গুণেন একা

গুণেন একা

গুণেন দোকান বন্ধ করে উঠে পড়বে ভাবছিল। রাত বেশি হয় নি। সোয়া সাত, সাড়ে সাত। কিন্তু দিনটা ভাল যাচ্ছে না। কালও যায়নি। মরা মাঘে বেয়াড়া বাদলা এসে জুটেছে। পরশু রাতে এক পশলা ঝমঝমে বৃষ্টির পর কাল সকাল থেকেই মেঘলা আর টিপ টিপ বর্ষা। কখনও বাড়ে, আবার কমে।

গুণেনের দোকান সদর বাজারের কচ্ছি গলির মধ্যে। সরু আঁকাবাঁকা গলি; গলির একটা মুখ গিয়েছে সদর বাজারের বড় রাস্তায়, অন্য মুখ সবজি বাজারে। এই শহরের দশ আনাই কাঁচা রাস্তা, কচ্ছি গলিও। পাকা রাস্তাতেও ধাঙড়রা নামছে না আজ চার পাঁচ দিন। মিউনিসিপ্যালিটির সঙ্গে গণ্ডগোল। ফলে বড় রাস্তাই আস্তাকুঁড়। আর এই কচ্ছি গলি নালার আবর্জনায়, বৃষ্টির কাদায়, গরু-ঘোড়ার মল ময়লায় একাকার। এই কদিনই সবজি বাজারের দুর্গন্ধ আরও চাপ হয়ে ভেসে আসছে।

বৃষ্টি কিংবা চারিদিকের এই ময়লার জন্যেই যে গুণেন আগেভাগে উঠে পড়বে ভাবছিল তা অবশ্য নয়। তাদের ধবলি মহল্লায় ক’দিন ধরেই এক আতঙ্ক জেগেছে। সকলেই তটস্থ। কোথাকার একটা কুকুর মহল্লায় যাকে দেখা যেত না, এসে জুটেছে আচমকা। কুকুরটা পাগল। একেবারে বুনো কুকুরের মতন দেখতে, বিশাল লম্বা চওড়া চেহারা, যেন শালা বাঘ। গুণেন নিজে অবশ্য দেখেনি, কিন্তু শুনেছে—কুকুরটার রঙ কালচে খয়েরি, ভোঁতা মুখ, ভাঙা কান। জনা দুইকে এরই মধ্যে কামড়েছে, আঁচড়েছে আরও এক আধজনকে, এক টাঙাঅলার ঘোড়ার একটা পায়ের মাংস খাবলে নিয়েছে। এখানে হাসপাতাল নেই। সরকারী বড় হাসপাতাল মাইল সাতেক দূর; কামড়-খাওয়া লোকগুলোকে সেখানেই ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।

ধবলি মহল্লার এখন সবাই লাঠিসোঁটা নিয়ে তৈরি, তক্কে তক্কে রয়েছে অনেকেই, একবার শালাকে পেলে আর রক্ষা রাখবে না। মিউনিসিপ্যালিটি বলেছে, মরা কুকুর অফিসে জমা দিতে পারলে পঁচিশ টাকা বখশিস। অবশ্য পঁচিশটা টাকার জন্য কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না, কুকুরটাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে মহল্লার লোকরা। কাল থেকে তার আর পাত্তা নেই, কোথায় ঘাপটি মেরে আছে কে জানে, সামান্য তফাতেই পোড়ো কোলিয়ারির জঙ্গল, বন-তুলসী, কাঠগোলাপ আর পলাশের ঝোপ। কুকুরটা কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে কে জানে। আর কেউ কেউ বলেছে, ছোট লাইনে কাটা পড়েছে হয়তো, রেল লাইনও তো তেমন দূর নয়।

কুকুরটার জন্যেই এখন ধবলি মহল্লায় বেশ আতঙ্ক। সবাই নজর রাখছে, সাবধান হয়ে ঘোরাফেরা করছে। গুণেনও।

এই বৃষ্টি বাদলায় অনর্থক আর বসে থেকেও লাভ নেই। খদ্দের কোথায়? বিকেল থেকে বসে বসে ছ’ সাত টাকা মাত্র বিক্রি!

গুণেন দোকান বন্ধ করে উঠে পড়ার তোড়জোড় ছিল। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আবার খানিকটা শীতও ফিরে এসেছে। গরম চাদর, মাফলার ছাতা সব গুছিয়ে নিল গুণেন। বাজারে গিয়ে শেয়ারের টাঙা ধরবে। এই বেয়াড়া দিনে মাইল দেড়েক হাঁটা সম্ভব নয়।

দোকান বন্ধের মুখে ত্রিলোকী এল। গুণেনের প্রায় বন্ধুর মতন। দোকানে উঠে হাতের ছাতা রাখতে রাখতে আলগা মুখে বৃষ্টিবাদলা, আবহাওয়াকে গালাগাল দিল ত্রিলোকী। তারপর বলল, “আরে গুণিনবাবু, তুমি ভেগে পড়ছ?”

ত্রিলোকী গয়া জেলার লোক। কলকাতায় ছ’সাত বছর ছিল। বাংলা বলতে তার আটকায় না। পড়তেও পারে। ত্রিলোকী এখানকার বড় স্কুলের হাইজিন টিচার। তাছাড়া, সে এই শহরের সজ্জন সমিতির এক পাণ্ডা।

গুণেন বলল, “বেকার বসে থেকে কি লাভ! তুমি কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছ মাস্টারসাহাব?”

পকেট থেকে বিড়ির চ্যাপ্টা ডিবে বার করল ত্রিলোকী। বলল, “সজ্জনঅলাদের মিটিং ছিল। রামপ্রসাদবাবুর বাড়িতে। দো চার সজ্জন আয়া, বাকি কোহি নেহি আয়া।”

গুণেন ঠাট্টা করে বলল, “যো নেহি আয়া উয়ো দুর্‌জন হ্যায়।”

ত্রিলোকী হাসল। তাদের ‘সজ্জন সমিতি’কে লোকে ‘দুর্জন সমিতি’ বলে, এখবর তার জানা।

গুণেনকে বিড়ি দিয়ে ত্রিলোকী নিজেও একটা বিড়ি নিল। ধরাল। তারপর বলল, “আরে গুণিন, তোমাদের মহল্‌লায় দো পাগলা কুত্তা এসেছে?”

গুণেন কেমন আঁতকে উঠল। বলল, “দো কোথায়, একটা কুত্তাই তো জানি।”

“আমি শুনলাম দো।”

গুণেন পাগলা কুকুরের বৃত্তান্ত দিল। দিয়ে বলল, “শালা কুকুরের জন্যে ভয়ে আছি, ভাই। এই তো এখন ভেগে পড়ছি, বাড়ি ঢুকে তবে নিশ্চিন্ত হবো।”

ত্রিলোকী কিছু ভাবছিল। বলল, “চৌধুরীজীকে খবর ভেজেছ?”

“কোন চৌধুরীজী?”

“মোহনবাবু।”

“মোহনবাবু কী করবে?”

“বন্দুক চালাবে।”

“বন্দুক আছে নাকি মোহনবাবুর?”

“জরুর। শিকারী আদমি।”

গুণেন তেমন গা দিল না। মোহনবাবু বড়লোক মানুষ, বহু রকম ব্যবসাপত্র, হালে মোটর গাড়ি বেচবার কারবার করছে, তার বয়ে গেছে ধুবলি মহল্লায় গিয়ে কুকর মারতে।

থানার কথা তলল গুণেন, মহল্লার ক’জন থানায় গিয়েছিল। থানা থেকে বলেছে, কুকুর পাহারা দেবার লোক তাদের নেই, তোমরাই মেরে ফেল কুকুরটাকে। আর মিউনিসিপ্যালিটি বলেছে এখন ধাঙড় ধর্মঘট চলেছে। তারা ব্যস্ত। তবে যে-লোক কুকুর মারবে তাকে পঁচিশ টাকা বখশিস দেবে তারা।

ত্রিলোকী থানা আর মিউনিসিপ্যালিটিকে গালাগাল দিল। সবই শালা এক জাতের।

দোকান বন্ধ করল গুণেন।

রাস্তায় নেমে ত্রিলোকী বলল, “আরে গুণিন, যমুনাবাবুকে জানো তুমি?”

“যমুনাবাবু!”

“রেলকা যমুনাবাবু!”

গুণেন হেসে ফেলল। “যামিনীবাবু। রেলের মালগুদোমে কাজ করে।”

“হাঁ হাঁ। যামিনীবাবু।” বলে ত্রিলোকী একটু যেন দোনামোনা করল, করে বলল, “যামিনীবাবুকা বড়া লেড়কিকা হুয়া কিয়া?”

অবাক হল গুণেন, ত্রিলোকীর দিকে তাকাল। ত্রিলোকী হাসিতামাশা, আলগা গালিগালাজ করে, কিন্তু তার কোনো দোষটোষ নেই, বরং সাধারণ পাঁচটা গুণ আছে। ত্রিলোকীর স্বভাব ভাল। তার হঠাৎ যামিনীবাবুর মেয়ের খোঁজ কেন?

গুণেন বলল, “কেন, কী হয়েছে?”

“খবর জানো না?” ত্রিলোকী নিজেই অবাক।

“না।”

“ওহি লেড়কি তো হাসপাতালমে।”

“হাসপাতাল?” গুণেন কেমন চমকে উঠল।

“কাপড়ামে আগ লাগিয়েছে।

“কখন?”

“কাল!”

“পুড়ে মরেছে, না, বেঁচে আছে?”

“বেঁচে আছে। মগর পা, হাতভি পুড়লো।”

“তুমি দেখেছ?”

“না রে ভাইয়া। অনাদি-মাস্টারসে শুনলাম।”

গুণেন ব্যাপারটা ধরতে পারল না। যামিনীবাবুর মেয়ের বয়েস বেশি নয়, কুড়িটুড়ি হবে বড় জোর। এটি তাঁর প্রথম পক্ষের। দ্বিতীয় পক্ষের বোধ হয় গোটা দুই তারা আরও ছোট। যামিনীবাবু মাঝে মাঝে সংসারের সুখ দুঃখের গল্প করতেন। মেয়ের বিয়ে নিয়ে ভাবছিলেন খুব।

সদর বাজারের মুখে এসে ত্রিলোকী দাঁড়াল।

“গুণিন,” ত্রিলোকী বলল।

“বলো!”

“উয়ো লেড়কি ছিনার ছিল?”

‘ছিনার?”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ।”

মাথা নাড়ল গুণেন। সে জানে না। যামিনীবাবুর মেয়ে ছেনাল ছিল, না, অন্য কোনো ব্যাপার ঘটে গেছে সে কেমন করে জানবে!

কী মনে করে ত্রিলোকী বলল, “আমাদের গাঁওয়াইয়া এক গানা আছে, গুণিন। ধুনারিঅলা যব তুলোমে ধুন লাগায়, তব তুলো ওড়ে। ছুকরিরা যব যুবতী হয়ে ওঠে, তব ভি ধুন লাগায়, নাগিচ যেতে নেই। তুমি সেটা আঁখসে দেখতে পাবে না। হাজারো রঙ্গ তখন হাওয়ামে ওড়ায়। মালুম?”

বৃষ্টি এল আবার। ঝিরঝির বৃষ্টি। গুণেন আর দাঁড়াল না। ছাতা খুলে এক্কার খোঁজে এগিয়ে চলল। ত্রিলোকী বলল, কুকুর মারার জন্যে সে মোহনবাবুকে বলবে। গুণেন কানে কথাটা শুনল।

ত্রিলোকীও তার পথ ধরল।

বাড়ি এসে গুণেন হাঁফ ছাড়ল। টাঙা থেকে নেমে তাকে অনেকটা হাঁটতে হয়, গলিটলির মধ্যে দিয়ে। এই রকম এক বেয়াড়া দিন, তার ওপর রাত হয়ে আসছে, অন্ধকারও বেশ, পথে লোকজন না থাকার মতন। কুকুরটার জন্যেই ভয়। কখন, কোন গলিখুঁজি থেকে অন্ধকারে তেড়ে আসবে কে জানে।

সদর বন্ধ করে ঈশানী ততক্ষণে ভেতর উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

গুণেন বলল, “এ-বেলা কিছু হয়নি তো?”

“না; শুনিনি।”

“দেখেছে কেউ কুকুরটাকে?”

“জানি না। শুনিনি।”

গুণেন উঠোনের একপাশে ভেজা ছাতাটা মেলে দিল; জুতো খুলে রাখল। উঠোনেরই এক ধারে কাঠের একটা বড় প্যাকিং বাক্স। তার ওপর সংসারের পাঁচ রকম জিনিস। ঈশানী বাক্সটার সামনে দাঁড়িয়ে লণ্ঠন জ্বালল। জ্বেলে গুণেনের ঘর খুলে লণ্ঠনটা রেখে এল।

গায়ের গরম চাদরটা ঝেড়ে নিচ্ছিল গুণেন। সামান্য একটু ভিজেছে।

“চা খাবে?” ঈশানী জিজ্ঞেস করল।

“দাও। একটু আদা দিও।”

“আর কিছু খাবে? মুড়িটুড়ি?”

“না, আর কিছু নয়।

গুণেন নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। আলোটা উঁচুতেই রেখে গিয়েছে ঈশানী। জানলো খোলেনি।

জামাকাপড় ছেড়ে ঘরের পোশাকটা পরল গুণেন। লুঙ্গি আর তুলো-ধরানো গেঞ্জি। ঘরের মধ্যে খুব একটা শীত লাগার কথা নয়।

হাত পা ধুয়ে এসে গামছায় মুখ মুছছে গুণেন, ঈশানী চা নিয়ে এল।

“আজ সব চুপচাপ কেন।” গুণেন বলল।

ঈশানী প্রথমটায় কোনো সাড়া দিল না। গুণেনের হাত থেকে গামছাটা নিয়ে দরজার মাথায় রেখে দিল। পরে বলল, “ঘুমোচ্ছে।”

‘বিকেল থেকেই?”

“না। বিকেলে হরিপদ এসেছিল। তার সঙ্গে বকবক করল। সন্ধের মুখে ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“আফিং খেয়ে?”

মাথা নাড়ল ঈশানী।

গুণেন আর কিছু বলল না। চা খেতে লাগল।

চলে গেল ঈশানী।

চা খেতে খেতে অন্যমনস্কভাবে গুণেন তার ঘরটা দেখল। দেখার মতন কিছু নেই; সাধারণ ঘর, কোনো রকমে ইট-বালি দিয়ে দাঁড় করানো, মাথার ছাদ উঁচু-নিচু, বর্ষাকালে জল চোঁয়ায়। এই দুদিনের বৃষ্টিতে জলের ছোপ ধরেছে। জানলা মাত্র দুটো, একটা বাইরের দিকে, অন্যটা ভেতর দিকে। বাইরের জানলা খুললে এঁদো পুকুরের খানিকটা অবশ্য দেখা যায়। ময়লা জল, ধুবলি মহল্লার, যত রকম আবর্জনা পড়ে পড়ে জলের ওপর নীলচে এক সর পড়ে গিয়েছে। বাতাস দিলে বিচ্ছিরি এক দুর্গন্ধ ভেসে আসে।

জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখার মতন কিছু নেই, খাপছাড়া দু’ চারটে বাড়ি, এঁদো পুকুরের খানিকটা আর বিশাল এক বট গাছ। ঘরের ভেতরেই বা দেখার কী আছে। গুণেনের মামুলি বিছানা, পুরনো এক টেবিল, একপাশে রাখা একটা ট্রাঙ্ক, দেওয়ালে গাঁথা কাঠের আলনা, একটা কাঠের চেয়ার। আর সামান্য কিছু টুকিটাকি।

এই ঘরে গুণেনের প্রায় বছর পাঁচ কেটে গেল। এসেছিল যখন তখন তার বয়েস ছিল সাতাশ আটাশ আর আজ তো তেত্তিরিশের গায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কী দরকার ছিল তার আসার, আর কেনই বা সে পড়ে থাকল এই আস্তাকুঁড়ে!

চা শেষ করে গুণেন কাপটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। তার বিড়ি-সিগারেট জামার পকেটে। জামার পকেট থেকে বার করে নিল জিনিসগুলো। বিড়ির বান্ডিল স্যাঁতসেঁতে হয়ে গিয়েছে, উনুনের পাশে একটু রাখতে হবে।

একটা সিগারেটই ধরিয়ে নিল গুণেন। নিয়ে কি মনে করে বাইরের জানলাটা খুলে দিয়ে দাঁড়াল। সেই একই রকম টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। হয়ত সামান্য জোরে। মিহি, একঘেয়ে শব্দ হচ্ছিল বৃষ্টির। বাইরে বড় অন্ধকার। কাছাকাছি বাড়ির আলো দু-এক জায়গায় চোখে পড়ছে। পুকুরটা দেখা যায় না। বটগাছটা কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এই বৃষ্টির কোনো সুগন্ধ নেই। ভেজা স্যাঁতসেঁতে মাটির যেমন গন্ধ, সেই রকমই! বরং শীতটা আছে। কিংবা রাতের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। কেউ বলতে পারে না, মাঝরাতে আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে কিনা!

জানলাটা বন্ধই করে দিচ্ছিল গুণেন, হঠাৎ তার মনে হল, কুকুরটা কি ওই এঁদো পুকুরের কোথাও গিয়ে আস্তানা গেড়েছে!

অসম্ভব নয়।

ওই পুকুরের এক পাশে একটা ইটের ভাঙাচোরা ঘর ছিল। কেন ছিল কেউ জানে না। শোনা যায়, অনেক কাল আগে—পুকুরটা যখন বড় সড় ছিল, কে যেন ওখানে একটা ছোট মন্দির করেছিল। এখন ওটা ভাঙা ইটের পাঁজা।

গুণেন খানিকটা সন্দেহ এবং উদ্বেগের চোখে পুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকল। কুকুরটা যদি চালাকি করে ওখানে আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে গুণেনদের বড় কাছাকাছি রয়েছে। পাড়ার লোকজনদের কাল একবার বলতে হবে।

পায়ের শব্দে মুখ ঘোরাল গুণেন। ঈশানী ঘরে এসেছে।

“কাল একবার পোস্টাফিস যেতে পারবে?” ঈশানী বলল।

“পোস্ট অফিস। কেন?”

“একশোটা টাকা তুলতে হবে।”

গুণেন জানলা বন্ধ করে ঘরে দাঁড়াল। মশা আসছে। এই সময়টা বড় বেশি মশার উৎপাত। বলল, “দরকার পড়লে যাব। তা হঠাৎ শ’খানেক টাকা কী করবে?”

“জানি না।”

“জানি না!”

গুণেন তেমন অবাক হল না। বলল, “ও চেয়েছে?”

মাথা নাড়ল ঈশানী। হ্যাঁ।

গুণেন বিরক্ত হল। “এত টাকা ও কেন চায়? সেদিনও দেড়শো টাকা তুলে এনে দিয়েছি।”

“কেন চায় আমি কেমন করে বলব!”

“তুমি জানো।”

“না।”

“মিথ্যে কথা বলো না। একটা নুলো ল্যাঙ্‌ড়া টাকা নিয়ে বাইরে গিয়ে হাওয়ায় ওড়াচ্ছে নাকি যে তুমি জানবে না?”

ঈশানীও অসন্তুষ্ট হল। রুক্ষ চোখ করে বলল, “টাকা তোমার নয়, আমারও নয়। যার টাকা সে যদি তার টাকা নিয়ে হরিলুট দেয়, তোমার কী!”

“হরিলুট দেবার মতন লোক ও।” গুণেন ঘৃণার মুখ করে বলল। গলা সামান্য চড়ে গিয়েছিল তার। কর্কশ শোনাচ্ছিল। “এই টাকা নিয়ে ও সুদে খাটায়। বাড়ির মধ্যে শুয়ে শুয়েও নুলোর পয়সা রোজগারের ধান্ধা! টাকা নিয়ে ও স্বর্গে যাবে!”

ঈশানীও রুক্ষ হল। বলল, “স্বর্গে যাক আর নরকেই যাক—সে তার কপালে যাবে। তাতে তোমার কী!”

“আমার কিছু নয়। আমি ওর টাকার পুঁটলি বইতে পেছন পেছন যাব না। কিন্তু একটা কথা তোমায় সাফ বলে দিচ্ছি, টাকা এখন তোমার নামে। পোস্ট অফিসের খাতায় তোমার নাম। তুমি যদি ওর হুকুম মেনে চলো, তোমায় পস্তাতে হবে।”

ঈশানী কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠোঁটের ডগায় সামলে নিল। চুপ করে থাকল সামান্য। মুখের রুক্ষ শক্ত ভাব মোলায়েম করার চেষ্টা করল। মুখ তেমন নরম হল না, হাসির ভাব এল সামান্য। ঈশানী বলল, “আমায় পস্তাতে হবে না।”

“হবে না? কেন?”

ঈশানী চুপ করে থাকল।

গুণেন বলল, “তুমি ভাবছ তোমার অনেক আছে।”

ঈশানী ঠোঁট বুজে চাপা হাসল। চোখ ঝকঝক করে উঠল সামান্য। বলল, “না, তা ভাবছি না।”

“তবে?”

“তুমি তো আছ।”

গুণেন কথা বলতে পারল না। ঈশানী কেমন নির্বিকার। সহজ স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে। মিলের ছাপা শাড়ির আঁচল পায়ের কাছে নেমেছে, গোলগাল মুখ ঢলঢলে গা গতর, বড় বড় চোখ, বাঁ-গালে বড় মতন আঁচিল, কপাল বড় দেখাচ্ছিল, টান করে খোঁপা বাঁধা।

ঈশানী আরও একটু সহজ করে হাসল। “আসি, রান্নাঘরে কাজ রয়েছে।”

চলে যাচ্ছিল ঈশানী। গুণেন হঠাৎ বলল, প্রায় ছেলেমানুষের মতন, “আমি আর থাকব না।”

দাঁড়াল ঈশানী। দেখল গুণেনকে। তারপর দু’হাত তুলে আঙুলগুলো দেখাল। বলল, “এই এক কথা কতবার বলেছ তুমি। আগে গুনে রাখতাম। এখন আর আঙুলে ধরে না।”

আচমকা যেন গালে চড় খেল গুণেন। মাথা গরম হয়ে উঠল। চোখমুখ জ্বলছিল। ঈশানী তাকে যখন অপমান করে, এইভাবেই অক্লেশে অসঙ্কোচে করে। মনে হয়, গুণেন যেন ঈশানীর করুণাপ্রার্থী হয়ে পড়ে আছে।

গুণেন কিছু বলতে যাচ্ছিল, রাগের মাথায়, দেখল—ঈশানী বাঁ হাতে আলগা আঁচল তুলে নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

দাঁড়িয়ে থাকল গুণেন। সিগারেট কখন ফুরিয়ে নিবে গেছে হাতের আঙুলে। টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর আর কিছু করার না পেয়ে বিছানায় বসল।

নিজেকে অজস্রবার ধিক্কার দিয়েছে গুণেন। বহুবার তার মনে হয়েছে, আজ পাঁচ-পাঁচটা বছর ধরে সে যে-ধরনের জীবন কাটাচ্ছে তার চেয়ে হীনতার জীবন আর হয় না। কেন সে এই ভাবে ঈশানীর কাছে পড়ে আছে? কিসের দায় তার?

কোনো দায় নেই; থাকার কথাও নয়। এবাড়িতে আসার আগে গুণেন ঈশানীকে দেখেনি। ওই যে নুলো-ল্যাঙড়া লোকটা পাশের ঘরে পড়ে আছে, তাকে ছেলেবেলায় এক-আধবার দেখেছে। ভজুডিতে যে পিসির কাছে থাকত গুণেন সেই পিসিই একদিন বলল, ‘যা না কেদারের কাছে। দেখ গিয়ে যদি কিছু হয়। পুরুষ মানুষ ঘরে বসে সিঁথি কাটলে কি চাকরি জোটে!’ যাচ্ছি, যাব করে গুণেন আরও কিছু সময় কাটাল। তার নিজের ঘরবাড়ি বলতে কিছু নেই। সৎ মা, গোটা দুয়েক হাড়হারামজাদা বৈমাত্রেয় ভাই-বোন, অহরহ চুলোচুলি। সৎ মায়ের জলের টান তখনও ফুরোয় নি, এ ও মাঝে মাঝেই তদারকি করতে আসত। ব্যাপারটা ভাল দেখাত না। গুণেন বেশি ঝা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে না গিয়ে ভজুডিতে পিসির কাছে চলে যায়।

পিসিই তাকে পাঠাল। সে বেচারির নিজেরও আর চলছিল না। একটি মাত্র ছেলের সামান্য রোজগারে কত দিন বাইরের লোককে পোষা যায়!

কেদার হল আর-এক পিসির ছেলে। একেবারে নিজের ঠিক নয়, তবু আত্মীয়। গুণেন ভেবেছিল, একবার গিয়ে পড়লে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। আশে পাশে ছোটখাট অনেক কোলিয়ারি, যেমন-তেমন চাকরি কি আর একটা জুটে যাবে না?

খুঁজে খুঁজে কেদারদার কাছে। তখন সে নুলো-ল্যাঙড়া নয়। কিন্তু শরীর যে ভেঙে যাচ্ছে সেটা চোখে পড়ে। অথচ শরীর ভাঙার বয়েস হয়নি।

কেদারদারও ঠিক মনে পড়ছিল না, গুণেনকে একটু ঘেঁটেঘুঁটে মনে করাতে হল। তারপরই বলল, “ওরে শালা কার্তিক, তুই চাকরি খুঁজতে এসেছিস! তা চাকরি না খুঁজে যাত্রা পার্টিতে গিয়ে ঢোক না। চেহারাখানা তো বেহন্নলার মতন করে রেখেছিস!”

মুখের ভাষাটা ওই রকমই। কোনো বাদ-বিচার নেই। কিন্তু মন অন্য রকম। কেদারদার বাড়িতে আশ্রয় পেল গুণেন। আর পেল ঈশানীকে।

প্রথম দিকটায় একেবারেই খারাপ লাগেনি। বরং কেদারদা একটু বেশি রকম মায়া মমতা দেখাচ্ছিল। আজ একজোড়া ধুতি এনে দেয়, আর একদিন জামা তৈরির কাপড়, হাতে দশ পনেরোটা টাকা দিয়ে বলে যা একজোড়া চটি কিনে নিস।

গুণেন নিজে খুঁজে খুঁজে একটা চাকরিও যোগাড় করে নিল কোলিয়ারিতে। খানিকটা দূর। বাসে এক্কায় যেতে হয়।

দু চার মাস আরও কেদারদার বাড়িতে থেকে কোলিয়ারির কাছাকাছি কোথাও চলে যাবে গুণেনের সেই রকম ইচ্ছে ছিল। থাকা-খাওয়ার একটা ব্যবস্থা না করে যায় কোথায়!

যাব-যাচ্ছি করেও যাওয়া হয় না। পছন্দ মতন থাকার ব্যবস্থা যদি হয়, কেদারদা যেতে দেয় না। “কোথায় যাবি, শালা! বেশ তো আছিস আমার ঘাড়ে। ঈশানী তোকে কত তোয়াজ করে খাওয়ায় বল! সুখে আছিস, থেকে যা। যেদিন সুখ ফুরোবে, পালাস।”

গুণেন নিজেও বুঝতে পারছিল, তার যাবার ইচ্ছেটা আন্তরিক নয়, লৌকিক। সাত আট মাইল রাস্তা আসা-যাওয়া করার ধকল আছে ঠিকই, সকালে যাও, সন্ধের মুখে ফেরো। এ বাড়ির আরাম-আয়াস আলাদা। ঈশানী তাকে তোয়াজেই রাখে।

ঈশানীর সঙ্গে একটা সম্পর্ক যে গড়ে উঠেছে এটা সে বুঝতে পারত। এত ধীরে, এমন নিঃসাড়ে যে বাইরে থেকে কিছু বোঝা যেত না। বাইরে থেকে মনে হত, দুজনের সম্পর্কটা সাংসারিকভাবে সরল, আশ্রিতকে উপেক্ষা অবজ্ঞা না করে ঈশানী বরং বেশি খাতির যত্ন করে এই মাত্র। এর বাইরে যা—তা হল হাসি-তামাসা, রঙ্গ-রসিকতা। তা সম্পর্কে গুণেন তো দেওর হল ঈশানীর, ওটুকু থাকবে বইকি।

ভেতরে যা ঘটছিল তা অন্য রকম। ঈশানী বলত ঠাট্টা করেই “তুমি বাপু সত্যই গুণধর, সিঁধকাঠি নিয়ে ঢুকেছ নাকি গো?”

গুণেন চোর হয়ে বাস্তবিক এ বাড়িতে ঢোকেনি। কিন্তু দিনে দিনে সে চোর হয়ে যাচ্ছিল। হচ্ছিল নানা কারণে। তার মধ্যে একটা কারণ হল, কেদার আর ঈশানীর সম্পর্ক। প্রথমে না হলেও পরে গুণেন স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিল, ঈশানী কেদারদার ঠিক ঠিক দ্বিতীয় পক্ষ নয়। কোনোভাবে, কোথাও থেকে জুটিয়ে নেওয়া। বেমানান বয়েসের জন্যে নয়, এমনিতেও দুজনের আচার-আচরণ দেখলে সেটা বোঝা যেত। অন্তত কাছাকাছি থেকে গুণেন সেটা বুঝতে পেরেছিল।

একদিন ঈশানীকে নিয়ে গুণেন গিয়েছিল ঝিমলিতলাওয়ে মাথিয়াবাবাকে দেখতে। বাবা বসে থাকেন তিন দিকে মাটিতে ত্রিশূল গেঁথে তার ওপর তক্তা পেতে। পরনে কৌপিন, গায়ে রামনাম লেখা। মাথায় জটা। খুব ভিড় হচ্ছিল মাথিয়াবাবার কাছে।

ফেরার পথে সন্ধে। অনেকটা পথ। মাইল পাঁচেক। ঝোপঝাপড়া, মাঠ, টিমটিমে কোলিয়ারি, জল জঙ্গলা দিয়ে আসা। টাঙায় করে ফিরছিল দুজনে। অন্ধকারও যেন সব দিক ঢেকে আছে।

এ-কথা সে-কথা, কখনো চুপচাপ, কখনো ঘোড়ার পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না, মাঝে-সাঝে টাঙাঅলা গুনগুন করে তুলসী গাইছে, হঠাৎ ঈশানী গুণেনের হাত টেনে নিয়ে কোলের ওপর চেপে রাখল! বলল, “চোখে দিশা পাচ্ছি না, গুণধর।”

গুণেন বলল, “বড্ড অন্ধকার।”

ঈশানী বলল, “আলোতেও যে পাই না গো!”

আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ। জল জঙ্গলার গন্ধ ভারি হয়ে উঠেছিল।

গুণেন আচমকা বলল, “একটা খটকা আছে মনে। বলব?”

“খটকা?”

“তুমি কি কেদারদার…” কথাটা শেষ করতে পারেনি গুণেন, অথচ যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছিল।

ঈশানী কথা বলল না, গুণেনের হাত কোল থেকে বুকের মাঝখানে উঠিয়ে নিল। আরও চাপ দিল। জ্বরো রোগীর মতন তপ্ত হাত। অনেকক্ষণ পরে বলল, “তোমারই মতন। তোমার তবু পেছনে গিঁট আছে। আমার ছিল না। সজনপুরে এক কুঞ্জবাবু তার ঘরেদোরে আগলে রেখেছিল। তার বউয়ের সুতিকা। আজ মরে কাল মরে। বাবুর শরীর ক্ষয় হচ্ছিল। সেই বাবুর বাড়ি থেকে তোমার কেদারদা আমায় ভাগিয়ে নিয়ে আসে।”

গুণেন ঈশানীর হাতের ঘাম মাখছিল। “তোমরা বিয়ে করেছিলে?”

“না। আদরা স্টেশনে কাপড়চোপড় পাল্টে বউ সেজেছিলাম। আর কোথায় যেন, শিবমন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে সিঁদুর পরেছিলাম।”

গুণেন আর কিছু বলল না। ঈশানীও নয়।

বাড়ি ফিরে গুণেন সেদিন আরও যেন লোভীর চোখে ঈশানীকে দেখেছিল।

এইভাবেই বছর কাটল।

বছর দুইয়ের মাথায় কেদার পড়ল অসুখে। বড়সড় অসুখ বলে মনে হয়নি প্রথমটায়। জ্বর, হাতপায়ে ব্যথা। তখন শীত চলছে বলে এটা-ওটা অনেক ভাবা হয়েছিল। শেষ সন্দেহ হল, বাত। বাতের সন্দেহ মিটতে মিটতে দেরি হয়ে গেল খানিকটা, তখন জানা গেল, এ হল পক্ষাঘাত, শহরের সেরা দুই ডাক্তার বললে স্নায়ু অকেজো হয়ে পড়ছে। এটা আরও বাড়তে পারে।

কেদার বিছানা নিল। চিকিৎসাপাতি হল, লাভ ঘটল না তেমন।

সেই থেকে কেদার একরকম বিছানায়। তার লম্বা শরীরটা ভাঙতে কুঁজো হয়ে এসেছে, গায়ের মেদ উবে গেছে, সরু সরু হাত পা। বাঁ হাতটা একেবারে কাঠি হয়ে এল, বেঁকে গেল অনেকটা। বাঁ পায়েরও সেই অবস্থা। দাঁড়াতে কষ্ট হয়, বগলে ঠেকা দিয়ে দু চার পা হাঁটে।

কে জানত কেদারের এই অবস্থা হবে।

অসুখে পড়ার কিছু দিন পরে যখন কেদার বুঝতে পারল তার আর বাইরে যাবার উপায় নেই, বরাবরের জন্যেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা, তখন গুণেনকে বলল, “তুই চাকরিটা ছেড়ে দে গুণি; দরকার নেই তোর ছোটাছুটি করে।”

গুণেন বলল, “চাকরি ছেড়ে তারপর—?”

“দোকানে বোস।”

ঈশানীর মুখ থেকে আগেই খানিকটা শুনেছিল গুণেন, অবাক হল না, বলল, “আমিও পারব কেন? তা ছাড়া, আমি কোবরেজ নই।”

“আমি শালাই কি কোবরেজ। তোর কাছে কেউ নাড়ি টেপাতে আসবে না। সে যারা যাবার তারা বুড়ো গোপীনাথজির কাছে যাবে। তুই শুধু শিশি বোতল টিনের কৌটো বেচবি। ব্যস্।”

মাথা নাড়ল গুণেন। সে পারবে না। তার চেয়ে দোকান বেচে দাও।

কেদার খেপে গেল। “শালা বেহন্নলা, আমার এগারো বছরের দোকান। আমার লক্ষ্মী, আমার মা জননী। এই ঘরবাড়ি আমি ওই জননীর দয়ায় করেছি। আমার পেট পাছা বাঁচিয়েছে ওই লক্ষ্মী। তুই শালা নেমকহারাম আমায় দোকান বেচতে বলছিস! তোর এত বড় আস্পর্ধা। বেরিয়ে যা হারামজাদা আমার বাড়ি থেকে। তোর মুখে আমি লাথি মারি।” বলেই কেদারের কান্না।

গুণেন এতটা ভাবেনি। ঈশানী এসে সামলাল।

মাসখানেক লড়ালড়ি চলল। গুণেন কচ্ছি গলিতে গিয়ে কেদারের কবিরাজী ওষুধের দোকানে সকাল বিকেল বসে থাকতে রাজি নয়। আর কেদারও তার মা জননীকে বেচবে না। সারাদিন গুণেনকে গালাগাল দেয়। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলে তুই শালা দাসত্ব করবি। পাবি দেড়শো টাকা। কোলিয়ারির ধুলো খাবি, পাছায় তেল লাগাবি তোর বড়বাবুর, আট মাইল ছোটাছুটি করবি—আর এ তোর পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনাকে অবজ্ঞা করবি। মর শালা। যেমন মা তার তেমনি ছাঁ। তোর মায়েরও শুনেছি জেদ ছিল খুব।

রাত্রে ঈশানী অনেক রকম আদর সোহাগ ঢেলে দিয়ে গুণেনকে বোঝায়। “মানুষটাকে ছটফটিয়ে কি লাভ তোমার, গুণধর? মারতে চাও?”

“আমি কাউকে মারতে চাই না। দোকান চালাতে আমি পারব না।”

“গণ্ডায় গণ্ডায় তোক দোকান চালাচ্ছে তুমি পারবে না?”

“আমার পোষাবে না।”

“কেউ কি জানে কার কি পোষায়? আমার তো পোষাচ্ছে।”

“তুমি পার। আমি পারি না।”

“ওই মানুষটা তোমায় এক কথায় ঘরে ঠাঁই দিয়েছে। তোমায় ভালবাসে। ওই দোকান ও তোমায় লিখে দেবে।”

“আমি চাই না।”

“কোনোটাই চাও না?” বলে ঈশানী চোখে কেমন একটা প্রশ্ন তুলল। তুলে আড়চোখে নিজের দিকটা দেখাল।

শেষ পর্যন্ত রাজি হতেই হল গুণেনকে। কেদারের কান্নাকাটি আর সহ্য হচ্ছিল না। মানুষটা মুখ ছুটিয়ে গালাগালও যেমন দেয় তেমনই আবার হাতেপায়ে ধরতে যায়। পারে না অবশ্য। গুণেন চাকরি ছেড়ে কচ্ছি গলির দোকানে গিয়ে ঢুকল।

মন কিছুদিন মিইয়ে থাকল; রাগ হত কেদারের ওপর; গা জ্বলত। ক্রমেই সব সয়ে আসতে লাগল। বাড়িতে কেদার দোকানের পাঁচটা জিনিস শিখিয়ে দেয়। শেখাবার অবশ্য বেশি কিছু নেই। এলাহাবাদ, কলকাতা আর রানীগঞ্জ—এই তিন জায়গা থেকে ওষুধ আসে দোকানের। আসলগুলো এলাহাবাদ আর কলকাতা থেকে খুচরোগুলো রানীগঞ্জ থেকে।

একটা জিনিস গুণেন বেশ তাড়াতাড়ি বুঝতে পারল। এখানে ডাক্তার আর ডাক্তারখানা কম করেও আট দশটা, তবু কেদারের দোকানে বিক্রিবাটা বেশ ভাল। গরীবগুর্বো মানুষ, সবজিঅলা, টাঙাঅলা, মজুর ধাবড়া আর বস্তির যত লোকজন তারা সহজে ডাক্তারখানায় যেতে চায় না। পেটের ব্যথা, বদহজম, শরীরের দুর্বলতা, কার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, কার বা এটা-ওটার উপসর্গ—সব এসে কেদারের দোকানে জড় হয়। মেয়েলি রোগের দশ আনাই প্রথমে কবিরাজী ওষুধে সারাবার চেষ্টা করে এরা।

কোনো সন্দেহ নেই, দোকানটা কেদারের লক্ষ্মী।

আগে অবশ্য আরও ছিল, এখন খানিকটা পড়েছে। সুঁই নেবার ভয় কমছে গরীরগুর্বোদের, চার পয়সায় মাথা ধরার একটা বড়ি পাচ্ছে, আবার কী!

তবু কেদারের দোকান এখনও চলছে। চলবে আরও কিছুকাল।

চাকরি ছেড়ে দোকানে আসার পর থেকে দুটো তিনটে বছর কেটে গেল। এই দু’তিন বছরে কেদার আরও পঙ্গু অসহায় হয়ে পড়েছে। ডান অঙ্গেও জোর কমেছে। কোনো রকমে ধরাধরি করে নিত্যকর্মগুলো সারিয়ে আনতে হয়, নয়ত লোকটা সারাদিন বিছানায়। শরীরের থাকার মধ্যে চামড়া আর ক’টা হাড়। আর আছে গলার জোর। বিশ্রী লাগে শুনতে। মরণকালে ভীমরতি ধরে মানুষের, কেদারেরও তাই হয়েছে। আফিংয়ের নেশা বাড়িয়েছে যেমন, সেই রকম শালা, নুলো-ল্যাঙড়া লোক ডেকে এনে মহাভারত পড়ায়।

গুণেন একটা সময় পর্যন্ত কেদারকে খাতির করেছে, মান্যও করেছে। ভালবেসেছিল লোকটাকে, কিন্তু মাসের পর মাস সইতে সইতে দেখতে দেখতে এখন তার ঘেন্না ধরে গেছে। কেদারের দিকে আর তাকাতে ইচ্ছে করে না, মানুষ এত কুরূপ কুৎসিত হয়ে ওঠে কে জানত।

শুধু চেহারায় কুৎসিত নয়, বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে লোকটার মনও ইতর নোঙরা হয়ে উঠেছে। মানুষ বোধ হয় এই রকমই হয়, যতদিন বোঝে তার হাতের মুঠোয় জোর আছে, ততদিন মুঠো আলগা করতেও ভয় পায় না; যখন দেখে জোর গিয়েছে তখনই প্রাণপণে মুঠোয় ধরে রাখার চেষ্টা। কেদারেরও তাই। যখন নিজের ওপর আস্থা ছিল তখন মুঠো খুলে দিয়েছিল। গুণি, দোকান তোর, তোকে দিয়ে গেলাম, ঈশানীকে আর কে ঘরে তুলে আসন পেতে দেবে রে, এ বাড়ি ওর, আমার টাকা পয়সা ঘরবাড়ি সব তোদের।

দরাজ হাতে সব বিলি-বাটরা করে কেদার তখন ফকির হয়ে স্বর্গে যাবে বলেছিল। কিন্তু ও-সব মুখে। কাজের বেলায় কী করল? পোস্ট অফিসের গচ্ছিত টাকাটাই যা ঈশানীর নামে করে দিল। না দিলে কে ওই নুলো ল্যাঙড়াকে দেখবে! কিন্তু বাড়ি দোকান—? কেদার না দিয়েছে ঈশানীকে, না, গুণেনকে। মনে মনে কী ঠাওরেছে কে জানে। লোকটার এখন সন্দেহ কত? আফিং খেয়ে ঝিম মেরে ঘুমোয়—তবু ঝিমুনির মধ্যে নাক কান রেখে শোনে ঈশানীর সঙ্গে গুণেন কোন রসকষের কথা বলছে! গুণেনের দিকে বেশি ঘেঁষলেই ওই নুলো ঈশানীকে খেউড় করে।

আর ঈশানীও বড় অদ্ভুত। গুণেন তার আসল নকল বুঝল না। এই ঈশানীই গত বছর খাঁ খাঁ বৈশাখে কেদারকে দু দিনের জন্যে চঞ্চলাদির জিম্মায় রেখে গুণেনকে নিয়ে গিয়েছিল শ’ খানেক মাইল তফাতে মুহুলিয়ায় সর্বেশ্বরীর মন্দিরে মেলায়। বলেছিল, কেদারের নামে পুজো দিতে যাচ্ছে।

ধর্মশালায় জায়গা হল না, অশ্বথতলায় চটের ঘেরা ছাউনির তলায় একটা রাত কাটাল দুজনে। পরের দিন সকাল থেকেই শোনা গেল মড়ক লেগেছে মেলায়। বিকেলে পুলিশ এসে মেলা ভাঙতে লাগল। পালাও সব। ভাগো জলদি। ঈশানী খড়ের গাদায় বসে গুণেনের গা জাপটে বলল, “একটা কথা বলব গুণধর?”

“বলো।”

“গা ছুঁয়ে বলল, তোমার মরা মায়ের দিব্যি করে বলো, এ-কথা কাউকে বলবে না?”

গুণেন শপথ করল।

ঈশানী বলল, “যে মানুষ মরে না, যার মরা উচিত, তাকে যমের হাতে তুলে দেবার জন্যে পুজো-মানত করে, জানো?”

চমকে উঠে গুণেন বলল, “না, জানি না তো!”

“করে। লোকে বলে প্রায়শ্চিত্ত। তুই বাপু মরছিসও না, সারছিসও না। হয় মর, না হয়…। তা তোমার কেদারদার তো সারার পথ বন্ধ, লক্ষণও নেই। মরবে—তাও তো মরছে না। অথচ মরার দিকেই যাচ্ছে।” বলে ঈশানী সামান্য চুপ করে থেকে বলল, “আমি আজ সেই পুজোই দিয়ে এসেছি। আর আমি পারছি না!”

গুণেন পাথর হয়ে গেল যেন। বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঈশানী এসেছিল আরোগ্য কামনা করতে, করে গেল মৃত্যু কামনা?

অনেকক্ষণ পরে গুণেন বলল, “এ-সব হয় না। এ আমি বিশ্বাস করি না।”

“হয়ত হয় না। যদি হয়—!” বলে ঈশানী গুণেনের দু হাত টেনে নিয়ে বুকে চেপে রাখল। গা পুড়ে যাচ্ছে ঈশানীর।

ঈশানী নিজেই মরতে বসেছিল। মড়কের মাঠে শেয়াল কাঁদছে সারা রাত। এক-গা জ্বর, চলতে পারে না, তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে—সেই ঈশানীকে নিয়ে বন জঙ্গল রোদ, ধুলো শতেক বাধা পেরিয়ে মাইল দুই পথ হেঁটে এসে বাস। বাসের মাথায় লোক, পাটাতনে লোক। ওরই মধ্যে কোনো রকমে দু হাতে জাপ্টে ঈশানীকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছিল গুণেন।

বাড়ি এসে কদিন বেঘোর জ্বর।

ভাল হয়ে উঠে ঈশানী একদিন বলল, “সেই সুতলিটা আমার খোয়া গেছে গুণধর?”

“কোনটা?”

“যেটা ওর হাতে বাঁধব বলে নিয়েছিলাম।”

“ভালই হয়েছে।”

“কার ভাল! ওরও নয়, তোমার আমারও নয়।”

“তবু তো ওটা পাপ।”

“মুখে বললে। মনে ভাবলে নয়। …তোমার সঙ্গে পাপ করে গা ধুয়ে শাড়ি ছেড়ে ওর খোঁড়া পায়ে কোবরেজী তেল মাখাই যে আমি। আমার দু তরফেই পুণ্যি। তাই না?”

গুণেন চুপ।

অনেকক্ষণ পরে ঈশানী বলল, “রাগ করো না, গুণধর! তোমায় সত্যি করে বলছি, একজন আমায় উঠিয়ে এনেছিল আরেক জনের কুঞ্জ থেকে, তুমি আমায় সেদিন তার চেয়েও বড় জায়গা থেকে তুলে এনেছ, মড়কের মাঠ থেকে। আমি তোমায় কেমন করে ফেলব গো?” বলে ঈশানী হেসে উঠে আচমকা গুণেনের গালে চুমু খেল।

এই তো ঈশানী। তার আসল নকল ধরা যায় না।

গুণেনের এখন আফসোস হয়; আফসোস, দুঃখ, রাগ। নিজের ওপরই ঘেন্না জাগে। কেন সে কেদারের কথায় রাজি হল? চাকরি-বাকরি ছেড়ে কেদারের দোকান নিয়ে বসা মানেই তার নিজের খুঁটি ভেঙে গেল। তখন মাঝে মাঝে মনে হত, কেদারের মতন অক্ষম অসহায় অথর্ব মানুষটাকে বুঝি গুণেন বাঁচিয়ে দিল, সে যতটুকু কৃতজ্ঞ কেদারের ওপর, তার অনেক বেশি ফেরত দিল দোকানটা হাতে নিয়ে। এখন মনে হয়, গুণেন মস্ত বড় ভুল করেছে। সে কেদারের ফাঁস গলায় পরে ওর পোষা কুকুর হয়ে গেছে। একদিকে কেদারের দোকান, অন্যদিকে ঈশানী—এই দুইয়ে মিলে গুণেনের সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছে। গুণেন এখন মনে মনে কী চায় সে জানে!

গুণেনের সব কিছু খোলাখুলি প্রকাশ হয়ে পড়েছে বলেই আজ ঈশানীর এত তেজ। গ্রাহ্য করছে না গুণেনকে। মুখের ওপর অপমান করছে। ভাবছে, এই পোষা কুকুরটার অন্য কোথাও যাবার উপায় নেই।

সত্যিই কি গুণেন পোষা কুকুর হয়ে গেছে?

পরের দিন দুপুরে দোকান থেকে বাড়ি ফেরার সময় গুণেন পোস্ট অফিস থেকে তুলে আনা টাকা আর পাস বইটা সরাসরি কেদারের কাছে গিয়ে রাখল।

আজ সকাল থেকেই রোদ উঠে গিয়েছে। বাদলা পালিয়ে যাওয়ায় শীত যেন আরও একটু বেড়েছে। দু’একদিন থাকবে, তারপর পালাবে।

কেদারের স্নান খাওয়া শেষ। তার পুরু বিছানায় তুলোর ফতুয়া গায়ে দিয়ে কেদার গোটা তিন-চার হরেক রকম বালিশ ভর করে বসেছিল। মাথা প্রায় নেড়া কেদারের, আজকাল আর চুল রাখতে পারে না মাথায়। লুঙ্গির মতন করে পরা খাটো ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত। তার ওপর হালকা কাঁথা চাপানো। কেদারের মুখ আর মরা মানুষের মাথার খুলির মধ্যে বিশেষ কোনো তফাত নেই, নিতান্ত যেন চামড়াটা এখনও রয়েছে তার।

কেদার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। কিছু দেখছিল বোধ হয়।

গুণেন চলে আসছিল। হঠাৎ বলল, “খাতাটা একবার দেখে নিও।”

কেদার ডাকল। “কত আছে?”

“তুমি দেখে নিও।”

“কেন রে শালা, তোর চোখ নেই? তুই দেখতে পারিস না?” কেদার খেঁকিয়ে উঠল।

“আমি দেখিনি। তোমারও তো চোখ আছে। দেখে নাও না।”

কেদার বলল, “আমার চোখ আছে বইকি রে, হারামজাদা। চোখ আছে বলেই তো দেখছি। ক—ত রকম দেখছি।”

গুণেন দাঁড়াল না। সারা ঘরে ওষুধ, মালিশ, তেল আর কাঁথা কম্বলের গন্ধ, বমি আসে গুণেনের। বাইরে উঠোনে এসে গুণেন শুনল ভেতর থেকে কেদার বলছে, “ভগবান আছে বুঝলি রে শালা, সব দেখছে। আমি অন্ধ হলেও সে দেখছে।”

কিছুই বলল না গুণেন।

স্নান-খাওয়া শেষ করে, খানিকটা বিশ্রাম সেরে বিকেলের গোড়ায় আবার দোকান যাচ্ছিল গুণেন, ঈশানী অবেলার হাই তুলতে তুলতে বলল, “ফিরবে কখন?”

কথার জবাব দেবে না ভেবেছিল গুণেন; তবু দিল। “দেরী হবে।”

“দেরী কেন?”

“এক জায়গায় যাব।”

“কোথায়?”

“রেলের যামিনীবাবুর বাড়ি।”

“সেখানে কী?”

“শুনলাম ওঁর বড় মেয়ে আগুনে-পুড়ে হাসপাতালে রয়েছে। কেমন আছে খবর নিয়ে আসব।”

ঈশানী কেমন করে যেন চাপা ঠোঁটে হাসল। “কে তাকে পোড়াল? তুমি?”

গুণেন তাকাল। চোখ দেখল ঈশানীর। তারপর বলল, “যা ভাব তাই। সবাই তোমার মতন নয়।”

হেসে ফেলল ঈশানী। বলল, “তা তোমার ইচ্ছে। তবে বেশি রাত কোরো না। কুকুরটা আবার আজ দেখা দিয়েছে। সাবধানে ফিরো।”

গুণেন উঠোন দিয়ে সদরে নেমে গেল।

ফিরতে রাতই হয়ে গেল গুণেনের। বোধ হয় দশটা বাজতে চলেছে। টাঙা থেকে নামল গুণেন। আজ সে টাঙায় একা।

বড় রাস্তা প্রায় ফাঁকা, এক-আধটা টাঙা কি ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। গলির মুখে দাঁড়িয়ে একবার চারদিক ভাল করে দেখবার চেষ্টা করল। দেখতে পেল না, তার চোখ কেমন টেনে যাচ্ছে। পাতা বুজে আসছে। ঘুম পেয়েছে যেন বড়। হাত পা শিথিল।

শীতটা আবার জাঁকিয়ে এল নাকি? হাওয়া দিচ্ছে ঠাণ্ডা। গুণেনের অবশ্য শীত করছিল না। বরং ভেতরে সে সামান্য ঘামছিল। গায়ে একটা গরম চাদর ছিল, চাদরটা এখন কাঁধে, এলোমেলো। গলিতে একটাও লোক নেই। বাড়িঘরের দরজা বন্ধ। বাতিটাতি কোনোকালেই নেই। অন্ধকারে কেমন যেন টলতে টলতে, অবশ পায়ে গুণেন এগিয়ে চলল।

মানুষজন নেই, অন্ধকার ঘুটঘুটে গলি—তবু বাড়ির মধ্যে থেকে মাঝেসাঝে সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল।

গুণেন একটা মোড় ঘুরল। ঘাঁটিদের বাড়ি। সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা। মশলাপাতি, গুড়, ছোলাদানার পাইকারি ব্যবসা করে। টাকাপয়সা করেছে প্রচুর। বড় ঘাঁটির দুটো বউ। আট দশটা ছেলেমেয়ে।

হাসি হাসি পাচ্ছিল গুণেনের। কিন্তু অন্ধকারটা বড় বেশি। চোখে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা সিগারেট ধরাবে নাকি? অবশ্য চোখ থাকলেই বা কতটা দেখা যায়? বরং চোখ না থাকলেই ভাল। সোজা হেঁটে যাও, বরাতে যা আছে হবে।

সিগারেট ধরাবার জন্যে গুণেন পকেটে হাত দিল। হাত দিতেই চাবির গোছা আঙুলে ঠেকল। দোকানের চাবি। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। শালা। দোকান তো ওই, মৃতসঞ্জীবনী, সালসা আর মেয়েদের অশোকারিষ্ট বেচে চলে—সেই দোকানের চার পাঁচটা তালা। ভারি ভারি। গুণেন চাবির গোছাটা বার করে নিল। হাতে নাচাল।

আজ এই চাবি সে কেদারের মুখের ওপর ছুঁড়ে দেবে। শালা নুলো, ল্যাঙড়া—তুমি গুণেনকে গোলাম করতে চেয়েছিলে? লোভের গোলাম? পেটের গোলাম? গুণেন আর থোড়াই তোমার গোলামি করবে।

তুমি নুলো সবচেয়ে শয়তান। দু দিকে দুই পাল্লা ঝুলিয়ে রেখেছিলে, একদিকে দোকান, অন্যদিকে ঈশানী। ভেবেছিলে, গুণেনের সাধ্য নেই, সরে দাঁড়ায়।

এতদিন গুণেন সত্যি সত্যি সরতে পারেনি। কিন্তু আজ সে সরেছে। কাল সকালের পর আর গুণেনকে তোমরা দেখবে না। সে চলে যাবে। এই শহর ছেড়েই চলে যেতে পারে, না হয় আপাতত অন্য জায়গায় গিয়ে থাকবে। ত্রিলোকী গুণেনকে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। এমনকি ত্রিলোকী একটা কিছু জুটিয়েও দিতে পারে। আর যামিনীবাবুর মেয়ে শেফালীকে বিয়ে করবে গুণেন। শেফালীর তেমন কিছু পোড়েনি। পায়ের দিকটাই যা ঝলসে গেছে। বাঁ হাতের সামান্য। লোকে বড় গুজব রটায়। শেফালী বৃষ্টিবাদলার দিনে তার স্যাঁতসেঁতে শাড়ি সায়া শুকোতে গিয়ে আচমকা আগুন লাগিয়ে ফেলেছিল। এ তো লাগতেই পারে।

শেফালী ডাগর মেয়ে। বছর কুড়ি একুশ বয়েস। একটু খোলামেলা মেজাজের। তা বলে, ত্রিলোকী যা বলেছিল, ছেনাল বলে শুনেছে, তা নয়। গুণেনের সঙ্গে বয়েসের বেশ তফাত হয়ে যাবে, যামিনীবাবুর সঙ্গে শ্বশুর-জামাই সম্পর্কটাও বেমানান দেখাবে, তা কি করা যাবে, সংসারে সবই কি আর মানানসই হয়! গুণেনের জীবনের সঙ্গে ওই কেদার আর ঈশানী যে জড়িয়ে গিয়েছিল—সেটা কি মানানসই ছিল?

সংসারে মানুষ কী চায় হে? দু মুঠো ডাল ভাত, মাথার ওপর একটা ছাদ। তারপর কিছু সুখশান্তি। তা হলে গুণেন আর দোষ করল কী? পেট ভরাবার একটা ব্যবস্থা করেই সে শেফালীকে বিয়ে করবে। ঘরসংসার পেতে বসবে। শেফালীর পায়ে পোড়ার দাগ থাকল, না হাতে একটু চামড়া কুঁচকে থাকল কী তার যায় আসে।

সমস্ত ব্যাপারটাই যেন ঠিকঠাক, কোথাও কিছু আটকাচ্ছে না—শুধু দু’একটা মাস মাঝখানে পড়ে আছে এই যা—গুণেন কেমন খুশী খুশী মনে মাথা দোলাল। গান গান ভাব এল তার জড়ানো গলায়, একবার গুনগুন করল, চৌদিকে কে মেরেছে বাণ…আর তো পারি না ধরিতে প্রাণ…।

হঠাৎ, একেবারে হঠাৎই গুণেন কেমন চমকে উঠল। কি যেন একটা তার গায়ের পাশ দিয়ে অন্ধকারে তীরবেগে ছুটে বেরিয়ে গেল। ছুটে যাবার শব্দ পেল গুণেন, পায়ের দিকে ছোঁয়াও যেন লাগছে। সেই কুকুর নাকি? খেপা কুকুর?

সঙ্গে সঙ্গে কেমন অসাড় হয়ে গেল গুণেন। বুক হিম হয়ে গেল। এই অন্ধকার গলি। মানুষজন নেই। কুকুরটাকে নাকি সকালে পাড়ায় আবার দেখা গিয়েছিল। যদি সেই বুনো পাগলা কুকুরটাই হয় তা হলে গুণেন এখন কী করবে? তার হাতে ছাতা লাঠি কিছুই নেই, পায়ে জোরও নেই আজ, নেশা করেছে; চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না, মাথা ভার।

গুণেন আরও ঘামতে লাগল।

অথচ দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। পালাতেই হবে। কুকুরটা যে কোনো কারণেই হোক ছুটে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। আবার এখুনি ফিরবে। মানুষের গন্ধ কুকুর চেনে।

ভয়ে গুণেন একবার চেঁচিয়ে উঠল। তারপর ছুটতে লাগল।

পা ওঠে না, দম যেন কবেই কোনকালে ফুরিয়ে গেছে। সরু নোংরা, আঁকা-বাঁকা গালি দিয়ে গুণেন ছুটতে লাগল। তার পায়ের শব্দ উঠছিল অদ্ভুতভাবে।

কুকুরটাও কি আবার ছুটে আসছে? গন্ধ পেয়ে গেছে গুণেনের?

পালাবার কোনো উপায় নেই। এই গলিতে গুণেন একা। আর ওই বুনো কুকুরটাও।

তবু গুণেন হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটছিল। ছুটতে ছুটতে পড়ল। লাগল হাতে পায়ে। আবার উঠে দাঁড়াল। খোঁড়া পায়ে, ঘামতে ঘামতে ছুটতে লাগল। বুক ফেটে যাবার মতন। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না আর।

একটা হল্‌লা জাগছে না কেন এখনও? কোথায় গেল তারা, যারা কুকুর মারার জন্যে লাঠিসোটা গুছিয়ে নিয়ে বসেছিল?

আর পারছিল না গুণেন। পা কাঁপছে, উরু-টুরু টনটন করছে, মাংসপেশীগুলো লাফাচ্ছে যেন। পায়ের গোড়ালিতে অসহ্য ব্যথা, কোমর ভেঙে পড়ছে। না, আর দম নেই গুণেনের। সে অনেক ছুটেছে। বুক ফেটে যাবে আবার।

তবু আরও খানিকটা টলতে টলতে এগিয়ে গেল গুণেন। গিয়ে দেখল, রাস্তা বন্ধ। ভুল করে সুজনচাঁদের কাঠগোলার পেছন দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে আর এগিয়ে যাবার উপায় নেই। মুখের সামনে ভাঙা টিনের বেড়া, পাশে আবর্জনার স্তূপ, কয়েকটা জংলা ঝোপের টিবি।

উপায় নেই। গুণেনকে এখানে থামতেই হবে। আর সে এগুতে পারবে না, পিছোতেও নয়। চারদিক দিয়ে সে কোণঠাসা।

তা হলে?

তা হলে আর কী? গুণেন তো শুনতেই পাচ্ছে, কুকুরটা আসছে। প্রথমবার সে ভুল কয়েছিল। পা ছুঁয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল তীরবেগে। এবার আর ভুল করেনি। আসছে আবার। মানুষের গন্ধ কুকুর ভুল করে না। নখের শব্দ হচ্ছে মাটিতে। কে জানে একটা না দুটো কুকুর? শালা একবারও ডাকছে না। শুধু ছুটে আসছে। তার ছুটে আসার শব্দ গলিটাকে আরও থমথমে করে দিয়েছে।

কুকুরটা যে আসছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। নখের ডগায় গলির মাটি খামচে সে আসছে। ছুটতে-ছুটতে।

গুণেন দেখল সে অসহায়। তার হাতে কিছু নেই। গায়ের চাদরটা কখন পড়ে গেছে। হাতের চাবিটাও। সে শুধু একা।

তা হলে ও আসুক। আসুক তবে।

গুণেন একবার শুধু বিকট করে চেঁচাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *