৩. প্যাথোজেন ও ইলেকট্রনিক ঘড়ি

০৩.

প্যাথোজেন ও ইলেকট্রনিক ঘড়ি

ঘুম ভাঙলে প্রথমে কয়েক মুহূর্ত কিছু টের পেলুম না যে কোথায় আছি। মাথাটা খালি লাগছিল। তারপর মনে পড়ল রাত তিনটেয় গ্রিন হোটেলে ফিরে এসেছিলুম কর্নেলের সঙ্গে। কোন কথা আর বলিনি পরস্পর এবং শুয়ে পড়েছিলুম।

মাথার কাছে হাতড়ে ঘড়িটা বের করলুম। দেখি, সাড়ে আটটা বাজে। তখন মুখ ঘুরিয়ে আমার বৃদ্ধ বন্ধুকে খুঁজলুম। ওঁর বিছানা খালি। এত পারেন বটে! যত রাতই জাগুন, বরাবর দেখেছি, ছটার পর আর বিছানায় কিছুতেই পড়ে থাকবেন না। প্রাতঃকৃত্য সেরেই বেড়াতে বেরোবেন এবং যথাসময়ে ফিরে আমাকে জেগে থাকতে দেখলে সলজ্জ হেসে বললেন–সুপ্রভাত ডার্লিং! আশাকরি, সুনিদ্রার কোন ব্যাঘাত ঘটেনি।

পশ্চিমের জানলা খোলা ছিল। কাত হয়ে কিছুক্ষণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে থাকলুম। এখন উজ্জ্বল রোদ ঝলমল করছে। পাহাড় ও অরণ্য জুড়ে হলুদ ও লাল রঙে আঁকা এক অপার্থিব আনন্দ-ধারার ছবি আঁকা হয়েছে যেন। তাজা জীবনের ওই দপে মৃত্যুর দুঃখ বা তাশরীরী অশুভের কোন আতঙ্ক নেই।

এবার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সেই কুখ্যাত ভূতের পাহাড়ে চোখ গেল। সেখানেও রোদ ঝলমল করছে। এখন মনে হল, গত রাতে যা কিছু ঘটেছে সব একটা মারাত্মক দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু নয়।

হাত বাড়িয়ে ঘণ্টার সুইচ টিপতে যাচ্ছি, দরজায় বেয়ারা হরিয়ার পরিচিত গলা শোনা গেল–বেড টি এনেছি সাহাব!

–চলে এস।

 হরিয়া চা রেখে চলে গেল। ওকে জিগ্যেস করলুম না–এখন বেড টি দিতে কে ফরমাশ করল। কর্নেল ছাড়া আর কে হবেন? নিশ্চয় তিনি তার হাজার চোখের একটি দিয়ে সব দেখতে পাচ্ছেন আমি কী করছি না-করছি।

ধীরেসুস্থে আধশোয়া অবস্থায় চা খেয়ে তারপর উঠে পড়লুম। বাথরুমে গিয়ে দাড়ি কাটতে কাটতে রাতের সব ঘটনা এতক্ষণে চোখের সামনে ভেসে উঠল। শ্যামলীর মুখটা মনে পড়ল। অমনি সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে গেল। অধ্যাপক অরিন্দম দ্বিবেদী, পুলিস অফিসার মিঃ সত্যেশ খান্নাকে বলছিলেন, যদি এ কোন অলৌকিক বা ভুতুড়ে কাণ্ড হয়, তাহলে আমার ধারণা, বিকেলে ওই ভূতের পাহাড়ে চড়ার সময় দুষ্ট আত্মাটা শ্যামলীর পিছু নিয়েছিল।

তখন কথাটা গ্রাহ্য করিনি। এখন মনে হল, তাই ঘটেছে। তাছাড়া আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে শ্যামলীর মৃত্যুর? আর মোহন পারেখের ব্যাপারটা…

চিন্তায় বাধা পড়ল আমার বৃদ্ধ সঙ্গীর কণ্ঠস্বরে। সুপ্রভাত জয়ন্ত। আশা করি তোমার সুনিদ্রা হয়েছে। উঁকি মেরে দেখি, কর্নেল আর জয়ন্তী ঘরে ঢুকেছেন কখন। আশ্চর্য, এতটুকু শব্দ হয়নি দরজার! জয়ন্তীর মুখটা ফেলা ফোলা। চোখ দুটো কোটরে ঢুকেছে। শোকগ্রস্ত রুক্ষ চেহারা। বেচারার জন্যে দুঃখ হল। সে একটা চেয়ারে বসলে কর্নেল আমার উদ্দেশে ফের বললেন– জয়ন্তের মেজাজের কাটা কি এখনও স্বাভাবিক ডিগ্রিতে পৌঁছায়নি? তোমাকে ওই পাহাড়ী জংলী টাট্ট বদ্রীটার সঙ্গে ভূতপ্রেত অধ্যুষিত বাণেশ্বরে খানিকটা ছোটাছুটি করিয়েছিলুম গত রাত্রে। এজন্যে আমাকে ক্ষমা করো। তোমার মতো শক্তসমর্থ বুদ্ধিমান যুবক আর কোথায় পেতুম তখন?

কথার ভঙ্গি শুনে হেসে ফেললুম। দাড়ি কাটার সময় কথা বলতে নেই। এ আমার গুরুজনের শিক্ষা। যাক্ গে। মোহন পারেখের পাত্তা পাওয়া গেল?

–হ্যাঁ।

 চমকে উঠলুম। –হ্যাঁ মানে? শ্যামলীর কথা তাহলে সত্যি?

–নিখাদ সত্যি, জয়ন্ত। কিছুক্ষণ আগে ভূতের পাহাড়ের পশ্চিম খাদে ওর দলাপাকানো লাশটা পুলিশ খুঁজে পেয়েছে। কেউ সত্যি ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল।

তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলুম। দাঁত ব্রাশ করা আর হল না। ঘরে ঢুকে নিজের বিছানায় বসে বললুম–আপনি স্বচক্ষে দেখে এলেন নাকি?

–দেখলুম।…….কর্নেল চিন্তিত মুখে জবাব দিলেন।

শ্যামলীর লাশের ময়নাতদন্ত এতক্ষণ নিশ্চয় হয়ে যাওয়া উচিত। কোন খবর পাননি এখনও?

–ডঃ পট্টনায়ক মর্গে রয়েছেন। উনি রিং করবেন নটা নাগাদ। দেখা যাক।

মর্গ তো সেই বাণেশ্বর-ইস্টের হাসপাতালে?

 কর্নেল মাথা দোলালেন। জয়ন্তী আস্তে ভাঙা গলায় বলল–কী পাবে লাশে? কিছু না। আমাকে শ্যামলী বরাবর কুসংস্কারের ডিপো বলে ঠাট্টা করত। তাই যেন ওর এই কঠিন শাস্তি হল! ওর মাকে কী ভাবে মুখ দেখাব, ভেবে পাচ্ছি না!

বললুম–ওর আত্মীয়স্বজনকে টেলি করা হয়েছে তো?

কর্নেল বললেন তুমি এইমাত্র ঘুম থেকে উঠেছ কি না। গতরাত্রে আরো কত ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে, জানো না জয়ন্ত। বাণেশ্বরে আমরা আপাতত কয়েকটা দিন আটকে গেলুম। কারণ ফেরার পথ বন্ধ। টনকপুরের রাস্তায় বিরাট ধস নেমেছে। টেলিসংযোগ বিচ্ছিন্ন–সব পোস্ট উপড়ে গেছে। মেন ইলেকট্রিক লাইনও ছিঁড়েছে। তার ফলে এখন স্থানীয় বিদ্যুতের ওপর সামান্য ভরসা। লাধিয়া নদীর জলপ্রপাত থেকে জলবিদ্যুৎ যেটুকু হয় তার তিন ভাগ যায় সামরিক ছাউনিতে, এক ভাগ পায় বাণেশ্বরের অসামরিক বাসিন্দারা। লোডশেডিং না হয়ে যায় না আজ। বুঝলে জয়ন্ত, আপাতদৃষ্টে সমস্ত ব্যাপারটা যেন এক অদৃশ্য শক্তির মারাত্মক ষড়যন্ত্র!

বললুম–তাহলে অবশেষে আপনি এতদিনে অলৌকিকে বিশ্বাসী হলেন?

–হলুম মানে? আমি কি অলৌকিকে অবিশ্বাসী ছিলুম কখনও?

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম আমার দীর্ঘ দিনের চেনা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানী ও সর্বশাস্ত্রবিদ প্রাজ্ঞ বন্ধুটির দিকে। বলেন কী! অবশেষে এই বাণেশ্বরে এসে এক রাত্রেই ভীষণভাবে বদলে গেলেন ভদ্রলোক?

আমার মনের কথাগুলো যেন টের পেয়েই ধুরন্ধর বৃদ্ধ একটু হাসলেন। বললেন–জয়ন্ত, প্রকৃতি রহস্যময়ী।

–কী মুশকিল! প্রাকৃতিক রহস্যে বিশ্বাস এক কথা, আর ভূতে বিশ্বাস অন্য কথা যে!

–জয়ন্ত, জয়ন্ত! খামোকা তর্ক করো না। আমি ভূত কথাটা বলিই নি। বলেছি, প্রাকৃতিক শক্তির কথা। সব সময় পায়ে-পায়ে এই অদৃশ্য শক্তির খেলা তুমি কি লক্ষ্য করো না? ভুলে যেও না–আমাদের সামনে প্রতি মুহূর্তে রয়েছে। এক অজানা ভবিষ্যৎ। যা ইচ্ছে করি, তা যে ঘটবেই তার গ্যারান্টি আছে কি? সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে পারে–ওই বুঝি ডঃ পট্টনায়ক ফোন করছেন

প্রতি স্যুটে ফোনের ব্যবস্থা আছে গ্রিন ভিউ হোটেলে। ফোন বেজে উঠেছিল। কর্নেল হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরলেন–হ্যালো, কর্নেল সরকার বলছি।…..হ্যাঁ…..মাই গুডনেস! ……কী? রক্তে প্যাথোজেন? আর ইউ সিওর ডক্টর?…..ও! মাই! ………..আই এগ্রি……….ঠিক আছে। চলে আসুন, অপেক্ষা করছি। ……কে? মিঃ খান্না?…..দ্যাটস রাইট। চলে আসুন।

কর্নেল ফোন রাখলেন। জয়ন্তী উদ্বিগ্নমুখে বলল–মর্গ থেকে ফোন করছিল নাকি?

কর্নেলকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। বললেন–হ্যাঁ। শ্যামলীর মৃত্যুর কারণ তেমন কিছু বোঝা যায়নি। হঠাৎ হার্ট ফেল করেছে, এটুকুই বলা যাচ্ছে। আর রক্তে প্যাথোজেন নামে একরকম সাংঘাতিক জীবাণু পাওয়া গেছে। এসব জীবাণু ফুলগাছের গোড়ায় সঁতসেঁতে মাটিতে হয়, অনেক সময় ফুলদানিতে অনেকদিন ফুল রাখলে তার জলে এরা কলোনি গড়ে তোলে। রক্তের সংস্পর্শে গেলেই চোখের পলকে ঠিক পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের মতো কোটি কোটি কলোনি গড়ে তোলে। সম্প্রতি একটা মারকিন মেডিক্যাল পত্রিকায় পড়ছিলুম, মায়ামি হাসপাতালের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে পর-পর অনেকগুলো অপারেশনের রুগী মারা পড়ে। ডাক্তাররা হতভম্ব। তদন্ত বোর্ড বসল। শেষঅব্দি গোয়েন্দা বিভাগ আসরে নামল। তবু রহস্যের মীমাংসা হল না। অবশেষে দুজন ছোকরা ডাক্তার মরিয়া হয়ে লেগে গেলেন। তারপর আবিষ্কার করলেন যে ওই ওয়ার্ডে একটা ফুলদানিই হচ্ছে অপরাধী! নানা জয়ন্ত, তাই বলে তুমি এ ঘরের ফুলদানি দুটোর দিকে নিষ্ঠুরভাবে তাকিও না। ওই পাহাড়ী অর্কিডে সাজানো টারিলাস ম্যারাইটাভিরাস গোষ্ঠীর ফুল অনেক কষ্টে আমি সংগ্রহ করেছি। প্রতি সকালে তুমি ঘুমিয়ে থাকার সময় ফুলদানি দুটোর জল পালটে দিই। জীবাণুনাশক লোশন ঢেলে দিই। অতএব নির্ভয়ে থাকো। আর জয়ন্তী, ডার্লিং! ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো কিছুক্ষণ। সেই ছটা থেকে অনেক ঘুরেছ এ বুড়োর সঙ্গে। যথাসময়ে তোমাকে ডাকব।

জয়ন্তী বেরিয়ে গেল। আমি বললুম-মোহন পারেখের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবলেন?

কর্নেল বললেন–ভেবেছি। ও ঠিক আমাদের নীচের তলার স্যুইটে ছিল। বেয়ারারা বলেছে, গতকাল দুপুর নাগাদ ও বেরিয়ে যায়। কাকেও কিছু বলে যায়নি। আর ফেরেনি!

কিন্তু বদ্রী বলল সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ফোন করে ওকে এখানে পেয়েছিল।

–বদ্রীটা সম্ভবত কিছু জানে, গোপন করছে। তবে ওর ভুল হতেও পারে। কারণ পুলিসের জেরায় ও কবুল করেছে যে পারেখের কণ্ঠস্বর ওর চেনা নয়। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে কেউ এসময় ওর সুইট থেকে ফোন ধরেছিল।

–কিন্তু স্যুইটে তো ডিরেক্ট লাইন নেই! হোটেলের ম্যানেজার কী বলছেন? অপারেটারেরই বা বক্তব্য কী?

–ম্যানেজার কোন খবর রাখেন না। অপারেটর মেয়েটি বলছে যে সে যথারীতি পারেখ সায়েবের স্যুইটে কানেকশন দিয়েছিল। কোন বোর্ডার ঘরে না বাইরে, তার তো জানার কথা নয়। তবে সে দুপক্ষের যা সব কথাবার্তা শুনেছে, তাতে বদ্রীর কথা ঠিকঠাক মিলে যায়।

–অর্থাৎ ওই সময় পারেখের ঘরে কেউ ছিল?

–রাইট, রাইট!

–পারেখের ঘর তো রাত্রেই সার্চ করা হচ্ছিল। কিছু বোঝা গেছে?

–কিছু না। তেমন কোন সন্দেহজনক ব্যাপার দেখা গেল না। তবে কিছু খোওয়া গেছে কি না, বলা কঠিন। বলতে পারত পারেখ নিজে।

–কিন্তু কর্নেল, মিসেস মালহোত্রার লাইন কাটল কে? বদ্রীকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

–বদ্রীকে পুলিসও বিশ্বাস করে না। তাই গ্রেফতার করেছে। দেখা যাক্।

এই সময় জয়ন্তী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। কর্নেল! কর্নেল! এ কী কাণ্ড! আমাদের ঘরে কেউ ঢুকেছিল জিনিসপত্র হাতড়ে একাকার করে রেখেছে।

–সে কী! বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন–জয়ন্ত, এক মিনিট। আমি আসছি। তুমি তিনটে ব্রেকফাস্ট বলে দাও। খিদে পেয়েছে এবার।

ফোনে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিয়ে রাতের পোশাক বদলাচ্ছি, তখন কর্নেল ও জয়ন্তী ফিরলেন। বললুম–কী ব্যাপার?

কর্নেল একটু হাসলেন–ক্রমশ বোঝা যাচ্ছে, মোহন পারেখ বা শ্যামলীর হত্যাকারী ভূতপ্রেত হোক বা মানুষ হোক, একটা কিছু খুঁজে পাওয়ার জন্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। কী হতে পারে সেটা? এ সার্টেন থিং–কোন একটা জিনিস, তা অপরের কাছে যত অনাবশ্যক বা তুচ্ছ মনে হোক, তার কাছে জীবনমরণ প্রশ্নে জরুরী। হা–এটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জিনিসটা যে কী, তা শ্যামলী আর মোহন পারেখই জানত। দুর্ভাগ্যক্রমে দুজনেই আজ মৃত!

এই সময় ডঃ পট্টনায়কের সাড়া পাওয়া গেল।–আসতে পারি কর্নেল সরকার?

কর্নেল দরজা খুলে বললেন–আসুন, আসুন। আপনারাই অপেক্ষা করছি। এখন শুধু ব্রেকফাস্টপর্ব বাকি। আপনি ইচ্ছে করলে আমাদের সঙ্গে……

ডঃ পট্টনায়ক হাত তুলে বললেন–এইমাত্র সেরে এলুম, কর্নেল।

দয়া করে বসুন।

ডঃ পট্টনায়ক বসে পড়লেন। তারপর চিন্তিত মুখে বললেন–জীবনে অনেক মড়া ঘেঁটেছি। একসময় তো ডাক্তারিই পেশা ছিল। ভুবনেশ্বর মর্গের চার্জেও ছিলুম কিছুদিন। তারপর তো বিলেতে ফোরেন্সিক ডিগ্রি নিয়ে এলুম। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডেও শিক্ষনবিশি করেছি। কিন্তু কর্নেল, শ্যামলীর ডেডবডি আমাকে এক অদ্ভুত রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিনে। এ এক আজব হেঁয়ালি!

দয়া করে বিশ্লেষণ করুন ডক্টর।

মৃত্যুর কারণ কমন। আকস্মিক হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু কেন বন্ধ হল হৃৎপিণ্ড? ওইরকম হঠাৎ বন্ধ হলই বা কেন? তার কোন সূত্র বডিতে নেই। রক্তে অবশ্য প্রচুর প্যাথোজেন পাচ্ছি। কিন্তু প্যাথোজেন–প্রথম কথা, রক্তের সংস্পর্শ না পেলে দেহে ঢুকতে পারে না। দ্বিতীয় কথা–ঢুকলেও মৃত্যু ঘটাতে অন্তত সাত-আট ঘণ্টা সময় নেয়। এই সময়টার পর্ব ভাগ করা যায়। প্রথমে শুরু হয় অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, ঘুম ঘুম ভাব। দ্বিতীয় পর্বে আক্রান্ত স্থান। ফুলতে শুরু করে। বেদনা বাড়ে। জ্বর আসে প্রচণ্ড। চোখের তারা লাল হয়ে যায়। তৃতীয় পর্বে আরম্ভ হয় প্রলাপ বকা। খেচুনি। মুখে ফেনা জমে ওঠা। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ। তারপর শ্বাসকষ্ট এবং আধ ঘণ্টার মধ্যেই হার্ট ফেল করে। এখন বলুন কর্নেল প্যাথোজেন কীভাবে শ্যামলীর মৃত্যুর কারণ বলি?

কর্নেল বললেন–তা তো বটেই।

–অথচ ব্লাডে প্যাথোজেন রয়েছে। কীভাবে এল এই জীবাণু? দেহে কোন ক্ষত নেই শ্যামলীর।

ইনজেকশনের কোন চিহ্নও পাননি!

–পাইনি। সে তো আপনাকে ফোনেই বলেছি তখন। ……ডঃ পট্টনায়ক একটু হাসলেন। এই প্যাথোজেনই সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তা না হলে মৃত্যুটার একটা ব্যাখ্যাই দেওয়া যেত–ভূতের হাতে মৃত্যু।

কর্নেল একটু নড়ে বসলেন। –আচ্ছা ডঃ পট্টনায়ক, শ্যামলীর কোনরকম অসুখবিসুখের চিহ্ন কি পেয়েছেন বডিতে?

 মাথা নাড়লেন ডঃ পট্টনায়ক। কিছু পাইনি। সে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল– নীরোগ ছিল। এমন কোন অবস্থা তার দেহে দেখিনি, যাতে কোন অসুখের আভাস মেলে। অবশ্য, ওই প্যাথোজেনঘটিত প্রতিক্রিয়াটা বাদে।

–ডঃ পট্টনায়ক, এবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

 –বলুন!

–আমি যদ্দুর জানি, প্যাথোজেন দেহে ঢোকার পর কলোনি ফর্ম করতে শুরু করে সেকেন্ডে হাজার কোটি হিসেবে। এরকম চলে কমপক্ষে দুঘণ্টা। এই পর্যায়ের কলোনির চেহারা ঠিক গুচ্ছ গুচ্ছ। পরের পর্যায়ের দুঘণ্টা সেকেন্ডে পাঁচশো কোটিতে দাঁড়ায়। এই কলোনিরও চেহারা গুচ্ছ গুচ্ছ–কিন্তু একটি করে বৃত্ত থাকে। একেকটি বৃত্তে এক কোটি করে গুচ্ছ। তৃতীয় পর্যায়ে কলোনি গড়ার গতি আরো মন্থর–সেকেন্ডে আড়াইশো কোটি। গুচ্ছবৃন্তগুলো এবার ঠিক বৃত্ত বলা যায় না বলা যায় ডিম্বাকৃতি। চতুর্থ পর্যায়ে আবার গোড়ার মতো সরলরেখায় চলে। কিন্তু গুচ্ছগুলো অনেক বড়। গোড়ায় একটা গুচ্ছের মাপ থাকে এক বাই লক্ষ সেন্টিমিটার। শেষ ধাপে গুচ্ছের মাপ হয় এক লক্ষ সাতান্ন হাজার সেন্টিমিটারের কিছু বেশি।

– ডঃ পট্টনায়ক হাঁ করে শুনছিলেন। এবার বললেন–ওয়ান্ডারফুল!

-হ্যাঁ। এ আমার সামান্য পড়াশোনার ফলাফল মাত্র। এখন তাহলে শুনুন ডঃ পট্টনায়ক! কারো দেহে প্যাথোজেন সংক্রামিত হলে বের করা সম্ভব যে ঠিক কোন জায়গা দিয়ে ওই মারাত্মক জীবাণু ঢুকেছে। প্রথম পর্যায়ের কলোনির চেহারা ও মাপ নিয়ে এবং দেহের যেখানে ওগুলো পাওয়া গেছে, সেখানে খুঁজলেই অবশ্য আমরা প্রথম আক্রমণের জায়গাটি দেখতে পাব।

কর্নেল থামতেই ডঃ পট্টনায়ক লাফিয়ে উঠলেন–তাই তো! তাই তো! এদিকটা তো ভাবিইনি!…বলে তিনি ফোন তুলে নিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন– বাণেশ্বর-ইস্ট হ্যাঁরিংটন হসপিটাল প্লিজ!

তারপর ফোনে কান রেখে আমাদের দিকে ঘুরে বললেন–এতক্ষণ ডেডবডিটার কী অবস্থা কে জানে?

জয়ন্তী বলে উঠলকী অবস্থা মানে? ডেডবডি আমরা নেব যে!

আমি বললুম–টেলি যোগাযোগ চালু করতে এক সপ্তাহ লেগে যাবে।  শ্যামলীর আত্মীয়স্বজনের ভাগ্যে বডি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এই সময় ব্রেকফাস্ট এসে গেল।

ডঃ পট্টনায়ক লাইন পেলেন। –হ্যালো! হ্যাঁরিংটন? ডঃ প্রসাদকে দিন।… ডঃ প্রসাদ, পট্টনায়ক বলছি। জরুরী ব্যাপার। ডেডবডিটা অ্যাজ ইট ইজ আছে তো?……আছে? প্লিজ তাই রাখুন।…..না, না। আমি এখনই যাচ্ছি। একটা। ভুল…হ্যাঁ, যাচ্ছি।

ডঃ পট্টনায়ক উঠে দাঁড়ালেন। কর্নেল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ব্যাপারটা আমি ভাবিইনি আদতে। ঠিক আছে–চললুম।

কর্নেল বললেন–আমাকে মিসেস মালহোত্রার ওখানে পেয়ে যাবেন। এখনই বেরোব আমরা।

ডঃ পট্টনায়ক বেরিয়ে গেলেন ব্যস্তভাবে।…..

.

সেই বিভীষিকার স্মৃতিজড়ানো ঘরটাতে কর্নেলের সঙ্গে ঢুকে আবার আমার অস্বস্তি জেগে উঠেছিল। ঘরের যেখানে যা ছিল, একটুও নড়চড় করা হয়নি। গত রাতের গোল টেবিল আর তাকে ঘিরে আটটা চেয়ার একই অবস্থায় আছে। পারেখ সাহেবের জন্যে বদ্রী যে চেয়ারটা রেখেছিল এবং শ্রীমতী মালহোত্ৰা যেখানে সরিয়ে রেখেছিলেন, সেটা সেখানেই আছে। রাতে পুলিস এসে পড়ার পর থেকে বাড়িটা প্রকৃতপক্ষে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে।

আমার বিভ্রম ঘটছিল। মনে হচ্ছিল, ওই শূন্য চেয়ারটায় এখনও শ্যামলীকে যেন দেখতে পাচ্ছি–সেই বীভৎস কালচে মুখ একদিকে কাত হয়ে আছে। পুলিস অফিসার শ্ৰী খান্না আর কর্নেল ঘরের জানলাগুলো খুলে দিলেন। ঘরের মধ্যে সকালের উজ্জ্বল আলো এসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমার অস্বস্তি খানিকটা দূর হল।

খান্না ঘরটার ভিতর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন কর্নেল, আমার মনে হচ্ছে আততায়ী এই ঘরে আগে থেকেই লুকিয়ে ছিল। এতে কোন ভুল নেই। এত সব বইয়ের শেলফ আর আলমারি চারদিকে! পিছনে ফাঁক যেটুকু আছে, একজন লোক কাত হয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কেউ তাকে দেখতে পাবে না। এই বলে তিনি শ্যামলীর চেয়ারের এক মিটার দূরে বড় আলমারিটার পিছনে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন। কর্নেল বললেন–অবশ্য সবই অনুমান। এবং অনুমান কখনও সিদ্ধান্ত নয় মিঃ খান্না।

–তা যদি বলেন, আমি বলব, অনুমানটা যুক্তিসিদ্ধ।…..খান্না সরে গিয়ে পাশের জানলার কাছে গেলেন। জানলাগুলো সবই বন্ধ ছিল। কাজেই বাইরে থেকে কেউ যে কিছু ছুঁড়ে মারবে শ্যামলীর দিকে, তাও অসম্ভব!

কর্নেল একটু হেসে বললেন–ছুঁড়বেটা কী শুনি?

–ধরুন, কোন বিষাক্ত সুচলো অস্ত্র! এমন সূক্ষ্ম অস্ত্র কি থাকতে পারে না। কর্নেল?

–খুব পারে। বিদেশে পেশাদার এক হত্যাকারী একরকম যন্ত্র বানিয়েছিল। রিভলবারের মতো দেখতে। গুলির বদলে নল দিয়ে দুইঞ্চি সূক্ষ্ম ইঞ্জেকশানের সূচের মতো বিষাক্ত তীর ছুঁড়ে মারত। ভিকটিম সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়ত! এই বিষ কিন্তু আমাদের সভ্যজগতের জানাশোনা বস্তু নয়। ব্রাজিলের আমাজন নদের অববাহিকায় যে হাজার হাজার বর্গমাইল জঙ্গল রয়েছে, সেখানকার জিরো নামে এক আদিম জাত নাতেমা নামে একরকম সুতীব্র বিষ তৈরি করে। তা সামান্য পরিমাণে তীরে মাখিয়ে তারা শিকার করতে অভ্যস্ত। সেই হত্যাকারী কীভাবে নাতেমা যোগাড় করেছিল কে জানে, তার অদ্ভুত ব্লো-গানের সাহায্যে দিব্যি হত্যার পর হত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তো আক্কেল গুড়ুম!……

খান্না সোৎসাহে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন-কর্নেল, কর্নেল! এক্ষেত্রেও যেন তাই হয়েছে অবিকল! কারণ, ডেডবডিতে আমাদের ডাক্তাররা আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়ার মতো কোন জিনিস খুঁজে পাননি। এ সেই নাতেমার কাজ নয় তো?

কর্নেল হো-হো করে হেসে উঠেই গম্ভীর হয়ে গেলেন হঠাৎ। আপনমনে অস্পষ্ট স্বরে দুর্বোধ্য কী আওড়ালেন। তার মধ্যে দুটো শব্দ বোঝা গেল– নাতেমা, প্যাথোজেন।

খান্না তাঁকে অবাক হয়ে লক্ষ্য করার পর বললেন–এনিথিং সিরিয়াস, কর্নেল?

কর্নেল আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। না, তেমন কিছু নয়। মিঃ খান্না, এবার আমাদের ডাইনিং হলে যেতে হবে।

–সে কী! আপনার এর মধ্যেই ডিটেল পরীক্ষা হয়ে গেল নাকি? বলেছিলেন, দিনের আলোয় ঘরটা খুঁটিয়ে দেখবেন!

–নাঃ, দেখার কিছু নেই।….বলে কর্নেল ফের একটু হাসলেন। মিসেস মালহোত্রার বইয়ের সংগ্রহ দেখাটাই উদ্দেশ্য ছিল আসলে। কী কাণ্ড! শুধু প্রেততত্ত্ব, প্যারাসাইকলজি আর দর্শনের বইতে ভর্তি! সত্যি, ভদ্রমহিলার পাণ্ডিত্যের কোন তুলনা হয় না! কী জয়ন্ত, তুমি মুখ বুজে রয়েছ যে? বলো– কিছু বলো!

 বললুম–কী বলব? আমি যদি কর্নেল সরকার হতুম, তাহলে অন্তত এ ঘরে একটা ব্যাপার চোখ এড়িয়ে যেত না যে…..।

কর্নেল আমাকে থামতে দেখে কৌতূহলী হয়ে বললেন বলে যাও!

–দেয়ালঘড়ির কাটাদুটো চলছে না। আটটা পাঁচ মিনিটে আটকে আছে।

খান্না দ্রুত নিজের ঘড়ি দেখলেন। তার মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কর্নেল মুখ তুলে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন তো আছেনই। আমি এই রহস্যের আবিষ্কর্তা হিসেবে খুবই গর্বিত বোধ করছিলুম। মনে মনে বলছিলুম, কী গোয়েন্দাপ্রবর? তাহলে অনেক ব্যাপার তোমারও চোখ এড়িয়ে যায় বটে তো?

খান্না রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলেন–ঘড়িটা বন্ধ দেখছি? রাত্রে তো লক্ষ্য করিনি আমরা!

এবার কর্নেল মুখ নামলেন। মুখটা দারুণ গম্ভীর। বললেন–ঠিক ওই সময়ই শ্যামলীকে মৃত অবস্থায় আমরা দেখতে পাই–অর্থাৎ তখনই মিসেস মালহোত্রা বড় আলো জ্বেলে দেন। আমি অভ্যাসমতো তখন নিজের ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলুম। তারপরই দেখছি, ওই দেয়ালঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। ভারি আশ্চর্য তো!

খান্না ব্যস্তভাবে বললেন মিসেস মালহোত্রা কিছু বলতে পারেন নাকি দেখা যাক। এক মিনিট আসছি।

উনি ডাইনিং হলের দিকের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। রাত্রেই এ ঘরের চাবি উনি শ্ৰীমতী মালহোত্রার কাছে নিয়ে রেখেছেন।

কর্নেল ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে সপ্রশংস স্বরে বললেন– তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, জয়ন্ত।

বললুম–তাহলে দেখুন, আপনার সঙ্গগুণে আমিও সহস্রাক্ষ হতে পেরেছি!

কর্নেল মিটিমিটি চোখে হেসে বললেন–তবে কী জয়ন্ত, জানো? চোখ দুটোই থাক্ আর হাজারটাই থাক–খুব কাছে দেখলে সব জিনিসই পুরোটা দেখা যায় না।

প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলুম, শ্ৰীমতী মালহোত্রা এসে পড়লেন। কী ব্যাপার?– ঘড়ি বন্ধ? সে কী? ঘড়ি তো কেউ বন্ধ করিনি আমরা! হঠাৎ বন্ধ হবার কোন কারণও তো নেই। ইলেকট্রনিক সিসটেমে তৈরি। আমার পরলোকগত স্বামীর পার্টনার বিদেশ থেকে এনে উপহার দিয়েছিলেন। এত ভালো সার্ভিস কোন ঘড়ি দেয় না!…

কর্নেল বললেন–তাহলে ওটা ইলেকট্রিক কারেন্টে চলে মিসেস মালহোত্রা?

–হ্যাঁ….বলে শ্রীমতী মালহোত্রা ঘড়িটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন ফের–আশ্চর্য, পরম আশ্চর্য ঘটনা! ঠিক এসময় অশরীরী আত্মাটা শ্যামলীকে মেরে রেখে চলে যায় গত রাতে। আটটা পাঁচ….ঘড়ি দেখে নিয়েছিলুম তক্ষুনি….

–কোন ঘড়ি?

 থতমত খেয়ে শ্রীমতী মালহোত্রা বললেন–কেন? আমার রিস্টওয়াচ!

কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়েছিলেন। বললেন–মিসেস মালহোত্রা, অনুগ্রহ করে আর একটা কথার জবাব দিন। আপনার চেয়ার থেকে ওই ঘড়িটা সোজা তাকালেই চোখে পড়ে। গত রাতে প্রথম আলো বা দ্বিতীয় আলোটা জ্বালার পর তা স্বভাবত আপনার দিকে চোখ পড়া উচিত ছিল!

শ্রীমতী মালহোত্রা গম্ভীর মুখে বললেন–ছিল, অবশ্যই ছিল। কিন্তু কেন যে ওদিকে তাকাইনি, সেটা এখন বলা কঠিন। তবে একটা সহজ ও সঙ্গত কৈফিয়ত আমি দিতে পারি। প্রেতশক্তিতে যারই বিশ্বাস আছে, সেই পারে কর্নেল! সে আমাদের বিভ্রান্ত করে ফেলেছিল!

–কিন্তু আপনি তখন আলো জ্বেলেছিলেন কেন, তা আশা করি স্মরণ আছে মিসেস মালহোত্রা। আপনি শ্যামলীকে অবিশ্বাস করেই রেগে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রেতশক্তি সত্যিসত্যি আসেনি এই বিশ্বাসেই আলো জ্বেলেছিলেন!

শ্রীমতী মালহোত্রা এবার চঞ্চল হয়ে উঠলেন কিন্তু প্রেতশক্তি সত্যিই এসেছিল, অস্বীকার করতে পারেন? আপনিও তো ছিলেন কর্নেল। বলুন, আপনিও কি অভিভূত বা হতভম্ব হয়ে পড়েননি তখন? আপনিও কি অন্য কোন দিকে তাকাবার সুযোগ পেয়েছিলেন?

কর্নেল হার মেনে বললেন–রাইট, রাইট। আই, এগ্রি, ম্যাডাম। আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র শ্যামলীই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বটে!

এইসময় মিঃ খান্না বলে উঠলেন–মাই গুডনেস! কর্নেল! মিসেস মালহোত্রা! ঘড়ির পিছনে ইলেকট্রিক তারটা কাটা রয়েছে যে!

এবার খান্নার দিকে চোখ গেল সবার। এতক্ষণ তিনি ঘড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে কী সব দেখছিলেন। আমরা গিয়ে দেখলুম, ঠিক তাই বটে।

কিন্তু শ্ৰীমতী মালহোত্রা সন্দেহাকুল হয়ে বললেন-তারটা জ্বলে যায়নি তো মিঃ খান্না?

না ম্যাডাম। সুন্দরভাবে ধারালো কিছু দিয়ে কাটা হয়েছে!

 শ্ৰীমতী মালহোত্রা যেন শিউরে উঠলেন। ফোনের লাইনও অমনিভাবে কে কেটে রেখেছে! কেন? কেন কর্নেল? কী উদ্দেশ্য ছিল সেই অশরীরী আত্মার?

অসহায় দেখাচ্ছিল ভদ্রমহিলাকে। কর্নেল বললেন–আপনার প্রেততত্ত্বে কী বলে জানি না। প্রেতশক্তি কি এমন কিছু করে? পড়েছেন এমন কোন ঘটনার কথা?

শ্ৰীমতী মালহোত্রা উদ্বিগ্নমুখে জবাব দিলেন–কিছু অসম্ভব নয় ওদের পক্ষে। অনেক অদ্ভুত ঘটনার কথা নিশ্চয় পড়েছি।

খান্না সকৌতুকে বললেন–প্রেতশক্তি ছুরি ব্যবহার করেছে নাকি?

শ্ৰীমতী মালহোত্রা ক্ষুব্ধস্বরে বললেন–পার্থিব অস্ত্র ব্যবহার করার দরকারই হয় না ওদের। ইচ্ছে করলেই সব ঘটে যায়। বড় গাছ বিনা ঝড়ে আচমকা ভেঙে পড়ার কথা কি শোনেননি আপনারা? শোনেননি, সেবারে হঠাৎ ভূতের পাহাড়ের ওপর থেকে তিনশো টন একটা পাথর পড়ে গিয়েছিল দিনদুপুরে? বস্তুবাদী বিজ্ঞান বলবে এই এই কারণে এটা ঘটেছে। কিন্তু কারণের কারণ থাকে।

কর্নেল অন্যমনস্ক হয়ে ছিলেন যেন। হঠাৎ বললেন–আচ্ছা মিসেস মালহোত্রা, আপনার ওই ঘড়িটার তো দেখছি পেন্ডুলাম নেই। কিন্তু টিকটিক শব্দ করতে তো বারণ নেই। রাত্রে আমরা তেমন কোন শব্দ শুনিনি কিন্তু।

–না। ইলেকট্রনিক সিসটেম থাকায় ওটা নিঃশব্দে চলে।

–ঘণ্টাও কি বাজে না?

 শ্ৰীমতী মালহোত্রা চমকে উঠে বললেন–বাজে তো!

 –কিন্তু গত রাতে আমরা ঘড়িটা বাজতে শুনিনি।

শ্ৰীমতী মালহোত্রার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। তাই তো! হা-ঘড়িটা তো বাজেনি! আশ্চর্য, বড় আশ্চর্য! আমার তো একটুও খেয়াল ছিল না!

এতক্ষণ ধরে এই ভ্যাজর-ভ্যাজর শুনে আমার কান গরম হয়ে উঠেছিল। তাই বললুম–আপনারা কথা বলুন, কর্নেল। আমি একটু বাইরে ঘোরাঘুরি করি ততক্ষণ।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, হ্যাঁ। দেখ জয়ন্ত, বেচারা জয়ন্তী এতক্ষণ ওঘরে হাঁপিয়ে উঠেছে। তুমি ওকে সঙ্গ দাও। আমরা আসছি। মিঃ খান্না, ওকে দরজা খুলে দিন।

ইন্টারলকিং সিসটেমের এই এক জ্বালা! বলে মিঃ খান্না দরজা খুলে দিলেন।

আমি ডাইনিং হলে গিয়ে জয়ন্তীকে খুঁজলুম। বা রে! গেল কোথায় সে? এতক্ষণ একা বসিয়ে রাখার জন্যে রেগে হোটেলে ফিরে গেল নাকি? দরজার বাইরে তিনচারজন কনস্টেবল বসে ছিল। ভেতরে একজন সাব-ইন্সপেক্টর কোনার সোফায় বসে পুরনো খবরের কাগজ পড়ছিলেন। এর আগেই আলাপ হয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম ব্রিজেশ সিং। আমাকে দেখে বললেন–ওঁদের বেরোতে দেরি হবে নাকি চৌধুরী সাহাব?

–হতে পারে। ইয়ে মিঃ সিং, আমাদের সঙ্গের ভদ্রমহিলা কোথায় গেলেন বলুন তো?

ব্রিজেশ সিং হাসলেন। স্ত্রীলোকেরা স্যার বড্ড সাম্প্রদায়িক। সুতরাং মিস রায়কে কিচেনের দিকে যেতে দেখেছি এবং সরযূর সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি।

আমি একটু ইতস্তত করে ডাইনিংয়ের শেষ দিকে কিচেনের কাছে এগিয়ে গেলুম। ওখানে যেতেই জয়ন্তীর কণ্ঠস্বর কানে এল। ডাকব কি না ভাবছি, লছমন নামে বুড়ো চাকরটা পর্দা তুলে বেরিয়ে এল। আমাকে দেখে সেলাম দিয়ে বলল–দিদিজিকে খুঁজছেন স্যার? সরযূর সঙ্গে গল্ করছেন। ডেকে দিচ্ছি।

সে চলে গেল। তারপর জয়ন্তী বেরিয়ে এল। বললুম রাগ করেননি তো? আপনি আমাদের সঙ্গে ওঘরে যেতে চাইলেন না–তো কী করব?

জয়ন্তী বলল–ওঘরে প্রাণ গেলেও যেতে পারব না। সব মনে পড়ে যাবে যে!

-না, আর যেতে বলতে আসিনি। চলুন, বাইরে লনে যাই।

চলুন!

লনে কনস্টেবল আর কিছু পুলিস অফিসার রয়েছেন। আমরা বাড়ির পিছন দিকে চলে গেলুম। সুন্দর ফুলবাগিচা আর গাছপালা আছে সেদিকটায়। একটা ফুলেভরা মেখুগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালুম। সেই সময় জয়ন্তী চাপা গলায় বলল–জয়ন্তবাবু, সরযূর কাছে একটা অদ্ভুত কথা আদায় করতে পেরেছি।

-কী বলুন তো?

জয়ন্তী কণ্ঠস্বর আরো চাপা করে বলল–টেলিফোন লাইনটা মিসেস মালহোত্রাকে ও নিজের হাতে কাটতে দেখেছে। আমাদের লনে বসিয়ে রেখে একবার বাড়ি ঢুকলেন, মনে পড়ছে–ছটা বা ওইসময় নাগাদ? তখনই নাকি সরযূ দেখেছে ব্যাপারটা। সে বলল–মাইজি সেক্ পাগলি। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করে আসছেন–মাথামুণ্ডু খুঁজে পায় না সরযূরা। তা, সরযূ কথাটা বদ্রীকে না বলে পারেনি। তখন বদ্রী ওকে আরেকটা অদ্ভুত ঘটনা শোনায়। মাইজী নাকি স্টাডিতে ঢুকে

ইলেকট্রনিক ঘড়ির তার কেটেছেন, এই তো?

 জয়ন্তী সবিস্ময়ে বলে উঠল–জানেন আপনি? কীভাবে জানলেন? আশ্চর্য তো!