তুষারে রক্তের দাগ – ৪

০৪.

রাত তিনটেয় নিচে খুব চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বর। সে স্লিপিং ব্যাগ থেকে ধুড়মুড় করে বেরিয়ে ডাকল, সোনালি, সোনালি!

পাশের খাট থেকে সোনালির ঘুম-জড়ানো অস্ফুট সাড়া এল।

ধ্রুব গায়ে ওভারকোটটা দ্রুত চাপিয়ে তাকে ঠেলাঠেলি করে জাগাল।…এই, নিচে কী গণ্ডগোল হয়েছে মনে হচ্ছে! আমি যাচ্ছি। তুমি দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দাও।

সোনালি জাগল, কিন্তু উঠল না। বলল, পাগল পাগল! রাত দুপুরে গোয়েন্দাগিরি করবে, বায় চড়েছে মাথায়। ভ্যাট!

আহা, দরজাটা…

 থাক্। কেউ আমাকে খুন করবে না।

অগত্যা ধ্রুব বেরোল। কাঠের মেঝেয় খুব হাঁটাহাঁটির শব্দ হচ্ছে। গোলমাল বেড়েছে মনে হলো। ধ্রুব নিচের করিডরে আসতেই গ্যারেজম্যানের সঙ্গে দেখা হলো। ধ্রুব বলল, কী হয়েছে? অত গোলমাল কেন?

গ্যারেজম্যান হেসে বলল, শ্রীবাস্তবজির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

তার মানে?

গিয়ে দেখুন না সায়েব! বলে লোকটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

ডাইনিং হলের উল্টোদিকে অফিস। অফিসের সামনে ভিড় জমে গেছে। গুলাব সিং, ইউসুফ সায়েব, জনাচার সেপাইও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। কর্নেল আছেন। আর শ্রীবাস্তব ভীষণ চেঁচামেচি করছে।

ধ্রুবকে দেখে কর্নেল একটু হাসলেন।

শ্রীবাস্তবের হাতের দিকে চোখ গেল ধ্ৰুবর। ক্রাচে ভর দিয়ে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং তার দুহাতে দুটো বাস্কেট–স্কি-পোলের তলায় যা লাগানো থাকে। ধ্রুব চমকে উঠল! শ্রীবাস্তব খেপে গিয়ে বলছে, সব ব্যাটাকে আমি ফাঁসিকাঠে ঝোলাব। এখানে সব্বাই খুনী–এভরি বডি ইজ দা মার্ডারার!

ব্যাপার কী? ধ্রুব গুলাব সিংকে ইশারায় ডেকে একটু তফাতে দাঁড়াল। গুলাব সিং গম্ভীর। কাছে এসে বলল, এক আজব ব্যাপার, চাউন্ড্রি সায়েব। আমার মাথায় আসছে না কিছু। শ্রীবাস্তব সায়েবের দরজায় কিছুক্ষণ আগে কে নক করছিল। দেমাগ খারাপ থাকার দরুন ওঁর ঘুম হচ্ছে না দুরাত থেকে। তো, উনি জেগেই ছিলেন নাকি। বার বার নক করাতে উনি অনেক কষ্টে উঠে দরজা খোলেন। অমনি কে ওঁর ঘরের ভিতরে ওই বাস্কেট দুটো ছুঁড়ে ফেলে ওঁকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। ওই বাস্কেট দুটো নাকি শ্রীবাস্তব সায়েবেরই স্কি-পোলের।

ধ্রুব সবিস্ময়ে বলল, তিন নম্বর?

হ্যাঁ সেট নাম্বার থ্রি।

লোকটাকে চিনতে পারেননি উনি?

না। লোকটা নাকি মুখে রুমাল ঢেকে এসেছিল। আর ধাক্কা খেয়ে উনি নাকি পড়ে গিয়েছিলেন। পায়ে জখম আছে–উঠতে উঠতে লোকটা ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে।

ধ্রুব চোখ টিপে হাসল।..গুলাব সিংজি, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে এ ঘটনা?

গুলাব সিং গোঁফের নিচে মৃদু হেসে চাপা গলায় বলল, মোটেও না। শ্রীবাস্তব সায়েব আরও অনেক নাটক করবেন এবার। দেখুন না, করিডরে সেপাইরা কড়া পাহারা দিচ্ছে তার মধ্যে কোন লোক গিয়ে শ্রীবাস্তবের দরজা নক করল, আর তারা কিছু দেখতে পেল না?

কর্নেল এসে ধ্রুবর হাত ধরে টানলেন!..এস ধ্রুব, আমার ঘরে একটু বসবে।

কর্নেলের ঘরে, ঢুকে ধ্রুব বলল, সোনালি একা আছে। বেশিক্ষণ বসব না কর্নেল!

কর্নেল বললেন, না–বসতে ডাকিনি। তিন নম্বর বাস্কেটটা তাহলে পাওয়া গেল! ব্যাপারটা লক্ষ্য করছ? আমি ঠিক এ রকমই আশা করেছিলাম। ওটা কোন না কোনভাবে পাওয়া যেতই।

ধ্রুব বলল, শ্রীবাস্তবের আর বাঁচার পথ নেই, কর্নেল। ব্যাটা নিজে থেকে যেন ধরা দিতে চায়।

কেন, কেন?

এমন নাটকীয়তা ওর না করলেও চলত।

ব্যাপারটা সত্যি হতেও তো পারে।

অসম্ভব, কর্নেল। করিডরে সেপাইরা ছিল তাদের চোখ এড়িয়ে…

কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, সেপাইদের পাহারার কথা বলো না। এই তুষার ঝড়ের রাতে ওরা কোণঠাসা হয়ে জড়োসড়ো বসেছিল। করিডর ঢাকা হলে কী হবে? ওখানে তো কোন হিটিং ব্যবস্থা নেই–কী ঠাণ্ডা দেখছ না? ব্যাটারা আগাগোড়া কুমড়োর বস্তার মতো কম্বল মুড়ি দিয়ে দেয়ালে এঁটে থাকে। পাশ দিয়ে কেউ গেলেও তখন কারো মুখের ঢাকনা সরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে না।

ধ্রুব বলল, কিন্তু তাহলে শ্রীবাস্তবই যে খুনী, আর আমার কোন সংশয় নেই।

কর্নেল হাসলেন, তোমার এ সিদ্ধান্তের কারণ?

অনেক। তবে একটা একেবারে ভাইটাল। লিফটম্যান খুনের খবর দিতে যাবার পথে কাকে স্কি করে যেতে দেখেছিল। আমি ভেবে দেখেছি সেই স্কিয়ার নিশ্চয়ই শ্রীবাস্তব। কারণ, যার কাছে খুনের খবর নিয়ে যাচ্ছে, তাকে ওইভাবে ওখানে দেখেছিল বলেই লিফটম্যান অত দৌড়াদৌড়ি করেছিল বা দেরি করে ফেলেছিল। এইটাই যুক্তিসঙ্গত।

হ্যাঁ-মন্দ যুক্তি নয়। স্বীকার করছি। কিন্তু শের সিংকে তাহলে বেঁহুশ করা হলো কেন? স্টোরের ডুপ্লিকেট চাবি তো শ্রীবাস্তবের কাছেই ছিল।

বেঁহুশ সত্যি করা হয়েছিল কি না–তার প্রমাণ কোথায় কর্নেল? ও তো আপনার অনুমান। শের সিং যে গ্লাসে মদ খেয়েছিল, সেটা পরীক্ষা না করে কীভাবে প্রমাণিত হবে?

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, রাইট, রাইট। সেও তো ঠিক। তুমি একজন ফোরেনসিক এক্সপার্ট। তোমার যোগ্য কথাই বলেছ। পরক্ষণে হাসলেন…আমার দুর্ভাগ্য, গ্লাসটা সকালে ধুয়ে ফেলা হয়েছিল সম্ভবত। আর আমার থিওরি প্রমাণের কোন উপায় নেই!

ধ্রুব বলল, এখন আসি। সওয়া তিনটে বেজেছে। এখনও যথেষ্ট ঘুম হবে।

কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ–ঘুমোও গিয়ে। আমার ইনসমনিয়াটা আবার বেড়ে গেছে।…

ধ্রুব বেরিয়ে দেখল ভিড় কমেছে। শ্রীবাস্তব নেই। ইউসুফ সায়েব স্কিয়ারদের সঙ্গে কথা বলছেন। ধ্রুব পাশ কাটিয়ে চলে এল।

সিঁড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ ধ্রুবর কানে এল ওপরে কে যেন চাপা চিৎকার করে উঠল। একমুহূর্ত থামল। না–কানের ভুল নয়। গোঙানির শব্দ বেশ স্পষ্ট। সে কয়েকটি লাফে ওপরে পৌঁছল! সর্বনাশ! তার ঘরেই কে যেন গোঙাচ্ছে এবং প্রচণ্ড ধস্তাধস্তির শব্দ হচ্ছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, সোনালি! সোনালি! তারপর দরজার হাতল ঘোরাল। পরক্ষণে আচমকা দরজা খুলে কে ভীষণ জোরে তার বুকে ধাক্কা মারল। পড়ে গেল ধ্ৰুব। পড়ে গিয়েই চেঁচিয়ে উঠেছিল সে–চোর! চোর!

চোর বলে কেন চেঁচাল, সে-মুহূর্তে বলা কঠিন ধ্রুবর পক্ষে। যাই হোক, সে মেঝে থেকে উঠে একলাফে প্রথমে সোনালির কাছে গেল। টেবিলল্যাম্পটা তেমনি জ্বলছে। সোনালি স্লিপিং ব্যাগের ভিতর অর্ধেক শরীর ঢুকিয়ে বিছানায় বসে রয়েছে। চুল বিস্রস্ত বড়ো বড়ো চোখ। ভীষণ হাঁপাচ্ছে। খাটের পাশেই তার রেশমি স্কার্ফটা পড়ে রয়েছে।

ধ্রুব রুদ্ধশ্বাসে বলল, কী হয়েছে, কী হয়েছে সোনালি?

সোনালি ঠোঁট কাঁপছে। কিছু বলতে পারল না। আঙুল তুলে নিচে স্কার্ফটার দিকে দেখাল মাত্র। ভয়ে তার মুখটা সাদা হয়ে গেছে।

স্কার্ফটা তুলে ধ্রুব বলল, আঃ, কী হয়েছে বলবে তো? কে এসেছিল?

 দরজার বাইরে শের সিং-এর গলা শোনা গেল, সায়েব, সায়েব!

সিঁড়িতে অনেকগুলো পায়ের দৌড়ে আসার শব্দ হলো। অনিবার্যভাবে আবার একটা নাটকীয় ভিড় জমে যেতে থাকল ধ্রুবর ঘরের সামনে।

ধ্রুব বড়ো আলোটা জ্বেলে দরজা খুলতেই শের সিং, গুলাব সিং, ইউসুফ তেঙ, আর কর্নেল ঢুকে পড়লেন। আরো অনেকে দৌড়ে আসছে শোনা গেল।

সোনালি অস্ফুট স্বরে বলল, জল খাবো।

জল খাবার পর সুস্থ হয়ে সোনালি যা বলল, তাতে সবাই আতঙ্কে বিস্ময়ে কাঠ। ধ্রুবর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।

কে দরজা খুলে সোনালির ঘরে ঢুকে ওর মাথার কাছ থেকে স্কার্ফটা নিয়ে গলায় পেঁচাতে থাকে। ধ্রুব বেরোবার পর তখন সোনালির একটু ঘুম এসেছিল ফের–সে কিছু টের পায়নি। হঠাৎ দম আটকে আসায় সে জেগে ওঠে। তারপর দ্যাখে, কে ওর বুকে বসে গলায় স্কার্ফটা পেঁচাচ্ছে। দম আটকে যেতে থাকে সোনালির। যথাশক্তি দুহাতে ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।

লোকটার মুখে কালো রুমাল ঢাকা ছিল। চিনতে পারেনি। কিন্তু তার গায়ের জোর প্রচণ্ড। ধ্রুবও টের পেয়েছে। এবং চিনতে পারেনি সেও।

হ্যাঁ–এটা স্পষ্ট, সোনালিকে শ্বাসরুদ্ধ করে খুন করতে এসেছিল সে। ভাগ্যিস, ঠিক সময়ে ধ্রুব এসে পড়েছিল। তা না হলে সোনালিকে এতক্ষণ লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হত বিছানায়।

কিন্তু কেন সোনালিকে খুন করতে এসেছিল সে? কে সে? সেই কি ললিতা কিংবা সঞ্জয়ের হত্যাকারী? সোনালিকে খুন করে কী উদ্দেশ্য চরিতার্থ হত তার?

নানা প্রশ্ন সবার মাথায় ভিড় করে এল। বাকি রাতটা আর কেউ ঘুমোল না।…

.

সকাল হলো। কিন্তু আবহাওয়া বিশ্বাস্যভাবে চমৎকার। দুরন্ত তুষারঝড় আর নেই। আজ সূর্যের চেহারা দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। বরফ পড়া প্রায় বন্ধ। কেবল কুয়াশার আবছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে সবখানে। গাছের পাতা আর ঘরবাড়ি থেকে চাপচাপ বরফ খসে পড়ার জন্যে ধোঁয়াটে হয়ে যাচ্ছে রোদটা। চমৎকার অনুকূল আবহাওয়া স্কিয়ারদের পক্ষে। কিন্তু স্কি আপাতত বন্ধ। পুলিস কাকেও বিনা অনুমতিতে বেরোতে দেবে না।

ধ্রুবর ঘরে কর্নেল এসে ব্রেকফাস্ট সেরেছেন। সোনালি কিন্তু রাতের সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা একেবারে ভুলে বসেছে যেন। যথারীতি হাসিখুশি দেখাচ্ছে। ওকে। ধ্রুব শুধু অসম্ভব গম্ভীর।

অনেকক্ষণ ধরে সে কর্নেলের সঙ্গে হত্যা রহস্যের আলোচনায় ব্যস্ত থেকেছে। সোনালিকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছে অনেক কিছু। সোনালির জবাব খুব ভাসা ভাসা। কর্নেলের ধারণা, সোনালি নিজের অবচেতনার মধ্যে খুনী সম্পর্কে কোন মারাত্মক তথ্য জানে–খুনী সেটা টের পেয়েছে বলেই তাকে হত্যা করতে চায়। তাই সোনালিকে অত প্রশ্ন করা। কিন্তু সোনালির জবাবের মধ্যে তেমন কোন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ধ্রুব বিরক্ত।

একসময় কর্নেল বললেন, যাই হোক, ধ্রুব–তুমি কক্ষনো সোনালিকে একা কোথাও যেতে দিও না! সোনালি, তুমি সাবধান হও। তোমার ওপর আবার একটা চেষ্টা করতে পারে খুনী। দিস ইজ সিরিয়াস।

সোনালি খিলখিল করে হেসে উঠল, ভ্যাট।

উঁহু–এত হালকাভাবে নিও না ব্যাপারটা। সম্ভবত খুনী ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ধ্রুব বলল, কর্নেল, আপনি বলছিলেন–বাস্কেটের মধ্যেই রহস্যের চাবিকাঠিটি রয়েছে। কিন্তু বাস্কেট দুটো তো পাওয়া গেছে।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ–পাওয়া যেতই। কিন্তু এভাবে পাওয়া যাবে, আমি মোটেও ভাবিনি। খুনী ভীষণ চতুর বোঝা যাচ্ছে। তবে ধ্রুব, এই তিন নম্বর সেটের বাস্কেট নিয়ে সে-রাতে তোমার সঙ্গে পাহাড়ে লড়াই হয়নি খুনীর–সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সেই বাস্কেটটা ছিল খুনীর নিজের স্কি-পোলের।

তার মানে?

সেদিনকার খুনের ঘটনাটা মনে মনে সাজিয়ে নাও। বেশি কল্পনার দরকার নেই। কারণ আমাদের হাতে প্রচুর ফ্যাক্টস রয়েছে। খুনী হুইল চেয়ারে ললিতাকে খুন করে। তার সেই হত্যার ইনস্ট্রমেন্ট অর্থাৎ একটা স্কি-পোলের বাস্কেটটা পাহাড়ের ওপর পড়ে যায়। ওই বাস্কেটে তার সেট নাম্বার খোদাই ছিল। তাই রাতে সে সেটা কুড়িয়ে আনতে যায় এবং তোমার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে সেটা হাতায়। এবার হুইল চেয়ারে ফেরা যাক আবার। একটা স্কি-পোলে ললিতাকে হত্যা করল সেতার হাতে তখন রইল আরেকটা স্কি-পোল। ওই একটা দিয়েই সে কি করে অনেক দূর চলে যায়। তারপর সবার অজান্তে ঘুরপথে ট্রেনিং ক্যাম্পের পিছনের জঙ্গলে আসে। লিফটম্যানের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। তাই না?

হ্যাঁ বলুন।

আগের প্ল্যান মতো সে স্টোরের পিছনের দেয়ালে কাটা কাঠের টুকরো সরিয়ে শ্রীবাস্তবের স্কি-পোল দুটো নেয়।

কেন?

মনে রেখো–তার দ্বিতীয় লক্ষ্য সঞ্জয়কে খুন করা। এবং যেভাবেই হোক, সে জানত–সঞ্জয় টেলি পেয়েই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে টোগাড়ির পথে। স্টোরের পিছনের সমতল জায়গার পর দুমাইল বিপজ্জনক পথ তাকে স্কি করে যেতে হবে এবং ফিরতে হবে। কাজেই দুটো স্কি-পোল তার দরকার। তার নিজের স্কি-পোল তো মার্ডার ইনস্ট্রমেন্ট–কোন মতে আলগাভাবে বাস্কেটে বসানো রয়েছে মাত্র। এখন তার একটা জরুরী কাজ হাতে রইল। তা হলো শ্রীবাস্তবের পোল থেকে বাস্কেট দুটো খুলে নিজের বাস্কেট দুটো পরানো। ব্যস, আর কোন ঝামেলা রইল না।

কিন্তু শের সিং স্কিসেট ফেরত জমা নিয়েছিল সেদিন–যতটা আমার মনে পড়ছে, প্রায় আড়াইটে নাগাদ। খুনের গণ্ডগোলের দরুন সবাই ব্যস্ত ছিল। একসঙ্গে নিশ্চয় কেউ ফেরত দ্যায়নি। শের সিংকে ডাকব?

ডাকো। ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া ভালো।

ধ্রুব বেরিয়ে গেল এবং তক্ষুনি শের সিংকে নিয়ে ঢুকল।..শের সিং আমাদের কাছেই আসছিল।

শের সিং সেলাম দিয়ে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন, বসো শের সিং। তোমাকে খুঁজছিলাম।

শের সিং বলল, দিদিজির জন্যে সব সময় আমি আশেপাশে আনাগোনা করছি, স্যার। আমার চোখ ফাঁকি দিতে আর কেউ পারবে না।

সেজন্যে নয় শের সিং। তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করব!

নিশ্চয়। বলুন।

খুনের দিন তুমি কটা নাগাদ স্কিয়ারদের বা ইনস্ট্রাক্টারদের স্কিসেট জমা নিয়েছিলে?

দেরি হয়েছিল, স্যার। তখন তো হইচই চলেছে। একে একে ডেকে জমা নিতে অনেক দেরি হয়েছিল। স্কিসেট নিতে তিনটে বেজে যায়।

শেষ জমা কে দিয়েছিল? কত নম্বর?

একজন নতুন স্কিয়ার–প্যাটেল। রণজিৎ প্যাটেল। সেট নাম্বার নয়।

প্রত্যেকটার সেট নাম্বার নিশ্চয় মিলিয়ে দেখেছিলে?

নিশ্চয়।

ইসু রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলে?

শের সিং একটু ইতস্তত করে বলল, না স্যার-রেজিস্টার খোলা দরকার মনে করিনি। ফেরত নেবার সময় কোন দিনই রেজিস্টার মিলিয়ে দেখিনি। ইসুটাই তো জরুরী–সই দিয়ে নিতে হয় স্কিয়ারদের। সিজন শেষ হলে তখন মিলিয়ে নিই। কারণ তখন সবাই সেন্টার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

শের সিং, এমনও তো হতে পারে, কেউ তার সেট ফেরত দিল না কোনদিন?

শের সিং একটু ভেবে বলল, তা অসম্ভব নয়। কিন্তু অত ঝামেলা করে কে আর স্কিসেট নিজের ঘরে বয়ে নিয়ে যাবে? সবাই তো স্কি শেষ হলে জমা দিয়ে যায়।

ধরো–এমনও হতে পারে, খুনের দিন কেউ সেট ফেরত দ্যায়নি?

আমি অবশ্য অত গুনে দেখিনি–শুধু নম্বর মিলিয়ে রাখা ছাড়া। কারণ, বুঝতেই পারছেন–অমন একটা খুন-খারাপি হয়ে গেছে তখন। কোনরকমে তাড়াহুড়ো করে জমা নিয়েছি মাত্র।

…একটু ভেবে কর্নেল আপন মনেই বললেন, খুনের দিন অবশ্য অনেককেই বগলে স্কি আর স্কি-পোল নিয়ে হোটেলে লনে সবখানে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি আমরা। তখন তো সবাই ভীষণ উত্তেজিত ছিল।

হ্যাঁ স্যার। আমিই তো সবাইকে তাড়া দিয়ে সেট জমা নিয়েছিলুম।

তাহলে সেই সময় কেউ তার স্কিসেট নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলেও আমরা অতটা লক্ষ্য করিনি। তাই না? ধ্রুব কী বলো?

ধ্রুব বলল, ঠিক বলেছেন। আমিও তো স্কিসুদ্ধ অফিসে গিয়ে ঢুকেছিলুম।

এবং কেউ জমা না দিলেও শের সিং টের পায়নি।

শের সিং চিন্তিত মুখে বলল, হ্যাঁ–তাও সম্ভব।

কর্নেল সোজা হয়ে বসলেন হঠাৎ… কিন্তু শের সিং, তার পরদিন কি কেউ তোমাকে স্কি সেট জমা দিতে গিয়েছিলেন? মানে গতকাল?

না, স্যার!

তুমি একবার দেখবে–রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে? সবার সেট জমা পড়েছে কি না।

এক্ষুনি দেখে আসছি। বলে শের সিং বেরিয়ে গেল।

.

ডাইনিং হলে সবাই লাঞ্চ খাচ্ছে, তখন শ্রীনগর থেকে বিশেষ তদন্তটিমটি এসে গেছে জানা গেল। বিশেষজ্ঞরা এসেছেন সরেজমিন তদন্তে। ললিতা ও সঞ্জয়ের অভিভাবকরা উচ্চবর্গীয় মানুষ। মন্ত্রিসভা অব্দি কাঁপিয়ে দেবার ক্ষমতা আছে তাঁদের। পুলিসের গোয়েন্দা ও ফোরেনসিক বিভাগ শশব্যস্তে দৌড়ে এসেছে। দুগালও এসেছে ওঁদের সঙ্গে।

বিকেলে কর্নেল ইউসুফ তেঙের কাছে একটা অদ্ভুত খবর জানতে পারলেন। ললিতার বদ্ধ দাঁতের ফাঁকে এক চিলতে চামড়া পাওয়া গেছে–সে চামড়া খুনীর গায়ের। তার মানে ললিতা খুনীর শরীরের কোথাও কামড়ে ধরেছিল নিজেকে বাঁচাতে। কিন্তু কোন অংশের চামড়া হতে পারে? সারা শরীর তো পুরু পোশাকে ঢাকা ছিল সকলের। বিশেষজ্ঞদের মতো চামড়াটা খুনীর কঁধ বা গলার। কারণ–শরীরের ওই অংশে মাত্র একটা স্কার্ফ জড়ানো ছিল। চামড়াটা মুখেরও হতে পারে–তবে এ বিষয়ে এঁদের মধ্যে মতভেদ আছে। তাছাড়া চামড়ায় যে রক্ত পাওয়া গেছে, তা ললিতার নয়। র বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। ওঁরা। ও রক্ত অন্য গ্রুপের।

তাহলে খুনীর গলায় বা ঘাড়ে ক্ষতচিহ্ন থাকবেই। এখানে কারো গলা বা ঘাড়ে সেই ক্ষতচিহ্ন আছে? পুলিস কি এবার প্রত্যেকের শরীর হাতড়াবে?

শ্রীবাস্তবের দুর্ভাগ্য। ধ্রুব দৌড়ে এল কর্নেলের কাছে। শের সিং সোনালিকে পাহারা দিচ্ছে। ধ্রুব চুপিচুপি বলল, কর্নেল, আমারই ধারণা সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। শ্রীবাস্তবের গলা আর চোয়ালের মধ্যে একটা টাটকা কাটা দাগ রয়েছে–প্লাস্টার করা ছিল। আশ্চর্য, আমরা তো সবাই দুদিন থেকে ওর প্লাস্টারটা দেখেছি। কিছু টের পাইনি।

বল কী! কর্নেল নিরাসক্তভাবে বললেন। 

হ্যাঁ–ওকে তো গোড়া থেকেই পুলিস সন্দেহ করে রেখেছিল। সব খোঁজখবর করার পর ডিটেকটিভ অফিসারদেরও সন্দেহ ওর ওপর গিয়ে পড়ে। তারপর ওর প্লাস্টারটাই ওকে খেল।

ওকে কি অ্যারেস্ট করল খুনের দায়ে?

বলেন কী! হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। এক্ষুনি নিয়ে যাবে।

 ক্ষতচিহ্নের জন্যে? আশ্চর্য তো!

আপনি কী বলছেন ঠিক বুঝতে পারছিনে কর্নেল। এতে আশ্চর্যের কী আছে?

 হুম! শ্রীবাস্তব কী কৈফিয়ত দিল ক্ষতচিহ্নের?

আবার সেই গোয়েন্দাগিরি! ভ্যাট! মামা, আপনি ওসব ছাড়ুন তো এবার। শ্রীবাস্তব খুন করে ধরা পড়েছে–চুকে গেল।

না সোনালি–প্লিজ। দিস ইজ ভেরি ইম্পরট্যান্ট।

শের সিং পট হাতে ঢুকল। সোনালি বলল, এত শিগগির পাওয়া গেল?

শের সিং বলল, নিচে যজ্ঞ হচ্ছে যে। সব সময় কফি তৈরি রাখতে হচ্ছে। অফিসাররা যাবার আগে গরম হয়ে বেরোতে চান কিনা।

ধ্রুব এল সেই সময়।

কর্নেল বললেন, ধ্রুব, বসো। দিস ইজ এ সিরিয়াস কনফারেন্স।

 ধ্রুব হাসলো…কনফারেন্স! কিসের?

হত্যা রহস্যের। কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন…শের সিং, মাই বয়, প্লিজ একবার পুলিস অফিসার মিঃ ইউসুফকে খবর দেখে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। খবর দিলেই আসবেন।

শের সিং বেরিয়ে গেল তক্ষুনি। সোনালি কফি ভাগ করে দিতে দিতে বলল, মামা, আপনি বড্ড গোলমেলে মানুষ। হত্যারহস্য দিব্যি সমাধান করল পুলিস– বাই দা বাই, ধ্রুব, শ্রীবাস্তব সায়েবের পায়ের জখম নিশ্চয় মিথ্যে তাহলে?

এখনও সেটা জানা যাচ্ছে না। ডাক্তারি পরীক্ষা হলে ধরা পড়বে।

 বারে! তাহলে ওকে ধরল যে?

গালের নিচে ক্ষতচিহ্নই তো বড়ো প্রমাণ। ললিতার দাঁতের কামড়ে যে চামড়া পাওয়া গেছে…

সোনালি হাত তুলে থামাল ওকে। ভুরু কুঁচকে বলল, ললিতা খুনীকে , কামড়ে দিয়েছিল, তার দাঁতে খুনীর চামড়া আছে–সবাই জেনেছে। কিন্তু ক্ষত চিহ্ন থাকলেই যে সে খুনী হবে… বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল সোনালি। তার মুখটা কেমন বদলে গেল। উত্তেজিত দেখাল তাকে। বিড়বিড় করে বলল, ললিতা কামড়েছিল…ক্ষতচিহ্ন..

কর্নেল ওর দিকে স্থিরদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন, হুম! সোনালি?

সোনালি লাফিয়ে উঠল।..মামা, মামা! আমি বুঝতে পেরেছি, কেন খুনী আমাকে গতরাতে খতম করতে চাইছিল।

ধ্রুব হাঁ করে রয়েছে।

কর্নেল বললেন, কেন?

আমি তার গলার একপাশে পিঠের দিকে একটা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলুম। শুধোলে সে আমাকে বলেছিল–স্কি করতে গিয়ে গাছের শুকনো ডালের খোঁচা লেগেছিল। মামা, আশ্চর্য, ভারি আশ্চর্য। কিন্তু…

কর্নেল বললেন, কে সে?

সোনালি স্তম্ভিত মুখে বলল, কিন্তু তা তো অসম্ভব–মানে, ও কেন সঞ্জয় বা ললিতাকে খুন করবে?

তার নাম বলো, সোনালি!

ধ্রুব বিরক্ত মুখে বলল, বড় জট পাকাতে ওস্তাদ। সোজা বলো না বাবা-শ্রীবাস্তব, না মিঃ প্রসাদ, না মিঃ ভেঙ্কটেশ, না মিস রিটা, না মিস প্রভাবতী? তোমাকে তো সবার সঙ্গেই দেখেছি আড্ডা দিতে।

সোনালি কড়ামুখে বলল, তুমি থামো!

কর্নেল সস্নেহে বললেন, সোনালি, তার নাম কী?

বলছি। বলে সোনালি হেঁট হয়ে কফির কাপ ওঁর হাতে এগিয়ে দিল।…

.

ওরা একটু পরেই নিচে নামল। রিস্তা ক্যাম্পের পুলিস অফিসার ইউসুফ তেঙ দৌড়ে গিয়ে গেটের কাছে ডিটেকটিভ অফিসারটির কানে কিছু বললেন। পুলিসের গাড়ির সবে স্টার্ট দিতে যাচ্ছিল, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। গাড়িটি প্রিজন ভ্যান নয়–স্টেশনওয়াগন। তার মধ্যে শ্রীবাস্তব বন্দী। দুজন সশস্ত্র সেপাই তার দুপাশে বসে রয়েছে।

ডিটেকটিভ অফিসার কর্নেলের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করলেন। একটু তফাতে লনের ওপর ভিড় করে ট্রেনিং সেন্টারের লোকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপচাপ। তাদের মধ্যে সোনালিও রয়েছে–রিটা মবলঙ্করের কাঁধে তার হাত। সোনালিই কেবল রিটাকে চাপা গলায় হেসে-হেসে কিছু বলছে। রিটাও হাসছে–তবে। নিঃশব্দে। খুনী চালান যাচ্ছিল, হঠাৎ কী কারণে অফিসাররা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং ফিসফিস করে কী পরামর্শ করছেন–সবাই তা দেখে বিস্মিত এবং কৌতূহলী।

ওরা আরও অবাক হলো। বন্দী শ্রীবাস্তবকে গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। কী ব্যাপার? গুলাব সিং ভিড়ের দিকে আসছিল। সোনালি তাকে জিজ্ঞেস করল, কী হলো মিঃ সিং? আপনাদের আসামীকে নামানো হলো যে গাড়ি থেকে? চালান দিচ্ছেন না?

গুলাব সিং অকারণ গলা চড়িয়ে ঘোষণা করলেন, এইমাত্র ওয়ারলেসে খবর এসেছে, রাস্তায় ধস নেমেছে–গাড়ি যাবে না।

স্কিয়াররা হইচই করে উঠল। সর্বনাশ, তাহলে সব ফিরে যাবে কেমন করে? আগামীকাল সকালে সবাই যে-যার জায়গায় ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে রয়েছে। অনেকে বোঁচকাকুঁচকি বেঁধে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আর এ অভিশপ্ত স্কি কেন্দ্রে একমুহূর্তও থাকার ইচ্ছে নেই কারও। হঠাৎ রাস্তায় ধস নামার দুঃসংবাদে সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।

ধস কোন জায়গায় নেমেছে–কত মাইলে এবং শিগগির রাস্তা মেরামত করার সম্ভাবনা আছে কি না এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে গুলাব সিং প্রায় কোণঠাসা হয়ে পড়ল। তাকে ঘিরে স্কিয়ারদের ভিড় হোটেলে গিয়ে ঢুকল।

এতক্ষণ কর্নেল, ইউসুফ তেঙ, ডিটেকটিভ অফিসার মিঃ রাঘবন, ফোরেনসিক বিশেঃ উঃ শর্মা, ধ্রুব চৌধুরী তার কি ট্রেনিং সেন্টারের কর্তা মিঃ দুগাল আরেকটা ভিড় করে বাইরে গেটের কাছে কথা বলছিলেন। সেপাইরা কাকেও সেদিকে এগোতে দিচ্ছিল না। এখন ওঁরা সবাই অফিসে গিয়ে ঢুকলেন।

শ্রীবাস্তবকে আবার অফিসঘরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিস। হঠাৎ দেখা গেল, সে ক্রাচে ভর করে করিডর পেরিয়ে ডাইনিং হলের দিকে চলেছে। স্কিয়াররা আরেকদফা অবাক হলো। তারা গুলাব সিংকে ঘিরে ইতিমধ্যে ডাইনিং হলে ঢুকেছে। কফি খাওয়া চলেছে চূড়ান্তভাবে। শ্রীবাস্তব ঢুকে বলল, হ্যাল্লো লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন!

সবাই মুখ তাকাতাকি করতে লাগল। হলে তখন অগাধ স্তব্ধতা। কেবল সোনালি জনান্তিকে মুখ টিপে হেসে একবার শের সিং-এর দিকে কটাক্ষ করল। শের সিং সব সময় তার কাছে-কাছে ঘুরছে কর্নেল আর ধ্রুবর নির্দেশে।

শ্রীবাস্তব বলল, আপনারা নিশ্চয় খুব অবাক হয়েছেন আমাকে ওঁরা হঠাৎ ছেড়ে দিলেন দেখে। তাই না? হ্যাঁ–এখন আমি আপনাদের মতনই একজন মুক্ত মানুষ।

কেউ টু শব্দটি করছে না। শ্রীবাস্তবের ঠোঁটের কোনায় অদ্ভুত একটু হাসি ফুটে উঠল। সে বক্তৃতার ঢঙে গম্ভীর এবং উদাত্ত গলায় ফের বলতে থাকল, মাননীয় ভদ্রমণ্ডলী এবং ট্রেনিং সেন্টারের সহকর্মী বন্ধুগণ! পাপ কখনও চাপা থাকে না। বাইবেলে বলা হয়েছে–পাপের বেতন মৃত্যু। আমি কোন পাপ করিনি বলেই ঈশ্বরের করুণায় এখন আমি মুক্ত মানুষ।

ভিড় থেকে লিফটম্যান বলে উঠল, মিঃ শ্রীবাস্তব, আপনিই কিন্তু আট নম্বর রুমের ইলেকট্রিক লাইন নিজের হাতে কেটে রেখেছিলেন। মেঝেয় ফুটো। করেছিলেন। নিচের ঘরে মিস টোড়মলের বিছানায় লক্ষ্য রাখবার জন্যে। আমি নিজের চোখে আপনাকে এসব করতে শুধু দেখিইনি–আমার মুখোমুখি ধরাও পড়েছিলেন। আপনার সৌভাগ্য যে পুলিসকে এখনও তা বলিনি! বলে সে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে হেসে উঠল।

শ্রীবাস্তব একটুও ঘাবড়াল না। বলল, খুব সত্যি। টেন্ডুলকার, তুমি একটুও মিথ্যে বলোনি। তোমার মুখ চাপা দেবার জন্যে তোমাকে আমি প্রচুর টাকা ঘুষও দিয়েছি–সেটা ভুলে যেও না।

লিফটম্যান টেন্ডুলকার বিকৃতমুখে বলল, আপনার টাকা আমি এখনই ফেরত দিতে প্রস্তুত আছি, স্যার। চান তো এক্ষুনি দিয়ে দেব।

শ্রীবাস্তব হঠাৎ গর্জে উঠল, টেন্ডুলকার! ললিতা টোডমল আমার বাগদত্তা স্ত্রী। ওই বাঁচাল শুয়োরের বাচ্চা সঞ্জয় ওয়াড়েকার তার পিছনে জোঁকের মত ঘুরত। আমি তাই আট নম্বরের মেঝের ফুটো দিয়ে রিভলবারের নল তৈরি রাখতে চেয়েছিলুম–যদি তাকে ললিতার বিছানায় দেখতে পাই, তাহলে গুলি করে মারব। কিন্তু সে-সুযোগ পেলুমই না।..

টেন্ডুলকার বলল, পরে তো পেয়েছিলেন। স্কি-পোল বিঁধিয়ে…

 শ্রীবাস্তব আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, শাট আপ মিথ্যেবাদী।

আমি নিজের চোখে দেখেছি।..টেন্ডুলকার হেসে উঠল।

 কী, কী? একটু এগিয়ে এল শ্রীবাস্তব তার দিকে।

টেন্ডুলকার দমল না। নির্বিকারভাবে বলল, হ্যাঁ–আমি আপনাকেই লাফ দিয়ে মিস টোডমলের পাশে বসতে দেখেছি হুইল চেয়ারে। তারপর একটামাত্র পোল নিয়ে আপনি বাঁধের নিচেকার জঙ্গলে স্কি করে স্টোরের দিকে যাচ্ছিলেন। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। তারপর দৌড়ে গিয়ে আপনাকে ধরে ফেললাম আপনি আবার আমাকে মোটা টাকা বকশিশের লোভ দেখালেন। তারপর…

হল খুব স্তব্ধ। দরজার ওপাশে কর্নেল, ধ্রুব, মিঃ দুগাল আর ডঃ শর্মা প্রমুখ। অফিসাররা এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কখন–এবার দেখতে পেল সবাই।

শ্রীবাস্তবের মুখটা আস্তে আস্তে লাল হয়ে গেল। কিন্তু সে প্রচণ্ড চেষ্টায় নিজেকে শক্ত রেখে বলল, সত্যি নাকি টেন্ডুলকার? তাহলে তো দেখছি, তুমি একজন জব্বার প্রত্যক্ষদর্শী। একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী তুমিই। কিন্তু কই, তুমি তো পুলিসকে এসব তথ্য জেরার সময় জানাওনি। বলেছ নাকি যে তুমি চিনতে পারোনি সেই এক পোলওয়ালা স্কিয়ারকে। কেন টেন্ডুলকার? মোটা টাকা পাবার প্রতীক্ষায় ছিলে বলে? বেশ চমৎকার। তাহলে এখনই বা বলছ কেন? টাকা আমি দিইনি তাই–কেমন?…শ্রীবাস্তব একটু হাসল। ঠোঁটের কোনায় বিদ্রূপ। …টেন্ডুলকার, পুলিস এখন আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। তুমি যতই আমার নামে মিথ্যে সাক্ষী দাও–জিজ্ঞেস করো ওঁদের, ওঁরা আমাকে আর গ্রেপ্তার করতে রাজি নন। কারণ, জানো না-হঠাৎ ওঁরা এমন মারাত্মক প্রমাণ পেয়েছেন, যাতে খুনীকে স্পষ্ট জানা গেছে।

টেন্ডুলকারের মুখ সাদা হয়ে গেল হঠাৎ। অস্ফুট স্বরে বলল, কে–কে খুনী?

যাকে তুমি বাঁধের নিচেকার জঙ্গলে সেদিন খুনের পরই দেখতে পেয়েছিলে?

সে তো আপনি!

 চুপ মিথ্যেবাদী!

বা রে! আপনাকে তাড়া করে ধরে ফেললুম–কারণ, আপনার একটা মাত্র স্কি পোল এবং সেটা বার বার বাস্কেট থেকে খুলে যাচ্ছিল। তাই জোরে এগোতে পারছিলেন না। তাছাড়া গাছের কাটা গুঁড়ি বরফের ঢিপির মতো ছড়িয়ে থাকার দরুন আপনার স্কি বাধা পাচ্ছিল–আছাড় খাবার উপক্রম হচ্ছিল আপনার। তারপর আপনার কাছাকাছি যেতেই আপনি বকশিশের লোভ দেখালেন!

শ্রীবাস্তব খেপে গিয়ে বলল মিথ্যা, মিথ্যা কথা!

টেন্ডুলকার দমল না।…মিথ্যে কথা! কেন? ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বললেন না? তারপর স্কি-পোলটা গায়ে ঠেক রেখে দুহাতের সবগুলো আঙুল দেখালেন। তখন আমি বললাম, কত? দশ মানে? আপনি দস্তানাপরা আঙুল অনেকটা ফাঁক করে পরিষ্কার দশটা আঙুল দেখালেন। আমি বললাম, দশ হাজার? আপনি তখন মাথা দোলালেন। আমি চলে যেতে দিলাম আপনাকে। ইচ্ছে করেই দেরি করলাম–যাতে আপনি পেছন ঘুরে নিরাপদে অফিসে পৌঁছতে পারেন।

শ্রীবাস্তব বলে উঠল, ওঃ হো! তাই তুমি আমাকে অফিসে ললিতার খুনের খবর দেবার পর ফিসফিস করে বলেছিলে–কখন পাচ্ছি স্যার? আমি ভাবলুম– তোমার ছুটির কথা বলে রেখেছিলে, তাই বললাম–হবে, হবে। পাবে। তুমি চলে গেলে। আসলে আমি দুগালজি ফিরে আসার পর ছুটি দেওয়া সম্ভব হতে পারে ভেবে ওকথা বলেছিলাম। আশ্চর্য তো!

ভিড় থেকে শের সিং প্রশ্ন করল, টেন্ডুলকার, মিঃ শ্রীবাস্তব তাহলে জঙ্গলে বকশিশের লোভ দেখানোর সময় তোমার সঙ্গে মুখে কথা বলেননি–ইশারায় বলেছিলেন? তাই না?

টেন্ডুলকার মাথা দোলালো। …হ্যাঁ–অত ঠাণ্ডায় তখন দাঁত কাঁপছে।

শের সিং বলল, তাহলে কেমন করে জানলে যে উনিই শ্রীবাস্তবজি?

টেন্ডুলকার রেগে গেল।…তোমার মতো বুন্ধু নাকি আমি? আগের রাতে আট নম্বরের ফুটো দিয়ে ললিতাজিকে দেখার সময় ওঁকে হাতে নাতে ধরেছি– ঘাঁর ফিরে পঞ্চাশ টাকা বকশিশ দিয়েছেন। আর পরের সকালে ললিতাজি খুন হলেন–আর আমি ওই অবস্থায় দেখতে পেলাম আগাগোড়া–আমি তো বুঝেই নিলাম, লোকটা কে। ওতে আবার কথা বলা লাগে নাকি?

শের সিং বলল, তুমি আট নম্বরে রাতের বেলায় তাহলে ওঁকে ফলো করেছিলে। কেন টেন্ডুলকার?

আট নম্বরের ইলেকট্রিক লাইনে ফিউজ বক্স খুলতে দেখেছিলাম। মেঝেয় ফুটো করতেও দেখেছিলাম। তখনই সন্দেহ হয়েছিল–কেন উনি এমন করছে?

শ্রীবাস্তব গুম হয়ে পড়েছিল। এবার বলল, স্কিয়াররা পোশাক পরে যখন বেরোয়, তখন তাদের তুমি চিনতে পারো তাহলে! তোমার কি ভেতরে দেখার আরেকটা চোখ আছে টেন্ডুলকার?

আলবাৎ। এ লাইনে এত বছর কেটে গেল! পোশাকে ঢাকলে কী হবে? ভঙ্গি দেখেই চিনতে পারি পোশাকের ভিতরে কে আছে। টেন্ডুলকার সগর্বে হাসল।

ললিতার পাশে হুইল চেয়ারে যে উঠে বসেছিল, তার ভঙ্গি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছিলে?

নিশ্চয়।

 সে আমি?

হুঁ-উ। পোল যখন বেঁধালেন, তখন আপনার চেয়ার সবে আমার ডানদিকে পাহাড়ের ওপর কাত হয়েছে। স্পষ্ট দেখলাম ব্যাপারটা। স্বয়ং আপনি বলেই মুখ বন্ধ করে থাকলাম।

কিন্তু টেন্ডুলকার, আমাদের নিয়ম আছে কোন ইনস্ট্রাকটারের পাশে শুধু ট্রেনি স্কিয়ারই চাপবে। ললিতা নিজে একজন ইনস্ট্রাকটার। সে তার পাশে আমার মতো একজন ইনস্ট্রাকটারকে চাপতে অ্যালাউ করবে কেন? লাইনে দাঁড়ানোর সময়ই তো আপত্তি করবে। বিশেষ করে সবাই জানে, তখন তার সঙ্গে আমার ভীষণ মন কষাকষি চলেছে। সে আমাকে পাশে নিতে ওই দুটো কারণেই চাইবে না। লাইন থেকে সরে দাঁড়াবে।

টেন্ডুলকার বলে উঠল, কী বলেন স্যার! অত বরফ পড়ার ধোঁয়া-বাতাস বইছে জোরে। কনকনে ঠাণ্ডা। তার মধ্যে কে কার দিকে লক্ষ্য রাখে?

লক্ষ্য রাখাটা জরুরী কিন্তু। ট্রেনি স্কিয়ারের জীবন-মরণ নির্ভর করে পাশের ইনস্ট্রাক্টারের ওপর। তার সাহায্য ছাড়া চলে না।

কী মুশকিল। পোশাকে আগাগোড়া ঢাকা সবাই, নাক পর্যন্ত স্কার্ফ জড়ানো, চোখে গগ–পুরুষ না মেয়ে তাই চেনা যায় না! তো মিস টোডমল কেমন করে জানবে, কে তার পাশ দাঁড়িয়ে আছে?

ঠিক বলেছ। ললিতা তো তোমার মতো ঝানু নয় যে ভঙ্গি দেখে চিনবে কে তার সহযাত্রী! ব্যঙ্গ হেসে উঠল শ্রীবাস্তব।…কিন্তু তুমি ঠিক চিনেছিলে! আচ্ছা প্রিয় লিফটম্যান সায়েব, যদি এখন সব স্কিয়ার-ইনস্ট্রক্টারদের পোশাক পরে লাইনে দাঁড় করানো হয়, তুমি চিনতে পারবে?

লিফটম্যান টেন্ডুলকার মাথা নেড়ে বলল, তার গ্যারান্টি দিতে পারি না। আমি যার-যার চলাফেরার ভঙ্গির সঙ্গে খুব পরিচিত, তাদের শনাক্ত করতে পারি। যেমন আপনাকে তো বেশি করেই পারি।

এতক্ষণে কর্নেল দরজা থেকে সরে এসে বললেন, মাই অনারেবল ফ্রেন্ড টেন্ডুলকার, আপনাকে গোটা কতক প্রশ্ন করতে চাই।

লিফটম্যান বিব্রতমুখে তাকালো ওঁর দিকে। এই কর্নেল ভদ্রলোকের প্রতি তার বরাবর কেমন অদ্ভুত ভীতি আছে। ভিড় থেকে অনেকেই বলে উঠল, করুন, করুন। রিটা মবলঙ্কর সোনালির কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়েছিল। হেসে সোনালিকে বলল, ভেরি ইনটারেস্টিং জেন্টলম্যান। তাই না মিস সেন? সোনালি জবাবে শুধু হাসল।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা মিঃ টেন্ডুলকার, ভঙ্গি দেখে চেনার কথা বলছিলেন। নিশ্চয় সেগুলো ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গি।

টেণ্ডুলকার মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ স্যার।

শ্রীবাস্তবজির কী কী বিশেষ ভঙ্গি বলতে পারেন–যা দেখে ওঁকে অন্যের থেকে স্পষ্টত আলাদা করা যায়?

টেন্ডুলকার যেন মুখস্থ বলে দিল।…উনি লাইনে দাঁড়ানোর সময় বাঁ হাতের স্কি-পোল বগলদাবা রাখেন, ডানটার হাতল বাড়িয়ে সামনে উঁচিয়ে রাখেন। তাছাড়া আরও অনেক আছে। স্কি করার সময় উনি কখনো স্পিড দেবার মুখে হাঁটু দুমড়ে বসেন না–একটু ঝুঁকে পড়েন মাত্র। এরকম কেউ করে না। তবে সব থেকে ওঁর বিশেষ ভঙ্গি হলো–লাইনে দাঁড়িয়ে বার বার ঘুরে চারদিকে মুখ উঁচু করে তাকানো।

তাহলে ঠিক এইসব ভঙ্গি সেদিন লাইনে এবং পরে জঙ্গলে সেই স্কিয়ারের মধ্যে লক্ষ্য করেছিলেন?

আলবাৎ।

আর কার-কার বিশেষ ভঙ্গির সঙ্গে আপনি পরিচিত?

দুগালজির। তারপর ইনস্ট্রাকটার মিঃ গুটা আর মিস প্রভাবতী নিরালার।

স্কিয়ারদের মধ্যে?

সামান্য দু-একজনের।

 যেমন?

 মিঃ প্রসাদ, মিস মবলঙ্কর, মিঃ ভেঙ্কটেশ।

এঁরা এবার নতুন স্কিয়ার?

প্রসাদজি আর ভেঙ্কটেশজি আগের বছরও এসেছিলেন–একেবারে আনাড়ি নন। মিস মবলঙ্কর এবার নতুন–আনাড়ি। প্রথমদিনই অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলেছিলেন প্রায়।

কর্নেল হাসলেন। ভিড়ের অনেকেই রিটা মবলঙ্করের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। রিটা অপ্রস্তুত মুখে বলল, আমি সার্কাসের মেয়ে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, স্কিতে একেবারে যাকে বলে–আই ওয়াজ বর্ন ইয়েস্টারডে!

টেন্ডুলকার রিটার দিকে তাকিয়ে বলল, উনি পোশাক পরলেই হোঁচট খান– আর স্কি-পোল ধরে থাকেন–ঠিক এইভাবে… বলে সে ভঙ্গি দেখিয়ে দিল।

আরও হাসি শোনা গেল চারপাশে। কেবল শ্রীবাস্তব গম্ভীর।

টেন্ডুলকার ফের বলল, আর যখন ঝাঁপ দেবেন–তখন দেখে মনে হয় স্রেফ পাখি হয়ে যাচ্ছেন। দুটো স্কি-পোল একেবারে দুপাশে ছড়িয়ে…

রিটা চটে মটে উঠল, দিস ইজ ক্যারিকেচার! ইট শুড নট বি অ্যালাউড। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল।

কর্নেল বললেন, আচ্ছা টেন্ডুলকার, কোন স্কিয়ার ইনস্ট্রাকটার যদি অবিকল শ্রীবাস্তবজির ভঙ্গিতে লাইনে দাঁড়ায়, চেয়ারে ওঠে, কিংবা স্কি করতে থাকে– তুমি তাহলে নিশ্চয় শ্রীবাস্তবজী বলে ভুল করবে?

টেন্ডুলকার ভেবে, একটু ইতস্তত করে বলল, ভুল হতে পারে স্যার। তা হওয়া স্বাভাবিক স্বীকার করছি।

ভালো করে ভেবে বলো।

 হ্যাঁ–ভুল হবেই। কিন্তু…

 কোন কিন্তু নয়–স্পষ্ট বলো, ভুল হবে কি না?

 হবে স্যার।

বেশ–সেদিন যদি অন্য কেউ ললিতাকে…।

টেন্ডুলকার উত্তেজিতভাবে বাধা দিয়ে বলল, অন্য কেউ নয় স্যার। কেন অন্য কেউ শ্রীবাস্তবজির ভঙ্গি নকল করবে?

নকল করবে কারণ সে খুনী এবং খুনের দায় শ্রীবাস্তবজির কাঁধে চাপাতে চায়।

কিন্তু আট নম্বর রুমে শ্রীবাস্তবজি..

এবার কর্নেল বাধা দিয়ে বললেন, টেন্ডুলকার, যে তোমার মুরগির ডিমগুলো চুরি করেছে, সেই যে তোমার মুরগিটাও পরে চুরি করল–তার কি মানে আছে?

স্যার। বড্ড ধাঁধায় পড়ে গেছি।

তুমি যাকে স্পষ্ট আলোয় হাতে-নাতে ডিম চুরি করতে ধরেছ, পরে অন্ধকারে যখন তোমার মুরগি চুরি যাচ্ছে–তখন সে যে সেই চোরটাই বটে, তোমার নিশ্চয় ধারণা হবে। তাই না?

হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয় তা হবে। সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু এই মুরগি চোর অন্য লোক হতেও পারে। ভেবে দ্যাখো।

তা পারে স্যার।

তুমি মূলত একজন সৎ লোক টেণ্ডুলকার–কিন্তু তোমার টাকার লোভ প্রচণ্ড

আমি খুব গরিব মানুষ স্যার। পহেলগাঁওয়ে আমার একদল পুয্যি আছে।

বুঝতে পারছি। কিন্তু টেন্ডুলকার, ফ্যামিলিম্যান বলেই তুমি একজন অত্যন্ত দায়িত্বশীল নাগরিক দেশের। প্রকৃত খুনীকে ধরিয়ে দেওয়া তোমার কর্তব্য।

কিন্তু শ্রীবাস্তবজি যদি খুনী না হন, কে সেই খুনী? আমি আর কেমন করে জানব স্যার?… লিফটম্যান বিপন্নমুখে তাকালো।

 জানো। একমাত্র তুমিই প্রত্যক্ষদর্শী। এবং তুমিই চেষ্টা করলে খুনীকে কখনও বের করতে পারবে। অবশ্য আমরা ইতিমধ্যে কিছুটা জেনেও ফেলেছি। শুধু…

টেন্ডুলকার আহত স্বরে বলল, আপনারা যদি জানেন, কে আসল খুন তাহলে আমার ওপর জুলুম করছেন কেন?

জুলুম নয়। তোমার সহযোগিতা চাইছি ভাই। খুনী কে আমরা জানি– কিন্তু তাকে আইনত ন্যায্য শাস্তি পাইয়ে দিতে হলে ভারতীয় বিচার পদ্ধতি অনুসারে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য চাই। ফোরেনসিক পরীক্ষায় যা সামান্য একটু তথ্য পাওয়া যেতে পারে, তা অনেকসময় পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের জোর থাকলেও প্রমাণ করা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তাছাড়া এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সাক্ষী যখন একজন পাওয়ার সম্ভাবনা–তখন সে চেষ্টা আমরা ছাড়তে চাইনে টেন্ডুলকার।

টেন্ডুলকার বিপন্নমুখে একটু চুপ করে থেকে বল, কিন্তু আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছিনে।

তুমি অভিজ্ঞ মানুষ। ব্যক্তিবিশেষের বিশেষ বিশেষ ভঙ্গি লক্ষ্য করার প্রবণতা তোমার আছে। তাই বলছি, তুমি ভালো করে স্মরণ করো তো টেন্ডুলকার। খুনী অবশ্যই শ্রীবাস্তবজির ভঙ্গি নকল করেছিল। কিন্তু তাহলেও তোমার দৃষ্টি এড়ানো কঠিন মনে করি। লিফটে চড়ার আগে থেকে জঙ্গলে মুখোমুখি হওয়া অব্দি সেই স্কিয়ারের আর কী বিশেষ ভঙ্গি লক্ষ্য করেছিলে– স্মরণ করো। দেখবে, ঠিক মনে পড়ে যাবে। চিনতেও পারবে।

টেন্ডুলকার তাকাল কর্নেলের দিকে।  

হ্যাঁ –জাস্ট থিংক।

টেন্ডুলকার মুখ নামিয়ে মেঝে দেখতে দেখতে ফের মুখ তুলে তাকাল।

 ইয়েস, ইয়েস মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। থিংক।

টেণ্ডুলকার দুটো মুঠো পাকিয়ে নিচে তাকাল। ফের মুখ তুলল।

 ইয়েস, টেণ্ডুলকার!

হঠাৎ টেন্ডুলকার লাফিয়ে উঠল। উত্তেজিত হয়ে বলল, স্যার! লাইনে দাঁড়ানোর সময় একবার কি দুবার স্কিয়ার ডান পায়ের স্কি ঘষেছিল মাটিতে!

নেক্সট?

জঙ্গলে স্কি করে যাবার সময়… হঠাৎ থামল সে।

হ্যাঁ বলো।

জঙ্গলে স্কি করে যাবার সময় মাথাটা সামনে পিছনে দোলাচ্ছিল।

এ ভঙ্গি কার টেন্ডুলকার? তুমি আগে কনভিনণ্ড হও নিজে। এক্ষুনি বলো না।

টেন্ডুলকার চারপাশের মুখগুলো দেখে নিয়ে বলল, সবার সামনে বলব স্যার?

না, না। তুমি আমার কানে কানে বলো। কর্নেল প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন।

টেন্ডুলকার কর্নেলের কানের কাছে মুখ আনল।…

.

রাত বারোটা। লিফটম্যান টেন্ডুলকার তার নিজের ঘরে শুয়ে রয়েছে। তার দরজায় নক করল কে। টেন্ডুলকার ঘুমোয়নি। সে উত্তেজিতভাবে দরজা খুলে দিল। অমনি মুখে কালো রুমাল ঢাকা একটি মূর্তি তার গলায় ফাঁস পরিয়ে হ্যাঁচকা টানে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলল। টেন্ডুলকার জানত এমন একটা কিছু ঘটতে পারে–কিন্তু কিভাবে ঘটবে আঁচ করেনি। তাই সে বেমক্কা ধরাশায়ী। হয়ে গোঁ-গোঁ করতে থাকল। তার বুকে হাঁটু চেপে মূর্তিটা বসেছে।

অমনি টর্চের আলো পড়ল খাটের তলা থেকে। দরজা ঠেলে কারা সব ঢুকে গেল হুড়মুড় করে। আওয়াজ শোনা গেল–হ্যান্ডস আপ!

মুর্তিটি ঝটপট টেন্ডুলকারকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কর্নেল এগিয়ে তার মুখের রুমাল সরিয়ে দিলেন একটানে। গম্ভীর গলায় মিঃ রাঘবন বললেন, রিটা মবলঙ্কর! মিস ললিতা টোডমল এবং মিঃ সঞ্জয় ওয়াডেকারকে খুন করা এবং মিস সোনালি সেন আর এই টেন্ডুলকারকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে আপনাকে আমরা গ্রেফতার করলাম। মিঃ গুলাব সিং! এদিকে আসুন।…

.

সেই রাতদুপুরে ডাইনিং হলে আবার ভিড় জমে গেছে। কর্নেল আগাগোড়া খুনের মডুস অপারেন্ডি ইত্যাদি খুঁটিয়ে বর্ণনা করছিলেন। রিটার গোড়া থেকেই প্ল্যান ছিল শ্রীবাস্তবের ওপর খুনের দায় চাপানোর। শ্রীবাস্তবের সঙ্গে সঞ্জয়-ললিতার রেষারেষি লক্ষ্য করেছিল। তাছাড়া সম্ভবত শ্রীবাস্তব যে আট নম্বর ঘরে ইলেকট্রিক সংযোগ ছিন্ন করে মেঝেয় ফুটো তৈরি করে ললিতার ঘরে লক্ষ্য রাখতে চেয়েছিল, তাও রিটা যে কোন উপায়ে জেনে থাকবে। এর ফলেই রির্টা আরও উৎসাহী হয়ে পড়ে।

দুগাল সায়েব প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মোটিভ কী? রিটা মবলঙ্কর কেন ওদের খুন করল?

কর্নেল বললেন, প্রণয়ের প্রতিহিংসা। সঞ্জয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। রিটা সার্কাসের মেয়ে। সে একজন দক্ষ স্কিয়ার। সুইজারল্যান্ডে স্কি করার প্রচুর, অভিজ্ঞতা তার আছে। রিটার ব্যাকগ্রাউন্ড আমি কিছুটা জানতাম। কিন্তু সঞ্জয়ের সঙ্গে তার প্রণয়ের কথা জানতাম না। জানা গেল রিটার ঘরের কাগজপত্র হাতড়ে। আমি গতকাল একফাঁকে ওর ঘরে হানা দিয়েছিলাম। রিটাকে তখন সোনালি আমারই প্ল্যানমাফিক নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নিজের ঘরে আড্ডা দিতে ডেকেছিল। রিটা আরেকবার চান্স নিতেই গেল–সোনালি তার ক্ষতচিহ্ন দেখেছে, তাকে না সরালে অস্বস্তিতে ভুগছিল রিটা। কিন্তু সফল হলো না– শের সিং-এর উপস্থিতির জন্যে। এদিকে তখন রিটার ঘরে আমি সার্চ করে সঞ্জয়ের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক আবিষ্কার করে ফেলেছি। তারপর পাতলাম এই ফাঁদ। চান্স ছিল নিতান্ত পঞ্চাশ পারসেন্ট। ভাবিনি যে সত্যি রিটা এভাবে হাতে-নাতে ধরা দেবে। কিন্তু ও তো আজ সন্ধ্যার পর মরিয়া। সবার সামনে রাগের ছলে বেরিয়ে গেলেও আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিল। আমি হলের বাঁ দিকের জানলার কাছে স্পষ্ট তার ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। টেন্ডুলকার যে ওকে অবশেষে চিনতে পেরেছে, এটা অনুমান করার মতো ধুরন্ধর বুদ্ধি ওর ছিল। অবশ্য ওর ঘাড়ের ক্ষতচিহ্ন সোনালি দেখে ফেলেছে, তাতে উৎকণ্ঠা ছিল প্রচণ্ড। কিন্তু শ্রীবাস্তবের দাড়ি কাটতে গিয়ে ব্লেডে চেরা গাল রিটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আপাতত। শুধু একটা ব্যাপার তেমন আমল দেয়নি রিটা। স্টোরে সে তার স্কিসেট জমা না দিয়ে ঘরেই রেখেছিল-কারণ নিজের বাস্কেট পরিয়ে নিয়ে শ্রীবাস্তবের বাস্কেট পাচার করা দরকার। শের সিং খাতা দেখে এসে আমাকে জানায়। একটা সেট জমা পড়েনি। এখন সেটা রিটার ঘরে পাওয়া। গেল। যাই হোক, এবারকার স্কি তেমন জমল না–আমাদের দুর্ভাগ্য। দুগালজিরও দুর্ভাগ্য।…

এক সময় সোনালি আর ধ্রুব বেরিয়ে নিজেদের ঘরে এল। ন নম্বরে। তারপর সোনালি বলল ভ্যাট, আমার সব বরবাদ হলো। এই, দুগালজিকে বলো না–আমরা যারা এখানে থেকে কি করতে চাই, করব। সত্যি, যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া যাব কেমন করে? রাস্তায় ধস নেমেছে? না?

ধ্রুব বলল, ওটা গুলাব সিং-এর বানানো। কিন্তু এই অভিশপ্ত জায়গায় আর থাকতে পারব ভাবছ? তোমার আমার কেসও তো তাই। বলা যায় না– তোমার যদি কোন পূর্বপ্রেমিক থাকে, তাহলে নির্ঘাত স্কিয়ার সেজে এসে আমাকে খুন করে বসবে।

সোনালি বলল, না মশাই–তোমারই কোন প্রণয়িনী থাকলে এখনও বলো। সাবধান হয়ে যাবো।

ধ্রুব দরজা লক করে দুহাতে সোনালিকে জড়িয়ে ধরে বলল, এখানে থাকতুম–কিন্তু থাকব না। কালই শ্রীনগর ফিরে সেখান থেকে দিল্লী–তারপর সটান ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের আপিসে। অন্তত খুন হলেও সান্ত্বনা থাকবে সোনালি আমার ধর্মপত্নী তো ছিল।

সোনালি বলল, এই! তাহলে আমরা একটু অ্যাডভান্স ট্রায়াল হিসেবে আজ একই শয্যায় শুয়ে দেখতে পারি।

ধ্রুব ওকে নিজের বিছানায় ঠেলে দিয়ে বলল, ভ্যাট! আসলে বলো যে একা শুতে ভয় করছে।