পলাশ

পলাশ

ওখানে পলাশ ফুটেছে। ফাল্গুনের এই গোড়াতেই গাছগুলোর গা-মাথা লাল টুকটুক করছে। সকালের রোদে—শুধু সকাল কেন, একটু চড়া বেলার রোদে—দুপুরে, শেষ বিকেলেও যে কী সুন্দর দেখায়! তাকালে চোখ ফেরানো যায় না। তবু তো ওখানটা পলাশবন নয়; মাঠের মধ্যে এদিক-ওদিক দু-দশটা গাছ, এই যা। তা বলে ধুধু মাঠ নয়। ধান কাটার পার ফাঁকা ক্ষেত। কেমন যেন করুণ-করুণ চেহারা। আলের পর আল; আঁকাবাঁকা। তারই মধ্যে কোথাও একটা আমলকী গাছ দাঁড়িয়ে আছে; কোথাও হরীতকী। পোড়ো জমিতে জাম-জামরুল। রেল লাইনের পাশে টেলিগ্রাফ পোস্ট। তারের ওপর ফিঙে। জল জমে জমে ডোবার মতন হয়েছে কোথাও, শেওলা-জমা সবুজ মতন জল, তার ওপর তিরতিরে পাতা, জলশাক। ধবধবে বকগুলো এই এসে বসে, আবার উড়ে যায়। কোথায় যে যায়! আল ধরে ধরে খানিকটা গেলে ঝোপঝাড় কিছু আছে দূরে। ছায়াভরা গ্রামটাম হবে। ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।’ উমা কৌতুকের সুরে হেসে উঠে রতিকান্তর বর্ণনায় ছেদ টেনে দেয়। বলে “আপনি কাজকর্ম কিছু করেন, না বসে বসে পলাশ গাছ আর মাঠ-বন দেখেন, সত্যি করে বলুন তো জামাইবাবু?”

রতিকান্তর পোশাক পরা শেষ হয়েছিল। সাদা শার্ট, খাকি হাফপ্যান্ট। মোজা সমেত পা-টা চটির মধ্যে গলিয়ে ডেক-চেয়ারে শুয়ে শুয়ে সিগারেটটা শেষ করে নিচ্ছিল। এখন সবে সাড়ে-আটটা। এরই মধ্যে নাওয়া, খাওয়া, পোশাক পরা সব শেষ। বিনু একটা বড় মতন টিফিন কৌটো ঝাড়নে বেঁধে এনে দেবে, আর চায়ের ফ্লাস্কটা; কাঠের ফ্রেমে আঁটা জলের কুঁজোও। চাপরাসী এসে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কৌটো, ফ্লাস্ক, কুঁজো নিয়ে চলে যাবে। তারপরই রতিকান্ত উঠে পড়ল। টেবিল থেকে সেই এক বিঘতটাক চওড়া নোট বই আর পেন্সিল পকেটে ফেলে, স্কেলটা বুকপকেটে গুঁজে, জুতো বদলে, চশমার ওপর অ্যাটাচিটা এঁটে নিয়ে চলে যাবে রতিকান্ত।

“কাজকর্ম না করে কি উপায় আছে?” উমার কথার জবাবটা দিল রতিকান্ত। বিনু ফ্লাক্স আর টিফিন-কৌটো হাতে ঘরে এসে পড়েছে ততক্ষণে। রতিকান্ত আবার বললেন, “তবে ফাঁকি মারতে ইচ্ছে হলে কেউ কি আর ঠেকাতে পারে!”

বিনু স্বামীর জন্যে কাচা পাট করা রুমাল, ভাজা মশলা, এটা-সেটা গোছ করে দিতে দিতে বলল, “রোজ রোজ তো শোনাচ্ছ কী সুন্দর জায়গা, কী সুন্দর জায়গা—পলাশফুল ফুটেছে, হাতিঘোড়া নাচছে—তা একদিন ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও না বেড়াতে।”

প্রস্তাবটা আগেও উঠেছে। উমা নিজেই বলেছে। আজ আবার। উমা ঠোট উল্টে বলল, “ও-কথা আর বলিস না দিদি। জামাইবাবুর মাথা কাটা যাবে।”

“মাথা কাটা যাবে বলিনি তো।” রতিকান্ত সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল। হাসি মুখ। বলল, “চাকরিটা যাবে বলেছি।”

“ওই একই হল।” উমা দিদির ব্লাউজের হাতার ফুল তুলছিল সুতো দিয়ে। দাঁত দিয়ে সুতো কাটল। নিচু মুখ। চোখ দুটো শুধু ভুরুছোঁয়া হয়ে রতিকান্তকে নজর করল।

বিনু বোনের হয়ে বলল, “আর কারুর চাকরি যায় না, তোমার বেলাতেই যত অমুক সাহেব তমুক সাহেব দেখে ফেলবে।” কথাটা শেষ করতে করতে বিনু বাইরে চলে গেল টিফিন, জলের কুঁজো চাপরাসীকে গছিয়ে দিতে।

রতিকান্ত ডেক-চেয়ার ছেড়ে উঠল। সামনেই ড্রয়ার দেওয়া টেবিল। তারই উপরে কাঠের টুকরো এঁটে আয়না বসান। কাচটার রঙ কেমন একটু হলুদ হলুদ। দু-চারটে চিড়ও আছে। রতিকান্তর নিজের হাতের মিস্ত্রীগিরি।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ওপর চিরুনির কয়েকটা দ্রুত এবং অভ্যস্ত টান দিল রতিকান্ত। কাচের মধ্যে দিয়েই উমার গোলগাল ফরসা মুখটা দেখা যাচ্ছিল। “রেলের ট্রলির নিয়মকানুনটা আলাদা, বুঝলে উমা। এ তো আর তোমার দিদির কুড়িয়ে পাওয়া ঠেলাগাড়ি নয়।” বলে রতিকান্ত হেসে নিজের বুকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। “এ-ঠেলাগাড়িতে তোমার দিদি যা খুশি চাপাতে পারে। কিন্তু রেলের ট্রলিতে ওয়াইফকেও চাপানো যায় না।” রতিকান্ত হাসতে লাগল। সেই সঙ্গে নোটখাতা পেন্সিল, রুমাল পকেটে পুরে নিচ্ছিল।

“আ—হা, কী কথা!” উমা জামাইবাবুর দিকে আড়চোখে চেয়ে মধুর ভঙ্গীতে হাসল। “ওয়াইফের চেয়ে ওয়াইফ-সিস্টারের দাম বেশি মশাই। আপনার সাহেবকে সেটা বুঝিয়ে দেবেন।”

“নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমিও তাই বলি। বিশেষ আমরা যখন হারাধনের দশটি গিয়ে একটিতে ঠেকার মতন, সবে ধন নীলমণি একটি মাত্র ওয়াইফ-সিস্টার।” রতিকান্ত মাথা নেড়ে নেড়ে বলল। তারপর দুজনের একসঙ্গে হাসি।

হাসি থামলে উমা বলল, “আপনার সেই গোকুলবাবুর ওয়াইফ-সিস্টারের গল্পটা কাল রাত্রে যতবার মনে পড়েছে—ততবার হেসেছি জামাইবাবু।”

বিনু এল। রতিকান্ত তৈরি। শুধু জুতোটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়ার বাকী।

ঘরের মধ্যে জানলার কাছে কাঠের দোলনায় রতিকান্তর মেয়ে ঘুমোচ্ছে। দেড় বছরের মেয়ে। মেয়ের গালে আস্তে আস্তে করে একটু আঙুল ঘষে হাসিহাসি চোখে বললে রতিকান্ত, “এ বেটি মাসির মতনই তেজী হবে। এক ফোঁটা মেয়ের মুখের চেহারাটা দেখ। গাল ফোলানো কপাল কোঁচকানো।”

বিনু স্বামীর সোলার হ্যাটটা পেরেক থেকে নামিয়ে এনেছে। জুতো পরা হয়ে গেলে এই টুপিটা হাত বাড়িয়ে দেওয়ার যা বাকী। তারপর আর রতিকান্তর জন্যে করণীয় কিছু নেই।

“মাসির মুখটা এমন কিছু ফেলনা নয়; বোনঝির তাতে জাত যাবে না।” উমা কৃত্রিম একটা ঝাঁজ দেখাল।

“তা ঠিক; তবে ফলাফলটাও খুব ভালো হবে বলে মনে হয় না—”, রতিকান্ত খুব প্রচ্ছন্নভাবে কিসের যেন একটা ইঙ্গিত দিয়ে হাসিমুখে বাইরে চলে গেল।

বাইরে ঠিক নয়। ঘরের চৌকাঠের সামনে হেঁট হয়ে জুতো পরতে লাগল।

বিনুর সঙ্গে উমাও চৌকাঠের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

জুতোর ফিতে বেঁধে রতিকান্ত মুখ তুলল। বিনু টুপিটা দিল। উমা বলল, “খুব যে মাসির নিন্দে করে পালাচ্ছেন। আর আসছি না বাপু এখানে এই প্রথম, এই শেষ।”

“ছি ছি—”, রতিকান্ত জিভ কাটল, কানে আঙুল দিয়ে বলল, “অমন কথা শুনতে নেই।”

“কেন বলবে না! সারাদিন তো নিজে ঘুরে বেড়াও, কিন্তু ওকে কবে একটু সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে গেছ?” বিনু বোনের হয়ে বলল, “এসে পর্যন্ত ত মেয়েটার ঘরে বসে বসেই কাটছে।”

কথাটা রতিকান্তের কানে গেছে কি যায়নি বোঝা গেল না। জুতোর শব্দ তুলে ততক্ষণে সে এগিয়ে গেছে।

দুই বোনে একটুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকল। উমা দিদির কাঁধ থেকে খসে পড়া আঁচলটা তুলে দিতে দিতে বললে, “জামাইবাবু কেমন হয়ে গেছে দিদি দেখছিস?”

“কেমন?” অন্যমনস্কভাবে শুধল বিনু।

জবাবটা চট করে ঠোঁটে এল না উমার। কথাটা কেন বলল, কী দেখে কী ভেবে—উমাও তার হদিশ পেল না। একটু থেমে যেন কিছু একটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলল, “এই বয়সেই কেমন যেন একটু বুড়ো বুড়ো।”

বিনু মুখ ঘুরিয়ে বোনকে দেখল। তারপর কিছু না বলেই হাসল একটু।

দিন দুই যেতে-না-যেতেই এক সকালে উমার হুটোপাটি শুরু হয়ে গেল। রতিকান্ত কথা দিয়েছে আজ ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। না, না—চাঁদমারি কিংবা তিন-পাথরের গুহা থেকে চুইয়ে পড়া জল দেখতে নয়, নিয়ে যাবে ট্রলি করে, পাঁচ মাইল দূরের সেই পলাশফোটা রোদ-ঝলমল মাঠে। রতিকান্তর মুখে শুনে শুনে, সেই তেপান্তর সম্পর্কে উমার কেমন একটা কৌতুহল জেগেছিল। আর যদি সে-কৌতূহল খুবই সাধারণ হয়, তাতেই বা কী! ট্রলির উপর বসে পাঁচ মাইল পথ, হাওয়ার দমকা খেতে হু হু করে এগিয়ে যাওয়া, ভাবতেই যে ভালো লাগে। ট্রলিতে কখনো চড়েনি উমা। দেখেছে। এইত সেদিনও দেখল। লাইনের উপর দিয়ে যখন চলে যায়, এমন সুন্দর একটা গনগন আওয়াজ হয়। যেন একদল ভোমরা গুনগুন করছে। লাইন ধরে রাস্তাটাও—জামাইবাবু যেখানে কাজে যায়—নাকি চমৎকার। ঝোপঝাড় জঙ্গল, মাঠ, ছোট ছোট দুটো নদী। উমার তো উৎসাহ খুব। কলকাতার অন্ধগলির বাসিন্দে সে। ট্রেনেই চড়েছে জীবনে হয়ত দু-চারবার। ফাঁকা মাঠঘাট বন এসব এক সিনেমার ছবিতে ছাড়া দেখছেই বা কোথায়। আর দেখবেই বা কবে!

আসলে হয়ত এসব কিছুই না। শুধু একটা চঞ্চলতা, ঘর থেকে বাইরে বেরুবার, দু-পাঁচ ঘণ্টা কোথাও কোনো নতুন জায়গা থেকে বেড়িয়ে আসার।

অত সকালে কি স্নান সারা যায়, ভাতই কি খাওয়া যায়! তবু উমা স্নান সারল। ভিজে চুল শুকবে কি শুকবে না, বিনুনি দিলে নির্ঘাত জট; দরকার কি, এলোই থাক। ভাত দু-গরাস পেটে গেল। ওতেই হবে। “বুঝলেন জামাইবাবু, লুচি আলুরদম সব বাপু বেঁধে নিয়ে যাচ্ছি, আমাদের সেই বেহালার মাঠে বেড়াতে যাওয়ার মতন। আমার আবার বাইরে বেরুলে খিদেটা বেশি পায়। দিদি, ক’টা পান দিবি? ও জামাইবাবু, যদি বলেন তো আমার সঞ্চয়িতাটা নিই; গাছের ছায়ায় বসে বসে পড়া যাবে।”

বিনু বোনের ছটফটানি দেখে বলে, “তুই যেন হরিদ্বারে গঙ্গা চান করতে যাচ্ছিস উমি, এমনি করছিস। যা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিগে যা। ছাপা শাড়িটাই পরে যাস, ভালোটালো পরে দরকার নেই, জলে কাদায় কাঁটার খোঁচায় ত একশা করে আনবি।”

যাবার মুখে কিছু না হক, উমা একমুঠো এলাচ-দারচিনি নিয়ে বেরুল। রতিকান্ত হেসে বলল, “তা ভালো, সারাটা পথ তোমার মুখ থেকে সুগন্ধ বাক্য শোনা যাবে।”

উমা ভ্রূভঙ্গি করে জামাইবাবুর হাতে চিমটি কেটে দিল। এদিক-ওদিক একটু তাকিয়ে জিব ভেঙিয়ে বলল মৃদু সুরে, “দয়া হলে এমনিতেই অনেক কিছু শোনাতে পারি মশাই।”

ট্রলিতে উঠে উমার মুখ যেন আর বন্ধ হয় না। একটার জবাব পেতে-না-পেতে আর একটা। “ও জামাইবাবু, মাথার ওপর এ আবার কী? এ যে রাজছত্র! রঙটা সাদা কেন? পিছনের লোক দুটো যে লাইনের ওপর দিয়ে ছুটছে—ওমা পা পিছলে পড়ে যাবে না? আপনি ছুটতে পারেন লাইন দিয়ে? পারেন না!”

রতিকান্তর পাশে কাঠের বেঞ্চটায় বসে উমার যেন শান্তি হচ্ছিল না। একবার ডানদিকে, পরক্ষণেই বাঁদিকে মুখ ফেরাচ্ছে। সামনের জিনিসটা কখন যে হুস করে পিছনে পড়ে যাচ্ছে ভালো করে ঠাওর করতেই পারছে না। তখন আবার ঘাড় ঘোরাও। দাঁড়িয়ে যেতে পারলেই যেন স্বস্তি পেত উমা। কিন্তু সেখানে তার ভয় আছে।

একটা পুরো এলাচ মুখে ফেলে দিয়ে চিবুতে লাগল উমা। “ওটা কী জামাইবাবু? দেখুন দেখুন, একপাল গোরু কিভাবে নামছে ঢালু দিয়ে। যদি পা পিছলে পড়ে—!”

রতিকান্ত প্রথম প্রথম জবাব দিয়েছিল, এখন আর সব কথার জবাব দিচ্ছে না। বুঝতে পেরেছে রতিকান্ত, উমার প্রশ্নগুলোর জবাব না দিলেও চলে।

খানিকটা এগিয়ে আসতে আশপাশের চেহারাটাই যেন বদলে গেল। মাঠের পর মাঠ। উঁচুনিচু। ছোট ছোট শালঝোপ। জল-শুকনো বালি কিচকিচ নালা। সামান্য দূরেই একটা পাহাড়ের ঢল নেমে এসেছে। গাছ আর ঝোপ সেই ঢালুর মুখে যেন কেউ গেঁথে বসিয়ে দিয়েছে। ছোট বড়ো পাথর। কালচে রঙ। একটা নীল মেঘ পাহাড়টার মাথার উপর চাঁদোয়ার মতন বসানো। দু-একটা লোক দেখা যায় কি যায় না।

পাহাড়টার নাম কী? কত দূর? ওখানে মন্দির আছে কি নেই? উমার বকবকানি শেষ পর্যন্ত থেমে গেল।

পরিবেশটা আবার বদলাল। এবার দু-পাশে একটু তফাত থেকে বুনো ঝোপ-জঙ্গলের একটানা ছায়া-ছমছম চেহারা। ঝাঁকড়া-মাথা গাছ; গাছের গা বেয়ে বেয়ে বুনো লতা। কতক পাখি। কাঠবেড়ালি।

উমা হঠাৎ কান খাড়া করে কী যেন শুনতে লাগল। “ওটা কী ডাকছে জামাইবাবু?”

“ঘুঘু।” রতিকান্ত একটু অবাক হয়ে উমার দিকে চাইল।

“ইস্; আমারও ঠিক তাই মনে হয়েছিল।” উমা আঁচল দিয়ে কপালটা চট করে মুছে নিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপটাও বেড়েছে।

রতিকান্ত রসিকতা করে বলল, “ঘুঘুও কি কলকাতায় নেই নাকি উমা?”

“কী যে বলেন! তা নয়। কলকাতার ঘুঘুগুলো এমন সুন্দর করে ডাকতে পারে না। ওদের দম নেই।” উমা নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠল।

রতিকান্ত হো হো করে হেসে ফেলল।

হাসি থামল। উমা আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিয়ে এবার ঝুঁকে বসল। জানুর উপর কনুই, হাতের তালুতে মুখের ভার দিয়ে।

“আমরা কতটা এলাম জামাইবাবু?”

“অর্ধেকটা চলে এসেছি।” রতিকান্ত জবাব দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল।

“আপনার জলতেষ্টা পাচ্ছে না? আমার গলা তো শুকিয়ে এল।” সামনের রোদের দিকে চেয়ে চেয়ে উমা বলল। তাতটা সত্যিই বেড়েছে। ফাল্গুনের গোড়াতেই এত ঝকঝকে রোদ এখন। লাইনগুলোতে যেন আঁচ লেগেছে পাথরের টুকরোগুলোও বোধ হয় গরম।

“জলতেষ্টা পেয়েছে তো জল খাও।” রতিকান্ত কুঁজোটার জন্যে পিছন দিকে চাইল।

“থাক; এখন খাব না বরং একটা পান খাই,” সত্যসত্যই কাগজে মুড়ে গোটা চার-পাঁচ খিলি পান এনেছে উমা। রতিকান্ত পান খায় না। উমা জোর করে গুজে দিল মুখে। তারপর নিজে একটা খিলি মুখে পুরে বলল, “আপনাকে বড়ো সাধ্যসাধনা করতে হয়। স্বভাবটা আজও তেমনি আছে। বদলাল না।”

ঠিক কী সূত্রে যে কথাটা, রতিকান্ত বুঝে উঠতে পারল না। অনুমান করতে পার, কোনো একটা পুরনো প্রসঙ্গ আছে। বলল রসহ্যভরেই, “সাধ্যসাধনা আর করল কে? বলতে-না-বলতেই চাকরির মায়া ছেড়ে এখানে বেড়াতে নিয়ে এলাম তোমায়।”

“যান, যান—” উমা মুখ না তুলে শুধু একটু ঘাড় ফেরাল, “তাও যদি না সব কথা। আমার মনে থাকত।” উমা চুপ করে গেল। ট্রলিটা লাইনের উপর সুন্দর একটানা শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে ঝলসানো রোদ। পাশের লাইন দিয়ে একটা মালগাড়ি আসছে এই মুখে। তার ইঞ্জিনের ধোঁয়া।

রতিকান্ত উমাকে দেখছিল। ফরসা মুখটা রোদের ঝাঁঝে লালচে হয়ে উঠেছে। ঠোঁট দুটি পানের রসে লাল। কাঁধে জড়ানো এলো চুল শুকিয়ে গেছে। হাওয়ায় উড়ছে কতকগুলো। কানের পাশে, কপালে। একটু যেন ঘাম জমেছে কপালে।

নীরবতা কাটিয়ে উমা হঠাৎ বলল, “আপনার বিয়ের পর এই আবার আপনার সাথে দেখা। মধ্যে অবশ্য কলকাতায় একবার দেখা হয়েছিল—ঘণ্টাখানেকের জন্যে।”

কথাটা ঠিক। বিনুকে আনতে গিয়ে একবার দেখা হয়েছিল উমার সঙ্গে বিনুদের বাড়িতে। উমাই এসেছিল দেখা করতে শাঁখারীটোলা বাড়ি থেকে, বিনু তার মাসতুতো বোন। আলাদা আলাদা বাড়ি মা-মাসির।

বাড়ি আলাদা হলেও মেয়েদের বিয়ের সময় একত্রে পাত্র খোঁজা শুরু করেছিল। মেয়েরা মায়েরা। বিনুতে উমাতে এমন কিছু বয়সের তফাত নয়; বছর আড়াই তিন বড়জোর। পাত্র হিসেবে রতিকান্তর সংবাদটা জোগাড় করেছিল উমার মা। বিয়েটা কিন্তু হয়ে গেল বিনুর সঙ্গে। তারপরে চারটে বছর কেটে গেছে, উমার বিয়ে হয়নি আজও। এই ক’বছরের মধ্যে উমাদের সংসারে ছোট বড় অনেক কাণ্ডই ঘটে গেছে। উমার মা মারা গেছে। নানা কারণে ওর বিয়ের কথাটা চাপাই পড়ে আছে এখনো। আবার উঠবে। হয়ত উঠেছেও এর মধ্যে। নয়ত চার বছর পরে হঠাৎ এই শাল-পলাশের দেশে হাওয়া বদলাতে পাঠাবে কেন উমার বাবা এবং মাসি—বিনুর মা।

এসব পুরনো কথা আজ উমা কিংবা রতিকান্তর মনে পড়ছিল কিনা বলা মুশকিল। দেখা হবার কথায় হয়ত কিছু মনে পড়ে থাকতেও পারে।

“তুমি তো অনেক দিন থেকে এখানে আসব-আসব করছিলে, এলেই পারতে।” রতিকান্তর গলার স্বর এমনিতেই একটু মৃদু, এখন আরো মৃদু এবং কোমল হল।

“আমার ইচ্ছেতেই যদি কাজ হত—!” উমা সামনে-এসে-পড়া মালগাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল।

মালগাড়ির শব্দটা এতক্ষণ কথা ছাপিয়ে যাওয়ার মত ছিল না। এবার রীতিমত কর্কশ হয়ে উঠেছে। ঘটাং ঘটাং বিশ্রী একটা শব্দকে খাদে বেঁধে চাকা ঘষে যাওয়ার একটানা একটা আর্তনাদ। লাইনে, পাথরে এই ফাঁকায় সেই শব্দটা যেন প্রতি মুহূর্তে আরো তীব্র হচ্ছিল।

উমার মনে হল রতিকান্ত যেন কিছু একটা বলল। কী বলল, উমা শুনতে পেল না। শুধু একটা ‘তুমি’ ছাড়া।

দুজনেই চুপ। মালগাড়িটা পেরিয়ে গেল। শব্দটাও ডুবে আসতে লাগল।

একসময় আবার শান্ত। সেই ট্রলির চাকার শব্দ, সামনে ঝলসে-ওঠা রোদ, মাঠঘাট, টেলিগ্রাফ পোস্ট।

উমা মুখ তুলে রতিকান্তর দিকে চেয়ে হঠাৎ একটু হাসল। “আপনাকে আমি যত চিঠি দিয়েছি তার সিকির সিকিরও জবাব আপনি দেননি।”

রতিকান্ত কথাটায় যেন লজ্জা পেল। বলল, “আমি ভালো চিঠি লিখতে পারি না, উমা। আর সেই একঘেয়ে আমরা ভালো আছি, তোমরা কেমন আছ—এ লিখতেও ইচ্ছে করে না।” একটু থামল রতিকান্ত। যেন আরো কিছু বলার আছে এমন ধরনের একটা ভঙ্গী করে। শেষে বলল, “তা বলে ভেব না তোমার কথা আমার মনে পড়ত না।”

উমা রতিকান্তর চোখের দিকে এক পলক চেয়ে থেকে মুখ নামিয়ে নিল। নিজের পরনের ছাপা শাড়িটার একটা ফিকে-হয়ে যাওয়া ফুল দেখতে দেখতে বলল, “চোখের সামনে কেউ থাকলে তাকে এসব কথা বলতে হয়, না, জামাইবাবু?” কথার শেষে ম্লান একটু হাসি।

রতিকান্ত জবাব দিল না। অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে চেয়ে থাকল।

জায়গাটায় পৌঁছে খুশি। রতিকান্ত যা বলেছে তার সঙ্গে যদি ফর্দ মেলানো যায়, কোথাও কমতি হবে না। সত্যিই সুন্দর এই জায়গাটা।

ট্রলি থেকে নেমে কিছুক্ষণ ত উমা চোখ ভরে সব দেখল। লাইনের এপাশটায় আলতোলা ফাঁকা ক্ষেত। দৃষ্টির সীমানা অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়, সবুজ একটা বনের মাথায় আকাশ যেখানে ছুঁয়ে যাচ্ছে, ততদূর। মাঝে-মধ্যে একটি করে যেন কুঞ্জবন, অনেকগুলো গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশটায় পলাশ। ছাড়া ছাড়া, কিন্তু দূর থেকে মনে হয় ঘেঁষাঘেঁষি। লাল টুকটুক করছে। সামনে কনস্ট্রাকশনের লাল-ইঁট-গাঁথা কেবিনের অসম্পূর্ণ চেহারাটা। চুনসুরকির একটা ডাঁইও চোখে পড়ে। সামান্য কিছু মজুর, হল পাইপ, তারের বাণ্ডিল, রেল-লাইনও চোখে পড়ে।

রতিকান্ত বলল, “তুমি ওখানটায় ছায়ায় বসে বসে জিরোও, আমি একটু কাজকর্ম দেখে আসি।”

উমা মাথা নেড়ে সায় জানাল। তারপর আস্তে আস্তে সামনের ছায়াটায় এসে বসল।

কী রোদ! আকাশটা যেন তার গা থেকে সমস্ত রোদের ঢেউ এই মাঠ আর ক্ষেত আর নিরিবিলি ফাঁকায় ছড়িয়ে দিয়েছে। অকৃপণভাবে। ফাল্গুনের হাওয়া। একটু তবু তপ্ত। কতকগুলো ফড়িং সামনের ঘাসে উড়ে উড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। দু-একটা পাখি সামনে দূরে দূরে ডেকে ডেকে উড়ে যাচ্ছে, আবার এসে বসছে আশপাশে।

উমা মুখটা মুছে নিল। ট্রলিটা একপাশে ছায়ার নিচে রাখা রয়েছে। কাছেই। জলতেষ্টা পাচ্ছিল খুব। কুঁজোটা আনতে এগিয়ে গেল উমা।

জল খেয়ে ছায়ার তলায়, ঘাসে পা ছড়িয়ে চুপ করে বসে থাকল উমা। আশপাশে কেউ নেই। পাখিদের খুব মৃদু একটা কিচির-মিচির ছাড়া কোনো শব্দ কানে আসে না। তাও এর মধ্যে ছেদ আছে, দীর্ঘ ছেদ। একটা ফড়িং উমার হাঁটুর উপর এসে বসল, ছাপা শাড়ির ফুলের উপর। আবার উড়ে গেল। মাঠ আর আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে কখন যেন ঘোর লেগে যায় উমার।

রতিকান্ত কখন এসে পাশে বসেছে, উমার হুঁশ ছিল না। কিংবা হয়ত হুঁশ ছিল, তবু অন্যমনস্কতা কাটাতে পারেনি। রতিকান্ত জলের কুঁজো তুলে আলগোছে অনেকটা জল খেয়ে নিল।

“কেমন লাগছে?” রতিকান্ত বেশ করে গা এলিয়ে বসল ঘাসের উপর।

“খুব সুন্দর।” উমা কোলের উপর জড়ো-করা আঁচলটা পাশে ফেলে দিয়ে সুন্দর, করে হাসল।

একটু চুপচাপ। উমাই বললেন, “আমার যদি আপনার মতন কাজ হত, এখানে বসে বসে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতুম।”

“একা একা?” রতিকান্ত পরিহাস করে শুধল হাসিমুখে।

উমা রতিকান্তর দিকে আড়চোখে চাইল হাসিমুখেই। মাথা কাত করে জবাব দিল, “দোকা যখন নেই তখন একা একাই।”

রতিকান্ত সিগারেট ধরাল। আরো একটু আরাম করে বসল। বলল, “তুমি কি কবিতা-টবিতা লেখ নাকি?”

“না। আপনার বিয়েতেই একটা যা লিখেছিলুম।” উমা রতিকান্তর মুখের দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে থাকল।

“সেটা তো চুরি।” রতিকান্তর জবাব।

“কী—?” একটা কৃত্রিম তিরস্কার, কিংবা প্রতিবাদ, “আর একবার বলুন তো কী বললেন।”

“চমৎকার হয়েছিল কবিতাটা।” রতিকান্ত তাড়াতাড়ি তারিফ করার একটা ভঙ্গী করল, “ফার্স্ট ক্লাস। কী ভাষা, কী ছন্দ! পড়লেই রবিঠাকুরের সেই—আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে—মনে পড়ে যায়।” হাসতে লাগল রতিকান্ত।

উমা চুপ। অন্যদিকে চেয়ে থাকল। বলল তারপর, খুব মৃদু গলায়, “মিথ্যেই বা কী—বড় মাসির বাড়ি তো আনন্দেই ছেয়ে গিয়েছিল।”

“আমি বোধ হয় আনন্দময়ী—সরি, আনন্দময় ছিলাম?” রতিকান্ত ধোঁয়া ছাড়ল।

উমা মাথা হেলাল।

রতিকান্ত হঠাৎ বলল, “আর তুমি বেচারি বোধ হয় সেই দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে?”

রতিকান্ত হাসছিল। উমার মুখে হাসি ছিল না। এবার যেন একটু হাসি এল, রতিকান্তর কথা শোনার পর। বলল, “আপনি যা ভাবেন।” উমা ঘাসের উপর থেকে আঁচলটা তুলে মুঠোর মধ্যে দুমড়তে লাগল। আর বলব-না বলব-না করেও শেষে বলে ফেলল, “আমার কবিতাটাই শুধু চুরি, আরো”—কথাটা শেষ করল না উমা।

ইঙ্গিতটা কিন্তু রতিকান্ত ধরতে পারল। উমার মার খোঁজ নেওয়া, দেখা পাত্র বিনুর মা চুরিই করেছে বলা যায়। পুরনো এই প্রসঙ্গটার জের না টেনে ব্যাপারটাকে লঘু করার চেষ্টা করলে রতিকান্ত। “আমিও বোধ হয় কিছু চুরিটুরি করেছিলাম, কী বল? নেহাত বেঁধে আনতে পারলাম না—!”

একটু থেমে রতিকান্ত শালীর মুখের দিকে চাইল, “সে কী আমার কম দুঃখ।” মুখে হাসিঠাট্টার একটা হায় হায় বেদনার ভাব ফোটাল রতিকান্ত।

উমার মুখে কোনো জবাব নেই। বেশ খানিকটা নীরবতার পর উমা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এখানে বসে বসেই কি দিন কাটাবেন নাকি? কই উঠুন, বলেছিলেন না যেদিকে দু-চোখ যায়—বেড়াব।” বলতে বলতে উমা উঠে দাঁড়াল।

রতিকান্ত খানিকটা উঠে বসে রোদের দিকে চাইল। “এই রোদে ঘুরবে? তারপর যদি মাথা ধরে?”

“আপনি টিপে দেবেন না হয় একটু।” উমা হেসে উঠল। একটু আগের সেই গম্ভীর মুখের রেশ সবটুকু এখনো কাটেনি। তবু এই হাসি সুন্দর। রতিকান্তর ভালো লাগল।

উমা আবার তাগাদা দিল।

উঠল রতিকান্ত। শুধু ওঠা নয়। উমার কথামত টিফিনের কৌটোটা পর্যন্ত হাতে ঝুলিয়ে নিল, চায়ের ফ্লাস্কটা কাঁধে। উমার ইচ্ছে দূরের ওই ছায়াঘন কোনো কুঞ্জে বসে চা খাবে। বিকেলের আগে আর এদিক মাড়াচ্ছে না।

হয়ত এমনিই হয়। একটা বাঁধা সীমানা ছাড়িয়ে চলে আসতে পারলে অনেক কিছু ভুলে যায়। শাঁখারীটোলার অন্ধ গলির মেয়ে অনেক কিছু ভুলল। ভুলে গেল যে, জুতো হাতে ঝুলিয়ে আল দিয়ে খালি পায়ে ছোটা দৃষ্টিকটু; ভুলে গেল যে, হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে বলে চোরকাঁটার ভয়ে গোড়ালির অনেকটা উঁচু পর্যন্ত কাপড় তুলে নেওয়া অসভ্যতা। শাড়ির তলায় খানিকটা সায়া যে বেরিয়ে রয়েছে পায়ের কাছে, এটা অসভ্যতা। এবং হোক রতিকান্ত জামাইবাবু, তবু যখন-তখন তার হাত ধরে টানা—উঠতে পড়তে তাকে জড়িয়ে ধরা, তার সঙ্গে অজস্র কথা বলা এবং ওর সঙ্গে অট্টরোলে সারাক্ষণ হাসাহাসিটা তার উচিত নয়। এসবই অনুচিত।

রতিকান্ত ভুলে যাচ্ছিল। বিনুর স্বামী হিসেবে তার যেসব কর্তব্য, সেই কর্তব্যগুলো কি বজায় থাকছিল এখানে—এই রোদভরা মাঠে আর ফাঁকায় আর ফাল্গুনের হঠাৎ মধুর দুপুরে। বোধ হয় থাকছিল না। উমার ফরসা রোদের ঝাঁঝলাগা মুখখানা দ্রুত মুগ্ধ হয়ে তবে কেন সে দেখবে? মাথার উপরকার তাতটুকু বাঁচাবার জন্যে, উমা আলগা করে যে-ঘোমটাটুকু তুলে দিয়েছিল, সেই ঘোমটাটুকু বা রতিকান্তর এত ভালো লাগবে কেন? কেন মনে হবে তার পাশে-পাশে মাথায় কাপড় তুলে দেওয়া যে-মেয়েটি চলেছে এর সঙ্গে বিনুকে অনায়াসে কল্পনা করা যায়।

উমার চঞ্চলতা, তার উচ্ছ্বাস, খোলামেলা রঙ্গ-রসিকতা রতিকান্তকে মুগ্ধ করছিল। শাঁখারীটোলার মেয়ে এত জীবন্ত—রতিকান্ত যেন জানত না। বুঝতে পারেনি, উমার মধ্যে এত সুন্দর আকর্ষণ এবং মাধুর্য লুকিয়ে আছে। এখন বুঝছে রতিকান্ত। উমার ছায়ায় নিজের ছায়াকে প্রায় মিশিয়ে দিয়ে এই নির্জনে হাঁটতে হাঁটতে।

ওরা ফুল পাড়ল। একরাশ ফুল। “ইস্‌, কী লাল। ইচ্ছে হচ্ছে সব নিয়ে যাই। দিন তো একটা ছোট্ট মতন ফুল জামাইবাবু। মাথায় দিই। দূর ছাই, এলো চুলে কি আর ফুল থাকে?”

“কই দাও আমায় দাও। আহা, অত ছটফট করো না। ফার্স্ট ক্লাস।” রতিকান্ত। সতোর মত দুটি চুলের গুচ্ছে ফাঁস দিয়ে পলাশ ফুলটা গুঁজে দেয়।

“আমি কী রকম ঘেমেছি দেখছেন, জামাইবাবু। কপাল গলা বুক ভিজে টসটস করছে।”

রতিকান্ত উমার ঘামের বিন্দু তোলা মুখ-গলা দেখল। উমার রঙটা রোদের তাতে তাতে আরো লাল হয়ে উঠেছে। চোখ দুটি বড়ো সুন্দর উমার। বেশ টলটলে। গলায় একটা তিল। আলতা-লাল ব্লাউজটা যেন জ্বলজ্বল করছে। রতিকান্তের ঘোর লাগে।

উমার আচল ভর্তি পলাশ, ছাপা বাসন্তী রঙ শাড়িটায় কেমন একটা স্নিগ্ধতা।

“চলুন, এবার ওই পুকুরটার কাছে গিয়ে বসি। খুব ছায়া আছে।”

পুকুরের পাড়ে এসে বসল দুজন। ছায়া এখানে ঘন। গাছ, লতাপাতা, বুনো মিষ্টি গন্ধ। জলটা কালো। ঘুঘু ডাকছে মাথার উপর। ক’টা শালিক ঘাস খুঁটছে।

টিফিন, চা শেষ করে ক্লান্ত দুটি মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে। মাঝে মাঝে উমা মাটির ছোট ছোট ঢেলা ছুঁড়ছে পুকুরের জলে।

“ক’টা বাজল জামাইবাবু?”

“তিনটে প্রায়।” রতিকান্ত ঘড়ি দেখে বলল।

“আর ঘণ্টাখানেক, তারপরেই ফিরব, কেমন?”

“না ফিরলেই বা কী।” রতিকান্ত হাসে। কিন্তু এ-হাসি যেন শুধুই তরল পরিহাস নয়।

“ও বাবা, খুব যে আটখানা প্রাণ দেখি।” উমা দাঁতে করে ঘাসের শিষ কাটছিল। আড়চোখে চেয়ে বলল।

“আটখানা নয়, তবে দুখানা।” রতিকান্ত আমগাছের ডালপাতায় চোখ রেখে জবাব দিল।

উমা পা দুটো টান টান করে ছড়িয়ে দিয়ে আরাম পেল। “আমি কলকাতায় ফিরে গেলে—টুকরো দুটো আবার জুড়ে যাবে, না জামাইবাবু?” সরলভাবে হাসছিল উমা।

রতিকান্ত জবাব দিল না। ভাবছিল কিছু।

মধ্যাহ্নের খর উজ্জ্বলতা এবার ম্লান হয়ে আসছিল। অন্তত এখানে। পত্র পল্লবের ফাঁক দিয়ে যে-আলোটুকু পুকুরপাড়ের সবুজের উপর এসে পড়েছে তার তীব্রতা এখন আর তত নেই। এ যেন মরা আলো। যে-পাশে রতিকান্তরা বসে আছে সে-পাশটায় ছায়া আরো গাঢ় ঘন হয়ে আসছে। আবহাওয়াটা কেমন ক্লান্ত, অলস, তন্দ্রাজড়ানো। টুপটাপ দু-একটা পাতা খসে পড়ছিল পুকুরের জলে। একটা কাঠবেড়ালি আমগাছের গুঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। ঘুঘুর ডাকও আর শোনা যায় না। বোধ হয় উড়ে গেছে।

চুপচাপ দুটি মানুষ। কেউ কারুর দিকে চাইছে না। তবু দুজনেই অনুভব করতে পারছে এখন একের মনে অন্যজন এই নিস্তব্ধ পরিবেশটির মতন ছড়ানো, মাখানো।

উমা আঁচল জড়ো করা পলাশ ফুল মাঝে মাঝে তুলছিল আর রাখছিল কখনো ফুলের নরম পাপড়ি গালে গলায় ধীরে ধীরে বুলিয়ে কোমল অথচ অন্য রকম এক স্পর্শ নিচ্ছিল।

তারপর একসময় উমা নিজের তন্ময়তার মধ্যে গুনগুন শুরু করল। সুরটা যখন কথায় ফুটল, তখন দিন আর মধ্য নেই, তবু তার কথাগুলো বাতাসে যেন শব্দ ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে যেতে লাগল। ঘরোয়া মেয়ের গলার গান। হয়ত সুরের হেরফের আছে। তবু, এ-গান, এখন—এই পরিবেশে—নিজের মতন করে জগৎ গড়ে নিতে পারে। ‘মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি—হে রাখাল বেণু তব বাজাও একাকী।’

পাখিরা গান বন্ধ করেছিল, কিন্তু কোনো রাখাল বেণু বাজাল না। না বাজাক, রতিকান্তর মন দূরবাঁশির সুর শোনার মতন আনমনা। উমার মনও।

গান থামল। ছায়া যেন আরো বিষন্ন হয় এখানে। একটা দমকা হাওয়া এল। গাছপাতা নড়ল। হাওয়ার শব্দটা অবুঝ দীর্ঘনিশ্বাসের মতন খানিকক্ষণ ছটফট করে মিলিয়ে গেল।

রতিকান্তর চোখ নাকি সব সময়ে হাসি দিয়ে মাখানো। এখন মনে হচ্ছিল কথাটা ভুল; ভীষণ এক অন্যমনস্কতা এবং বিষন্নতা মাখান। সেই চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে উমাকে মাঝে মাঝে দেখছিল রতিকান্ত। উমার ঠোঁটে পানের লাল দাগ শুকিয়ে গেছে। চোখের তারার তলায় তেমনি একটা শুষ্কতা।

চারটে বেজে গেছে কখন। অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। রতিকান্তর যেন হুঁশ। হল। বলল, “চল উমা, ওঠা যাক।”

উমা উঠে দাঁড়াল। পা বাড়িয়ে বলল, “আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মাঝে মাঝেই একটা পুকুর দেখি। জল টলটলে। এটা বোধ হয় সেই পুকুর, না জামাইবাবু?”

“বোধ হয়।” রতিকান্ত হাঁটতে শুরু করে বলল, “এবার থেকে আমিও বোধ হয় দেখব।”

পুকুরের উঁচুটুকু পার হয়ে আসতেই একটা গাছে উমার আঁচল জড়িয়ে গেল। আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে গাছটা একটু দেখল উমা। হঠাৎ বলল, “এটা কী গাছ, জানেন।”

গাছটা চিনত রতিকান্ত। বলতে গিয়েও থেমে গেল। বলল না। মাথা নাড়ল, “জানি না।”

অথচ মাঠে নেমে রতিকান্ত কিছুতেই বুঝতে পারল না, কামরাঙা নামটা কেন তার ঠোঁটে আটকে গেল? কেন? আর কেনই বা এখন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে তার।

পড়ে-আসা বিকেলের আলো দিয়ে ফিরে চলল রতিকান্ত আর উমা।

পাঁচটা নাগাদ ট্রলি ফেরার কথা। ফিরল না। মাঝখানে কোথায় প্যাসেঞ্জার-ট্রেনটা আটকে গেছে লাইনের গোলমাল হয়ে, খানিক দেরি হবে।

দেরি বলে দেরি। প্রায় একটা ঘণ্টা আটকে থাকতে হল। প্যাসেঞ্জার-ট্রেনটা চলে গেলে রতিকান্তরা যখন ট্রলিতে উঠল—তখন সামনের মাঠে গোধূলি সবটুকু আলো ঢেলে দিয়ে মাটির তলায় চলে গেছে।

এবার ফেরার পালা। ট্রলিম্যানরা জোর কদমে ছুটেছে। ট্রলিটাও যেন হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। উমা পায়ের কাপড় হাঁটু দিয়ে চেপে বসল। আঁচলে জড়ানো একরাশ পলাশ।

“দিনটা বেশ কাটল জামাইবাবু?” উমা বলল।

“হ্যাঁ। বেশ।”

“আমি তো ভুলতেই পারব না।” উমার এলো চুলের একটা গুচ্ছ হাওয়ায় তার। চোখের উপর এসে পড়ল। চুল সরাতে লাগল উমা।

রতিকান্ত কোনো কথা বলল না।

চাঁদ উঠল। শুক্লপক্ষের চতুর্দশীর চাঁদ। কেউ জানত না, খেয়ালও করেনি। হঠাৎ যেন চোখে পড়ল। পুব আকাশ ধবধব করছে। গোল চাঁদটা ওদের মুখোমুখি।

আর সেই চাঁদের আলো রেল-লাইনের দুপাশে, সামনে মাঠে, গাছে, জঙ্গলে ছড়িয়ে গেছে। ডুবে গেছে বলা যায়। সবই স্পষ্ট, লাইন দেখা যাচ্ছে, পাথর, সিগন্যালের তার পর্যন্ত। পাশের মাঠঘাটও যেন সকালের ফরসায় স্পষ্ট। একটা ছুঁচ পড়লেও কুড়িয়ে নেওয়া সহজ।

উমা দু-চারটে কথা বলছিল এতক্ষণ, এবার চুপ করে গেল। রতিকান্ত একেবারেই অন্য মানুষ। কথা তো বলছেই না, উমার দিকে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না। ট্রলির চাকায় সেই সুন্দর একটানা শব্দ। ফাল্গুনের দক্ষিণ হাওয়াটা দিচ্ছে। কি যে সুন্দর গন্ধ।

রতিকান্ত কথা বলছিল না। কিন্তু ভাবছিল। ভাবছিল হঠাৎ এ কী হয়ে গেল তার? কেন হল! এমনিই হয় নাকি!

বিনুকে বারবার জোর করে মনের সামনে টেনে আনছে রতিকান্ত। এ যেন ঝুটো কি আসলের বিচার। এতকাল—চারটে বছর—বিনু কি ঝুটো ছিল? আবিষ্কার করার কারণটা আজই ঘটল রতিকান্তর। আজকের সকাল দুপুর বিকেলের অভিজ্ঞতার পর।

বিনু যে ঝুটো—এ-কথাটা রতিকান্ত নানাভাবে ভেবেও স্থির করতে পারছেনা। প্রথমত তাকে স্ত্রী হিসেবে না ধরে একটি মেয়ে হিসেবেই ধরা যাক। পুরুষের চোখে খারাপ লাগবে এমন মেয়ে বিনু নয়। এ-কথা ঠিক, বিনু ডানাকাটা পরী নয়। কিন্তু এও তো ঠিক, বিনু কুৎসিত নয়। বিনুর রঙ ফরসা, উমার মতনই প্রায়। বিনুর মুখের গড়ন ভালো; উমার চেয়েও ভালো। বিনুর ঠোঁট দুটি সুন্দর, অসম্ভব সুন্দর। তার চুল আরো কালো। দেহের গড়নে খুঁত যেসব আছে—সেসব খুঁত সকলের থাকে, লক্ষতে একটি দুটি বাদে। উমার চেয়ে বিনু রূপের বিচারে হীন নয়, বরং ভালো। আর তাই তো রতিকান্তর বিয়েটা বিনুর সঙ্গেই হল। দিদি দেখে, বিনুকেই সেরা ভেবেছিলেন।

রতিকান্ত এরপর বিনুকে স্ত্রী হিসেবে যাচাই করতে লাগল। ভালো লাগে না, এমন স্ত্রী তো বিনু নয়। যা চায় মানুষ স্ত্রীর কাছে—যেসব সহজ, সাধারণ প্রত্যাশা—বিনু তার কোনোটাই মেটাতে পারে না এমন নয়। বিনু ভালো ঘরণী। স্বামীর জন্যে, সংসারের জন্যে তার দিনরাত্তির এক হয়ে গেছে। যদি বল সেবা, বিনু আর দশটা বাঙালী ঘরের মেয়ের মতন সেবাময়ী। তার মন নরম, কোমলতায় স্নিগ্ধ। স্বামীর পান চুন হাতে হাতে যোগায়। রুমাল, গেঞ্জি, মোজা কাচে। আবার সর্দি হলে তেল মালিশ করে দেয়।

বিনু আমায় ভালোবাসে। আমি বিনুকে ভালোবাসি। ভালোবাসি আমার মেয়েকে। আমার সংসারকে। রতিকান্ত মনে মনে কথাটা বলে ফেলে অনেকটা স্বস্তি পেল।

কিন্তু? রতিকান্ত এতক্ষণ পরে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে উমাকে দেখল। উমা ভাবুকের মতন গালে হাত দিয়ে দিগন্ত-ধোয়া জ্যোৎস্নার দিকে চেয়ে রয়েছে। ফাল্গুনের হাওয়ায় তার এলোমেলো চুল আরো আলুথালু হয়ে যাচ্ছে।

উমাকেও যেন বড়ো ভালো লাগছে। রতিকান্ত পুরনো কথাটা আবার মনে টেনে আনল। মনে হচ্ছে, এইভাবে যদি ট্রলিটা রাতের পর রাত জ্যোৎস্না-ডোবা মাঠঘাটের মধ্যে লাইন দিয়ে ছুটে যায়—রতিকান্তর ইচ্ছে হবে না, ওটা থামুক; রাত শেষ হোক।

কিন্তু এ-কল্পনার অর্থ হয় না। রাত ফুরোবে। চাঁদ ডুববে। ট্রলিও থামবে। তার চেয়ে বাস্তব একটা কল্পনা করা যাক। উমা যদি এখানে থেকে যায়, তার কাছে। যদি এমনি মাঝে মাঝে ওরা দুটিতে ফাঁকায় বেড়াতে বেরয়। সেটা তো অসম্ভব নয়। তখন কি ভালো লাগবে না উমাকে? লাগবে, লাগবে, লাগবে।

রতিকান্তর মনে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি জুড়ে বসছিল। বেশ বুঝতে পারল রতিকান্ত, উমাকে তার ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। একটা পঁয়ত্রিশ বছরের পুরুষ বাইশ বছরের এক মেয়েকে যেমন করে ভালোবাসতে চায়, যেমনভাবে।

….আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে—এদের ভালোবাসার পরও আমি কী করে উমাকে ভালোবাসতে পারি? এটা সম্ভব নয়।…

সম্ভব যে কেন নয়, রতিকান্ত ভেবে ভেবেও তার কোনো সুসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। যেসব কারণ সকলেই জানে, রতিকান্তও—তারও, বাস্তবিক তার কোনো কিছুরই মাথামুণ্ডু রতিকান্ত বুঝতে পারছে না এখন।

ইচ্ছে করাটা এক, আর ইচ্ছে করতে নিষেধ করাটা অন্য জিনিস। ইচ্ছেটা মনের, নিষেধটা অন্যের।

ভালোবাসার এই ইচ্ছের সঙ্গে কি আর কিছু নেই? কিচ্ছু না? রতিকান্ত মাথার চুলগুলো আঙুল দিয়ে টেনে টেনে স্নায়ুগুলোকে একটু পরিষ্কার করতে লাগল।

কিন্তু কিচ্ছুই হল না। রতিকান্ত অনুভব করতে পারল, তার আবার নতুন করে ত্রিশের আগে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। যখন তার বিয়ে হয়নি, যখন যেকোনো মেয়েকে ভালোবাসা যেতে পারত, অন্তত সেটুকু নিষ্কলুষ স্বাধীনতা তার ছিল।

…এখন আমার আর সে-স্বাধীনতা নেই। ইচ্ছে থাকলেও। মন চাইলেও। ভালোবাসার জন্যে মন কাঁদলেও।…

কেন?

কেনর জবাবটা রতিকান্ত জানে না। অথচ বিনুকে জানে, এবং কেনর কথায় বিনু, বিনুর মেয়ে আসে। তারা আসবেই। রতিকান্ত তাদের সরাতেও চায় না।

ট্রলিটা প্রায় রতিকান্তদের স্টেশনটার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তেমনি খই ছড়ানো জ্যোৎস্না, দক্ষিণের হাওয়া, উমার লাবণ্যভরা মুখ।

রতিকান্তর মনে হঠাৎ অন্য একটা কথা কিভাবে যেন এসে যায়। ঢেউয়ের একটা ধাক্কার মতন। আর কথাটা ভাবতে গিয়ে নিজেকেই তার পাগল মনে হয়।

তবু কথাটা না ভেবেও পারে না রতিকান্ত। তার মনে হয়, ভালোবাসাটা একটা গুণ। কোয়ালিটি। নিজের মনের কাছে নিজের মুখ রেখেই রতিকান্ত তার এই সহসা-আবেগ প্রকাশ করে ফেলে। যেমন দয়া, যেমন সততা—রতিকান্ত বলছিল এবং বেদনা অনুভব করছিল, তেমনি, আমার আমাদের এ-ভালোবাসা, এই ভালোবাসার ইচ্ছাটা একটা গুণ। আমাকে—আমাদের এই ভালোবাসাকে সংখ্যায় বেঁধে ফেলতে বলছ। বেশ তো বাঁধছি। আমার স্ত্রীকেই আমি ভালোবাসব; একটি শুধু মেয়েকে। কিন্তু ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে উমাকে—এই ইচ্ছেকে তুমি নষ্ট করে দিতে চাও। পারবে? পারবে না।

একটা শব্দ উঠছিল। ট্রলি ইয়ার্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। স্টেশন এসে গেল।

ট্রলি থেকে নামবার সময় উমা হঠাৎ বলল, “ও জামাইবাবু, আমি কি এমনিভাবে পুঁটলি বেঁধে রাস্তা দিয়ে যাব নাকি? ফুলগুলো আপনি নিন।” উমা আঁচল খুলে ধরল।

রতিকান্ত থমকে চেয়ে থাকল একটু। টকটকে রোদে পলাশগুলো কত লাল ছিল, আর এখন চাঁদের এমন আলোতেও যেন সেই লাল মরে ক্ষয়ে কোন পাংশু রঙের হয়ে গেছে।

“তাই দাও।” রতিকান্ত ম্লান হাসি হেসে বলল, “ওগুলো এখন আমার হাতেই ভালো মানাবে।” ফুলগুলো তুলে রুমালে বাঁধতে লাগল ও।

“মানে?” উমা তাকাল।

“মানে আর কী, ওদের অবস্থা এখন আমারই মতন।”

উমা জামাইবাবুর মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে তারপর বলল, “ছি, ও-কথা বলবেন না। বলতে নেই।”

উমার চোখে বড় সুন্দর একটু হাসি ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *