সোপান

সোপান

প্রথম টাঙ্গায় বাবা, মা; পরেরটায় দিদি আর পুষ্প। শেষের গাড়িটায় আমরা দু’জন—হেমদা আর আমি। টাঙ্গায় ওঠার সময় হেমদাকে আমরা দিদির গাড়িতে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলাম একবার; পুষ্প রগড় করে বলেছিল, “যান না, জোড় বেঁধে বসুন গে যান, এখানে কেন?” পালটা রসিকতা করে হেমদা বলল, “দেখো ভাই, প্রত্যাশার জন্যে মানুষ সামনের দিকে চায়, আমি ও-গাড়িতে বসলে আমায় যে পিছু দিকে চাইতে হবে;” বলে হেমদা পুষ্পর চোখে চোখ রেখে হাসল। পুষ্প কথাটার মানে বুঝতে মুহূর্ত সময় নিল, তারপর হেমদার হাতে চিমটি কেটে দিল জোরে, বলল—“আ—হা!”

আমাদের টাঙ্গা তিনটে প্রায় ঘন্টা খানেক হল ছুটছে। বাবা-মা’র গাড়িটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে ভাল গাড়িটায় ওঁদের বসানো হয়েছে; ভাল ঘোড়া, ভাল গদি না হলে বাবা-মা’র কষ্ট হতো। প্রথমত ওঁদের বয়স হয়েছে, দ্বিতীয়ত, বাবা আজ সাত-আট বছর নিজের বাড়ির অস্টিন গাড়ি ছাড়া অন্য কিছুতে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত নন। আজকের এই হুজুগে আমরা ওঁদের জোর করে টেনে এনেছি।

দিদি আর পুষ্পর গাড়িটা মন্দের ভাল। টাঙ্গার ঝাঁকুনি দিদির সয় না; ভারী শরীরে টাল সামলাতে কষ্ট হয়, কখনো কখনো আঁতকে চেঁচিয়ে ওঠে। দিদিদের গাড়িটাকে তাই ধীরেসুস্থে চালাতে বলে দেওয়া হয়েছিল। ওরা আমাদের খানিকটা আগে আগে যাচ্ছে।

শেষের গাড়িটা একেবারে লঝ্ঝড়। যেমন গাড়ি, তেমনি ঘোড়া। নড়বড়ে শরীরে শব্দ করতে করতে, আমাদের দু’জনকে কখনো ডাইনে টলিয়ে দিয়ে, কখনো বাঁয়ে হুমড়ি খাইয়ে গাড়িটা চলেছে। হেমদা মাঝে মাঝে বলছে, “অন্তু, নার্ভাস হয়ো না; মহাপ্রস্থানের পথের এটা প্রাইমারি প্রিপারেশান।”

আমরা পঞ্চপাণ্ডব নই, মহাপ্রস্থানেও যাচ্ছি না। আমরা মজুমদার ফ্যামিলি: সুরেশ্বর মজুমদার, তাঁর স্ত্রী, দুই কন্যা এক পুত্র এবং জামাতা—এই মিলিয়ে আমরা ছ’জনে একটি গোটা পরিবার আপাতত চলেছি একটি স্তম্ভ দেখতে; প্রাচীনকালের স্তম্ভ।

শীতের রোদ খুব ঘন এবং হলুদ হয়ে এসেছে; যেন সকাল থেকে নীল অনন্ত আকাশে মাঘের রোদ জ্বাল দেওয়া হচ্ছিল, ফুটে ফুটে এখন তা ঘন ও ঠাণ্ডা হয়ে পুরু একটা সর পড়ে গেছে রোদের। দুপুর শেষ হতে চলল। পাহাড়ী বনপথের মেঠো রাস্তা ধরে আমাদের টাঙ্গা তিনটে ছুটছে; ঘোড়ার গলায়-বাঁধা ঘণ্টির মালা ঝুনঝুন শব্দে বাজছে সর্বক্ষণ; মনে হবে আমরা যেন কোনো প্রাচীন কালের তীর্থযাত্রী।

এখন আমরা যেখান দিয়ে যাচ্ছি, তা যেন পাহাড়তলীর মতন। নির্জন, নিস্তব্ধ। চোখ মেলে দেখছি, কোথাও ঢালু জমি নদীর চরের মতন আদিগন্ত ছড়ানো, ছোট বড় পাথরের বিক্ষিপ্ত স্তূপ, ঝোপঝাড়; কখনো চোখে পড়ছে অরণ্যের হরিৎ-শ্যাম পটচিত্র, আকাশ-মাটির মাঝখানে দৃষ্টি জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কখনো উত্তরে, দূরান্তে পাহাড়টি দেখতে পাচ্ছি, রৌদ্রকিরণ এবং মেঘপুঞ্জের জন্য তার মাথায় ধোঁয়ার জটা। কদাচিৎ একটি গ্রাম, কাঠুরিয়ার বয়েলগাড়ি এবং ছোলার ক্ষেত চোখে পড়ছিল।

হেমাদা বলল, “অন্তু, আমরা বেরাস্তায় চলে আসিনি তো? কোথায় সেই ‘কেপ অফ গুড হোপ’! চোখে পড়ছে তোমার?”

হেমদা যেদিন থেকে এই স্তম্ভটার কথা শুনেছে সেদিন থেকে ওটাকে ‘কেপ অফ্ গুড হোপ’ বলে আসছে। আমি অনেকবার বলেছি, “তুমি কেপ পাচ্ছ কোথায়, হেমদা! ত্রিপাঠীবাবুর কথামতন ওটা টাওয়ার; টাওয়ার অফ্ গুড হোপ বলতে পার।” দিদি বলেছে, “সোজাসুজি মিনার বলো না, বাপু! যা বুঝছি তাতে ওটা মনুমেন্ট কি মিনার-টিনার হবে।” দিদির কথায় পুষ্প আর হেসে বাঁচেনি, বলেছে, “শুনছ ওটা কোন আদ্যিকালের সৃষ্টি, লোকে তখন মিনার-টিনার বুঝত না। তার চেয়ে এরা যা বলে তাই বলো।”

এরা যা বলত তাতে আমরা কৌতুক বোধ করতাম। এরা বলত ‘মন্‌দির ’ । সরল, দেহাতী মানুষগুলোর কাছে ইটের ঢিবি মাত্রেই মন্দির। ত্রিপাঠীবাবু অবশ্য বলেছিলেন, অনেকে একে ‘নভস্‌তি’ বলে। কথাটা আমরা বুঝিনি প্রথমে, পরে বুঝলাম: কোনো কালে কেউ সংস্কৃত ভাষায় বুঝি বলেছিল নভে অস্তি, তাই থেকে নভস্‌তি । অর্থাৎ মিনার চূড়া যেন আকাশ ছুঁয়ে রয়েছে, শূন্যে ভাসছে।

ত্রিপাঠীবাবু আমাদের নভস্তির গল্পটা শুনিয়েছিলেন। তার আগে পুষ্প শুনেছিল মতিয়ার কাছে।

মতিয়া এ বাড়ির চাকর, এখানকারই লোক। আমরা আজ পক্ষকাল এখানে। সপরিবারে বেড়াতে এসেছি। ব্যবসাসূত্রে বাবার পরিচিত কেউ তাঁকে এই স্বাস্থ্যকর নির্জন জায়গাটির কথা বলেছিলেন। বাড়িও তিনি যোগাড় করে দিয়েছেন। এসে পর্যন্ত আমাদের বিশেষ কোনো অসুবিধে ভোগ করতে হয়নি। বাবা পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, মা সংসার দেখছিলেন, আর আমরা চারজনে—হেমদা, দিদি, পুষ্প আর আমি এখানের প্রচণ্ড শীতে যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়ে, নদী ও ঝরনা দেখে, হাটমাঠ করে, খেয়ে ঘুমিয়ে, তাস খেলে দিন কাটাচ্ছিলাম। বিহার ও উত্তরপ্রদেশের সংলগ্ন এই মনোরম, নির্জন ও নির্বান্ধব। জায়গাটি ভাল লাগলেও ক্রমশই আমরা উত্তেজনাহীন হয়ে উঠছিলাম। হেমদা না থাকলে হয়তো এত নির্জনতা সহ্য করা যেত না।

এমন সময় একদিন মতিয়ার কাছে এক গল্প শুনে পুষ্প বলল, “এখান থেকে খানিকটা দূরে এক মন্দির আছে, সেই মন্দিরের মাথায় চড়লে একেবারে স্বর্গ। …চলো, একদিন স্বর্গ বেড়িয়ে আসি।”

হেমদা বলল, “স্বর্গের জন্যে বাইরে ছুটব কেন ভাই, আমার হাতের কাছে ডবল স্বর্গ রয়েছে।”

পুষ্প ছুটে এসে হেমদার মাথার চুল ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল; বলল, “ইস্—মানুষের একটা হয় না, আপনার আবার ডবল।”

হাসি-তামাশার মধ্যে পুষ্প আমাদের কাছে মতিয়ার কাছে শোনা গল্পটা বলল। শুনে আমরা হেসে বাঁচি না। কোন এক রাজা নাকি রামজির বড় ভক্ত ছিল, বহুকাল সুখে শান্তিতে রাজত্ব ও প্রজাপালন করে শেষে বুড়ো বয়সে ছেলের হাতে রাজ্যপাট তুলে দিয়ে বাণপ্রস্থ গ্রহণ করল। রামভক্ত সেই ধার্মিক রাজা বনে বনে ঘুরে বেড়ায়, সাধনভজন করে, তার সঙ্গে না আছে পাত্রমিত্র না সৈন্যসামন্ত। ঘুরতে ঘুরতে রাজা একদিন এল মহাদেও পর্বতমালার কাছে; চেয়ে দেখল বিরাট পর্বত, আকাশ ছাড়ানো মাথা; ভাবল, ওই পাহাড় বেয়ে সে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের মতন এবার স্বর্গে চলে যাবে। পাহাড় চড়া শুরু হলো তার। রাজা বড় ভুল করেছিল, পাহাড়ে চড়ার আগে পুজো দেয়নি পর্বতের, তাই পর্বত তাকে নিল না, ফেলে দিল। রাজার পা গেল ভেঙ্গে, হাত ঠুঁটো হল। তখন সেই অক্ষম রাজা তার রামজিকে ডেকে বলল; আমি চিরকাল তোমার পুজো করে এসেছি, আর কারও পুজো করব না; তুমি আমায় স্বর্গে ওঠার পথ যদি করে দাও তবে যাব, নয়তো পড়ে থাকব এইখানে। রামজি তখন ওই মন্দির করে দিলেন—ভক্তের জন্যে; বললেন: তোমার ভাঙা পা ভাঙা হাতেই তুমি ধীরে-সুস্থে ওই সিঁড়ি ধরে উঠে আসবে, আমি তোমার জন্যে পাহাড়ের চেয়ে উঁচু মন্দির বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু মন্দিরে ঢুকলে আর ফিরতে পারবে না। রাজা তখন রামজির পুজো করে ওই মন্দিরে ঢুকল, তারপর আর মন্দিরের বাইরে আসেনি।

হেমদা হেসে বলল, “রামচন্দ্রের অপার মহিমা। সাগর বাঁধতে পারেন, আর রাবণের ওপর টেক্কা মেরে স্বর্গের সিঁড়ি করতে পারবেন না। …যাই বলো, এইসব সরল মানুষের ইমাজিনেশান বড় সাদামাটা, সুন্দর।”

তারপর আমরা একদিন ত্রিপাঠীবাবুকে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন: রামজি-টামজি না ভাইয়া, কোই হিন্দু রাজা ওটা বানিয়েছিল। দুসরা এক কিস্সা আছে, শুনুন।

ত্রিপাঠীবাবুর গল্পে ইতিহাসের একটু গন্ধ ছিল, যদিও তা কাহিনী। এক হিন্দু রাজার তৈরী ওই নভস্‌তি; কি তাঁর নাম, কিবা তাঁর পরিচয়, আজ আর জানা যায় না। কিংবদন্তী বলে, তিনি ছিলেন শাহজাহান বাদশার সমসাময়িক। রাজা আবার স্বয়ং একজন দক্ষ স্থপতি। একবার তিনি তাঁর অসামান্যা রূপলাবণ্যময়ী যুবতী মহিষীকে সঙ্গে করে মহাদেব পর্বতমালায় পুজো দিতে এসেছিলেন। ফেরার পথে রাজারানী বনাঞ্চলে বিশ্রাম নিচ্ছেন, অপরাহ্ণ বেলা, অদূরে তাঁর সৈন্যসামন্তরা ক্লান্তি বিনোদন করছে, বসন্তকাল, বনভূমি নব পত্রপল্লবে সজ্জিত, রাজার এই স্থানটি নয়নে ধরে গেল। রানীও বিমোহিত। রাজা রানীকে বললেন, তোমার সৌন্দর্যের স্মৃতিতে এইখানে একটা কিছু গড়ে দিতে চাই, বলল কি ইমারত গড়ব? রানী বললেন, আমার দুটো শর্ত আছে, যদি শর্ত রাখেন, তবে প্রার্থনা জানাই। রাজা হেসে বললেন, রাখব শর্ত। তখন রানী দুই শর্ত দিলেন। রাজাকে স্বহস্তে একটি মিনার তৈরী করে দিতে হবে; আর দ্বিতীয় শর্ত—যতদিন না রানী সন্তুষ্ট হয়ে বলছেন, তিনি তৃপ্ত, ততদিন রাজাকে মিনারের উচ্চতা বাড়িয়ে যেতে হবে। …রাজা প্রতিশ্রুতি দিলেন, রানীর ইচ্ছা মতনই কাজ হবে। …তারপর ওই নভস্‌তি কাজ শুরু হল, রাজা নিজে নকশা বানালেন মিনারের, তদারকি করতে লাগলেন কাজের, আর মিনার মাথা তুলতে লাগল। মিনারের একটি করে তল শেষ হয়, রাজা নিয়ে আসেন রানীকে, দু’জনে উঠে এসে দাঁড়ান শেষ চত্বরে, রাজা শুধোন, তুমি তৃপ্ত? রানী বলেন—না; তিনি তৃপ্ত নন। আবার মিনারের উচ্চতা বাড়ানোর কাজ শুরু হয়, রানী ফিরে যান রাজপুরীতে। এমনি করে সাত বছরে সাতটি চবুতর বা তলা তৈরী হলো। রানী আসেন, শীর্ষে উঠে দেখেন চারপাশ, তারপর মাথা নেড়ে বলেন, তিনি এখনো তৃপ্ত নন। …আস্তে আস্তে বছর যায়, রাজা বৃদ্ধ ও অক্ষম হয়ে পড়েন, রানীও বিগতযৌবনা। অবশেষে রাজা শেষ তল তৈরী করে রানীকে ডেকে পাঠালেন। তারপর দু’জনে মিনারের মধ্যে প্রবেশ করলেন। আর ফিরে আসেননি। ৰা রাজা তাঁকে ফিরতে দেননি।

“আর রাজা?” আমি ত্রিপাঠীবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

ত্রিপাঠীবাবু বলেছিলেন, “ভাইয়াজি, রাজাভি নেহি লোওট আয়া। মালুম মনোরথ পূরণ হো গ্যয়া, সুখ মিলা শান্‌তি মিলা।”

কাহিনী শুনিয়ে ত্রিপাঠীবাবু আমাদের বলেছিলেন, আমরা যখন বেড়াতেই এসেছি, তখন একবার ঘুরে যাই না কেন নভস্‌তি। গল্পকথায় কত কি তো বলে তাতে কি যায় আসে! “আগর যাইয়ে গা তো বহুৎ আনন্দ্ মিলে গা, আসমান উঁচা ওহি নভস্‌তি; অন্দর ভি ভারী মনোরম।”

হেমাদা জিজ্ঞেস করল, “লোকে বেড়াতে যায় না? মিনারে চড়ে না?”

ত্রিপাঠীবাবু বললেন, “কেউ যায় বটে, এখানকার কথা ক’জন আর জানেন বলুন! তবে যারা বা মিনারে চড়তে যায় তারাও সামান্য উঠে ফিরে আসে, ভয় পায়, ঠকে যায়।”

ত্রিপাঠীবাবুর গল্প শোনা হয়ে গেলে আমরা অন্য কোথাও কিছু দেখতে যাবার মতন না পেয়ে ওই নভস্‌তি বা মিনারটি দেখতে যাওয়া স্থির করলাম।

হেমদা বলল, “কত আর উঁচু হবে—, গল্পের গরু গাছে ওঠে। আর যদি একটু উঁচুই হয়—ক্ষতি কি—ঘষড়ে-টষড়ে উঠে যাব, তারপর না হয় বিছানায় শুয়ে পায়ে তেল মালিশ চালাব। চলো পুষ্প, মনস্কামনা পূর্ণ করে আসি। টপে চড়লে তো আর তোমায় আমায় ফিরতে হবে না।” হেমদা হাসতে লাগল।

দিদি হেসে বলল, “আমায় বাপু তা বলে ঠেলে ফেলে দিও না।” হাসি শেষে দিদির মুখে একটু বা লুকোনো বিষাদ নামল।

আমরা আজ ছ’জনে—সুরেশ্বর মজুমদার এবং তাঁর পরিবারবর্গ—মাঘের দুপুরে টাঙায় চড়ে সেই মিনার দেখতে যাচ্ছি। বাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না যাবার, মা-ও নিমরাজী ছিলেন। আমরা একরকম জোর করেই তাঁদের দলে টেনেছি। এই ভ্রমণ অন্তত তাঁদের খারাপ লাগার কথা নয়।

হেমদা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “অন্তু, ওই যে—ওই, নর্থের দিকে তাকাও। দেখতে পাচ্ছ!”

উত্তরের দিকে তাকিয়ে আমি একটি ধূসর মিনার দেখতে পেলাম।

আমরা মিনারের কাছে এসে দাঁড়ালাম। টাঙ্গা তিনটে চড়াইয়ের নিচে। এতক্ষণে সূর্য হেলে পড়ছে; পশ্চিমের দিকে সামান্য একটি চালা। ওই চালার সামনে একটি গ্রাম্য কূপ। অল্প তফাতে বুঝি একটি গ্রাম আছে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রাম। চালাবাড়িতে কেউ ছিল না, ঘরের মধ্যে একটি ধুলোভরা খাতা, কয়েকটি অর্ধদগ্ধ মোমবাতি পড়ে আছে। টাঙ্গাঅলারা বসেছিল, আপনারা যান, আমরা দরোয়ানকে ডেকে আনছি।

মিনারের চারপাশে আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, বাবা বললেন, “পুরনো টাওয়ার, তবে খুব পুরনো নয়। শ’ দুই-আড়াই হতে পারে।”

মা বললেন, “জায়গাটি বড় নিরিবিলি। মন জুড়োয়।”

পুষ্প মাথা তুলে হাঁ করে মিনারের চূড়া দেখছিল, বলল, “দাদা দেখ, মনে হচ্ছে মিনারের মাথাটা হেলে পড়ছে, এক্ষুনি হুড়মুড় করে আমাদের ঘাড়ে পড়বে।”

হেমদা বলল, “ইলিউসান অফ ভিস্যান।”

সুবিশাল মিনার, তলার দিকটা জরাজীর্ণ দেখায়, ফাটলে ফোকরে গুল্ম ও লতাপাতা, চাপড়া চাপড়া ঘাস। মাথা তুলে মিনারের উচ্চতা দেখে আমার মনে হল না, স্থানটি অনধিগম্য। শীতের আকাশ আরো নীল, আরো স্বচ্ছ হয়ে এসেছে, একটি হালকা মেঘখণ্ড চূড়ার মাথার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। হু হু বাতাস বইছে। বননীর গন্ধ সেই বাতাসে।

লোকটা এল; এখানকার তদারকি করে; প্রায়-বুড়ো। বোঝা গেল, পিছনের গ্রামটিতে থাকে, কদাচিৎ কোনো ভ্রমণকারী এসে পড়লে তার চালাঘরের খাতাটি দেখায়, মোমবাতি বেচে। আমরা মোমবাতি নিলাম না, হেমদা টর্চ; এনেছিল সঙ্গে করে। মিনারে ঢোকবার সদর দরজাটির তালা সে খুলে দিল। বিশাল দরজা, বিরাট তালা।

হেমদা পরিহাস করে বলল, “ভেতরে ভয়ের কিছু নেই তো? সাপ-খোপ?”

মাথা নাড়ল বুড়ো, বলল, “অত উঁচুতে সাপ-খোপ যাবে কি করে! সাপ নেই, শের নেই, ভাল্লু নেই। মিনারের নিচুর দিকে পাখির বাসা, পাখি দু’-চারটে থাকতে পারে, পতঙ্গ দু’ পাঁচটা।”

দরজা দিয়ে ঢোকার সময় হেমদা হাসিমুখে আবার শুধালো, “ওপরে উঠতে কতক্ষণ লাগবে জি?”

বুড়ো হেমাকে দেখল কয়েক পলক, আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে মিনার দেখাল, নাকি আকাশ, বলল, “রামজিকে মালুম।”

বাবা দরজা দিয়ে প্রথমে গেলেন, তারপর মা; দিদি গেল, পুষ্প গেল; হেমদা আমায় ঠেলা দিল, আমি হেমদাকে আগে এগুতে দিয়ে পরে একবার বাইরের দৃশ্যাবলী এবং সেই বৃদ্ধের মুখ চকিতে দেখে নিয়ে মিনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম।

বাইরের অফুরন্ত আলো এবং রোদ থেকে বদ্ধগৃহে আসায় সহসা মনে হল, সমস্ত আলো দপ করে নিবে গেছে। অন্ধকার যেন অভেদ্য। সামান্য সময় আমরা নাড়াচাড়া না করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমি যথাসাধ্য চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক করে যখন এই অন্ধকার সইয়ে নিচ্ছি তখন আমার মনে হল, আমার এবং হেমদার হেমদা এবং দিদির, বাবা মা পুষ্প—আমাদের সকলের মধ্যে কেমন একটি ব্যবধান রচিত হয়ে গেছে, আমরা প্রত্যেকেই পৃথক। অদ্ভুত কোনো অন্ধকার যেন আমাদের মধ্যে দিয়ে পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে নদীর স্রোতের মতন বয়ে যাচ্ছে।

বাবা সামান্য কাশলেন, তারপর পা বাড়ালেন; তাঁর হাতে ছড়ি ছিল, ছড়ির শব্দে বুঝলাম তাঁর চোখে এই আকস্মিক অন্ধকার সয়ে গেছে, তিনি এগুতে শুরু করেছেন।

মা, দিদি, পুষ্প একে একে এগিয়ে যেতে লাগল। আমার চোখে অন্ধকার সয়ে গেল; বাবা, মা, হেমদা—সকলকেই দেখতে পেলাম। যে অন্ধকার অভেদ্য মনে হয়েছিল, সে অন্ধকার যে কিছু না, নিতান্ত দৃষ্টিবিভ্রম, এখন তা অনুভব করে খুব সহজেই পা বাড়ালাম।

বাবা, মা, দিদি, পুষ্প—সকলেই কথা বলছিল। আমরা সামান্য এগিয়ে যেতেই আলো পেলাম, নিচের বৃহৎ গোল চত্বরটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হল।

হেমদা বলল, “অন্তু, কিভাবে ভিত তুলেছে, দেখেছ! কত বড় সারকামফারেন্স। মনে হচ্ছে যেন বিরাট একটা গোল পুকুর কেটে বেঁধেছে।”

বাবা সামান্য কাশছিলেন, দিদিও গলা পরিষ্কার করছিল। নিচের বাতাস বড় ভারী, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কতকালের বাতাস যেন এখানে চুপ করে বসে বসে নিজেকে ক্রমশ একরকম প্রাচীন গন্ধ দিয়েছে, যে গন্ধ আলোয় ও বাতাসে পরিশুদ্ধ নয়।

বাবা আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন, পাশে মা, মা’র প্রায় গা ঘেঁষে দিদি। আমরা পেছনে।

দিদি বলল, “বাবা, তোমার কষ্ট হচ্ছে?”

“হয়েছিল একটু, এখন সয়ে আসছে।”

“দেখতে পাচ্ছ? টর্চ দিতে বলব?”

“এখন পাচ্ছি। ওপর থেকে আলো আসছে।”

ওপর থেকে আলো আসছিল। আমরা প্রথম সোপানের মুখে এসে দাঁড়ালাম।

“জামাইবাবু—” পুষ্প ডাকল।

“বলো।” হেমদা জবাব দিল।

“সিঁড়ি গুনবেন নাকি?”

“ওঠার সময় নয়।”

“কেন!”

“ওপরে ওঠার সময় কখনো শেষ দেখতে নেই, উদ্যম নষ্ট হয়,” হেমদা হালকা গলায় বলল। “সিঁড়িও গুনতে নেই ঠিক ওই কারণে।”

বাবা সোপানে পা দিয়েছেন, মা বললেন, “পারবে তো?”

“তোমার কি মনে হচ্ছে পারব না?” বাবা কেমন গলায় যেন বললেন।

মা বোধহয় একটু লজ্জা পেলেন। “অভ্যেস তো নেই। আস্তে ওঠো।”

“আমি ঠিক উঠব। তুমি সামলে এস।” বাবা যেন অনেকটা আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজের আরোহণ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন। তারপর সামন্য বুঝি পরিহাস করে দিদিকে বললেন, “রেণু, তোমার মা’র একটা হাত ধরো।”

দিদি বোধ হয় মা’র হাত ধরতেই যাচ্ছিল, মা বললেন, “ছাড়, এত চওড়া সিঁড়ি, সবাই উঠছে আমি পারব না!”

বাবা মা দিদি সোপান উঠছে, আমরা পিছু পিছু। আশ্চর্য, প্রথমে যখন ভেতরে ঢুকেছিলাম তখন এই কূপসদৃশ বদ্ধ ইমারতের কোনো দিশে পাইনি। এখন আমাদের সামান্যই অসুবিধে হচ্ছে। সোপানের ধাপগুলি মিনারের গা বেয়ে বুঝি চক্রাকারে উপরে উঠে গেছে। ক্রমশই অনুভব করছিলাম, কয়েকটি চক্রাকার সিঁড়ির আবর্তের পর একটি করে তল; অনুমান করতে পারছিলাম, প্রতি তলে বাইরে গিয়ে দাঁড়াবার পথ ও অলিন্দ আছে, কেননা আমরা বাইরে থেকে প্রাচীর দেওয়া অলিন্দ দেখেছি। গবাক্ষ, ঘুলঘুলি ও অলিন্দ-পথে আলো আসছিল।

“হেমদা—” আমি বললাম, “মনে হচ্ছে খানিকটা উঠে গেলে আলো বাতাসের কমতি হবে না।”

“হওয়া উচিত না,” হেমদা বলল। “দেখে তো মনে হয় উলটো-উলটি জানলা মাথা বরাবরই আছে।”

আমাদের গলার স্বর সামান্য অস্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। হয়তো এই শূন্য এবং বিশাল ইমারতের মধ্যে ঢোকার পর আমরা ক্রমশই নিজেদের অজ্ঞাতে আমাদের গলার স্বর উচ্চ করছিলাম। বদ্ধ এবং জনশূন্য বড় ঘরে যেমন শব্দ সামান্য প্রতিধ্বনিত হয়, আমাদের কথাগুলিও আপাতত সেই রকম প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছিল।

পুষ্প বলল, “আমি সেই রাজার কথা ভাবছি, বেচারি রাজ্যের পাথর গাঁথতে গাঁথতে বুড়ো হয়ে গেল!”

“রাজপ্রাসাদে বসে থাকলেও বুড়ো হত,” হেমদা জবাব দিল।

“হলেও বা, কিন্তু এই পাথর গেঁথে সময় নষ্ট কেন!”

“আমাদের কাছে পাথর, যে করেছিল তার চোখে হয়তো পাথর ছিল না।”

হেমদার কথায় খুব আচমকা আমার কেমন যেন এক বুদ্ধিভ্রম হল। মনে হল, আমরা বাস্তবিক একটি প্রাচীন জরাগ্রস্ত স্তূপ অতিক্রম করছি না। রানীর কথা আমার মনে পড়ল: আশ্চর্য সেই রাজমহিষী! রাজার সঙ্গে তিনি কি শুধু কথার খেলা খেলেছিলেন? কি অভিপ্রায় ছিল তাঁর? কেন তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি? মনে মনে আমি সেই উপকথার একটি ছবি তৈরী করে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

বাবার কথা আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। তাঁর গলার স্বর গম্ভীর শোনাচ্ছিল। বাবা মাকে বলছিলেন, “ছেলেবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম। আমাদের ওখানে একটা চাঁদমারি ছিল, বড় টিলার মতন, আমরা নিচের মাঠ থেকে ছুটে এসে এক দমে সেই চাঁদমারি উঠতাম। যে আগে উঠত সেদিনকার মতন চাঁদমারিটা তার দখলে যেত। চাঁদমারি ছিল আমাদের কেল্লা আর কি!” বাবা হাসলেন।

মা’র মাথার কাপড় পড়ে গিয়েছিল, কাপড়টা তুলতে তুলতে মা হাসির গলায় বললেন, “তুমি ক’দিন কেল্লা পেতে?”

“প্রায়ই পেতাম। আমার খুব দম ছিল।” বলে বাবা থামলেন; তারপর আমাদের সকলের সামনে রহস্য করে মাকে বললেন, “আমার দমটা বড় বুকের, তুমি তো জানোই।”

দিদি বাবার একটু বেশীরকম প্রিয়। বাবার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে দিদির বাধে না। বাবার কথা শুনে দিদি হেসে বলল, “তুমি এমন করে বলছ-না বাবা, যেন এখনো আমরা সবাই মিলে ছুটলে সবার আগে ওপরে উঠে যাবে!”

বাবা এবার জোরে হাসলেন। তাঁর হাসি যখন প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, তখন তিনি হঠাৎ বুঝি নিজের কানে সেই শব্দ শুনতে শুনতে থেমে গেলেন। তারপর ডান দিকে ফিরে চওড়া মতন জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন, “এস তবে, দেখ—। এ-পর্যন্ত আমি পৌঁছেচি, তোমাদের আগে আগেই।”

সিঁড়ি ঘুরে আমরা একে একে মিনারের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। বাঁধানো চত্বর, বুক সমান পাঁচিল তোলা। শীতের মধ্যাহ্ন ফুরিয়ে এল। রোদ অনেকটা যেন দোপাটি ফুলের রঙ নিয়েছে, তার তাত মরে এসেছে। এতটা উঁচুতে দাঁড়িয়ে চারপাশ স্নিগ্ধ, পরিচ্ছন্ন ছবির মতন দেখাচ্ছিল। দূরে আমাদের সেই তিনটে টাঙা, ঘোড়াগুলো মাঠে চরছে, প্রান্তর এবং তৃণাচ্ছাদিত ভূমিতে রোদ আলস্যভরে শুয়ে আছে, শীতের বাতাস বইছিল; দূরে পাহাড়, একটি মেঘ আপন মনে ভেসে চলেছে। কয়েকটি বুনো বক শুন্যে বিচরণ করছিল।

হেমদা ঘড়ি দেখল। প্রায় সাড়ে তিনটে। পুষ্পর কাঁধে জলের বোতল। আমার হাতে চায়ের গোল ফ্লাস্ক। হেমদার ঘাড়ে মস্ত একটা থলি ঝুলছে, তার মধ্যে পুরনো খবরের কাগজ, টর্চ, কমলালেবু, বিস্কিট, আরও কত টুকটাক।

পুষ্প জল খেল কয়েক ঢোঁক। দিদির হাতে মা’র পানের কৌটো, মা পান খেলেন। হেমদা আমাদের কমলালেবু দিল। লেবুর খোসা ছাড়িয়ে আমরা নিচে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলাম।

দিদি বলল, “আরো খানিকটা ওপরে উঠে চা খাব।”

আমরা উর্ধ্বমুখে মিনারের চূড়া দেখলাম। মাথার ওপরকার তলাগুলি ঠিক বোঝ যায় না, বাইরের বাঁধানো গোল অলিন্দে আড়াল পড়ে যায়। দিদি বললে—আরো চার; পুষ্প বলল, পাঁচ; আমার মনে হলো আরো বেশি।

বিশ্রাম শেষ হলে বাবা বললেন, “নাও, চলো। শীতের বেলা দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যাবে।”

আমার মনে হল, বাবার পক্ষে এই সিঁড়ি ওঠার পরিশ্রম হয়তো বেশি হচ্ছে। শরীর খারাপ হতে পারে। বললাম, “তুমি আরো উঠবে?”

বাবা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে এক এক সময় আমি অত্যন্ত প্রখর এক সঙ্কল্প অনুভব করি। মনে হলো, বাবা সেই রকম দৃষ্টিতে আমায় দেখলেন। তারপর বললেন, “চলো, দেখি।”

আমরা আবার মিনার অভ্যন্তরে একে একে প্রবেশ করলাম।

আলো এবং ছায়ার মধ্য দিয়ে সোপান অতিক্রম করে আরো খানিকটা উঠে এলাম। ধুলো, মাটি, পাখির গায়ের বাসী গন্ধ, জীর্ণতার ঘ্রাণ প্রায় আর ছিল না। সিঁড়িগুলি এখনো চওড়া, তবে মনে হল ক্রমশই তার দৈর্ঘ্য কমে আসছে। বাবা সামান্য দেরি করে পা ফেলছিলেন। মা একবার দিদির হাত ধরে ফেলেছিলেন, ভেবেছিলেন সিঁড়িতে হোঁচট লেগেছে, আসলে মা’র পায়ে শাড়ি জড়িয়ে গিয়েছিল। সুর্য ক্রমশই হেলে যাচ্ছে বলে রোদের কেমন গোল ও চৌকোনো কিরণ মিনারের ঘুলঘুলি ও ঝরোকা পথে সোজাসুজি দেওয়ালে গিয়ে পড়ছিল। আর আমাদের কণ্ঠস্বর এখন প্রতিধ্বনিত হতে হতে নিচে এবং ওপরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। পুষ্প খেলাচ্ছলে কয়েকবার আ—আ করে ডেকেছে, এবং তার ডাক অধঃ এবং উর্ধ্বে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

বাবা এক সময় বললেন, “তোমাদের উচিত ছিল আরো একটু বেলাবেলি আসা।”

দিদি বলল, “আর কত বেলাবেলি আসব। দুপুরেই তো এসেছি।”

“আলো পড়ে গেলে অসবিধে হবে।”

“আমাদের সঙ্গে টর্চ আছে।”

“তোমরা শেষ পর্যন্ত উঠবে ঠিক করেছ?”

“হ্যাঁ, নয়ত আসা কেন!”

“পারবে তো?”

দিদি কিছু বলার আগেই হেমদা বলল, “এমন কিছু উঁচু নয়, না পারার কিছু নেই।”

বাবা সামান্য চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললেন, “ওপরের দিকের সিঁড়ি কেমন তা তো জান না!”

হেমদা কোনো জবাব দিল না। যেন বাবার এই সন্দেহ সম্পর্কে কিছু বলা নিরর্থক। আমরা বুঝতে পারছিলাম, বাবা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তিনি আর বেশি উঠবেন না, ওঠা সম্ভব নয়। আরো সামান্য কিছুটা উঠতে পারলে বাবা বিশ্রামের স্থান পাবেন ভেবে আমরা কোনো উদ্বেগ বোধ করলাম না। তাঁকে বিব্রত বা ব্যস্ত না করার জন্যে আমরাও ধীর পায়ে সোপন উঠছিলাম। সকলেই নীরব তখন, আমাদের পায়ের শব্দ, বাবার ছড়ির শব্দ, স্থূল একটি আলোর বৃত্ত বাবার মাথার ওপর, বাবা সামান্য পরে সেই আলোর বাইরে চলে গেলেন, দিদি একবার ঘাড় ফিরিয়ে মাকে যেন দেখল।

এই স্তব্ধতা আমাকে কাতর করছিল। কেন জানি না, যেসব কথাগুলি এতক্ষণ আমাদের ছ’জনের মধ্যে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়েছিল, যেন সেই হাত আমরা ছাড়িয়ে নিয়েছি কিংবা শিথিল করেছি—এই রকম মনে হওয়ায় আমি অধৈর্য হয়ে কথা বললাম।

“হেমদা, তোমার গরম লাগছে?”

“সামান্য।”

“কোটটা খুলে ফেললে হয়।”

“চলো, ওপরে গিয়ে দেখব।”

পুষ্প ডাকল, “জামাইবাবু—”

“বলো।”

“সেই রানী এই সিঁড়ি কেমন করে উঠত?”

“তুমি যেমন করে উঠছ।”

“আমার তো হাঁটু ব্যথা করতে শুরু করে দিয়েছে।”

“তবে আর কি, থেকে যাও।”

“ইস্ রে, এত সহজে! চলুন না, শেষ পর্যন্ত কে থাকে কে যায় দেখব।”

“তাই ভাল—।” হেমদা গলার স্বর খুব নিচু করে বলল, “তুমি আগে আগে থাকলে আমি প্রেরণা পাব।”

পুষ্প যেন বলার কথা পেল না কিছুক্ষণ, তারপর মুখ ফসকে বলে ফেলল, “আর আমি কি পাব?”

ওরা কেউ এবার হাসল না।

এ-সোপান শেষ হল। বাবা প্রশস্ত স্থানটি দিয়ে বাইরে এলেন। মা, দিদি, হেমদা পুষ্প এবং আমিও। অনেকক্ষণ পরে আবার মুক্ত আলো-বাতাসে চোখ মেলে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বাবা হাঁপাচ্ছিলেন, মা’র কপালে ঘামের বিন্দু। দিদি মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছিল। বাইরে এখনো রোদ, মোলায়েম এবং নিষ্প্রভ সেই আভায় চতুর্দিক ঈষৎ আর্দ্র দেখাচ্ছে যেন; মাঠে আমাদের অলস ঘোড়াগুলি দাঁড়িয়ে, টাঙাঅলারা কুয়ার জল তুলছিল, অতি দূরে একটি বয়েলগাড়ি কাঠ-বোঝাই হয়ে চলেছে। শীতের হাওয়া খর হয়েছে।

হেমদা কাঁধের ঝোলা থেকে পুরনো কাগজ বের করে পুষ্পর হাতে দিল। পুষ্প কাগজ বিছিয়ে দিল নিচে। বাবা বসলেন, মা বসলেন; দিদি এবং পুষ্পও। আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম। জল খাওয়া শেষ হলে চায়ের কাপ বেরুল । বাবা শুধুই চা খেলেন, মা চা এবং পান। আমরা কিছু খাবার ও চা খেলাম।

বাবাকে পরিশ্রান্ত দেখালেও বিরক্ত দেখাচ্ছিল না। তিনি যেন নিরুদ্বেগে এই বিশ্রাম উপভোগ করছেন। তাঁর মুখে একটি অবসাদ মোচনের আলস্য ভাব। মিনে করা সিগারেট-কেস থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে মৃদু মৃদু ধোঁয়া টানছিলেন, কখনো আকাশ দেখছিলেন, কখনো মাকে, কখনো আমাদের।

আকাশে একটি মনোহর অলক্ত মেঘ ভেসে এসেছে, বিহঙ্গহীন শূন্যের কোথাও বুঝি অপরাহ্নের মায়া জমেছিল। আমরা একে একে পুনযার্ত্রার জন্যে প্রস্তুত হয়ে উঠলাম।

দিদি বলল, “বাবা, তুমি তাহলে এখানে বসছ!”

“হ্যাঁ, আমি আর পারব না। দিস ইজ্ মাই লিমিট্।”

পুষ্প হেসে বলল, “তুমি কিন্তু খুব একটা উঁচুতে ওঠোনি, বাবা। ঘুরে ঘুরে উঠতে হয়েছে বলে এতটা লাগছে।”

বাবা পুষ্পর দিকে তাকালেন, তাকিয়ে থাকলেন স্থির চোখে, ওঁর দৃষ্টি সহসা আহত, ক্ষুন্ন ও অসন্তুষ্ট মানুষের মতন দেখাল। বললেন, “হ্যাঁ, আমি অনেক ঘুরে ঘুরে উঠেছি। …আরো ওঠার সাধ্য আমার নেই, সাধও নেই।”

বাবার গলার স্বর সম্পূর্ণ অন্যরকম শোনাচ্ছিল, আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম, বাবার চোখের তলায় অভিমানের সামান্য কালি পড়ল যেন। তিনি মা’র দিকে আস্তে করে মুখ ফেরালেন, মুখ ফিরিয়ে টেনে টেনে অন্যমনস্কভাবে পুষ্পকে বললেন, “…তোমার মা জানেন আমি কতটা ঘুরে কোথায় উঠেছি। …তা সে যাই হোক, আমি এতেই সন্তুষ্ট।”

আমরা, বাবার পুত্র কন্যা ও জামাতা, সকলেই বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বাবা আমাদের কাউকেই দেখছিলেন না, তিনি মা’র মুখের দিকে অপলকে তাকিয়ে ছিলেন।

আমরা চারজনে অপেক্ষাকৃত দ্রুত পায়ে সোপান উঠেছিলাম আবার। বাবা নিচে থেকে গেছেন, মা-ও আর আসতে পারেননি। বাবা ও মা’র কাছ থেকে চলে আসার পর আমরা আগের মতন হালকা ও স্বাভাবিক মন ফিরে পাচ্ছিলাম না। কেউই কারুর কাছে প্রকাশ করছিলাম না যে, আমরা কোথায় যেন একটি অন্যমনস্কতা নিয়ে আপাতত সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছি, অথচ বুঝতে পারছিলাম, আমরা বাবা এবং মা’র কথা ভাবছি।

বাবার বিষয়ে দিদির দুর্বলতা সবচেয়ে বেশি। দিদি বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, “আমার জ্ঞান হওয়া থেকে এখন পর্যন্ত আমি বাবাকে দেখছি। আমি জানি, বাবার সবটাই নিজের করা।”

আমরা কোনো সাড়া দিলাম না। দিদি কি বলতে চাইছে, আমরা জানি। আমি আমার ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত বাবাকে দেখেছি, দিদির আরো প্রায় সাত-আট বছর বেশি দেখার কথা। হয়তো দিদি বলতে চাইছে, বাবার সেই প্রায়-নিঃসম্বল অসহায় দরিদ্র অবস্থাটিও দিদি দেখেছে। আমিও আমার জ্ঞান উন্মেষেৱ বয়সে বাবার রাজকীয় রূপ দেখিনি। সংসারে বাবা অনেক পুড়েছেন, অনেকবার মার খেয়েছেন, হয়তো পা রেখেছেন কোথাও, পরমুহূর্তে দেখেছেন অবলম্বন সরে গেছে। এ-সব আমরা কিছ জানি, কিছু বা শুনেছি। শোক, তাপ; সন্তাপের পর তবে তাঁর সাফল্য।

দিদি আবার বলল, “যে-মানুষ এক সময় টিনের ছাউনির তলায় একটা ভাঙা মেশিন আর একজন মাত্র লোক নিয়ে সারা দিনে পাঁচটা টাকার বেশি রোজগার করতে পারেনি, আজ তার লক্ষ টাকার কারখানা, নিজের বাড়ি-গাড়ি। এতটা করা মুখের কথা নয়।”

পুষ্প কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, “অত বলার কি আছে! বাবা সুখস্বাচ্ছন্দ্য চেয়েছেন জীবনে, তা পেয়েছেনও, এ আমরা জানি।”

পুষ্পর কথায় দিদি যেন অপমান বোধ করল, আহত হল, বলল, “হ্যাঁ, আমরাও সেটা না পাচ্ছি এমন নয়। বাবা চেষ্টা করে পেয়েছিলেন, আমরা সবাই বসে বসে পাচ্ছি। …আর আমরা পেয়েছি বলেই তার দাম দেবার কথা ভাবছি না।”

দিদি এবং পুষ্পর কথাকাটাকাটি হেমদা আর বাড়তে দিল না। বলল, “সকলেই একরকম জিনিস চায় না। যার যা আশা। তোমাদের বাবা তো বলেই দিলেন, তিনি আর কিছু চান না, ওই পর্যন্ত তাঁর লিমিট।” বলে হেমদা হেসে বলল, “রেণু ঠিকই বলেছে, তোমাদের উনি এ পর্যন্ত এনে দিয়েছেন, সাংসারিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে তোমাদের আর ভাবতে হবে না। …এখন যা ভাবার তাই ভাব, এখনো অনেকটা উঠতে হবে—দম নষ্ট করো না।”

পুষ্প আর কিছু বলল না, দিদিও চুপ করে গেল।

আমি আমার পায়ের তলার সিঁড়ির কথা ভুলে গিয়েছিলাম প্রায়, এখন আবার মনে হল। পা শক্ত করে এক সিঁড়ি থেকে অন্য সিঁড়িতে উঠে যেতে যেতে হঠাৎ কি মনে হওয়ায় সকলকে শুনিয়ে বললাম, “বাবা আমাদের অনেকগুলো শক্ত সিঁড়ি তুলে দিয়েছেন; নাও এখন চলো।”

হেমদা হাসল, “বেশ বলেছ অন্তু, মার্ভেলাস। …কিন্তু একটা জিনিস তুমি দেখলে না।”

“কি জিনিস?”

“মা কেমন বাবার পাশটিতে থেকে গেলেন।”

“মা কোনোকালেই বাবার বেশি যেতে চান না। বাবাকে ছেড়েও যেতে চান না।” আমি সরল গলায় বললাম।

হেমদা হাসল, তার হাসি দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে কেঁপে যেন অনেকক্ষণ ধরে আস্তে আস্তে নিচে তলিয়ে শেষে ডুবে গেল।

আমরা চারজনে আরো দুটি তল উঠে এলাম। দিদি হাঁপিয়ে পড়েছিল। দিদির চেহারাটা একটু ভারী। মাথায় কিছু লম্বা বলে দিদিকে ওই ভারী চেহারায় বেমানান দেখাত না। অনেক সময় দিদিকে লোকে অবাঙালী বলে ভুল করেছে। দিদির মুখেও তেমন তেলতেল ভাব ছিল না, একটু বোধ হয় রুক্ষ ও শক্ত দেখাত।

দিদি পুষ্পর কাছ থেকে জল চেয়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। পুষ্পও মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিল। আমরা যেন যথেষ্ট উচ্চে উঠে এসেছি তা বোঝা যাচ্ছিল। নিচের যাবতীয় বস্তু ক্ষুদ্র দেখাচ্ছিল; আমরা দূরান্তের গ্রামটি এবং বৃক্ষলতা স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিলাম না, সব যেন একই পটে আঁকা; উচ্চতার জন্য এখানে বাতাস অত্যন্ত তীব্র ও তীক্ষ্ণ, শীত করে উঠল, আমরা মা ও বাবাকে দেখলাম, নিতান্ত শিশুর মতন দেখাচ্ছিল, পুষ্প ডাক দিয়ে ওঁদের ডাকল, হাত নাড়ল, বাবা-মা মুখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

মাঘের এই অপরাহ্ণ-বেলা ক্রমশই বিষন্ন হয়ে এসেছে, অদ্ভুত নিঃশব্দতা চতুর্দিকে, সেই অলক্ত মেঘটি কোন দূরান্তে চলে গেছে। একটি পাখির দল বনপ্রান্তর থেকে উড়ে উড়ে আসছিল। নীল আকাশতলায় মিনারের মাথাটি যেন মহিমার মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছে।

হেমদা বলল, “নাও, আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই, বিকেল হয়ে আসছে, আলো থাকতেই স্বর্গে উঠতে হবে।”

আমরা প্রস্তুত, দিদিই মাটিতে বসে। দিদির চোখ দুটিতে অবসাদ; মুখে ক্লান্তি ফুটে আছে। হাতের রুমালে দিদি কপাল মুছল। শীতের এই প্রচণ্ড বাতাসে তার কপালে ঘাম থাকার কথা নয়, হয়তো যে গ্লানিটুকু তার কপালে জমে আছে, অভ্যাস-বশে সে সেটুকু মোছার চেষ্টা করল। দিদি অনেকদিন হল এইভাবে তার কপাল মোছার চেষ্টা করছে, আমি জানি।

দিদির জন্যে আমার মায়া হল, দুঃখ হল। বললাম, “কি দিদি, ওঠো।”

ওঠার কথায় দিদি তেমন উৎসাহ পেল না আর, তবু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।

হেমদা শুধলো, “পারবে কি?”

দিদি ক্লান্তস্বরে বলল, “দেখি। এই মাঝপথে একলা বসে থাকব কি করে!” দিদির বিষন্ন চোখ দুটি আমায় অপরাহ্ণের ছায়ার কথা মনে পড়াল।

আমরা চারজনে আবার সেই বদ্ধ এবং ধূসরলোক মিনারের মধ্যে এলাম। সোপানগুলি এখন বেশ ছোট এবং খাড়া হয়ে উঠেছে। হেমদা আগে; পুষ্প, দিদি—পর পর; সবার শেষে আমি। আমরা সকলেই কম-বেশি পরিশ্রান্ত থাকায় আগের মতন দ্রুত সিঁড়ি উঠতে পারছিলাম না; এই সিঁড়ির ধাপগুলিও আরোহণের পক্ষে কষ্টসাধ্য। দিদির কথাও আমরা ভাবছিলাম, তাকে ধীরে সুস্থে উঠতে দেওয়াই ভাল। কনকনে ঠাণ্ডার একটি ভাব জমছিল এতক্ষণে।

হেমদা বলল, “অন্তু, মহাপ্রস্থানে যাবার সময় কার কি দোষে পতন হয়েছিল জানো ত?”

“জানি বলে মনে হচ্ছে।”

“আমার মনে নেই, ভুলে গেছি।”

হেমদা কথাটা কেন বলল জানি না। আমার দিদির কথা মনে পড়ল। হেমদা কি দিদিকে ইঙ্গিত করে কিছু বলতে চাইল! এবার কি দিদির পতন হবে!

পুষ্প অকস্মাৎ কেমন ভীতরবে চেঁচিয়ে উঠল। আমরা চমকে গেলাম। পুষ্পর আতঙ্কিত স্বর আরো ভয়ানক হয়ে ফাঁপা ফাঁপা সুবিশাল এই মিনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল। হেমদা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে পিছু ফিরে পুষ্পকে ধরে ফেলল।

“কি হল?” হেমদা উদ্বিগ্ন গলায় শুধোলে।

পুষ্প কোনো কথা বলতে পারল না সামান্য সময়, তারপর ভীতস্বরে বলল, “কি একটা আমার মুখের পাশ দিয়ে ছুঁয়ে গেল।”

“দূর… কি ছুঁয়ে যাবে আবার!”

“আমি বলছি গেছে, আমার গলার পাশ দিয়ে চলে গেল। হাতের মতন।”

“বাদুড় হয়তো।” আমি বললাম।

হেমদা ঝোলা থেকে টর্চ বের করে আলো ফেলল। “কই! কিছু নেই তো!”

“অন্ধকারে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে…” পুষ্প বলল।

“যাক, নাও চলো।”

আরো খানিকটা উঠে আসতেই আমরা আচমকা একটি ঘরের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। মনে হল সিঁড়ির বাঁকে একটি ছোট ঘর, তার দু’দিকেই উন্মুক্ত পথ। তৃতীয় পথে আমরা এসেছি। আমরা ডান দিকের পথে এলাম, সামনে নিকষ কালো অন্ধকার, বাঁ দিকের পথে গেলাম—অটুট আঁধার, যেন অন্ধকারের প্রাচীর গাঁথা আছে। হেমদা টর্চ জ্বালাল। আলোয় অল্পে অল্পে বোঝা গেল: উভয় পাশেই ক্ষুদ্রাকার ঘর, ঘরগুলির দু-পাশেই দু’টি দরজার মতন পথ। ডান দিকের ঘর ধরে এগিয়ে যেতে আবার একটি সমান আকারের একই রকম পথ-অলা ঘর চোখে পড়ল। আমরা আর বাইরের আলো পাচ্ছিলাম না।

হেমদা বলল, “অন্তু, আমার মনে হচ্ছে, একটা বড় গোল ঘরকে যেন চার-পাঁচ ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ঘরে দুটো করে দরজা করা হয়েছে।”

“কেন?”

দিদি যেন কি বলতে যাচ্ছিল, পুষ্প হঠাৎ বলল, “আমার কেমন লাগছে। আমরা যেন পাতালে নেমে গিয়েছি। কী অন্ধকার!…আমার ভয় করছে। জামাইবাবু, বাইরে চলুন।”

হেমদা কোনো জবাব দিল না, কি যেন ভাবছিল চুপ করে দাঁড়িয়ে। শেষে বলল, “আমার বিশ্বাস এই গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে কোনো একটা পথ চূড়ায় উঠে গেছে। হয়তো সামান্য আর-একটু পথ বাকি আছে আমাদের।”

“কিন্তু হঠাৎ এখানে এ-রকম বেয়াড়া ঘর করবার কারণ কি?” আমি শুধোলাম।

“কে জানে! হয়তো ওপরের কনস্ট্রাকশানের জন্যে। …আসলে অন্তু, এগুলো ঠিক ঘর নয়, পথও নয়; খিলান। খিলান বড় বেশি, তাই ধাঁধার মতন দেখাচ্ছে।”

দিদি বলল, “আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, বাইরে চলো।”

“তাহলে—” হেমদা হাসল; “এই পর্যন্ত; এত কাছাকাছি এসেও ফিরে যেতে হবে।”

আমার ফেরার ইচ্ছা ছিল না। যদি এমনই হয়, প্রায় আমরা চূড়ার কাছে পৌঁছে গেছি—তবে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমার বরাবর আফসোস থাকবে। আমি বললাম, “হেমদা, দিদিরা বাইরে অপেক্ষা করুক, চলো আমরা যাই।”

হেমদা বলল, “তাই ভাল।…তার আগে তো বাইরে যাই…”

আমরা বাইরে আসার জন্যে একটি একটি করে দরজা পেরোলাম, কিংবা সেই বিসদৃশ খিলানগুলি অতিক্রম করছিলাম। হেমদার হাতে টর্চ। আমরা চারজনে গায়ে গায়ে পিছু পিছু চলেছি। চলেছি, চলেছি—অথচ কী আশ্চর্য, বাইরের আলো পাচ্ছি না, পথ পাচ্ছি না। ক্রমশই দিদি ভীত হচ্ছিল, পুষ্প অধৈর্য হয়ে উঠছিল। আমারও কেমন উদ্বেগ জমছিল ক্রমশ।

দিদি বিড়বিড় করে বলল, “ছি ছি, কী ভুল করেছি। …এখানে কেন এসেছি!”

পুষ্প কাতর হয়ে বলল, “জামাইবাবু, বাইরে চলুন—আর পারছি না।”

আমরা বাইরের পথ পাচ্ছিলাম না। প্রতি বার ভাবছি, ওই খিলানের আড়াল পেরোলে বাইরের আলো আমাদের পথ দেখিয়ে ডেকে নেবে; প্রতি মুহুর্তে ভাবছিলাম, আমরা আমাদের পথটুকু পেয়ে যাব, অথচ আমরা এই রহস্যময় গোল ঘরটির কয়েকটি অংশের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। যত সময় বয়ে যাচ্ছিল আমরা পথ হারানো পথিকের মতন, গুহা মধ্যে নিক্ষিপ্ত পশুর মত ততই অধৈর্য ও হতাশ হয়ে কেমন অদ্ভুত এক শঙ্কা অনুভব করছিলাম। দিদি চিৎকার করে কি যেন বলল তারপর নিজের সেই অদ্ভুত চিৎকারের বিচিত্র প্রতিধ্বনি স্তব্ধ হবার আগেই পাশের দরজার দিকে ছুটে গেল। দিদি ওখানে আলোর আভাস দেখে ভেবেছিল, বাইরের পথ পেয়েছে। দিদি ছুটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তার পিছু পিছু ছুটে গেলাম। বাইরের আলো দেখা দিল, অতি সামান্য; আমরা দিদির জন্যে—আলোর জন্যে মরিয়া হয়ে আলোর দিকে এগিয়ে যাবার সময় সহসা পরস্পরের কথা ভুলে গেলাম! আমরা প্রত্যেকেই পাগলের মতন আলোয় আসতে গিয়ে হুড়োহুড়ি এবং ছুটোছুটি করে কোথায় এসে পৌঁছলাম জানি না—অথচ আমি আমার পাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে সঙ্গীচ্যুত ও একাকী হয়ে গেছি অনুভব করে পাথরের মত নিষ্প্রাণ নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

আমার ভীত হৃৎপিণ্ড অতি দ্রুত হয়ে উঠেছিল, ধক ধক শব্দটা আমার কানে বাজছিল, যেন হৃৎপিণ্ডটি বুকের মধ্য থেকে লাফিয়ে আমার কানের কাছে চলে এসেছে। সম্পূর্ন অন্ধকারে আমি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে।

সেই অবর্ণনীয় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে আমি হেমদাকে ডাকলাম।

আমার ডাকের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে আসার আগেই পুষ্পর ডাক শুনতে পেলাম, “অন্তুদা—”

হেমদা ডাকল, দিদি ডাকল। আমরা পরস্পর পরস্পরকে ডাকছি। গলার স্বর মাত্র আমাদের সম্বল। আমরা কেউ আর পরস্পরের পাশে নেই। আমরা সকলেই আতঙ্কিত ও আর্ত। আমরা পরস্পরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানাচ্ছিলাম।

হেমদা চেঁচিয়ে বলছিল যে, অন্ধকারে আমরা যেন পথের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, হেমদা আলো হাতে একে একে আমাদের কাছে আসবার চেষ্টা করছে।

প্রায়-মৃত, বেহুঁশ মানুষের মতন আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম। অজ্ঞাত, বীভৎস একটি দানবের মতন যেন নিঃশব্দে মৃত্যু আমার কাছে এগিয়ে আসছিল।

দিদি পাগলের মতন কাঁদছে, পুষ্প ডেকে ডেকে গলা দিয়ে বুঝি রক্ত বের করে ফেল্ল, হেমদা সাহস দিচ্ছে; বার বার বলছে, সে আসছে, সে আসছে। অথচ হেমদা আসছিল না।

হয়তো মানুষের কোনো আদি অনুভূতি তাকে শেষ সময়ে পশুর মতন বেপরোয়া করে তোলে; আমি সেই পাশব ও অদম্য আত্মরক্ষার প্রেরণায় মসীকৃষ্ণ অন্ধকার ও অজ্ঞাত পথ অতি সন্তর্পণে পেরিয়ে আসবার জন্যে পা বাড়ালাম। পা টেনে টেনে দেওয়াল ধরে ধরে হাঁটছি, হাঁটছি; দিদি বমি করছে যেন, পুষ্প বাচ্চা মেয়ের মতন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কখনো মনে হয়, তারা আমার কাছে চলে এসেছে হাত বাড়ালে স্পর্শ করতে পারব; কখনো মনে হচ্ছিল ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে, আমি এখানে একা। সম্ভবত আমারই মতন দিদি এবং পুষ্প মরিয়া হয়ে অন্ধকারে পথ হাতড়ে মরছিল, হেমদা সেই অদ্ভুত গোলকধাঁধার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার জন্যে যথাসাধ্য করছিল। ক্রমশই আমাদের গলার স্বর বসে এল, আমরা ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে নীরব হয়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করলে এই স্থানটি যেন তার পরিত্যক্ত মহিমা ফিরে পেল।

কতক্ষণ পরে জানি না, সহসা আলো দেখতে পেয়ে আমি হেমদাকে ডাকলাম। হেমদা আমায় ডাকল। পুষ্প সাড়া দিল, দিদির কথা ভেসে এল। আমরা কে যে কোথা থেকে বেরিয়ে ছুটে আলোর সামনে আসছিলাম জানি না, পাগলের মতন ছুটে আসতে গিয়ে পুষ্প হেমদার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঠক্ করে শব্দ হল; হেমদার হাতের টর্চ মাটিতে পড়ে গেছে। আবার অন্ধকার। হেমার মুখ থেকে আর্ত শব্দ হল: যাঃ—!

মাটিতে বসে হাতড়ে হাতড়ে হেমদা টর্চ কুড়িয়ে ঝাঁকাল, হাতের তালুতে ঠুকল, নাড়ল-চাড়ল, তারপর আতঙ্কের স্বরে বলল, “বাল্ব ভেঙ্গে গেছে।”

টর্চের আলোটুকুতে আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করছিল; আমি অনুভব করলাম—আমার এই হাত পা মাথা মুখ দৃষ্টি—এমনকি আমার হৃৎপিণ্ডও—আমার যা আছে—কিছু না, কিছুই নয়, ওই বাইরের আলোটুকুই আমার জীবন। সেই আলো নিবে গেলে আমি মৃত্যুভয়ে শিহরিত হলাম।

তারপর কি ঘটছিল আমি সুস্থ চেতনায় কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। কখনো হারিয়ে যাচ্ছিলাম, কখনো আমার পাশে কাউকে অনুভব করছিলাম। পুনরায় সেই নিষ্ফল চেষ্টা, ব্যর্থ উদ্যম, বারংবার পরস্পরকে আহ্বান। অন্ধকারের মধ্যে আমি একটি নাগরদোলায় চড়ে আছি যেন, নাগরদোলাটি ঘুরছে, কখনো আমায় ওপরে তুলছে, কখনো আবার নিচে ফেলে দিচ্ছে। অবশেষে আমার মনে হলো, আমি যেন একটি ঘুমন্ত খোপকাটা জালি ঘরের মধ্যে একটি খোপে বন্দী, সমস্ত কক্ষটি—প্রতিটি খোপ ঘুরছে ক্রমাগত এবং আমি পাশের খোপে যেতে গিয়েও পারছি না, কখনো দিদি আমার কাছে এসে পড়ছে, তাকে হাতে ধরে টেনে নেবার আগেই সে চলে যাচ্ছে; কখনো হেমদা, কখনো পুষ্পকে আমি ছুঁতে গিয়েও ছুঁতে পারছি না।

এক সময় হেমদা আর দিদিকে আমার কাছাকাছি কোথাও অনুভব করলাম। দিদি প্রলাপের মতন কথা বলছে। —”আমি জানি, তুমি ইচ্ছে করে আমার দিকে আসছ না; আমি তোমার হাত ধরতে পেয়ে যদি বেঁচে যাই, তাই তুমি হাত গুটিয়ে আছ।”

“আমি তোমায় খুঁজে পাচ্ছি না, রেণু।”

“ও তো পুরনো কথা। …তুমি কি খোঁজ, কাকে খোঁজ, আমি জানি।”

“তুমিও তো খুঁজছিলে।”

“পাইনি। আমার কপাল।”

“তবে আর কি! যার যা কপাল…”

দিদির গলা আর উঠল না, হয়তো সে মুখ বুজে কাঁদছিল।

দিদিকে এ-সময় আমি কিছু বলতে চাইছিলাম। তাকে খোঁজার জন্যে হাতড়ে হাতড়ে কোথায় এলাম জানি না। “দিদি—”

দিদির সাড়া নেই। কয়েকবার ডাকলাম, “দিদি—দিদি।” দিদি সেখানে ছিল না। সে কোথায় গেল জানি না।

দীর্ঘসময় পরে আমি আবার দুটি মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

“অত ভয় পাচ্ছ কেন, আমার হাত ধরার চেষ্টা কর—চেষ্টা কর।”

“যাব কোথায়?” পুষ্পর গলা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

“কোথাও যাব,” হেমদা বলল।

“কোথায় আর যেতে পারছি!”

“পারব। …আমরা বেরোবার পথ খুঁজছি, একবার যদি পথ পাই…”

“আমি আর স্বর্গে যেতে চাই না।”

“পুষ্প, তুমি ভীষণ ভয় পেয়েছ; অত ভয় কেন!…আর একটু কাছে এস, আমি “তোমায় কোথাও নিয়ে যাব, কোথাও…”

আমি হেমদাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলাম না, আমার গলা বন্ধ হয়ে এল।

রাত্রে ঘুমের মধ্যে পথ হাঁটলে যেমন নিদ্রিত ব্যক্তির কোনো অনুভব থাকে না, আমারও কোনো চেতনা ছিল না, আমি অচেতনায় হাঁটতে হাঁটতে হাতড়াতে হাতড়াতে, পা ফেলে ফেলে কোথায় এসে পৌঁছলাম জানি না, অকস্মাৎ আমার চোখে শেষ অপরাহ্ণের আলো লাগল। বিশ্বাস হল না, আমি আলোয় এসেছি; মনে হল: এ আমার মতিভ্রম। চোখ পরিষ্কার করে তাকালাম, আলো নিবল না। আমি আমার গা হাত পা লক্ষ করলাম, পোশাক নজর করে দেখলাম। অবশেষে আমি বাইরে আসতে পেরেছি। সহসা জীবনের বাসনাগুলি আমায় আন্দোলিত করল, সাহস এল, স্বস্তি ফিরে পেলাম। চারপাশের ঘেরা ঘুলঘুলি দিয়ে তাকিয়ে গোধূলির ম্রিয়মাণ আলো, ছায়াময় দূরান্ত বনানীর একটি অংশ যেন আমার চোখে পড়ল। সন্ধ্যাসমাগমে শীতের বাতাস অসহ্য হয়ে উঠেছে।

কিছু সময় আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার কোনো অতীন্দ্রিয় অনুভূতি আমায় বলছিল, আমার মাথার ওপরে মিনারের শেষ চূড়ার মাথায় গোধূলির স্বর্ণচ্ছটা এখনো মুছে যায়নি। ওখানে কায়ক্লেশে ওঠার এখনো সময় আছে। আরো কয়েকটি দণ্ড।

কোনো এক দুর্বোধ আবেগ এবং আশঙ্কা আমায় অস্থির করে তুলছিল। এ সুযোগ কে হারায়! অনেক কষ্টের পর, অনেক ভ্রম এবং বহু অনিশ্চিত সোপান পেরিয়ে আমি এখানে এসেছি। নিতান্ত সৌভাগ্যবশে। এখান থেকে ফিরে যাওয়া মূর্খতা।

বাবার কথা আমার মনে পড়ল, তিনি এক জায়গায় উঠে এসে বসে আছেন। মা’র মুখ আমার চোখের সামনে ভাসল, মা বাবার পাশে পাশেই আছেন, যেন জীবনে মা সঙ্গদান ভিন্ন অন্য কিছুর আশা করেননি। দিদি অনেক আগে থেকেই ক্লান্ত, তবু সে মাঝপথে থাকতে ভয় পেয়ে হেমদার কাছাকাছি উঠে আসতে চেয়েছিল, পারেনি। দিদি তার কপাল মুছতে পারল না। প্রথম যৌবনের গ্লানি তার কপালে লেগে আছে। দিদি মর্যাদার মোহে এবং আত্মরক্ষার্থে যেখান পর্যন্ত এসেছিল, সেখানে এসে থেমে গেছে, হেমদা তাকে খুঁজে পায় না। পুষ্প স্বর্গ চায় না, সে কি চায় জানে না, সে নিজের শঙ্কিত বাসনার অবসান চায় হয়তো, হয়তো সে চতুর প্রতিদ্বন্দ্বীর মতন চরম জয় চায়। আমি জানি না সে কি চায়। হেমদা অতি গোপনে তার জীবনের কোনো নিস্ফল বাসনা পূর্ণ করতে চায় বুঝি, সে শুধু পথ খুঁজছে।

নিজেকে নিঃসঙ্গতম মানুষ অনুভব করার পর যে বেদনা হওয়া সম্ভব, আমি এখন সেই বেদনা অনুভব করছিলাম। আমি সকলকে পরিত্যাগ করেছি, সকলের সহযাত্রী হয়ে যাত্রা শুরু করে অবশেষে একাকী এখানে এসেছি। আমি চেষ্টা করব শীর্ষ চূড়ায় পৌঁছে যেতে।

খুব সন্তর্পণে আমি গোধূলির আলোকটুকুতে একটি পথের আশায় চতুর্দিক লক্ষ করতে লাগলাম। সুউচ্চ প্রাচীর এবং সামান্য মাত্র ঘুলঘুলির জন্যে কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। অনুমানে আমি পথ হাতড়াচ্ছিলাম।

সেই রাজ্যত্যাগী বৃদ্ধ রাজার কাহিনী আমার মনে পড়ল, যিনি খঞ্জ এবং অক্ষম হয়েও চেষ্টা করেছিলেন স্বর্গারোহণ করার। তিনি কি পেরেছিলেন শীর্ষে পৌঁছোতে ? আমার ত্রিপাঠীবাবুর কাহিনীও মনে পড়ল। সেই রানী প্রকৃতই কী চেয়েছিলেন! কোন অসামান্য তৃপ্তি ? কতটা উচ্চতায় এসে তিনি তৃপ্ত হয়েছিলেন? নাকি রাজা দেখেছিলেন, রানীকে তৃপ্ত করা অসাধ্য, তাই সাধ্যমত চেষ্টার পর রানীকে আর ফিরতে দেননি?

গোধূলির আলো ক্রমশই ম্লান হয়ে আসছিল। আমার বুক অবসিত আলোর দিকে তাকিয়ে ক্রমশই দ্রুত ও ভয়ানক হয়ে উঠছিল। আর সামান্য পরে আলো মুছে যাবে, আমি শীর্ষদেশে উঠতে পারব না।

কে যেন আমায় বলছিলঃ তাড়াতাড়ি করো, সময় ফুরিয়ে এল। আশ্চর্য এক আবেগ আমায় উত্তেজিত ও আকুল করছিল। আমি পাগলের মতন সামান্য মাত্র পথ খুঁজছিলাম, কোনো রকমে যেখান দিয়ে চলে যেতে পারব। আমার কেমন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, আর কয়েকটি সোপান শেষেই শীর্ষ চূড়া। সেখানে পৌঁছতে পারলে আমার সমস্ত শ্রম সার্থক হবে। যে গোধূলিটুকু এখনো পৃথিবীতে বেঁচে আছে, সেই শেষ আলোয় আমি জ্ঞানে-অজ্ঞানে, বেদনায় ব্যাকুলতায়, দুঃখে হতাশায় ও আঘাতে যা খুঁজেছি হয়তো তা দেখতে পাব।

অব্যক্ত কোনো যন্ত্রনায় এবং ভয়-তাড়িত ব্যাকুলতায় বার বার উন্মত্তের মতন, ভিক্ষুকের মতন, শিশুর মিনতির মতন, যুবকের প্রেমকামনার মতন এবং বৃদ্ধের ভগবত প্রার্থনার মতন আমার পথটুকু আমি খুঁজে ফিরলাম।

হয়তো আমি কোনো প্রচণ্ড আক্রোশে এবং বিক্ষত যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, সহসা গোধূলির অন্তিম আলোটুকু আমার চোখে মরে গেল।

অন্ধকারে আর কিছু দেখা গেল না, আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *