সমুদ্রে মৃত্যুর ঘ্রাণ – ২

০২.

 রাত নটায় আমরা দুজনে নীচে ক্যান্টিনে গেলুম। কর্নেল দুবার কৌশল্যাদেবীর স্যুইটে সরাসরি ফোন করেও সাড়া পাননি। বোঝা যায়, তিনি স্যুইটে তখনও ফেরেননি।

পূর্বাচল থ্রি-স্টার মার্কা হোটেল। বিত্তবানরাই এখানে ওঠেন। নীচের ক্যান্টিনহলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন বোর্ডাররা। বাইরের লোকেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে বোর্ডারের গেস্ট হিসাবে বাইরের লোক আসতে পারেন। ক্যান্টিনে বসে প্রবীণেরা এখনই ডিনার খাচ্ছেন। বেশির ভাগই দম্পতি। তবে যুবক যুবতীদের দেখে বলা কঠিন, তারা দম্পতি না নিছক প্রেমিক-প্রেমিকা। কেউ কেউ চা বা কফির কাপ টেবিলে রেখে চাপাস্বরে কথা বলছে।

কর্নেল ক্যান্টিনের ভেতর চোখ বুলিয়ে লাউঞ্জে গেলেন। লাউঞ্জের শেষপ্রান্তে বার। সেখানে শুধু কজন নানাবয়সী পুরুষ বিয়ার বা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে।

লাউঞ্জের অন্যপ্রান্তে একা বসেছিলেন ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডে। কর্নেলকে দেখে মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, হ্যালো-ও!

কর্নেল বললেন, আজ রাতের আবহাওয়া চমৎকার ডঃ পাণ্ডে!

 তিনি কাছাকাছি একটা ভেলভেটে মোড়া চেয়ারে বসলেন। আমি বসলুম একটা কারুকার্যখচিত থামের পাশে বসানো চেয়ারে। হাতের কাছে অ্যাশট্রে দেখে সিগারেট ধরালুম।

ডঃ পাণ্ডে বললেন, আবহাওয়া চমৎকার, নাকি দূষিত কর্নেল সরকার?

 কেন ডঃ পাণ্ডে?

মিসেস হাজরা কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন, তাঁর স্বামীর ল্যাব-অ্যাসিস্টান্টকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!

কর্নেল একটু হেসে বললেন, বিকেলে আপনি আর মিসেস মালবিকা হাজরা বিচে ঘুরছিলেন।

ডঃ পাণ্ডেও হাসলেন। স্বামীকে খুঁজে না পেয়ে ভদ্রমহিলা রাগ করে বিচে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে সঙ্গ দিলুম। তবে এ বয়সে আমার মধ্যে রোম্যান্টিসিজম বলতে আর কিছু নেই।

ডঃ কৌশল্যা বর্মনকে দেখেছেন কি?

হাজরা বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে ভদ্রমহিলা বেরিয়ে গেছেন। লক্ষ্য করেছি, উনি একটা অটো রিকশাতে চেপে কোথাও গেলেন।

ডঃ হাজরা কি পায়ে হেঁটে গেছেন?

 হ্যাঁ। হাতে টর্চও দেখেছি। সম্ভবত সি-বিচে গেছেন।

ওখানে তো যথেষ্ট আলো আছে।

ডঃ পাণ্ডে চোখে হেসে বললেন, আলোর তলায় অন্ধকার থাকে। কাল বিকেলের অধিবেশন শেষ হওয়ার পর সি-বিচের দিকে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ চোখে পড়েছিল, মেয়েটি–মানে হাজরার ল্যাব-অ্যাসিস্টান্ট ওই ঝাউবনের শেষ দিকটাতে একজন যুবকের সঙ্গে কথা বলছে। না–দুজনেই দাঁড়িয়েছিল। তারপর যুবকটি, সোজা এদিকে চলে এল। মেয়েটি বিচে নামল। আমি কাছাকাছি যেতেই সে আমাকে হাই সম্ভাষণ করে উল্টো দিকে চলে গেল।

আপনার পর্যবেক্ষণশক্তি অসাধারণ ডঃ পাণ্ডে!

ডঃ পাণ্ডে গম্ভীর হয়ে গেলেন। যুবকটিকে আমি সমুদ্রবিজ্ঞানভবনে আমাদের কনফারেন্স হলে দেখেছি। ফিল্মের হিরো টাইপ পোশাক ও চেহারা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে হাজরার ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টের প্রেমিক। সম্ভবত হাজরার অজ্ঞাতসারে সে তার প্রেমিকাকে অনুসরণ করে এখানে এসেছে।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আপনি মুখে বললে কী হবে ডঃ পাণ্ডে? আপনি ভেতরে ভেতরে রোম্যান্টিক।

না, না। উল্টোটা। আমি কোনো ঘটনার বাস্তব দিকটাই বিচার করি। হাজরার এসব লক্ষ্য রাখা উচিত। কারণ-ধরুন, সে কোনো নতুন কিছু আবিষ্কার করল, বিশেষ করে ওর সাবজেক্ট হল আণবিক জীববিজ্ঞান তার ল্যাব অ্যাসিস্টান্ট, কী যেন নামটা?

শ্রাবন্তী সেন।

হ্যাঁ। শ্রাবন্তী সেটা জানতেই পারে এবং কথাপ্রসঙ্গে তার প্রেমিকের কানে কথাটা তুলতে পারে। এসব ক্ষেত্রে গোপনীয়তা খুব দরকার। কারণ সারা বিশ্বে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এখন সহযোগিতার তুলনায় প্রতিযোগিতাই বেশি। আমার ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টদের দিয়ে আমি কাজ করিয়ে নিই। তাদের বেশি পাত্তা দিই না। সেইজন্য তাদের কাউকে সঙ্গে আনিনি।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আপনি ডিনার খাবেন কখন?

একজন গেস্ট আসবার কথা। তার জন্য অপেক্ষা করছি। ও! আপনি তো তাকে চেনেন! সমুদ্রবিজ্ঞানী ডঃ উমেশ ঝা।

ডঃ ঝা সম্ভবত আপনাকে তার কোয়ার্টারে একবেলা খাইয়েছেন।

ডঃ পাণ্ডের গাম্ভীর্য কেটে গেল। ঠিক ধরেছেন। তবে সেজন্যও না, ওঁর সঙ্গে আমার কিছু কথা আলোচনা করারও দরকার আছে। গোপন কিছু নয়। জেলি ফিশ সম্পর্কে কিছু নতুন তথ্য ডঃ ঝা এখানে পেয়েছেন। আপনি নিশ্চয় জানেন, জেলি ফিশে মানুষের চামড়ার পক্ষে ক্ষতিকর উপাদান প্রচণ্ড! তো– বাহ্! ডঃ ঝা এসে গেছেন। উঠলুম কর্নেল সরকার!

খোলা বিশাল দরজা দিয়ে দেখলুম, একটা গাড়ি এসে হোটেলের লনে ঢুকল। রোগা ঢ্যাঙা এক ভদ্রলোক ব্রিফকেস হাতে নামলেন। গাড়িতে ড্রাইভার আছে। সে গাড়িটা পার্কিং জোনে নিয়ে গেল। ডঃ পাণ্ডে গিয়ে ডঃ ঝায়ের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর দুজনে ক্যান্টিনহল অর্থাৎ ডাইনিং হলে ঢুকলেন।

কর্নেল বললেন, আমরা দশটায় ডিনার খাব জয়ন্ত। নাকি তোমার খিদে পেয়েছে?

বললুম, নাহ্। পকৌড়া এখনও হজম হয়নি।

কর্নেল চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। মিনিট পাঁচেক পরে একটা অটো– রিকশা এসে নীচের রাস্তায় দাঁড়াল। দেখলুম, কৌশল্যাদেবী এতক্ষণে ফিরলেন।

লাউঞ্জে ঢুকে উনি কর্নেলকে দেখতে পেয়ে কাছে এলেন। ডঃ পাণ্ডে যে চেয়ারে বসেছিলেন সেটাতেই বসে পড়লেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, হোটেল দ্য শার্কে পরিবেশবিজ্ঞানী ডঃ রঘুবীর আচারিয়ার কাছে আবার গিয়েছিলুম। উনি আমাকে বোনের মতো স্নেহ করেন।

কর্নেল দ্রুত বললেন, তাকে কি ঘটনাটা জানিয়েছেন?

জানাতে বাধ্য হলুম। আমার মাথার ঠিক নেই।

ডঃ আচারিয়া কী পরামর্শ দিলেন?

উনি বললেন–আপনি যা বলছিলেন, এখনই হঠাৎ করে পুলিশকে জানাতে নিষেধ করলেন। পুলিশ হইচই বাধাবে এখানে এসে। আর মুখ নিচু করে কৌশল্যা আরও আস্তে বললেন, উনি আপনার সাহায্য নিতে পরামর্শ দিলেন। ডঃ আচারিয়ার থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু দিল্লীতে একটা বড়ো সেমিনার হবে। ওঁর থাকা খুবই নাকি জরুরি। উনি কাল বারোটা পাঁচের ট্রেনে চলে যাচ্ছেন। তো ডঃ হাজরা ফিরেছেন?

নাহ্।

কৌশল্যার মুখে হতাশার ছাপ ফুটে উঠল। তা হলে মেয়েটা পালিয়ে গেছে। পুলিশকে বললে হয়তো ওরা রেল স্টেশন বা বাসস্টেশনে লক্ষ্য রাখতে পারত। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই।

আচ্ছা কৌশল্যাদেবী, আপনি কি শ্রাবন্তীর সঙ্গে কোনো যুবককে কোনো সময় দেখেছেন?

কৌশল্যা তাকালেন। একটু পরে বললেন, না তো! তবে সমুদ্রবিজ্ঞান ভবনে কনফারেন্সের প্রথম দিন দুপুরে ব্যুফে লাঞ্চের সময় এক যুবক শ্রাবন্তীর আগে ছিল। সে পেছন ফিরে শ্রাবন্তীর প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিল দেখেছি। এটা ভদ্রতা হতে পারে। কেন?

আর কোনো সময়ে যুবকটিকে দেখতে পাননি?  

হ্যাঁ। কনফারেন্স হলে তাকে বসে থাকতে দেখেছি। আমি ভেবেছিলুম কোনো সাংবাদিক। তার হাতে প্যাড আর কলম ছিল। জয়ন্তবাবু চিনতে পারেন।

বললুম, নাহ্। কলকাতা থেকে যে-সব সাংবাদিক এসেছিল, সবাই আমার চেনা। তাছাড়া আমাদের জন্য আলাদা প্রেস লেখা জায়গা ছিল। তাকে কি সেখানে দেখেছিলেন?

না। আমন্ত্রিত শ্রোতাদের আসনে দেখেছি।

 তা হলে সে সাংবাদিক নয়।

 বেশ স্মার্ট চেহারা। ফিল্ম হিরোর মতো দেখতে।

কর্নেল বললেন, চলো জয়ন্ত! ডিনার সেরে নেওয়া যাক। কৌশল্যাদেবী! আপাতত আমাদের টেবিলে যোগ দেবেন চলুন। এখন মাথা ঠিক রাখা দরকার। প্লিজ, কাকেও যেন জানতে দেবেন না কী ঘটেছে। আসুন! স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুন।

ক্যান্টিনহলে গিয়ে শেষপ্রান্তে চারজনের বসার জায়গা পাওয়া গেল। পাশে খোলা জানালা। সামুদ্রিক হাওয়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। কারণ পূর্বাচল উঁচু জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেলের দাড়ি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। তবু তিনি জানালা বন্ধ করলেন না।

চুপচাপ আমরা ডিনার খেয়ে উঠে পড়লুম। কৌশল্যা বর্মন বললেন, আমি স্যুইটে যাই। কাপড় চোপড় বদলাতে হবে। দরকার হলে আমরা পরস্পরকে টেলিফোন করব।

পাণ্ডে এবং ঝা তখনও ডিনার শেষ করেননি। দুজনেই কথা বলছেন আর একটু-আধটু করে খাচ্ছেন। আমাদের ওঁরা লক্ষ্য করলেন না।

সিঁড়িতে দেখা হল মালবিকা হাজরার সঙ্গে। কর্নেল বললেন, ডঃ হাজরাকে দেখছি না?

মালবিকা গম্ভীর মুখে বললেন, ল্যাব অ্যাসিস্টান্টকে সি-বিচে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

 বলেন কী? দেখতে পেয়েছেন বুঝি?

সি-বিচে আলো আছে, দেখতে পাওয়া যায়।

 গেল কোথায় মেয়েটি?

নরকে। বলেই মিসেস হাজরা দ্রুত নেমে গেলেন।

আমাদের স্যুইটে ঢুকে হাসতে হাসতে বললুম, ভদ্রমহিলা সম্ভবত তার স্বামীর সঙ্গে শ্রাবন্তীর অবেধ সম্পর্কের কথা জানেন।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে কী জবাব দিতে ঠোঁট ফাঁক করেছেন, বদ্ধ দরজায় জোরালো ধাক্কার শব্দ হল। দরজা খুলতেই ডাঃ কৌশল্যা বর্মন ঝোড়ো কাকের মূর্তিতে ঘরে ঢুকে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে উঠলেন, মার্ডার! কর্নেল সরকার, আমার সুইটের বাথরুমে মার্ডার!

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে তার দুধে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, শ্রাবন্তীর ডেডবডি?

ঝাঁকুনিতে কৌশল্যাদেবীর উন্মাদিনীর ভাবটুকু ঘুচে গেল। ভাঙা গলায় বললেন, হ্যাঁ। শ্রাবন্তীর ডেডবডি! বীভৎস দৃশ্য কর্নেল সরকার। চিত হয়ে পড়ে আছে। চোখ খোলা। আমি বাথরুমের দরজা ঠেলছিলুম। খুলছিল না। শেষে জোরে ঠেলার পর দরজা একটু ফাঁক হল। অমনি দেখলুম–হা ঈশ্বর! এবার আরও সর্বনাশ হল!

কর্নেল বললেন, আপনি এখানে চুপচাপ বসুন। জয়ন্ত! তুমি থাকো। আমাকে আপনি চাবি দিন!

কৌশল্যা বললেন, চাবি তো বিছানায় ফেলে এসেছি। তাহলে দরজা খোলা যাবে না। আমি ম্যানেজারকে ডুপ্লিকেট চাবি আনতে বলছি। বলে কর্নেল টেলিফোন ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বলেন, সুইট নাম্বার সেভেন থেকে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্রকে দিন।…মিঃ মহাপাত্র! আমি কর্নেল সরকার বলছি। তিনতলায় ১৭ নম্বর সুইটের ডুপ্লিকেট চাবি…ও হ্যাঁ! দুই বোর্ডারকে দিয়েছেন। …তা হলে মাস্টার কি নিয়ে এখনই আসুন। আমি আমার দরজার সামনে অপেক্ষা করছি। …হ্যাঁ। একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এখন কোনো উত্তেজনা বা হইচই নয় প্লিজ! শুধু আপনি আসুন মাস্টার কি নিয়ে।…ধন্যবাদ।

দরজা খোলা রইল। একটু পরে দেখলুম মিঃ মহাপাত্র হন্তদন্ত এসে গেলেন। তারপর দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেন।

কৌশল্যাদেবীকে বললুম, আপনি বরং ব্যালকনিতে গিয়ে বসুন। সিঁড়ি দিয়ে বোর্ডার বা হোটেলবয়রা ওঠানামা করতে পারে। আপনাকে এভাবে এখানে বসে। থাকতে দেখে তাদের কৌতূহল হতে পারে।

কৌশল্যা রুমালে চোখ মুছে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেন। আমি দরজার দিকে ঘুরে বসে সিগারেট ধরালুম।

একটু পরে ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডে আপনমনে এসে সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় নিজের ঘরে চলে গেলেন। এ ঘরের দিকে তাকালেন না।

পাঁচ মিনিট পরে কর্নেল এবং মিঃ মহাপাত্র ফিরে এলেন। কর্নেল তাকে বললেন, যে নাম্বারটা দিলুম, ওটা ও সি রণবীর জেনার ব্যক্তিগত নাম্বার। আমার নাম করে বলবেন কী ঘটেছে এবং তিনি যেন সম্ভব হলে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর কল্যাণ পট্টনায়ককে সঙ্গে নিয়ে আসেন। আমার ঘর থেকে সরাসরি বাইরে ফোন করা যাবে না। পি বি এক্স অপারেটর চমকে উঠবে। কাজেই…

ও কে কর্নেল সরকার। বলে ম্যানেজার নেমে গেলেন।

কর্নেল দরজা এঁটে ব্যালকনিতে গিয়ে কৌশল্যাদেবীকে স্যুইটের চাবি এবং আরো এক গোছা চাবির রিং দিয়ে বললেন, একটা কথা। আপনার চুরি সম্পর্কে পুলিশকে আজ রাতে কিছু বলবেন না। আপনি বলবেন, বিকেলে সি বিচ থেকে ফিরে স্যুইটে ঢুকেছিলেন। কিন্তু বাথরুমে যাননি। তারপর নিচে গিয়ে ডঃ হাজরাকে বলেন, শ্রাবন্তীকে দেখতে পাচ্ছেন না। সে আপনার স্যুইটে থাকে। কাজেই তার খোঁজ আপনি নিতেই পারেন। তারপর আপনি হোটেল দ্য শার্কে ডঃ আচারিয়ার কাছে একটা ব্যক্তিগত মেসেজ দিতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে ডিনার করে হ্যাঁ, এর পরের অংশটা ঠিক-ঠাক বলবেন।

কৌশল্যাদেবী রুমালে আবার চোখ মুছলেন। আমি ভাবতে পারিনি এমন কিছু ঘটবে।

ঘটে যখন গেছে, ঠাণ্ডা মাথায় তার মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে।

বলে কর্নেল এসে বসলেন। চুরুট ধরিয়ে আস্তে বললেন, খুনী শ্রাবন্তীর গলায় নাইলনের দড়ির ফঁস আটকে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছে। দড়িটা লম্বা। আমার ধারণা শাওয়ারে তাকে ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল–যাতে আত্মহত্যা বলে মনে হয়। খুনী পারেনি। শ্রাবন্তী ছিপছিপে গড়নের মেয়ে। ততকিছু ওজন নয় তার শরীরের। আমার অনুমান পঞ্চাশ কিলোগ্রামও ওজন নয়। বড় জোর পঁয়তাল্লিশ থেকে সাতচল্লিশ কেজি।

নাইলনের দড়িটা কি এখনও গলায় জড়ানো আছে?

হ্যাঁ। ঝোলানোর চেষ্টা করেছিল কোমোডে উঠে। কোমোডের নীচে বালি পড়ে আছে। জুতো খুলে রেখে কোমোডে চড়েছিল খুনী। ব্যর্থ চেষ্টার পর পালিয়ে যায়। দরজা তো ভেতর থেকে খোলা যায়। দরজার সামনে একই বালি। অবশ্য আমাদের অনেকের জুতোর তলায় সামুদ্রিক বালি ছিল।

আমার ছিল না।

কর্নেল হাসবার চেষ্টা করে বললেন, হ্যাঁ। তুমি এ বেলা বেরোওনি।

আস্তে বললুম, কর্নেল! মিসেস হাজরা খুনী নয় তো?

হতেই পারেন। তবে যতক্ষণ না কোনো প্রমাণ পাচ্ছি, চুপচাপ থাকাই উচিত। কর্নেল একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, অদ্ভুত! আমার ইনটুইশনের বড়াই করি। অথচ তখন কৌশল্যাদেবীর খাটের তলায় উঁকি দিলুম। বাথরুমে গেলুমই না। এমন তো হতেই পারে, আমরা ঘরে ঢোকার সময় খুনী বাথরুমের দরজা বন্ধ করে তখনও ভেতরেই ছিল। আসলে তখন ফাইল চুরির ব্যাপারটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলুম।

শ্রাবন্তীর খোঁপা লক্ষ্য করেছেন?

খোঁপার যেটুকু দেখতে পেয়েছি, তাতে বুঝেছি, ফুলগুলো সে বাইরে কোথাও ফেলে দিয়ে এসেছিল। শুধু দুটো ফুল খোঁপায় আটকে ছিল। একটা পড়েছিল ব্যালকনিতে। একটা খাটের পাশে।

সে তো দেখেছি। আপনি কুড়িয়ে নিলেন।

এবার বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটা ঘরে ফিরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খুনীর সঙ্গে কথা বলছিল। খুনী তাকে ভেতরে কোনো ছলে ডেকে আনে। তারপর ব্যালকনির দরজা ভেজিয়ে দেয়। সম্ভবত কোনো গোপন কথা আলোচনার ছল করেছিল।

মেঝের কার্পেট লক্ষ্য করেছেন?

খুন করেছে মেঝেতে। দুই খাটের মধ্যিখানে। কিন্তু নারকেল ছোবড়ার কার্পেট মেঝের সঙ্গে সেঁটে আছে দেখে এলুম। শুধু একটুখানি জায়গা কুঁচকে আছে। ওটা তখন কৌশল্যা দেবীর সঙ্গে গিয়েও লক্ষ্য করেছিলুম। কিন্তু গুরুত্ব দিইনি। এই দেখ! জুতোর ডগা দিয়ে কার্পেটটা একটু কুঁচকে দিলুম। লক্ষ্য করছ? গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে কি দেখলে পরে?

নাহ্।

কর্নেল ডাকলেন, ডঃ বর্মন! ঘরে এসে বসুন এবার।

কৌশল্যাদেবী ঘরে এসে কর্নেলের বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলেন। তাকে এখন শান্ত এবং কিছুটা নির্বিকার দেখাচ্ছিল। বললেন, আমি আপনার মেয়ের বয়সী কর্নেল সরকার। আমাকে আপনি নাম ধরে ডাকবেন।

কর্নেল শান্তভাবে হাসলেন। ঠিক আছে। তুমি আমার মেয়ে। তবে আমি চিরকুমার। সামরিক জীবন আমাকে যদি গিলে না খেত, তা হলে আমি হয়তো বিয়ে করতুম এবং আমার মেয়ে জন্মালে এতদিনে তোমার বয়সী হত। তুমি– আমার অনুমান, বড়জোর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী।

কৌশল্যা মুখ নামিয়ে বললেন, আমি এ মাসে পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে ছত্রিশে পড়েছি।

জয়ন্ত! দেখ, কেমন নির্ভুল আমার হিসেব। তুমি কত ভেবেছিলে?

বললুম, আমার অনুমান ছিল কৌশল্যাদেবীর বয়স তিরিশের বেশি নয়।

কৌশল্যা বললেন, আমি বাংলা বলতে পারি না। যদিও আমার জন্ম হয়েছিল ত্রিপুরার আগরতলায়। আমি বড় হয়েছি দিল্লিতে মামার বাড়িতে। আমার মামা জগদীপ সিনহাকে আপনি ভালো চেনেন। তিনি আপনার বন্ধু। তাই না? তো মামী মার্কিন মহিলা। তাই আমার বাংলা শেখা হয়নি। আর জয়ন্তবাবু! আপনি আমাকে কৌশল্যাদিদি বললে খুশি হবো।

কর্নেল শুধরে দিলেন। বাঙালিরা কৌশল্যাদি বলবে। দিদি অবশ্য সম্ভাষণে।

টেলিফোন বাজল। কর্নেল দ্রুত রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। মিঃ মহাপাত্র?… মিঃ জেনা আসছেন?…মিঃ পটনায়ক? ঠিক আছে।… একটা হইচই উত্তেজনা তো হবেই। হত্যাকাণ্ড। না, না। আপনি কী করতে পারতেন? কোনো সমস্যাই নয়। পুলিশ এলে বোর্ডাররা জানবে। অনেকে অবশ্য দরজা এঁটে শুয়ে পড়েছেন। কাজেই ততকিছু ভিড় হবে না। ডঃ হাজরা এইমাত্র ফিরলেন? ঠিক আছে। ওঁরা স্বামী-স্ত্রী খেয়ে নিন। এখন ওঁদের কিছু বলবেন না। যথাসময়ে পুলিশই ওঁদের জানাবে। ঠিক আছে। কোনো চিন্তার কারণ নেই। রাখছি।…

কর্নেল উঠে গিয়ে দরজা খোলা রাখলেন। বললুম, কী ব্যাপার? দরজা–

বৃদ্ধ রহস্যভেদী আমার কথার ওপর বললেন, স্পিকটি নট। চুপচাপ বসে থাকো।

দু-তিন মিনিটের মধ্যেই ডঃ পরিমল হাজরা এবং তার স্ত্রী মালবিকা হাজরাকে দরজার সামনে দেখা গেল। মালবিকা আমাদের ঘরের দিকে না তাকিয়ে চটির শব্দ তুলে চলে গেলেন। ডঃ হাজরা থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, একটু কথা আছে কর্নেল সায়েব!

কর্নেল বললেন, স্বচ্ছন্দে ভেতরে এসে কথা বলতে পারেন।

একটু দ্বিধার সঙ্গে পরিমল হাজরা ঘরে ঢুকলেন। কৌশল্যাদিকে দেখে ইংরেজিতে বললেন, আপনি আছেন এখানে? ভালোই হল। আপনি তখন শ্রাবন্তীকে খুঁজছিলেন–

কৌশল্যাদি বললেন, খুঁজছিলুম–মানে, তাকে অনেকক্ষণ আমার ঘরে বা নীচে কোথাও দেখিনি। তাই একটু উদ্বিগ্ন হয়েছিলুম। সে একজন যুবতী মেয়ে।

ফিরেছে কি শ্রাবন্তী?

না। সে ফিরে এলে এখানে কেন আড্ডা দেব?

আমি কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এলুম। ভাবলুম, এতক্ষণে নিশ্চয় ফিরেছে। মালবিকা বলছিল, না ফিরে থাকলে আপনি হোটেলের ম্যানেজারকে নিশ্চয় জানাতেন। ম্যানেজার কার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত দেখে চলে এলুম। রাত এগারোটা কখন বেজে গেছে।

তাপনি তামার কথা শুনে তখন সর্বনাশ বলে ছুটে গেলেন কেন জানতে পারি?

উঃ হাজরা আস্তে বললেন, এখানে শ্রাবন্তী আমার সঙ্গে আসার পর অচেনা-অজানা এক যুবককে গায়ে পড়ে তার সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছিলুম। বখাটে ধরনের যুবক। তাই ভেবেছিলুম, শ্রাবন্তী তার ছলনায় পড়ে সি-বিচে গেছে। আজকাল তো সর্বত্র মানে, নারীধর্ষণ আর খুন-খারাপি হচ্ছে। তাই আমার প্রচণ্ড আতঙ্ক জেগেছিল। ওই বখাটে ছোকরার ফাঁদে পা দিয়ে শ্রাবন্তী হয়তো বিপদে পড়েছে।

কর্নেল বললেন, ডঃ হাজরা! কিছু মনে করবেন না। বিকেলে দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের কাছে আপনি আর শ্রাবন্তী পাশাপাশি বসেছিলেন। আমি দেখেছি।

কৌশল্যাদি বললেন, আমিও দেখেছি। আপনি তার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিচ্ছিলেন।

ডঃ হাজরা নিমেষে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার! কর্নেল একটু হেসে বললেন, নিশ্চয় আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে এখনও শ্রাবন্তী ফিরে এল না। আপনি পুলিশকে জানাননি কেন?

এখনই স্যুইটে ফিরে জানাচ্ছি। আমি আপনার পরামর্শ নিতে চেয়েছিলুম।

ঠিক এই সময় সিঁড়িতে কয়েক জোড়া জুতোর শব্দ হল। তারপর কয়েকজন পুলিশকে দেখা গেল। একজন পুলিশ অফিসার কর্নেলকে দেখে বলে উঠলেন, এই যে, কর্নেল সরকার! চলুন। লাশটা দেখি।

লক্ষ্য করলুম, ডঃ হাজরা পাথরের মূর্তিতে পরিণত।

.