ্ছ না?”

“তোমার ভয় পেতে হবে না। আমি মানুষ, সাপ নই।”

ডালিমের হাত আরও শক্ত হল। তারপর আলগা হতে লাগল। হাত ছেড়ে দিল ও।

আমি কতক্ষণ যেন চুপ করে বসে থাকলাম। খেয়াল হল আচমকা।

ডালিমের হাত আমার কোলের ওপর পড়েছিল। আস্তে করে উঠিয়ে নিলাম। গাড়ির কাচে একরাশ জোনাকি।

“ডালিম! লোকটার নাম নিশীথ। দিবা হলেও হতে পারত। এই দিন, এই রাত্রি, এই যে ষড় ঋতু—এদের কাছ থেকে তুমি আমি আমরা যে কিছুই লুকোতে পারি না।”

ডালিমের হাত কখন আমার কপাল ছুঁয়েছে বুঝতে পারিনি। পরে অনুভব করলাম, তার হাত ক্রমশই উষ্ণ হয়ে উঠছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *