১. ভূতের পাহাড়ে একটি সূর্যাস্ত

০১.

ভূতের পাহাড়ে একটি সূর্যাস্ত

 মে মাসের গরম আবহাওয়ায় যাঁরা জীবনধারণ অসহ্য মনে করেন, সময় ও টাকাকড়ি থাকলে তাদের পক্ষে বাণেশ্বরের চেয়ে ভালো জায়গা আর দুটি নেই। উত্তরপ্রদেশ ও নেপালের সীমান্তে এই তরাই অঞ্চলের পাহাড়ী জঙ্গল বসন্ত ও গ্রীষ্ম দুটি ঋতুতেই নিজস্ব সৌন্দর্যের জন্যে প্রসিদ্ধ। বসন্তে গাছে-গাছে ও ঝোপেঝাড়ে যে অজস্র লাল ও হলুদ ফুল ফোঁটার পালা শুরু হয়, গ্রীষ্মের শেষ দিনটি অবধি তাতে বিরতি পড়ে না। যে দিকে চোখ যায়, স্থির শব্দহীন ওই উজ্জ্বল রঙের মেলা ভ্রমণবিলাসী ও শান্তিকামীদের মন ভরিয়ে দেয় অপার্থিব কী সুখের স্বাদে এবং তার সঙ্গে যখন দূর সমতলের উচ্চণ্ড আবহাওয়া সইতে না পেরে পালিয়ে আসা হাজার হাজার পাখি প্রতিটি সকাল-সন্ধ্যা কোরাসে গান। গাইতে থাকে, মনে পড়ে যায় প্রখ্যাত ফারসি কবিতার দুটি লাইন : স্বর্গ যদি মর্ত্যে কোথাও থাকে, তা এখানে, এখানে এবং এখানেই।

সমুদ্রতল থেকে তিন-সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচুতে আছে বলে বাণেশ্বরের আবহাওয়া এই গ্রীষ্মে খুবই শান্তিদায়ক। রাতের দিকে বরং একটু শীত-শীতই লাগে। বিশেষ করে রাত তিনটের পর হিমালয়ের তুষারে ঢাকা উত্তর অঞ্চল থেকে একটা হাওয়া আসে শেষরাতের অতিথির মতন, সূর্য না ওঠা অবধি সে বেশ খানিকটা দাপট দেখাতে থাকে এবং তখন গায়ে কম্বল না চড়ালে রক্ষে থাকে না।

বাণেশ্বরের আরেকটি বড় আকর্ষণ ধর্ম। বাণেশ্বর শিবের একটি খুব পুরনো মন্দির আছে এখানে। সারা ভারত থেকে লক্ষ তীর্থযাত্রী বছরের একটি সময়ে এখানে এসে ভিড় জমান। সে সময়টা হল চৈত্রের শিবচতুর্দশী তিথি। তারপর কিছুদিন বাণেশ্বর চুপচাপ অনাথ পড়ে থাকে। স্থায়ী ছোট্ট বাজারটা আবার ফাঁকা ফাঁকা দেখায়। কিছু সরকারি আপিস, কোয়ার্টার, একটা স্বাস্থ্যনিবাস, তিনটে ছোটবড় হোটেল আর ত্রিশ-বত্রিশটি বেসরকারি বাড়ি মিলে অল্পস্বল্প জীবনযাত্রার যা ভিড় ও চাঞ্চল্য, তা বিশাল আকাশ ও পরিব্যাপ্ত অরণ্যভূমিতে খুব একটা তরঙ্গ তুলতে পারে না।

তারপর গ্রীষ্মে আস্তে আস্তে কিছু ভ্রমণবিলাসীর ভিড় দেখা যায়। কিন্তু তারা অনেকেই টাকা-কড়িওয়ালা মানুষ। কারণ এখানে জিনিসপত্রের দাম বড্ড চড়া। হোটেলভাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর একমাত্র কারণ বাণেশ্বরের ইউরোপীয় ঐতিহ্য–যা বৃটিশ আমলের সৃষ্টি। শিবমন্দির এলাকায় ধর্মশালা অবশ্য আছে। কিন্তু সেখানে সাধুসন্ন্যাসীদেরই দাপট বেশি। আর, সারা ভারতে এটা বরাবর লক্ষ্য করার মতন ব্যাপার যে একমাত্র বাঙালিই। সম্পূর্ণ ধর্মছাড়া কারণে অর্থাৎ নিছক ভ্রমণে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যলিপ্সায় ঘরের বাইরে পা বাড়ায় এবং বাণেশ্বর কেন, এজন্যে আরো দুর্গম জায়গায় যেতে তার আপত্তি নেই। অন্য প্রদেশবাসীরা এরকম ধর্মহীন বা অর্থোপার্জনবর্জিত ভ্রমণের সচরাচর পক্ষপাতী নন। বাঙালি মানসিকতার বৈশিষ্ট্য এটাই।

বাণেশ্বরের পূর্বপ্রান্তে বয়ে চলেছে সারদানদী, ওপারে নেপাল। উত্তরদিকটা খুবই দুর্গম, খাড়া পাহাড়ের দেয়াল নেমে গেছে ভয়ঙ্কর খাদে, তারপর শুরু হয়েছে ঢেউখেলানো পাহাড় ও বনাঞ্চল, দূরে তুষারঢাকা পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। বাকি পশ্চিম ও দক্ষিণেও তেমনি পাহাড় ও জঙ্গল আছে–কিন্তু অনেক রাস্তাঘাট ও মাঝে মাঝে উপত্যকা থাকায় দুর্গম নয়। এইসব রাস্তায় এখন বাস চলাচল করে নিয়মিত। কোথাও পাহাড়ী নদী থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, কোথাও সেনানিবাস ও সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু কয়েকশো বর্গমাইল পাহাড় জঙ্গলের পরিবেশে এসব মানুষোচিত স্পন্দন খুবই নগণ্য। এখনও প্রকৃতির দাপটই এখানে বেশিমাত্রায় প্রকট। আদিমতার বিস্তীর্ণ অন্ধকারময় সমারোহে ইলেকট্রিক বাল্বগুলো জোনাকির চেয়েও তুচ্ছ হয়ে পড়ে। পাহাড়ের গায়ে কোন উজ্জ্বল সাদা বা হলুদ বাড়িও মনে হয় এই আদিমতার একটি অদ্ভুত ধরনের অংশ ছাড়া কিছু নয়।…

আমার বৃদ্ধ সঙ্গী এবং বন্ধু কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, নেশায় খাঁটি প্রকৃতিবিদ। বাইনাকুলার ও একটি ক্যামেরা সবসময় তার কাছে থাকে। নানা জাতের পাখি দেখা ও নোট করে যাওয়া তার হবি। এক বিকেলে যখন আমরা গ্রিন ভিউ হোটেল থেকে বেরিয়ে টনকপুর রোডে ঘুরছি, ডান দিকের লাগোয়া পাহাড়ের চুড়োয় পুতুল-পুতুল দুটি মেয়ের মূর্তি দেখতে দেখতে তিনি বললেন বুঝলে জয়ন্ত, এই হচ্ছে বাঙালির মানসিক বৈশিষ্ট্য। ওই যে মেয়ে দুটিকে দেখছ, বাইনাকুলার ছাড়াও এই বুড়ো চোখে দেখে আমি বলতে পারি–ওঁরা সেই বঙ্গললনায়। ওঁরা এখন সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছু দেখছেন না এবং নিছক সৌন্দর্যের খাতিরেই সবরকম বিপদ-আপদের তোয়াক্কা না করে অকুতোভয়ে। এই ভূতের পাহাড়ে উঠে গেছেন।

কর্নেলের ধারণা কখনও মিথ্যা হতে দেখিনি। তবু ব্যাপারটা বেশ অবাক লাগল। এখানে আসার পরই শুনে আসছি যে ওটা ভূতের পাহাড় নামে কুখ্যাত এবং পারতপক্ষে ওটাতে কেউ ওঠে না। অথচ এখন এই শেষবেলায় দুটি মেয়ে ওখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? বাঙালি যতই সৌন্দর্যের পূজারী হোক, ভূতের ব্যাপারে সে আফ্রিকার আদিমতম গোষ্ঠীর চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে নেই, এটা অস্বীকার করবে কোন্ মূর্খ?

কর্নেলের কাছ থেকে বাইনাকুলারটা নিয়ে চোখে রাখলুম। অমনি চমকে উঠলুম। চিনতে একটুও ভুল হল না। আরে, এঁরা তো আমাদের পাশের স্যুটেই গতকাল এসে উঠেছেন! অল্পস্বল্প আলাপও হয়েছে পরস্পর। তবে সেটা কর্নেলের জন্য। ইনি যেখানে যান, আলাপ জমাতে তো দেরি করেন না, তা সে যে শ্রেণীর লোক হোক না কেন!

বাইনাকুলারটা নামিয়ে রেখে বললুম–মাই ডিয়ার ওল্ড ম্যান, আপনি কি পূর্বজন্মে পক্ষিবিশেষ ছিলেন, যারা এক মাইল ওপর থেকেও পৃথিবীতে প্রাণীর নিস্পন্দ দেহ দেখতে পায়?

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–তুমি আমাকে শকুন বলতে চাও, জয়ন্ত?

তাছাড়া কী বলব?…..বলে কপট গাম্ভীর্যে বাইনাকুলারটা ফিরিয়ে দিলুম ওঁর হাতে।ওঃ! এইসব দিব্যদৃষ্টির অধিকারীদের কাছাকাছি থাকতেও বড় ভয় করে। মানুষের মনের ভিতরও তাদের দৃষ্টি হানা দিতে পারে বৈকি!

–পারে …কর্নেলের মুখ কৌতুকে উজ্জ্বল হল।–যেমন, এ মুহূর্তে শ্রীমান জয়ন্তের চিত্তচাঞ্চল্য আমি স্পষ্ট অবলোকন করতে পারছি। সে এই পক্ককেশ শ্মশ্রুবিশিষ্ট বুড়োকে ছেড়ে ভূতের পাহাড়ে উঠে যেতে চাইছে। তার তর সইছে না। তো, আমার আপত্তি নেই জয়ন্ত! চলে যাও। ওঁদের সঙ্গ দিয়ে, আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে এস। আর, দেখ জয়ন্ত, প্রকৃতির মধ্যে মানুষ একা গিয়ে পড়লেই নিঃসঙ্গ বোধ করে। সে হাঁফিয়ে ওঠে। কারণ আদিম সময় থেকেই মানুষ যুথবদ্ধ প্রাণী হয়ে বেঁচে আসছে। এই লক্ষ লক্ষ বছরের অভ্যাস তার দেহের কোষে কোষে–ক্রোমোসোমে অর্থাৎ জিনপুঞ্জে ডি এন এ অণুর মধ্যে রয়ে গেছে।

হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলুম-প্লিজ কর্নেল, প্লিজ! জেনেটিক্স নিয়ে লেকচার শুরু করলে এই চমৎকার বিকেলটার কী পরিণতি ঘটবে, ভেবে আমি শিউরে উঠছি। তার চেয়ে দয়া করে চলুন, আজ আমরা দুজনেই ওই ভূতের পাহাড়ে উঠে যাই। তাছাড়া, এই পাহাড়ের ভূতঘটিত রহস্যও তো আপনার এবারকার ভ্রমণের সূত্রে একটা আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হতে পারে!

কর্নেল একবার বাঁদিকে রাস্তার ওধারে দক্ষিণের ঢালু হয়ে যাওয়া জঙ্গল ও উপত্যকায় উড়ন্ত পাখির ঝাঁক দেখে নিয়ে বললেন–কিছু অসম্ভব নয়, জয়ন্ত। এটা আমার ভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য বলতে পারো, যেখানে যাই, নারদের তেঁকির মতন একটা-না-একটা ডেড-বডি আমার বাহন হয়ে ওঠে! হরিবল জয়ন্ত, হরিবল্! যেন এক ইটারনাল মার্ডারার আমার পিছনে সবসময় ওঁৎ পেতে ঘুরছে।

কর্নেলের মুখে আচমকা একথা বেরোতে শুনে আমার যেমন অবাক লাগল, তেমনি অজানা আতঙ্কে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। কেন একথা বলছেন কর্নেল? এখানে এসে তেমন কি কোন ভয়ঙ্কর ঘটনার আভাস, য়েছেন?

উদ্বিগ্ন হয়ে বললুম-হঠাৎ এসব কথা কেন কর্নেল?

–ও কিছু না। ভূতের খাতিরে। যেখানে ভূত, সেখানেই মৃত্যুর গন্ধ। চলো জয়ন্ত, অবশেষে তাহলে আমরা ভুতের পাহাড়েই যাই। কিন্তু সাবধান বৎস, শ্যামলী ও জয়ন্তীর সঙ্গে কখনো প্রেম জমাতে চেষ্টা করবে না।

হো-হো করে হেসে উঠলুম ওঁর কথার ভঙ্গিতে। তারপর আই অ্যাসিওর ইউ ওল্ড বস্ বলে ওঁর একটা হাত নিলুম এবং ভূতের পাহাড়ে চড়া শুরু হল।

আমার প্রাজ্ঞ সঙ্গীর শারীরিক ক্ষমতা দেখে তাক লেগে যায়। এই বত্রিশেই আমার কয়েকশো ফুট খাড়াই ভাঙতে হাঁফ ধরে যাচ্ছিল, আর উনি পাহাড়ী বাঘের মতন অনায়াসসাধ্য ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতায় সবসময় অনেকটা করে এগিয়ে রয়েছেন। এখন যদি প্রশ্ন করি তাহলে, উনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা রণাঙ্গনের কোন কোন পাহাড়ে উঠেছিলেন, তার বর্ণনা শুরু করবেন। সর্বক্ষেত্রে ওই একটি বাক্যই তাঁর মূলধন; জয়ন্ত, কথাটা হচ্ছে অতীত অভিজ্ঞতা। তবে কিনা এ জিনিসটা সব মানুষেরই আছে। স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ তা অর্জন করে। কিন্তু তাকে কাজে লাগাতে পারে কজন? যে পারে, তাকেই আমরা সবখানে জিতে যেতে দেখি। এখন, আমার কথা উঠলে বলব যে, আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার প্রতিটি ব্যাপারেই সাধ্যমত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করি।

যাই হোক, ভূতের পাহাড়ের দক্ষিণ কঁধ দিয়ে দূর উপত্যকার ওদিক থেকে পড়ন্ত সূর্যের লালচে রোদ্র এসে পড়ে ওঁর মুখটা জ্বলজ্বল করছিল। খানিকটা ঝোপঝাড়েভরা খাড়াই অনেক কষ্টে ভেঙে এবার আমরা বেশ ঢালু ঘাসের জমি পেয়ে গেলাম। জমিটায় বড় বড় পাথর ছড়ানো। তার ডাইনে অর্থাৎ উত্তরে ঘন গাছপালার জঙ্গল। ঢালুটা পেরিয়ে সোজাসুজি চুড়োয় ওঠা অসম্ভব–সামনে একটা গ্রানাইট দেয়াল রয়েছে। তাই আমাদের ডাইনের জঙ্গলে ঢুকতে হল। এখানে ঢোকার পর আমরা শ্যামলী ও জয়ন্তীকে আর দেখতে পাচ্ছিলুম না। গাছের আড়াল দৃষ্টিতে বাধা দিচ্ছিল।

কর্নেল এক জায়গায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর কান পেতে কিছু শুনে বললেন–কাছাকাছি ওপিঠে কোথায় একটা ঝরনা আছে মনে হচ্ছে। নিশ্চয় সাধারণ ঝরনা নয়, পাতাল জলের ধারা। অর্থাৎ যাকে বলে প্রস্রবণ। এনিওয়ে! জয়ন্ত, সম্ভবত, ওই ঝরনার জল স্বাস্থ্যকর। ফেরার পথে সময় থাকলে একবার ওদিকটা ঘুরে যাব। আমার কাছে একটা হ্যাঁভারস্যাক রয়েছে। কিছু জল নিয়ে যাব।

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন–হুম! তুমি অধৈর্য হয়ে পড়েছ! চলো, এখন আমরা চুড়োর দিকেই যাই।

ক্লান্তির জন্যে পরিহাসটা গায়ে মাখলুম না। তাছাড়া ইতিমধ্যে আমি এক অদ্ভুত ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। এই পাহাড়টার নাম ভূতের পাহাড় কেন? শনশন করে হাওয়া বইছিল আর নির্জন পাহাড়ী জঙ্গল জুড়ে কী যেন। ধুন্ধুমার অদৃশ্য উপদ্রব চলছিল, ঠিক বোঝাতে পারব না এই অনুভূতিটা। মনে হচ্ছিল, জীবিতদের আবির্ভাবে যুগ-যুগান্তের বাসিন্দা অশুভ আত্মারা যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে! একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখলুম, এলাকার অন্যসব পাহাড় ও জঙ্গলের মতন এখানে কোন গাছেই ফুল নেই, এখানে কোথাও কোন পাখিও নেই। সচরাচর পাহাড়ী এলাকায় যে গিরগিটি জাতীয় প্রাণী সবসময় চোখে পড়ে, তারাও এখানে নেই। তখন আরও সচেতন দৃষ্টি পরখ করতে থাকলুম এবং টের পেলুম যে এক উদ্ভিদ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পার্থিব প্রাণী যেন এখানকার বাসিন্দা নয়। এ যে রীতিমতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

পথ বলতে কিছু নেই। আন্দাজ করে এগোতে হচ্ছিল। জঙ্গলের পর বড় বড় পাথরের টুকরো পেরিয়ে যেতেই আমরা ৪৫ ডিগ্রি কোণ বরাবর উঁচুতে ফের মেয়ে-দুটিকে দেখতে পেলুম। ওদের কথা কিছুক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলুম যেন। এখন দেখামাত্রই দ্বিতীয় এক বিস্ময় জাগল। এরকম কষ্টসাধ্য চড়াই ভেঙে ও জঙ্গল ঠেঙিয়ে এই নির্জন কুখ্যাত পাহাড়ের চুড়োয় গিয়ে ওঠার ক্ষমতা ও সাহস ওরা পেল কোথায়? বিশেষ করে, দুটি বাঙালি মেয়ে ওরা। বয়স বড়জোর পঁচিশের মধ্যেই। কোন পুরুষ সঙ্গী নেই। মেমসায়েব হলে অবাক হতুম না নিশ্চয়। তাই কথাটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেলকে বললুম–নীচে থেকে যা ভেবেছিলুম, পাহাড়টা অত সাদাসিধে গোবেচারা নয় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এমন ঘোরপ্যাঁচওয়ালা জায়গায়, মেয়েরা পা বাড়ায় কোন সাহসে? বাস! আমারই তো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে!

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন-জয়ন্ত, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। তবে শ্ৰীমতীদের তুমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য কোরো না। ওরা দুটিতেই কিন্তু এক মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের সদস্যা। গতবছর এমনি জুনে যে মহিলা অভিযাত্রীরা মানালিতে চড়েছিলেন, শ্যামলী ও জয়ন্তী সে-দলে ছিল।

এতক্ষণে সব টের পেয়ে গেলুম।তাই বলুন! কিন্তু আশ্চর্য, এরই মধ্যে ওদের নাড়ীনক্ষত্র আপনার জানা হয়ে গেছে দেখছি।

কর্নেল একটা শুকনো বেঁটে হলুদ গাছের গায়ে জড়িয়ে থাকা মোটা মোটা একগুচ্ছ লতা আঁকড়ে ধরে একটা পাথরে উঠলেন। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন–চলে এস।

এবার আমরা চুড়োর সীমানায় এসে গেছি। চুড়োটা হাতির পিঠের মতো দেখতে! লম্বায় বড় জোর বিশ গজ। চওড়ায় তার অর্ধেক। কোথাও টাকের মতো নগ্ন পাথর রয়েছে। কোথাও শুকনো ঘাস। ততক্ষণে ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে। দুজনেই এদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মুখে চাপা হাসি ঝিলিক দিচ্ছে। প্রচণ্ড বাতাসে শাড়ি জড়িয়ে যাচ্ছে গায়ে। দেখে তাক লেগে গেল আমার। কর্নেল চেঁচিয়ে উঠলেন কনগ্রাচুলেশান গার্লস ফর ইয়োর অ্যাডভেঞ্চার।

দুজনেই হাত নেড়ে বলল–কনগ্রাচুলেশান কর্নেল ফর ইয়োর অ্যাডভেঞ্চার অলসো!

দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় একটা বড় পাথর চুড়ো থেকে বেরিয়ে ছিল চাতালের মতন। তার ওপর গিয়ে বসে পড়লুম সবাই। কর্নেল আরামে বসে চুরুট বের করলেন। ওরা বাতাস বাঁচিয়ে সেটা জ্বালাতে সাহায্য করল। এ বুড়োর সঙ্গে তরুণীদের কীভাবে অত খাতির জমে যায়, আজও আমার কাছে রহস্য।

কর্নেল চুরুট টানতে টানতে বললেন–চমৎকার সূর্যাস্ত দেখা যায় এখান থেকে। শ্যামলী! জয়ন্তী! তোমাদের সৌন্দর্যবোধের প্রশংসা না করে পারা যায় না!

শ্যামলী হালকা ছিপছিপে গড়ন, মুখটা কিছু লম্বাটে, ডিমালো গাল ও সুচলো চিবুক। ওর চোখদুটোয় এক ধরনের নির্লিপ্ততা বা ঔদাসীন্যের ভাব আছে। খুব পাতলা ঠোঁট। তাই একটুখানি হাসিও জোরালো হয়ে ফোটে। আর জয়ন্তী ওর চেয়ে খানিকটা স্বাস্থ্যবতী অর্থাৎ অল্পস্বল্প মুটকি বলা যায়। অতটা ফর্সাও নয়, চাপা রঙ। মুখটা ভারী ও ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক, পুরু ভুরু, দৃষ্টিতে তীব্রতা আছে। ভরাট গাল, অর্ধবৃত্তকার চোয়াল, তার গ্রীবা ও বাহুদুটোয় শক্তির আভাস মেলে। দুজনেই মোটামুটি সুন্দরী এবং পতঙ্গ আকর্ষণের মতন দীপ্তিময়ী।

শ্যামলী বলল–আজ কতগুলো পাখির ছবি নিলেন কর্নেল?

কর্নেল হাসলেন।-এবেলা ক্যামেরাকে সে সুযোগ দিলুম কই? আমার তরুণ বন্ধুটি হঠাৎ তোমাদের আবিষ্কার করে খুব ধাঁধায় পড়ে গেলেন–যার ফলে…

দ্রুত বললুম–মোটেও তা ঘটেনি।

শ্যামলী ও জয়ন্তী হেসে উঠল। কর্নেল অপ্রস্তুত হবার ভান করে বললেন– তাহলে আমারই বোঝবার ভুল! যাই হোক, এই পাহাড়টা নাকি কুখ্যাত। এখানে অজস্র ভূতের আড্ডা। তাই কারো মনে ধাঁধা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক বৈকি!

জয়ন্তী বলল–ব্যাপারটা কী হয়েছে, তাহলে বলি কর্নেল।….

তাকে বাধা দিয়ে শ্যামলী বলল-দেখ জয়া, তোমার ওসব আজেবাজে কুসংস্কারের ঢাকঢোল আর না পেটালেও চলবে।

জয়ন্তী হাসতে হাসতে বলল–কিন্তু তুমিই তো বললে যে……

শ্যামলী রেগে গেল।কী বললুম? বললুম যে ভূত দেখেছি-তুমিও দেখবে এস?

জয়ন্তী বলল–ওভাবে বলোনি। স্বপ্নে দেখেছ বললে!

শ্যামলী বলল–হ্যাঁ, স্বপ্ন। নিছক দিবাস্বপ্ন। তবে সেজন্যেই কি তোমাকে এখানে টেনে এনেছিলুম?

জয়ন্তী বলল–না, তা আনেনি। বললে–এখান থেকে সূর্যাস্ত নাকি খুব সুন্দর লাগে। কিন্তু যাই বলো, তোমার আসল মতলব ছিল–স্বপ্নের ব্যাপারটা সত্যি কি না দেখতে আসা।

–হ্যাঁ, তুমি মনের লেখা পড়তে ওস্তাদ।

–কিছুটা। দেখ, আমাকে লুকিয়ে পার পাবে না। এখানে ওঠার পর সবসময় লক্ষ্য রেখেছি, তুমি অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন খুঁজছ। আমি দিব্যি তখন টের পেয়ে গেলুম যে আসলে তুমি স্বপ্নের ব্যাপারটা নিয়েই কৌতূহলী এবং সূর্যাস্ত দেখার ছলে এনকোয়ারি করতে এসেছ। আর এ তো তোমার বরাবরকার স্বভাব। কেন? মুক্তেশ্বরের ওদিকে রাতদুপুরে বাংলোর পিছনে কিসের শব্দ শুনে ওই কনকনে ঠাণ্ডায় বেরিয়ে পড়তে আমাকে সাধাসাধি করেছিলে! অথচ বললুম-ঘুমের ঘোরে যা শোনার শুনেছ, ওটা সত্যি নয়। তোমার এই নাকগলানো অভ্যেস দেখে মনে হয়–গত জন্মে নিশ্চয় তুমি পুলিসের গোয়েন্দা টোয়েন্দা ছিলে! বাণেশ্বর এসে স্বপ্নে দেখবে একটা আস্ত জ্যান্ত মড়া! সেটা আবার এই ভূতের পাহাড়েই ডিগবাজি খেয়ে বেড়াবে! কী অদ্ভুত ব্যাপার!

আমরা দুজনে চুপচাপ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলুম এতক্ষণ। দুটি মেয়ের সংলাপ, তর্কাতর্কি, ভাবভঙ্গি বরাবর আমার কাছে জটিল হেঁয়ালি এবং দুর্বোধ্য। মেয়েরা যে অপার রহস্যের আগার, তাতে কোন ভুল নেই। দুজন জলজ্যান্ত পুরুষের সামনে এতক্ষণ ওরা যে সব নিয়ে কথা বলল, তা যত অদ্ভুত বা খাপছাড়া শোনাক–এটাই সম্ভবত স্ত্রীজাতির স্বাভাবিক রীতিনীতি। আমি ফেস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার সিগারেট ধরালুম। সূর্যাস্ত দেখতে থাকলুম।

এবার কর্নেল বললেনবাই জোভ! স্বপ্নে জ্যান্ত মড়া! সে কী?

জয়ন্তী মুখ টিপে হেসে বলল–দিবাস্বপ্ন। তাও আবার গ্রীষ্মকালীন! কাজেই বুঝতেই পারছেন কর্নেল, বহু অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যেতে পারে। কিন্তু শ্যামলীর কারবারই আলাদা। ওই যে বললুম, সবতাতে নাক-গলানো ওর চাই-ই। আবার বলে কী জানেন? ওর নাকি একটা সিক্সথ সেন্স আছে। ওই সিক্সথ সেন্সের জ্বালায় যে পড়েছে, সেই জানে পরিণতিটা কদ্দূর গড়ায়। ইতিমধ্যে আপনারা না এসে পড়লে ও নির্ঘাত সারা পাহাড় খোঁজাখুঁজি করে বেড়াবার জন্যে আমাকে সাধাসাধি করত! ওকে সামলানো আমার পক্ষে এত যে কঠিন হয়ে পড়ে সময়-সময়!

 শ্যামলী মুখ গম্ভীর করে বসে ছিল। ওর কথা শোনার পর বলল–থাক, আর গার্জেনগিরি ফলাতে হবে না।

আমার মনে হল শ্যামলীকে চেহারা দেখে খুব হুল্লোড়বাজ সরল মেয়ে মনে হলেও আদতে ও তার উল্টো। বেশ চাপা ধরনের মেয়ে। এই চেপে রাখার প্রবণতার জন্যেই সম্ভবত ওর সুন্দর টানা-টানা চোখ দুটোকে নির্লিপ্ত বা উদাসীন দেখায়।

তা কর্নেল আবার সবতাতে নাক গলানোর জন্য প্রসিদ্ধ। ওঁর মুখে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলুম এবার। বললেন–তাহলে জয়ন্তী, তুমি বলতে চাইছ যে আজ দুপুরে হোটেলে তোমরা দুপুরবেলা দুটিতে ঘুমিয়ে কাটিয়েছ। তারপর ঘুম ভেঙে উঠে শ্যামলী তোমাকে বলেছে, স্বপ্নে এই ভূতের পাহাড়ে একটা জ্যান্ত মড়া জিগবাজি খাচ্ছিল। তারপর বলেছে, পাহাড়টায় চড়ে সূর্যাস্ত দেখা যেতে পারে। এবং তোমরা শেষ অব্দি বেরিয়ে পড়েছ। পাহাড়ে চড়েছ। তারপর তোমার ধারণা হয়েছে যে আসলে শ্যামলী তার স্বপ্নের সত্যতা পরীক্ষা করতেই এখানে এসে হানা দিয়েছে। এই তো?

জয়ন্তী সোৎসাহে মাথা দুলিয়ে বলল–হুবহু ঠিক। কর্নেল! সত্যি আপনার দক্ষতা আছে রিপোর্টিংয়ে।

কর্নেল আমাকে দেখিয়ে বললেন–কিন্তু হিয়ার ইজ এ রিয়্যাল রিপোর্টার। আশা করি, তোমাদের মনে আছে সেকথা। দৈনিক সত্যসেবকের প্রখ্যাত রিপোর্টার শ্রীমান জয়ন্ত চৌধুরী সামনাসামনি থাকতে, মাই ডিয়ার গার্ল, আমাকে ওই প্রশংসাটা দিও না। জয়ন্ত মনে মনে তোমার মাথা কাটবে।

জয়ন্তী আমার দিকে কটাক্ষ করল।–উনিই যে তিনি তার প্রমাণ তো শুধু আপনার মুখের কথা। তাই বিশ্বাস না করে উপায় নেই। কিন্তু ওঁকে আমার মোটেও সেরকম মনে হচ্ছে না, কর্নেল!

কর্নেল বললেন–কেন, কেন?

জয়ন্তী ফিক করে হাসল! রিপোর্টাররা সবসময় কৌতূহলী হবেন। সবসময় পেছনে লেগে থাকবেন। প্রশ্নে প্রশ্নে জ্বালিয়ে মারবেন। আরো স্মার্ট হবেন। কিন্তু আপনার সঙ্গী ভদ্রলোক দেখছি, নিতান্ত সাদাসিধে মানুষ। কথাই বলতে পারেন না। চুপচাপ, ভীতু-ভীতু মুখ, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন খালি।…..

শ্যামলী ধমকাল–তুমি বড্ড বাঁচাল, জয়া। এবার আমাকে ছেড়ে ভদ্রলোককে নিয়ে পড়লে? নিজেকে কি তুমি ভি আই পি মনে করো? ভি আই পি হলে নিশ্চয় জয়ন্তবাবু তোমার পিছনে লেগে থাকতেন–তুমিও খুব প্লিজড হতে।

কর্নেল হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন। বললেন–জয়ন্ত আসলে এবার মনমরা হয়ে আছে। পাহাড় জঙ্গল এসর প্রাকৃতিক পরিবেশ একজন সুযোগ্য যুবকের পাশে একজন যুবতাঁকেই মানায়। তার বদলে এক বাহাতুরে ওল্ড ফুল।

জয়ন্তী সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলল–আহা! সেও কথা! জয়ন্তবাবু আর মন খারাপ করে থাকবেন না। আমরা আপনাকে সঙ্গ দেব। রাজি তো?

টের পেলুম, মেয়েটি সত্যি বাঁচাল এবং যেন একটু পুরুষালি টাইপের। অথচ ওর মুখে একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ বেশ প্রখর। অধ্যাপিকা কিংবা দিদিমণিসুলভ গাম্ভীর্যের রেখা প্রকট হয়ে আছে। তাই বেশি কথা বললেও বেশ মানিয়ে যায়। শুধু বললুম–প্রস্তাবটা ভেবে দেখব।

 জয়ন্তী খিলখিল করে হেসে উঠল। এই সময় লক্ষ্য করলুম, শ্যামলী কিন্তু বরাবর কেমন গম্ভীর আর অন্যমনস্ক হয়ে রয়েছে। মনে কী যেন চাপা চাঞ্চল্য আছে, তা দমিয়ে রাখার যত্ন ও কষ্ট ওর মুখে ছাপ ফেলেছে। খারাপ স্বপ্ন দেখলে অনেকে নাকি এরকম নার্ভাস হয়ে পড়ে। আমার এক বন্ধু তার ফিয়াসের মৃত্যু দেখেছিল স্বপ্নে। মেয়েটি থাকে বম্বেতে। সে কদিন ধরে এমন উত্ত্যক্ত হল যে অবশেষে বোম্বে মেলের টিকিট কেটে বসতে বাধ্য হল। তবে সে তো প্রেমজ অস্বস্তির ব্যাপার। শ্যামলী কার মড়া দেখল স্বপ্নে, জানৰ্তে ইচ্ছে করছিল।

কথাটা বলেই ফেললুম–বাই দা বাই, স্বপ্নে যার মৃত্যু দেখা যায়, তার নাকি আয়ু বাড়ে। শ্রীমতী শ্যামলী নিশ্চয় কোন আত্মীয়ের মড়া দেখে থাকবেন।

কর্নেল বাইনাকুলারে চোখ রেখে পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম গায়ে সম্ভবত পাখি খুঁজছিলেন। অন্যমনস্কভাবে শুধু বললেন–রাইট, দ্যাটস রাইট!

জয়ন্তী বলল–মাই গুডনেস! হারে শ্যামলী, কার মড়া দেখেছিস তা তো বলিসনি?

শ্যামলী বাঁকা ঠোঁটে বলল-ওসব ছাড়ো তো বাবা! এক কথা নিয়ে ভ্যাজর-ভ্যাজর ভালো লাগে না! ওই দেখ দিনমণি এবার ডুব দিলেন।

আমরা এবার সূর্যাস্তের দিকে ঘুরে বসলুম। অপূর্ব, অপূর্ব! দূর উপত্যকার ওদিকে পর্বতশ্রেণীর মাথায় একটা বিশাল লাল গোলক আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে। চারদিকে হালকা গোলাপী, হলুদ, সবুজ, নীল, সোনালী এক ব্যাপক, বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ছে দীর্ঘ সব তুলির টানের মতন জ্যামিতিক সরল রেখায়, দিগন্তকে দেখাচ্ছে অলৌকিক শক্তিমান এক মহান সাধু। শবের মতন নিস্পন্দ শুয়ে আছেন তিনি, যেন স্বয়ং মহাকাল।….

.

গ্রিন ভিউ হোটেলের দিকে যে প্রাইভেট রাস্তাটা উঠে গেছে, তার শুরুতে বড় সরকারি রাস্তার বাঁক! বাঁকের মুখে ডান হাতে অর্থাৎ দক্ষিণ কয়েক একর সমতল জমির ওপর একটা মোটামুটি বড় বাড়ি। বাড়িটা অবশ্য একতলা। পুরনো ধাঁচের এইসব বাড়ি এখানে তানেক রয়েছে। কাঠ ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে প্রাঙ্গণটা ঘেরা! ফুলবাগিচা আর দেশী-বিদেশী অনেক গাছ আছে! সবুজ ঝকঝকে লনে চেয়ার-টেবিল পেতে কয়েকজন পুরুষ ও স্ত্রীলোক বসে আছেন দেখলুম। গেটে বুগানভিলিয়ার ঝাপি আছে। এখান অব্দি এসেই কর্নেল বললেন–যদি আপত্তি না থাকে, আমি জয়ন্তী ও শ্যামলীকেই বিশেষভাবে বলছি, বাণেশ্বরের এক মহীয়সী মহিলার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চাই। উনি ভীষণ খুশি হবেন। অন্যপক্ষে তোমরাও খুব খুশি তো হবেই, উপরন্তু একটি আশ্চর্য চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হবে! মিসেস মালহোত্রার কোন তুলনা হয় না। এমন মিশুকে মহিলা আজকাল দুর্লভ।

জয়ন্তী উৎসাহ দেখাল। কিন্তু শ্যামলী বলল–আজ থাক্। বরং আরেক সময় আসা যাবে।

জয়ন্তী ওর হাত ধরে টানল।–আয় না বাবা! এখানে ঘুরতেই তো এসেছি! প্রবাসে নিয়মটিয়ম কেউ মানে নাকি! বলা যায় না, নতুন চেনাজানা থকে অনেক সময় অনেক কিছু মিলে যায়।

কর্নেল কী বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় এক প্রৌঢ়া মহিলাকে দেখলুম চেয়ার ছেড়ে হনহন করে গেটের দিকে এগিয়ে আসছেন হাসিমুখে। কর্নেল আগে থেকেই হাত নাড়তে লাগলেন এবং চাপাস্বরে বললেন–মিসেস মালহোত্রা।

ইনি যে যৌবনে অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন, তার ছাপ এখনও মুছে যায়নি। বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখার মতন চেহারা। কর্নেলকে ইংরেজিতে বলে উঠলেন– হ্যালো, হ্যালো! আসুন, আসুন! আপনারই অপেক্ষা করছি আমরা। ডঃ পট্টনায়ক তো অস্থির এদিকে–যা খেয়ালি মানুষ আপনি! বলা যায় না, কোথায় জঙ্গলে গিয়ে ওৎ পেতে বসে আছেন হয় তো।

তারপর আমাদের দিকে ঘুরে অত্যন্ত অমায়িক হেসে বললেন–কী কাণ্ড! এইসব কচিকচি ছেলেমেয়ে নিশ্চয় কর্নেল সায়েবের পাল্লায় পড়ে হয়রান হয়েছে!

কর্নেল আমাদের সস্নেহে দেখে নিয়ে বললেন–আলাপ করিয়ে দিই। মিসেস সরোজিনী মালহোত্রা। একসময় নৈনিতাল গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা– ছিলেন। এখন পাকাপাকিভাবে বাণেশ্বরের বাসিন্দা। আর এ হচ্ছে শ্যামলী সেন। ওর বন্ধু জয়ন্তী রায়। দুজনেই সেরা পাহাড়চড়িয়ে। মানালি অভিযানে ছিল। এ জয়ন্ত চৌধুরী। কলকাতার প্রখ্যাত দৈনিক সত্যসেবকের রিপোর্টার, প্রখ্যাত ব্যক্তি এখন।

মিসেস মালহোত্রা এসে শ্যামলী ও জয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরলেন দুহাতে। তারপর আমার দিকে ঘুরে বললেন–চলে আসুন, চলে আসুন! ওঃ আমার কী সৌভাগ্য আজ! খুব জমে যাবে আসর! কর্নেল, আপনার কোন তুলনা হয় না।

ধাড়ি মুরগি যেমন ছানা নিয়ে এগোয়, আমাদের নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন মিসেস মালহোত্রা।

লনে অনেকগুলো খালি চেয়ার ছিল। আমরা বসে পড়লুম। মিসেস মালহোত্রা ছোটাছুটি করে বেড়াতে থাকলেন ব্যস্তভাবে। একজন লোক একটা ট্রেতে সাজিয়ে কোকাকোলার বোতল নিয়ে এল।

ততক্ষণে অন্ধকার সবে জমে উঠেছে। বাড়ির সামনে বাতিটি জ্বলে উঠল। এবার মিসেস মালহোত্রা পরিচয় করাতে থাকলেন। ইনি মিঃ অরিন্দম দ্বিবেদী। ইতিহাসের অধ্যাপক। থাকেন দিল্লীতে। ইনি মিঃ রঘুবীর জয়সোয়াল। রিটায়ার্ড পুলিস সুপার। এখন জয়পুরের বাসিন্দা। আর ইনি হচ্ছেন প্রখ্যাত ফোঝেনসিক এক্সপার্ট ডঃ সীতানাথ পট্টনায়ক। ওড়িশার লোক। এখন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোরেনসিক বিভাগের লেকচারার। এখন আসতে বাকি রইলেন মিঃ মোহন পারেখ। বোম্বের বিখ্যাত ফিল্ম গায়ক। এবার আমার নবাগত বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দেবেন স্বনামধন্য কর্নেল সরকার।

কর্নেল তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাননীয় ভদ্রমহোদয়গণ ও ভদ্রমহিলারা সম্বোধন করার পর পাঁচ মিনিট ধরে আমাদের তিনজনের সম্পর্কে গালভরা কিছু বাক্য বলে বসে পড়লেন।

তারপর উঠলেন ফের মিসেস মালহোত্রা।–ফ্রেন্ডস! আজকের আসরের প্রোগ্রাম আবার ঘোষণা করতে অনুমতি দিন। একটু পরেই আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় যাব এবং প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করব। হা–আমাদের আজকের প্রোগ্রাম মিডিয়ামের মধ্যে অশরীরী আত্মা আনা। চমৎকার প্রোগ্রাম এবং রোমাঞ্চকর। তাই নয়?

কে জানে কেন, আমি শিউরে উঠলুম। চারপাশে সমর্থনসূচক সাড়া পড়ে গেল। কর্নেল প্রশংসা করে বললেন–ওয়ান্ডারফুল! মিসেস মালহোত্রার নতুনত্বের তুলনা হয় না!

তারপর একটুখানি নীরবতা জাগল। সেই সময় শুনলুম, আমার পাশ থেকে শ্যামলী ফিসফিস করে জয়ন্তীকে বলছে–তুই এসব বিশ্বাস করিস?

জয়ন্তী বলছে নিশ্চয় করি।

–আমি করি না। মিডিয়ামরা সব ধাপ্পা দেয়!

–বেশ তো! তুই মিডিয়াম হয়ে দেখ না। পারবি?

–নিশ্চয় পারব! বলে শ্যামলী হাসল একটু। ফের বলল–মিডিয়াম ওদের নিশ্চয় ঠিক করা আছে। যে-সে নাকি মিডিয়াম হতেই পারে না! ওটাই তো চালাকি রে!

–চালাকি? বেশ। ওঁদের বলছি, তোকেই মিডিয়াম করে যেন!

বলে দেখ। রাজি হবে না।

 কর্নেল হঠাৎ ঘুরে বললেন–ইয়ে মিসেস মালহোত্রা, মিডিয়াম কে হচ্ছেন?

মিসেস মালহোত্রা ঘড়ি দেখে বললেন–আইডিয়াটা মিঃ পারেখের। উনিই তো মিডিয়াম হবেন বলেছিলেন। এখনও এসে পৌঁছলেন না। আশ্চর্য তো!

এবার শ্যামলী মুখ ফুটে বলে ফেলল–মিসেস মালহোত্রা, আমি মিডিয়াম হতে রাজি আছি।

তীক্ষ্ণদৃষ্টে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিসেস মালহোত্রা কী যেন দেখলেন। তারপর সস্নেহে হেসে বললেন–পরে কিন্তু শরীর ভীষণ খারাপ করবে।

করুক না। শ্যামলীর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।

 কর্নেল বললেন–হ্যাঁ, শ্যামলী পারবে। ওর শক্তি সাহস দুইই আছে– আমি সার্টিফাই করতে পারি।

মিসেস মালহোত্রা ঘড়ি দেখে একটু ইতস্তত করার পর রাজি হয়ে গেলেন।–ঠিক আছে। কর্নেলের কথার ওপর কথা নেই। তাহলে আমরা আর মিঃ পারেখের জন্যে অপেক্ষা না করতে পারি। কী বলেন আপনারা?

সবাই সায় দিলেন। তখন মিসেস মালহোত্রা আবার ঘড়ি দেখে বললেন– কফি খেয়েই আমরা উঠব। ঠিক সাতটায় বসব।

আমার কে জানে কেন, খুব অস্বস্তি হতে লাগল। শ্যামলীর মিডিয়াম হতে চাওয়াটা পছন্দ হচ্ছিল না। জয়ন্তীও এবার চুপিচুপি ওকে নিবৃত্ত করছে শুনলুম। কিন্তু শ্যামলী জেদের সঙ্গে ফিসফিস করে বলল–ভ্যাটু! সব বাজে। দেখি না কী হয়!