আজ কি শুভ্র আসবে

আজ কি শুভ্র আসবে

আজ শুভ্র আসবে না। তবু পর্ণার মনে হচ্ছে, আজ শুভ্র আসবে। অবশ্যই আসবে। আজ দোল না?

শুভ্র কাল যখন ফোন করেছিল পর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে। মোবাইলটা বেজেই চলছিল, বেজেই চলছিল। একঘেয়ে বিশ্রীভাবে। ঘুমের মধ্যেই শুনতে পেল পর্ণা। বালিশ বিছানা হাতড়ে মোবাইল কানে চেপে ধরল। শুভ্রর গলা না শুনেই বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘কী হয়েছে মানে? ধরছ না কেন? ঘুমোচ্ছিলে?’

‘না জেগেছিলাম। তোমার সঙ্গে গল্প করছিলাম। কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বললো, কেটে যাবে।’

এখানকার মোবাইলগুলো এরকমই। যখন তখন কেটে যায়, কথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। বিয়ের পর পর্ণা খুব বিরক্ত হত। বলত, ‘যদি না শোনা যায় তা হলে রেখে লাভ কী? গাদাখানেক টাকা গোনা শুধুমুদু।’

শুভ্র বলত ‘কই! শোনা যায় তো। আমি তো শুনতে পাই।’

‘তুমি ওরকমই। একে শোনা বলে? স্পষ্ট নয়, খালি কেটে যায়। কাল কলকাতায় কথা বলছিলাম, মাঝপথে ফট করে বন্ধ হয়ে গেল।’

‘আবার করলে না কেন?’ শুভ্র শান্ত গলায় বলল।

পর্ণা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘করব কী করে? সিজনাল এল সেই রাতে। দশটারও পর। তখন কি মা জেগে থাকে? ইস মা কী মনে করল বলো তো।’

শুভ্র অল্প হেসে বলল, ‘এটা কলকাতা নয় পর্ণা। এখানে টাওয়ার নেই। টাওয়ার সেই আরসায়। ওখান থেকে রিলে হয়। তুমি মাকে বুঝিয়ে বলবে।’

পর্ণা স্বামীর দিকে ঘন হয়ে আসে। গলা নামিয়ে বলে, ‘শুধু কি মা? তুমি কোন করলে হ্যালো হ্যালো বলতে গলা ফেটে যায়। বাড়িসুদ্ধ সবাই শুনতে পায়। বুঝতে পারে তুমি ফোন করেছ। পরে জিজ্ঞেস করে, কী হল শুভা ফোন করেছিল? কী বলল? কবে ফিরবে? লজ্জা করে না বুঝি?’

শুভ্র মাথা নামায়। হাসে। বিড়বিড় করে কিছু বলে। সেগুলোও মোবাইলের মতো অস্পষ্ট, ছেঁড়া ছেঁড়া।

কাল রাতে কিন্তু শুভ্রর কথা সবটাই স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে পর্ণা। যদিও ঘুমের মাঝে ফোন ধরেছিল। সেই হিসেবে কথা আরও অস্পষ্ট, আরও ঘেঁড়াহেঁড়া শোনা উচিত ছিল। ব্যাপারটা কাল মনে হয়নি, আজ সকালে মনে হচ্ছে। মজার কাণ্ড তো!

পর্ণা বলেছিল, ‘কী হয়েছে?’

শুভ্র বিরক্ত গলায় বলল, ‘ট্রেন মিস করেছি।’

পর্ণা পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ‘কী হবে এখন?’

‘কী আর হবে? বাড়ি যাওয়া হবে না। স্টেশনে পচে মরতে হবে। শালার চাকরি।’

পর্ণা চাপা গলায় ধমক দিল, ‘গাল দিচ্ছ কেন?’

শুভ্র দাঁতে দাঁতে ঘসে বলল, ‘না গাল দেব না, দুধ ভাত দেব। শুয়োরের বাচ্চা।’

পর্ণা হাই তুলে বলল, ‘কাকে বলছ?’

শুভ্র বলল, ‘আবার কাকে? নিজেকে। হিয়া কী করছে?’

পর্ণা ঘুমে কাদা মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে বলল, ‘লুডো খেলছে। এরপর বলছে স্কিপিং করবে। তোমার মেয়ে আজকাল রাত দুটোর পর স্কিপিং করে।’

শুভ্র বউয়ের রসিকতায় রাগ করল না। সম্ভবত ট্রেন মিস করার রাগে আর রাগ করার ক্ষমতা হারিয়েছে।

‘ইস মাত্র পনেরো মিনিটের জন্য ঝাড় খেয়ে গেলাম। ওনলি ফিফটিন মিনিটস। হাঁপাতে হাঁপাতে স্টেশনে ঢুকে শুনি গাড়ির বাচ্চা…।’

‘ঠিক আছে কাল ফিরবে।’ পর্ণা বুঝতে পারল তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ঘুম পাচ্ছে। এটা আগে ছিল না। আগে শুভ্রকে পেলে সারারাত কুটুর কুটুর করে গল্প করত। রাতেই মোবাইলের কার্ড ফুরিয়ে যেত। আজকাল ঘুম পায়।

শুভ্র এবার রেগে উঠল। বলল, ‘কী হাবিজাবি বছ? কাল কী করে ফিরব? কাল সারাদিন গাড়ি নেই। সেই পরশু। তাও পরশু আবার ট্যুর। গেলেও রাতে থাকতে পারব। না। গিয়ে কী হবে? দূর যাবই না শালা।’

শুভর গলা শুনে পর্ণার মনে হল মানুষটার মন খারাপ হয়ে গেছে। পর্ণার খারাপ, ভাল কিছুই লাগছে না। শুভ্রর বাড়ি না ফেরা তার কাছে নতুন কিছু নয়। প্রথমে মানতে পারত না। এখন জলভাত হয়ে গেছে। তাও তো এখন মেয়েটা আছে। একসময় খুব একা লাগত।

ফিসফিস করে বলল, ‘মন খারাপ কোরো না। খেয়েছ?’

‘হ্যাঁ’।

পর্ণা আবার হাই তুলল। বলল, ‘কী খেয়েছ?’

‘এয়ার, ফ্রেশ এয়ার। এত রাতে রেল স্টেশনে খাবার কোথায় পাব? লাইনের পাথর চিবিয়ে খেতে পারি, খাব?’

এরপরই ফোন কেটে গেল। মোবাইলের আলো কয়েক মুহুর্ত জেগে থেকে, ঝুপ করে ডুব দিল অন্ধকারে। কত রাত তখন? এগারোটা? বারোটা? একটা? নাকি আরও বেশি? ইচ্ছে করলে পর্ণ সময় দেখে নিতে পারত। একবার ভাবল দেখেও নেবে। নীচের রাস্তা দিয়ে একটা রিকশ ঝনঝন আওয়াজ তুলে ছুটল। এখানে এরকমই। দিনরাত রিকশগুলো পিড়মড়ি করে ছুটছে। দূরে কে যেন ডাকল, ‘বাবু, বাবু, আই বাবু…।’ একবার, দু’বার, তিনবার। বাবু কে? এত রাতে তাকে কে ডাকছে? বাবু কি এখনও বাড়ি ফেরেনি? নাকি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ডাকছে?

ঘুমিয়ে পড়ল পর্ণা। তার সময় দেখা হল না।

আজ ভোরে চোখ খুলেই পর্ণার মনে হল, শুভ্র আসবে। কাল রাতে টেলিফোন করে যা-ই বলুক, আজ সে আসবে। দোল বলেই আসবে। পর্ণা পাশ ফিরল। জানলার ফুটোগুলো দিয়ে আলো ঢুকছে। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে পর্ণা এবার হেসে ফেলল। লজ্জাও হল। দূর, যত্তসব ছেলেমানুষি। দোল তো কী হয়েছে? সে কি শুভ্রর সঙ্গে রং খেলবে? এমা, ছিঃ।

খাটের একপাশে হিয়া গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। চাদরটা পায়ের কাছে দলা পাকানো। মেয়েটাকে নিয়ে এই এক সমস্যা। ঘুমের সময় গায়ে কিছুতেই চাপা রাখবে না। সারারাত টেনে টেনে দিতে হয়। পাঁচ বছর বয়স হতে চলল, এখনও অভ্যেস পালটায়নি। ক’দিন আগেও বেচারি খুব সর্দি কাশিতে ভুগত। মাঝে মাঝেই জ্বর হত। বুকে সাঁই সাঁই আওয়াজ। শুভ্র বাড়িতে থাকত না। থাকবে কী করে? সেলসের চাকরি। নিজেই বলে ‘ফিরিওয়ালা’। ফিরিওয়ালার বাড়িতে থাকলে চলে? তার ওপর কোম্পানি ছোট। খাটিয়ে মারে। কোনও কোনও দিন মাসে একবারও বাড়ি ফিরতে পারে না। এখন মানিয়ে নিয়েছে পর্ণা, তখন খুব অসুবিধে হত। অসুস্থ মেয়েকে কোলে নিয়ে রাত জাগত পর্ণা। ভয় করত, কান্না পেত। অন্ধকার ঘরে বসে কাঁদত। কাঁদতে কাঁদতেই শুনতে পেত পাশের ঘরে মায়া হাসছে। মায়ার বয়স সতেরো। কিন্তু হাসি কিশোরীদের মতো সুন্দর হাসি নয়। খল খল করা বিশ্রী হাসি। শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। তখন মেয়েটার অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি। এখনকার মতো সারাদিন ঘরে বন্ধ করে রাখতে হত না। শুধু যেদিন যেদিন বাড়াবাড়ি করত সেদিন তালা পড়ত। শাশুড়ি আসতেন সকালে ঘুম ভাঙার পর। তখন খাটের গায়ে হেলান দিয়ে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে পর্ণা। শাশুড়ি এসে হইচই বাধিয়ে দিতেন।

‘বউমা, মেয়েকে এবার আমার কাছে দাও দেখি, দাও। এসে সোনা, এসো, এসো। আমার কোলে এসো। পর্ণা, তুমি বরং গিয়ে চা বসাও। শ্বশুরমশাই আবার ঘুম ভেঙে চা না পেলে বিরাট রাগারাগি করবে। পকেটে ঢু ঢু অথচ মেজাজ দেখে। ঝাটা মারি তোর মেজাজে। তারপর নাতনিকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে মহিলা বলতেন, ‘আহা রে! কী কষ্ট রে, বাছা আমার, মনা আমার। আমার পুনুপুনু, আমার মুনমুন। কাশতে কাশতে ম’ল বেচারি। নিশ্চয় মামাবাড়ির ধাত পেয়েছে। হ্যাঁগো বউমা, তোমার বংশে কেউ হাঁপের রোগী আছে? তোমার বাপ-কাকার সর্দি কাশি কেমন?

পর্ণা খাট থেকে নামতে নামতে বলত, ‘বাপ কাকার সর্দি কাশি ভাল মা। একতলায় কাশলে তিনতলা পর্যন্ত শোনা যায়। গলায় জোর আছে। তবে আমাদের বাড়িটা আরও ভাল। ড্যাম্প ধরা নয়, রোদ ঢোকে। সাউথ ফেসিং। পুৰটা ফাঁকা।’

শাশুড়ি চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, ‘কী করব বাপু, রোদ তো টেনে হিচড়ে ঢোকাতে পারব না। তোমার শ্বশুরমশাই সারাজীবন সামান্য চাকরি করেছেন। যেটুকু পেরেছেন এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে মাথা গোঁজার ঠাই করেছেন। তোমার কলকাতার অট্টালিকার সঙ্গে এ জিনিসের তুলনা করলে চলবে কেন বাছা? তা ছাড়া…’

‘তা ছাড়া কী?’ পর্ণা মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে। নিজের কথার মধ্যেই সে জোর খোঁজে। নাতনির পিঠে হাত বুলিয়ে শাশুড়ি আড়চোখে পুত্রবধূর দিকে তাকান। মুখ ঘুরিয়ে বলেন, ‘তা ছাড়া, তোমায় তো জোর করে স্যাঁতস্যাতে বাড়িতে এনে তোলা হয়নি বউমা, তুমি নিজেই এসেছ। নাকি বিয়ের আগে তোমায় ঘরবাড়ির কথা কিছু বলেনি শুভ? লুকিয়েছিল?

ভুরু তুলে চুপ করেন মহিলা।

থমকে দাড়ায় পর্ণা। না, শুভ্র তাকে কিছুই লুকোয়নি। ঘরবাড়ি, অসুস্থ শ্বশুরমশাই, পাগল ননদ সবই বলেছিল। বলেছিল, ‘তুমি পারবে না পর্ণা। দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই তুমি হাঁপিয়ে উঠেছ। শুধু মনে হবে, কলকাতায় পালিয়ে আসি। তখন কিন্তু আমার কিছুই করার থাকবে না। যা রোজগার করি তাতে দুটো সংসার অসম্ভব। তুমি পারবে না পর্ণা। জীবনটা গল্প উপন্যাস নয়।’

পর্ণা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর অল্প হেসে বলেছিল, ‘জীবনটা গল্প উপন্যাসের থেকেও ভাল। আমি জানি, আমি পারব না। তবু আমি যাব। ওমা, দেখো দেখো পাঁচিলের মাথাটা দেখো, কেমন লাল হয়ে গেছে! ইস কী সুন্দর! কলকাতার রাস্তায় পলাশ পড়ে জানতাম না তো! অ্যাই, হাত বাড়িয়ে ক’টা এনে দাও না বাবা। দাও না প্লিজ। এই লম্বু…।’

শুভ্র সরে গিয়ে বলেছিল, ‘পারব না।’

পর্ণা খিলখিল করে হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, তোমায় পারতে হবে না। আমি আঁচল বেঁধে পাঁচিলে উঠছি। এই দেখো।’

শাশুড়ি বোধহয় পর্ণার মন বুঝলেন। ঠোঁটে হেসে বললেন, ‘এখন আর আপশোস করে লাভ কী? তবু দেখো, তোমার বর ফিরলে বলে দেখো। সে যদি তোমার জন্য রোদের কিছু ব্যবস্থা করতে পারে।’

শুধু রোদ নয়, রোদের সঙ্গে বৃষ্টিরও ব্যবস্থা করল শুভ্র। ধার দেনা করে ছাদের ঘরটা সারিয়ে সুরিয়ে নিল। প্লাস্টার, একটা নতুন দরজা, হোয়াইট ওয়াশ। ছোট আর সাদামাটা হলেও পর্ণা নিজের একটা ঘর পেল। খরচ বাঁচাতে ঘরের সামনেটা অ্যাসবেসটসের চাল। বৃষ্টিতে সারারাত ঝমঝম করে বাজে।

মেয়ের চাদর গলা পর্যন্ত টেনে বালিশটা ঠিক করে দিল পর্ণা। হিয়া ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, বাবা এসেছে?

পর্ণা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘এখনও আসেনি। তবে এসে পড়বে। তুমি আর একটু ঘুমিয়ে নাও।’

হিয়া চোখ বুজেই বলল, ‘তুমি বাবাকে রং আনতে বলেছ?’

পর্ণা নিচু গলায় বলল, ‘বলেছি।?’

‘আর পিচকিরি? পিচকিরি বলোনি?’

‘হ্যাঁ তাও বলেছি।’

‘কীরকম পিচকিরি? বন্দুক পিচকিরি না আমব্রেলা পিচকিরি, আমব্রেলা হলে আমি নেব না। আমি বন্দুক চাই। শান্তার যেমন আছে।’

পর্ণা একটা চাপা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘মনে হচ্ছে তোমার বাবা বন্দুক পিচকিরিই আনবে। তুমি এখন চুপ করে ঘুমোও।’

পর্ণা বারান্দার দরজাটা খুলল। দোতলার এই বারান্দাটা আসলে বারান্দা নয়। নেড়া ছাদের একটুখানি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ছাদের ফালি ঘরটার সঙ্গে শুভ্র এটাও বানিয়েছিল। দেয়ালে প্লাস্টার নেই। ইটগুলো দাঁত বের করে আছে। সেই ইট ঢাকতে পর্ণা একবার দুটো টব এনে রাখল। জুঁই গাছের টব। বিকেল হলে জল দিত। শখ করে বারান্দার নাম দিল জুঁই বারান্দা। ফুল হওয়ার আগেই গাছ দুটো মরে গেল। তবে নামটা রয়ে গেছে। জুঁই বারান্দায় এসে দাঁড়াল পর্ণা। বাতাসে একটা ভেজা ভেজা ভাব। ফাল্গনে এরকম হয়। কোনও কোনও দিন সকালটা কুয়াশামাখা স্যাঁতস্যাঁতে লাগে। পাতলা শিরশিরে হাওয়া দেয়। মনে হয় বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হয় না। বরং বেলা বাড়লে চড়চড়ে রোদ ওঠে। আজও কি রোদ উঠবে? কোনও কারণ নেই, তবু কেন জানি পর্ণার মনে হল, দোলের দিন কড়া রোদ ভাল নয়।

মেয়ে বেলা করে উঠলে সুবিধে। অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলা যায়। চা জলখাবার করে, শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়ে, রান্নার গোছগাছ সেরে ভাতটা পর্যন্ত চাপানো হয়ে যায়। সবথেকে বড় কাজ হল, মায়ার কাজ। তাকে স্নান করানো, ঘর পরিষ্কার করে খেতে দেওয়া। সতেরো বছর বয়সের পাগল মেয়েকে স্নান, খাওয়া করানো সহজ কথা নয়। অনেকটা সময় লাগে। এটা রুটিনে ছিল না পর্ণার। মাস কয়েক হল ঢুকেছে। রোগা জিরজিরে মেয়েটাকে দেখভালের জন্য এক দশাসই আদিবাসী মহিলার ব্যবস্থা ছিল। শুভ্রই করেছিল। সকালে আসত, যেত একেবারে রাতে রোগীকে খাইয়ে। মহিলা এমনি খারাপ ছিল না, তবে আড়ালে মায়াকে মারধর করত। পর্ণা কথাটা বলেছিল শুভ্রকে।

‘পাগল সামলাতে অমন একটু-আধটু করতে হয় পর্ণা।’

‘তা বলে অত বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলবে!’

‘আঃ পর্ণা, এখানে বড় ছোটর কিছু নেই। ওরা ছেলেমানুষের মতোই। পাগলাগারদে দিলে তো আরও খারাপ হবে।’

পর্ণা নিচু গলায় বলে, ‘না, না এটা ঠিক নয়, তুমি বারণ করে দেবে।’

শুভ্র এবার রেগে যায়। হাত জোড় করে বলে, ‘দোহাই পর্ণা আর ঝামেলা পাকিয়ো না। ওপরে ঘর করা নিয়ে তো দেখলে কী হল, বাবা এখনও ঠিকমতো কথা বলে না। এখন যদি ওই লোক চলে যায়, মায়াকে কে দেখবে বলো? তুমি? না আমি চাকরি ছেড়ে বসে থাকব।’

পর্ণা ছাদ থেকে তুলে আনা শাড়ি ভাজ করতে করতে বলে, ‘ঘরটা ভেঙে দিয়ো না হয়।’

সেই মহিলা কাজ ছেড়ে দিয়েছে। এমনি ছাড়েনি। মায়া তার গালে কামড় দিয়েছিল। অল্প কামড় নয়, জোর কামড়! মুখ একেবারে রক্তে ভেসে গিয়েছিল। ওই হাড় বের করা মেয়ে দাঁতে অত জোর পেল কী করে! পরদিন জানতে পেরেছিল। অপমানের জোর। সেই অপমান মায়া নিজেই জামা খুলে দেখিয়েছিল। পর্ণা অবাক হয়ে গেল। পাগলেরও অপমান! সেই থেকে পর্ণা ননদের দায়িত্ব নিয়েছে। অন্তত শুভ্র যতদিন না পর্যন্ত একটা ভাল অ্যাসাইলামের ব্যবস্থা করে। মনে হয় না খুব তাড়াতাড়ি সে ব্যবস্থা করতে পারবে। যে দু’-একটা খোঁজ পাওয়া গেছে তাদের খরচ অনেক। বাকিরা শিকলে বেঁধে রাখে।

আলো বাড়ছে। কুয়াশা কুয়াশা ভাবটা কেটে স্পষ্ট হচ্ছে চারপাশ। এদিকে গাছপালা অনেক। বাড়ির সামনেই দু’-দুটো বকুল গাছ। চট করে এমন হয় না। ঘন ডালপালা নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল শুরু হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই নীচটাও সাদা হয়ে যাবে। মনে হবে, গাছ তার তলায় চাদর বিছিয়েছে। পর্ণা কখনও ফুল মাড়িয়ে যায় না। এখানে আসার পর দুটো বছর গাছপালা নিয়ে খুব লাফালাফি করেছিল। একটা খাতাই বানিয়ে ফেলল! ফুল-পাতার খাতা। সিজন ধরে ধরে সেখানে গাছের পাতা আর ফুলের পাপড়ি থাকত। একবার সেই খাতা কলকাতায় নিয়ে গেল পর্ণা। দেখে গম্ভীর হয়ে গেল।

‘তোর বাবাকে দেখিয়েছিস?’

পর্ণা হেসে বলল, ‘এখনও দেখাইনি, তবে ঠিক করেছি আজ ডিনারের পর দেখাব। আগে নিজের হাতে কফি বানাব, তারপর জমিয়ে বসে কফি খেতে খেতে দেখাব।’

‘থাক, দেখাতে হবে না।’

পর্ণা অবাক হয়। খাতার পাতা উলটে বলে, ‘সে কী! কেন মা! তুমি বর্ষা আর বসন্তের সিরিজটা দেখলে? এই দেখো শিমূল, পারুল, এই যে পলাশ। বকুল দেখেছ? কলকাতায় ইচ্ছে করলেও এই কালেকশন তুমি করতে পারবে না। বলো পারবে? আচ্ছা, বলো তো মা এটা কোন পাতা? এটা আমাদের বাড়ির গাছ। ঠিক বাড়ির নয়, তবে বাড়ির মতোই, গেটের পাশেই আছে। পারলে না তো? জানতাম পারবে না। দেখব বাপি পারে কিনা। বাপিকে যখন দেখাবি…।’

মা কঠিন গলায় বলল, ‘না, দেখাবে না।’

মা এবার রেগে যায়। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘পর্ণা আমরা জানি, এই বিয়ে করে তুমি কতটা জলে পড়েছ। ফুল পাতা দিয়ে তা ঢাকার চেষ্টা কোরো না।’

ফেরার পথে ট্রেনেই খাতাটা ফেলে দিয়েছিল পর্ণা। তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শুভ্রকে বলেছিল, ‘একটা চা বলো না। খুব তেষ্টা পেয়েছে।’

মায়ার কাজ শেষ করে একেবারে স্নান করে এসে তবে মেয়েকে তোলে পর্ণা। আর তো ক’টা দিন। এরপর স্কুল শুরু হলে সব রুটিন পালটে যাবে। কলকাতায় থাকলে এখনই হয়ে যেত। আজকাল তিন বছর থেকেই ছেলেমেয়েরা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এই পাড়াগাঁ শহরে কোনও নার্সারি স্কুল নেই। বড় স্কুলও তেমন নেই। ট্রেনে করে সেই আরসা পর্যন্ত যেতে হবে। ঘণ্টা খানেকের মামলা। সব মিলিয়ে হয়তো আরও বেশি।

শুভ্রকে কথাটা বলেছিল পর্ণা।

‘হিয়া, অতটা ট্রেন জার্নি পারবে তো?’

শুভ্র অবাক গলায় বলল, ‘কেন? পারবে না কেন? আমরা সবাই পেরেছি। ও কেন পারবে না?’

‘তোমাদের সময় আর ওদের সময় এক নয়।’

শুভ্র শান্ত গলায় বলল, ‘ওদের সময় কীরকম পর্ণা? হেলিকপ্টার চড়বার সময়?’

পর্ণা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘এরকম করে বলছ কেন?’

শুভ্র ভুঁরু কুচকে কয়েক মুহুর্ত থমকে থাকল। তারপর চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বলল, ‘কীরকম করে বলছি? দেখো পর্ণা, তুমি যেমন চাইছ তেমন হবে না। আমার পক্ষে দুটো। সংসার মেইনটেইন করা ইমপসিবল। একথা আমি তোমাকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম। সেদিন তুমি শোনেননি। আজ বলছি, তুমি যদি চাও, বাপের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মেয়েকে পড়াতে পারো। সেটা সবার পক্ষেই মঙ্গল হবে। আশা করি আজ তুমি আমার কথা শুনবে।’

সেদিন এই বারান্দায় অনেক রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল পর্ণা। কাঁদছিল কি? কে জানে হয়তো কঁদছিল, হয়তো কাঁদছিল না। মনে নেই। তবে মনে আছে ছাদ জুড়ে অনেকটা জ্যোৎস্না ছিল৷ আর বাতাসে ছিল একটা চাপা গন্ধ। চাপা অথচ মিষ্টি বকুল গাছের গন্ধ। ফুল দেওয়ার আগে কোনও কোনও বকুল গাছ লুকিয়ে লুকিয়ে এই গন্ধ ছাড়ে।

বেলা পর্যন্ত বিছানায় থাকতে পর্ণারও ভাল লাগে। বিয়ের আগে তো দশটাতেও খাটে গড়িয়েছে। ঘুম ভাঙলেও ওঠেনি। মটকা মেরে পড়ে থেকেছে। বিয়ের পর গড়ানো যায় না। তাও মাঝে মাঝে দোর দিয়ে পড়ে থাকে। শাশুড়ি ছাদে হাঁটেন, সিঁড়িতে ওঠেন, নামেন। পায়ের আওয়াজ করেন দুমদুম। আর চাপা গলায় গজগজ করতে থাকেন। করতেই থাকেন।

‘এ কেমন অলুক্ষুনে কাণ্ড গো। ছি ছি। শ্বশুরবাড়িতে এত বেলা পর্যন্ত বিছানায়? লজ্জা শরম নেই নাকি গো? তাও যদি বুঝতুম বর রাতে ছিল। লোকে কী ভাববে গো? অ্যাঁ! কী ভাববে?’

শুভ্রকে নালিশ করলে বলে, ‘এসব ছোটখাটো জিনিস নিয়ে বিরক্ত কোরো না পর্ণা। প্লিজ। মাস শেষ হতে চলল, এখনও টার্গেট হয়নি। কী দরকার বাপু তোমার অত বেলা পর্যন্ত নাক ডেকে ঘুমোনোর।’

বারান্দার দরজা দিয়ে ঘরে উঁকি দিল পর্ণা। মেয়েটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। পর্ণা থমকে দাঁড়াল। ঘুমোলে মেয়েটাকে বড় সুন্দর দেখায়। ঠোট দুটো অল্প অল্প কাঁপে। ঠিক শুভ্রর মতো! আহা রে, কত আশা বেচারির, বাবা পিচকিরি এনে দেবে, রং এনে দেবে। দোল খেলবে। পাশের বাড়ির শিবুটাকে দিয়ে একটু পরেই একটা পিচকিরি আনিয়ে নিতে হবে। আর আবির। আবির গুলেই খেলবে। এখানকার রং ভাল না। গায়ে র‍্যাশ হয়।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পর্ণা নিজের বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কামড় দিল। তিনবার কামড়। মেয়েকে সুন্দর দেখলে মাকে তিনবার কামড় দিতে হয়। নইলে নজর লাগে।

সিঁড়ির শেষে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা। মুখ থমথমে। তিনি রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। নিশ্চয় কিছু ঘটেছে।

‘কী হয়েছে মা?’

শাশুড়ি গনগনে গলায় বললেন, ‘জানি না। তুমি মায়ার কাছে আজ যাবে না। ছি ছি, একটা বছরকার দিনে…।’

পর্ণা উদ্বিগ্ন গলায় বলে, ‘কেন কী করছে মায়া?’

‘নিজে গিয়ে দেখো একবার কী করছে। থুতু দিচ্ছে। নতুন পাগলামি। আমি ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, জানলা দিয়ে থু থু করে একগাদা… ইস মাগো… আমি তেড়ে গেলাম তখন আবার দিল। আজ নোড়া দিয়ে হারামজাদির সব ক’টা দাঁত যদি না ফেলেছি। দেখব ফোকলা দাঁতে তখন কত গুক দেয়। ভূমি সরো বউমা, সরো দেখি। আমি রান্নাঘর থেকে নোড়াটা নিয়ে আসি।’

পর্ণা শান্ত গলায় বলে, ‘দাঁড়ান মা, আমি দেখছি। আপনি শান্ত হন।’

এগিয়ে যায় পর্ণা। বারান্দা পেরিয়ে মায়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্ধ জানলায় মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। পর্ণাকে দেখে হাসে। পর্ণাও হাসে।

‘মায়া, ভাল আছ?’

‘হ্যাঁ, বউদি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?’

‘আমি ভাল আছি।’

পূর্ণা এগিয়ে এল। সে প্রতিদিনই আগে কথা বলে মেয়েটার মনের অবস্থা বুঝে নেয়। তারপর দরজা খোলে। পর্ণা নিচু গলায় বলল, ‘যা শুনলাম সেটা কি সত্যি? তুমি কি…?’

মায়া কথার মাঝখানেই বলে, ‘হ্যাঁ সত্যি। সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি। এবার তোমাকেও দেব। সবাইকে দেব।’ পর্ণা মুখ সরানোর সময় পায় না।

দোল একটা আনন্দের দিন। এদিন কেউ কাঁদে না। এদিন কাঁদতে নেই। পর্ণা তাই দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকে রেখেছে। আটকে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। দিয়েই চলেছে।

আজ শুভ্র আসবে না। তবু পর্ণার মনে হচ্ছে, আজ শুভ্র আসবে। অবশ্যই আসবে। আজ দোল না?

বর্তমান, রবিবার ১৬ মার্চ, ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *