নিকুঞ্জবাবু

নিকুঞ্জবাবু

দরজার আড়ালে কেউ হাসছে। কে হাসছে? নিকুঞ্জ পাঠকের মাথা বালিশে, দুটো পা টানটান করে সামনে মেলা। সেই পা তিনি নাড়াচ্ছেন। নাড়াতে নাড়াতে ভাবছেন, কীভাবে শুরু করবেন। কোথা থেকে শুরু করবেন। হাসির আওয়াজে পা নাড়ানো বন্ধ করলেন নিকুঞ্জবাবু। ভুরু কোঁচকালেন। মৃত্যুর বাড়িতে হাসে কে! এ আবার কেমন অসভ্যতা? একটা মানুষ মাত্র হাত কয়েক দূরে মরে পড়ে আছে, সেইসময় হাসাহাসি! ঠিক শুনছেন তো?

হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন। দরজার ওপাশেই বারান্দা। নিকুঞ্জবাবুর শখের বারান্দা। সেই শখের বারান্দা থেকে হাসি ভেসে আসছে। জোরে হাসি নয়, চাপা গলায় হাসি। মুখে হাত রেখে হাসলে যেমন হয় সেরকম।

আশ্চর্য। খুবই আশ্চর্য। বাড়ির কর্তার মৃত্যুর মতো একটা শোকাবহ ঘটনার পর হাসি!

কে হাসছে? বাড়ির কোনও মেম্বার? নাকি বাইরের কেউ? হতে পারে, বাইরের লোকও হতে পারে। কিছুক্ষণ হল একটা-দুটো করে বাইরের লোকজন আসতে শুরু করেছে। গাড়ি, ট্যাক্সির হর্ন শোনা যাচ্ছে। সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। ‘মরোমরো’ অবস্থার খবর পেলে আজকাল আর বাইরের লোক আসে না। তারা আসে ফাইনাল মারা যাওয়ার পর। ঠিকই করে। মরামরো সময় ছুটে আসার মানে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল, অক্সিজেনের হাজারটা ফ্যাচাঙে জড়িয়ে পড়ে। মারা যাওয়ার পর পৌঁছেলে আর সে ঝামেলা থাকে না। একেবারে ঝাড়া হাত-পা।

কাল রাতে যখন শ্বাস উঠল তখন ক’টা বাজে? নিকুঞ্জলালু সময় মনে করার চেষ্টা করলেন। খুব বেশি হলে একটা। প্রথমে চাপ, তারপর কষ্ট বুকটা ঢেউয়ের মতো একবার উঠছে, একবার নামছে। চোখ দুটো বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে। কপাল, গলা ঘামছে দরদরিয়ে। এসব এলাকায় রাত একটা মানে অনেক। সুরমাদেবীর চেঁচামেচিতে বাড়িসুদ্ধু সবাই উঠে পড়ল। দুই ছেলে, তাদের বউরা, বড় নাতনি, গোপালের মা— সবাই। একটা হট্টগোলের মতো অবস্থা। ঘরে ঘরে আলো জ্বালানো হল। কেউ হাতপাখা খুঁজছে। কেউ জল আনছে। কেউ ওষুধের বাক্স হাতড়ে ওধ খুঁজছে আর বাড়ির সবাইকে গাল দিচ্ছে— ‘এ বাড়িতে একটা জিনিস যদি ঠিক সময় পাওয়া যায়। এটা বাড়ি না অন্যকিছু?’

একটা বেজে পনেরো-কড়ি নাগাদ সুরমাদেবী মখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন।

স্বপন রেগে গিয়ে বলল, ‘আঃ মা, কী আরম্ভ করেছ? রাতদুপুরে মরাকান্না শুরু কেন?’

সুরমাদেবী কান্না থামিয়ে বড় ছেলেকে ধমক দেন।

‘তোর বাবা রাতে মরছে তাই রাতে মরাকান্না কাঁদছি। দিনে মরলে দিনে কাঁদতাম। তোর কী অসুবিধে?

কথা শেষ করে সুরমাদেবী আবার মুখে আঁচল চাপা দিলেন। নিকুঞ্জবাবু বিয়ের পর থেকেই দেখছেন, তাঁর স্ত্রীর এই ক্ষমতা অদ্ভুত। কান্নাকাটির মধ্যেও সে ধমকাতে পারে। স্বপন অবাক হয়ে বলল, ‘মরছে! মরছে কোথায়! বাবার বুকে ব্যথা হচ্ছে, বুকে ব্যথা হলেই কি মানুষ মরে যায় নাকি? গ্যাসের ব্যথা হতে পারে।’

অন্তরার ঘর থেকে বেরোতে দেরি হয়েছে। সে পরে ছিল নাইটি। নাইটি পরে শ্বশুরের ঘারে আসা যায় না। শ্বশুর মৃত্যুপথযাত্রী হলেও না, না হলেও নয়। সে হাউসকোট খুঁজে, গায়ে জড়িয়ে তবে এল।

সুরমাদেবী তার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, ‘এতক্ষণ কী করছিলে? তখন থেকে ডাকছি। বাপ রে! বাড়িতে একটা মানুষ মরছে আর নাক ডেকে এত ঘুম!’

অন্তরা কাটা গলায় জবাব দিল, ‘এত ঘুম কোথায়? এই তো সব সেরে সুরে বারোটার পর শুলাম। আপনি তো ভাল করেই জানেন মা, সবাইকে খাইয়ে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, বিছানা করে এই বাড়ির বউদের শুতে কত দেরি হয়। আপনি কি জানেন না? কুন্তলার তো আরও সময় লাগে। ওর ছেলে ছোট।’

সুরমাদেবী চোখের জল মুছে বললেন, ‘স্বামী মারা যাচ্ছে, এখন আর বাড়ির বউদের কাজের ফিরিস্তি না-ই বা শুনলাম অন্তরা। একেবারে না হয় সব চুকেবুকে যাওয়ার পর শুনব। এখন যাও দেখি, একটা হাতপাখা নিয়ে এসো।’

তপন জলের গ্লাস হাতে নিকুঞ্জবাবুর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, ‘হাতপাখা দিয়ে কী হবে মা? ঘরে তো ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে।’

সুরমাদেবী ছোট ছেলের কথায় আমল দিলেন না।

কুন্তলা দরজার পাশ থেকে সরে এসে স্বামীকে বলল, ‘আঃ, মা যখন বলছে… এইসময় হাতপাখা লাগে। তুমি বরং ডাক্তার সরকারকে ফোন করো।’

তপন বিরক্ত গলায় বলল, ‘তুমি জলের গ্লাসটা ধরে দাঁড়াও। গ্লাস হাতে ফোন করতে পারব না।’

ডাক্তার সরকারকে ফোন করা হল দুই পর্যায়ে। ল্যান্ড এবং মোবাইলে। প্রথম পর্যায়ে ফোন বেজে গেল। দ্বিতীয় পর্যায়ে ঘুম ভাঙা, বিরক্ত গলায় ডাক্তারবাবু বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যান।’

হাসপাতাল শুনে সুরমাদেবীর কান্না বাড়ল। দুই পুত্রবধূ এসে শাশুড়ির গায়ে হাত রাখতে গেলে তিনি কান্না থামিয়ে সেই হাত সরিয়ে বললেন, ‘গায়ে হাত দাও কেন? আমি কি মুচ্ছা যাচ্ছি? সরো তো, মানুষ মরার সময় আদিখ্যেতা ভাল লাগে না। আদিখ্যেতা করতে হলে অন্য সময় করবে।’

হাসপাতালে নিতে হল না। তার আগেই নিকুঞ্জ পাঠকের বুকের ওঠা-নামা বন্ধ হল। চোখ স্থির হল। তিনি মারা গেলেন।

কিন্তু এখন হাসে কে? যে-ই হোক, নিকুঞ্জবাবুর মনে হচ্ছে, এই লোকের গালে এখনই একটা চড় লাগানোর দরকার। শোকের বাড়িতে হাসা বেরিয়ে যাবে। শুধু শোক তো নয়, একটা ভদ্রতা-সভ্যতাও আছে।

গায়ের চাদর সরিয়ে খাটের ওপর উঠে বসলেন নিকুঞ্জবাবু। হাতে সময় অল্প। এতে কতটুকু দেখা হবে? কিছুই হবে না। দীর্ঘ পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে কত মানুষ, কত ঘটনা। একটা পাক মারতে না মারতেই সময় ফুরিয়ে যাবে। সময় বাড়াবার জন্য নিকুঞ্জবাবু যে চেষ্টা করেননি এমন নয়। চেষ্টা করেছিলেন। ‘উনি’ কিছুতেই রাজি হলেন না।

‘স্যার, আর এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দিন।’

‘উনি’ শান্ত গলায় বললেন, ‘এইটা বলবেন না নিকুঞ্জবাবু। একেই আউট অব টার্ন পারমিশান করে দিলাম, এখন যদি আরও আবদার করেন তা হলে মুশকিলে পড়ব।’

নিকুঞ্জবাবু হাত কচলে বললেন, ‘অনুমতি দিলেন বলেই আর একটু সময়ের জন্য রিকোয়েস্ট করছি। নইলে কি ছাই সাহস পেতাম?’

‘উনি’ হেসে ফেললেন। সুন্দর, সৌম্য হাসি। বললেন, ‘আচ্ছা নিকুঞ্জবাবু, আপনি ঠিক কী দেখতে চাইছেন?’

নিকুঞ্জবাবু গদগদ গলায় বললেন, ‘শুধু দেখতে নয়, শুনতেও চাইছি স্যার। আমার মৃত্যুর পর প্রিয়জন, পরিচিত মানুষ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কে কী করে, কে কী বলে— আড়াল থেকে একবার দেখতে চাই।’

‘কী হবে দেখে?’

নিকুঞ্জবাবু লাজুক গলায় বললেন, ‘মানুষের এটাই মজা স্যার? নিজের জন্য অন্যের হাসি, আহ্লাদ, আনন্দ দেখে যেমন সুখ হয়, তেমনি তাদের শোক, দুঃখ দেখেও ভাল লাগে। তৃপ্তি পায়। এত মানুষ আমার জন্য কাঁদছে, আহা রে উহু রে বলছে— এটা একটা বড় পাওনা স্যার। বলছে, মানুষটা কত ভাল ছিল, কত বড়মাপের ছিল। সমুদ্রের মতো মন, পর্বতের মতো হৃদয়। শুনতে ভাল লাগবে না স্যার? আপনিই বলুন না!’

‘উনি’ মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না। হয়তো লাগবে। আচ্ছা নিকুঞ্জবাবু, আপনি নিজের জন্য কতখানি শোক, দুঃখ আশা করছেন?’

নিকুঞ্জাবু উৎসাহী গলায় বললেন, ‘নিজের মুখে কী বলব স্যার? অনেকটাই করছি, বলতে পারেন পুরোটাই। এত বছর বেঁচে থেকে এত কিছু করলাম আর মরার পর একটু কান্নাকাটি এক্সপেক্ট করব না? শুত্ব তো আর একটা তিনতলা -চারতলা বাড়ি তৈরি নয়, স্ত্রী যেমনটি চেয়েছে, তেমনটি করে বানিয়েছি। তার শখ মেটাতে ধার করছি, পরিশ্রম করেছি। তারপর আমার দুই ছেলের কথাই ধরুন স্যার। স্বপন, তপন। মার্ভেলাস ছেলে। ছোটটা ব্যাবসা নিয়ে একটু গোলমালে আছে বটে কিন্তু সেটা বড় কিছু নয়। দু’জনকেই মানুষ করলাম, তাদের বিয়ে দিলাম। মেয়ে স্যার বর্ধমানে। জামাই কিঙ্কর অতি চমৎকার ছেলে। দারুণ রেজাল্ট। এই ছেলেকে আমিই খুঁজে বের করেছিলাম। সে এক গল্প স্যার। একদিন অফিস থেকে ফিরছি, হঠাৎ বাসে দেখি… যাক, সে গল্প আর একদিন হবে। নাতি, নাতনিগুলো আমার ভারী লক্ষ্মী পক্ষী। বড় ছেলের মেয়ে বুলি তো একটা সময় দাদু বলতে পাগল ছিল। খালি বায়না আর বায়না। এখন বড় হয়ে গেছে। সারাদিন কম্পিউটার ঘাঁটে। বিদেশে যাবে বলে বায়না ধরেছে। ছোট ছেলের পুত্রটি স্যার আমার বড় আদরের। এত আদরের যে নাম দিয়েছি আপু। আদর থেকে আদু। নিজের মুখে বলাটা ঠিক নয়, তবু আপনাকে বলছি, শুধু বাড়ির জন্য নয়, বাইরেও কাজকর্ম করেছি। খাতিরও পাই। পাড়ার তিন-তিনটে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আমি। এই বুড়ো বয়সেও প্রতি মাসে একবার করে পুরনো অফিসে যাই। সবার সঙ্গে দেখা করে আসি। চা না খাইয়ে বেটারা ছাড়তেই চায় না। আমাকে পেলে ওরা কত খুশি যে হয়…। ’

‘উনি’ যেন খানিকটা আপন মনেই বললেন, ‘সেই খুশিটা নিয়ে চলে যাওয়াটাই বুদ্ধির কাজ হত না কি নিকুঞ্জবাবু?’

নিকুঞ্জবাবু হাত জোড় করে ফেললেন, ‘প্লিজ স্যার। একটিবারের জন্য।’

‘উনি’ মাথা নামিয়ে, জাবদা খাতায় ঘসঘস করে লিখতে লিখতে বললেন, ‘ঠিক আছে যান, যখন চাইছেন একবার ঘুরে দেখে আসুন। তবে মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু নিজেকে দেখাতে পারবেন না। শরীরটা আপনার শোওয়ার ঘরে যেমন শুয়ে আছে, মরে আছে, তেমনিই থাকবে। আপনি ঘুরবেন ছায়ার মতো, বাতাসের সঙ্গে। সবই দেখবেন, শুনবেন, কিন্তু দেখা দিতে পারবেন না। বলতেও পারবেন না কিছু। যান, আড়ালে থেকে দেখা করে আসুন সবার সঙ্গে।’

‘তা হলে স্যার সময়টা কি আর একটু বাড়াবেন না?’

‘উনি’ মুখ তুলে তাকালেন। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, ‘না। মনে হয় না আপনার লাগবে।’

চোখ খুলে বিছানায় উঠে বসতেই নিকুঞ্জবাবু দেখতে পেলেন, ঘর প্রায় ফাঁকা। দু’-একজন এদিক সেদিক বসে দাঁড়িয়ে আছে। তারা বেশিরভাগই অচেনা বা আধ চেনা। বাড়ির লোকজন সব গেল কই? সুরমা? এ আবার কী? মৃত স্বামীকে ছেড়ে সে গেল কোথায়? ছেলেরা? তাদের বউ? নাতি নাতনি? নিশ্চয় হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে গেছে। সে তো যাবেই। আহা, বেচারিদের পুরো রাতটাই ধকল গেছে। রাতে মানুষ মরা ঠিক না।

মৃতদেহের বালিশের পাশে কে যেন যত্ন করে চশমা, ঘড়ি রেখে দিয়েছে। নিকুঞ্জবাবু তুলে চোখে দিলেন। ঘড়ি পরলেন হাতে। সময়টা খেয়াল রাখতে হবে। ‘উনি’ রেগে না যান। চিরুনি পাওয়া যাবে? মাথার এই উলুঝুলু অবস্থায় ঘর ছেড়ে বেরোনোটা বিচ্ছিরি। যাক কী আর করা। মরা মানুষের চিরুনি খোঁজাটা ভাল দেখায় না। হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করলেন, তারপর দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সবার আগে শোকের বাড়িতে হাসির রহস্য ভেদ করা দরকার।

কিন্তু বাইরে এসেই চমকে উঠলেন নিকুঞ্জবাবু।

আরে! এ তো বড় নাতনি বুলি দাঁড়িয়ে! বুলির সঙ্গে শালার মেয়েটাও আছে। কী যেন নাম মেয়েটার? মনে পড়েছে, কাজল। ওরা এর মধ্যে জামশেদপুর থেকে চলে এল! ভেরি গুড

নিকুঞ্জবাবু নাতনির দিকে সরে এলেন। দাঁড়ালেন ফুল ফুল গ্রিলের সঙ্গে মিশে।

বুলি হাসি হাসি গলায় বলল, ‘অ্যাই কাজল, চল না, কাল দুপুরে ছবিটা দেখে আসি। খুব হাসির বই।’

কাজল হাসতে হাসতে বলল, ‘একেবারে কালই? হ্যাঁরে কাল সময় পাব? বাড়িতে এত ঝামেলা।’

বুলি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ওমা! ঝামেলা কোথায়? বাবা বলছে আজ সন্ধের মধ্যেই শ্মশানমশান হয়ে যাবে। তারপর ফ্রি। আর ঝামেলা হলেই তো ভাল। আমাদের দিকে কেউ খেয়ালই করবে না। টুক করে ছবি দেখে চলে আসব। কাঁদোকঁদো মুখে বাড়ি ঢুকলেই চলবে।’

কাজল এবার হেসে ফেলল। চোখ নাচিয়ে বলল, ‘অ্যাই, ও যাবে?’

বুলি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘কে?’

কাজল বলল, ‘ওই যে তোর ও।’

বুলি হাসতে হাসতে বলল, ‘মার খাবি কাজল। ভাল হচ্ছে না কিন্তু। একটু আগে মোবাইলে ফোন করেছিল। আমি বললাম, আজ কথা বলব না। দাদু মারা গেছেন। পাজিটা কী বলল জানিস?’

কাজল ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘কী বলল?’

‘বলল, তাতে কী হয়েছে? দাদু মারা গেলে, প্রেম করা বারণ নাকি? হি হি।’

নিকুঞ্জবাবু কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি সরে এলেন। পায়ে কোনও আওয়াজ নেই। পা টেপার কোনও দরকার ছিল না, তা তিনি পা টিপে টিপে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। ওদের কথা তিনি শুনেছেন জানতে পারলে মেয়েদুটো লজ্জা পাবে। আহা, ছেলেমানুষ। ওরা ওসব দুঃখ-দুঃখ কী বোঝো?

বারান্দার শেষে বড় ছেলের ঘর। ঘরের সামনে পরদা। বড় বউমার টেস্ট ভাল। মনে আছে, স্বপনের সম্বন্ধ দেখার সময় গায়ের রঙের পাশাপাশি তিনি টেস্টের ব্যাপারটা খেয়াল রেখেছিলেন। রুচি ভাল হলে মানুষও ভাল হয়। ঘরের পরদা সুন্দর। সুন্দর পরদা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন নিকুঞ্জুবাবু।

ওয়ার্ডরোবের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তরা কাপড়তাম গুছোচ্ছে। একপাশে সোফায় বসে আছে স্বপন। তার চোখমুখে রাত জাগার ক্লান্তি।

‘অমন মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন?’

স্বপন মুখ তুলে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী করব? নৃত্য করব?’

‘আমাকে ধমকাচ্ছ কেন? বুড়া বয়সে বাবা মরেছে, তাতে ক্ষতিটা কী? বরং লাভই হয়েছে। এরও লাভ, আমাদেরও লাভ।’

‘লাভ!’

স্বপন মুখ তুলল। অন্তরা বলল, ‘বাঃ লাভ নয়? এই যদি অসুখবিসুখ করে বিছানায় পড়ে থাকত ভাল হত? নিজে কষ্ট পেত, আমাদেরও জ্বালিয়ে মাত্র। জ্বালাতে তো শুরুই করেছিল। এটা খাব, ওটা খাব। বউমা কচু লতির শাক করো, তিলের নাড়ু বানাও।’

‘না বানালেই পারতে।’

অন্তরা ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘ইঃ না বানালেই পারতে। বলা খুব সোজা। উনি ছেলের বউমা বলে রাঁধুনি নিয়ে এসেছেন না? অর্ডার মতো না খাবার পেলে বুড়ো ছাড়ত? মুখে আবার কত আদিখ্যেতা। আমার বড় বউমার রান্নার হাত আমি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দেব। কচুর মাথা দেবে। আসল সোনা তো সব নিজের স্ত্রীর লকারে।’

নিকুঞ্জবাবু পরদার আড়ালে এক পা সরে এলেন। এসব কী শুনছেন। ঠিক শুনছেন তো! স্বপনই বা চুপ করে আছে কেন? কিছু বলবে না? একটা ধমক তো দিতে পারে। বাবাকে ‘বুড়ো’ বলছে আর ছেলে চুপ করে শুনছে!

স্বপন বলল। হাত নেড়ে বলল, ‘বাজে কথা ছাড়া তো। আমি রয়েছি নিজের জ্বালায়।’

অন্তরা মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কী জ্বালা আবার?’

‘শুনলে না তপনটা কী বলল?’

‘কী বলল তোমার গুণধর ভাই?’

‘বলল, দাদা তুই বড়, শ্মশানমশান, শ্রাদ্ধশান্তি, লোক খাওয়ানো সব তুই সামলাবি। ও সবের হ্যাপার মধ্যে আমি নেই। তা ছাড়া এই মাসটা ব্যাবসায় টানাটানি চলছে।’

‘মানে?’

‘মানে আর কী, খরচাপাতি সব আমার।’

অন্তরা মুখ ঝামটে বলল, ‘কেন, তোমার কেন? উনি কি বানের জলে ভেসে এসেছেন? বিয়ের পরপরই তোমাকে বলেছিলাম, তোমার এই ভাইটি একটি মিচকে। বলিনি? বলো তুমি? শুধু তোমার ভাই নয়, তোমার ভাইয়ের ফরসা বউটিও সুবিধের নয়। একা পেলেই শ্বশুরের সঙ্গে এত গুজুর গুজুর কীসের রে বাপু? শ্বশুর কি তোর একার?’

স্বপন বলল, ‘কী আবার? নিশ্চয় বাবার কাছ থেকে ব্যাবসার টাকা ম্যানেজ করত। যাক, ওসব ছাড়ো, আমি দেখি কাজকর্ম কত শর্টে সারা যায়।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে এলেন নিকুঞ্জবাবু। সন্তানের সব কথা ধরতে নেই। শোকের মাথায় মানুষ উলটোপালটা কত কী বলে। পিতৃশোক বলে কথা। চাট্টিখানি ব্যাপার নয়।

ছোট ছেলের ঘরে পরদা টানা নয়, ভেজানো। বিয়ে-থা হয়ে গেলে ছেলের ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকতে নেই। বাইরে থেকে হয় ডাকতে হয়, নয় গলাখাঁকারি দিতে হয়। আজ সেসব সমস্যা নেই। দরজার সঙ্গে মিশে ভেতরে সেঁধিয়ে পড়লেন নিকুঞ্জ পাঠক।

টেবিলের সামনে বসে তপন অফিসের কাগজপত্র ঘাঁটছে। একটু দূরে খাটে বসে আছেন তার শাশুড়ি। পান চিবোচ্ছেন। নিকুঞ্জবাব বেয়ানকে দেখে খুশি হলেন। এই মহিলাকে তিনি পছন্দ করেন। মহিলা সরল সাদা মানুষ। কথায় কথায় বলতেন, ‘আমাকে কিছু বলবেন না দাদা, মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। মেয়ে এখন আপনার। এই মেয়ের ভালমন্দ কিছুই আমি বুঝি না।’ এই মহিলা মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সবার আগে ছুটে আসবে না তো কে আসবে? এমনটাই হওয়া উচিত। বিপদের সময় পাশে না দাঁড়ালে কীসের আত্মীয়? কীসের আপনজন?

খাটের অন্যপাশে কুন্তলা তার চার বছরের ছেলে আদুকে ভাত খাওয়াচ্ছে। সিদ্ধ ভাত। ভাতের আড়ালে একটা ডিমও আছে। আদু ভাত খেতে চাইছে না। কুন্তলা ধমক দিয়ে খাওয়াচ্ছে।

নিকুঞ্জবাবু খাটের পাশে চুপটি করে দাঁড়ালেন।

শাশুড়ি-মহিলা তাঁর মেয়েকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি কর। হুট বলতে কে এসে যাবে।’

তপন মুখ না ফিরিয়ে বলল, ‘এসে যাবে তো কী হয়েছে?’

মহিলা চিবুক তুলে মুখের পিক সামলে বললেন, ‘মরার বাড়িতে রান্নাবান্না ভাল দেখায় না। তার ওপর তোমার বাবার দেহ এখনও রয়েছে।’

তপন মুখ দিয়ে অবজ্ঞা ধরনের আওয়াজ তুলে বলল, ‘ওসব আমি মানি না। আমিও খাব।’

মহিলা বললেন, ‘আমি মানামানির কথা বলছি না। দেখানোর কথা বলছি। তোমার খাওয়াটা ঠিক হবে না তপন। কেউ দেখলে…।’

কুন্তলা তার মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে কঠিন গলায় বলল, ‘কী হবে মা? বাবা মরেছে বলে ছেলে উপোস করে থাকবে? এটা কেমন কথা বলছ? সবাই তো লুকিয়ে এটা-সেটা মেরে দিচ্ছে। তুমি কি ভাবছ এ বাড়ির বড়বউ তার স্বামীকে না খাইয়ে রেখেছে? ভোরবেলা চা দিল, বিস্কুট দিল। একটা ডিম পর্যন্ত ঝট করে ভেজে দিয়েছে। গোপালের মা আমাকে খবর দিয়েছে। তা ছাড়া উনি তোমার জামাইয়ের জন্য বাড়তি কী করেছেন? কিছুই নয়। কতদিন ধরে আদুর বাবা হাজার চল্লিশ টাকা চাইছে। এমনি চায়নি, বিজনেসের জন্য চাইছে। বাবা একটা ফিক্সড ভাঙালেই হেসে খেলে হয়ে যেত। শ্বশুরমশাই কিছুতেই শুনলেন না। দিচ্ছি, দেব বলে কাটিয়ে দিলেন। এখন তো বিশ বাঁও জলে। তার জন্য আমরা কেন বুক চাপড়ে কাঁদব?

নিকুঞ্জবাবু সরে দাঁড়ালেন। এখানে এক মিনিটও নয়। এই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়াটাই নিরাপদ। যত দ্রুত পালানো যায় তত মঙ্গল।

কুন্তলার মা চাপা গলায় বলছেন, ‘গাধার মতো কথা বলিসনি। শ্বশুর গেছে তো কী হয়েছে, এখন তার শাশুড়িকে ম্যানেজে রাখতে হবে। টাকাপয়সা, বাড়িঘর ভাগাভাগির ব্যাপার আছে। যা ছেলেকে খাওয়ানো বন্ধ করে শাশুড়ির কাছে গিয়ে বস। গায়ে মাথায় হাত বোলা। এমনি বোলাবি না, সঙ্গে কাঁদবি।’

কুন্তলা গজগজ করে বলল, ‘যাচ্ছি, কিন্তু কাঁদতে পারব না। তুমি তো জানো মা, টিভির সিরিয়ালগুলো ছাড়া চট করে আমার চোখে জল আসে না। তা ছাড়া মানুষটাকে কখনওই আমি পছন্দ করিনি। সারাদিন বাড়িতে বসে খালি ট্যাঁক ট্যাঁক আর ট্যাঁক ট্যাঁক। আলো নেভাও রে, কল বন্ধ করো রে, ছাদের দরজাটা খোলা কি না দেখে এসো রে, উফ হরিবল।’

নিকুঞ্জবাবু বেরিয়ে পড়লেন। তিনি কি চিন্তিত? মুখ দেখে মনে হচ্ছে চিন্তিত। আবার নাও হতে পারে। জীবিত মানুষের মুখ দেখে যা মনে হয়, মৃত মানুষের বেলায় তা নাও হতে পারে।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখা হল মেয়ের সঙ্গে। ‘দেখা হল’ বলাটা ঠিক নয়। নিকুঞ্জবাবু ঝুমুরকে দেখতে পেলেও, ঝুমুর তাঁকে দেখতে পেল না। পাওয়ার কথাও নয়। ঝুমুরের পেছনে তার স্বামী, কিঙ্কর। মেয়ের হাতে রুমাল। জামাইয়ের হাতে ঢাউস সুটকেস। বধমান থেকে আসছে বলে সুটকেস! নিশ্চয় এখানে ক’টা দিন কাটিয়ে ফিরবে।

নিকুঞ্জবাবু সিঁড়ির একপাশে সরে দাঁড়ালেন। ঝুমুরের মুখের দিকে তাকালেন। মেয়ের মুখ থমথমে এবং লালচে। আহা রে, নিশ্চয় খুব কান্নাকাটি করেছে। মেয়েটার এই এক দোষ। বড্ড নরম। বাবার একটা কিছু হল কি হল না কেঁদে ভাসাবে। এই তো গত বছর সামান্য ফ্লু নিয়ে কী কাণ্ড করল। সকালে খবর পেয়ে বিকেলের ট্রেনে চলে এসে কান্না জুড়ল। আর এ তো একেবারে মৃত্যু। কাঁদবে না?

মেয়ের কান্নায় বাবারা দুঃখ পায়, আজ অন্যরকম হল। নিকবাবু খুশি হলেন। তিনি মেয়ে-জামাইয়ের পিছু নিলেন।

ঝুমুর কোনও দিকে না তাকিয়ে চটি ফটফটিয়ে তাঁর মায়ের ঘরে এসে থামল। নিকুঞ্জবাবুও ঢুকে পড়লেন বন্ধ জানলা গলে। সুরমাদেবী আধশোয়া অবস্থায় খাটে শুয়ে আছেন। চোখ বোজা। মাথার কাছে গোপালের মা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করছে। দু’পাশে অন্তরা আর কুন্তলা দুজনেই দাঁড়িয়ে। হাতে গ্লাস। দু’জনেই তাদের শাশুড়ির জন্য শরবত এনেছে। সম্ভবত সুরমাদেবী এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, কোনটা তিনি খাবেন।

ঝুমুরের পায়ের আওয়াজে সুরমাদেবী চোখ খুললেন।

‘এসেছিস?’

ঝুমুর ঝুঁকিয়ে উঠল, ‘মা আমি এত পরে খবর পেলাম কেন?’

সুরমাদেবী বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এতে আগে পরের কী আছে? মানুষটা না মরলে মরার খবর দেব কী করে? তা ছাড়া স্বপন তো সকালেই ফোন করেছে।’

‘ওটা সকাল হল? সাতটাটা কি সকাল? আমাদের আদ্দেক কাজ হয়ে যায়। তোমাদের বাড়ির মতো সবাই পড়ে পড়ে ঘুমোয় না।’

কথা শেষ করে বউদের দিকে আড়চোখে তাকাল ঝুমুর। অন্তরা চিমটিটা ধরে নিল। নিচু গলায় বলল, ‘পড়ে পড়ে ঘুমোনোর কী আছে দিদি? গোটা রাতই তো আমরা জেগেছি।’

সুরমাদেবী মুখে আঁচল দিয়ে বললেন, ‘এটা কোনও কথা নয়, বড় বউমা। বাড়ির কর্তা মারা যাচ্ছে, বাড়িসুদ্ধ সবাই জাগবে না তো কী করবে? নাক ডেকে ঘুমোবে? সত্যি তো তোমাদের ঝুমুরকে আরও আগে খবর দেওয়া উচিত ছিল।’

কুন্তলা জায়ের পক্ষ নিল। রিনরিনে গলায় বলল, ‘সাতটা এমন কিছু দেরি নয়। বর্ধমান থেকে তো দশ মিনিট অন্তর অন্তর ট্রেন। সেরকম হলে কিঙ্করদার গাড়ি ছিল, এরকম একটা বিপদের দিনে তেল খরচ নিয়ে ভাবলে চলে না।’

কিঙ্কর বোকাসোকা মানুষ। চট করে সবটা ধরতে পারে না। সে সবসময়ই বউয়ের কথা অনুযায়ী চলতে চেষ্টা করে। কখন রাগবে, কখন খুশি হবে পারলে সেটাও জেনে নেয়। অপমান গায়ে লাগতে কিঞ্চিৎ বেশি সময় নিল। সে তার বউয়ের দিকে তাকাল। ঝুমুর গলা তুলল, ‘ভাবতে তো হবেই। এখন থেকে সব খরচাপাতি নিয়েই ভাবতে হবে। নিজের বাড়ির টাকাপয়সা নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, এ বাড়ির টাকাপয়সা নিয়েও ভাবতে হবে। বাবার সম্পত্তি শুধু ছেলের নয়, মেয়েরও।’

সুরমাদেবী বললে, ‘উফ ঝুমুর। এখনও তোর বাবা পাশের ঘরে শুয়ে আছে, এসব কী শুরু করলি?’

বাবার মৃত্যুশোকে এতক্ষণ পর্যন্ত যে মন খুলে কাঁদবার সময় পায়নি সেই ঝুমুর এবার ফুঁপিয়ে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শুরু আমি করেছি, না তোমার ছেলে আর তাদের বউরা শুরু করেছে মা? আমাকে বাবার মৃত্যুর খবর কেন দেরি করে দেওয়া হল আমি জানি না ভেবেছ? প্রমাণ করতে চাইছে, ঝুমুর কুণ্ডু এ বাড়ির কেউ নয়। এটা সহজ হবে না। এই বলে রাখলাম, পাই পয়সা সব বুঝে তারপর এ বাড়ি ছাড়ব।’ কথা শেষ করে ঝুমুর তার স্বামীর দিকে ফিরে বলল, ‘হাঁদার মতো দাড়িয়ে আছ কেন? চলো, ঘরে চলো। কী জানি এরা বোধহয় আমার ঘরে এতক্ষণে তালা মেরে দিয়েছে। মেরে দিলে ক্ষতি নেই, উকিল ডেকে তালা ভাঙাব।’

দেয়াল বেয়ে নিকুঞ্জবাবু একতলায় এসে দাঁড়ালেন। মনটা বিষয়। খুবই বিষণ্ণ। এসব কী শুরু হয়েছে বাড়িতে! কী শুরু হয়েছে! এই তাঁর ছেলে-মেয়ে! এই তার সংসার!

ভাবতে ভাবতে পাক দিয়ে বাড়ির পেছনে এলেন। বাগানে এসে দাঁড়ালেন। এদিকটা ভাড়াটেদের। ভাড়াটে বলতে দুটি মাত্র মানুষ। অল্পবয়সি স্বামী-স্ত্রী। চাকরি-বাকরি ছাড়া সারাদিন গান-বাজনা আর লেখাপড়া নিয়ে থাকে। এমনি গান-বাজনা নয়, গম্ভীর গান-বাজনা। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকস্। বেটোফেন, মোৎসার্ট, চাওকোভাস্কি। অনেক ঝাড়াই-বাছাই, ইন্টারভিউয়ের পর এদের একতলার পেছনের দুটো ঘর দিয়েছিলেন নিকুঞ্জবাবু। বাড়িতে লেখাপড়া, গান-বাজনার একটা পরিবেশ থাকা দরকার। সে নিজের ঘরেই হোক বা ভাড়াটের ঘরেই হোক। বাড়ি তো একটাই। ছেলে-মেয়ে দু’জনেই চমৎকার। এলেই ডেকে, ঘরে বসিয়ে খাতির যত্ন করেছে।

‘এটা কী বাজছে হে?’

‘ফিফথ সিম্ফনি মেসোমশাই।’

‘ফিফথ সিম্ফনি! সেটা আবার কী!’

‘এটা খুব বিখ্যাত একটা সুর। ভেতরে আসুন না মেসোমশাই। এক কাপ চা খেতে খেতে বাজনা শুনে যান।’

নিকুঞ্জবাবু ভেতরে গেছেন। সোফায় বসে বাজনা শুনতে শুনতে চা-বিস্কুট খেয়েছেন। চোখ বুজে মাথা নেড়েছেন। ‘বিখ্যাত’ সুর তাঁকে যতটা না আপ্লুত করেছে, তার থেকেও বেশি আপ্লুত করেছে, ভাড়াটেদের আচরণ। দশ-বারো দিন ভাড়া দিতে দেরি হলে গা করেননি কখনও। এই তো এ মাসের ভাড়া এখনও দেয়নি, তিনি কি তাড়া দিয়েছেন? দেননি। দেবেনই বা কেন? চমংকার মানুষের থেকে কি ভাড়া বড় হল?

মৃত্যুর খবর পেয়ে এরা কী করছে? আজ কি গান-বাজনা শুনছে? দুঃখের বাজনা? বেহালা বা বাঁশি?

না, বাজনা শুনছে না। বাগানের ঝোপঝাড় আগাছার ওপর দিয়ে ভেসে নিকুঞ্জবাবু এসে দাঁড়ালেন ভাড়াটেদের ড্রইংরুমের জানলায়। এই তো স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বসে। হাতে বই। মুখ থমথমে। থমথমে হওয়ারই কথা। মাথার ওপর পছন্দের মানুষটা মরে পড়ে আছে, ওদের মুখ থমথমে হবে না তো কী হবে?

মেয়েটি বলল, ‘খারাপ লাগছে।’

স্বামী মুখের সামনে থেকে বই সরিয়ে বলল, ‘আমারও লাগছে বিপাশা।’

নিকুঞ্জবাবু সরে এলেন। তাঁর চোখদুটো আনন্দে চকচক করে উঠল। বিপাশা কাঁদোকাঁদো মুখে বলল, ‘অনেক ভাগ্য করে এমন একজন বাড়িঅলা পেয়েছিলাম।’

ছেলেটি বলল, ‘আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না, কিন্তু এঁকে পেয়ে মনে হচ্ছিল, ভাগ্যই আসল।’

নিকুঞ্জবাবু মুগ্ধ। ইচ্ছে করছে, ঘরে ঢুকে পড়তে। তারপর সোফায় বসে হাসতে হাসতে বলবেন, ‘এক কাপ চা খাওয়াও দেখি। আর ওই যে কী ফোনি আছে তোমাদের, বাজনাটা বাজাও। শুনতে শুনতে চা খাই।’

কিন্তু সে উপায় নেই। ‘উনি’ এক চক্কর ঘুরে দেখার অনুমতি দিয়েছেন। দেখা দেওয়ার অনুমতি দেননি। তাও আরও সরে এলেন নিকুঞ্জবাবু। একেবারে দরজার পাশে। নিজের জন্য অন্যের মায়া, শোক, প্রশংসা শোনার মধ্যে এত আনন্দ!

বিপাশা বলল, ‘ভাগ্য বলে ভাগ্য। এমন বোকাহাঁদা বাড়িওলা কার কপালে জোটে বলো?’

ছেলেটি হাসল। পায়ের ওপর পা তুলে বলল, ‘বোকা বলে বোকা? একেবারে গ্রেট বোকা। সেইজন্যই তো খারাপ লাগছে। বাজনা শুনিয়ে আর চা খাইয়ে হাঁদাটাকে তুমি যেভাবে ম্যানেজ করে রেখেছিলে বিপাশা, ভাড়া দিতে দেরি হলেও টুঁ-শব্দটা করত না। এমন গাধা তুমি কোথায় পাবে?’

বিপাশা খিলখিল করে হেসে উঠল।

‘অ্যাই আস্তে। শুনতে পাবে।’

‘কে?’

‘গাধা বাড়িওলার গাধা ভূত।’

এবার দুজনেই মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসতে লাগল।

নিকুঞ্জবাবু ছাদে। বেলা হল, রোদ কড়া হচ্ছে। নিকুঞ্জবাবু পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন। পাঁচিল টপকে তাকালেন নীচে। অনেক মানুষ। কাচের গাড়ি এসে গেছে। দুই ছেলে সেই গাড়ি ফুল মালা দিয়ে সাজাচ্ছে চোখের জল মুছতে মুছতে। আহা রে! ঝুমুর আর পুত্রবধূদের অবস্থা আরও খারাপ। নতুন ধুতি পাঞ্জাবিতে মৃতদেহ সাজাতে সাজাতে কেঁদে ভাসাচ্ছে। চদন পরাচ্ছে বিপাশা। ভারী যত্ন করে পরাচ্ছে। নিকুঞ্জবাবু অবাক হলেন, এই মেয়ের এত গুণ!

সুরমা ইতিমধ্যে বার কয়েক ফিট গেছে। কাজল, আর বুলি তাকে সামলাচ্ছে। নিকুঞ্জবাবু স্ত্রী ফিট যাওয়ার ঘটনায় চিন্তিত। এটা ঠিক নয়। শোকের জন্য নিজেকে অসুস্থ করা মোটে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সুরমাটা কোনওদিনই নিজের দিকে খেয়াল রাখে না।

নিকুঞ্জবাবু হাত উলটে ঘড়ি দেখলেন। সময় ফুরিয়ে এসেছে। এবার যাওয়ার পালা। দেরি করলে ‘উনি’ রাগ করবেন। দেরি করার দরকারও নেই। দেখাশোনা সবই হয়ে গেছে। খানিক আগে পুরনো অফিসেও ঢুঁ মেরেছিলেন তিনি। একেবারে লিফটে চেপে সোজা অ্যাকাউন্টসে। কত বছর যে এই ডিপার্টমেন্টে কাটিয়েছেন। টেবিল, চেয়ার, ফাইল সব জায়গাতেই মায়া পড়ে আছে।

সুদীপ্ত নিজের টেবিল থেকে চিৎকার করে বলল, ‘খবর পেয়েছ অম্বরীশ, পাঠকদা গেছেন।’

উলটোদিকের টেবিলে বসে অম্বরীশ ফাইল ঘাঁটছিল। মুখ তুলে বলল, ‘কোথায় গেলেন?’ সুদীপ্ত হাত তুলে আকাশ দেখাল। অম্বরীশ হেসে উঠল।

অম্বরীশ বলল, ‘যাক নিজে বাঁচলেন, আমাদেরও বাঁচালেন। সপ্তাহে সপ্তাহে এসে আর জ্বালাবেন না। রিটায়ার্ড লোকগুলোর এই হয়েছে সমস্যা। ভাবে তাদের মতো অন্যদেরও বুঝি কাজকর্ম নেই।’

সুদীপ্ত হাসতে হাসতে বলল, ‘বাপু হে, কাউকে পাঠিয়ে তাড়াতাড়ি একটা মালা ঘুষ দিয়ে এসো। ভূত হয়েও যেন আর এদিক মুখো না হয়।’

নিকুঞ্জবাবু পাঁচিলের ধার থেকে সরে এলেন। এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। ঠিক তখনই হালকা পায়ের আওয়াজ তুলে ছাদে উঠে এল আদু। চার বছরের ছোট্ট আদু। নিকুঞ্জবাবুর আদরের নাতি।

নিকুঞ্জবাবু থমকে দাঁড়ালেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল আদুও। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, ‘দাদু, তুমি! তুমি এখানে!’

নিকুঞ্জবাবু চমকে উঠলেন। আদু তাঁকে দেখতে পাচ্ছে! কী করে পাচ্ছে! ‘উনি’ তো সেই ক্ষমতা দেননি। বরং বারবার বলে দিয়েছেন, ‘মনে রাখবেন নিকুঞ্জবাবু, আপনি দেখবেন, কিন্তু আপনাকে কেউ দেখতে পাবে না। আপনি চাইলেও পাবে না। মরা মানুষকে জ্যান্ত দেখা গেলে সে এক কালোরি কাণ্ড হবে। নিয়মকানুন সব উলটেপালটে যাবে।’

তা হলে কী হল! ছোট্ট আদুর বেলায় নিয়ম কি উলটেপালটে গেল?

আদু দু’-পা এসে নিকুঞ্জবাবুর ডান হাতটা ধরল। সেই নরম আঙুল! সেই গরম গরম ছোঁয়া : নিকুঞ্জবাবুর শরীর কেঁপে উঠল। মৃত শরীরে প্রাণের কাঁপন!

‘ছাদে কী করছ দাদু?’

নিকুঞ্জবাবু নিচু হয়ে নাতির মুখের কাছে মুখ নিয়ে হেসে বললেন, ‘কিছু নয় রে বেটা। চলে যাওয়ার আগে বাড়িটা একবার ঘুরে নিচ্ছি।’

আপু আবদারের ঢঙে বলল, ‘না, তুমি যাবে না।’

‘ছি সোনা, অমন বলতে নেই।’

‘যাবে না, যাবে না, যাবে না।’

নিকুঞ্জবাবু হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘নীচে সবাই অপেক্ষা করছে। গাড়ি এসেছে, ফুল এসেছে।’

‘করুক, তোমাকে আমি ছাড়ছি না। এসো তুমি আর আমি ঘুড়ি ওড়াই। তুমি কিন্তু লাটাই ধরবে, এই বলে রাখলাম।’

দাঁত চেপে নিজেকে সামলালেন নিকুঞ্জবাবু। তিনি কি এইটুকু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন?

‘ও কথা বললে কি হয় বাবা? সময় হলে তো যেতেই হবে। তা ছাড়া দেরি করলে উনি যে রাগ করবেন দাদুভাই।’

ছোট্ট আদু তার চোখের ছোট্ট জল মুছে বলল, ‘উনি কে দাদু?’।

নিকঞ্জবাবু নাতির মাথায় হাত রাখলেন। প্রশ্ন এড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘ভাল থেকো বাবা। দুষ্টমি কোরো না। মা’র কথা শুনবে, কেমন?

আদু ঘাড় কাত করল। বলল, ‘আবার আসবে তো?’

নিজের মৃত্যুতে মানুষ কখনও কাঁদে? কখনও কাঁদে না। নিকুঞ্জবাবুর চোখে তা হলে কীসের জল?

‘আসব সোনা, নিশ্চয় আসব।’

নিকুঞ্জবাবু চলে যাচ্ছেন। তাঁর ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে, আর একটু থেকে যাই। আর একটুখানি।

শববাহী গাড়ি স্টার্ট নিল।

পুঃ গল্পটি লেখার পর প্রকাশের আগেই শুনি গল্পের সঙ্গে নাকি সিনেমার কাহিনির কিছু মিল পাওয়া যাচ্ছে। সিনেমাটি আমি দেখিনি। গভীর আগ্রহে সেই গল্পটি তখন শুনি। না, মিল নেই। বাইরের চেহারা দেখে কিছু বিভ্রম হয়েছে মাত্র। আসলে এই গল্পের সঙ্গে যে কাহিনির মিল আছে, সেটি হল,..।

শারদীয় আজকাল, ১৪১৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *