লাস্ট ট্রেন

লাস্ট ট্রেন

মনে হচ্ছে, আজ আমার জন্য খুব বড় ধরনের বিপদ অপেক্ষা করে আছে। ধানখেতের মধ্যে সারারাত আমাকে বসে থাকতে হবে। ফোন করে যে পর্ণাকে একটা খবর দেব সে পথও বন্ধ। বিকেলেই আমার মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গেছে। ট্রেন ধরার আগে। লোকাল ট্রেনে চার্জ দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা থাকে না। যদিও পর্ণা এসব শুনবে না। বিয়ের রাতেই সে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল, আগামী দু’বছর রাগ হলে সে কোনওরকম যুক্তি বুদ্ধির ধার দিয়ে যাবে না। পুরো তিন দিন আমার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখবে। এই তিন দিন আমি যেন তাকে কোনওভাবে বিরক্ত না করি। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘ওরে বাবা, দু’বছর! অতদিন কেন?’

পর্ণা গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘ম্যাক্সিমাম বছর দেড়েক স্বামীদের প্রতি বিশ্বাস থাকে। আমি আরও ছ’মাস বাড়িয়ে রাখলাম। তারপর আর বিশ্বাস থাকে না। বিশ্বাস না থাকলে রাগ টাগেরও কোনও কারণ নেই।’

আমি ভেবেছিলাম পর্ণাকে জিজ্ঞেস করব, এই উদ্ভট তত্ত্বটি সে কোথা থেকে পেল? কিন্তু সাহস পাইনি। ফট করে যদি রেগে যায়।

আমাদের বিয়ের দু’বছর এখনও হয়নি। দেড় মাস বাকি আছে। ফলে পর্ণাও তার সিস্টেম বজায় রেখেছে। রাগ হলে স্কুলের মেয়েদের মতো কথা বন্ধ করে দেয়, আর সেই

তিন দিন আমি একটা দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়ি।

তবে শুধু তো কথা বন্ধের জন্য নয়, আমি আজ না ফিরলে বেচারি খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়বে।

খানিক আগে পর্যন্ত ভেবেছিলাম ঝড়-বৃষ্টি দুটোই কমে আসবে। বৃষ্টিটা একটু ধরেও এসেছিল। আবার নতুন করে নেমেছে। সেই সঙ্গে হাওয়াও দিচ্ছে খুব। নিশ্চয় বড় কোনও দুর্যোগ শুরু হয়েছে। এই যে নিম্নচাপ না কী যেন বলে। টানা তিন-চার দিন এই অবস্থা চলবে। আমার নার্ভাস লাগছে।

ট্রেন শেষ পর্যন্ত পৌঁছোবে তো? নাকি মাঝপথেই কোথাও আটকে যাবে? ওভারহেডের তার ছিঁড়লে বা লাইনের ওপর গাছ পড়লে রেহাই নেই। তার ওপর জল জমার ব্যাপার আছে। গত বর্ষায় মুম্বইতে আমার ছোটমামার এই কাণ্ড হয়েছিল। ছোটমামা আসছিল থানে থেকে। বৃষ্টিতে লাইনে জল জমে ট্রেন গেল আটকে। পুরো দেড় দিন গাড়িভরতি মানুষ বসে ছিল ট্রেনের ভেতর। খাবারদাবার, বাথরুম কিছু নেই। ট্রেন থেকে নেমে যে জল ভেঙে হাঁটবে সে পথও বন্ধ। গুজব ছড়িয়েছিল, একজন নাকি ছেঁড়া ইলেকট্রিক তারে কারেন্ট খেয়ে মারা গেছে। এরপর আর কেউ নামে? এমনিতে ছোটমামার কথা আমার একেবারেই মনে পড়ে না। আজ বারবার পড়ছে। মানুষের মনের এই একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। বিপদের সময় বিপদের গল্প বেশি বেশি করে মনে পড়ে। অথচ ভাল সময়ে ভাল কিছু মনে পড়বে না। কথা বন্ধের মতো পর্ণার আরও ছেলেমানুষি আছে। কোনও কোনও রাতে বিছানায় শুয়ে সে আমার সঙ্গে গল্প করতে চায়। বলে, খানিকক্ষণ গল্প না করলে কিছুতেই আমাকে তার গায়ে হাত দিতে দেবে না। তাও আবার হাবিজাবি অফিসের গল্প করলে চলবে না। ইন্টারেস্টিং বিষয় নিয়ে গল্প করতে হবে। কী ভয়ংকর। আমি পড়ি সাত হাত জলে। ঠিক ওই সময়টাতেই আমার কোনও ইন্টারেস্টিং বিষয় মনে আসে না। আমি আঁতিপাঁতি করে গল্প মনে করবার চেষ্টা করি। পর্ণা পাশ ফিরে শুতে শুতে বলে, ‘আমি এখন ঘুমোলাম। গল্প মনে পড়লে ডেকে তুলবে, আমি শুনব।’

না, লাস্ট ট্রেন ধরাটা ঠিক হয়নি। অবশ্য ঝড়-বৃষ্টির আর লাস্ট ফার্স্ট কী? যখন গাড়িতে উঠেছি তখন আকাশের অবস্থা এরকম ছিল না। শুধু শিরশিরে একটা হাওয়া দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে হালকা হালকা বিদ্যুৎ। সারাদিন গুমোট গরমে ছোটাছুটি করে কাজ করেছি, ঠান্ডা হাওয়া বেশ লাগছিল। সেই হাওয়া যে এমন ভয়ংকর চেহারা নেবে কে জানত?

ট্রেন স্পিড কমিয়ে দিয়েছে। একটু বেশি দুলছেও। ঝড়ের জন্য দুলছে নাকি? সিটের পিছনটা চেপে ধরলাম। ঘটনাটা শুনে মনে হচ্ছে, জীবনে এই প্রথম ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনে উঠেছি। মোটেও তা নয়। আড়াই বছর চাকরিতে জয়েন করেছি। সেলসের কাজ। সেদিক থেকে চাকরি এখনও নতুন। টার্গেট সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাই। মারাত্মক ছোটাছুটি করতে হয়। হাড়কাঁপানো শীত, পিচগলা গরম, তুমুল বৃষ্টি— সব সময়েই ঘুরে বেড়াই। তবে সেগুলোর কোনওটাই আজকের মতো ভয়ংকর ছিল বলে মনে পড়ছে না। আজ দূরের এক মফস্‌সল শহরে কাজ সেরে ফিরছি। পর্ণার জন্য তিন দিনের কাজ দু’দিনে করেছি এবং খুব স্বাভাবিক কারণে টার্গেট ফেল হয়েছে। আরও হাফবেলা অন্তত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু উপায় কী? পর্ণাকে কথা দিয়েছি আজ ফিরব। যত রাতই হোক ফিরে একসঙ্গে ডিনার করব। পর্ণা জেগে থাকবে। শুধু জেগে থাকবে না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটার এই আর এক খারাপ অভ্যেস। আমার ফেরার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। বারণ করলেও শোনে না। আমাদের বারান্দাটা আবার খোলা। একবার ঠায় আড়াই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছিল বেচারি। আমি মোবাইলে তাকে কত বলেছিলাম ‘লক্ষ্মীটি, এরকম করে না, তুমি ঘরে যাও। আমি মিটিং-এ আটকে পড়েছি। মুম্বই থেকে বস এসেছে।’ কে শোনে কার কথা? সুন্দরী মেয়েরা জেদি টাইপের হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করা ঠিক হয়নি। আজ যদি সারারাত না ফিরি তা হলে আমি নিশ্চিত পর্ণা সারারাতই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে। কী জ্বালাতন! এই কামরায় কারও কাছে কি মোবাইল আছে? অনুরোধ করলে একটা ফোন করতে দেবে?

আমার টেনশন বাড়ছে।

খানিক আগে সিট বদল করেছি। এদিকের জানলাগুলো ঠিকমতো বন্ধ করা যাচ্ছে না। সিট, মেঝে সব জলে ভেসে গেছে। আমার জামা প্যান্টেও ঝাপটা লেগেছে। খোলা জানলার ওপারে হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় দেখছিলাম অন্ধকার ধানখেত আর মাঠ জুড়ে বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়ার দাপটে সাদা পরদার সেই বৃষ্টির পরদার মতো দুলছে। লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভুতুড়ে গাছগুলো তেড়ে তেড়ে আসছে। ডালপালা নাড়ছে তো না, যেন হাত পা দাপাচ্ছে! কে জানে অন্য সময় হলে এই দৃশ্য হয়তো ভাল লাগত। আজ ভয় ভয়ও করছে। এদিকে অবশ্য দু’পাশের জানলাই বন্ধ। ফলে ঝড়ের দাপাদাপি দেখতে হচ্ছে না। বিয়ের আগে শুনেছিলাম বড়, টানা টানা চোখের মেয়েরা বৃষ্টি ভালবাসে। কুশলের বউ ওরকম। বৃষ্টি-পাগল মেয়ে। আমার পর্ণার চোখও বড় আর টানা টানা, কিন্তু সে একেবারেই বৃষ্টি পছন্দ করে না। তার মতে বৃষ্টি মানেই জল-কাদা, জামাকাপড় স্যাঁতসেঁতে, সর্দি কাশির সময়। তার পছন্দ ঝলমলে রোদ। গোটা আষাঢ়-শ্রাবণ মাস দুটো ধরে পর্ণা মুখ বেজার করে থাকে। যেন আকাশে নয়, তার মুখেই মেঘ জমেছে। প্রথম প্রথম একটু দুঃখ পেয়েছিলাম। কারণ বৃষ্টি ছিল আমার ফেভারিট। পরে দেখলাম পর্ণাকে আমার হাসিমুখেও যেমন ভাল লাগে, বেজার মুখেও ভাল লাগে। মজার কথা হল, ওর সঙ্গে থাকতে থাকতে আজকাল আমিও বৃষ্টি অপছন্দ করতে শুরু করেছি।

গোটা কামরাটা ফাঁকা। এমনিতেই লাস্ট ট্রেনে প্যাসেঞ্জার কম হয়। আজ মনে হচ্ছে আরও কম। হাতে গোনা দু’-পাঁচজন মাত্র। তারাও এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে যে কাউকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিন ট্রেনের ভিড় অসহ্য লাগে। আজ মনে হচ্ছে, ভিড় থাকলে ভাল হত। চেঁচামেচি, হই-হট্টগোল, তাস খেলা দেখতে দেখতে সময় কাটত। ব্যাগ থেকে অফিসের কাগজপত্র বের করে উলটোলে কেমন হয়? সেলস টার্গেট ফেল করার ধাক্কা আগামী মাসে কীভাবে সামলাব তা নিয়ে কিছুটা অন্যমনস্ক থাকা যেত। কিন্তু সে উপায় নেই। এদিকটায় যেমন জলের ছাট কম, তেমন আলোও কম। মাথার ওপর পরপর দুটো বাল্‌ব জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু দুটোর অবস্থাই শোচনীয়। লোহার জালির মধ্যে ঝুলকালি মেখে টিমটিম করছে। এই আলোয় কিছু পড়া অসম্ভব। আমি চোখ নামালাম।

আর তখনই উলটোদিকে বসা মানুষটাকে দেখতে পাই।

লম্বা সিটের এককোনায় ভদ্রলোক বসে আছেন চোখ বুজে। মনে হচ্ছে, ঝিমোচ্ছেন। ঝিমোনোর মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত ভাব। আশচর্য! এত ঝড়-জলে এরকম নিশ্চিন্তে কেউ ঘুমোতে পারে? মনে হচ্ছে, বাইরে কী হচ্ছে জানেই না। অথবা জানলেও পাত্তা না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমোনোর জন্য অন্ধকার দিকটা বেছে নিয়েছেন। ভদ্রলোকের গায়ে ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবি। চোখে পুরনো ধরণের মোটা লো ফ্রেমের চশমা। চশমা নাকের ওপর ঝুলে পড়েছে। বুকপকেটে পেন। পাশে একটা ব্যাগও রয়েছে। ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগটাও বেশ পরিষ্কার। ভদ্রলোকের বয়স কত? বুঝতে পারছি না। চুয়ান্ন পঞ্চান্নর নীচে নয়। ঘাড়টা ডান দিকে সামান্য হেলে আছে। ট্রেনের দুলুনিতে একটু একটু কাঁপছে। আমার হিংসে হচ্ছে। আহা। আমিও যদি এমন করে ঘুমোতে পারতাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পর্ণাকে স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম, আমি আর পর্ণা টেবিলে খেতে বসেছি। বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ার অপরাধে নিয়ম অনুযায়ী সে আমাকে শাস্তি দিয়েছে। কথা বলছে না। ইশারায় আমাকে আরও একটা রুটি নেওয়ার জন্য ধমক দিচ্ছে। ইশারায় প্রেম করা যায় জানতাম, ধমকও যে দেওয়া যায় পর্ণাকে বিয়ে না করলে জানতাম না। ইশারা ইঙ্গিতে পর্ণা আমাকে ভারী সুন্দর ধমক দিতে পারে। মুখে কিছু বলি না, কিন্তু মুগ্ধ হয়ে যাই।

আচ্ছা, এই ঘুমন্ত ভদ্রলোকও কি কলকাতা যাচ্ছেন? গেলে ভাল। একজন সঙ্গী পাওয়া যাবে। ঘুমন্ত সঙ্গী।

ট্রেন থমকে দাঁড়াতে বুকটা ধড়াস করে উঠল। ছাদ থেকে ঝরঝর করে জল পড়ার আওয়াজ পাচ্ছি। স্টেশন না ধানখেত? ধানখেতই হবে। উঠে একবার দেখলে হয়।

আমি ওঠবার আগেই উলটোদিকের ভদ্রলোক চোখ খুলে ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসলেন। নাকের ওপর ঝুলে পড়া চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে তুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আনন্দপুর এল, না?’

ভদ্রলোকের জেগে ওঠা এবং কথা বলায় আমি উৎসাহ পেলাম। বিনয়ী গলায় বললাম, ‘ঠিক জানি না। এই লাইনে আমার যাতায়াত নেই।’

ভদ্রলোক হাতের কবজি উলটে ঘড়ি দেখলেন। বললেন, ‘আনন্দপুরই হবে।’

যারা এক পথে রোজ যাতায়াত করে তাদের জানলা দিয়ে স্টেশনের নাম দেখতে হয় না। সময় দেখেই বলে দিতে পারে ট্রেন কোথায় এসেছে। তাদের হাতের ঘড়িতেই স্টেশনের নাম ফুটে ওঠে। তবে আজ গাড়ি সময় মেনে চলছে না। ভদ্রলোক ভুল বলছেন।

আমি নার্ভাস গলায় বললাম, ‘মনে হয় মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়েছে।’

ভদ্রলোক হাতদুটো মাথার ওপর তুলে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে থমকে গেলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘মাঝপথে! কেন? মাঝপথে দাঁড়াবে কেন?’

‘যা ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ি লেট করছে।’

ভদ্রলোক হেসে ফেললেন। বললেন, ‘না না, গাড়ি রাইট টাইমে যাচ্ছে।’ বলতে বলতে সরে গিয়ে ভদ্রলোক জানলার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। যেন স্টেশন দেখিয়ে আমাকে হাতেকলমে আশ্বস্ত করতে চাইছেন। তবে দু’হাতে জানলাটা একটু খুলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। চলন্ত জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, নির্জন, ভেজা একটা প্ল্যাটফর্ম হুসহাস করে পার হয়ে যাচ্ছি। জানলার গা বেয়ে ঝপঝপ করে জল পড়ছে। ভেজা স্টেশনে জলে মুছে যাওয়া ধরনের আলোর তলায় ছাতা মাথায় একজন দাঁড়িয়ে। লোকটার পিছনে হলুদ বোর্ড। এক ঝলকের জন্য পড়তে পারলাম, তাতে লেখা— আনন্দপুর।

ট্রেন স্পিড বাড়াল।

ভদ্রলোক আবার জানলা তুলে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। আমি খুব খুশি হলাম। আলাপ করার ঢঙে বললাম, ‘ঝড় কমেছে। বাপ রে যা শুরু হয়েছিল।’

ভদ্রলোক ঠোঁটের ফাঁকে আবার মুচকি হাসলেন। বাঃ, মানুষটা বেশ হাসিখুশি ধরনের তো! মনে হয় আমার নার্ভাস ভাব দেখে মজা পেয়েছেন। অন্য সময় হলে রাগ হত। এখন হচ্ছে না। উনি তো ঠিকই বলেছেন! গাড়ি ঠিক সময় চলছে। না দেখেই স্টেশনের নাম বলে দিলেন। বাকি পথটা যদি ঠিকমতো চলে তা হলে হাওড়া আর বেশিক্ষণ নয়। পর্ণাকেও বারান্দায় দাঁড়াতে হবে না। সে আমার সঙ্গে কথাও বন্ধ করবে না। দু’দিন পরে বাড়ি ফিরে বউয়ের সঙ্গে ইশারায় ভাব-ভালবাসা চালাতে হলে খুব বাজে হত। এখন মনে হচ্ছে, আমার এতটা টেনশন করা বাড়াবাড়িই হচ্ছিল। মনটা এক ঝটকায় অনেকখানি হালকা হয়ে গেছে। এই ভদ্রলোকই নিশ্চিন্ত করে দিয়েছেন। মুচকি হাসি কেন, মানুষটা যদি এখন গালে একটা চড়ও দেয় আমি কিছু মনে করব না। বয়সে তো আমার থেকে বেশ কিছুটা বড়ই, ভদ্রলোকের চেহারাতেও একটা মাস্টার মাস্টার ভাব আছে। চড়ে ক্ষতি নেই। মুখ হাসিহাসি রেখেই পাশে রাখা ঝোলাটা থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বের করলেন ভদ্রলোক। রুপোলি কৌটোর ঢাকনা খুলে দু’আঙুলে তুলে কিছু একটা মুখে দিলেন। ঢাকনা বন্ধ করতে গিয়ে মুখ তুলে আমার দিকে ভুরু তুলে বললেন, ‘খাবেন? মশলা।’

ট্রেনে অচেনা কারও কাছ থেকে কিছু খাওয়া ঠিক নয়। তবে এই ভদ্রলোকের বেলায় এই সাবধানতার কোনও মানে নেই। ইনি টেনশন দূর করে আমার উপকার করেছেন। বাকি পথটুকু বকবক করার লোভ সামলাতে পারছি না। হাত বাড়িয়ে মশলা নিয়ে মুখে দিলাম। মশলাজাতীয় জিনিস আমি একেবারেই পছন্দ করি না, পর্ণা করে। বিয়েবাড়ি বা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেই এক খাবলা তুলে মুখে দেয়।

আমি মিথ্যে করে বললাম, ‘বাঃ, চমৎকার মশলা তো। সুন্দর গন্ধ।’

ভদ্রলোক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্যি সুন্দর?’

আমি স্মার্ট সাজার চেষ্টা করে হাসলাম। বললাম, ‘মিথ্যে বলব কেন?’

ভদ্রলোক কৌটোটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তা হলে এটা রাখুন।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না না, এই তো খেলাম।’

ভদ্রলোক সহজভাবে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? আবার খাবেন। নিন ধরুন। বাড়িতে নিয়ে যান। আমার কাছে আরও আছে।’

ভদ্রলোক যেভাবে হাত এগিয়ে দিয়েছেন তাতে প্রত্যাখ্যান করা খারাপ দেখায়। আমি দ্রুত ভেবে নিলাম, অসুবিধে কী? নিয়ে নিই। মশলার কৌটো উপহার নিয়ে বাকি পথটুকু যদি ঘনিষ্ঠ থাকা যায় ভালই তো। আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে হাত বাড়িয়ে কৌটোটা নিয়ে ফেললাম। শার্টের পকেটে রাখতে রাখতে লাজুক হেসে বললাম, ধন্যবাদ, আমার স্ত্রী মশলা খুব ভালবাসেন।’

ভদ্রলোক ছোট একটা হাই তুলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমার স্ত্রীও ভালবাসতেন।’

পর্ণার সঙ্গে মিল শুনে আমি খুশি হলাম। নতুন নতুন বিয়ের এই একটা সুন্দর ব্যাপার।

ছুতোনাতায় বউয়ের কথা মনে পড়লেই ভাল লাগে। তরল গলায় বললাম, ‘উনি এখন ভালবাসেন না?’

“ঠিক জানি না। আমি এখনকার খবর বলতে পারব না।’

এখনকার খবর বলতে পারব না! কথাটার মানে কী? স্ত্রী কি ভদ্রলোকের সঙ্গে আর থাকেন না? সম্পর্ক নেই? ডিভোর্স?

ভদ্রলোক নিজেই উত্তর দিলেন। ঠোঁটের কোনায় মৃদু হেসে বললেন, ‘সে এখন তো আমার সঙ্গে থাকে না, তাই বলতে পারব না।’

একটু অস্বস্তি হল। আমি বললাম, ‘ও।’

ভদ্রলোক কথা বন্ধ করে আপনমনে গুনগুন করে একটা গানের মতো কী করতে লাগলেন। যেন স্ত্রী সঙ্গে না থাকাটা তাঁর কাছে এখন আর কোনও ব্যাপার নয়। আমি প্রসঙ্গ পালটাতে বললাম, “আসলে কী জানেন, ঝড়-বৃষ্টিতে টেনশন হয়ে গিয়েছিল। যদি না কমে।’

গান থামিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘বয়স কম, টেনশন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। খোলা ট্রেনে সব সময়েই বৃষ্টি বেশি মনে হয়। তার ওপর দু’পাশে মাঠঘাট, খেত, গাছপালা। সবটা জুড়েই বৃষ্টি দেখা যায়। পরিমাণে মনে হয় অনেক। সেই সঙ্গে রাতও হয়েছে; সব মিলিয়ে আপনার মনে হচ্ছিল, বড় কোনও দুর্যোগ চলছে। তাই তো?’

কথা শেষ করে ভদ্রলোক সুন্দর করে হাসলেন।

চমৎকার যুক্তি। আলাপী, হাস্যমুখের মানুষটাকে এতক্ষণ নিজের ভয় ভাঙানোর জন্য পছন্দ করছিলাম, এখন সত্যি সত্যি পছন্দ করে বসলাম। মানুষটা মিশুকেও। একটু মিশুকে নয়, অতিরিক্ত মিশুকে। নইলে সামান্য আলাপে কেউ মশলার কৌটো প্রেজেন্ট করে বসে? ভদ্রলোক পুরো পথটা সঙ্গে থাকলে বাঁচি। কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। আমি অন্তরঙ্গ হওয়ার কায়দায় বললাম, ‘আসলে বাড়িতে অপেক্ষা করে থাকবে। আটকে গেলে মুশকিল।’

ভদ্রলোক আরাম করে বসে ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের আঙুলগুলো মটকাতে থাকলেন। পুরনো দিনের অভ্যাস। আজকাল আর কাউকে খুব একটা আঙুল মটকাতে দেখা যায় না।

‘সে তো দেখেই বুঝতে পারছি। অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করছ। তুমি বলছি ভাই, বয়সে ছোট। তা ছাড়া স্কুল মাস্টারি করে আপনি, আজ্ঞে ভুলে গেছি। কিছু মনে করলে না তো?’

আমি আগ্রহ নিয়ে হেসে বললাম, ‘ছি ছি, মনে করব কেন?’

‘বাড়িতে বউ চিন্তা করছে? ছটফটানি দেখে মনে হচ্ছে হয়েছে।’

একেই সহজ সরল মানুষ বলে। নিশ্চয় কলকাতার বাইরে থাকেন। কলকাতায় থাকলে চট করে কেউ এই প্রশ্ন করতে পারত না। ভদ্রতায় লাগত। আমি লাজুক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লাম।

‘বিয়ে বেশিদিন হয়নি। আমার স্ত্রী পর্ণা আবার অল্পেই চিন্তা করে বসে। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত জেগে থাকবে।’

ভদ্রলোক এবার যেন নিজের মনেই হাসলেন। গায়ের পাঞ্জাবিটা হাত দিয়ে টেনেটুনে ঠিক করলেন। ভদ্রলোক খানিকটা শৌখিন প্রকৃতির। এই ঝড়-জলেও ধুতি পাঞ্জাবিতে একফোঁটা কাদা লাগাতে দেননি।

‘স্বাভাবিক, বিয়ের পরপর এটাই স্বাভাবিক। আমার উনিও একই কাণ্ড করতেন। আমার স্কুল তোমার ঘণ্টা আড়াইয়ের ট্রেন জার্নি। তখন আবার ক’টা টিউশন করতাম। তার ওপর ট্রেনের গোলমাল ছিল, চেনাজানাদের সঙ্গে স্টেশনে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া ছিল। কোনও কোনও দিন বন্ধুরা টানাটানি করলে তাসের আড়াতেও বসে যেতাম। সেসব সামলে বাড়ি ফিরতে দেরি হত। গিয়ে দেখতাম সে বেচারি ঠায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বোঝো কাণ্ড!’

বারান্দায়! আমি চমকে উঠলাম। আরে, এ তো একেবারে পর্ণার মতো! সব নতুন বউই এরকম করে নাকি? বারান্দায় দাড়িয়ে অপেক্ষা করে? আমার যেসব বন্ধুবান্ধব আগে বিয়ে করেছে তারা নিজেদের দাম্পত্য সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতার কথাই আমাকে জানিয়েছে। না জানতে চাইলে জোর করে জানিয়েছে। সেগুলো সবই শিক্ষামূলক। রাতের শিক্ষা। আমাদের অফিসের মানসদা নাকি রবিবার দুপুরেও ‘ওস্তাদ’। অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল, ‘মানসদার কাছে একবার এক্সপিরিয়েন্স শুনে এসো ভায়া। ছুটিছাটার দিনে কাজে লাগবে। আমি শুনেছিলাম, তবে লাভ হয়নি। পর্ণা দিনের বেলায় কিছুতেই রাজি হয় না। ওর নাকি লজ্জা করে। কী ঝামেলা! বিয়ের দু’বছর হতে চলল এখনও লজ্জা! কে যেন বলেছিল, যাদের মাথায় একটাল চুল থাকে তারা নানা ধরনের ঝামেলা পাকানোর এক নম্বর হয়। পর্ণারও তাই। অনেক রবিবার দুপুরেই হতাশ মনে ভাবি, এক ঢালের চুলের মেয়েকে বিয়ে করাটা একেবারেই উচিত হয়নি। বিরাট বোকামি হয়েছে।

ট্রেন দাঁড়াল। মিনিট খানেকের জন্য। জল পড়ার আওয়াজ পাচ্ছি না। বৃষ্টি কি থামল? ভদ্রলোক মনে হয় আমার মনের কথা বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘বৃষ্টি ধরে এসেছে। চিন্তা কোরো না, ঠিক সময় পৌঁছে যাবে। আমার গিন্নির বুঝলে আরও একটা মজার স্বভাব ছিল।’

ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর কথা বলতে ভালবাসছেন। আমার নাম কী? কী কাজ করি? দেশের ভবিষ্যৎ কেমন? রাজনীতি কতটা গোল্লায় গেছে। আবহাওয়ার পাগলামি কেন বেড়েছে? এই ধরনের কমন টপিক ছেড়ে শুধু স্ত্রীর কথা বলছেন। কেন? ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বলে? তাই হবে। বয়স্ক মানুষরা পুরনো দিন, পুরনো সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে। আমার মজা লাগছে। আবার একটু খারাপও লাগছে। যতই হোক স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।

‘কী স্বভাব?’ আমি কৌতুহল দেখালাম।

‘বিয়ের প্রথম দিকে আমার ওপর রাগ হলে সে কোনও যুক্তির ধার ধারত না। একেবারে স্টপ টকিং তিন দিন কথা বন্ধ। তখন কোনও সাধাসাধি গায়ে মাখবে না। আমি পড়তাম জটিল সমস্যায়। সারাক্ষণ জামা পাচ্ছি না, ব্যাগ দাও, চশমা কোথায়? খিদে পেয়েছে— দেয়ালের সঙ্গে কথা বলতে হত।’

কথা শেষ করে নিঃশব্দে দুলে দুলে হাসতে লাগলো ভদ্রলোক। নিমেষের জন্য আমার শরীরটা যেন অবশ হয়ে গেল। ভদ্রলোক বলছেন কী! রাগ করলে স্ত্রী কথা বলত না। তাও আবার ঠিক তিন দিন। এ তো একেবারে বসানো পর্ণা! মশলা ভালবাসে, স্বামীর জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, রাগ করলে কথা বন্ধ করে দেয়। নড়েচেড়ে বসে নিজেকে দ্রুত বোঝানোর চেষ্টা করলাম— দু’জন বিবাহিত মহিলার আচরণ তো একই রকম হতেই পারে। এতে অবাক হচ্ছি কেন! রাগ-অনুরাগ দেখানোর ব্যাপারগুলো কাছাকাছি হলে অসুবিধা কোথায়? নিজেকে সামলে আমি আবার সহজ হতে চেষ্টা করলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক একটু ঝুঁকে পড়ে, চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকালেন। মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘বুঝলে ভায়া, সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করার অনেক হ্যাপা। তারা যেন জেদি হয়, ঝামেলাও করে বিস্তর। হুট বলতে চোখে জল এনে ফেলে। আমার স্ত্রীটি আবার ছিলেন বেশি রকমের সুন্দরী, বড় আর টানা টানা চোখ। কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল। গোড়ার দিকে রান্নাবান্নায় ছিল অষ্টরম্ভা। রোজই মন দিয়ে শুধু আলুরদম বানাত। গাদাখানেক ঝাল। আমি সেই ঝাল আলুরদম খেয়ে উস আস্‌ করতে করতে ন’টা বারোর গাড়ি ধরতে ছুটতাম। বেশ লাগত ভায়া।’

ছেলেমানুষের মতো হাসতে শুরু করল মানুষটা।

আমিও হাসতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। আমার শরীর মনে হচ্ছে কাঁপছে। বেশি নয়, খুব সামান্য। কিন্তু কাঁপছে। পর্ণাও রান্না পারে না। এই কারণে রান্নার একজন লোক রাখা হয়েছে। মাঝেমধ্যে সে শখ করে দু’-একটা আইটেম রাঁধে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোতে অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে ফেলে। দারুণ, দুর্দান্ত, ফ্যানটাস্টিক বলে সেই রান্না আমি খাই। আমার যে খুব খারাপ লাগে এমন নয়। বরং মনে হয়, যত্ন করে বেচারি আমার জন্য বেঁধেছে তো। এই ভদ্রলোকের ঘটনা দেখছি এক! পর্ণার সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর এত মিল!

না, আর আমার ভাল লাগছে না। আমার ভালবাসার মানুষের সঙ্গে আর একজনের এত খুঁটিনাটি মিল থাকবে কেন? এটা খুবই অস্বস্তিকর। মনে হচ্ছে পর্ণাই যেন ওঁর স্ত্রী। ভদ্রলোকের সঙ্গে তার স্ত্রীর পরিণতিটাও তো ভাল নয়। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। না, আমি আর এইসব গল্প শুনতে চাই না। কে জানে, এরপর হয়তো ভদ্রলোক বলবেন, তাঁর স্ত্রীর নামও পর্ণা। বাপ রে!

ভদ্রলোককে এবার কেমন জানি লাগছে। এইটুকু আলাপে হড়বড় করে এত স্ত্রীর গল্প শোনানোর কী আছে? একবার বলেছেন, ব্যস। সহজ সরল হওয়া ভাল, বেশি হওয়া ভাল নয়। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, এই ভদ্রলোকের সহকর্মী, পরিচিতরা আড়ালে হাসিঠাট্টা করে। সামনেও করতে পারে। সেই কারণে হয়তো যাকে পায় তাকে ধরেই বউয়ের গল্প শোনায়।

আমি কথা ঘোরানোর জন্য বললাম, ‘আমার এক মামা একবার বিপদে পড়েছিলেন। বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনে আটকে ছিলেন সারারাত। বিচ্ছিরি কাণ্ড। তবে এখানে নয়, মুম্বইতে।’

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে আমার দিকে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে রইলেন। কিছু একটা ভাবলেন। অন্যমনস্কভাবে বললেন, ‘এখানেও হতে পারে। বিপদ কখন হয়, তার কি কোনও ঠিক আছে? কোনও ঠিক নেই। বিপদে পড়লে ট্রেনে যেমন আটকে থাকতে হয়, তেমন দরকার হলে ট্রেন থেকে আগেভাগে নেমেও পড়তে হয়।’

কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘মানে!’

ভদ্রলোক একই রকম মুচকি হেসে বললেন, ‘কিছু নয়।’

একটা কিছু হেঁয়ালি রয়েছে। গল্পের মতো। নিশ্চয় এই এখানেও তাঁর স্ত্রী থাকবেন। আমি কিছুতেই শুনব না। বললাম, ‘আপনি কতদূর যাবেন? হাওড়া?’

ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে পাঞ্জাবির খুঁটে মুছতে মুছতে বললেন, ‘সেরকমই তো ইচ্ছে।’

এবার আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। ইচ্ছে মানে। এটাও কি হেঁয়ালি? নাকি ঠাট্টা? মানুষটা সম্পর্কে আমার ধারণা একটু একটু করে বদলাচ্ছে। গোড়াতে যেমন লাগছিল, এখন মনে হচ্ছে খানিকটা অস্বাভাবিক। আমি গলায় সামান্য কঠিনভাব এনে বললাম, ‘আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

বেশ কিছুক্ষণ আগেই ভদ্রলোক সিটের ওপর দুটো পা তুলে বাবু হয়ে বসেছেন। মিটিমিটি হেসে বললেন, ‘ওই যে বললাম না? বিপদে পড়লে যেমন তোমার মামার মতো আটকে থাকতে হয়, আবার দরকারে আগে নেমেও যেতে হয়।’

‘আপনি কি গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন? অ্যাক্সিডেন্ট?’ আমি বিরক্ত গলায় বললাম।

‘না, তা নয়।’

‘তবে? আমি ভুরু কোঁচকালাম।

ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। ট্রেন আবার দাঁড়াল। ভদ্রলোক ঘড়ি দেখলেন। মনে হয় স্টেশনের হিসেব কষলেন। কামরার ওদিক থেকে উঠে দু’জন নেমে গেল। এর আগের স্টেশনেও কয়েকজন নেমেছে। কামরায় আর কি কেউ আছে? নাকি শুধু আমরা দু’জন? না থাক। আর চিন্তা নেই। এসেই তো গেলাম। বাইরের ঝড়-জলও থেমে গেছে। খোলা দুটো দরজা দিয়ে শুধু ঠান্ডা হাওয়া আসছে।

ট্রেন ছেড়ে দিতে চুপ করে রইলাম। এবার ভদ্রলোকের সামনে থেকে উঠে গেলে কেমন হয়? বৃষ্টির ব্যাপার নেই। বাকি পথটুকু ওদিকে হাত পা ছড়িয়ে বসে থাকি। তবে ওঠবার জন্য একটা জুতো বের করা দরকার। বললাম, ‘চা পেলে হত।’

‘পেলে হত, কিন্তু এই বৃষ্টি-বাদলায় কে চা বেচবে? তা ছাড়া রাতও হয়েছে। বরং বাড়ি ফিরে বউকে বলবে আদা-চা করে দিতে। দু’জনে চা খেতে খেতে গল্প করবে।’

বিরক্তি অস্বস্তির মাঝখানেও মজা লাগল। বয়স হয়ে গেলে কী হবে, মানুষটার রসবোধ আছে। একটু মমতাও হল। আমি হেসে বললাম, ‘এত রাতে গল্প!’

ভদ্রলোক চশমার ভেতরে চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘তা নয় তো কী? বিয়ের প্রথমদিকের ক’বছর প্রতি রাতে স্ত্রীকে গল্প শোনাতে হত। একেবারে মাস্ট ছিল। নইলে…।’

ভদ্রলোক আওয়াজ করে হেসে উঠলেন। অপ্রকৃতিস্থের হাসি। আমার শরীর ঝনঝন করছে। গল্প শোনাতে হত। আমি কি ঠিক শুনছি? মনে হচ্ছে না ঠিক শুনছি। এ তো একেবারে পর্ণার ঘটনা! নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে বলে ফেললাম, ‘নইলে কী?’

ভদ্রলোক সিট থেকে পা নামালেন। নীচে রাখা জুতা পায়ে গলিয়ে নিচু হয়ে বেল্ট বাঁধলেন। ধুতির কোচাঁ ঠিক করতে করতে বললেন, ‘নইলে কী হত তুমি বুঝতে পারছ না? তোমার বয়েসেই তো আমার বিয়ে হয়েছিল বাপু।’

ভদ্রলোক পাশে পড়ে থাকা কাঁধে ব্যাগ তুলে ধুলো ঝাড়লেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ, কপাল, ঘাড় মুছলেন। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘বুঝলে হে ভায়া, গিন্নিটি আমার বড় জ্বালাতন করত। ছুটিছাটার দিনে দুপুরে আদর সোহাগ করতে গেলে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিত। দিনের আলোয় তার নাকি লজ্জা করে! বোঝো কাণ্ড। বিয়ের বছর দুই কোটি গেছে, তার পরেও স্বামীর কাছে লজ্জা! তবে তোমাকে চুপিচুপি বলছি, এই লজ্জাটুকু আমার কিন্তু মন্দ লাগত না। বেশ লাগত।’

ভদ্রলোক হাসতে লাগলেন।

আমার মনে হচ্ছে, আমি আর রক্ত-মাংসের মানুষ নেই। আমি একটা পাথরের স্ট্যাচু হয়ে গেছি। হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছি না। এমনকী চোখের পাতাও নয়।

ভদ্রলোক বঁধে ব্যাগটা তুললেন। দু’হাতে চশমাটা ঠিক করতে করতে ফিসফিস করে বললেন, ‘একদিন কী হল জানো?’

আমার ইচ্ছে করল ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে চিৎকার করে বলি, ‘আমি জানতে চাই না। আপনি চুপ করুন। প্লিজ চুপ করুন আপনি।’

গলা দিয়ে স্বর বেরোল না। আতঙ্কে কণ্ঠনালিও কি পাথর হয়ে গেল!

‘একদিন হঠাৎ দুম করে দু’পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হল। নেতা না কে মারা গেছে। অন্যদিন হলে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতাম। সেদিন কেন জানি আমার মনে হল, বাড়ি গিয়ে বউকে চমকে দিলে কেমন হয়? সে সময় তো এখনকার মতো মোবাইল-টোবাইলের ব্যাপার ছিল না। আগেভাগে খবর দেওয়ার উপায় ছিল না। দিতে চাইনি। আমি রিকশ নিয়ে ছুটলাম স্টেশন। কপালও ভাল ছিল। ট্রেনও পেয়ে গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। সাঁইসাঁই করে পৌঁছে গেলাম বাড়ি। বাড়ি বলতে ভাড়া বাড়ির একতলা। বাড়িওলা থাকে বাইরে। দরজার সামনে গিয়ে দেখি তালা ঝুলছে। আমি একটু অবাকই হলাম। মনে আছে সময়টা ছিল বৃষ্টি বাদলার। বড় বৃষ্টি নয়। ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। আমার উনি আবার বৃষ্টি সহ্য করতে পারেন না। জল-কাদায় নাক সিঁটকোয়। তার পছন্দের হল কড়া রোদ। তা হলে বৃষ্টির মধ্যে গেল কই? কারও বাড়ি? দোকান বাজারে যায়নি তো? কে জানে রান্না করতে গিয়ে হয়তো কঁচা লঙ্কা কম পড়েছে।

ভদ্রলোক মুহূর্তখানেকের জন্য চুপ করলেন। কবজি উলটে ঘড়ি দেখলেন। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ঢোঁক গেলা দরকার! পারছি না। আমি কি ঢোঁক গিলতে ভুলে গেছি? পর্ণার মতো ওই মহিলাও বৃষ্টি পছন্দ করেন না! এটাও কি কাকতালীয়?

ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে ফের নিজের কপাল মুছলেন। একটু যেন উত্তেজিত। নিশ্বাস ফেলছেন ঘনঘন। ফ্যাকাশে ধরনের হাসলেন।

‘মিনিট পাঁচ-সাতেক ছাতা মাথায় অপেক্ষা করার পর বাড়ির পিছন দিকটায় গেলাম। ওদিকেও একটা দরজা আছে। বাগানের দিকের দরজা। আমার স্ত্রী কোনও কোনও সময় সেই দরজা আটকাতে ভুলে যায়। এমনও হয়েছে, রাতে বাড়ি ফিরে দেখেছি, খিল, ছিটকিনি কিছুই পড়েনি। বললে দু’দিন মনে রাখে, ফের ভুলে যায়। আজ ভুলে যায়নি তো? সেটা দেখতেই পিছনে গেলাম। মনে মনে ঠিক করলাম, দরজা খোলা দেখলে জোর বকুনি দেব। তাতে রাগ করলে করবে। আসলে বকুনির থেকে খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ার একটা সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম।’

এতক্ষণ পরে আমি কথা বলতে পারলাম। বিড়বিড় করে উঠলাম, ‘কী দেখলেন? খোলা?’ ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসলেন। ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বললেন, না বন্ধ! তবে পাশের জানলাটা সামান্য খোলা। ওটা আমাদের শোওয়ার ঘর। জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ঘরের ভেতর থেকে ফিসফিসানি ভেসে এল।’

‘ফিসফিসানি!’

‘হ্যাঁ ফিসফিসানি। একজনের নয়, দু’জনে ফিসফিস করে কথা বলছে।মহিলার গলা চিনতে পারলাম। আমার বউ। পুরুষমানুষটি অচেনা। আমি খানিকটা অবাকই হলাম। ওর কোনও আত্মীয় এসেছে? তাই হবে। ডাকতে গিয়ে থমকে যাই, সামনের দরজায় তা হলে তালা কেন! যা করা উচিত নয়, আমি তাই করলাম।’

‘কী? প্রশ্নটা করলাম বটে, তবে মুখ দিয়ে বের হল কিনা বুঝতে পারলাম না।

‘জানলায় কান পাতলাম। স্পষ্ট শুনলাম, অচেনা পুরুষটি বলছে, চলো, এখনই আমার সঙ্গে পালিয়ে চলো… আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না… তোমার বিয়ের পর একটা রাতও আমি ভাল করে ঘুমোত পারি না। আমার বউ আদুরে গলায় বলল, ছিঃ সোনা অমন করে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তুমি আর ক’টাদিন অপেক্ষা করো। মানুষটা যে খারাপ নয় গো, ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য একটা গোলমাল-টোলমাল তো লাগবে….।আমি পা টিপে সরে আসি।’

ভদ্রলোক উঠে দাড়ালেন। ট্রেন ছুটছে। শেষ মুহূর্তে এসে যেন স্পিড বাড়িয়েছে।

ভদ্রলোক বড় করে হাসলেন, ‘এবার বুঝতে পারলে তো কেন এত বউ বউ করি? তবে ঘটনা সবাইকে বলি না। সবাইকে নিজের ঘরের কেচ্ছা কেলেঙ্কারি বলা যায় না। এ আর নতুন কী? কতই তো ঘটে। বিয়ের পর পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হওয়া তো জল-ভাত। সংসার ছেড়ে চলে যাওয়াও আশ্চর্যের কিছু নয়। তবু বলি। বয়স হয়ে যাচ্ছে বলেই হয়তো… তোমার মতো কাউকে মনে পরে গেলে বলে ফেলি। লাস্ট ট্রেনে অবশ্য সব সময় মনের মতো লোক পাওয়া মুশকিল। সেটা একটা সমস্যা।’

আমি দরদর করে ঘামছি। কিন্তু হাত তুলে সেই ঘাম মোছার মতো অবস্থা আমার নেই। অস্ফুটে বললাম, ‘আপনি কি সবসময় লাস্ট ট্রেনেই যাতায়াত করেন।’

ভদ্রলোক অল্প হেসে বললেন, ‘উপায় কী বলো? সেই ঘটনার কিছুদিন পর স্ত্রী ছেড়ে চলে গেল। আমি কোনও গোলমাল করিনি, কোনও সুযোগ দিইনি, তবু চলে গেল। অনেক বারণ করেছিলাম। লাভ হয়নি। ভেবেছিলাম, ভুলে যাব। ভাবতে ভাবতে বেশ কটা বছর কাটিয়ে ফেললাম। ভুলতে পারলাম না। এমনি বউ হলে পারতাম। জ্বালাতনের বউ বলেই পারলাম না। যাবার সময়ও আমাকে জ্বালিয়ে গেছে। বলে যায়নি কেন যাচ্ছে। আমার দোষ বলে যায়নি। যত দিন যেতে লাগল সে যেন ঘাড়ের ওপর চেপে বসল। স্কুলের চাকরিটা দিলাম একদিন ফট করে ছেড়ে। সারাদিন সদর দরজায় তালা দিয়ে পিছন দিয়ে ঢুকে ঘরে বসে থাকতাম। বসে থাকতাম স্কুল থেকে ফেরার পোশাকে! ধূতি, পাঞ্জাবি, কাঁধে ব্যাগ, পকেটে পেন। বুঝতে পারলাম, এই অবস্থা বেশিদিন চলতে দেওয়া উচিত নয়। চলতে দিলে আমি পাগল হয়ে যাব। পাড়ায় ছেলেপিলোর তা!মাকে দেখে ঢিল ছুড়বে, ধুতির কেঁচা খুলে দেবে। বলবে বউ-পাগলা…। তাই একদিন ভেবেচিন্তে লাস্ট ট্রেন থেকে দিলাম ঝাঁপ। সুইসাইড করার জন্য ঝড়-বৃষ্টির দিনের লাস্ট ট্রেন ভারী চমৎকার। লোকজন কম থাকে। তোমাকে বললাম না, দরকার হলে আগেও ট্রেন থেকে নেমে যেতে হয়? ইচ্ছে থাকলেও পুরো যাওয়া যায় না। আজ আসি ভাই কেন?’

ভদ্রলোক চলন্ত ট্রেনের খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমার উচিত উঠে গিয়ে ওঁকে জাপটে ধরা। আমি পারছি না। কিছুতেই পারছি না। আমাকে কি কেউ সিটির সঙ্গে বেঁধে ফেলেছে? নাকি আমি চাইছি, ভদ্রলোক ঝাঁপ মারুন? আমি চোখ বুজলাম।

ট্রেন থেকে নেমে প্রথমেই চোখ গেল আকাশে। লমলে আকাশ। তারা ফুটেছে। হাত দিলাম জামার পকেটে। না, মশলার কৌটোটা নেই।

সাপ্তাহিক বর্তমান, ১৪ নভেম্বর ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *