উদ্বেগ

উদ্বেগ

সারাটা দিন আকাশ ময়লা হয়ে ছিল। কখনও আধ-ফোটা রোদ কখনও মরা। মেঘলা। শীত অনেক দূরে চলে গিয়েও মাঘের এই একেবারে শেষে আবার যেন ভাবছিল অল্পের জন্যে আসবে কিনা ; ফেলে যাওয়া কোনো জিনিস নিতে, কোনো ভুলে যাওয়া কথা বলতে মানুষ যেমন করে ফিরে আসে। সকাল থেকেই কুয়াশায় সব অপরিষ্কার থাকল, অনেক বেলায় যখন এক আঁজলা রোদ দিচ্ছিল আকাশ, তখন শীতের স্পর্শ পাওয়া গেল ; তারপর মেঘলা হল। দুপুর বিকেল বলে আলাদা করে কিছু বোঝা গেল না ; এই রকম অপরিষ্কার সারাটা দিন কেটে গেল, সন্ধের দিকে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল।

শিশির তখন রাস্তায়। গার্লস স্কুলের গলি দিয়ে পথ ছোট করে নেওয়া যেত। সাইকেলটা আজ বারবার ভোগাচ্ছে। চেন খুলে যাচ্ছে। ইচ্ছে ছিল বাজারে গিয়ে মেরামত করিয়ে নেবে। গার্লস স্কুলের গলি না ধরে শিশির কিশোরীলালের। ছিট-কাপড়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল একটু মাথা বাঁচিয়ে। আর তখন সেই টুপ-টাপ বৃষ্টির মধ্যে পথ দিয়ে রাম-রাম ধ্বনি দিয়ে আরও একটা শব সৎকারের জন্যে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছিল হিন্দুস্থানী মহল্লার লোকেরা।

এই নিয়ে আজ চারটে শব যেতে দেখল শিশির সারা দিনে। তার চোখের বাইরে দিয়ে আরও কটা গেছে কে জানে!

শহরে এ সময়ে মড়ক লাগার কথা নয়। আরও পরে ফাল্গুনের শেষ থেকে কিছু লোক বসন্তে প্রতি বছরই মারা যায়। এ বছর অনেক আগে থেকেই কেমন যেন একটা আতঙ্ক এসে গেছে অকস্মাৎ। না, ঠিক বসন্ত নয়, অন্য এক রোগ। আজ পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা গেল না, রোগটা কি, কেমন করে এ শহরে ঢুকে পড়ল।

খদ্দের না থাকলেও কিশোরীলালের দোকানে তার এক কর্মচারী ছিল। আগামীকাল রবিবার। রবিবার হরিপুরায় হাট বসে। কিশোরীলালের লোক সেই রবিবারের বাজারে দু চার গাঁট কাপড় নিয়ে বেচতে যায়। কালকের হাটের সওদা গুছিয়ে দিতে দিতেও দাম-টাম বুঝিয়ে দেবার সময় পথ দিয়ে শব যেতে দেখল কিশোরীলাল। অস্ফুটে একবার ‘রাম-রাম’ করল, করে আবার নিজের কাজে মন দিল। খুবই আশ্চর্য যে, রাস্তার উল্টো দিকে রাজারামবাবুর তিন মহলা বাড়ির ওপর তলায় এ-সময়ে রেকর্ড অথবা রেডিওর নাচের বাজনা বাজছিল প্রবল সুরে। জাপানী চিক আধখানা করে গুটিয়ে ফেলে হালকা নীল আলোয় ব্যালকনিতে রাজারামবাবুর ছেলে এবং বউ বসেছিল বোধহয়।

বৃষ্টি হবে। ‘ফোঁটা দেখে মনে হচ্ছিল, দশ বিশ মিনিট জ্বালাবে মিছিমিছি । সারাদিনের শুকনো ধুলো এবার মৃদু মৃদু সোঁদা গন্ধ দিল। শিশির অপেক্ষা না করে চলে যাবে কিনা ভাবল। দু’চার ফোঁটা জলে সে ভিজতে পারে। কিছু নয়, ওই টুকু ভেজা কিছুই নয়। তবু সময়টা এত খারাপ চলছে যে, দুচার বিন্দু অসময়ের জল গায়ে মাথায় লাগাতে সাহস হল না শিশিরের।

অল্প সময় ঝির ঝির করে একটু বৃষ্টি হল ; তারপর থেমে গেল। রাস্তা দিয়ে তোক চলাচল, গাড়ি আসা-যাওয়া কোনো সময়েই থামেনি। সাইকেল ঠেলে শিশির বাজারের দিকে এগিয়ে চলল।

পথে মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলছে। কাচের গায়ে বৃষ্টির ছাট লেগে ঝাপসা দেখাচ্ছে, হলুদ আলোর গা গড়িয়ে জলের দাম ধরেছে কেমন, গড়িয়ে গড়িয়ে জল নামছে। শিশিরের মনে হল, এই শহরের অদ্ভুত ব্যাধি যেন আলোগুলোকেও সংক্রামিত করেছে। বিবর্ণ ঘর্মাক্ত রক্তহীন মুখের মতন আলোগুলো হতাশ হয়ে তাকিয়ে আছে।

আলো থেকে চোখ নামিয়ে নিল শিশির। তার খারাপ লাগছিল। নিজের অক্ষমতায় মানুষ যে ভাবে লজ্জিত হয়, শিশির সেইভাবে লজ্জিত হচ্ছিল। তার এ লজ্জা অকারণ ; তবু আশ্চর্য যে, সে লজ্জিত না হয়ে পারছিল না।

বসন্তের মতন, কিন্তু বসন্তের হাওয়া নয়। সব্জি বাজারের নিচু মাঠ দিয়ে বাতাস এল কয়েক দমকা। শীতের আলগা ছোঁয়া ছিল বাতাসে, অথচ বসন্তের মতন চঞ্চল ।

রাস্তার ডান পাশে তুলোপট্টি এবং কয়েকটা তামাক পাতার দোকান। এখনও ঝাঁপ পড়েনি। পেট্রম্যাস্কের বাতি জ্বালিয়েছে ওরা সন্ধের মুখে। এতক্ষণে বাতিগুলো বাতাস ফুরিয়ে মিটমিটে হয়ে এসেছে। খানিকটা পরে এ সব দোকান বন্ধ হয়ে যাবে ; বাতি উজ্জ্বল করার তাড়া কারুর নেই বোধ হয়। নালার ওপাশ থেকে অন্ধকার পেরিয়ে একটা কুকুর সাইকেলের সামনে এসে গেল। শিশির দেখতে পায়নি, হয়ত সামান্য লেগেছিল, কুকুরটা শব্দ করে পাশ কাটিয়ে পালাল।

এই শহরে সবচেয়ে যে কুকুরভুক্ত, নিশীথ হালদার, গত রবিবারে সে মারা গেছে। শিশিরের মনে পড়ল নিশীথকে। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা ঔদাসীন্যে, কিছুটা অনুতাপে শিশির মনে মনে বলল : নিশীথ সবচেয়ে কুকুর ভক্ত মানুষই ছিল। এখন নেই। এখন তার বাড়িতে পাঁচটা কুকুর সংসার পেতে আছে।

নিশীথ বিয়ে করে নি। তার রমণী ছিল। যথাস্থানে না থাকলে মৃত্যু সময়ে মানুষকে দেখা যায় না, রমণীটিও নিশীথকে শেষ সময়ে দেখতে পায়নি। ভালই হয়েছে। নিশীথ যখন মারা যাচ্ছিল, তার মুখের চামড়া মোমের মতন সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং সেই রকম শুকনো, চোখদুটি গাঢ় হলুদ, নাকের কাছে চিবুক বরাবর একটা কালো দাগ।

শিশির পুনরায় অনুভব করল, নিশীথের মৃত্যুর জন্যে তার মনে বিস্বাদ এক আবহাওয়া সৃষ্টি হয়েছে। অকারণ। অকারণেই মনে হচ্ছে, শিশির এই মৃত্যুটির জন্যেও কিছুটা দায়ী। সামান্য বিরক্ত হল শিশির। অথচ অনুশোচনা অধিক বলে বিরক্তি কখনওই প্রখর হতে পারল না।

চৌমাথার মোড়ে পুলিস দাঁড়িয়ে আছে। নাগ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে কোনও স্বামী-স্ত্রী মিষ্টি কিনছিল । নিত্যকার খাদ্যবস্তুগুলো কাচের আবরণের ওপাশে যথারীতি সাজানো রয়েছে। এক থালা লবঙ্গ লতিকা দেখতে পেল শিশির, মুগের বরফিগুলোয় আলো যথেষ্ট পরিমাণে পড়েছে। খুব হলুদ দেখাচ্ছে। যে কোনও কারণেই হোক শিশির আর ওদিকে তাকাল না। খারাপ লাগছিল তার।

বাজারের সমস্ত দোকানপত্রই খোলা। পালদের কাপড়ের দোকান, যমুনা দাসের স্টেশনারী দোকান, বোম্বাইঅলার হোটেল, জুতোর দোকান- সমস্তই খোলা। বাজারের মাঝপ্রান্তে সিনেমা হাউসটাও চালু রয়েছে ; রিকশা টাঙ্গা গাড়ি, মানুষজন এই চলাচল করছে। মনে হয় না, এই শহরে মড়ক এসেছে হঠাৎ।

উদাস অপ্রসন্ন মনে শিশির সাইকেলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।

দোকানে পরেশ একলা ।

“সাইকেলটা একটু ঠিক করে দিতে হবে পরেশ।” কাঠের পাটাতনের ফাঁকে সাইকেল ঠেলে দিয়ে শিশির বলল।

“কি হল সাইকেলের ?” পরেশ টিনের চেয়ারে বসেই বলল ।

“নতুন চেন। বড় হয়েছে বোধ হয়, খুলে যাচ্ছে বার বার ।”

মুখের বিড়ি ফেলে দিয়ে পরেশ হাসল। “তখনই ত বলেছিলাম বাবু, একটু ছোট করে দি; আপনি বললেন, ঠিক আছে। দিশী চেনের এই হাল।”

“ছোটটু কোথায় ?”

“ওর মার অসুখ। বিকেলে কামাই দিয়েছে—”

“অসুখ !”

“সাইকেল রেখে যান। কাল সকালে ঠিক করে দেবে ছোটটু।”

শিশির ভীত বোধ করছিল। ছোটটুর মার অসুখ। কাল পরশু কিংবা আরও দুদিন পরে তবে ছোটটুর মাও যাচ্ছে। এই শহর বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

যে কোনো লোক যে কোনো সময় মারা যেতে পারে। মড়কটা সিঁদ কাঠি হাতে করে ঘরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অসতর্ক হলে অবধারিত মৃত্যু।

উদ্বিগ্ন গলায় শিশির শুধলো, “কি অসুখ ?”

‘জ্বর।”

“কবে থেকে?”

“কাল রাত থেকে।” পরেশ দোকানের ঝোলানো বাতি নামাতে গেল। সে আজ একলা, দোকান গুছিয়ে বন্ধ করতে অনেকটা সময় লাগবে। বাতি নামিয়ে নেওয়ায় চারপাশ থেকে কেমন অন্ধকার এসে পড়ল। মেঝের ওপর আলো রেখে পরেশ বলল, “ছোটটু খুব ভয় পেয়েছে, বাবু। বাচ্চা তো ! আজ ধোবি মহল্লায় দুটো মরেছে।”

শিশির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। কপাল এবং বুকের কাছে ঘাম জমার মতন ভয় জমে আছে। ঠাণ্ডা আর ভাল লাগছিল না। নিশ্বাস ফেলল শিশির, হৃৎপিণ্ডের বেদনাদায়ক কেমন এক অস্বস্তি থেকে গেল তবু।

সাইকেল পরেশের দোকানে রেখে আবার পথে এসে দাঁড়াল শিশির। আধখানা সিনেমা দেখে, কিছু লোক বাইরে বেরিয়ে এসেছে, ফেরিঅলারা চেঁচাচ্ছে, রিকশাঅলা ছোঁড়াগুলো ঘন্টি বাজাচ্ছে মজা করে।

পথ দিয়ে হাঁটবার সময় রুমাল বের করে মুখ মুছতে গিয়ে শিশির অনুভব করল, তার আঙুল খুব ঠাণ্ডা, হাতের তালু ঘর্মাক্ত।

বাজারে কোনো রকম দুশ্চিন্তা অথবা ভীতি দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক আলোয়, প্রাত্যহিক প্রসাধনে সজ্জিত এই বাজারটাকে সুখী বনিতার মতন দেখাচ্ছে। পানের দোকানে রেডিও বাজছে, নিই স্টোর্স-এ দু রকম আলো, বেগুনি আর নীল মাথার ওপর খেলা করছে। এই আলো সামনের রাস্তার খানিকটা জায়গা মনোহর করে তুলছে।

একটা ঝকঝকে গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার সময় হর্ন দিল। শিশির সরে গেল এক পাশে। সরে গিয়ে দেখল, মুখার্জি সাহেব স্ত্রী এবং কন্যা সহ গাড়ির মধ্যে বসে আছেন। মুখার্জি সাহেবের মুখে সিগারেট, মিসেস মুখার্জির কানে দুটো বড় বড় লাল পাথর দুলছে। গাড়ির মধ্যে বাতিটা জ্বলছিল। ওদের মেয়ে সিটে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে।

গাড়ির দিকে তাকিয়ে শিশিরের একবার মনে হল, গাড়িটা একবার সে থামাতে বলে। হয়ত হাত তুললে মুখার্জি সাহেব তাকে দেখতে পেতেন। দেখতে পেলে হয়ত দাঁড়াতেন। কিন্তু শিশির হাত তুলল না। গাড়ি তার অল্প দূর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল।

খুব অন্যমনস্কভাবে শিশির বাজারের রাস্তা দিয়ে আরও কিছুটা গেল, তারপর তালাবন্ধ ব্যাঙ্কের পাশ দিয়ে যে গলিটা ডাইনে চলে গেছে সেই গলি ধরল। তার ডান পায়ে জুতোর একটা পেরেক বুড়ো আঙুলের কাছে ফুটছিল। ক্রমাগতই ফুটে যাওয়া সত্ত্বেও হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে শিশির ক্লেশটা অনুভব করতে পারল।

এ গলি তেমন আলোকিত নয়। অনেক দূরে দূরে একটা করে বাতি। সামান্য বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ফলে, নালির দুপাশ থেকে গন্ধ উঠছে, জঞ্জালের গন্ধ। আঁশ এবং পচা বাঁধাকপির পাতা এবং কিছু শালপাতা মাটির খুরি ইত্যাদি চোখে পড়ার পর শিশির মনে করতে পারল, গতকাল বৃন্দাবনবাবুর মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আজ বোধহয় পরিশিষ্ট।

এতক্ষণে শিশির সামান্য তৃপ্তি অনুভব করল। গতকাল যাদের বিয়ে হয়েছে তারা আজ এ শহরে নেই। বর-কন্যা চলে যাওয়ারই কথা। শিশির ধরে নিল, বিবাহিত নবদম্পতী চলে গেছে; ধরে নিয়ে, বৃন্দাবনবাবুর মেয়ের কথা ভাবছিল। মেয়েটির নাম লতা। শিশির চেনে। নিতান্ত সাধারণ মেয়ে; তবু তাকে চিনে রাখার একমাত্র কারণ গত বছর বারোয়ারী দুর্গা পুজোর আরতির সময় প্রদীপের তাপ নিতে গিয়ে লতার কাপড়ে আগুন ধরে উঠেছিল। পুড়তে পুড়তে বেঁচে গেছে।

সেদিনের দুর্ঘটনা খুব বড় করে আজ আর মনে হচ্ছে না। বরং আজকের সুখের ঘটনা থেকে সামনের দিকে তাকানো যায়। শিশির কৌতূহল ও কৌতুকভরে ভেবে দেখল, লতা মুখ হেঁট করে আধখানা ঘোমটার তলায় বধূর মতন বসে আছে এবং সদ্য দেওয়া সিঁদুরের গুড়ো তার নাক, গাল ও কাপড়ে ঝরে ঝরে পড়ছে। ট্রেনের মধ্যে এক পাশে লতাকে পুতুলের মতন বসে থাকতে দেখে শিশির যেন মনে মনে হাসল। বেশ নিশ্চিন্ত লাগছিল, এই শহরের মড়ক থেকে ওরা চলে যেতে পেরেছে।

মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা দরকার। শিশির ভাবছিল। জীবন যথার্থ আমাদের কি দেয়, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা অথবা কিছু সুখ কিছু শান্তি অথবা একান্তই কিছু দেয় কি না, নিতান্ত অভ্যাসজনক দিন যাপন ইত্যাদি প্রশ্ন ভাবা অনর্থক। কে কখন কিভাবে কোন স্বাদ পাচ্ছে তা বলা যায় না। লতা আগুনে পুড়ে গেলে কি হত, আর এখন সে কি পাচ্ছে—লতা নিজে ভেবে দেখবে।

প্রায় গলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে শিশির দাঁড়াল। একটা রিকশা দাড়িয়ে আছে। অন্ধকারে পেছন থেকে অত্যন্ত কদাকার দেখাচ্ছিল রিকশাটিকে। অবয়বহীন জন্তুর মতন। এ সময় আবার কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি।

রিকশার পাশ কাটিয়ে যাবার সময় রিকশাঅলা ছেলেটাকে শিশির সামান্য এগিয়ে আলোর কাছে দাঁড়াতে বলল।

“বাত্‌তি কো নাগিচ খাড়া হুয়া করো, ভাই; রাস্তা থোড়া সাফ রাখো।”

কানে কথা তুলল না ছেলেটা। বিড়ি খেতে খেতে সে বার বার পাশের বাড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।

কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে শিশিরের মনে হল, এই রিকশাটা ভাড়া রিকশা নয়, পাঠক ডাক্তারের প্রাইভেট রিকশা।

পাঠক ডাক্তারের কথা মনে হতেই শিশির পিছু ফিরে বাড়িটার দিকে তাকাল। সহসা তার মনে হল, মড়ক এই গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

বিছানায় শুয়ে মীরা বলল, “ঘুমোলে নাকি?”

“না।” শিশির সাড়া দিল।

“কী ভাবছ?”

“কিছু না।”

“অত গম্ভীর দেখছি, তাই বলছি।” মশারি যেখানে যতটুকু গোঁজবার মীরা পরিপাটি করে গুঁজে নিল। গুঁজে মশারির মধ্যেটা ভাল করে দেখল, কোথাও একটা মশা রয়ে গেল কিনা। পায়ের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাঁটু ভর করে বসল, তালির শব্দ হল একবার। “না, মশা নয়। একটা কালো সুতোর আঁশ লেগেছিল জালে।” মীরা আবার মাথার দিকে ফিরে এল। বসল। বসে খোঁপাটা ঘাড়ের আর-একটু ওপরে উঠিয়ে দিল, চড়ি থেকে সেফটিপিন খুলে দাঁতের মধ্য থেকে মউরির দানাটা খুঁচিয়ে ফেলে দিল। গায়ের জামা ঢিলে করল, কোমরের ওপর থেকে শাড়িটা আলগা করতে করতে বলল, “এবার খুব তাড়াতাড়ি গরম পড়বে।” ছোট্ট করে হাই তুলল মীরা ।“কাল আমি ঘেমেছি রাত্রে, আজ আর লেপ নেব না।” বালিশের পাশ দিয়ে মশারি ফাঁক করে হাত বাড়িয়ে বাতি নেবাল মীরা। কেরোসিনের ছোট টেবিল-বাতি নেবানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন ঝুপ করে অন্ধকারের মশারিটাও খুলে পড়ে গেল।

স্বামীর দিকে না ফিরে চিৎ হয়ে শুয়ে মীরা দু মুহূর্ত মনে মনে ঠাকুর প্রণাম করে নিল। পরে বলল, “আজ কদিন তুমি এত গম্ভীর কেন গো?”

শিশির নীরব।

“ঘুমিয়ে পড়লে নাকি এর মধ্যেই?” মীরা স্বামীর দিকে পাশ ফিরল। “কি হয়েছে গো?”

“কি আর! কিছুই নয়।”

“রাখো—। সারাক্ষণ মুখ গুম করে রয়েছ।” মীরা বালিশ থেকে আরও গড়িয়ে এল, শিশিরের বুকে হাত রাখল। “কি না তখন বলছিলে—, শহরে ক’টা লোক মারা গেছে! তুমি কি সারাক্ষণ ওই ভাবছ?”

“ভাবছি।” অক্লেশে শিশির ছোট করে বলল।

“তুমি ভাবছ কেন? তোমার ভাবার কি দরকার? যাদের ভাবনার তারা ভাবুক।”

“কেউ ভাবছে না।”

“কেন! এই যে শুনলাম মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ঢেঁড়া পিটিয়েছে; জলটল ফুটিয়ে খেতে বলছে, ব্লিচিং পাউডার ছড়াতে বলছে নালি নর্দমায়!” মীরা বলল। তার গলার স্বর তেমন উদ্বিগ্ন নয়, একটু হয়ত স্বাভাবিক দুশ্চিন্ত ছিল, যা শিশিরের কানে উদাসীন ধরনের বলে মনে হল।

মীরার হাত নরম। সাংসারিক সমস্ত কাজ করা সত্ত্বেও কর্কশ বা কঠিন হয়ে ওঠেনি। শিশির বুকের ওপর মীরার হাত অনুভব করতে করতে বলল, “রোজ আট দশ জন করে লোক মারা যাচ্ছে, জান?”

“শুনছি তো।”

“এই শহরে প্রত্যহ এতগুলো লোক মারা যাওয়ার অবস্থাটা বুঝতে পারছ না?”

“কলেরা বসন্তর সময়ও তো মরে।”

“না; এভাবে নয়।” শিশির বিরক্ত হল। ঘটনার ভয়াবহতা মীরা বুঝতে পারছে না। এই শহরের সবাই যেমন নিশ্চিন্ত, কিংবা ধরে নিয়েছে যে এই মড়ক স্বাভাবিক, হুট করে এসেছে, আবার চলে যাবে, মীরাও তেমনি ভাবছে। বিষয়টা তাকে বিচলিত ও চিন্তিত করছে না।

মীরা শিশিরের বুকে একটা আঙুল আলতো করে ঘষছিল। বলল, “আমরা সাবধানে আছি বাপু। কোনও রকম নোংরা-টোংরা তুমি এ বাড়িতে দেখবে না।”

অসন্তুষ্ট হল শিশির। মীরা শুধু নিজেদের কথাই ভাবছে। যদিও সাবধানে থাকার সঙ্গে এ রোগের কোনো সম্পর্ক আছে কি না শিশিরের জানা নেই, তবু মনে হল স্বার্থপর এই চিন্তা খুবই নোংরা। মানুষ এই রকম চিন্তা করে বলেই সমস্যা থেকে বিচ্ছন্ন ও পৃথক হয়ে যায়।

“সাবধানে থাকলেই তুমি বেঁচে যাবে, তোমায় কেউ বলেছে?” শিশির ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, “তুমি কতটা সাবধানে থাকতে পার।”

মীরার ইচ্ছে করছিল না রাত দুপুরে শুয়ে শুয়ে এখন রোগ ভোগ নিয়ে গল্প করে। সংসারে সারাক্ষণই শত দুশ্চিন্তা; বাবার চিঠি পেয়ে গতকাল থেকেই মন খারাপ হয়ে আছে মীরার, মা বুড়ো বয়সে পা ভেঙে শয্যাশায়ী। বাচ্চুর চিঠি এসেছে আজ, স্কুলের বোর্ডিংয়ে থেকে লেখাপড়া করে আসানসোলে; লিখেছে, মা আমার দুদিন ধরে খুব সর্দি-কাশি হয়েছে। আমার সমস্ত বই এখনো কেনা হয়নি। তুমি এ মাসে বইয়ের টাকাও পাঠিয়ো।

শহরের রোগের কথা না ভেবে, মীরা স্বামীর বুকের পাশে মাথা রেখে চোখ বুজে বাচ্চুর কথা ভাবছিল। বাচ্চুর বয়স এখন মাএ তেরো। মীরার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন বাচ্চুর বয়স ছিল সাত আট। বাছুর মা, অর্থাৎ শিশিরের প্রথম স্ত্রী দ্বিতীয় সন্তান হতে গিয়ে মারা যায়। বাচ্চু তখন বছর চারেকের ছিল। করবে না করবে না করেও শিশির বেশ দেরি করেই আবার বিয়ে করল।

তা করুক। মীরার তেমন কোনো ক্ষোভ এ-বিষয়ে নেই। তবে তার দুঃখ, নিজের গর্ভে কোনো সন্তানাদি তার হল না। হয়ত আর হবে না। বাচ্চুটাও কাছে থাকে না বলে বড় ফাঁকা লাগে। শিশির এই শহরের স্কুলে ছেলেকে পড়াবে না। বলে, এখানকার গোয়ালে ছেলেকে রাখলে তোমার কপালে দুঃখ ছাড়া কিছু জুটবে না।

মীরা নিশ্বাস ফেলল। ফেলে বাচ্চুর কথা তুলল। বলল, “তোমার যত অকাজের চিন্তা। যাও না, ছেলেটাকে একবার দেখে এসো বরং। সর্দিকাশিতে ভুগছে—”

শিশির সামান্য পাশ ফিরল। জানলার বাইরে যতখানি শূন্যতা সমস্তটাই অন্ধকারে ভরা। অতি ক্ষীণ একটি আলোর মলিন রেখা টিউবকলের পাশ দিয়ে ফুল গাছটার কাছে গিয়ে পড়েছে। আলোটা পথের। শিশির, বাচ্চুর কথা দু মুহূর্ত ভাবল বোধহয়। ছেলেকে সবাইর সঙ্গে সুখে দুঃখে কষ্টে অসুবিধায় সে মানুষ করতে চায় বলে অল্প বয়স থেকেই বাইরে রেখে দিয়েছে। আত্ম-নির্ভরতা না থাকলে মানুষ কখনও মানুষ হয় না। যদি সর্দি-কাশি হয়ে থাকে হোক, শিশির ভাবল সর্দি-কাশি মানুষ মাত্রেরই হয়ে থাকে, সেরে যাবে, দেখতে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

“বাচ্চু কি যেতে লিখেছে আমাকে?” শিশির বলল।

“না, যেতে লিখবে কেন?”

“তবে যাবার কি দরকার! সর্দি-কাশি সব মানুষেরই হয়।”

মীরা অসন্তুষ্ট হল। শিশির এমনভাবে কথাটা বলল যেন তাকে উপেক্ষা করল, উপহাস করল। ক্ষুব্ধ হয়ে মীরা বলল, “সব মানুষেরই যদি সর্দি-কাশি হয়, তবে সব মানুষের রোগও হয়। কেউ কেউ রোগে মরে। তুমিই বা অত মাথা ঘামিয়ে মরছ কেন?”

জবাব দেবার আগে শিশির কেন যেন সাইকেলের দোকানের ছোটটুর কথা ভাবল। বলল, “তুমি বুঝতে পারছ না শহরের অবস্থা কেমন হয়ে আসছে।”

“না, আমি কিছু বুঝি না; সব তুমিই বোঝ।”

“খানিকটা বুঝতে পারি।” বলে থামল শিশির। বলল, “আজ পনের ষোল বছর আমি এই শহরে আছি। ভাল-মন্দ দুই-ই দেখেছি।…তুমি জান এখানের শ্মশানে মাসে চারটে মরা পুড়লেই যথেষ্ট হত। একটা পাকা ঘাট, মাথা বাঁচাবার মতন একটু জায়গা চেয়ে চেয়ে লোক হদ্দ হয়ে গেছে, পায়নি। আজ সেখানে রোজ সাতটা আটটা করে লোক মরছে।…এভাবে চললে এই শহর শ্মশান হয়ে যাবে।”

মীরা স্বামীর উদ্বেগ নিতান্ত অকারণ মনে করল। মনে করে বলল, “তুমি ছটফট করলেই যেন সব সমস্যা মিটে যাবে। যাদের ভাববার তারা ভাবছে।”

“তারা ভাবছে না। তারা এই ঢেঁড়া পেটানোর কথাটুকুই ভাবছে।”

“না তারা ভাবছে না, সব ভাবনা তোমার ওপর দিয়ে বসে আছে!…তুমি কে?”

শিশির নীরব হয়ে গেল। মীরার কথাটা শোনার পর তার মনে আচমকা এই প্রশ্নটাই লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল। তুমি কে? ভাবনার দায়িত্ব তোমায় কে দিয়েছে? তুমি কোন অধিকারে এ-সব ভাবছ?

কুল ঝোপের কাছে যে পাতলা কোনো রকমে লেগে থাকা ঈষৎ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিশীথের কথা তার মনে পড়ল। মোমের মতন সাদা মুখ, হলুদ দুটি চোখ, কয়েকটা কুকুর পাশের ঘরে চেঁচাচ্ছে— নিশীথ মৃত্যু শয্যায়। এই মৃত্যু শিশির দেখেছে। অস্বাভাবিক, অসঙ্গত, নির্দয়। ‘আমার খয়েরি কুকুরটার বাচ্চা হবে শীঘ্র বুঝলেন শিশির দা। যদি সব কটা বেঁচে যায় আমি আড়াই শো তিনশো টাকা কামিয়ে নেব। ইচ্ছে আছে হাতে টাকা এলে একবার গয়ায় যাব। মা-র পিণ্ডিটা দিয়ে আসা উচিত। পাঁচ বছর হয়ে গেল। …” শিশির নিশীথের এই ক’টি কথা স্মরণ করতে পারল। পথে দেখা হয়েছিল একদিন, অসুখের ঠিক আগে আগে।

এখনও শিশিরের মনে হল, নিশীথের মৃত্যু তাকে অকারণে অপ্রসন্ন করছে। যেন সে কোথাও না কোথাও দায়ী। তার দায়িত্ব বস্তুত কোথাও, কেন, কি করে সম্ভব— শিশির ধারণা করতে পারছিল না, তবু আশ্চর্যভাবে অনুভব করছিল, সে এই অস্বস্তিকর দুর্বোধ্য দায়িত্ব পীড়ন থেকে মুক্ত হতে পারছে না।

মীরা ঘুমিয়ে পড়েছিল। শিশির মীরার হাত আস্তে করে নিজের বুক থেকে সরিয়ে দিল।

পরের সপ্তাহটা আরও ভীতিকর হয়ে উঠল। সোমে মারা গেল দশজন, মঙ্গলবার গোশালার দিকে ইতর জনের মহল্লাটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল, ওদিকে পা বাড়াতে কারও সাহস হচ্ছিল না। বুধবার একই রকম অবস্থা। মনে হচ্ছিল, পরবর্তী দিন পূর্ববর্তী দিনকে প্রাণপণে হারিয়ে দেবার জন্যে ছুটছে, কে কত বেশি মাথাগুণতি মৃত্যু নিয়ে শ্মশানটাকে ছুঁতে পারে। শহরে এতদিনে একটা আতঙ্কের ভাব দেখা দিল। মিউনিসিপ্যালিটির তরফ থেকে দুটো লরি ভাড়া করে জনা কয়েক লোককে তারস্বরে চেঁচাতে বলা হয়। তারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে বেড়াতে লাগল; ‘ভাই ও, আপনা জান্ আপকো হাত মে। মাছ্ছি-চুহা-তেলচিট্‌টা সে, সামাল কর রহিয়ে গা। গান্‌ধি সে তফাত, ময়লা পানি সে তফাৎ,…।’ কয়েকটা সাইকেল রিকশার ওপর ব্লিচিং পাউডার ও ডি ডি টি রেখে স্যানিটারীবাবু পাড়ায় পাড়ায় প্রতিরোধ বিলি করতে লাগলেন। মিউনিসিপ্যালিটির অফিসে মেম্বারদের মিটিং হয়ে গেল। কয়েকজন পুলিশ বাজারের ক’টা খাবারের দোকান থেকে কিছু খাবার টেনে নালিতে রাস্তায় ফেলে দিল।

শনিবার সকাল হতে অতটা বোঝা যায়নি, কিন্তু বেলা যত বাড়তে লাগল, মনে হল মিউনিসিপ্যালিটির ছেলে মানুষিকে উপহাস করার জন্যে অথবা তাকে ধিক্কার দেবার আনন্দে কিংবা যেন ক্রুদ্ধ হয়েই সেই অজ্ঞাত ভীষণ সংক্রামক ব্যাধিটা শহরের উচ্চ নীচ অধম ইতর কিছুমাত্র বিবেচনা না করে প্রায় প্রতি ঘণ্টার মাথায় একটি করে জীবন গ্রাস করতে লাগল।

রবিবার আসার পর বোঝা গেল, এই শহর অতি রকম ভীতার্ত। দু দল ভলেন্টিয়ার পালা করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরছে। জেলা শহর থেকে ডাক্তার এসেছে চারজন। নদীর কাছে তাঁবু ফেলা হচ্ছে অসুস্থদের জন্য, কিছু ডোম মেথর মুদ্দফরাস এসেছে পাবলিক হেলথের গাড়ি চড়ে কোদাল ঝুড়ি হাতে নিয়ে।

শহর খাঁ খাঁ করছিল প্রায়। কিছু লোক পালিয়েছে ইতিমধ্যে; কিছু কিছু পালাচ্ছে। একটা পুলিশ পার্টি জিপ চেপে সমস্ত শহর টহল দিচ্ছে, কোনও রকম খাবারের দোকান খোলা চলবে না, পান বেচা বন্ধ বাজারে মাছ-মাংস অথবা পচা কফি বেচা নিষেধ।

শিশির এইমাত্র স্নান সারল। মীরা টিউবকলের জল ফুটিয়ে লাইজল ঢেলে তবে এক বালতি জল দিয়েছিল স্বামীকে স্নান করতে। স্নান করতে করতে শিশির লাইজলের গন্ধে অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। খুব বেশি রকম সতর্কতা ও এটা নয়; এক এক ধরনের মূর্খতা। স্নানের জল নিয়ে এতটা সাবধান হওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

বাইরে কড়া নাড়ল কে যেন।

সাড়া দিল শিশির। মীরা বলল, “তুমি কাপড় ছাড় গে যাও, আমি দেখছি।”

মীরা দেখতে গেল বাইরে। শিশির ঘরে এসে কাপড় ছাড়তে লাগল।

সামান্য পরেই ফিরে এল মীরা, হাতে একটা খাম । বলল, “তোমার চিঠি যেন কিসের। কি রকম চোগাচাপকান পরা একটা এসেছিল গো চিঠি দিতে।”

চিঠিটা নিল শিশির। মুখার্জি সাহেবের মোহর করা চিঠি। খাম ছিঁড়ে চিরকুটটা বের করল। সন্ধ্যেবেলা মুখার্জি সাহেব দেখা করতে বলেছেন।

সন্ধেবেলা ঘটনাটা এই রকম ঘটল।

মুখার্জি সাহেব প্রশ্ন করলেন, “আপনি ডাক্তার?”

“আজ্ঞে না।” শিশির জবাব দিল বিনীত স্বরে।

“আপনি না কোর্টে চাকরি করেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি…”

“আপনি মিউনিসিপ্যালিটির মেম্বার?”

“আজ্ঞে না। আমি মেম্বারও নই।”

মুখার্জি সাহেব শিশিরের চোখে চোখে তাকালেন দু মুহূর্ত। বললেন, “যে লোক ডাক্তার নয়, সে কোনো রকম সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের রেকর্ড দেখতে পারবে না, এমন কি মিউনিসিপ্যালিটির মেম্বারও নয়, তার পক্ষে এসব ধৃষ্টতা কেন?” কথাটা শেষ করে মুখার্জি সাহেব পকেট থেকে একটা পাতলা কাগজ বের করে মুচড়ে তাল পাকিয়ে ছুঁড়ে দিলেন শিশিরের মুখের দিকে। মনে হল, শিশিরের মুখে ছুঁড়ে মারলেন।

মুখার্জি সাহেবের সংযত ভঙ্গি সত্ত্বেও তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠছিল, চোখ অত্যন্ত নোংরা দেখাচ্ছিল।

শিশির কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল। তার নিশ্বাস পড়ছিল না। হাত এবং পায়ে ঘাম হচ্ছিল। কান জ্বালা করছিল।

এই গ্লানি সহ্য করা অসম্ভব। শিশির উঠে পড়ার জন্যে চেয়ার ঠেলে দাঁড়াতে গেল। শব্দ হল একটু।

“শহরে এপিডেমিক কেন হল, কি জন্যে হল, কি করা উচিত, কি করলে ভাল হয় তা দেখার জন্যে মিউনিসিপ্যাল বোর্ড আছে, হেলথ্ ডিপার্টমেন্ট আছে, আমি আছি, গভর্নমেন্ট আছে। হু আর ইউ?” মুখার্জি সাহেব এমনভাবে কথাটা বললেন যেন হাত বাড়িয়ে শিশিরের লাইসেন্স দেখতে চাইলেন, কোন্ অধিকারে শিশির জনকল্যাণ ফিরি করছে।

কিছু বলল না শিশির। ভদ্রভাবে একটা নমস্কার সারল। সেরে চলে আসছে, মুখার্জি সাহেব আবার বললেন, “ইউ শুড্ বি অ্যামেড…নিজের ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে আপনি শহরের এপিডেমিকের কথা ভাবছেন। যান, বাঁদরামি আর করবেন না। আগে যোগ্যতা হোক।”

শিশির বাইরে এল।

বাইরে এসে তার চৌদ্দ বছরের সাইকেলটা ঠেলে মহামারীর দিকে এগিয়ে চলল।

যেতে যেতে শিশির ভাবছিল, এই শহরের মহামারীতে সে এবং মীরা কোনওদিন মৃতের তালিকায় স্থান পেতে পারে। কেন না, আপাতত এই শহর কেবল মাত্র যোগ্য এবং অধিকারী ব্যক্তিদের উপদেশ মতন পরিচালিত হবে। রাজারামবাবু আরও দেদার ব্লিচিং পাউডার ছড়াতে হুকুম করবেন, তিনি চেয়ারম্যান। মুখার্জি সাহেব ইঁদুর মশা মাছি থেকে সাবধানে থাকতে বলবেন, কেন না তিনি হাকিম, শিশির কিছু বলতে পারবে না—কেননা প্রতিটি মৃত্যুর উদ্বিগ্ন ও অস্থির বোধ করছে। সে শুধু লজ্জিত হবে। অনুতপ্ত হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *