এরা ওরা

এরা ওরা

কাল সকাল থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রথমে এল একটা ট্রাক; তার পর খানিকটা বেলায় চার চাকার ছোট ভ্যান। মালপত্র যে অঢেল তা নয়। তবে সবই ঝকঝকে, দামি। মালের সঙ্গে চার ছ’জন করে লোক। জিনিসপত্র সাবধানে নামাল, যত্ন করে বাড়ির মধ্যে ঢোকাতে লাগল। হেমদাকান্ত তখনই স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘ভাল কাজকর্ম করে মনে হচ্ছে। রাস্তার লরি নয় বুঝলে সুশীলা, কোম্পানির ট্রাক।’

সুশীলা একটুও অবাক হলেন না। ফ্ল্যাট বাড়িতে ভাড়াটে কত আসে, কত যায়। আসার আগে ঘর-দোর পরিষ্কার করায়, চুনকাম করিয়ে নেয়। মুখোমুখি বাড়িটার দোতলার যারা আসছে তাদের কিন্তু সবই বেশি বেশি। দেওয়ালে রঙ হল, দরজা জানালা গ্রিলও বাদ পড়ল না। তারপর এল ইলেকট্রিক মিস্ত্রী। ভেতরে কী সব কাজকর্ম করল কে জানে। দিন সাতেক ধরে এই সব চলছিল। সুশীলার সন্দেহ হয়েছিল কোনো মাড়োয়াড়ি বা পাঞ্জাবি আসছে ভাড়াটে হয়ে। এই পাড়াটা তো এখন মাদ্রাজি মাড়োয়াড়িতেই ভরতি। পাঞ্জাবিও ঢুকতে শুরু করেছে।

গত পরশুই প্রথম সন্দেহ ঘুচলো সুশীলার। সন্ধের দিকে গাড়ি নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে হাজির। সঙ্গে স্ত্রী। দুজনেই ছেলেমানুষ। ছেলেটির বয়েস বছর বত্রিশ কি চৌত্রিশ, মেয়েটির আঠাশ ত্রিশ। দেখেই বোঝা গেল বাঙালী।

সুশীলা স্বামীকে বললেন, “বাঙালি গো! ছেলে ছোকরা।”

হেমদা বললেন, “হ্যাঁ, দেখলাম। ছেলেটি বেশ লম্বা। ঝরঝরে চেহারা।”

“মেয়েটিরও গড়ন ভাল। রঙ ফরসা তবে বড্ড ফ্যাশান।”

“তা যখনকার যা হাওয়া। তোমার ছেলের বউই বা কম কী যেত!”

“না বাবা, বউমার অমন মদ্দা-মদ্দা চুল ছিল না। মেয়েদের ওইরকম মাথা নেড়ানো বিচ্ছিরি লাগে।”

এ করে করে দিন সাতেক কাটল। কাল ছিল শনিবার। সকালে ট্রাক এল, বিকেলে ভ্যান। তারপর আজ সকালে আবার একটা ট্রাক। জিনিসপত্র ঠাসাঠাসি। সঙ্গে লোকলস্কর। দুপুরে একটা একটা টেম্পো করে গ্যাস সিলিণ্ডার, ফুলের টব, ঝড়তি পড়তি কিছু মাল।

বিকেলে এল নতুন ভাড়াটে। সঙ্গে বোধ হয় আত্মীয় বা বন্ধুগোছের জনা দুই।

সন্ধের মুখে ঘর গোছানো মোটামুটি শেষ।

বাইরের ব্যালকনিতে বসে ওরা তখন চা খাচ্ছে সবাই মিলে। গল্প হাসাহাসি চলছে। এমন সময় ঝপ্ করে অন্ধকার হয়ে গেল।

হেমদার কেমন দুঃখ হল, হাসি পেল। নতুন পাড়াতে এসেছে বেচারিরা। প্রথম দিনই সন্ধেবেলায় আলো গেল। ভাল লাগবে না নিশ্চয়। নতুন পাড়া, নতুন বাড়ি, হয়ত কাজকর্মও ছিল কিছু—বেচারিরা এখন ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকুক। উপায় কী?

এই রকম ভর সন্ধেতে আলো চলে গেলে হেমদার বড় ভয় হয় সুশীলাকে নিয়ে। সুশীলা একরকম অন্ধ। তাঁর ওই মোটা কাচের চশমা দিনে ভাল, আলোতেও চলে যায়—কিন্তু অন্ধকারে একেবারেই অচল। এই অন্ধকারেই সুশীলা বার কয়েক জখম হয়েছেন। একবার পড়ে গিয়ে হাত মচকেছিল, একবার কপাল ফাটিয়েছেন; আর সেদিন মোমবাতি ধরাতে গিয়ে পুড়ে মরছিলেন। কতবার তিনি বলেছেন স্ত্রীকে, আলো থাক না-থাক সব সময় যেন সন্ধের পর হাতে একটা টর্চ রাখেন সুশীলা। বলা না-বলা সমান। ভুলে যান সুশীলা, মনে থাকে না। এমনিতেও অসাবধানী। তাও যদি বুদ্ধি করে নিজে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে আর মকরকে ডেকে আলোটালো দিতে বলেন। তাও তো করবেন না। নিজেই হাতেড়ে হাতড়ে এটা ওটা করতে যাবেন আর একটা কাণ্ড ঘটাবেন। যেদিন সুশীলার কপাল ফাটল হেমদা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন খুব। অনেকটা রক্ত পড়ল। যন্ত্রণা। খুব কষ্ট পেয়েছে।

হেমদার সেদিন ভীষণ রাগ হয়েছিল। বলেছিলেন, ‘দরকার নেই আর আমার এইভাবে থেকে। ঘরবাড়ি বেচে দিয়ে চলো নিতুর কাছে চলে যাই। কোন দিন কী ফ্যাসাদ বাধিয়ে তুমি মরবে।’

এসব মুখের কথা, রাগের কথা। হেমদা যাবেন কোথায়? সারা জীবন চাকরি করেছেন রেলে। কলকাতার বাইরে ছিলেন। অ্যাকাউন্টস অফিসার। একটা ডিভিশনের দায়িত্ব। চাকরি শেষ করে জীবনের সমস্ত পুঁজি মাটির তলায় ঢেলে দিয়ে এই বাড়ি। তখন এদিককার নাম শুনলে লোকে নাক সিটকোতো। ওই স্যাঁতসেতে জমি, সারা বর্ষা জল জমে থাকে, শীত গ্রীষ্ম বলে কথা নেই, মশাই মানুষ তুলে নিয়ে যায়, কাঁচা নালা, আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা নেই, কে বাড়ি করাতে যাবে ওখানে? সবই ঠিক। কিন্তু যেটুকু ময়দা আছে হাতে সেইটুকুই তো মাখতে হবে। হেমদার যা সঞ্চয় ছিল তাতে তিনি ছিমছাম এলাকায় যেতে পারেন না। সস্তায় জমি ছিল তখন, কিনে ফেলেছিলেন। চাকরির শেষ অবস্থা চলছিল, ওপাট শেষ হল, তার পর বাড়ি। তেতলার ভিত ছিল, দোতলার পর এগুতে পারলেন না। মেয়ের দায় ছিল ঘাড়ে। তবু রক্ষে যে, মেয়ের বিয়ে এক বন্ধুর ছেলের সঙ্গে হয়েছিল। হেমদাকে ঝঞ্জাট পোয়াতে হয়নি। জামাই রেলের ডাক্তার। এখন রয়েছে দানাপুরে। আর ছেলে নিতু—মানে নিত্যপ্রিয় দিল্লিতে। চাকরি মোটামুটি ভালই করে। কলকাতাতেও খারাপ চাকরি করত না। কিন্তু তার বউ আর শশুর মিলে এমন করে নাচতে লাগল যে নিতুর আর কলকাতা, মা-বাবা কিছুতেই মন ভরল না। দিল্লি চলে গেল। আসলে নিতুর বউ শাশুড়িকে, হয়ত শ্বশুরকেও তেমন পছন্দ করতে পারছিল না। কেন পারছিল না সে নিজেই জানে। আজকালকার মেয়েরা নিজেদের অধিকারটা বেশি বোঝে, যোল আনা খাটাতে চায়। হয়ত বউমারও মনে তাই ছিল। তাছাড়া বউমার বাবা দিল্লির সরকারি অফিসের বড় চাকুরে, জামাইকে মই দিয়ে গাছে তুলতে চেয়েছেন। ছেলেরা আজকাল বউ আর শ্বশুরের, মা-বাপের নয়। কথাটা কিন্তু হেমদার নয়, হেমার এক বন্ধুর। এরকম কথা হেমদা কোনোদিন মুখে বলেননি, মনে মনে হয়ত ভেবেছেন। কেনই বা ভাববেন না, এই তো সেদিন—পুজোর সময় নিতুরা দিল্লি থেকে এল। নিতু, নিতুর বউ, দাদুভাই, টুকটুকি। দিল্লিতে থাকতে থাকতে নিতুর রঙ পরিষ্কার হয়েছে, স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে আরও, চোখমুখ অবশ্য খরখরে হয়ে গিয়েছে। বউমারও চমৎকার রঙ হয়েছে গায়ের। শরীর ভারি। তব কেমন খটখটে চনচনে ভাব হাঁটা-চলায়। ভালই তো লাগছিল বাইরে বাইরে। দাদুভাই মাত্র সাত বছর বয়সে জেন্টলম্যান। চামচ ছাড়া খাবে না, দিদার পাশে শোবে না, বাথরুমে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে দেবে। হেমদাকে বলত, বুঢ্ঢা দাদা। দুরন্তপনাও করত হেমদার সঙ্গে, এটা দাও, ওটা দাও; আমার বার্থ ডে উইন্টারে, তুমি আমায় বেবি সাইকেল কিনে দাও। হেমদার সবই ভাল লাগত নাতির। বরং টুকটুকিকে তিনি ঠিক সামলাতে পারতেন না। বড় কচি, মাত্র দু বছর বয়েস।

হেমদা আশা করেছিলেন, ছুটির পনেরো-বিশটা দিন নিতুরা এখানেই কাটিয়ে যাবে। দিন চার পাঁচ যেতে না যেতেই বউমার খুঁতখুঁতুনি শোনা যেতে লাগল। এত পাওয়ার কাট্, ঝুড়ি ঝুড়ি মশা, ড্রেনের পচা গন্ধ, হরদম মাইক বাজে, বিশ্রী। বারে বা, হেমদা যখন জমি কিনেছিলেন, বাড়ি করেছেন—তখন নিশ্চয় অনেক অব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন তো এই পাড়া রীতিমত অভিজাত। রাস্তাঘাট হয়েছে, মাটির তলায় পাইপ বসেছে মোটা মোটা, অজস্র দোকান, মিনি বাস যাচ্ছে হরদম, চাইলেই ট্যাক্সি পাবে। মশা যত ছিল ততই বা কোথায়? আসলে তোমাদের দিল্লি দিল্লি বাই হয়েছে।

হেমদা আর সুশীলা যাই বলুন, বউমার বায়না আর ঘিনঘিনে ভাব শুরু হবার দিন তিনেক পরেই নিতুরা বাক্স বিছানা গুছিয়ে চলে গেল নিউ আলিপুর, সেখানে বউমার কোন দিদি থাকে, দিন চারেক কাটিয়ে সদলবলে গেল দার্জিলিং বেড়াতে। ফেরার পথে আর এ-বাড়ি এল না। এক রাত হোটেলে কাটিয়ে সোজা দিল্লি। হেমদা ছেলের ফোন পেয়েছিলেন যাবার দিন। ব্যাস। তারপর চিঠি, পেলেন দিল্লি থেকে। নিতুরা নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছে।

তোরা নিরাপদে থাক, সুখে থাক—এর বেশি আর কী চাইতে পারেন হেমাদা আর সুশীলা।

ছেলের চেয়ে মেয়ে বরং মা-বাবার খোঁজ-খবর অনেক বেশি রাখে। মাসে কম করেও দুটো করে চিঠি। জামাইকে যদি কলকাতায় আসতে হয় কোনো কাজে কর্মে সোজা এখানে এসে ওঠে। মেয়ে বছরে দু বছরে একবার। তার সুযোগ কোথায়! স্বামীর সঙ্গে চরকি হয়ে ঘুরছে, ট্রান্সফার আর ট্রান্সফার। ছেলেপুলে বলতে একটি। সে আছে পাটনায়। পড়াশোনা তো জলে ফেলে দেওয়া যায় না।

হেমদা আর সুশীলা তাই এধরনের নিঃসঙ্গ। দুই বুড়োবুড়ির সংসার। সারাক্ষণের সঙ্গী বলতে ওই মকর। বিধবা বয়স্কা মেয়ে। সুশীলার কাছে পড়ে আছে। কাজকর্ম করে। আর শিবু বলে একটা ছেলে আছে। তার হল একবেলার চাকরি। হেমদা বলেন, পার্টটাইমের শিবু। শিবু হাটবাজার করে দেয়, চিনি গম এনে দেয় রেশন শপ থেকে; ওষুধপত্র পোস্ট অফিস মায় ব্যাংক পর্যন্ত সবই করে সে। ছেলেটা ভাল। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। এ বাড়িতে তার অবাধ গতি। মাঝে মাঝে সুশীলাকে ধমকায়, “ও দিদিমা চোখে দেখতে পাও না, পঞ্চাশ টাকার নোট দশ টাকার নোট বলে হাতে গুঁজে দাও। আমি কিন্তু কেঁপে দেব, বলে দিচ্ছি।”

সুশীলার কোনো অপ্রস্তুত ভাব নেই। শিবুর গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “তুই অন্ধদিদির পয়সা নিতে পারবি নারে নাতি। নিলেও কিছু বলব না।”

“বেশ। একদিন বুঝবে।”

হেমদার বড় মজা লাগে। আজ তাঁর হাতে কোনো ক্ষমতা নেই, দাপট নেই তাঁর। যখন ছিল—তখন শিবুকে পেলে তিনি রেলে ঢুকিয়ে দিতেন। এমন সৎ, বিশ্বাসী ছেলে আজকাল নাকি হয় না! কে বলল? হেমদা যে চাকরি করেছেন সেখানে হাতের আঙুল সামান্য মেলে ধরলেই অনেক আসত। আসতে দেননি হেমদা। তাঁর বাংলোয় বন্ধু বান্ধব ছাড়া কারও ঢোকার উপায় ছিল না। এমন কি বড়দিনে তিনি ডালিও নিতেন না। সৎ হওয়া কষ্ট, থাকাও কষ্ট, তবু কেউ কেউ তো এই কষ্ট সহ্য করে যায়। হেমাদা জন্মসূত্রে কৃশ্চান। সুশীলাও তাই। কিন্তু ওই সূত্রটুকু ছাড়া তাঁদের আর কিছু নেই। ছেলে কৃশ্চান পরিবারে বিয়ে করেছে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে হিন্দু পরিবারে। কী আসে যায়! সুশীলা বাড়িতে ঘট পট নিয়ে বসে থাকেন না, কিন্তু তাঁর অন্য সব আচার হিন্দুবাড়ির মতন। পুজোর প্রসাদ খান, মাথায় চওড়া করে সিঁদুর পরেন, কোন্ বেতো বাবার মাদুলি পরিয়েছেন হেমদাকে বাতের জন্যে।

ধর্ম নিয়ে কোনো দিন মাথা ঘামাননি হেমদা। আজও ঘামান না। যে মুগ্ধ অভিভূত বিষন্ন চোখ নিয়ে যীশুর ছবি দেখেন, সেই একই অভিভূত মন নিয়ে ‘কথামৃত’ পড়েন। মন যাঁকে শেষ পর্যন্ত অনুভব করতে চায়—তিনি তো ঈশ্বর। কে পায় তাঁকে।

কোথায় একটু আলো জ্বলতেই হেমদা কেমন আঁতকে উঠলেন। “সুশীলা?”

“এই যে…!”

“কোথায় তুমি? আবার তুমি আলো জ্বালছ?”

“আমি জ্বালিনি। মকর জ্বেলেছে।”

হেমদার বুকের ভীতির ভাবটা কমে আসতে লাগল। “কী করছ?’

“বালিশের ওয়াড় পালটাচ্ছিলাম। আলো চলে গেল।…এবার তোমার দুধ গরম করে দেব। একটু সুজি করে দেব খাবে?”

“না, পেট ভার হয়ে আছে। আজ থাক।”

খানিক পরেই আলো এসে গেল। হেমার দুধ খাওয়া শেষ হয়েছে। দুধের সঙ্গে অন্য যে পদার্থটা খেতে হয়, তাঁকে সেটার স্বাদ ভাল লাগে না। কিন্তু উপায় নেই। সুশীলার নজর এ-সব ব্যাপারে কড়া। যে-মানুষের রক্তের চাপ মাঝে মাঝেই কমে যায়, সামান্য ডায়েবেটিসের ভাব আছে তাকে ও-সব খেতে হয় বইকি! অখাদ্য কুখাদ্য বলো আর যাই বলো, ওটা তোমার পথ্য। মাংস খাওয়া ছেড়েছে, ডিম খেলে পেটে সহ্য হয় না তেমন, কাজেই দু’টুকরো মাছ দিয়ে তোমায় কেমন করে সুস্থ রাখি গো। ছানা, শিশির ওই প্রোটিন—এ তোমায় খেতেই হবে। সুশীলা বাস্তবিক কোনো অত্যাচার করেন না স্বামীর ওপর। ডাক্তারে যেমন যেমন বলেছে—তেমন তেমনই করেন, তার বেশি কিছু নয়।

আলো আসার আগেই হেমদার ঘরে ঢুকেছিলেন। ঘরে ঢুকলেও উলটো দিকের বাড়িটা চোখে পড়ছিল। হাত বাড়ালে ছোঁয়ার মতন কাছাকাছি নয় বাড়িটা। সামান্য তফাৎ বইকি। তেকোনা ছোট পার্কের একেবারে দক্ষিণ কোণে, সব চেয়ে যেটা ছোট আর সরু—তার এক পাশে হেমদার বাড়ি অন্য পাশে ওই বাড়িটা। দু দিকের দুই রাস্তা এখানে মিশে চওড়া হয়েছে। হেমদার বাড়ির পুব দিকে রাস্তা, ও-বাড়ির পড়েছে পশ্চিম দিকে।

খোলা ব্যালকনির দরজা, পাশের দুই জানালা দিয়ে ও-বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। ব্যালকনিতে চায়ের আসর ভেঙে গিয়েছে। চেয়ারগুলো পড়ে আছে তখনও। হয়ত অন্ধকার বলে আসর ভেঙে দিয়েছিল—জানত না আবার ঝপ করে আলো এসে পড়বে।

হেমাদার মনে হল দরজাটা এবার বন্ধ করে দেওয়া দরকার। যদিও শীত পড়েনি খানিকটা তফাতে রয়েছে, এখনও তবু সামান্য ঠাণ্ডার ভাব এসেছে। হালকা কুয়াশা, পাতলা হিম এসব তো নজর করলেই বোঝা যায়্। তার চেয়েও বড় কথা মশা। দরজা জানালা খোলা থাকলে এই সন্ধের ঝোঁকে ঝাঁক বেঁধে ঘরে ঢুকবে।

হেমদা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, দেখলেন, নতুন ভাড়াটেদের আত্মীয় বন্ধুরা চলে যাচ্ছে। সকলেই নিচে। রাস্তায়। একটা ট্যাক্সি ধরা হয়েছে। কথাবার্তা শেষ করে হাত নাড়ানাড়ি করছে। হাসির একটা দমকও ভেসে এল।

দরজা বন্ধ করলেন হেমাদা। “ওদের বন্ধু বান্ধবরা চলে গেল,” হেমদা বললেন।

সুশীলা কিছু করছিলেন ঘরে, আলো আসায় আবার তাঁর চোখ ফুটেছে। বললেন, “ওরা মাত্র দুটি মানুষ?”

“তাই তো মনে হচ্ছে।”

“বাচ্চাকাচ্চা নেই?”

“দেখলাম না তো!”

“আজকালকার ছেলেমেয়েদের ওই আর-এক ফ্যাশান। যতদিন পারব নেড়া নেড়িতে থাকব! সব জিনিসেরই সময় আছে, সময়ে হলে দেখতেও ভাল লাগে! তাই না?”

দরজা বন্ধ করে হেমদা জানালা বন্ধ করছিলেন, “ওদেরও হয়ত আছে। কোথাও রয়েছে হয়ত। পরে আসবে।”

“কিংবা নতুন বিয়ে।”

“নতুন বিয়ে! কেমন করে বুঝলে?”

“অত জিনিসপত্র…; খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল সোফাসেট, ফ্রিজ, টিভি এক কাঁড়ি জিনিস। তুমিই তো বলছিলে সব ঝকঝকে, নতুন নতুন।”

জানালা বন্ধ করে সোফার দিকে এগিয়ে এলেন হেমদা। এটা তাঁদের বসার ঘর। শোবার ঘর ওপাশে, ডাইনে। এ-বাড়িতে ঘর বলতে মাত্র তিন। শোয়া বসা ছাড়া বাড়তি আর একটা মাত্র। রান্না ভাড়ার সব অবশ্য আলাদা। এই ঘরের লাগোয়া অনেকখানি জায়গা অ্যাসবেসটাসের ছাদ, সিলিং, পাঁচিলের দিকটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা। ছাদের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে খাওয়া-বসার ব্যবস্থা। শীতের দিন সারা সকাল দুপুর আরামের জায়গা ওটা। আর গরমের দিন বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত।

হেমদ তাঁর সিগারেটের প্যাকেট তুলে নিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। “ঝকঝকে হলেই নতুন বিয়ে হবে? হয়ত নতুন করে রঙ পালিশ করিয়েছে। তবে তুমি যা বলছ, তাও হতে পারে; ছেলেটির বয়েস তো বেশি নয়।”

“আমাদের নিতুর বয়েসী।”

“নিতুর চেয়ে দু’এক বছরের ছোটই হবে।” হেমাদা সিগারেট ধরালেন।

“মেয়েটা আমাদের বউমার চেয়ে বেশ ছোট, বয়েসে। বউমার বত্রিশ।”

হেমদা পায়চারি করার মতন ঘরের মধ্যে দু’চার পা হাঁটাহাঁটি করলেন। “তোমার বউমাকে চিঠি লিখেছ?”

“না। শুরু করেছিলাম…। থাক, আমি আর লিখব না। তুমি নিতুর চিঠির জবাব দিয়ে দাও।”

“আমার তো লেখা হয়ে পড়েই আছে। তোমার জন্যে বসে ছিলাম।”

“আমি আর দেব না। তুমি দিলেই হল। নাতির সাইকেলের টাকাটাও পাঠিয়ে দিও।”

“দেব। ওর কাছে পার পাবার উপায় আছে! কেমন লিখেছে দেখো নি বড় বড় করে—হোয়ার ইজ মাই সাইকেল?…বেটা একেবারে সাইলক্।” হেমদা হো হো করে হেসে উঠলেন।

সুশীলার মুখেও হাসি। বললেন, “ওই নাতিই তোমায় জব্দ করবে। নিজের পাওনা গণ্ডা ঠিক বুঝে নেবে। দেখো।”

হেমদা হাসছিলেন।

॥ দুই ॥

সপ্তাহখানেকের মধ্যে ভাসা ভাসা একটা পরিচয় পাওয়া গেল। খানিকটা শোনা গেল শিবুর মুখে, নিচের ভাড়াটেরা কিছু কিছু খবর দিল সুশীলাকে, বাকিটা এর ওর মুখে। ছেলেটির ডাকনাম, জয়; ভাল নাম এ. সান্যাল। লেটার বক্সে নামটা এ. সান্যাল। ‘এ’ থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই, অরুণ, অজয়, অমল, আত্মব্রত—কত কি হতে পারে। মেয়েটির নাম মীনা; লেটার বক্সে মীনাক্ষী। ডাকনামটা গেল ঝি, চাকর আর কাছকাছি লোকের মুখ থেকে। ওরা নিজের কানে শুনেছে, ছেলেটি এবং মেয়েটি পরস্পরকে নাম ধরে ডাকে। ছেলেটি কাজ করে কী-এক কন্‌সালটিং এঞ্জিনিয়ার্স ফার্মে। ব্রিটিশ ফার্ম। এ-খবরটা হেমদার কানে এসেছে ও-বাড়ির মিস্টার দত্ত এবং তাঁর নিজের ভাড়াটে মন্মথবাবুর মারফত। জয়ের বউ মীনাও কাজ করে, তবে কোথায় সেটা জানা যায়নি।

মীনা যে চাকরি-বাকরি করে হেমাদা দু-তিন দিনের মাথায় ধরতে পেরেছিলেন। পর পর ক’দিনই তিনি দেখলেন, সকালে ন’টা নাগাদ জয় বকসিদের বাড়ির গ্যারেজ থেকে তার বাচ্চা হেরালড্ গাড়ি বার করে আনছে। মীনা ততক্ষণে রাস্তায়। সাজগোজ করা ফিটফাট চেহারা। হাতে মোটা-ধরনের এক চামড়ার ব্যাগ, দু-একটা চওড়া ধরনের ম্যাগাজিন। জয় গাড়ি নিয়ে আসতেই মীনা দরজা খুলে উঠে পড়ল তারপর হু-স।

সুশীলারও চোখে পড়েছিল। “রোজ যায় কোথায় গো?”

“চাকরি-বাকরি করে কোথাও।”

“কিসের চাকরি?”

“তা কেমন করে বলব! ভাল চাকরি নিশ্চয়।”

“সারাদিন ও-বাড়িতে ওই একটা আয়াগোছের কাজের লোক! দিন দুপুরে চুরিচামারিও তো হয়ে যেতে পারে।”

“তা কেন হবে! নিজেদের বিশ্বাসী লোক নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে, সে তো আর চুরি করবে না। আর বাইরের চোর যদি চুরি করে তার আর করার কী আছে। দিনের বেলায় এদিকে যে দু-চারটে চুরি হয়েছে, তেমন চুরি ঠেকানো মুশকিল।”

সুশীলা সন্তুষ্ট হলেন না, খুঁতখুঁতে গলায় বললেন, “ওদের তো কোনো অভাব, নেই। টাকাপয়সা আছে; তবু মেয়েটি চাকরি করবে কেন?”

হেমাদা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “এরা ঠিক টাকাপয়সার জন্যে চাকরি করে না। হয়ত আগে করত, অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া আজকার অনেক মেয়েই বাড়িতে বসে বসে সময় কাটাতে চায় না। নিজে কিছু একটা করলে সময়ও কাটে, নিজেকেও স্বাধীন স্বাধীন মনে হয়।”

সুশীলা বোপর বাড়িতে পাঠাবেন বলে কাপড়চোপড় মাটিতে নামিয়ে রাখছিলেন। বললেন, “কী জানি আমাদের তো মনে হত না। সময়ও কেটে যেত।”

হেমদা হাসলেন। “তোমাদের আমাদের সময় তো আর নেই, সুশীলা। আমরা যাতে সুখী হতাম—এরা তাতে হবে কেন? আমরা বোধহয় খানিকটা হাত গুটিয়ে থাকতাম। এরা যতটা পারে হাত বাড়ায়।”

সুশীলা কথাগুলো শুনলেন, কিন্তু কিছুই বুঝলেন না। কী একটা ধোপার বাড়ি দেবার জন্যে ভেবেছিলেন এখন আর মনে পড়ছে না। চারদিক তাকালেন। না, মনে এল না। আজকাল সব ভুল হয়ে যায়। মনে রাখতে পারেন না।

মনে করার জন্যেই যেন বিছানায় বসলেন। দু মুহূর্ত চোখের পাতাও বুজে থাকলেন। ওমা, চোখের পাতা বুজতেই সেই ছোট্ট বাংলো বাড়িটা ভেসে উঠল মনে। রেলের বাংলো। চারদিকে মেহেদির উঁচু বেড়া। মস্ত দুই গাছ বাগানে, কাঁঠাল আর দেবদারু গাছের ডালে কাঠের দোলনা ঝোলানো। ছেলে দোল খাচ্ছে, মেয়ে দোল দিচ্ছে। একটা চাপরাশি এসেছে অফিস থেকে সাহেবের দুপুরের খাবার নিয়ে যাবার জন্যে। সুশীলা বড় ব্যস্ত; এটা গুছিয়ে দিচ্ছেন ওটা গুছিয়ে দিচ্ছেন, জল ভরে দিচ্ছেন কাচের বোতলে। একটা চিরকুটে খসখস করে লিখে দিচ্ছে: ‘সাহেব, আজকের মৃগেলমাছে বড় কাঁটা, সাবধানে খেয়ো, গলায় কাঁটা ফুটিয়ো না।’ লিখছেন আর আপন মনে হাসছেন। চিরকুটটা চাপরাশির হাতে দেবেন না। পাগল নাকি! একেবারে নুনের মোড়ক করে দেবেন। হেমদার অভ্যেসই হল, পাতের একপাশে নুন ঢেলে নিয়ে খেতে বসা। তাছাড়া সুশীলার কোনো আরজি আব্দার থাকলে—এইভাবেই তিনি জানান স্বামীকে অফিসে।

হেমা কিছু বলেছিলেন সুশীলা অন্যমনস্ক থাকায় শুনতে পাননি। তাকালেন স্বামীর দিকে। হাসি চোখে তাকিয়ে বললেন, “কিছু বললে?”

“হ্যাঁ। কিন্তু তা তুমি হাসছ কেন?”

মাথা নাড়লেন সুশীলা। “এমনি, একটা কথা মনে পড়ছিল।”

হেমদা এবার একটু মজা করলেন। “তোমার যেন ডাকনাম কী ছিল গো? হাসিখুশি? তাই না?”

সুশীলা ভুরু কোঁচকাবার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। বয়েসে বোধ হয় রাগের ভানও কপালে চোখে মুখে—কোথাও আর ধরা যায় না। বললেন, “হাসিটা আমার মা-বাবার দেওয়া, খুশিটা তোমার।”

হেমদা ঘাড় দোলালেন, “যাক্, তবু একটা কিছু তো তোমায় দিতে পেরেছিলাম।” বলে হেসে উঠলেন।

সুশীলা স্বামীকে দেখছিলেন। মানুষটা একসময় বাড়িতে আকাশফাটানো হাসি হাসতে পারত। সুশীলা বলতেন, ডাকাত-চমকানো হাসি। অফিসে একেবারে গম্ভীর। এক দেওর ছিল সম্পর্কে, বলত ‘অফিসে দাদাকে দেখলে মনে হয় একগ্লাস স্ট্রং ত্রিফলার জল খেয়ে বসে আছে।’ হ্যাঁ—এই রকমই ছিল মানুষটা। অফিসে বিশ্বাস সাহেব। আর বাড়িতে যেন ফাজিল ফক্কড়। এখন তো সবই গিয়েছে, হাসিতে জোর নেই, সেই ভরা গলাও নেই। এখন ভাঙা ভাঙা গলা, একটুতেই বসে যায়। প্রায় গলা ব্যথা। নিত্যদিন গারগ্‌ল। মধ্যে খুব বাড়াবাড়ি হয়েছিল, খাওয়া বন্ধর অবস্থা। নুন, ঝাল সহ্যই করতে পারত না। ডাক্তাররা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যাক শেষ পর্যন্ত সামলে নিল। এখন দিনে চার-পাঁচটা সিগারেট, ও ডাক্তারের হাতেপায়ে ধরে ভিক্ষে চাওয়ার মতন করে আদায় কথা। অথচ তখন টিন উড়ত রোজ। কর্তার শরীর কিন্তু আর সারছে না, ভাঙছে। মুখ বসে গিয়েছে, দাঁত বারো-চোদ্দটাও নেই, মাথার চুল যেটুকু আছে তাও পাকা। হাত পা বেশ রোগা হয়েছে। প্যান্টগুলো ঢলঢলে করে। তার ওপর বাতে ধরে আরও কাবু করে ফেলেছে।

সুশীলার বড় কষ্ট হয়। এই প্রায়-অক্ষম স্বামী নিয়ে পড়ে আছেন তিনি। আর ছেলে দেখো—দিল্লী গিয়ে বউয়ের তোয়াজ করছে। ছি ছি। মানুষ কেন যে সন্তান পেটে ধরে!

হেমদা হঠাৎ বললেন, “আজ একবার চক্রবর্তীকে ফোন করব।”

সুশীলার যেন ঘোর ভাঙল “ডাক্তারবাবুকে? কেন?”

“গাঁটের ফোলাগুলো কমছে না।” হেমদা তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন, আঙুলগুলো দেখালেন।

“কমবে। আগের চেয়ে কত কমে গিয়েছে।”

“পায়ের হাঁটুতে জোর পাচ্ছি না। দেওয়ালীর সময় থেকে হাঁটাচলা বন্ধ।”

“পাবে। একটু সবুর করো।”

“তোমারও তো নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে,” হেমদা সরে এসে বিছানায় বসলেন, “ডাক্তারকে একটা খবর দেওয়া দরকার।”

“কোনো দরকার নেই। আমি বেশ আছি। বুড়ি মানুষ, তার ওপর এতখানি চেহারা—ওঠ-বোস করলে একটু হাঁফ ধরবেই।”

হেমদা হেসে ফেললেন। “কতখানি চেহারা? হাত দিয়ে দেখাও তো একবার।”

সুশীলাও না হেসে পারলেন না।

হেমদা একটা জিনিস আজকাল বেশ বুঝতে পারেন। সুশীলার চেহারায় কেমন মেন জোলো ফোলা ফোলা ভাব এসেছে। ওর মুখ বরাবরই গোলগাল, নাক সামান্য মোটা ছিল, কিন্তু গড়নে কোনো খুঁত ছিল না। বয়েসে শরীর ভারি হয়েছিল, গড়ন ভেঙেছিল, কিন্তু এই রকম একটা ফোলাফোলা অসুস্থ ভাব আসেনি। ধীরে ধীরে এটা দেখা দিল। এখন বেশ নজরে পড়ে। ডাক্তাররা বলছিল, একটু অ্যানেমিয়া আছে ঠিকই, তবে ফোলাটা খানিকটা কিডনির গোলমালের জন্যে। হেমদার বেশ দুশ্চিন্তা হয়।

সুশীলা বললেন, “আমার আজকাল সায়াসেমিজ রাখতেও ইচ্ছে করে না। হাঁসফাস করে শরীর।”

“এ আবার বেশি বেশি বলছ…ও-সব করো না; ঠাণ্ডা পড়ে আসছে।”

“বেশি বলছি! আচ্ছা বলো, আগে আমার চেহারা এতখানি ছিল।”

হেমদা হাসলেন। বিন্দু মাত্র ভাবলেন না, বললেন, “আগে বলতে কত, আগের কথা বলছ? বিয়ের পর, ছেলেপুলে হবার পর না, পাকাপোক্ত গিন্নি হবার পর?…বিয়ের পর তোমার চেহারা অনেকটা ওই নতুন ভাড়াটে মেয়েটির মতন ছিল। রোগাও নয়, মোটাও নয়, মাঝারি।” বলে হাসতে লাগলেন।

॥ তিন ॥

সুশীলাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেননি হেমদা; একাই গিয়েছিলেন। বেশি দূর নয়; আট দশটা বাড়ির পরই ভাদুড়ির বাড়ি।

ভাদুড়ির বাবা মারা গিয়েছেন আজ দুপুরে। অনেক বয়েস হয়েছিল; সাতাশি। আজ যাই কাল যাই করে টিকে ছিলেন। অথর্ব, অক্ষম হয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ। বাড়ির লোক একটা বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতন করে তাঁকে বইত। আজ বোঝা হালকা হয়েছে।

হেমদা খবর পেয়ে একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন। ভাদুড়ির সঙ্গে হেমদার পরিচয় আগেই ছিল, তারপর হঠাৎ দেখা গেল দুজনে একই জায়গায় বাড়ি করছেন। প্রতিবেশী হবার পর এক সময় দু জনে দু জনের খোঁজ খবর প্রায়ই করতেন। ধীরে ধীরে সেটা ঘুচে গেল। তবু সামাজিকতাটুকু তো রক্ষা করতেই হয়। ভাদুড়ির বাবা মারা যাওয়ায় ও-বাড়িতে বাহ্যিক একটু শোক ছাড়া কিছু দেখা গেল না বরং সবাই যেন নিশ্চিন্ত। সাতাশি বছরের অথর্ব বৃদ্ধের জন্যে বোধ হয় মানুষের শোক থাকে না।

বাড়ি ফিরে হেমদা বললেন, “ওরা এখন শ্মশানে যাচ্ছে।”

সুশীলা বসার ঘরে। সন্ধে হয়ে এল। মকর বাইরে কাজকর্ম করছে।

“একটু জল দিতে বলো।”

নিজেই উঠলেন সুশীলা জল আনতে।

হেমদা সোফায় বসলেন। আজ প্রায় দশ বারোদিন পরে তিনি নিচে নেমেছিলেন। হাঁটাচলা না করলে অভ্যেস চলে যায়, পা যেন আর চলতে চায় না গায়ে কট্স্ উলের বুশ শার্ট ছিল হেমদার, বোতামগুলো আলগা করলেন।

জল আনলেন সুশীলা।

জল খেয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন হেমদা। “ভালই হয়েছে, বুঝলে ভদ্রলোক বড় কষ্টেই ছিলেন। সাতাশি বছরটাও তো কম নয়।”

সুশীলা বললেন, “বয়েস হলে সবই যেন হাতের বাইরে চলে যায়। তাই না?”

“তা যায়। তবে তোমার সেই বয়েস হবার দেরি আছে—”

হাসলেন হেমদা, “এখন তোমার পঁয়ষট্টির কাছাকাছি, আরও দশ বারোটা বছর যাক।”

“তোমারই বা কি এমন থুত্থুড়ে হবার বয়েস গো! বাহাত্তরেও ধরেনি…। এরই মধ্যে জবুথুবু হয়ে পড়লে।”

স্বীকার করলেন হেমদা। “তা হলাম। এই বাতটাই আমায় ডোবাল। তারপর কী জানো! কলকাতার ওয়েদারটাই আমাদের সুট্ করল না, মধুপুরে সেই বাড়িটা কিনে ফেললেই ভাল হত। তখন ছেলেমেয়ের কথা ভেবে কলকাতাতেই এলাম। কোনো কাজে এল না।”

সামান্য চুপচুপ। সুশীলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

হেমদা বুঝতে পারলেন, কথাটা এখন তোলা ভুল হয়েছে। আজ সকালেই বউমার এক চিঠি এসেছে দিল্লি থেকে। শাশুড়িকে লিখেছে, চিঠিটা কেমন তেড়া বেঁকা। বউমা নাকি এ-বাড়িতে পাথর বসানো কানের গয়না ফেলে গিয়েছে। এতদিন পরে কথাটা তার খেয়াল হল? নাকি শাশুড়ির ক’টা ভাঙা গয়না, দেখে যাবার পর তার কানের গয়না হারাল?

হেমদা কথাটা ঘুরিয়ে নেবার জন্যে তাড়াতাড়ি বললেন, “ভাল কথা। লোকে যে কার মাথা কার ঘাড়ে বসায় কে জানে। আরে ওই ফ্ল্যাটের নতুন ভাড়াটে ছেলেটি—জয়, এ এঞ্জিনিয়ার নয়। বাজাজদের কোন্, এঞ্জিনিয়ার ফার্মের অ্যাকাউন্টটেন্ট। ডেপুটি চিফ অ্যাকাউন্টটেন্ট। আমার লাইনের লোক। আজ মুখার্জি বলল। ভাদুড়ির বাড়িতে কথা হচ্ছিল। মুখার্জিও ওকে চেনে। আর জয়ের বউ মীনা চাকরি করে একটা বিদেশি ব্যাঙ্কে। রিসেপশনিস্ট।”

সুশীলা বললেন, “এই তো একটু আগে ফিরল দু’জনে। গাড়ির শব্দ পেলাম। জনে নামল।”

“গাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় আবার বেরুবে।

“আবার?…সেই সকালে বেরুলো, ফিরল সন্ধেবেলায়, আবার এখন বেরুবে?”

“বাঃ বেরুবে না! ছেলেমানুষ বয়েস। সিনেমাটিনেমায় যাবে, কিংবা কোনো বন্ধুটন্ধুর বাড়ি।”

“দম আছে।”

হেমদা হেসে ফেললেন। তাঁর জিরোনো শেষ হয়েছে, এবার একটা সিগারেট খাবেন। হেমদা ধীরেসুস্থে সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন, দেশলাই।

সুশীলা বললেন, “একটা জিনিস বাপু বড় চোখে লাগে।”

“কী?”

“মেয়েটি বাড়িতে যে কী সব পোশাক পরে! দেখেছ?”

দেখেছেন হেমদা। পোশাকগুলোর নাম তিনি জানেন না, শুনেছেন হাউস কোট, ম্যাক্সি, কাফতান—এইরকম কী যেন। মীনাকে তিনি মেয়ে-পাজামা আর শর্ট ব্লাউজও পরতে দেখেছেন। বাড়িতে পরে। খুব ফ্যাশনদুরস্ত মেয়ে। চোখমুখে রঙচঙও মাখে বেশি।

সিগারেট ধরিয়ে হেমদা বললেন, “পরুক। কি আর হয়েছে। আজকাল সব মেয়েই পরে। এ-পাড়ায় তো ছেয়ে গিয়েছে। রাস্তায় তো বেরোও না।”

“না বেরিয়েও চোখে পড়ে। তা অল্প বয়সের মেয়ে, বিয়ে-থা হয়নি তবু এক রকম। কিন্তু বউ মানুষের পরলে কি ভাল লাগে!”

“তা ঠিক। তবে যখনকার যা হাওয়া। তোমার ছেলের বউ যে কলকাতায় থাকার সময় দু চারটে ওই কিনে নিয়ে গেল নিউ মার্কেট থেকে, জান না?”

সুশীলা জানেন। বললেন, “তোমায় কে বলল?”

“আমার স্পাই আছে। নাতি।” হেমদা হাসলেন।

সুশীলা কিছু বললেন না। তিনি বউমার সুটকেস নিজের হাতে খুলে কিছু দেখতে যাননি, কিন্তু ছেলে-বউকে যে-ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই ঘরের বিছানায়, আলনায় অনেক কিছু ছড়ানো থাকত—সাজপোশাক, মুখের রঙচঙ। বোধ হয় নিতু কিছু বলেছিল, কিংবা নিতান্ত চক্ষুলজ্জার জন্যে বউমা সে-সব পরত না। সব নয়। দুচারটে অবশ্য পরত, যেমন চোলি, ফিনফিনে সিল্ক আর লেসের বুক-জামা, কোমর ফেটি। কিছু পরত, কিছু ছড়ানো থাকত।

হেমদা দু চার মুখ ধোঁয়া গিললেন। কোনো তাড়া নেই। তারপর হেসে বললেন, “আমার স্পাই আরও অনেক খবর দিয়েছে। তোমার ছেলের বউ স্কুটার চালাতে জানে।”

সুশীলা এটা জানতেন না। বললেন “নিতু তার বউকে না সামলালে আমি আর কী করব।”

দুজনেই চুপ। আজকাল তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়। সন্ধে হলেই বাতি নেভে। মাঝে মাঝে দয়া হলে সন্ধেটা আলো দিয়ে রাত্রে বন্ধ করে দেয়। আজ আলো আছে এখনও। হয়ত তাই মশাটাও তেমন লাগছে না। হেমদা ভাবছিলেন সিগারেটটা শেষ করে ব্যালকনির দরজা জানালা বন্ধ করে দেবেন।

হঠাৎ কী মনে পড়ল হেমদার। “ভাল কথা, মুখার্জি বলছিল—ওই জয় ছেলেটি একটা গ্যারাজ খুঁজছে গাড়ি রাখার জন্যে। এখন বকসিদের ওখানে রাখছে, ক’দিন, কিন্তু বকসিদের গ্যারাজে জায়গা নেই, অসুবিধে হয়। মুখার্জি আমাদের গ্যারাজের ভাড়ার কথা বলছিল।”

“ভাড়া? কেন?”

“আমাদের আর গ্যারাজ কী হবে। গাড়ি বেচে দেবার পর থেকে তো পড়েই আছে ফাঁকা।”

“থাক ফাঁকা। ভাড়া দিতে হবে না।” সুশীলা উঠলেন। হেমার দুধ খাবার সময় হয়েছে, এই সময় প্রোটিনটুকু দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে না দিলে রাত্রে পেট ভারের বায়না ধরে।

“আজকাল গ্যারাজের ভাড়া কম নয় গো?”

“হোক ভাড়া। আমাদের দরকার কী? দুটো মানুষের পেট—দিব্যি তো চলে যাচ্ছে।”

হেমদা আর কিছু বললেন না। আসলে এইখানে সুশীলার বেশ অভিমান রয়েছে। হেমদার একটা ছোট ফোর্ড গাড়ি ছিল। চাকরি জীবনের। সেটাকে তিনি অনেক কাল যত্ন করে রেখেছিলেন। এ-বাড়িতেও ছিল। মাঝে মাঝে সুশীলাকে সঙ্গে নিয়ে একটু হাট বাজার ঘোরাফেরাও করতে, বেরুতেন। শেষে গাড়িটা হরদম বিগড়োতে লাগল, তেলের দাম বাড়তে লাগল হু হু করে, হেমদার নিজের শরীর বিকল হতে লাগল, কলকাতার রাস্তায় আর গাড়ি চালাবার মতন সাহস পেতেন না। গাড়িটা হেমদা বেচে দিলেন। আপত্তি ছিল সুশীলার। থাকলে তবু বুড়ো মানুষটা কাউকে ডেকে পাঁচ সাতটা টাকা দিয়ে মাঝে মাঝে একটু বেরুতে পারত। সেটা ঘুচল। তা অবশ্য ঘুচল কিন্তু, রেখেই বা কী লাভ হত।

হেমদা উঠলেন। ব্যালকনির দরজা, ঘরের জানলা বন্ধ করবেন।

নিচে শব্দ হল। জয় তার গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে, পাশে মীনা। হেড্‌ লাইট জ্বলল! হেমদা দেখলেন, গাড়িটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হুস করে চলে গেল।

॥ চার ॥

“সুশীলা?”

সুশীলা বাইরে, ছাদের দিকে। কিছু গরম কাপড় চোপড়, তোশক বালিশ রোদে দেওয়াচ্ছিলেন মকরকে দিয়ে। শিবু বাজার সেরে দিয়ে চলে গিয়েছে। আজ রবিবার শিবু তার মাকে দেখতে কাঁচড়াপাড়া যাবে। যাবার সময় সুশীলা তাকে একটা পুরনো গায়ের কাপড়, ফ্লানেলের ব্লাউজ আর কুড়িটা টাকা দিয়েছেন। শিবুর মার অসুখ।

সাড়া দিলেন সুশীলা। “বলো?”

“এদিকে এসো একবার।”

“দেরি হবে একটু, যাচ্ছি।”

সুশীলা যখন এলেন, হেমদা যা দেখাতে চাইছিলেন আর দেখাতে পারলেন না। খানিকটা হাসি, খানিকটা আফসোসের গলায় বললেন, “আর কি, তখন বললাম, এলে না, দেখতে পেলে না।”

অবাক হয়ে সুশীলা বললেন, “কী দেখতে পেলাম না?”

“ওই যে তোমার জয়ের কাণ্ড।” হেমদা চোখের ইশারায় জয়দের ফ্ল্যাট দেখালেন।

তাকালেন সুশীলা, কিছু দেখতে পেলেন না। ক’পা এগিয়ে ব্যালকনির কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাও কিছু চোখে পড়ল না। স্বামীর দিকে তাকালেন। “কই? কী কাণ্ড?”

“আর কাণ্ড! গাড়ি ছেড়ে যাবার পর স্টেশনে এলে কি গাড়ি ধরা যায় গো!” হেমদা হাসছিলেন।

সুশীলা সরে ছায়ায় এলেন। “কাণ্ডটা কী শুনি?”

“ছেলে-মেয়েদের কাণ্ড। জয় দাড়ি কামাচ্ছিল বোধ হয়। মুখ ভর্তি সাবান। দাড়ি কামাতে কামাতে কিছু হয়েছে, ওর বউ সেফটি রেজার কেড়ে নিয়েছে। একগালে সাবান, অন্য গাল কামানো। বেটার পরনে আবার একটা জাঙিয়া টাইপের ছোট প্যান্ট, ওপরে ঢাউস তোয়ালে জড়ানো ছিল। তা বউয়ের পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে তোয়ালে গেল খুলে। বেটা একেবারে অপ্রস্তুত। কী চেঁচান চেঁচাতে লাগল, হাত জোড় করে ভিক্ষে। আর ওর বউয়ের কী হাসি। লুটিয়ে পড়ছিল।” হেমদা দৃশ্যটা মনে করে আবার হাসতে লাগলেন।

সুশীলারও মুখে হাসি লাগল। “দুটোতে খুব খুনসুটি করে। আমিও সেদিন দেখেছি, ছেলেটা যতবার সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছে মেয়েটা ফুঁ দিয়ে লাইটার নিবিয়ে দিচ্ছে। আর কালকেই তো দেখলাম, মীনা কী একটা খাবার প্লেটে করে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে, মুখে তুলবে চামচে করে, ওর বর পেছন থেকে এসে ছোঁ মেরে প্লেট কেড়ে নিয়ে ঢুকে গেল। মীনাও ছুটল।” সুশীলা হাসতে হাসতে মুখে আঁচল চাপা দিলেন।

হেমদা গম্ভীর ভাবে বললেন, “নিশ্চয় আইসক্রিম।”

“আইসক্রিম!…এই ঠাণ্ডায়!”

হেমদা আড়চোখে স্ত্রীকে দেখলেন। একটু বেঁকা চোখে, খানিকটা মজার চোখে। বললেন, “ওদের বয়েসটা তো গরমের। …কেন, তুমি ওই বয়সে যখন কালুর দোকানের পেস্তা-বাদাম দেওয়া কুলফি মারতে তখন কি গরম বর্ষা মানতে, আবার আমার ভাগটা পুরো খেতে দিতে?”

সুশীলা এই বয়েসেও হেসে অস্থির। বসে পড়লেন সোফায়। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে হাসতেও তাঁর চোখে জল এসে গিয়েছিল। কথা বলতে গিয়ে দেখেন গলা জড়িয়ে গিয়েছে। জড়ানো গলাতেই বললেন, “তুমি কী মিথ্যেবাদী গো?”

হেমদা স্ত্রীকে জব্দ করার হাসি মুখে নিয়ে বসে থাকলেন।

সুশীলা চোখ মুছলেন। চওড়া কালো পাড়ের শাড়ি। চোখ মুখ মোছার সময় আধখানা মুখ কালো হয়ে থাকল ক’ মুহূর্ত। তারপর আবার সেই হাসি লাগা মুখ। মোটা কাচের চশমা তাঁর হাতে। দুটি চোখই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।

চশমা পরতে পরতে সুশীলা বললেন, “আমি আমার ভাগের অর্ধেক কুলফি তোমায় দিয়ে দিতাম।”

মাথা নাড়লেন হেমদা। “কোনো দিনই নয়। তুমি মাছ মাংসের বেলায় যথেষ্ট-হাত খোলা ছিলে গো; কুলফির বেলায় নয়। তোমার ছেলে-মেয়েরা থাকলে সাক্ষী দিতে পারত।”

সুশীলা রাগের মতন করে বললেন, “বেশ, ছিলাম।”

হেমদা স্ত্রীকে জব্দ করতে পেরে এতই খুশি যে সুশীলাকে বোকা বানিয়ে একটা সিগারেটও কখন ধরিয়ে নিলেন।

সুশীলার চোখ তখন আবার ওদিকের ব্যালকনির দিকে। মীনারা তাদের ব্যালকনি সাজিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি। কটা টব রেখেছে ব্যালকনিতে। পাতা বাহারের টব রয়েছে দু তিনটে, একটা বোধ হয় মরশুমী ফুলের; অন্যটা লতা গাছ; নীল ফুল ফুটেছে গোটা দুই। ওদের ব্যালকনির দরজায় পরদা ঝুলছে এখন। সব সময় পরদাটা একই ভাবে থাকে না, কখনও ওরা গুটিয়ে দেয়, কখনও হাওয়ায় ওড়ে। পরদা সরে গেলে ওদের মাঝখানের ঘর চোখে পড়ে। বসার ঘর। সোফাসেটি, বুক কেস, ছবি, রেডিয়ো কত কি চোখে পড়ে। পাশেই শোবার ঘর। জানলার পরদাগুলো কত বাহারী।

সুশীলা নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, “বেশ আছে দুটিতে। জোড় বেঁধে।”

হেমদা মাথা দোলালেন। “হ্যাপি কাপ্‌ল্‌। মোস্ট হ্যাপি। দেখতেও ভাল লাগে। কী বলো।”

সুশীলা চুপ করে থাকলেন।

“সুখই বলল, আর সুখীই বলো,” হেমদা বললেন, “আজকাল কত কম দেখা যায়। রেয়ার। মানুষ কেমন দুঃখী হয়ে গিয়েছে। তাই না।”

সুশীলারও তাই মনে হয়। সুখ আজকাল কোন আড়ালে লুকিয়েছে কে জানে? অথচ সুশীলা একসময় সুখী ছিলেন, ওদেরই মতন। ওদের অনেক বৈভব, টাকা পয়সাও হয়ত যথেষ্ট আছে। সুশীলাদের এত বৈভব ছিল না। স্বামী বড় কাজই করতেন, কিন্তু মাইনে গোন-গুনতি। রেলের বাংলো ছিল। মোটামুটি ভাল বাংলোই, গাছপালাও ছিল; কিন্তু সংসারের সব ছিল সাধারণ, খাট টেবিল আলমারি, বসার চেয়ার। সুশীলার খুব শখ ছিল প্যাটেল ফার্নিচার্সের কিছু আসবাবপত্র কিনবেন, অন্তত বসার ঘরের জন্যে। কিনতে পারেননি, কুলিয়ে উঠতে পারতেন না, সেই বেতের চেয়ার আর তুলোর গদি দিয়ে কাটিয়ে দিলেন। তবে এ-সব কোনোদিন দুঃখের কারণ হয়নি। দুই ছেলেমেয়ে, নিজের সংসার, একটু আধটু বেড়ানো, স্বামীর সঙ্গে হাসি-আমোদ, কিছু মান-অভিমান করে সুখেই ছিলেন। আর সত্যি বলতে কি আজ জয় আর মীনা যেমন নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে সুশীলারা তার চেয়ে কম করতেন না। কতদিন এমন হয়েছে, স্বামীকে বিরক্ত করার জন্যে তাঁর মোটা মোটা রেলের পড়াশোনার বই লুকিয়ে রেখেছেন, পড়ার সময় আলো নিবিয়ে দিয়েছেন, সিগারেটের কৌটো লুকিয়েছেন ভাঁড়ার ঘরের তাকে। একবার তো চোখের ওষুধ দেবার সময় ভুল করে খানিকটা বোরোগ্লিসারিন ঢেলে দিয়েছিলেন। হেমদাও কম যেতেন না। সুশীলাকে এক একদিন এমন নাস্তানাবুদ করতেন। কেউ বিশ্বাস করবে, আজ যদি সুশীলা বলেন, বিয়ের পর পর হেমদা একবার জ্যোৎস্নার দিন ভুলিয়ে স্ত্রীকে আমগাছের ডালে চড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন? কত রকম বদ বুদ্ধি ছিল ভদ্রলোকের। সুশীলার জন্যে মাথার তেল এনেছেন বলে চমৎকার শিশিতে গাড়ির মোবিল তেল ভরে এনেছিলেন, বলে ছিলেন, “ভালো ক্যাস্টর অয়েল মাথায় মাখার, মেখে ফেলো।” সেই তেল মেখে কী দুর্দশা সুশীলার।

“মা?”

সুশীলার হুঁশ ছিল না। শুনতে পাননি।

হেমদা বললেন, “মকর তোমায় ডাকছে।”

হুঁশ হল সুশীলার। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে স্বামীর দিকে তাকালেন। তখনও পুরোপুরি মন ফিরে আসেনি। “কিছু বললে?”

“মকর তোমায় ডাকছে।”

“হ্যাঁ, যাই। রান্নায় বসবে ও…।” বলে সুশীলা ধীরেসুস্থে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “শিবু ভাল ভেটকি মাছ এনে দিয়েছে। কী খাবে? স্টু? না ঝাল করে দেব। ঝাল খেতে পারবে?”

“ভেটকি!…একদিন ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করে। সেই বউমা করেছিল। মন্দ হয়নি।”

“তোমার বউমার চেয়ে আমি ভাল ফ্রাই করতে পারি। কত খেয়েছ—।”

“তা খেয়েছি। আর একদিন খাওয়াও।”

“আজ আর হবে না। শিবুকে ফ্রাইয়ের মাছ কাটিয়ে আনতে বলব।…আজ স্টু খাও।”

ঘাড় হেলালেন হেমা। “তাই করো।”

সুশীলা চলে গেলেন।

হেমদা বসে থাকতে থাকতে আবার একবার জয়দের ফ্ল্যাটের দিকে তাকালেন। কেউ নেই বাইরে। মাঝে মাঝে ব্যালকনির দরজায় পরদা উড়ে যাচ্ছে। আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। শীতের বাতাস কি বইতে শুরু করল। এখনও দেরি রয়েছে শীত পড়তে। কিন্তু ঠাণ্ডাটা বেশ বোঝা যায় রাত্রে।

হেমদাও উঠলেন। বাইরে গিয়ে বসবেন। দাড়ি কামাবেন আলস্য করে। চা খাবেন, এক কাপ। এই অগ্রহায়ণের একটু রোদ লাগাবেন গায়ে। ছাদে কয়েকটা টব আছে ফুলগাছের। পচা পাতা পরিষ্কার করবেন। মাটি খুঁড়ে দেবেন সামান্য। আঙুলের ফোলা অনেকটাই কমে গিয়েছে। চক্রবর্তী বলেছে, হাত পা নাড়াচাড়া করবেন সব সময়। হাতের আঙুলের একসারসাইজ করবেন। মুঠো করবেন শক্ত করে, মুঠো খুলবেন; কোনো জিনিস শক্ত করে ধরবেন, তারপর ছেড়ে দেবেন।

হেমদা হেসে বলেছিলেন, “তুমি যে কী বলো ডাক্তার। এ-বয়েসে শক্ত করে ধরার ক্ষমতা আর কোথায়! সবই আলগা করে দিচ্ছি।”

দুপুর বেলায় হেমদা ঘুমোন না। ঘুমোলে রাত্রে ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাগজ পড়েন, বই পড়েন; খানিকক্ষণ তন্দ্রার ঘোরে থাকেন। তারপর উঠে পড়েন। সুশীলা গা গড়াগড়ি করে খানিকটা ঘুমিয়ে নেন। পাশাপাশি জোড়া বিছানা। দু’জনে বরাবর এইভাবে শুয়ে এসেছেন।

বসার ঘরে ফোন বাজল হঠাৎ। থামল না, বেজেই চলল।

হেমদা গায়ের ওপরকার চাদর সরিয়ে উঠলেন। একটু শীত শীত লাগে তাঁর আজকাল। চাদর না চাপিয়ে পারেন না।

উঠে বসার ঘরে গেলেন হেমদা। ফিরে এলেন খানিক পরে।

“কার ফোন গো?” সুশীলা বললেন, তাঁর পাতলা ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

“ওই ওদের। জয়দের। কে একজন দত্ত ফোন করছিল, ল্যান্সডাউন থেকে। বলল, প্লিজ সান্যালকে একটু ইনফর্ম করে দেবেন, আমরা বিকেলে যেতে পারছি না। চেষ্টা করব। তবে পারব বলে মনে হচ্ছে না।”

“দত্ত কে?”

“ওদের বন্ধু-বান্ধব হবে।”

“তা বলে দিলে ওদের?”

“কাকে বলব! সব বন্ধ। নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ছুটির দিন।…বিকেলে বলে দেব। কিন্তু ওদের সঙ্গে তো আলাপ হয়নি আমার। ফোন নম্বর জানল কেমন করে?”

“আমি বলেছি।…মীনার সঙ্গে সেদিন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলছিলাম। তখন বলেছি।”

হেমদা হেসে ফেললেন, “ও তুমিই তা হলে ঘরের শত্রু বিভীষণ!” হাসতে লাগলেন হেমদা।

॥ পাঁচ ॥

সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। আজ কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, শীত তার আসার হাঁক দিয়েছে। বাতাসটা ঠাণ্ডা, তেমন কনকনে নয়, কিন্তু শুকনো গা সিরসির করে। বেশ এলোমেলো। আজ আলোও আছে। ওদিকে আবার জ্যোৎস্নাও। রাস্তার, বাড়ির আলোর জন্যে জ্যোৎস্না আড়াল পড়ে আছে।

হেমদা শোবার ঘরে দাঁড়িয়ে একটু গ্লিসারিন নিয়ে হাতে ঠোঁটে মাখলেন। ঠিক বুঝতে পারছেন না কেন, কিন্তু বিকেল থেকে কেমন জ্বালা করছে হাত মুখ। সাবানের দোষ, না শীতের বাতাসের জন্যে কে জানে। গলাটাও সামান্য ভেঙেছে। ঠাণ্ডা লাগল নাকি?

সুশীলা শাড়িটা পাল্টে নিচ্ছিলেন। আলমারির দিকে দাঁড়িয়ে। আজকাল তাঁর খুব সুবিধে। গা-ধোওয়ার পাট নেই, চুল আর চিরুনি নিয়ে বসতে হয় না, কোনো রকমে মাথার চুলে একবার চিরুনি ছুঁইয়ে শাড়িটা পাল্টে নিলেই হল। না পাল্টালেও চলে। তবু অভ্যেস।

হেমদা শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে এলেন। এসেই কেশে ফেললেন। নিঃশ্বাসে ধোঁয়া লাগল। মকরকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। সুশীলা বলেছিলেন, আবার মশার উৎপাত বাড়ছে, ছোবড়া আনিয়েছি নারকোলের, একটু ধোঁয়া দিয়ে দিস, মা। মকর ধোঁয়া দিয়েছে। ঘর একেবারে ধোঁয়ায় ভরতি।

ব্যালকনির দরজাটা না খুললেই নয়। হেমদা দরজাটা খুলে দিলেন। বাইরের এলোমেলো হাওয়া এসে ঘরে ঢুকুক। ধোঁয়ার ভাবটা কেটে যাক।

দরজা খুলতেই জয়দের ফ্ল্যাট থেকে বাজনা ভেসে গেল। প্রথমে বিকট হয়ে কানে এসে লাগল। তার পর শব্দটা কমে গেল অনেক, আবার আস্তে আস্তে বেড়ে মোটামুটি একটা উঁচু পরদায় বাঁধা থাকল। বিলিতি রেকর্ড বাজছে। বাজনার রেকর্ড। ভীষণ জোরে না হলেও মোটামুটি জোরে। জয়রা মাঝে মাঝে এই রকম করে: রেকর্ড চাপিয়ে দেয় গ্রামোফোনে। তবে হেমদারা যে-ধরনের গানটান শুনেছেন, যে মোলায়েম ঢঙে—এ তেমন নয়। হেমদা শুনেছেন, এই নতুন ব্যাপারটা স্টিরিও-র। বোধ হয় তাই। বাজে যখন—ঘরদোর কাঁপিয়ে দেয়। এ-পাড়াতে এই জিনিসটা খুব চলছে। জয়রাও স্টিরিও বাজাচ্ছে। কিন্তু বিলিতি বাজনা। ওরা বেশির ভাগ সময় এই ধরনের জিনিস বাজায়। একদিন উর্দু গজল বাজাচ্ছিল। হেমদা খাপছাড়া ভাবে শুনেছেন। ভালই লাগছিল। জয়দের সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন বিলিতিপনা। বিলিতি বাজনা বাজায়, গান শোনে। শনি রবিতে টি-ভি-ও খোলে না হিন্দী বাংলা সিনেমার জন্যে। অবশ্য আলোই বা ক’দিন থাকে।

ব্যালকনিতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন হেমদা। হ্যাঁ, শীতের বাতাস, বোঝা যায় বেশ, একটু বোধ হয় গন্ধও পাওয়া যায়, হেমন্তের শেষ আর শীতের শুরুর কুয়াশা মেশানো বাতাসের। সামান্য দূরে ট্রেন লাইন। জলা জায়গাও আছে লাইনের গায়ে গায়ে। বাতাসে সামান্য জংলা গন্ধও থাকে।

হেমদা এদিক ওদিক তাকালেন। আলো থাকলে পাড়াটা ভালই দেখতে লাগে। রাস্তা মেরামতি হয়েছে পুজোর আগে। পিচ কোথাও কোথাও চকচক করছিল। ট্যাক্সি যাচ্ছে। রিকশা। সোমসাহেবের বাড়িতে অ্যালসেসিয়ান এক আধবার গলা ছেড়ে হাঁক দিচ্ছে। হেমদার এক কুকুর ছিল আগে, অনেক আগে, ল্যাপ ডগ। অনেক দিন বেঁচে ছিল কুকুরটা, তারপর একদিন বাংলোর কাঁঠালতলায় গিয়ে হুট করে মরে গেল। আর কুকুর পোষেননি হেমদা। ছেলেমেয়েরা কী কান্নাই কেঁদেছিল। সুশীলাও।

তে-কোনা ছোট পার্কটার দিকে তাকালেন হেমদা। পার্কে আজকাল এক আধটা বাতি জ্বলে। একেবারে নেড়া। দুটো দোলনা আর স্লিপ ছাড়া বাচ্চাদের অন্য কিছু নেই। তাতেই কী ভিড় বিকেলের দিকে। এখন আবার ক্রিকেট নেমেছে। নিতুটার খুব ঝোঁক ছিল ক্রিকেটে। কলেজেও খেলাধুলো করত। এক বছর মাঠে কাদের হয়ে যেন খেলেও ছিল। তখনই কানের কাছে চোট পায়। আর খেলত না। বেটা ভীতু। নিতু বাঁ কানে একটু কম শোনে। বউমা বোধ হয় সেই জন্যেই নিতুর সঙ্গে কথা বলবার সময় বেশ জোরে জোরে কথা বলে। হেমদাদের অবশ্য বউমার এই কথা বলার ধরনটা পছন্দ হয় না। মনে হয় বউমা নিতুর ওপর তার দাপট দেখাচ্ছে, শাসন করছে।

জয়রা কি শব্দটা আবার বাড়িয়ে দিল? কানে লাগছে। বিকেলে হেমদা যথারীতি জয়কে টেলিফোনের খবরটা জানিয়ে দিয়েছেন। তখনই জয় বলছিল, একদিন তারা দুজনে আলাপ করতে এ-বাড়িতে আসবে।

না, শব্দটা বেশ জোরেই হচ্ছে। জয়রা আবার চড়া পরদায় তুলে দিয়েছে আওয়াজটা। অদ্ভুত সব যন্ত্র বাজছে। নানা রকম সুরেলা শব্দ যেন দোল খাচ্ছে, নাচছে। মাঝে মাঝে খুব জোরে তুড়ি মারার শব্দের মতন আওয়াজ উঠছে। তার পরই ব্যাঙ ডাকার মতন এক শব্দ। কী বাজছে ওটা? বোধ হয় কোনো নাচের বাজনা। সেই রকম মনে হচ্ছিল। শব্দটা নরম থাকলে হয়ত ভাল শোনাত। অতটা জোর হওয়ার কানে বাজছে।

হাওয়া এল হঠাৎ। এলোমেলো হাওয়া। এদের বসার ঘরের পরদা কাপড় উড়ে যাবার মতন উড়তে লাগল।

হেমদা জয়দের বসার ঘর দেখতে পাচ্ছিলেন। আলো কম নয়। অথচ সব আলোই যেন আনাচে কানাচে জ্বলছে। শেড দেওয়া স্ট্যান্ড লাম্পটা লালচে আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘরে।

উড়ন্ত পরদা পাক খেয়ে দুলতে দুলতে আবার যেমন কে তেমন হয়ে গেল। ঘর আর দেখা যাচ্ছিল না। তা না যাক। হেমদা যেটুকু আগে দেখেছেন দু এক ঝলক করে, সকালে সন্ধেতে, তাতে জানেন, আসবাবে, ঘর সাজানো জিনিসপত্রে জয়রা তাদের বসার ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। অজস্র পয়সা খরচ না করলে এ-ভাবে ঘর সাজানো যায় না।

কিন্তু বাজনার আওয়াজটা যে কানে বড় লাগছে। একটু কমিয়ে দিতে বলবেন নাকি? কাকে বলবেন?তাঁর গলার ভাঙা স্বর ওরা শুনতে পাবে না।

হেমদা একটু ঝুঁকে পড়লেন, যেন বলবেন কিছু।

আবার পত পত করে পরদাটা উড়ে গেল হাওয়ায়। বসার ঘরের অনেকটাই স্পষ্ট। হেমদা দেখলেন, জয় মোটা ভরাট সোফায় বসে আছে। ঠিক বসে নেই একটু আড় হয়ে গোল গোল কুশন পিঠে রেখে আধ শোয়া হয়ে রয়েছে। তার ঠোঁটে সিগারেট। সামনের সেন্টার টেবিলে বোতল, গ্লাস, বরফকুচো রাখার কাচের বাটি। হেমদা বুঝতে পারলেন জয় মদ খাচ্ছে। এমন ভাবে ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে যেন একটু বেশি নেশা হয়েছে তার।

মীনাকেও দেখা যাচ্ছিল। তার পরনে পাতলা সেমিজের মতন কিছু একটা, মাথার এলোমেলো। চোখমুখ ফোলা। সে জয়ের মাথার দিকে ছোট সোফায় বসে হাসছিল। তার হাতে গ্লাস। আস্তে আস্তে গ্লাসটা দোলাচ্ছিল। যেন বাজনার তালে তাল রাখছে।

জয়ের ঠোঁট থেকে সিগারেট তুলে নিয়ে মীনা নিজের ঠোঁটে দাঁতে কামড়ে ধরল।

“কি গো, তুমি দরজা খুলে বাইয়ে দাঁড়িয়ে কেন? কী দেখছ? ঠাণ্ডা লাগবে যে।” সুশীলার গলা। বসার ঘরে এসেছেন।

হেমদা চমকে উঠলেন। “না, না, ঘরে বড় ধোঁয়া জমে গিয়েছিল।…তাই।”

হেমদা তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে গেল। একেবারে চোখের পলকে। যেন অন্ধ করে দিল হেমদাকে।

“তুমি এগিয়ো না। দাঁড়িয়ে থাকো। আসছি।” হেমদা বললেন। অন্ধকারটা চোখে সইয়ে নিচ্ছিলেন।

ততক্ষণে ব্যালকনিতে জ্যোৎস্না নেমে গিয়েছে। সুন্দর নরম জ্যোৎস্না।

হেমদা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাবার আগেই দেখলেন, জয়দের, ঘরে আলো চমকে উঠেছে। আরে, আবার আলো এসে গেল নাকি? প্রায় পরমুহূর্তে হেমদা বুঝতে পারলেন, জয়রা নিজেদের আলোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

দরজা বন্ধ করলেন হেমদা। ব্যালকনিতে জ্যোৎস্না কেমন ফিকে হয়ে গিয়েছে। জয়দের আলোর জন্যে নাকি?

“তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো,” হেমদা স্ত্রীকে বললেন, “আমি আসছি।”

অন্ধকার হাতড়ে এসে হেমদা স্ত্রীর হাত ধরলেন। “বসো এখানে। সোফায় বসো। মকরকে আলো দিতে বলছি।”

হেমদা চেঁচিয়ে মকরকে আলো দিতে বললেন।

সুশীলা বসে পড়েছেন। তাঁর একটা হাত কিন্তু হেমদা ধরে আছেন তখনও।

সুশীলা বললেন, “মীনাদের বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখলাম।”

“হ্যাঁ। ওরা বোধহয় ইনভারটার লাগিয়ে নিয়েছে। আজই দেখলাম।”

“কী লাগিয়েছে?”

“ওই আলো। মিনি জেনারেটার গোছের। অনেকেই লাগাচ্ছে আজকাল।”

একটু চুপচাপ থাকলেন সুশীলা। তারপর বললেন, “আমরা একটা লাগাতে পারি না? এই অন্ধকারে তুমি বসে থাকো।…অনেক দাম নাকি ওই আলোর?”

হেমদা কোনো জবাব দিলেন না। স্ত্রীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অন্ধকারে স্ত্রীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হল, সত্যিই কি তিনি অন্ধকারে বসে থাকেন, তাঁর কষ্ট হয়? কই মনে তো হয় না। এই যে, এখন অন্ধকারে সুশীলার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর তো কোনো কষ্ট হচ্ছে না। বরং স্ত্রীর এই স্পর্শ থেকে তিনি অনুভব করছেন সুশীলা কত গোপনে কত গভীরে তাঁকে ইহজীবনের সমস্ত মমতা, নিবিড়তা, সান্নিধ্য, ভালবাসা নিবেদন করছে এবং বিষন্নতাও। পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা স্ত্রীর শুকনো, খসখসে, কোঁচকানো, রক্তস্বল্প হাত ধরে হেমদা দাঁড়িয়ে থাকলেন অশেষ মমতায় ও তৃপ্তির সঙ্গে।

মকর আলো আনছিল।

হেমদা বললেন, “অন্ধকারে কোথায় বসে থাকি। এই তো…! ওদের ওই আলো আমাদের চোখে সইবে না গো। পুরনো আলোই ভাল আমাদের।”

মকর আলো নিয়ে ঘরে এল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *