৭. গুহার মধ্যে একটি হাত

০৭.

গুহার মধ্যে একটি হাত

 সে রাতে জয়ন্তী আর আমি ঘরে বসেই ডিনার খেলুম। তারপর দশটা বাজল, বারোটা বাজল–তখনও কর্নেলের পাত্তা নেই। দুজনে অবশ্য গল্পগাছা এবং একটু-আধটু ফস্টিনস্টি করে কাটাচ্ছিলুম। তবে জয়ন্তী আমাকে বেশিদূর এগোতে দেয়নি। যাই হোক, বারোটার পর হাই তুলে ঢুলুঢুলু চোখে এবং ঘুমজড়ানো গলায় ও বলেছিল–আমি কর্নেলের বিছানায় শুয়ে পড়ছি। খবর্দার বিরক্ত করবে না কিন্তু। চেঁচামেচি করে হোটেল মাথায় করব বলে দিচ্ছি।

–বেশ, করব না। কিন্তু কর্নেল ফিরলে কি তোমার ঘরে গিয়ে শুতে বলব?

হুঁউ। কারণ, গত রাতটা প্রাণের দায়ে একা কাটিয়েছি। আজ আর নয়, বাব্বা। আজ প্রাণভরে ঘুমুতে চাই।

বলেই সে শুল তো সঙ্গে সঙ্গে মড়া হয়ে পড়ল। আমারও ঘুম পাচ্ছিল। শুয়ে পড়েছিলুম। তারপর কখন কর্নেল ফিরেছেন, ঘড়ি দেখিনি, প্রায় ঘুমের ঘোরে দরজা খুলে এবং তক্ষুণি টলতে টলতে ফের বিছানায় গড়িয়ে পড়েছি। কর্নেল, আমার অনুমান, জয়ন্তীর ব্যাগ হাতড়ে ওর ঘরের চাবি নিয়ে বেরিয়ে গেছেন এবং বাইরে থেকে আমাদের ঘরটা লক করে দিয়েছেন।

সকালে জয়ন্তীই আমাকে ওঠাল, তখন সাতটা। জীবনে এত সকালে ওঠার অভ্যেস নেই। ওকে তেড়ে ধমক দিলুম। কিন্তু ও আমাকে কাতুকুতু দিতে থাকল। সেই সঙ্গে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-ইস! কী চান্স না গেছে। তোমার!

ক্ষিপ্ত মেজাজের দরুন কথাটা অসভ্যতা বলেই ধরে নিলুম এবং নিজের চরিত্রের বলিষ্ঠতা সম্পর্কে ওকে একটা কড়া বক্তৃতা শোনাতেই ধুড়মুড় করে উঠে বসলুম। বললুম–দেখা জয়া, তুমি আমাকে চিনতে ভুল করছ! আমার মেয়েবন্ধুর সংখ্যা ছাত্রজীবন থেকে এ অবধি খুব কম নয়। কতবার একসঙ্গে বাইরে কাটিয়ে এসেছি দল বেঁধে। লিমিট রেখে কীভাবে অন্তরঙ্গতা বজায় রাখা উচিত–সে সেন্স আমার আছে।

জয়ন্তী আমার মুখে হাত চেপে বলল–চুপ! বেড-টি বলেছি। ওই শোন, দরজায় নক করছে। কিন্তু হায়, ওই অমৃত আপাতত বরাতে নেই! কারণ, দেখে এসেছি দরজা বাইরে থেকে লক করা।

কিন্তু কী আশ্চর্য, দরজা খুলে গেল এবং বেড-টির ট্রে নিয়ে হাসি মুখে ছোকরা বেয়ারাটি ঢুকে বলল–সেলাম সাব, সেলাম মেমসাব!

জয়ন্তী ভুরু কুঁচকে বলল-দরজা লক করা ছিল না?

–জি না মেমসাব।

–সে কী! এই একটু আগে আমি দেখলুম, দরজা লকড।

 আমি বললুম করিডরে কাকেও দেখলে এইমাত্র?

–জি হাঁ। কর্নেল সাহাব নেমে গেলেন।

আমরা পরস্পর তাকাতাকি করে একটু হাসলুম। বেয়ারা ট্রেটা রেখে চলে গেল। চায়ের কাপ তুলে নিয়ে জয়ন্তী বলল–আমি কিন্তু আজকাল বাসিমুখে বেড-টি খাইনে। খাওয়া উচিত নয়। অস্বাস্থ্যকর। তবে এক সময় খেতুম। ভারি ভাল লাগত। তুলনা হয় না!

চায়ে চুমুক দিয়ে বললুম-হ্যাঁ, তুলনা হয় না বটে। তাই স্বাস্থ্য মানি না। আমি তো এভারেস্টের চুড়োয় ওঠবার অ্যামবিশান নিয়ে জন্মাইনি!

জয়ন্তী চোখে ও ঠোঁটে ঝিলিক তুলে বললবাসি মুখে আর কী খেতে ভাল লাগে বল তো?

–সিগারেট।

ভ্যাট! বলতে পারলে না।

চুমু?

 জয়ন্তী হাসতে হাসতে অন্যদিকে মুখ ঘোরাল। শুধু বলল–যাঃ!

-তোমার এক্সপিরিয়েন্স থেকেই বলছ নিশ্চয়?

–না বাবা, না। ও কথা মোটেই নয়। আমি বলতে চাইছিলুম, বাসিমুখে কখনও পেস্ট খেয়ে দেখেছ? ছেলেবেলায় আমি খেতুম।

–এই রামোঃ! পেস্ট খেতে? ছ্যা, ছ্যা!

জয়ন্তী হাসতে হাসতে আমার হাঁটুতে খানিকটা চা ফেলে দিল।

.

বাথরুমে প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি সেরে নিতে আমার ঘণ্টাখানেক লেগেছে। বেরিয়ে দেখি, জয়ন্তীর বদলে আমার বন্ধুবর বসে রয়েছেন। স্বভাবমতো বাও। করে বললেন–সুপ্রভাত ডার্লিং! আশা করি, আজও সুনিদ্রার কোন ব্যাঘাত ঘটেনি?

গম্ভীর হয়ে বললুম–ঘটবার চান্স ছিল। তবু ঘটতে দিইনি।

তুমি কি আমার ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছ জয়ন্ত?

–বিলক্ষণ। আপনার কি এতটুকু বৈষয়িক বুদ্ধিসুদ্ধি নেই যে জয়ন্তীকে এ ঘরে রেখে চলে গেলেন। ওকে জাগিয়ে নিজের ঘরে পাঠানো উচিত ছিল না কি? এবং তার ওপর দরজা লক করে গেলেন! ভিতরে যে একজন শক্তসমর্থ যুবক আর একজন স্বাস্থ্যবতী যুবতী রয়ে গেল–তারা সদ্যপরিচিত এবং সম্পূর্ণ অনাত্মীয়, তাও খেয়াল করলেন না?

কর্নেল অপ্রতিভ মুখে বললেন–তুমি ঠিকই বলেছ, জয়ন্ত। ঘাট মানছি। এখন এস, ঝটপট ব্রেকফাস্ট সেরে নিই। অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে। জয়ন্তীরও আসছে। তারপর তোমাদের সামনে একটা চমৎকার দলিল পেশ করব। আজ সারাদিন তোমাদের নিয়ে কাটাতে কোন অসুবিধে নেই।

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললুম–দলিল! মানে, সেই খামটা তো?

–খামটা পরে। এই দলিল আমার তৈরি।

জয়ন্তী এসে গেল। হালকা নীল শাড়ি, হাতকাটা ব্লাউজের দুধারে ঝুলছে দুটি সরল আর নগ্ন বাহু, জোরালো নিয়নবাতির মতো উজ্জ্বল। তার বুকের এই উদ্দীপ্ত প্রগতা এর আগে লক্ষ্য করিনি। মনে হল, দুরধিগম্য পাহাড়ের বিপদসঙ্কুল চূড়া জয়ের চেয়ে সম্ভবত পুরুষ মানুষকে জয়ের গর্ব আনন্দ আর তৃপ্তি আজও মেয়েদের অনেক অনেক বেশি। এবং এ সবের চাপে মেয়েরা যেন একটু স্বার্থপরও হয়ে ওঠে। অন্তত শ্যামলীর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে জয়ন্তীর আচরণ চুলচেরা বিচার করলে এই স্বার্থপরতাটাই টের পাওয়া যায়। সত্যি, মেয়েদের রহস্যময়তার কোন তুলনা নেই।

জয়ন্তীর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে কর্নেল বললেন–ইয়ে, জয়ন্ত, জয়ন্তীর মধ্যে, এবেলা আমরা নতুন কিছু নিশ্চয় প্রত্যক্ষ করছি। তবে দেখ, মানুষের যা কিছু সৌন্দর্য চেতনা, তা আজও প্রকৃতির নিয়মের বাইরে নয়।

বক্তৃতা থামিয়ে দিল ব্রেকফাস্টের ট্রে। আমরা নিঃশব্দে খেতে বসলুম। খাওয়ার পর কর্নেল বললেন–ততক্ষণ তোমরা এই কাগজগুলো পড়ে ফেলো। আমি একবার লাউঞ্জে যাই। ডঃ পট্টনায়ক এসে পড়বেন। ওঁকে নিয়েই ফিরব।

পকেট থেকে কয়েক শিট ভাঁজ করা কাগজ হাতে গুঁজে দিয়ে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। আমি আর জয়ন্তী পাশাপাশি বসে তা পড়া শুরু করলুম।

হাতে লেখা কর্নেলেরই।…

(১) শ্ৰীমতী সরোজিনী মালহোত্রা : ৭ই জুন অর্থাৎ শ্যামলীর মৃত্যুর দিন সকাল আটটায় গ্রিনভিউ হোটেলে মোহন পারেখের সঙ্গে দেখা করেন। এক ঘণ্টা ছিলেন পারেখের ঘরে। হিস্টিরিয়ার রুগী! সরযূ লছমন আর বদ্রীর বর্ণনা অনুসারে দু-বছর আগের জুনে স্বামীর জিপ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর থেকে এই রোগ হয়েছে। ডঃ পট্টনায়কের মতে, রোগটা অভিনয় নয়। ভদ্রমহিলার নার্ভের অবস্থা চরমের দিকে এগোচ্ছে। এখন থেকে চিকিৎসা করা দরকার। নয়তো ভবিষ্যতে উন্মাদ রোগের সম্ভাবনা আছে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত কাণ্ড করেন। ৮ই জুন সকালে তার কিছু নমুনা আমরা পেয়েছি। ফিটের সময় বিড়বিড় করে একটা নাম উচ্চারণ করেন। মহাবীর সিং। জ্ঞান হবার পর প্রশ্ন করলে বলেন–ও নামে কাকেও চিনি না। সরযূ লছমন বদ্রীও চেনে না। প্ল্যানচেটের আসর গত বছর প্রথম এক রাত্রে বসিয়েছিলেন। অধ্যাপক দ্বিবেদী, জয়সোয়াল বা মোহন পারেখ কেউ ছিলেন না সে আসরে। যাঁরা ছিলেন, তারা এবার বাণেশ্বরে আসেননি। তবে সে-আসরে ব্যর্থ হয়েছিল। আত্মা আসেনি। মিডিয়ামটি নাকি খুবই ভীতু প্রকৃতির ছিলেন, তাই আসেনি–এ হল শ্রীমতী মালহোত্রার মত।

(২) শ্রীহরিহরপ্রসাদ মালহোত্রা : সরোজিনীর স্বামী। বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু এক অতর্কিত লোকসানের ধাক্কায় ক্রমশ ব্যবসা ভাটার দিকে যায়। আর সামলাতে পারেননি। একদিন নৈনিতাল থেকে দিল্লী যাবার পথে জিপ দুর্ঘটনায় মারা পড়েন। জিপটা খাদে গড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে কেউ ছিল না। একা নিজেই ড্রাইভ করছিলেন নাকি। অন্তত তার স্ত্রীর এই বর্ণনা। মন্তব্য : তথ্য খুব সামান্য। রাস্তা ও বেতার যোগাযোগ চালু হলে বিস্তারিত তথ্য নৈনিতাল পুলিশের কাছে জানা সম্ভব হত। শ্রীমতী মালহোত্রাও অনেক কথা সম্ভবত গোপন করছেন।

(৩) শ্রীমোহন পারেখ : বোম্বের প্রখ্যাত ফিল্ম হিরো। মালহোত্রার বন্ধুর ছেলে। ছেলেবেলা থেকে ওঁদের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। মালহোত্রার মৃত্যুর দিন সে ঘটনাচক্রে নৈনিতাল যায়। পথে জিপ দুর্ঘটনা ঘটতে দেখে এবং দুঃসংদু তার মুখেই শ্ৰীমতী মালহোত্রা পান। হোটেলে তার ঘরে একটি টেলিগ্রাম পাওয়া গেছে। শ্রীমতী মালহোত্রা তাকে অবিলম্বে বাণেশ্বরে আসতে বলেছেন। টেলিগ্রামের ডেসপ্যাঁচ তারিখ তেসরা জুন। পারেখ পৌঁছোয় ৬ই জুন রাত্রে। ৭ই জুন দুপুরে সে বেরিয়ে যায়। আর ফেরেনি। ভূতের পাহাড়ের পশ্চিম খাদে তার লাশ আবিষ্কৃত হয় ৮ই জুন ভোর ৬টায়। মন্তব্য : হঠাৎ তাকে শ্ৰীমতী মালহোত্রার টেলি করার কারণ কী? উনি তেমন কোন কৈফিয়ত দিচ্ছেন না। বলছেন–ওকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। বিশ্বাস হয় না।

 (৪) শ্ৰীমতী শ্যামলী সেন : ৭ই জুন সকালে মোহন পারেখের সঙ্গে লাউঞ্জে আলাপ। শ্যামলী ওর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে। জয়ন্তী বিরক্ত হয়েছিল। পারেখের ঘরেও গিয়েছিল শ্যামলী। জয়ন্তী এতে রাগ করে ওপরে চলে আসে। একটু পরেই শ্যামলী ফেরে। অভ্যাসমতো জয়ন্তীর ঘুম এসেছিল। ঘুমজড়ানো চোখে দেখে, শ্যামলী বিছানা ঠিকঠাক করছে। (ব্যাপারটা সিগনিফিকান্ট) তারপর শুয়ে পড়ে সে। জয়ন্তীর ঘুম ভাঙে আড়াইটে নাগাদ। তখন দেখে শ্যামলী বিছানায় নেই। সে ভাবে, পারেখের ঘরে গেছে। আধঘণ্টা পরে শ্যামলী আসে। অপ্রকৃতিস্থ চেহারা। জয়ন্তীর মনে সন্দেহ হয়, মোহন পারেখ ওকে বাগে পেয়ে নিশ্চয় একটা কিছু করেছে। জয়ন্তী প্রশ্ন করলে শ্যামলী জবাব দেয়, একটা বিচ্ছিরি স্বপ্ন দেখে মন খারাপ হয়েছিল। তাই বাইরে লনে পায়চারি করছিল এতক্ষণ। স্বপ্নটার কথা আমরা ওইদিনই ভূতের পাহাড়ে শুনেছি। সাড়ে তিনটেয় দুজন বেরোয়। শ্যামলী সারাক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল। মন্তব্য : মিডিয়াম হওয়ার সময় পারেখের আত্মা ওর মুখ দিয়ে যা বা বলেছিল–তা অবিকল ওখানে নোট করা হল….

(আমি তাকে চিনতুম। এই বাক্যটার তুলায় লাল কালির দাগ। প্রশ্ন : কে কাকে চিনতে পেরেছিল?)

(৫) অধ্যাপক অরিন্দম দ্বিবেদী : ৩রা জুন এসেছেন। ৭ই জুন মোহন পারেখ চলে যাবার পর নাকি মোহন পারেখের ঘরে ঢোকেন। বেয়ারাদের সাক্ষ্য। দুপুরে লাঞ্চের সময় হোটেলে ছিলেন না। বলেছেন, এক মাইল দূরে জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলুম। ফেরেন বিকেল তিনটে নাগাদ। তারপর পোশাক বদলে বেরিয়ে যান। শ্রীমতী মালহোত্রার কথামতো চারটেয় পৌঁছান ওঁর বাড়ি। লনে চেয়ার পেতে অপেক্ষা করছিলেন ভদ্রমহিলা। ৮ই জুন সকালে জয়ন্তীর ঘরে ঢুকেছিলেন। বলছেন, শ্যামলীর আত্মীয়স্বজনকে খবর পাঠানোর ব্যাপারে বেচারা বাঙালি মেয়েটিকে সাহায্য করা যায় কি না জানতে গিয়েছিলেন। দরজা খোলা ছিল। ঢুকে দেখেন কেউ নেই, তখন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে আসেন। অথচ জয়ন্তী বলছে, দরজা-লক করা ছিল। ৯ই জুন বিকেলে আমি ভূতের পাহাড়ে পশ্চিমের খাদের একটা ছোট চাতালে ওঁকে আবিষ্কার করি। কী করছিলেন? জবাবে বলছেন–বেচারী পারেখ কীভাবে কোথায় পড়ে মারা গিয়েছিল, দেখার কৌতূহল ছিল। কিন্তু জয়ন্তী যে খামটা উদ্ধার করেছে, তা উনিই লুকিয়ে রেখেছিলেন, ভূতের পাহাড়ের পূর্বদিকের খাঁজে। এ খাম কোথায় পেলেন? (খামে আছে একটি ছবির নেগেটিভ প্রিন্ট। খামের প্রশ্নে উনি আকাশ থেকে পড়লেন! জয়ন্তী ভুল দেখেছে। উনি নুড়ির ওখানে যানইনি। মন্তব্য : স্পষ্টই মিথ্যা বলছেন। কী উদ্দেশ্য?

(৬) শ্রীরঘুবীর জয়সোয়াল : ৬ই জুন এসেছেন। (বেশ সিগনিফিক্যান্ট) ৭ই জুন বেরিয়ে যান দুপুর বারোটায়। ফেরেন একেবারে চারটে নাগাদ। সাড়ে চারটেয় যান মালহোত্রা ভবনে। মোহন পারেখের সঙ্গে পরিচয় নেই কস্মিনকালে। বেরিয়েছিলেন সামরিক ছাউনির উদ্দেশে। সেখানে এক মেজর তাঁর বন্ধু নাকি। ওখানেই খাওয়া-দাওয়া করেন। (এর সত্যতা যাচাই আপাতত রাস্তা চালু না হওয়া অবধি অসম্ভব) শ্ৰীমতী মালহোত্রার সঙ্গে পরিচয় এখানে আসার পরই। ভূত-প্রেত ও ভগবানে আস্থা নেই। তাঁর মতে, হত্যাকারী শ্ৰীমতী মালহোত্রা ছাড়া আর কেউ নয়। উদ্দেশ্য? রাস্তা চালু হলে ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি পাব। জয়সোয়ালজির মতে, শ্রীমতী মালহোত্রায় ওই হিস্টিরিয়া নিছক ভান। (জাঁদরেল পুলিসকর্তার পক্ষে এ-সব মতামত স্বাভাবিক) আজ পশ্চিমের খাদে গিয়েছিলেন সরেজমিনে তদন্তে। সেখান থেকে শ্রীমতী মালহোত্রাকে আবিষ্কার করেন নীচের খাদে। এর অর্থ হত্যাকারীর সেই চিরন্তন মানসিকতা। হত্যাকাণ্ডের জায়গায় আবার যাওয়ার প্রচণ্ড কৌতূহল থাকে। না গিয়ে কিছুতেই পারে না। (শ্রীমতী মালহোত্রা কিন্তু স্বীকার করেছেন যে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে আজ খাদে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য? কৌতূহল এবং শোক। বাছা পারেখের জন্যে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে গিয়েছিলেন)…..

এবার সাত নম্বর লোকটির নাম দেখে আমি আকাশ থেকে পড়তে পড়তে চেঁচিয়ে উঠলুম-আরে, এ কী!

জয়ন্তীও চমকে উঠেছিল। পরক্ষণে সে ফিক করে হেসে উঠল। বলল, সুপার এক্সেলেন্ট! তারপর ঝুঁকে পড়ল কাগজটার দিকে।

 (৭) শ্রীজয়ন্ত চৌধুরী : ঘটনার সময় অর্থাৎ ৭ই জুন রাত্রে প্ল্যানচেটের আসরে ঘর অন্ধকার হওয়ার পর সে চেয়ার ছেড়ে উঠেছিল কি? বলেছে উঠিনি। অথচ আমার ধারণা, সে উঠেছিল এবং শ্যামলীর দিকে এগোচ্ছিল। আমার হাতে এর খসখসে কোটের ছোঁওয়া লেগেছিল। খামচে ধরতে যাচ্ছি, নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে এল কারণ টের পেয়েছিল যে আমি অন্ধকারেও সজাগ ও সতর্ক রয়েছি। (মন্তব্য : ওরকম খসখসে কোট কারো গায়ে ছিল না তখন।)

জয়ন্তী আবাক চোখ তুলে বলল–কী খুদে গোয়েন্দামশাই? ব্যাপারটা কী খুলে বল তো?

আমি গুম হয়ে ইললুম–ভ্যাট! সব গুল।

কর্নেলের ভুল হবে, বলতে চাও?

 –আলবৎ হবে। উনি তো দেবতা নন?

জয়ন্তী একটু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল–কে জানে! তোমাকে আমার বড় রহস্যময় লাগে!

–লাগা উচিত। প্রেমিক হিসেবে নিজেকে আমি খুব রহস্যময় মনে করি।

–থাক। আত্মপ্রশংসায় কাজ নেই। তারপর কী লিখেছেন কর্নেল, দেখি। আমরা আবার পড়তে নারি–

কিছু বাড়তি সূত্র : (১) প্ল্যানচেটের সময় অন্ধকারে জয়সোয়ালজির চেয়ার অন্তত এক মিনিট খালি ছিল। আমি হাত বাড়িয়ে এটা টের পেয়েছিলুম। সত্যিকার ভূত কি না দেখতে চেষ্টা করছিলেন নাকি? (২) ডাইনিং হলে কফি খাওয়ার সময় অর্থাৎ আসরের আগে অধ্যাপক দ্বিবেদী আর শ্যামলী পাশাপাশি বসে ছিল। তখন ওরা চাপা গলায় কিছু আলোচনা করছিল। অধ্যাপকের উচ্চারিত একটা শব্দ কানে এসেছিল আমার সাবধান! (৩) স্টাডিতে শ্যামলীর ঠিক পিছনের বুকশেলফটার তলায় খুবই সূক্ষ্ম কালো একটা চুলের মতো জিনিস পাওয়া গিয়েছে। কতকটা বিষাক্ত পতঙ্গের হুলের মতো দেখতে। ডঃ পট্টনায়কের পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির অভাব। (৪) শ্যামলীর মাথার পিছন দিকে বোলতার হুল ফোঁটানোর মতো একটা স্পট আছে। ওখানেই প্যাথোজেন প্রথম ঢোকে। (৫) ডঃ পট্টনায়ক বলছেন, প্যাথোজেনের সঙ্গে এক ধরনের অজ্ঞাত রাসায়নিক জিনিসও দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় পাওয়া গেছে। জিনিসটার উদ্ভূত ক্রিয়াশীলতায় প্যাথোজেনের কলোনি ফর্ম করার ক্ষমতা হাজারগুণ বেড়ে যায়।

আর পড়া হয় না। কর্নেল এসে পড়লেন। এসেই কাগজগুলো ছোঁ মেরে প্রায় কেড়ে নিলেন–যথেষ্ট হয়েছে। আমরা এবার বেড়াতে বেরোব। ওঠ তোমরা। নীচে ডঃ পট্টনায়ক অপেক্ষা করছেন।

উঠে দাঁড়িয়ে বেজারমুখে বললুম–আমার নামে ওসব কী লিখেছেন, শুনি?

কর্নেল মুচকি হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন–এখন কোন কথা নয়। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।

হোটেলের লনে গিয়ে দেখি, একটা জিপ আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। কর্নেল ইশারা করলে আমি আর জয়ন্তী লক্ষ্মী ছেলেমেয়ের মতো পিছনের দিকে ঢুকে বসলুম। কর্নেল আর পট্টনায়ক বসলেন সামনে। ড্রাইভারের পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছিল, গাড়িটা পুলিশের।

স্টার্ট দিয়ে টনকপুর বোডে পৌঁছুলে জয়ন্তী আমার দিকে তাকাল। অর্থাৎ কোথায় যাওয়া হচ্ছে এভাবে? মাথা নাড়লুম। কে জানে! যমের বাড়ি যে নয়, তা নিশ্চিত। গত পরশু রাতের ভয়ঙ্কর দুর্যোগে বাণেশ্বর যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তার সব রাস্তারই গড় দূরত্ব নিশ্চয় কমে গেছে। টনকপুর রোডের কোথায় ধস ছেড়েছে জানি না, তবে জিপের গতি দেখে মনে হল খানিকটা দূরেই হবে।

মাইলটাক রাস্তার আঁকিবুকিং গোলকধাঁধা ঘুরে একটা অনন্ত হাজার পাঁচেক ফুট উঁচু পাহাড়ের গায়ে গাড়ি উঠল। তারপর ফের এক চুলের কাটার মত বাঁকের কাছে গিয়ে থেমে গেল। ডাইনে খাড়া পাথরের দেয়াল, বাঁয়ে অতল খাদ। তাকিয়ে গা শিরশির করে উঠল। কর্নেল বললেন–তাহলে নেমে পড়া যাক।

সবাই নামলুম। জিপটা যেখানে ব্রেক কষেছিল, সেখানে বাঁয়ে খাদের ওপর রাস্তার কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড হলুদ গাছ। কাজেই ছায়া ছিল। কর্নেল আমার ও জয়ন্তীর হাত ধরে সস্নেহে বললেন–ডঃ পট্টনায়ক, চলে আসুন।

বাঁকের ওপারে কয়েক গজ এগিয়ে থমকে দাঁড়ালুম সবাই। এই ভয়ঙ্কর ধসের চেহারা কল্পনা করতে পারিনি। বনেদী এই হাইওয়েটা হঠাৎ কেউ যেন পাহাড়ের গা থেকে ধারাল কোন অস্ত্রে চেঁছে সাফ করে ফেলেছে–ঠিক দাড়ি কামানোর মতো। ওপারে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে অন্তত সিকি মাইল দূরে। নীচে বয়ে চলেছে একটা প্রবল জলস্রোত। উত্তর থেকে এসে ধসের খাদ ঘুরে একটা প্রকাণ্ড শাখাপথ তৈরি করে ফেলেছে সে। অজস্র গাছ উপড়ে পড়ে রয়েছে ইতস্তত।

ধ্বংসের এই দৃশ্য বিস্ময় এনেছিল প্রত্যেকের চোখে। একটু পরে ঠাহর হল, মানুষ তাই বলে ভড়কে যাবার মতো প্রাণী নয়। ওপারে অসংখ্য লোক রাস্তাটা আবার গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। পোশাক দেখে বোঝা গেল, ওরা সামরিক বাহিনীর লোক। অনেকগুলো এক্সক্যাভেটার, ডোজার, ক্রেনও দেখতে পেলুম। অতদূর থেকে সব কিছু পোকার নড়াচড়া বলে ভুল হতে পারে।

কিন্তু এইসব দেখাতেই কি নিয়ে এলেন কর্নেল? ওঁর দিকে তাকালুম। একটু হাসলেন। –দেখলে তো জয়ন্ত? অন্তত পনের দিনের আগে এখান থেকে বেরোনো যাবে না। তবে যদি অন্য ব্যবস্থা হয়ে যায় ইতিমধ্যে, তো মঙ্গল।

আমি কোন জবাব দিলুম না। জয়ন্তী শিউরে উঠে বলল–সর্বনাশ! তাহলে কী হবে!

কর্নেল জবাব দিলেন–খুব সম্ভব হেলিকপ্টার নামবার জায়গা আজই করে ফেলবেন বাণেশ্বর কর্তৃপক্ষ। গতকাল থেকে মিলিটারি হেলিকপ্টার খুব ঘোরাঘুরি করছে, নামতে পারছে না। বাণেশ্বর ইস্টের এয়ারস্ট্রিপটা সারদা নদী পুরো খেয়ে ফেলেছে। ওখানেই একটা পাহাড়ের মাথায় গাছপালা সাফ করা হচ্ছে। যাক গে, এবার আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় যাব। ডঃ পট্টনায়ক, আপনিও তো পথ চেনেন–আপনিই লিড নিন।

পথ! এখানে পথ কোথায়? চারদিকে খুঁজছি দেখে ডঃ পট্টনায়ক বললেন– চলে আসুন জয়ন্তবাবু!

খাদের দিকে রাস্তার কিনারায় একটা সাত-আটফুট উঁচু পাথর রয়েছে। ডঃ পট্টনায়ক পাথরটার কাছে গিয়ে হঠাৎ এক লাফ দিলেন। তারপর উনি অদৃশ্য। আমি হতবুদ্ধি হয়ে ইতস্তত করছি দেখে কর্নেল পিছন থেকে ঠেলে দিলেন। প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলুম। কিন্তু পড়ে গিয়ে দেখি একটা মোটামুটি চাওড়া জায়গায় দাঁড়িয়ে গেছি। ফুট চারেক নীচে একটা চাতাল। তারপর পাথরের চাই ধাপে ধাপে নেমে গেছ গভীর খাদটার দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে নামা শুরু হল। আন্দাজ একশো ফুট নামার পর দেখি ডঃ পট্টনায়ক একটা গুহার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমার পরে নামল জয়ন্তী, তারপর কর্নেল। ডঃ পট্টনায়ক পকেট থেকে টর্চ বের করে বললেন-সাবধানে আমাকে অনুসরণ করুন সবাই।

গুহার দরজাটা ফুট পাঁচেক উঁচু, চওড়ায় ফুট তিন-সাড়ে তিন হবে। অস্বস্তি হল একটু। ঘুরে কর্নেলের দিকে তাকালুম। কর্নেল এগিয়ে যেতে ইশারা করলেন। ডঃ পট্টনায়ক ভিতর থেকে ডাকছিলেন–কই, চলে আসুন আপনারা।

এই সময় লক্ষ্য করলুম, গুহার দরজার কালো স্লেটপাথরে অজস্র নাম সই করা রয়েছে। সব দ্রষ্টব্য পুরনো জায়গায় এমন কাণ্ড চোখে পড়ে। যারা বেড়াতে যায়, তারাই নাম লিখে রেখে আসে। কাজেই, এই গুহাটা অনাবিষ্কৃত রহস্যময় কোন গুহা নয়। তবে দুধারে ঝোপঝাড় গাছপালা, কিছু ছিল, ঝড়ে বৃষ্টিতে ধস ছেড়ে সেগুলো সাফ হয়ে গেছে। মাটি বলতে যা কিছু ছিল, সেদিন রাতে প্রকৃতি সব ধুয়ে মুছে ফেলেছে। কাজেই মাটির সন্তান ওই উদ্ভিদও মাটির অনুগামী হতে বাধ্য হয়েছে।

আঁশটে গন্ধ সব গুহাতেই পাওয়া যায়। নাকে রুমাল দিয়ে এগোলুম। মাথা নীচু করে যেতে হচ্ছিল। ভেতরটা প্রচণ্ড অন্ধকার। দম আটকে আসছিল। আন্দাজ পনের থেকে কুড়ি ফুট যাবার পর ডঃ পট্টনায়ক বললেন-বাঁয়ে ঘুরতে হবে।

মোড় নিতেই মনে হল এবার একটা চওড়া জায়গায় এসে পড়েছি। ডঃ পট্টনায়ক চারদিকে আলো ফেলছিলেন। ঠিক তাই। ছাদটা অন্তত ফুট নয়েক ওপরে–ভেতরটা কমপক্ষে পনের ফুট চওড়া। টুকরো কাগজ, বাদামের খোসা, চকোলেটের প্যাকেট, আর একটা ছেঁড়াখোঁড়া কম্বলও পড়ে থাকতে দেখলুম টর্চের আলোয়। এবার কর্নেল বললেন–জয়ন্তী, তাহলে এবার খুঁজে দেখা যেতে পারে।

জয়ন্তী বলল–ডঃ পট্টনায়ক, টর্চটা দিন, প্লিজ!

আমি জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে আছি তো আছি! টর্চটা ঝলসে উঠছে বার বার, আর ওর মুখেচোখে একটা তীব্রতা লক্ষ্য করছি। আর ক্ষোভে অভিমানের মনে জ্বালা ধরে যাচ্ছে। আশ্চর্য, জয়ন্তী আমাকে কত কথা লুকিয়েছি তাহলে। এই গুহার ব্যাপারটা তো বলেনি আমাকে বলেছে, ওই ধুরন্ধর বৃদ্ধকে! ঠিক আছে। এত গোপনীয়তা যখন আমার সঙ্গে, তখন আব ভাব করে কাজ নেই। আড়ি তোমার সঙ্গে আড়ি, জয়ন্তী! মনে মনে একে একশো আড়ি দিলুম।

এ সময় আমার কাঁধে কর্নেলের হাত পড়ল। কী জয়ন্ত! খুব বোকা বানিয়ে ফেলেছি কি? প্লিজ, ডার্লিং, একটু ধৈর্য ধরো।

জয়ন্তী হাঁটু দুমড়ে কাগজের টুকরোগুলো কুড়োচ্ছিল। অস্ফুটস্বরে বলল– আর কি পাব খুঁজে? ৬ তারিখ দুপুরের ব্যাপার, আজ ৯ তারিখ! তিন দিন!

বলতে বলতে হঠাৎ সে কোণের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উত্তেজিত স্বরে বলল ফের–পেয়ে গেছি। এই যে। তারপর দলপাকানো একটুকরো কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে কর্নেলের দিকে হাত বাড়াল।

কর্নেল সেটা নিয়ে পকেটে পুরলেন। তারপর অকারণ চেঁচিয়ে বললেন– তাহলে ফেরা যাক। ডঃ পট্টনায়ক, আপনি আগে–তারপর জয়ন্ত, তার পিছনে জয়ন্তী, শেষে আমি।

কিন্তু চওড়া জায়গা থেকে সরু সুড়ঙ্গে পৌঁছে দেখি, আমি আবার পিছনে। আমার আগে জয়ন্তী, তার আগে কর্নেল, এবং ডঃ পট্টনায়ক সবার আগে। তারপরই ডঃ পট্টনায়ক ঘোষণা করলেন-যাঃ! সুইচ বিগড়ে গেল টর্চের। সাবধানে এগোন।

কেউ কোন জবাব দিল না। জয়ন্তীকে ছুঁয়ে আন্দাজ করে পা বাড়াচ্ছিলুম। দম আটকে যাচ্ছিল আবার। আগে জানলে কক্ষনো ঢুকতুম না এখানে।

তারপর মনে হল, হাত বাড়িয়ে জয়ন্তীকে আর পাচ্ছি না। আসার সময় বাঁদিকে বেঁকে গিয়েছিল সুড়ঙ্গ–এবার তাহলে ডাইনে ঘুরতে হবে। ভাবলুম– ওদের ডাকি। কিন্তু পাছে ওঁরা ভাবেন যে ভয় পেয়ে গেছি, আঁতে ঘা লাগল। তাই সাহস করে ডাইনের দেয়ালে হাত রেখে এগোলুম। মনে হচ্ছিল, আমি কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। ওঁদের পায়ের শব্দ আবছা শোনা যাচ্ছে। এই সময় ডাইনে মনে হল পথটা ঘুরেছে। যেই ঘুরতে গেছি, অমনি টের পেলুম কী একটা আমার কোটের পকেটে ঢুকেছে। আঁতকে উঠে চেঁচালুম-কর্নেল, কর্নেল!

ভেবেছিলুম, নির্ঘাত পাহাড়ী গুহার অজগর ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু আশ্চর্য সেই জিনিসটা সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পেরিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আরও অবাক কাণ্ড, কর্নেলের সাড়া পেলুম না। তখন আমার অবস্থা শোচনীয়। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে–শরীর হিম, গলা শুকনো কাঠ। আবার চেঁচিয়ে উঠলুম-কর্নেল! ডঃ পট্টনায়ক! জয়ন্তী!

এবার সামান্য তফাতেই ডঃ পট্টনায়কের সাড়া পাওয়া গেল–এই যে, এদিকে জয়ন্তবাবু!

তারপর, অবাক কাণ্ড, ডঃ পট্টনায়কের বিগড়ে যাওয়া টর্চটা জ্বলে উঠল। আলো দেখাচ্ছিলেন উনি। আর পিছন ফিরে তাকালুম না। দৌড়ে সঙ্গ ধরলুম। তখন পট্টনায়ক বললেন–হঠাৎ থেমে গিয়েছিলেন নাকি?

কোন জবাব দিলুম না।

বাইরে বেরিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ল স্বাভাবিকভাবে। মনে মনে নাক-কান মলে গুম হয়ে ওঠা শুরু করলুম সবার আগে। পিছন জয়ন্তী ও কর্নেলের হাসির শব্দ শুনলুম।

ওপরে গিয়ে হলুদ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে মাথা ঠাণ্ডা করছি, কর্নেলরা এসে গেলেন। জয়ন্তী চাপা হেসে বলল কী হয়েছিল তোমার? পিছিয়ে পড়েছিল কেন?

জবাব দিলুম না। সিগারেট বের করে ধরালুম। সেই সময় কর্নেল মৃদু হেসে কাছে এলেন। ডার্লিং। আশা করি ভীষণ ভয়ের ব্যাপার কিছু ঘটেনি!

আর চুপ করে থাকা গেল না। রেগেমেগে বলে উঠলুম–আজ থেকে এই শেষ। আর কক্ষনো আমাকে কোথাও যেতে ডাকবেন না।

কর্নেল নিরীহ মুখে বললেন–আহা, অত রাগ কি তোমার মতো ছেলের শোভা পায়, জয়ন্ত? তুমি একটা জিনিয়াস ছেলে। তোমার সাহস আর শক্তির পরিচয় এর আগে তো কম পাইনি। হঠাৎ তুমি মিছিমিছি ভয় পেয়ে যাবে, এ তো ভাবতেই পারিনি আমরা?

এ একটা অদ্ভুত ব্যাপার–কর্নেলের ওপর রাগ করে থাকা কিছুতেই যায় না। ওই কথাগুলো এমন গুরুত্ব দিয়ে বললেন যে মনে হল উনি সত্যিই আমার জন্য সহমর্মিতা অনুভব করছেন। তাই রাগ খানিকটা কমিয়ে দিয়ে বললুম– থাক, খুব হয়েছে। আমি কচি খোকা নই।

কর্নেল চাপা গলায় বললেন–কী? হয়েছিল কী বল তো?

গজগজ করে জবাব দিলুম–অনেক কিছুই। প্রথমত আপনি ঘোষণা করলেন যে সবার পিছনে থাকবেন। অখচ পরে দেখি আমাকে কনুইয়ের গুতো মেরে পিছনে ঠেলে দিলেন। দ্বিতীয়ত–ডঃ পট্টনায়কের টর্চ আচমকা বিগড়ানোর ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। আপনাদের একটা ষড়যন্ত্র ছিল এর পিছনে। আমাকে নিয়ে মজা করতে চেয়েছিলেন। বলুন, এটা আমার পক্ষে অপমানজনক কী না। বলুন, এরপরও আপনাদের সঙ্গে ঘোরা আমার উচিত কি?

কর্নেল বিব্রতমুখে বললনে–আ ছিঃ ছিঃ! ওকথা বোলো না জয়ন্ত।

ডঃ পট্টনায়ক একটু তফাতে দাঁড়িয়ে মুদু মুদু হাসছিলেন। এবার কাছে এসে বললেন–চেঁচিয়ে উঠেছিলেন কেন জয়ন্তবাবু?

বললুম–দেখুন ডঃ পট্টনায়ক, ওই গুহার মধ্যে একটা অজগর-টজগর আছে, তাতে কোন ভুল নেই।

–অজগর? কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। পট্টনায়কও বিস্মিতমুখে তাকিয়ে রইলেন।

–হ্যাঁ। তাছাড়া আর কী হতে পারে? আমার কোটের পকেটে মুখ ঢুকিয়ে দিয়েছিল সাপটা।

জয়ন্তী খিলখিল করে হেসে উঠল। এবং আশ্চর্য, কর্নেল আর ডঃ পট্টনায়কও হো-হো করে হেসে উঠলেন। সে-হাসি আর থামতে চায় না। আমি এক লাফে তক্ষুনি গাড়িতে উঠে বসলুম। ড্রাইভার বলল–ক্যা হুয়া সাহাব?

কুছ নেহি। বলে গম্ভীর মুখে বসে রইলুম।

একটু পরে তিনজনে গাড়িতে ঢুকলেন। ঢুকেই কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন–তোমার ভুল হচ্ছে না তো জয়ন্ত? ওটা কি সাপ ঢুকেছিল, নাকি কারুর হাত?

জবাব দিলুম না। কিন্তু কথাটা শুনেই আঁতকে উঠলুম। হৃৎপিণ্ডে এক ঝলক রক্ত উপচে উঠল।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–সাপ হোক, আর হাতই হোক, ওটা যে খুবই নিরীহ বস্তু, তাতে আমাদের সন্দেহ নেই। ধরমবীর স্টার্ট দাও। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। আর ডঃ পট্টনায়ক, তাহলে আমাদের অনুমান হুবহু সত্য বলে প্রমাণিত হল। তাই না?

.

লাঞ্চের পর হোটেলের বাইরে লনে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আগাগোড়া সবটা ভাবছিলুম। ভাবতে ভাবতে টের পেলুম, প্রকৃত ব্যাপারটা কী ঘটেছে। গুহায় কর্নেলের পিছনে থাকার কথা চেঁচিয়ে বলে দেওয়া এবং আমাকে পিছনে ঠেলে দেওয়ার কারণ, কর্নেল জানতেন কেউ ওই কাগজটা হাতাতে চেষ্টা করবে। অর্থাৎ গুহার মধ্যে আগে থেকে কেউ লুকিয়ে ছিল কোথাও, কর্নেল জানতেন। কিন্তু তাকে হাতেনাতে ধরলেন না কেন উনি? যেন মজাটা আমার সঙ্গে নয়, তার সঙ্গেই করলেন। সুতরাং একটা ব্যাপার এতে স্পষ্ট। এই গুপ্ত লোকটিকে কর্নেল হাতেনাতে ধরতে চান না। স্বভাবমতো তার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে চান।

কিন্তু দুটো তীব্র প্রশ্ন সামনে ভেসে এল। এক : সেই কি শ্যামলী ও পারেখের হত্যাকারী? দুই : ওই কাগজে কী আছে?

প্রথম প্রশ্নটার দিকে আলাদা করে তাকাতে গিয়ে রক্তে খিল ধরে গেল। ওরে বাবা! তাহলে তো সে অনায়াসে আমাকে খুন করতে পারত, ঠিক যে উপায়ে শ্যামলীকে খুন করেছে।

অথচ কর্নেল বলেছেন যে সেই হাতটা খুবই নিরীহ বস্তু! কেন?

এই সময় জয়ন্তী হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল। আমার কাছে এসে বলল কী ছোট গোয়েন্দামশাই, মনে মনে ঝাল ঝাড়া হচ্ছে কারো ওপর তাই না?

বললুম–বয়ে গেছে! সিগারেট খাচ্ছি দেখতে পাচ্ছ না? তাছাড়া যা গরম পড়েছে! হাওয়া নিচ্ছি গায়ে।

জয়ন্তী আরো কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর বলল বুঝতে পারছি, তুমি আমার ওপর ভীষণ রেগে আছ। কর্নেলের আদেশের অবাধ্য হবার ক্ষমতা ছিল না। আমাকে ভুল বুঝো না, জয়ন্ত।

ঠিক আছে। আমি তো অবাধ্য হতে বলিনি কাউকে।

–কিন্তু এই চমৎকার পরিবেশে তোমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এখন অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে। এবার অনায়াসে জবাব দেব প্রশ্ন করো।

ওর সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে অভিমান পুষে রাখা গেল না। বললুম– ওই কাগজটার কী ব্যাপার?

ব্যাপার সত্যি বড্ড অদ্ভুত। তবে প্রথমে অতটা বুঝতে পারিনি বলে গুরুত্ব দিইনি এবং ভুলেও গিয়েছিলুম। ৬ তারিখে আমি আর শ্যামলী ওই গুহা দেখতে গিয়েছিলুম। আরো অনেক ট্যুরিস্ট ছিল ওখানে। বেশ ভিড় ছিল। অনেকে মোমবাতি হাতে নিয়ে ঢুকেছিল, তাই আলোর অভাব ছিল না। গুহার গায়ে আশ্চর্য সুন্দর সব ছবি আছে। অজন্তার মতো ফ্রেস্কো ছবি। তারপর কী। হল শোন। ভিড়ের মধ্যে কে শ্যামলীর হাতে একটা ভাজকরা কাগজ খুঁজে দিল। আমি দেখিনি, একটু পরেই শ্যামলী বলল সে-কথা। তখন দুজনে সেই অল্প আলোয় কাগজটা খুব পড়ার চেষ্টা করলুম। মোমের আলোগুলো নড়াচড়া করছিল। সেই ফাঁকে যতটা পড়া যায়, পড়লুম। লেখা আছে : মোহন পারেখ আসছে। সে একজন সাংঘাতিক লম্পট। ওর সঙ্গে মিশলে বিপদে পড়বেন। সাবধান। আমরা তো অবাক। শ্যামলী বরাবর নির্বিকার নির্লিপ্ত থাকতে চায়। কিছু গ্রাহ্য করা ওর স্বভাব নয়। দলাপাকিয়ে কাগজটা ফেলে দিয়েছিল। তারপর ও নিয়ে আমরা আর বিশেষ আলোচনা করিনি। ভুলেই গিয়েছিলুম।

–আমাকে বললে জানি না কোন্ মহাভারত অশুদ্ধ হত!

কর্নেল নিষেধ করেছিলেন বলতে। বলেছিলেন, জয়ন্তকে নিয়ে একটু মজা করতে চাই।

বলে জয়ন্তী আমার হাত ধরে টানল। চলো। ঘরে যাওয়া যাক! কী বাতাস এখানটায়।

লন পেরিয়ে লাউঞ্জে ঢুকলুম। দেখলুম, কর্নেল, ডঃ পট্টনায়ক আর ব্রিজেশ সিং কোণের দিকে বসে গম্ভীর হয়ে কী সব আলোচনা করছেন। আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেলুম। ওপরের করিডরে অধ্যাপক দ্বিবেদীর সঙ্গে দেখা হল। ভদ্রলোককে খুব মনমরা মনে হচ্ছিল। আমাদের দেখে একটু হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। আস্তে আস্তে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলেন। জয়ন্তী মুখ টিপে হাসল। সিঁড়ির দিকে ভদ্রলোক অদৃশ্য হলে সে বলল–ভদ্রলোক ওপরে ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছিলেন কেন, বুঝতে পারছ? সেই খামটার জন্যে।

ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলুম। তারপর বললুম–খামের মধ্যে একটা নেগেটিভ ছবি আছে, কর্নেল বলছিলেন। তুমি জানো ছবিটা কিসের বা কার?

জয়ন্তী মাথা দোলাল।

–জানলেও তো বলবে না। ঠিক আছে, বোলো না! তুমি তো এখন গোয়েন্দাপ্রবরের প্রধান শিষ্য। আমি কোথাকার কে?

জয়ন্তী তেড়ে এল। –এই! আর ঝগড়া নয়। এবার কিছুক্ষণ দিবানিদ্রার ব্যপার আছে।

তা তুমি নিজের ঘরে যাও না!

জয়ন্তী গাল ফুলিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো বললতাড়িয়ে দিচ্ছ?

ওর দুধ ধরে মুখের ওপর ঝুঁকে বললুম–তা কি পারি? কিন্তু একটা কথা–তুমি যেভাবে দিবানিদ্রার প্রতি আসক্ত, তোমার যে ভুড়ি ও চর্বি হয়ে যাবে জয়া! তখন আর পাহাড়ে চড়তে পারবে?

জয়ন্তী ক্লান্ত ও বিষণ্ণভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-শ্যামলী নেই। আর আমার পাহাড়ে চড়া হবে না, জয়ন্ত। ওর টানেই আমি মাউন্টেনিয়ারিংয়ের নেশায় পড়েছিলুম।

এতক্ষণে ওকে সত্যিকার আদর করতে করতে বললুম–ঠিক আছে। এবার লক্ষ্মী মেয়েদের মতো–বলেছি বাঙালি মেয়েদের ভঙ্গিতে স্রেফ কুলবধূ হয়ে যাবার চেষ্টা করো। কেমন?

ও মৃদু ধাক্কা দিয়ে একটু সরে বলল–বধূ হই আর যা হই, তুমি কিন্তু বিশেষ আশা করে বসো না। কারণ, আশা অনেক সময় শুধু ছলনায় ফুরিয়ে যায়…