কালো নেকড়ে – ৫

০৫.

 মির্জাসাহেব বারান্দায় বসে পাইপ টানছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, এরই মধ্যে বেড়ানো হয়ে গেল? আমি ভেবেছিলুম, জয়ন্তবাবুকে ফেলে কর্নেল সাহেব কোনো পাখির পেছনে উধাও হয়ে যাবেন। মার্চে সেহরাগড়ের সবখানে পাখির মেলা।

কর্নেল বললেন, পীরের সমাধিতে গিয়েছিলুম।

 অর্কিডটা নিয়ে এলেন বুঝি?

 নাহ, তবে যে জিনিস এনেছি, তা আরও দামী। বলছি। আগে—

 কফি! বলে মির্জাসাহেব হেসে উঠলেন। তারপর হাঁক দিলেন, রহমত!

জি হুজুর!

কফি লাও। জলদি!

রহমত চলে গেল মির্জাসাহেব চাপা স্বরে বললেন, রহিমবাবাকে ডাক্তার জগদীশ রায় একটা ব্যক্তিগত রিপোর্ট দিয়েছেন। ওটা আমার দেখার জন্য। ব্যক্তিগত রিপোর্ট বলার কারণ ওটা বেসরকারি। পুলিশকে দিলে অকারণ ঝামেলা বাড়বে। আপনি পড়ে দেখুন।

দেখলুম, ওটা একটা সাধারণ কাগজে টাইপ করা চিঠি। কর্নেল চোখ : বুলিয়ে বললেন, কাদের বখশের রক্তে টক্সিক সাবস্ট্যান্স পাওয়া গেছে। এটা এমন সাংঘাতিক জিনিস যে, রক্তে মিশলে দ্রুত শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। হাইঞ্জেক্ট করার কোনো চিহ্ন ছিল না বডিতে। তাই ডাঃ রায়ের ধারণা, হিংস্র জন্তুটার দাঁতের কামড়ের ফলে ভিকটিমের রক্তে টক্সিক এলিমেন্ট ঢুকে গিয়েছিল। তা হলে দেখছি, আমি যা ভেবেছি, তা-ই ঠিক।

মির্জাসাহেব জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি কী ভেবেছেন?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, বলছি। কফি খেয়ে নিই। ইতিমধ্যে আপনি ডাক্তার রায়কে টেলিফোনে জানিয়ে রাখুন, আমরা ওঁর কাছে যাচ্ছি। আপনি আমার পরিচয় দেবেন।

মির্জাসাহেব তখনই উঠে গেলেন। একটু পরে রহমত কফি নিয়ে এল। কর্নেল তাকে বললেন, রহমত! উয়ো বুজুর্গ আউলিয়াকা সাথ হামারা মুলাকাত হুয়া। উনহি এক শাবল লেকে পীরবাবাকা জাগাহ পর এক গাঢ়াহ করনে লাগা। হামলোগোকো দেখুকার উনহি ভাগ গেয়া। কুছ নেহি মালুম আতা। কাহে উনহি ভাগ গেয়া।

 রহমত হাঁ করে শুনছিল। বলল, তাজ্জব!

রহমত! উনহিকো সমঝানে পড়েগা, উয়ো কাম বহত খতরনাক্‌ হ্যায়। আর ওহি জগাহ ভি আভি বহত খতরনাক হ্যায়। উহা যানা-আনা ঠিক নেহি।

জি হাঁ। হাম উনকো হোশিয়ারি দেগা। ইয়ে ঠিক কাম নেহি।

মির্জাসাহেবকে দেখে রহমত সরে গেল। এক হাতে রাইফেল নিয়ে উনি এসে বললেন, ডাক্তার রায় একটার মধ্যে যেতে বললেন। একটায় উনি লাঞ্চ খেতে বাড়ি যান।

কফি শেষ করে আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি এবং মির্জাসাহেব গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করতে গেছেন, শাকিল মিয়াঁ বারান্দার পশ্চিমপ্রান্তে থেকে হন্তদন্ত এসে বললেন, কর্নিলসাবকা টেলিফোন আয়া কালকাত্তাসে। মেরা অফিসমে চলিয়ে।

কর্নেল তার সঙ্গে চলে গেলেন। মির্জাসাহেব অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা পোর্টিকোর সামনে এনে জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল সাহেব কোথায় গেলেন?

বললুম, শাকিল মিয়াঁ ডেকে নিয়ে গেলেন ওঁকে। কলকাতা থেকে টেলিফোন এসেছে।

মির্জাসাহেব বললেন, তাহলে আমার ঘরের নাম্বারে না পেয়ে অফিসের নাম্বারে দিয়েছে। তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। আসুন মিঃ চৌধুরি।

গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলুম, আপনার অফিস মানে কি আপনার কোনো বিজনেস কনসার্ন আছে?

 আছে। তবে সামান্য। স্থাবর সম্পত্তি কোনাবেচায় আমি মিডলম্যান–সোজা কথায় দালালি করি। বাইরে অফিস করিনি। মির্জাসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, বাইরে অফিস করতে গেলে এই বাড়ির নবাবি ট্রাডিশন আর ইজ্জত নাকি নষ্ট হবে। আমার মায়ের হুকুম এটা। আমি মেনে চলেছি। যাদের দরকার, তারা ফোনে যোগাযোগ করে এবং বাড়িতে আসে।

ওর খুড়তুতো ভাই সালিম সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা বলতে গিয়ে বললুম না। বরং কর্নেল বলবেন। আমার মুখ বুজে থাকা উচিত।

কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এসে গাড়ির সামনের সিটে বসলেন। মির্জাসাহেব গাড়ি ফের স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জরুরি ফোন নাকি?

মিঃ হালদার নামে আমার এক বন্ধুর ফোন। আমাকে শিগগির কলকাতা ফিরতে বলছেন। ওঁর একটা নার্শারি আছে। কয়েকটা ক্যাক্টাসের অর্ডার দিয়েছিলুম। সেগুলো এসে গেছে।

মির্জাসাহেব বললেন, ক্যাক্টাসের চেয়ে আমার ব্যাপারটা জরুরি কর্নেল সাহেব! প্লিজ

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, না। আমি শিগগির চলে যাচ্ছি না। ওঁকে বললুম, ক্যাক্টিগুলো আমার নামে মেমো কেটে জমা রাখুন।

রাস্তায় পৌঁছে মির্জাসাহেব বললেন, ব্যাপারটা শুধু তথাকথিত কালো নেকড়ে হলে ওই জানোয়ারটাকে আমি নিজেই মেরে ফেলার দায়িত্ব নিতুম।

কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি ভাববেন না। কাজটা শেষ না করে আমি ফিরছি না।

আমরা এবার উত্তরে বসতি এলাকার দিকে যাচ্ছিলুম। দুধারে টিলাপাহাড় আর জঙ্গল। একটা ছোট্ট বস্তিও চোখে পড়ল। চড়াই-উৎরাই রাস্তার পর চওড়া হাইওয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। হাইওয়ে পেরিয়ে নদীর ব্রিজ। কিছুদূর চলার পর সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি চোখে পড়ল। বাঁকি নিতে নিতে অবশেষে একটা হাসপাতালের গেটে গাড়ি ঢুকল। হাসপাতালটা আপাতদৃষ্টে পরিচ্ছন্ন এবং নতুন মনে হলো।

এখনও রোগীর ভিড় আছে। পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে মির্জাসাহেব বললেন, একটু কষ্ট করে দোতলায় উঠতে হবে।

মির্জাসাহেবকে দেখে দোতলার করিডরে অনেকেই ঝুঁকে সেলাম দিচ্ছিল। শেষপ্রান্তে একটা ঘরের পর্দা তুলে মির্জাসাহেব একজন সিস্টারকে বললেন, ডাক্তার রায়কে বলুন মির্জাসাহেব এসেছেন।

শিগগির ভেতরে যাওয়ার ডাক এল। একটা বড় ঘর এবং ল্যাবের সরঞ্জামে ভরা। টেবিলের সামনে একজন প্রৌঢ় শীর্ণকায় ডাক্তার বসে ছিলেন। হাত বাড়িয়ে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করে বসতে বললেন।

কর্নেল তার নেমকার্ড দিলেন। ডাক্তার রায় একটু হেসে ইংরেজিতে বললেন, আপনি প্রকৃতিবিদ। অতএব ছোটনবাবসাহেবের সঙ্গে আপনার সৌহার্দ্য স্বাভাবিক। এবার বলুন কী করতে পারি।

কর্নেল কিটব্যাগ থেকে সেই টেস্টটিউবটা বের করে বললেন, আমি প্রকৃতিবিদ। তবে মাঝে মাঝে রহস্যজনক ঘটনা কোথাও ঘটলে নাক না গলিয়ে থাকতে পারি না। পীরের সমাধির জায়গায় যেখানে কাদের বখশকে কোনো জন্তু আক্রমণ করেছিল, আজ সেখানে একটা গর্তের মধ্যে আমি এই জিনিসটা পেয়েছি। আমার প্রচণ্ড কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে ডাঃ রায়! এই জিনিসটা আপনি ল্যাবে পরীক্ষা করে আমাকে যদি জানান, খুব বাধিত হব। হা–এ কথাটা আগেই আপনাকে বলা উচিত। সেই গর্তে পচা মাংসের সঙ্গে অজস্র পোকা ছিল। এটা পচা মাংসের একটু অংশ। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়েছে, এর মধ্যে কোনো সাংঘাতিক টক্সিক জিনিস আছে।

টেস্টটিউবটা নিয়ে একটা উজ্জ্বল আলো জ্বেলে দেখার পর ডাক্তার রায় বললেন, আগে কোন মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে আমি ছোটনবাবসায়েরকে যে। ব্যক্তিগত রিপোর্ট দিয়েছি, তা সম্ভবত সত্য প্রমাণিত হবে। কর্নেল সরকার! আজ রাত দশটার মধ্যে আমি ফোনে আপনাকে জানাব। আমার বাড়িতে নিজস্ব একটা ল্যাব আছে। সেখানে কাজ করাটাই ভালো। বিশেষ করে কালো নেকড়ে নিয়ে সারা এলাকায় যা গুজব রটেছে, তাতে এখানে বসে কাজ করাটা ঠিক হবে না। এখানে নানা ধরনের লোক আনাগোনা করে।

ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ। বলে কর্নেল উঠলেন।

ডাঃ রায় বললেন, অসময়। তবু অনুরোধ করছি চা ঠাণ্ডা পানীয় একটা কিছু খেয়ে যান। বিশেষ করে ছোটনবাবসাহেব নিজে এসেছেন।

মির্জাসাহেব বললেন, ধন্যবাদ ডাঃ রায়। এইমাত্র আমরা কফি খেয়ে বেরিয়েছি। আচ্ছা, চলি।

কর্নেল বললেন, এটা কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়। আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন।

অবশ্যই।….

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মির্জাসাহেব বললেন, আমি কিন্তু অবাক হইনি কর্নেল সরকার! সকালে আপনি যখন গর্তটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন, তখনই ধরে নিয়েছিলুম আপনি কোনো ক্লু পেয়ে গেছেন।

কর্নেল বললেন, আপনার বাড়িতে বিশেষ করে বাইরে বারান্দায় বসে সব কথা আলোচনা করা সঙ্গত ছিল না। কথায় বলে, দেয়ালের কান আছে। বলবেন, আপনার কর্মচারীরা খুব বিশ্বস্ত। তবু এখন আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

হ্যাঁ। আপনি ঠিক বলেছেন। মির্জাসাহেব হাসলেন। দুই নবাব-ফ্যামিলির কর্তাদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও কর্মচারীদের মধ্যে তো কোনো বিবাদ নেই।

কর্নেলও হাসলেন। তখন বড় নবাববাড়ির গেটের কাছে আপনার খুড়তুতো ভাই সালিমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনিও ঠিক একই কথা বলছিলেন।

মির্জাসাহেব যেন একটু চমকে উঠলেন। বলেন কী! সালিমের সঙ্গে কীভাবে আলাপ হলো?

কর্নেল পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন।

শোনার পর মির্জাসাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এনেছি একথা কীভাবে ওর কানে গেল? এটা তো ভারি অদ্ভুত! তাছাড়া আপনাকে ডিটেকটিভ বলে সালিম অপমান করেছে।

চেপে যান। এবার শুনুন কীভাবে পীরের সমাধির কাছে পচা মাংস আবিষ্কার করলুম।…..

কর্নেলের কথা শেষ হলে মির্জাসাহেব উত্তেজিতভাবে বললেন, ওই পাগলাটা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল।

কর্নেল বললেন, আপাতত আমি পাগল লোকটা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। ওকে খুঁজে বের করে আটকে রাখা দরকার।

মির্জাসাহেব রুষ্ট মুখে বললেন, অবশ্যই দরকার। ওকে জেরা করলে অনেককিছু ফঁস হতে পারে। আমি রহিমকে গিয়ে বলছি। এ কাজটা রহিম পারবে। ওর ক্লাবের বন্ধুদের সাহায্য নেবে বরং।

এ কাজটা রহমত পারবে না? রহমত কোনো ছলে ওকে ভুলিয়ে, যদি মির্জাসাহেব কর্নেলের কথায় বাধা দিয়ে বললেন, রহমত বড্ড ভীতু। ওর চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায় না। তাছাড়া পাগলাটাকে ও বুজুর্গ ফকির বলে বিশ্বাস করে। রহত বলছিল না? ও তাকে পাথর খেতে দেখেছে!

কথায়-কথায় আমরা নদীর ব্রিজ এবং হাইওয়ে পেরিয়ে এলুম। একসময় হঠাৎ কর্নেল বললেন, কাল রাত্রে আপনি খুদা বশকে কুমারসাবের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। কে তিনি?

মির্জাসাহেব বললেন, এস কুমার নামে এক ভদ্রলোক এই এলাকায় বাগানবাড়ি করার জন্য খুঁজছেন। পাটনার লোক। এক সময় পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন। এখন আর রাজনীতি করেন না। কুমারসাব নরেশ সিংয়ের বন্ধু। দুদিন হলো এখানে এসেছেন। নরেশের বাড়িতেই আছেন। আপনি তো জানেন, আজকাল আমি রিয়েল এস্টেটের কারবার করি। ভদ্রভাবে এই কাজটা করা যায় বলেই করি।

গাড়ি গেটে ঢোকার সময় কর্নেল আবার ওঁকে মনে করিয়ে দিলেন, ওই পাগলকে খুঁজে বের করা জরুরি।

কিছুক্ষণ পরে গেস্টরুমে গিয়ে কর্নেল বললেন, তুমি স্নান করে নাও। আজ আমার স্নানের দিন নয়।

কর্নেল শীতকালে সপ্তাহে একদিন এবং বাকি সময় সপ্তাহে দু থেকে তিন দিন পর স্নান করেন। এটা নাকি ওঁর সামরিক জীবনের অভ্যাস। ব্যতিক্রম। ঘটলেই ঠাণ্ডা লেগে যায়।

বাথরুমে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করলুম, হালদারমশাইয়ের খবর কী? ফোনে কী বললেন?

কর্নেল আস্তে বললেন, আজ রাতের ট্রেনে উনি আসছেন।

সেই মহিলার ব্যাপারটা বললেন না?

তার সঙ্গেই আসছেন। বলে কর্নেল তাড়া দিলেন। দুটোয় নবাবি লাঞ্চ। দেরি কোরো না।….

মির্জাসাহেবের প্রিয় রহিমবাবার সঙ্গে আলাপ হলো দোতলায় ডাইনিং রুমে। বয়স একুশ-বাইশের বেশি নয়। সুশ্রী চেহারা। তেমনি স্মার্ট। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটি চঞ্চল প্রকৃতির এবং খেয়ালি। সে ইংরেজিতে কথা বলছিল। গত রাতে তার মোটরবাইক বিগড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী নাকি সেই পাগল। অত রাতে লোকটা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায় মাঝখানে। মোটরবাইকে চেপে তাকে তাড়া করতে গিয়ে বাহনটা গর্তে পড়ে বিগড়ে গিয়েছিল। রহিম বলছিল, লোকটা সত্যি পাথরের টুকরো চোষে। যখনই তাকে দেখতে পায়, রহিম খান তার সঙ্গে দুষ্টুমি না করে ছাড়ে না। তবে আঙ্কল মির্জাসাহেব যখন তাকে ধরে আনার হুকুম দিয়েছেন, সে তাকে ধরে আনবে! এজন্য সে ল্যাসো বা দড়ির ফাঁস তৈরি করে নেবে। কারও সাহায্য তার দরকার হবে না। তবে আঙ্কলের ঘোড়াটা তার চাই। পাহাড়ি বনবাদাড়ে মোটরবাইক অচল। ঘোড়াটা এসব জায়গায় ছুটোছুটি করতে পটু।

মিজাসাহেব বললেন, রহিমবাবা! তুমি আমার ঘোড়াকে মোটরবাইকের মতো বিগড়ে দেবে না তো?

কক্ষণো না। আঙ্কল! আপনি আমাকে কতদিন ধরে ঘোড়ায় চড়ায় ট্রেনিং দিয়েছেন। এবার আমার পরীক্ষা হয়ে যাক।

মির্জাসাহেব কিন্তু কিন্তু করে শেষে বললেন, ঠিক আছে। তবে তুমি সূর্যাস্তের আগে কিন্তু অক্ষত শরীরে আমার ঘোড়া ফেরত দেবে।

ও কে আঙ্কল! বলে রহিম খান আহারে মন দিল।

খাওয়ার পর গেস্টরুমে ফিরে কর্নেলকে বললুম, যদি পাগল লোকটা আমরা চলে আসার পর আবার সেই গর্তটা খোড়ে, তাহলে সে বিপদের মুখে পড়বে। পচা মাংসের গন্ধ পেয়ে জন্তুটা ছুটে এসে ওকে আক্রমণ করবে। কাজটা ঠিক হয়নি কর্নেল!

কর্নেল একটা ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরাচ্ছিলেন। বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। সে আর ওখানে যাবে না। কেন জানো? এটা সহজ অঙ্ক। সে একটা গর্ত খুঁড়ছিল এবং আমরা তা দেখে ফেলেছি। যদি সে ওখানে আবার আসে, গর্তটা আগের মতো বুজিয়ে ফেলা হয়েছে দেখে সে ধরে নেবে, গর্তে যা পোঁতা ছিল তা আমরা হাতিয়ে নিয়েছি।

একটু ভেবে নিয়ে বললুম, আচ্ছা কর্নেল! জন্তুটাকে মেরে ফেলার জন্য টোপ হিসেবে তো ওই পচা মাংসটা ব্যবহার করা যায়! ধরুন, গর্তটা আবার খুঁড়ে পচা মাংস বের করে রাখলেন। তারপর আড়াল ওত পেতে বসে থাকলেন। মির্জাসাহেবের রাইফেল আছে। আপনার আর আমার রিভলভার আছে।

কর্নেল হাসলেন। তুমি কি ভেবেছ আমার বাহাত্ত্বরে ধরেছে? জয়ন্ত! ওটা টোপ হিসেবে ব্যবহার করব ভেবেই গর্তটা বুজিয়ে রেখে এসেছি।

তাহলে দেরি করা কি ঠিক হচ্ছে?

কর্নেল চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন, আজ তোমার ভাতঘুম আসছে না কেন?

বিরক্তি চেপে বললুম, আসছে। কিন্তু

কিন্তু উত্তেজনা বাধা দিচ্ছে! বলে কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। উত্তেজিত না হয়ে রবং ঘণ্টা দেড় ঘুমিয়ে নিতে পারো। মির্জাসাহেবের সঙ্গে ততক্ষণ একটু শলাপরামর্শ করতে হবে। আমরা যে পথে পীরের সমাধিতে গিয়েছিলুম, ওই পথে যাওয়া ঠিক হবে না। অন্য কোনো গোপন পথে যেতে হবে।

কেন?

কর্নেল আবার চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর আধপোড়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, শিকারী যখন শিকারে যায়, তখন গোপন পথে নিজেকে আড়ালে রেখেই টোপের জায়গায় যায়। যাই হোক, তুমি স্বচ্ছন্দে ঘুমিয়ে নিতে পারো।

 কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। চোখ বুজে শুধু পাগলটার কথা ভাবছিলুম। কর্নেল বললেন বটে সে আর ওখানে যাবে না বা আবার গর্তটা খোঁড়ার চেষ্টা করবে না, কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত হবে পারছিলুম না। আরও একটা কথা বারবার মনে ভেসে উঠছিল। দুটো গর্তে পচা মাংস রাখা হয়েছিল কেন? একটা গর্তের পচা মাংসের গন্ধে ছুটে আসার পর জন্তুটা কাদের বখশকে সামনে পেয়েছিল। অর্থাৎ ব্যাপারটা একটা নিশ্চিত চক্রান্ত এবং কারও উদ্দেশ্য ছিল কাদের বখশকে জন্তুটার সাহায্যে হত্যা করা হয়। তার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় গর্তে আবার একই টোপ রাখার কারণ কী? এবার কার পালা? কর্নেলের এই কথাটা মাথার ভেতর মাছির মতো ভনভন করছিল। কর্নেল তাঁর থিয়োরি বদলালেও আমি বদলাতে পারছিলুম না।

কতক্ষণ পরে কর্নেল এসে ডাকলেন, জয়ন্ত! উঠে পড়া। এখন চারটে বাজে। সাড়ে চারটেতে আমরা বেরুব। তার আগে অবশ্য বারান্দায় বসে কফি খেয়ে নেব। তুমি তৈরি হয়েই বেরোও।

বারান্দায় গিয়ে দেখি, মির্জাসাহেব শিকারির বেশে তৈরি হয়ে আছেন। পাশে রাইফেলটা দাঁড় করানো আছে। কফি এসে গেল। আমরা কফি খাচ্ছি, সেই সময় মসজিদের ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চেপে রহিম খান ফিরে এল। সে ঘাড়া থেকে নেমে হাসতে হাসতে বলল পাগলাটা নদী পেরিয়ে পালিয়ে গেল। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত আর এত পাথর। আমি অবাক! তার হাতে একটি শাবল ছিল। সেটাও সে ফেলেনি।

মির্জাসাহেব বললেন, ঠিক আছে। কাল আবার চেষ্টা করবে। তিনি হাঁক দিলেন ডিব্বু! ডিব্ব!

সেই কিশোর সহিস দৌড়ে এসে ঘোড়াটাকে টহল খাওয়াতে নিয়ে গেল। রহিম বলল, আঙ্কল! আমি ক্লাবে যাচ্ছি। পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। ভাববেন না। আমার এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। পূর্বদিকে কালামহলের ধ্বংসাবশেষের পাশে একটা খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখি, নিচে খরস্রোতা নদী। রহমত দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল।

ঝোপঝাড় আর পাথরের আড়াল দিয়ে সাবধানে হেঁটে পীরের সমাধিস্থলে পৌঁছুলুম। তারপর চোখ গেল সেই গর্তটার দিকে আবার কেউ গর্ত খুঁড়েছে। কর্নেল হন্তদন্ত গিয়ে গর্ত দেখে বললেন, টোপ নেই। কেউ তুলে নিয়ে গেছে জন্তুটা যে খায়নি, তা স্পষ্ট। গুঁড়ো মাটিতে জুতোর ছাপ দেখতে পাচ্ছি।

মির্জাসাহেব আবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য তো!..

.