মৃত

মৃত

প্রথম ঘটনাটা ঘটল তিন দিনের মাথায়। তখনও ফ্ল্যাটে বাসি ফুলের গন্ধ। এদিক ওদিক দু’-একটা উপহারের মোড়ক উড়ে বেড়াচ্ছে। বেড়াচ্ছে। আওয়াজ হচ্ছে খচমচ খচমচ।

চোখ খুলেই বাঁধন বুঝতে পারল ভয় করছে। জানা ভয় নয়, অজানা ভয়। ভোঁতা এক ধরনের অনুভূতি। সেই অনুভূতি সারা শরীরে পাক মেরে মেরে তাকে ঘুম থেকে টেনে তুলেছে, তারপর জমাট বেঁধে থমকে দাড়িয়েছে মাথার পেছনে।

বিছানায় উঠে বসে বাঁধন। রাত কত? ঘড়িটা কোন দিকে? মনে পড়ছে না। বরানগরে টেবিল ক্লকটা থাকত খাটের পাশে, অঙ্কুরের পড়ার টেবিলে। কাঁটায় রেডিয়াম জ্বলত। রাতে সময় দেখা যেত না, শুধু একটা আবছায়া সবুজ সবুজ ভাব। এ ঘরেও ঘড়ি আছে। ওয়াল ক্লক। ফ্রেমের গায়ে লতাপাতার নকশা। কিন্তু দেওয়ালটা মনে পড়ছে না, শুধু ফ্রেমের লতাপাতাটা মনে পড়ছে। খানিক আগে পর্যন্ত এসি মেশিনটা ঝিঝি পোকার মতো আওয়াজ করছিল। এখন যেন গোঙাচ্ছে। এসি মেশিনে অভ্যেস নেই বাঁধনের। এরা কি রাতে গোঙায়? কে জানে হয়তো গোঙায়।

বাঁধনের বিয়ে হয়েছে মোটে তিন দিন হল। পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার মতো এখনও এই ঘর অচেনা। অন্ধকারও অচেনা। চোখ সওয়াতে অসুবিধে হয়। মশারির ভেতর থেকে চার পাশে তাকিয়ে বাঁধনের মনে হল, গত দু’দিনের তুলনায় আজকের অন্ধকারটা বেশি। এরকম মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। আজকের অন্ধকার বেশি হবে কেন?

সাত বছরের ছোট হলে কী হবে অঙ্কুর তাকে বারবার সাবধান করেছিল। বলেছিল, ‘দেখিস দিদি, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যেন দুম ধাড়াক্কা ভয় পেয়ে বসিসনি। তুই যা ভিতু।’

কথাটা ঠিক। সুন্দরী মেয়েরা সাধারণত দু’ধরনের হয়। ডাকাবুকো অথবা ভিতু। বাঁধন হল দ্বিতীয় ধরনের। সে একজন শান্ত এবং ভিতু প্রকৃতির মেয়ে। কদিন আগে পর্যন্ত সন্ধের পর বাড়িতে একা থাকার কথা কল্পনাও করতে পারত না। বাবা, মা বা অঙ্কুর কাউকে না কাউকে থাকতেই হবে। একেবারে কিছু না হলে পাশের বাড়ির বুলুকে ডেকে আনত। বলত, ‘বুলু, ঘুগনি হয়েছে, খেয়ে যাবি?’ বুলু হেসে বলত, ‘ঘুগনি খাব, কিন্তু আমি জানি তুমি ঘুগনির জন্য ডাকছ না বাঁধনদি। বাড়িতে নিশ্চয় কেউ নেই।’

বাঁধন ভাইকে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘মারব এক থাপ্পড়। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে খামোকা ভয় পাব মানে?’

অঙ্কুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ভয় মানুষ খামোকাই পায়। নিজেকে দেখে বুঝতে পারিস না? এই ধেড়ে বয়েসে ছায়া দেখে কেঁপে উঠিস, জানলায় খুট শুনে ফ্যাকাশে মেরে যাস, রাতে বাথরুমে যেতে হলে আমাকে ডাকিস— এর কি কোনও কারণ আছে? শ্বশুরবাড়ির গিয়ে যদি একই কাণ্ড করিস, তা হলে তোর নাম হয়ে যাবে ভিতুরানি। সবাই বলবে, ‘এই যে ভিতুরানি, এক গেলাস জল দাও দেখি।’

বাঁধন হাত বাড়িয়ে অঙ্কুরের ডান কনুইতে চিমটি কাটে, ঠোঁট উলটে বলে, ‘বয়ে গেছে ভয় পেতে, ওই ফ্ল্যাট তোমাদের এই বরানগরের বাড়ির মতো ড্যাম্প ধরা নয় যে দেওয়ালে বড় বড় ছায়া পড়বে। ঘরদোর রং করা সব। একেকটা ঘরে একেক রকম রং। মাঝরাতে বাথরুম পেলে উঠোন পেরিয়ে যেতে হয় না। শোওয়ার ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড। ঘরে ঝলমলে আলো। এখানকার মতো অন্ধকার, নোংরা, গা ছমছমে সিঁড়ির তলাও নেই, রান্নাঘরের টিনের চালও নেই। ভুত বাসা বাঁধবে কোথায়?’

অঙ্কুর হাই তুলে গম্ভীর গলায় বলল, ‘জামাইবাবুর সাইজটাও ভাল। মনে হয় না ভূত তার বউকে অ্যাটাক করতে সাহস পাবে। সব দিক দেখেই তো পাত্র পছন্দ করা হয়েছে।’

‘ক্লাস টেনের ছেলের পাকা পাকা কথা। মারব এক চড়।’

বাঁধন হাত তুলে ভাইকে চড় মারতে যায়। অঙ্কুর উঠে পালায়।

অঙ্কুরের কথাটা পুরো ঠিক নয়, আবার পুরো ভুলও নয়। বাঁধনের বাড়ির লোক আগে ছেলে পছন্দ করেনি। ঘটনাটা হয়েছে উলটো। মেয়ে পছন্দ করেছে অতীশ নিজে। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ফটো চেয়ে পাঠিয়েছিল। তারপর এক রবিবার হুট করে এসে হাজির। ব্যাবসার কাজে কলকাতায় এসেছিল। মেয়েও দেখে গেল। সঙ্গে দূর সম্পর্কের এক পিসিকে এনেছিল। তিনি কলকাতায় থাকেন। সে এক অদ্ভুত কাণ্ড। আগে থেকে বলা কওয়া কিছু নেই, একটা টেলিফোন করেনি। প্রমথবাবু বাড়ি ছিলো না। মুদির দোকানে গিয়েছিলেন মাসকাবারি আনতে। অঙ্কুর মোটা টেস্টপেপার হাতে নিয়েই ছুটল বাবাকে খবর দিতে। তাড়াহুড়ো করে ফিরতে গিয়ে ভদ্রলোক হাতেই ডালের ঠোঙা ফাটিয়ে ফেললেন। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে হবু জামাইয়ের সামনে তিনি যখন গিয়ে দাড়ালেন তখন হাত ভরতি মুসুর ডাল!

ঘটনা শুধু এটুকুই নয়, আরও আছে। বাঁধনদের বাড়িতে মাসে একদিন করে রান্নাঘর আর একদিন করে বাথরুম ধোয়া হয়। মৃন্ময়ীদেবী কোমরে আঁচল গুঁজে, হাতে শলা ঝাঁটা নিয়ে সকাল থেকে নেমে পড়েন। ঝাঁটায় বিশ্রী আওয়াজ হয়। সবাই আপত্তি করলেও মৃন্ময়ীদেবী শোনেন না। তার বিশ্বাস ঝাঁটার আওয়াজ ছাড়া বাথরুম, রান্নাঘর সাফ হয় না। সেই রবিবার ছিল রান্নাঘরের পালা। যথারীতি ঝাঁটায় আওয়াজ তুলে রান্নাঘর ধুচ্ছিলেন মৃন্ময়াদেবী। কে এসেছে দেখতে তিনি যখন বেরিয়ে আসেন তখনও হাতে ঝাঁটা। নার্ভাস হয়ে তিনি বেশ কিছুক্ষণ হাত থেকে ঝাঁটা নামাতে ভুলে যান।

এ তো গেল পাত্রীর বাবা-মায়ের অবস্থা, খোদ পাত্রীরও সেদিন ছিল বাজে পরিস্থিতি। তার চলছিল জ্বর। দু’দিন স্নান নেই। চোখ মুখ বসা, চুল উসকো খুসকো। খাটে চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি দিয়ে পড়ে ছিল বেচারি। তাকে ডেকে তুলে যখন বলা হল ‘ওরে তোকে দেখতে এসেছে’ তখন তার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, চোখ দুটো লাল।

তবে ‘মেয়ে দেখা’ বেশিক্ষণের হল না। অতীশ বাঁধনকে বলল, ‘জ্বর কত?’

বাঁধন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এ বাড়িতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জ্বর মাপার রীতি নেই। থার্মোমিটারে জ্বর দেখা হয়েছিল, সেই আগের দিন। বাঁধন বুঝতে পারছিল না সেটা বলা। কি ঠিক হবে? ছেলে বলল, ‘চোখ দেখে মনে হচ্ছে একের ওপর। যান শুয়ে পড়ুন। বেশি করে জল খাবেন। ভাইরাল ফিভারে রেস্ট আর জল শরীরের পক্ষে ভাল।’

বাঁধন দুর্বল শরীরে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। চোখ বুজেই বুঝতে পারে, বয়স্ক, কালোকুলো মানুষটাকে তার পছন্দ হয়ে গেছে। কেমন সুন্দর করে বলল, ‘যান শুয়ে পড়ুন। বেশি করে জল খাবেন।’ স্বামী এরকমই হওয়া উচিত। অল্প কথার মানুষ আর কেয়ারিং। আর কী পার্সোনালিটি! জল খেতে বলছে না তো যেন অর্ডার করছে। ভেদামারা, মিনিমিনি পুরুষমানুষকে আর যেভাবেই ভাবা যাক না কেন, স্বামী হিসেবে ভাবা অসহ্য। মানুষটা কী করে বুঝল তার জ্বর একের ওপর? চোখ দেখে জ্বর বোঝা যায়? থার্মোমিটারটা এনে একবার মেপে দেখলে কেমন হয়? থাক কেউ দেখে ফেললে একটা লজ্জার ব্যাপার হবে।

ছেলে এবং পিসিমা সে দিনই ‘হ্যাঁ’ বলে গেল।

পাত্রের বয়স বেশি বলে মৃন্ময়ীদেবীর খুঁতখুঁতানি ছিল। শুধু বয়স বেশি নয়, ছেলে দেখতে শুনতেও তেমন নয়। চেহারায় একটা থলথলে ভাব। প্রমথবাবু সেই কথা শুনে এই মারেন তো সেই মারেন।

‘ছেলের আবার চেহারা কী? অ্যাঁ। জামাই কি তোমার ফিল্মে নামবে? ইনকামটা দেখেছ? কত বড় ব্যাবসা। ফ্ল্যাট, গাড়ি সব আছে। কলকাতাতেও একটা ফ্ল্যাট কিনবে প্ল্যান আছে। তবে? আর কী চাই?’

মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘তবু বয়সটা দেখবে না? বাঁধনের সঙ্গে ডিফারেন্স কত হচ্ছে বলো তো? চোদ্দো-পনেরো তো হবেই। নাকি তার থেকেও বেশি?’

ক্রুদ্ধ প্রমথবাবু বললেন, ‘যতই হোক, যত খুশি হোক। চোদ্দো-পনেরো কেন, একশো, পাঁচশো হলেও কিছু এসে যায় না। স্বামী বয়েসে বড় হওয়াটাই মঙ্গল। চ্যাংড়াদের মতো পিঠোপিঠি বিয়েতে কী কাণ্ড হয় দেখোনি? ঘরে ঘরে ডিভোর্স। আগেকার দিনে এসব ছিল না। তখন নিয়ম ছিল, স্বামী বয়েসে বড় হবে। স্ত্রীকে বকাঝকা দেবে, সেরকম হলে দু’-একটা চড়ও লাগাতে হবে। মৃন্ময়ী, জেনে রাখবে সংসার টেকে শাসনে, চ্যাংড়ামিতে নয়। তা ছাড়া আরও একটা সুবিধে আছে।’

মৃন্ময়ীদেবী চোখ বড় করে বলেন, ‘কী সুবিধে?’

প্রমথবাবু ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে আর কেউ নেই। বাবা, মা মরেছে ছেলেবেলায়। আত্মীয়স্বজন বলতে শুধু ওই পিসি। তাও থাকে কলকাতায়। ঘটনা বুঝতে পারছ মৃন্ময়ী? সংসার শুধু তোমার মেয়েরই হবে। এমন চান্স তুমি কোথায় পাবে?’

মৃন্ময়ীদেবী কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কথাটা ঠিক। শ্বশুর-শাশুড়ির হ্যাপা হল ভয়ংকর হ্যাপা। এ ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে বাঁধন সেই হ্যাপা থেকে রক্ষা পাবে। এটা সত্যি একটা সুযোগ।

‘তাও তুমি একবার বাড়ি ঘরদোর দেখে এসো বাপু। একেবারে অচেনা ঘরে মেয়ে পাঠাবে? তার ওপর অত দূর।’

‘অত দূর! আজকাল বিয়ে করে মেয়েরা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে, আর তুমি এক রাতের ট্রেন জার্নিকে বলছ অত দূর। হাসালে মৃন্ময়ী। ছেলে দেখেছি, এবার ছেলের ঘরও দেখব। তুমি আমি দু’জনে গিয়েই দেখব। অতীশ তো নেমন্তন্ন করেই গেল, ভেরি ফেয়ার। এই শনিবারই চলো। এ জিনিস ফেলে রাখার নয়। ফেলে রাখলে হাতের কার্তিক, গণেশ একসঙ্গে পায়ে ঠেলা হবে।

মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘তোমার দেখি বেশি উৎসাহ, আমি কিন্তু বাপু জামাইয়ের বাড়িতে থাকতে পারব না।’

স্ত্রীর মুখে ‘জামাই’ শুনে খুশি হলেন প্রমথবাবু। অল্প হেসে বললেন, তা কেন? হোটেলে উঠব, বিকেলে গিয়ে ঘুরে আসব একবার। পর দিন সকালেই ব্যাক। সেইমতো টিকিট করে নিচ্ছি। তবে সে সবের আগে মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। তার মতটাও দেখতে হবে। পরে যেন কিছু না বলে।’

বাঁধন কিছুই বলল না। মায়ের প্রশ্নে মুখ নামিয়ে শুধু ঘাড় নাড়ল। লজ্জায় তার গাল চিকচিক করে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, ‘মা, থার্মোমিটারটা দাও তো দেখি জ্বর কত। আমার তো মনে হচ্ছে জ্বর এক-ই হবে। তোমার কী মনে হয়?

মৃন্ময়ীদেবী রেগে বললেন, ‘আমার কিছু মনে হয় না।’

হবু জামাইয়ের ওখান থেকে ফিরে মৃন্ময়ীদেবী উত্তেজিত। টানা দু’দিন ধরে বর্ণনা চলল, সঙ্গে উপদেশ।

‘দেখিস বাঁধন, গিজার চালাবি সাবধানে। গরম জলে ছেঁকা খাসনি যেন। ওয়াশিং মেশিনে কাপড় দেওয়ার আগে ভাল করে যন্ত্রটা বুঝে নিবি। হুটহাট এসি চালিয়ে শুবি না। তোর কিন্তু ঠান্ডার ধাত। অতীশ এবার সব ঘরেই এসি লাগিয়েছে। কী যে করে না ছেলেটা, বাড়াবাড়ির একশেষ। আর হ্যাঁ, শোন, বাথরুমে খুব সাবধান। যদিও কাচাকাচির কোনও ব্যাপার নেই। সব আলাদা আলাদা কাজের লোক। তবে স্নানের সময় তেল, শ্যাম্পু ফেলেছিস কী পা হড়কে মরবি। মেঝে মার্বেল পাথরের। এমনি মার্বেল নয়, অতীশ বলল, কুয়েত না বাগদাদের পাথর। এখানকার পাহর হল গিয়ে একেবারে তোর বেস্ট কোয়ালিটির। ময়লা ধরে না।’

এর পরই অঙ্কুর বলে, ‘আঃ মা, পাথরের গল্প থামাবে? দিদির তো পাথরের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে না।’

বাঁধনের বাবা-মা অনুষ্ঠান চেয়েছিল। একবারে ছাঁদনাতলায় পিড়ি বসিয়ে, যজ্ঞ করে বিয়ে হবে। সানাই বাজাবে, লোক খাবে। অতীশ রাজি হয়নি। সে চায় শুধু রেজিষ্ট্রি। পর দিন ভোরেই বউ নিয়ে চলে যাবে।

‘আপনার অনুষ্ঠান করতে পারেন, কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমাকে বাদ দিতে হবে। আমি মনে করি, বিয়ে একটা পারসোন্যাল ম্যাটার। স্বামী-স্ত্রী ছাড়া এর সঙ্গে অন্যদের কোনও সম্পর্ক নেই। তার ওপর ফালতু অনেকগুলো টাকা খরচ। তার থেকে বড় কথা, এখন আমার কাজের চাপ অতিরিক্ত বেশি। সামনে একটা বড় অর্ডার আছে। ইনফ্যাক্ট কাজের জন্যই আমি এতদিন বিয়ের মধ্যে যাইনি, সময় পাইনি। বিয়ের দিনও আমি কলকাতায় কাজ করব। কাজ সেরে আসতে আসতে সন্ধে। আশা করি আপনারা আমাকে অনুমতি দেবেন।’

ফেরার পথে ট্রেনে মৃন্ময়ীদেবী মুখ শুকনো করে স্বামীকে বললেন, ‘এ কীরকম কথা গো। একটা মাত্র মেয়ে, বিয়েতে আচার অনুষ্ঠান হবে না।’

প্রমথবাবু স্ত্রীকে চড়া গলায় বললেন, ‘ভাল কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয় মৃন্ময়ী। এই ছেলে একটু ভাল নয়, অতিরিক্ত ভাল। সে শুধু অনুষ্ঠান বাদ দিল না, শ্বশুরমশাইয়ের গাদাখানেক টাকাও বাঁচিয়ে দিল।

বিয়ে হল চুপচাপই। অতীশ যেমন চাইল। শুধু রেজিষ্ট্রি। অতীশের দিকের আত্মীয়স্বজন বলতে পিসিমা ছাড়া দু’-একজন। একটা দিন কলকাতায় থেকে পরদিন ভোরেই নতুন বউ নিয়ে রওনা দিল অতীশ।

এসি মেশিনের গোঙানিটা বেড়েছে। যেন এই হঠাৎ জেগে ওঠা নবপরিণীতাকে কিছু বলতে চাইছে, পারছে না বলে গোঙাচ্ছে। বাঁধন মনে সাহস আনার চেষ্টা করল। লাভ হল না। মনে হল, আর একটু পরেই বাইরের অন্ধকার এবার মানুষের মতো মশারি তুলে ভেতরে ঢুকে পড়বে। অতীশের দিকে তাকাল। অন্ধকারে ঘুমন্ত মানুষটাকে মনে হচ্ছে ছায়া। মাথা, হাত-পা, পিঠ সব ছায়া। কাপা গলায় বাঁধন ডাকল—

‘অ্যাই শুনছ? শুনছ? উঠবে একবার?’

অতীশ শুনল না। উলটো দিকে মুখ করে শুয়েই রইল। প্রথম রাত থেকেই অতীশ উলটো দিক ফিরে শোয়। অথচ স্বামী স্ত্রীর প্রথম রাত নিয়ে কতরকম গল্প শুনেছে বাঁধন। তার মুখোমুখি শুয়ে সারারাত ফিসফিস করে কথা বলে। সিরিয়াস কিছু নয়, হাবিজাবি সব কথা বলতে বলতে দু’জন দুজনকে আদর করে। কখনও চাপা গলায় হাসে, কখনও রাগ করে। সব শেষ করে যখন ঘুমোতে যায় তখন দেখে, রাত ফুরিয়ে গেছে, বাইরে আলো!

বাঁধনের বেলায় এরকম কিছুই হয়নি। যা হয়েছিল তা যেমন অদ্ভুত, তেমন ভয়াবহ রকমের অপমানের। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষটা সম্পর্কে বাঁধনের ধারণা নড়ে গিয়েছিল।

বউভাত বলে আলাদা করে কিছু হয়নি, শুধু রাতে অল্প কয়েক জনের খাওয়ার ব্যবস্থা। সবাই ব্যাবসার লোক। ফ্ল্যাটটা শহর থেকে খানিকটা দূরে। জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা। দুম করে রাত নামে। সবাই তাড়াহুড়ো করল। দশটা বাজতে না বাজতেই ফ্ল্যাট ফাঁকা। বাঁধনকে নিয়ে। খেতে বসল অতীশ। বাঁধন কিছুই মুখে তুলতে পারল না। খুঁটে খুঁটে প্লেট সরিয়ে রাখল।

অতীশ উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পুডিং বের করে আনে। নরম গলায় বলে, ‘একটু খাও। সারাদিন ধকলের পর একদম খালি পেট ভাল না। ঠান্ডা জিনিস, দেখো, ভাল লাগবে।’

ঠান্ডা কিছু বাঁধন খায় না। গলায় ব্যথা করে। কিন্তু পুডিং খেল। মনে হল অমৃত!

ডিনার শেষ হলে অতীশ বলল, ‘হালকা কিছু মিউজিক শুনবে বাঁধন? বাঁশি? হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া শুনতে পারো। ঘুমের আগে হালকা মিউজিক ঘুমের জন্য ভাল। স্টিমুলেশনের কাজ করে।’ বাঁধন চুপ করে রইল। কী উত্তর দেবে সে বুঝতে পারছে না। সে শুধু মুগ্ধ। মুগ্ধ মানুষ কথার উত্তর দিতে পারে না। অতীশ বলল, ‘বাজনা শুনতে ইচ্ছে না করলে, বই দেখতে পারো। গত মাসে ছবির ওপর একটা কালেকশন নিয়েছি। ক্লাসিকাল পেইনটিংস। মাটিস, টিনটোরেটো, রাফেল। নাম শুনেছ?’

বাঁধন মাথা নামিয়ে লাল বেনারসির আঁচলে আঙুল পাকাতে পাকাতে মাথা নাড়ল। অতীশ সামান্য হেসে বলল, ‘অসুবিধে কিছু নেই, শুনে নেবে। অনেক সময় পাবে। আমার এখানে কাজের লোকেরা সকাল সকাল কাজ সেরে চলে যায়। তারপর গোটা দিন ইউ উইল গেট প্লেনটি অব টাইম।’

বাঁধন যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। গদগদ মুখে বসে ছিল, আর ভাবছিল ‘এত সুন্দর! আমার বর এত সুন্দর!’

তখনও সে জানত না সুন্দর মানুষটা খানিকক্ষণের মধ্যে বদলে যাবে।

অতীশ বিছানায় উঠেছিল পায়জামা পাঞ্জাবি পরে। ধূসর রঙের পাঞ্জাবি। বুকের কাছে সুতোর কাজ। বাঁধন বেনারসি ছাড়েনি। ছেড়ে হালকা কিছু পরলে হত। অতীশ হাই তুলল। হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে স্বাভাবিক গলায় বলল, নাও, কাপড় খোলো। অনেক রাত হয়েছে। কাল আবার সকালে বেরোনো।’

বাঁধন চমকে উঠল। মুখ ফেরাল স্বামীর দিকে। সে কী শুনছে!

অতীশ শান্ত গলায় বলল, ‘শাড়ি-টাড়ি খুলে মাটিতে ফেলে দাও। সাবধানে ফেলবে, মশা না ঢোকে। এদিকটায় মশা বেশি। এসি চালালেও মশারি লাগে।’ বাঁধন নিথর হয়ে বসে রইল। এ কেমন কথা! কাপড় খোলো! অতীশ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘দেরি করছ কেন?’

বাঁধন শিউরে উঠল। ভালবাসা কই? আদর সোহাগ কই? প্রথম দিন স্ত্রীকে কেউ এমনভাবে বলে নাকি! মনে হচ্ছে স্ত্রী নয়, সে একটা বেশ্যা। ভাড়া করা বেশ্যা।

অতীশ এবার কঠিন গলায় বলল, “শুনতে পেলে না কী বললাম?

বাঁধনের কান্না পেল। সে মুখ ফিরিয়ে নিচু গলায় বলে, “আমার শরীর ভাল নেই।’

‘কী হয়েছে? জ্বর?’

‘না বমি পাচ্ছে।’

‘যাও, বাথরুমে গিয়ে বমি করে এসো, আমি অপেক্ষা করছি। সায়া ব্লাউজ খুলে ঘরে আসবে। আমি দেখব।’

এবার অতীশের গলা যেন খানিকটা হিংস্র। চোয়াল শক্ত। দাতে দাত ঘষার শব্দ হল কি?

বাথরুমে গিয়ে বাঁধন বেসিনের কল খুলে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। এ কোন মানুষের সঙ্গে বিয়ে হল তার! এসব কী কথা! সায়া ব্লাউজ খুলে ঘরে আসবে! কীভাবে আসবে? উদোম হয়ে? ঘরে ঝলমল করছে আলো। নিয়ন তো আছেই, সিলিং-এ ঝোলানো ছোট, বাহারি ঝাড়টাও জ্বলছে। আলো না থাকলেই বা কী হত? ওইভাবে হেঁটে আসত অচেনা মানুষটার সামনে? ছি ছি। সভ্য, সুস্থ কোনও মানুষ এমন কথা বলতে পারে? যদি সে রাজি না হয়? মনে হচ্ছে, মানুষটা জোর করবে। শাড়ি টেনে খুলবে। ব্লাউজ ছিড়বে। তারপর? না গো!

কল থেকে ঝরে পড়া জলে হাত রেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠল বাঁধন। কাঁদতে কাঁদতে সে কাঁধের ওপর লাগানো ক্লিপটা খুলতে থাকে। শাড়ির আঁচল নামিয়ে জামার বোতামে হাত রাখে। রেখে থমকে যায়। সে পারবে না, মরে গেলেও পারবে না। বেসিনের ওপর ঝুঁকে পড়ে বাঁধন।

বমি হল না। মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাঁধন ঘরে এসে দেখল, অতীশ ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মুখ উলটো দিকে ফেরানো।

শরীর জোড়া অপমান নিয়ে ফুলশয্যার রাতটা জেগে কাটিয়ে ছিল বাঁধন। অতীশ বিছানায় কোনও ফুল দিতে দেয়নি। ফুলের গন্ধে নাকি তার মাথা ধরে। মৃন্ময়ীদেবী সন্ধেবেলায় কলকাতা থেকে ফোন করেছিলেন। খাটে ফুল দেওয়া হয়নি শুনে অবাক গলায় বলেছিলেন, এটা কেমন কথা? ফুলশয্যার দিন বিছানায় কোনও ফুল থাকবে না?’

বাঁধন শুকনো হেসে বলেছিল, ‘থাক মা, উনি যখন চান না। সব মানুষ কি একরকম হয়?’

সব মানুষ যে একরকম হয় না, বাঁধন তার পরের দুটো দিনে আরও বুঝেছে। দিনে নয়, বুঝেছে রাতে। অতীশ আর একদিনও ওসব কথা বলেনি। সারাদিন স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। রাতে বাড়ি ফিরে ডিনার সেরে, বসার ঘরে ব্যাবসার কাজ সেরেছে কম্পিউটারে। তারপর এসে শুয়ে পড়েছে। পড়েই নিঃসাড়ে ঘুমিয়েছে। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত যেন। বাঁধন জেগে অপেক্ষা করেছে। ভেবেছে, এই বুঝি অতীশ জেগে উঠবে। আলতো ছুঁয়ে দিয়ে বলবে, সরি, সেদিন মজা করেছিলাম। এসো, কাছে এসো।’

অতীশ জাগেনি। একসময় ঘুমিয়েও পড়েছে বাঁধন।

আজ অতীশ বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই বিপাশা ফোন করল। বিপাশা কলেজ ছেড়েছে অনেক দিন, কিন্তু এখনও কলেজ বয়েসের ফাজলামি ছাড়েনি। ফোন ধরেই হড়বড় করে বলতে শুরু করল—

‘অ্যাই, বাঁধন কিচ্ছু সেন্সর করবি না, একটা সিনও না। কী হল সব বল। সেই ফুলশয্যা থেকে শুরু কর।’

বাঁধন লজ্জা পেয়ে বলল, ‘দুর, কী যে বলিস না। ওসব কিছু হয়নি।’

বিপাশা অবাক গলায় বলল, ‘ওমা হয়নি কী রে! তমাল তো প্রথম রাতেই এমন কাণ্ড করল যে দুটো ট্যাবলেটেও তিন দিন গায়ের ব্যথা মরে না। হটব্যাগ, আইসব্যাগ সব লাগল। হি হি।’

বাঁধন গাঢ় গলায় বলল, যাঃ খালি ফাজলামি। সবাই কি তোদের মতো? তোদের ছিল প্রেমের বিয়ে, চেনা মানুষ। আমাদের চিনতে বুঝতে সময় লাগবে না? তা ছাড়া এই মানুষটা অন্যরকম। খুব গম্ভীর। একটু রাগীও। মনে হয় একা থাকতে থাকতে এরকম হয়ে গেছে। সারাদিন ঠিক আছে। রাতে শুয়েই ঘুম। তাও আবার উলটো পাশ ফিরে।’

বিপাশা গলা গম্ভীর করে বলল, ‘রাগী লোকেরা কিছু করে না তোকে কে বলল বাঁধন?’

বাঁধন এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, ‘না রে সত্যি বলছি। এখনও…। মনে হয় সারাদিন খাটাখাটনিতে ক্লান্ত থাকে।’

বিপাশা হাসতে হাসতে বলল, ‘ও কিছু নয়। প্রথম প্রথম ওরকম হয়। ক’দিন পরে দেখবি ওহ লোক তোর কী কাণ্ড করে, মাই ডিয়ার ঘুম ভাঙানোর ব্যবস্থা করো। পাশ ফেরাও সোনা।’

‘ব্যবস্থা? সেটা কী!’

বিপাশা হাসতে হারতেই ফিসফিস করে ব্যবস্থা’ বলে। টেলিফোনেই কান গরম হয়ে উঠল বাঁধনের। সে হাত তুলে বলল, একটা চড় খাবি অসভ্য কোথাকার। ছি ছি আমি ওসব পারব না।’

পায়ের কাছে ঘরের একমাত্র জানলাটা বন্ধ। বাইরের আলো যে চলকে ঢুকবে তার উপায় নেই। একটা আবছা আলোর মতো থাকলে হয়তো এতটা ভয় হত না। কাল সকালে অতীশকে নাইট ল্যাম্পের কথা জিজ্ঞেস করেছিল বাঁধন। অতীশ তখন অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি। সুটের ওপর টাই বাঁধছে।

‘রাতে ঘরে কোনও আলো জ্বলে না?’

আয়না থেকে ঘুরে দাঁড়াল অতীশ। বলল, ‘রাতে আলো! রাতে আলো কীসের? রাত তো অন্ধকার।’

‘ঠিক আলো নয়, ওই যে নাইটল্যাম্প, কম পাওয়ারের, আছে না? আমাদের বরানগরের বাড়িতে ছিল। আমি আর অঙ্কুর যে ঘরে শুতাম সারারাত জ্বলত। একেবারে সেই ভোর পর্যন্ত।’ বাঁধন উৎসাহের সঙ্গে বলে।

মুখ ঘুরিয়ে অতীশ আবার টাইতে মন দেয়। গম্ভীর গলায় বলে, বাঁধন, এটা বরানগরের বাড়ি নয়। একেকটা বাড়ির একেকটা অভ্যেস। তোমাদের অভ্যেস আলো। আমার অভ্যেস অন্ধকার।’

বাঁধন ঢোক গিলে বলল, নতুন জায়গা তো, এখনও ভাল করে চিনি না।’

হাতে গাড়ির চাবি তুলে অতীশ বলে, ‘চিনে নেবে। একদিনে সব চেনা যায় না।’

আর নাইটল্যাম্পের কথা তোলেনি বাঁধন। তবে ফাজিল বিপাশার ‘ঘুম ভাঙানোর ব্যবস্থা শুনতে শুরু করল পরের দিন থেকে। তবে পুরোটা নয়, খানিকটা। বিপাশা চাদরের কথা বলেনি। বাঁধন তবু চাদর নিয়েছে। লজ্জা করেছে। অতীশ ঘুমিয়ে পড়ার পর, চাদরটা টেনে নিয়ে অন্ধকারেই নিজের পোশাক খুলেছে। বিপাশা বলেছিল, ‘লজ্জার কী আছে? তোর বর? নাকি অন্য কেউ? গাধা একটা। সেজেগুজে মটকা মেরে পড়ে থাকবি, দেখবি মুখ ফেরানো মানুষ মাঝরাতে উঠে তোকে ওই অবস্থায় পেয়ে কী ঝামেলা পাকায়। আর শোন, একটু ওদিকে ঘেঁষে শুবি। ঘুমের ঘোরে অতীশদার হাত যেন ঝপাং… হি হি।’

অপেক্ষা করা না ’মটকা মারা’? বাঁধন জানে না। তবে অপেক্ষা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল ভয়ের কারণে।

বাঁধন আবার অতীশকে ডাকল। এবার জোরে।

‘এই যে, এই যে শুনছ? উঠবে একবার? ওঠো না।’

ভয়টা বাড়ছে। এতক্ষণ মনে ছিল না, নড়তে গিয়ে বাঁধনের মনে পড়ল, তার গায়ে কিছু নেই। সে নগ্ন। চাদরটা গলার কাছে এক হাতে চেপে ধরে স্বামীর দিকে সরে গেল। আর তখনই শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল তার। শিউরে উঠল বাঁধন। মনে হল, ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা মানুষটা ঘুমিয়ে নেই, মানুষটা মরে আছে! সাড়াহীন, স্পন্দনহীন, শ্বাস-প্রশ্বাসহান একটা মরা মানুষ শুয়ে আছে পাশে!

ছিটকে সরে এল বাঁধন। দ্রুত হাতে মশারি সরিয়ে খাট থেকে নামতে গিয়ে হোঁচট খেল। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাড়াতে গিয়ে বুঝল পা কাপছে। দুটো পা-ই কাঁপছে থরথর করে। মেঝেতে পড়ে যাওয়া চাদরটা বুকের ওপর টেনে তুলল কোনওরকমে। খানিকটা জমাট বাঁধা অন্ধকার দিয়ে শরীরটা ঢাকল যেন! কী করবে এখন? কী করবে সে? কোথায় যাবে? পালাবে? আলোর সুইচগুলো কোথায়? কোন দেওয়ালে? বাঁ দিকে? না ডান দিকে? ঘরের দরজাটা? মনে পড়ছে না। কিছু মনে পড়ছে না। এক-একটা মুহূর্ত মনে হচ্ছে অনন্ত মনে হচ্ছে যুগের পর যুগ কেটে যাচ্ছে। শীতে কেঁপে কেঁপে উঠল বাঁধন। একটা কিছু করতে হবে। কী করতে হবে জানা নেই, কিন্তু করতে হবে। প্রায় মরিয়া হয়ে বাঁধন ঝাপিয়ে পড়ল পাশের দেওয়ালে, সারি দিয়ে সাজানো অসংখ্য সুইচের ওপর। আলোর সুইচ না, হাতে যেন চাদ পেল। এক মুহূর্ত দেরি না করে সুইচগুলো পরপর টিপতে লাগল বাঁধন। আলো জ্বলে উঠতে লাগল একটার পর একটা। প্রথমে দেওয়ালে সাজানো নিয়নগুলো, তারপর দরজার পাশে রাখা বাহারি শেডের আলো, একেবারে শেষে ঘরের মাঝখানের ঝাড়বাতিটা। আলোকোজ্জ্বল ঘরে, দেওয়ালের দিকে মুখ করে বাঁধন হাঁপাচ্ছে। গোটা শরীরটা কাঁপছে তার। হাতের চাদরটা আবার কখন মাটিতে পড়ে গেছে খেয়াল নেই।

‘এসব কী হচ্ছে! মাঝরাতে আলো জ্বেলে কী করছ বাঁধন?’

বাঁধন চমকে মুখ ফেরাল।

মশারির ভেতর অতীশ উঠে বসেছে। তার চোখ বিস্ফারিত।

পরের ঘটনাটা ঘটল এরও সাত দিন পর।

গোটা সপ্তাহটা বাঁধন কাটিয়েছে দারুণ লজ্জার মধ্যে। অতীশ কিন্তু বিষয়টা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। তার আচরণ ছিল আগের মতোই স্বাভাবিক, সহজ। যেন কিছুই ঘটেনি। অথবা ঘটলেও তা একেবারেই স্বাভাবিক কিছু। আতঙ্কের সেই রাতে আবার শুতে শুতে শান্ত গলায় বলেছিল, ‘আলোগুলো নিভিয়ে দাও বাঁধন। রাতে এরকম করলে আমার সমস্যা হবে। মনে রেখো, সকালে উঠতে হয় আমাকে। শোওয়ার আগে গায়ে কিছু পরে নিয়ে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

পর দিন থেকে শুধু নাইটি নয়, একেবারে হাউসকোট জড়িয়ে শুল বাঁধন। হাউসকোটের কোমরে দড়ি। উঠতে বসতে নিজের ওপর ভারী রাগ হল। ছি ছি, ছেলেমানুষের মতো ভয় পেয়ে কী কাণ্ডটাই না করল! একেবারে একঘর আলোর মাঝখানে… না, মানুষটা সত্যি খুব। ভাল। অন্য কেউ হলে তখনই জন্তুর মতো হামলে পড়ত। একটুও বুঝতে চাইত না। হয়তো বিছানা পর্যন্ত আসারও সময় দিত না। ঠান্ডা মেঝেতেই…। অথবা পরদিন সকাল থেকেই শুরু হত হাসিঠাট্টা। সত্যি সত্যি ডাকত ‘ভিতুরানি, এক গ্লাস জল দেবে?’

অতীশ সে সব কিছু তো করেইনি, বরং সকালেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে টেলিফোন করছে। বন তখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে। টোস্টে মাখন লাগাচ্ছে। বসার ঘর থেকে গলা তুলে অতীশ জিজ্ঞেস করল, ‘কী রঙের নাইটল্যাম্প লাগাবে? ব্লু না গ্রিন?’

বাঁধন লাজুক গলায় বলল, ‘যা খুশি।’

‘তোমার বরানগরের বাড়িতে কী ছিল? গ্রিনটা একটু হার্ড হয়ে যাবে। ঠিক আছে ব্লু-ই বলছি।’

নাইটল্যাম্পের আবছা নীল আলো বাঁধনের চেনা। বরানগরের ঘরে জ্বলতা এক ধাক্কায় বাঁধনের ভয় ভাঙিয়ে দিল এই চেনা আলো। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠল বাঁধনের। মনে মনে প্রথম রাতের বিশ্রী অপমান ক্ষমা করে দিল সে। পরপর কটা দিন বড় নিশ্চিন্তে, নির্ভয়ে ঘুম হল। শনিবার রাতে খেতে বসেই বাঁধন ঠিক করল, আর নয়, অনেক হয়েছে। যদি অতীশ তার ঘুমের আগেই শুতে আসে ঠিক আছে। আর যদি দেরি করে তা হলে মাঝরাতেই ঘুম ভাঙাবে। বাকি রাতটা জ্বালিয়ে মারবে। তারপর ভোর হলে চুপিচুপি ফোন করবে বিপাশাকে। এটা সেটা বলার পর সহজভাবে জিগ্যেস করবে, ‘হ্যাঁরে গায়ের ব্যথা কমানোর ট্যাবলেটের নামটা কী যেন বলছিলি?’

সে দিন ঘুম ভেঙেছিল মনের ভয়ে, আজ বাঁধনের ঘুম ভাঙল শরীরের উত্তেজনায়। চোখ খুলে দেখল, নীল নাইটল্যাম্পে সবকিছুই কেমন নীল নীল লাগে। বালিশ, বিছানা, মশারি, এমনকী ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা ঘুমন্তু স্বামীকেও। মনে মনে বাঁধন হাসল। রেগে যাবে? যাক। হাউসকোটটা কি আগেই খুলে রাখবে? না, থাক। বরং ঘুম থেকে তুলে অতীশকে ফিসফিস করে বলবে, “তুমি খোলো, আই চোখ বুজে খুলবে কিন্তু।’

কাছে সরে এসে উলটো মুখে শোয়া অতীশের গায়ে হাত রাখল বাঁধন। শরীরে শরীর লাগতেই ভেতরে কোথায় যেন বেজে উঠল। কী বাজল? বাঁশি? মিলনের আগে বুঝি ভেতরে এমন করে বাজে? আঃ কী আনন্দ! স্বামীর কাঁধের ওপর হাত নিয়ে মুখ ধরে আলতো টান দিল বাঁধন। সোহাগের টান। নিঃশব্দ রাতে সোনার চুড়িতে আওয়াজ হল। রিনঝিন, রিনঝিন…।

ঘুমন্ত অতীশের মুখের একপাশ কাত হয়ে পড়ল বালিশের এদিকে। নাইটলাম্পের আবছা আলোতেও বাঁধন দেখতে পেল সেই মুখে বীভৎস দুটো চোখ অল্প ফাক হয়ে আছে। মণিগুলো স্থির। মৃত মানুষের নিথর মণি। আর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে গেঁজলা। থকথকে ফেনার জেলা গড়িয়ে পড়ছে নীল আলোর বালিশে! তীব্র আতঙ্কে জ্ঞান হারানোর সময় মানুষ মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ধরনের চাপা আওয়াজ করে। বাঁধন জ্ঞান হারাল নিঃশব্দে।

ক্লিনিকের ভিজিটর্স রুমটা ভারী সুন্দর। নরম আলোর তলায় লম্বা লম্বা সোফা। এক দিকে দেওয়াল জোড়া অ্যাকোয়ারিয়াম। রঙিন মাছেরা জলের আশ্চর্য জগতে খেলে বেড়াচ্ছে। সেখানে পাহাড়, ঝরনা, ডুবন্ত সাবমেরিন। ঘরে বসলে না তাকিয়ে উপায় নেই। প্রমথবাবুও তাকিয়ে আছেন। তাকিয়ে মাছেদের খেলা দেখছেন আর লজ্জায় মরমে মরমে মরে যাচ্ছেন। ছি ছি। মেয়েটা কী কাণ্ড করল! এমন ঘটনা কেউ শুনেছে? স্বামীকে মৃত দেখা! কাল ভোরে অতীশের ফোন পেয়ে মৃন্ময়ীদেবী কাদতে কাদতে যখন তাঁকে ঘটনা বলে তিনি একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন এবং ক্রুদ্ধ হন।

‘থামাও তোমার কান্না। চুপ করে। ছি ছি স্বামীকে মরা ভেবে অজ্ঞান… ভয়েরও একটা সীমা আছে। তোমার মেয়ে সেই সীমা ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেছে। মেয়েকে কী তৈরি করেছ দেখো এবার।’

মৃন্ময়ীদেবী চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমায় কেন বলছ? মেয়ে কি আমার একার। তা ছাড়া তখনই বলেছিলাম, অত বয়স…।’

প্রমথবাবু গলা চড়িয়ে ধমকান, ‘চুপ। একদম চুপ। বড় বড় কথা বোলো না। অমন হিরের টুকরো স্বামী বাধন সাতজন্ম তপস্যা করলেও পেত না। সামান্য কেরানির ঘরের মেয়ে একেবারে রাজরানি হয়েছে। এই ছেলের খুঁত ধরো কোন মুখে? শুনলে তো, অতীশ ঘরে নাইটল্যাম্পের ব্যবস্থা পর্যন্ত করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বউয়ের ভয় কমাতে রাত জেগে পাহারাও দিত। তোমার মেয়ে ছোটবেলা থেকেই এরকম। এই বয়েসেও নড়তে চড়তে ভূতের ভয়। মুখে একেবারে কালি লেপে দিল। কথাটা কাউকে বলা যাবে?’

মৃন্ময়ীদেবী খানিকটা বিড়বিড় করে বললেন, ‘শুধু ভয় নয়, মেয়েদের আরও ব্যাপার

থাকে। তুমি বুঝবে না।’

প্রমথবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী ব্যাপার থাকে? অ্যাঁ? গাড়ি পেয়েছে, বাড়ি পেয়েছে, গান শোনা, বই পড়া বর পেয়েছে তার পরেও ব্যাপার? তোমাকে বলেছে?

‘ওসব কথা মাকে বলা যায়? আভাস দিয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম, পুরুষমানুষের অমন হয়, নিজেই ঠিক হয়ে যায়। যাক, আমিও তৈরি হয়েছি, তোমার সঙ্গে যাব।

প্রমথবাবু এবার বড় ধরনের উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘খেপেছ? দল বেঁধে, ভেড়া বাজিয়ে ভিতু মেয়েকে দেখতে যাব? গিয়ে কী করবে? গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, আহা রে, বাছা, সোনা ভয় পেয়ো না। তোমার বর মরা নয় জীবিত, ওই দেখো কেমন তোমার সামনে হাটছে চলছে?

‘ছি, রাগের মাথায় কী বলছ ঠিক নেই।

‘ছি আমাকে না বলে মেয়েকে বললেই পারতে। তা হলে অতীশের কাছে এইভাবে লস অব ফেস হত না। তুমি কি ভাবছ অতীশ ছেড়ে দেবে? একেবারেই নয়। বলবে পাগল মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছেন। এবার ঘাড়ে করে ফিরিয়ে নিয়ে যান।’

মৃন্ময়ীদেবী বললেন, ‘পাগল!

‘পাগল ছাড়া কী? পাগল না হলে কেউ… তোমরা কেউ যাবে না। তুমি, অঙ্কুর কেউ নয়। আমি একা যাচ্ছি। অতীশের কাছে যা অপমান, গালিগালাজ শুনতে হয় আমি শুনব। যদি বলে মেয়েকে নিয়ে চলে যান, হাত ধরে রিকোয়েস্ট করব। আমি জানি তার পরেও ছেলেটা অপমান করবে। আমি হলেও করতাম।’

অতীশের ব্যবহার একেবারে অন্যরকম হল। প্রমথবাবু অবাক হয়ে গেলেন। স্টেশনে। নিজে গাড়ি নিয়ে হাজির ছিল ছেলেটা। হাতের সুটকেসটা কেড়ে নিল। গাড়িতেই বলল, “চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। বাধনকে আমি এখানকার বেস্ট ক্লিনিকে রেখেছি। ভাক্তাররাও খুব ভাল। ভেরি এফিশিয়েন্ট অ্যান্ড কোঅপারেটিভ। ওঁরা বলছেন নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, অনেক সময় এরকম হতে পারে। তবে গুড নিউজ হল, ইতিমধ্যেই প্রাথমিক ট্রমা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে বাঁধন। জ্ঞান ফেরার পর ওরা স্যুপ দিয়েছিল। মনে হচ্ছে, কাল সকালেই ছেড়ে দেবে। আপনি কিছু খেয়েছেন? আজ রাতটা কিন্তু আমার ওখানেই থাকবেন।’

প্রমথবাবু অস্বস্তি নিয়ে বললেন, ‘না না, আমি হোটেলেই উঠব।’

প্রমথবাবু ঠিক করলেন, ক্লিনিকে ঢুকেই মেয়ের গালে ঠাটিয়ে একটা চড় মারবেন। সে মেয়ে যতই অসুস্থ হোক। মেরে বলবেন, ‘দেখ, মরা স্বামীর দায়িত্ব দেখ হারামজাদি। তোর পিছনে কেমন টাকা ঢালছে। তোর পিছনে নয়, তোর ভয়ের পিছনে। গাধা কোথাকার।’

চড় না মারলেও বেড়ে শুয়ে থাকা মেয়ের দিকে কড়া চোখে তাকিয়েছেন প্রমথবাব। বাঁধন বাবার হাতটা ধরে ফিসফিস করে বলেছে, “তুমি কি আমাকে বকবে?

‘বকব, তবে এখন নয়, অতীশের সঙ্গে এক বছর ঘর করার পর বকব এবং দুটো কান। আচ্ছা করে মুলে দেব।’

বাঁধন হাসল। চোখে মুখে ক্লান্তির ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে। বলল, “আমার খুব লজ্জা করছে বাবা। ইস মানুষটা এত ভাল। ওর সম্পর্কে কী যা তা ভাবলাম। ভয়ের রোগটা যে আমার কবে যাবে বাবা? এত বড় হয়েছি। অঙ্কুর নিশ্চয় খুব হাসছে?

নার্স বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে দিল না। পেশেন্টের ঘুম দরকার। প্রমথবাবু গিয়ে বসলেন ভিজিটর্স রুমে। ব্যাবসার কিছু জরুরি কাজ সেরে ক্লিনিকে অতীশ এল ফুল হাতে। শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেরি হয়ে গেল, আমি একটু দেখা করে আসি।’

আনন্দে চোখ চিকচিক করে উঠল প্রমথবাবুর। তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ঠিক করলেন, রাতটা হোটেলে নয়, জামাইয়ের ফ্ল্যাটে উঠবেন এবং কাল সকালে কলকাতায় ফোন করে মৃন্ময়ীকে আর এক প্রস্ত গাল দেবেন। মেয়েদের সমস্যা বোঝার বিরাট পণ্ডিত এসেছেন। ছাতার মাথা।

রাতে খাওয়ার পরে ড্রইংরুমে বসে কথা বলল অতীশ। মুখ উজ্জ্বল করে সে কথা শুনলেন প্রমথবাবু।

আপনাকে একটাই অনুরোধ। বাঁধাকে এখনই কলকাতায় নিয়ে যাবেন না। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে এর পক্ষে খারাপ হবে। তা ছাড়া মানুষের কতরকম হয়। কারও রাগ বেশি, কারও আবেগ। বাঁধনের হয়তো তেমনি, ভায়র দিকটা বেশি। যতই হোক ছেলেমানুষ। আমার মনে হয়, প্রবলেমটা এখানেই সলভ হবে। আমি ওর ভয় কাটাতে পারব।’

আপ্লুত গলায় প্রমথবাবু বললেন, ‘নিশ্চয় পারবে, অবশ্যই পারবে বাবা। ঘটনা শোনার পর থেকে আমার যে কী লজ্জা করছিল। কলেজে পড়ার সময় দল বেঁধে কত শ্মশানে মশানে ঘুরেছি, রাত কাটিয়েছি নির্ভয়ে। অথচ মেয়েটাকে দেখো, বাবার একটু সাহসও যদি পেত।’

অতীশ সামান্য হাসল। উঠতে উঠতে বলল, ‘পালে, বাবার মতো সেও একদিন সাহসী হয়ে উঠবে নিশ্চয়। আমি এখন শোব, কাল সকালে উঠতে হবে। আপনার শোওয়ার ব্যবস্থা গেস্টরুমে করা হয়েছে। কোনও অসুবিধে হলে আমাকে ডাকবেন। দরজা খোলা রাখব। আর যদি ইচ্ছে করেন, শুতে যাওয়ার আগে লাইট কোনও মিউজিক শুনাতে পারেন। হালকা বাজনা ঘুমের পক্ষে ভাল।’

হালকা বাজনা শুনতে হয়নি। মেয়ের দুশ্চিন্তা কাটায় মনটাই হালকা হয়ে গেছে প্রমথবাবুর। নরম বিছানায় শরীর রাখার পর পরই গভীর ঘুমের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।

মানুষের ঘুম ভাঙে আওয়াজে। প্রমথবাবুর ঘুম ভাঙল গন্ধে। তীব্র, কটু গন্ধ। গা গুলিয়ে দেওয়া গন্ধ। চোখ কচলে দ্রুত খাটের ওপর উঠে বসলেন প্রমথবাবু। অন্ধকার ঘরে গন্ধটা যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে, খেলে বেড়াচ্ছে অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছের মতো।

প্রমথবাবুর গোটা শরীরটাই কেঁপে উঠল। তিনি গন্ধটা চিনতে পেরেছেন। মৃত মানুষের গন্ধ।

শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *