কালো নেকড়ে – ২

০২.

 ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইয়ের জন্য কফি এনেছিল। কর্নেল যথারীতি আওড়ালেন, কফি খান হালদারমশাই। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফুঁ দিয়ে বেশি দুধ মেশানো গরম কফির পেয়ালায় বারকতক চুমুক দেবার পর একটু হেসে বললেন, আইজ নার্ভ চাঙ্গা হবে না।

কর্নেল হাসলেন, কেন বলুন তো?

আপনার কথায় নার্ভ ব্যাবাক তালগোল পাকাইয়া গেল। হালদারমশাই ভুরু নাচিয়ে চাপা স্বরে ফের বললেন, সেই মহিলা কি আপনার লগেও যোগাযোগ করছিল?

নাহ্।

তাহলে হঠাৎ আপনি ব্ল্যাক উলফের পিছনে দৌড়াইতে চান ক্যান?

কর্নেল হাসলেন। সেহরাগড়ে যাওয়ার প্ল্যান আমি আগেই করেছিলুম। ওই এলাকায় একটি রিজার্ভ ফরেস্ট আছে। তাছাড়া ওখানে আমার একজন বন্ধুও আছেন। তিনি সেহরাগড়ে নবাবদের বংশদর। তার কাছেই একটা মানুষখেকো কালো নেকড়ের খবর আমি পেয়েছি।

হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন, তা হলে হেভি মিট্রি!

অবশ্যই। বিশেষ করে আপনার মুখে যা শুনলুম, তাতে আমার নার্ভও তালগোল পাকিয়ে গেছে। বলে কর্নেল অ্যাশট্রে থেকে আধপোড়া চুরুটটি তুলে নিলেন। লাইটার জ্বেলে চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে ফের বললেন, সেহেরাগড় যাওয়ার দিনক্ষণ এখনও ঠিক করিনি। ইতিমধ্যে আপনি আজ একটা। কাজ সেরে ফেলুন। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করা যাবে।

হালদারমশাই কফি শেষ করে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, কেন কর্নেলস্যার!

কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, আপনি তো ছদ্মবেশে ধরতে ওস্তাদ। ইচ্ছেমতো ছদ্মবেশ ধরে সেই বাড়িটার কাছে গিয়ে ওত পেতে থাকুন। আমি লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে বলে রাখব। তাদের লোকও মেতায়েন থাকবে। সেই বেঁটে লোকটাকে দেখতে পেলেই জাপটে ধরে চোর-চোর বলে চ্যাঁচামেচি শুরু করবেন। কী? পারবেন তো?

আলবাত্ পারব। এ তো সামান্য কাজ। কন! কখন যাব?

 বিকেল চারটেতে আপনি পৌঁছুবেন।

হালদারমশাইয়ের গোঁফ তিরতির করে কাঁপতে থাকল। জিজ্ঞেস করলুম, কী ছদ্মবেশে ধরবেন হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর ফিক করে হেসে বললেন, কসমোপোলিটন এরিয়া। তবে মুসলিমরাই বেশি। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরব। মাথায় টুপি পরব। চোখে সানগ্লাস। আর–হঃ! দাড়ি তো লাগাবই।

কর্নেল বললেন, বাহ্।

অমনি হালদারমশাই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্তবাবু! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। মাঝে মাঝে কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট করতে আসি বটে, তবে আমারে ফুলিশ ভাববেন না। পুলিশ রিটায়ার করলে নাকি ফুলিশ হয়। আমার এক কলিগ কইত। কথাটা কত ভূল, তা প্ৰভ করার জন্যই তো প্রাইভেট ডিকেটটিভ এজেন্সি খুলছি। কর্নেলস্যার! শুধু একটা অনুরোধ।

কর্নেল বললেন, বলুন।

লালবাজারের ঘুঘুগুলি আমারে লইয়া মস্করা করে। প্লিজ, তাদের যেন আগেই জানাইয়া দিবেন না আমি কে। পরে, জানলে ক্ষতি নাই।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আপনার এই প্রব্লেমটা আছে অবশ্য। তবে চিন্তা করবেন না। আমি আশেপাশে থাকব।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ চিন্তিতভাবে বললেন, কিন্তু গলিটার নাম তো লক্ষ্য করি নাই। বাড়িটা পুরানো। গেট আছে। কী যেন নামটা…

কর্নেল বললেন, আমার এলাকা থেকে দূরে নয়। আমি বাড়িটা চিনি। ওটার নাম খুশবুমহল। ওই গলির নাম দিলজান লেন।

হালদারমশাই আবার ফিক করে হেসে বললেন, আপনি গিছলেন কখনও? কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, বছর পাঁচেক আগে ওই বাড়িতে একজন বাইজি খুন হয়েছিল। বাড়ির মালিকই তাকে খুন করেছিল। সে এখন জেলে। বাড়িটা বেহাত হয়ে গেছে। যাই হোক, প্লিজ টেক ইট সিরিয়াসলি!

অব কোর্স! বলে কে কে হালদার সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

বললুম, হালদারমশাই এখন থেকেই ড্রেসরিহার্সাল শুরু করবেন বাজি রেখে বলতে পারি।

কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। তেমনি তুম্বো মুখে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে ব্যস্ত হলেন।

প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম চলি! আজ আমার ইভনিং ডিউটি।

কর্নেল চাপা স্বরে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন শুধু। আমি বেরিয়ে এলুম।…

সেদিন সন্ধ্যায় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে বসে পুলিশসূত্রে পাওয়া গয়নার দোকানে ডাকাতির একটা খবর লিখছি। নিউজ ডিপার্টমেন্টের ব্যুরোচিফ সত্যদা ডাকলেন, জয়ন্ত! তোমার ফোন!

বিরক্ত হয়ে বললুম, আমার টেবিলে দিতে বলুন অপারেটরকে।

সত্যদা সহাস্যে বললেন, তোমার বসের ফোন। আশা করি কিছু একটা বেধেছে।

কে বস?

সত্যদা, অমনি রেগে গিয়ে হালদারমশাইয়ের মতো পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় বলে উঠলেন বুড়ারে কইয়া দিতাছি, জয়ন্ত ফোন ধরবে না। আর কনসিকোয়েন্টলি কী হইব জানো? তোমার একটা ইনক্রিমেন্ট স্টপ কইরা দিমু! ক্যান? না– সত্যসেক পত্রিকা একটা ইমপরট্যান্ট স্টোরি মিস করবে।

বেগতিক দেখে দ্রুত উঠে গিয়ে ওঁর টেবিলে টেলিফোন ধরলুম। আসলে আজ বিকেলে সেই বাইজিমহলের ব্যাপারটা তখন মাথায় ছিল না। আজ গয়নার দোকানে ডাকাতির ঘটনা সাংঘাতিক।

সাড়া দিতেই কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। তখন এমন করে আমার ঘর থেকে তোমার চলে যাওয়া উচিত হয়নি জয়ন্ত! ষষ্ঠী তোমার জন্য রান্না করেছিল। যাই হোক, শোনো। সত্যবাবুকে আভাস দিয়েছি। তুমি এখনই চলে এস। ছাড়ছি।…

সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় সব রাস্তায় জ্যাম। অলিগলি ঘুরে ইলিয়ট রোডে কর্নেলের বাড়ির লনে যখন গাড়ি ঢোকালুম, তখন সওয়া সাতটা বেজে গেছে।

তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় কলিং বেলের সুইচ টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে দিল। সে চাপাস্বরে বলল, বাবামশাই নিচে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন। এদিকে এক কাণ্ড! হালদার মশাইকে দেখলেই বুঝতে পারবেন! রক্তারক্তি কাণ্ড!

ষষ্ঠীচরণ হাসি সামলাতে না পেরে অন্য দরজা দিয়ে তার ঘরে ঢুকল। কর্নেলের ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, হালদারমশাইয়ের কানের নিচে ব্যান্ডেজ। পরনে চেককাটা লুঙ্গি আর নোংরা ফর্দাফাই রক্তমাখা পাঞ্জাবি। মাথায় অবশ্য টুপি নেই। মুখেও নকল দাড়ি নেই।

আমাকে দেখে তিনি একটিপ নস্যি নিলেন। কর্নেল বললেন, বসো জয়ন্ত! আগে কফি খাও।

বললুম, কফির আগেই ঘটনাটা শুনতে চাই বস্! হালদারমশাইয়ের কানের নিচে ব্যান্ডেজ। মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড কিছু ঘটেছিল।

হালদারমশাই বললেন, নাহ্। তেমন কিছু না। আমি ভাবি নাই হালা আমারে ক্ষুর মারবে। জাপটাইয়া ধরা মাত্র–ওঃ! হালারে পুলিশ লইয়া গেল। আমি পেটাবার সুযোগ পাইলাম না।

কর্নেল বললেন, হালদারমশাই খুব বেঁচে গেছেন। ওঁর গলার দিকে ক্ষুর চালাতে চেয়েছিল বজ্জাতটা। হা–আমিও এতটা ভাবিনি। ভাবা উচিত ছিল। আমার বুদ্ধির ভুলেই ওঁর প্রাণ যেতে বসেছিল।

যষ্ঠী কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে ঘটনাটা কর্নেলের মুখে শুনলুম।

খুশবুমহলের ভেতর থেকে বেঁটে ষণ্ডামার্কা লোকটা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হালদারমশাই তাকে জাপটে ধরে চোর-চোর বলে চিৎকার করছিলেন। হঠাৎ লোকটা ক্ষুর বের করে তাঁর গলায় চালানোর চেষ্টা করে। হালদারমশাইয়ের পুলিশজীবনের এধরনের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি খপ করে তার হাত চেপে ধরেন। তারপর সাদা পোশাকের চারজন পুলিশ লোকটাকে পাকড়াও করে। লোকটার নাম সেকেন্দার আলি। তবে সে বিট্টু পাহলোয়ান নামে পরিচিত। কর্নেল ঘটনাস্থলে ছিলেন। হালদারমশাইয়ের কানের নিচে ইঞ্চিটাক ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল। তাকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে এক ডিসপেনসারিতে নিয়ে গিয়ে কর্নেল ফার্স্ট এডের ব্যবস্থা করেন এবং সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরেন।

লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট সন্ধ্যা ছটা নাগাদ কর্নেলকে টেলিফোনে লোকটার পরিচয় জানায়। ঘুঘু লোক। পুলিশ রেকর্ডে সে একজন মার্কামারা অপরাধী। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সে বহুবার আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছে। এ সব লোকের মুখ থেকে গোপন কথা বের করা সহজ নয়। শুধু এটুকু জানা গেছে, নাসিমা নামে একজন মধ্যবয়সী শিক্ষিতা বারবনিতা তাকে মেট্রো সিনেমার সামনে হালদারমশাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিল। বিট্টু পাহলোয়ান বলেছে, তার কোনো কসুর নেই। হালদারমশাইকে নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে বলে সে নাসিমার ঘরে গিয়েছিল। কিন্তু নাসিমাকে দেখতে পায়নি। তাই তার খোঁজে ব্যস্ত ছিল সে। কোনা ঘরেই নাসিমাকে পাওয়া যায়নি। ঘরে তালা আঁটা ছিল। সন্ধ্যার পর বারবনিতাদের জিম্মাদারনী মুন্নিবাই ঘরের তালা ভাঙার হুকুম দেয়। তারপর দেখা যায়, নাসিমা কখন তার জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়েছে। বাড়িটার মালিক সুরেশ সিং প্রভাবশালী লোক। তার কাছে খবর যায়। কিন্তু সে ব্যাপারটা গ্রাহ্য করেনি। তার কথা, খাঁচার চিড়িয়া উড়ে গেল আরেক চিড়িয়া এসে ঢুকবে।

এখন পুলিশ সুরেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। নাসিমা সম্পর্কে পুরনো তথ্য জানা থাকলে একমাত্র সে-ই দিতে পারে। বিট্টু পাহলোয়ান অবশ্য বলেছে, নাসিমা এখানে এসে জুটেছিল মাস দেড়েক আগে। তাকে ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হতো। তাই বাড়ির সবাই তাকে সমীহ করে চলত। তা ছাড়া নাসিমা ছিল মেজাজী মেয়ে। তার ঘরে একজন বাঁধা খদ্দের ছিল। লোকটা পয়সাওয়ালা। বিট্টু এবং আরও অনেককে সে প্রচুর বখশিস দিত। তাকে ওরা। চাঁদ মিয়া নামে জানত। চাঁদ মিয়া আসত মারুতি গাড়ি নিয়ে। মাঝে মাঝে জিম্মাদারনীকে বখশিস দিয়ে নাসিমাকে সে বাইরে নিয়ে যেত।

কিন্তু নাসিমা জিনিসপত্র নিয়ে সদর গেট দিয়ে পালায়নি। তাহলে বাড়ির লোকদের চোখে পড়ত। পেছনে একটা দরজা আছে। দরজার বাইরে হাত তিনেক চওড়া একটা গলি। নাসিমা ওই পথেই পালিয়েছে। বিট্টু পাহলোয়ানের দৃঢ় বিশ্বাস, নাসিমা চাঁদ মিয়ার সঙ্গেই পালিয়ে গেছে।…

কর্নেলের মুখে সব কথা শোনার পর বললুম, বড় গোলমেলে ব্যাপার। তো হালদারমশাইয়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ল কী করে?

প্রাইভেট ডিটেকটিভ গোমড়ামুখে বললেন, জানি না। লক্ষ্য করি নাই। হয়তো ওই হালাই ছিঁড়ছে।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, আশা করি হালদারমশাইয়ের রাগ এতক্ষণে পড়ে গেছে। বিট্টু পাহলোয়ানকে আপাতত ক্ষমা করে দিন। পরে সুযোগ পেলে ওকে নিজের হাতে শায়েস্তা করবেন।

হালদারমশাই বললেন, আই প্রমিজ!

ঠিক আছে। এবার পোশাক বদলে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। আপনাকে আমার একপ্রস্থ পোশাক দিচ্ছি।

না কর্নেল স্যার! শুধু একখানা পাঞ্জাবি থাকলে দিন। ওই যথেষ্ট।

কর্নেল উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি এনে। দিলেন। তারপর বললেন, বাথরুমে গিয়ে এটা পরে নিন। ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা আপনাকে যত্ন করে রাখতে হবে। ওটা আদালতে একজিবিট হবে। বিট্টু পাহলোয়ানের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস দিয়েছে। ভুলে যাবেন না। আপনাকে খুনের চেষ্টা নিয়ে মামালাটা খুব গুরুত্বপূর্ণই হবে। ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা কাগজে মুড়ে নিয়ে যান। পুলিশ আপনার কাছ থেকে কাল ওটা নিয়ে আসবে।

হালদারমশাই বাথরুম থেকে পাঞ্জাবি বদলে এসে কর্নেলের কথামতো ছেঁড়া রক্তাক্ত পাঞ্জাবিটা কাগজে মুড়ে বগলদাবা করলেন। বললেন, তা হলে যাই গিয়া।

কর্নেল বললেন, ডিটেকটিভ সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ভদ্র সকাল নটা নাগাদ আপনার বাড়িতে যাবেন। আর একটা কথা। আপনি ওঁকে যেন বলে ফেলবেন না যে আমরা সেহরাগড় যাচ্ছি। শুধু আপনি যা জানেন, সেই অংশটা ডিটেলস বলবেন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বলবেন, আচ্ছা কর্নেলস্যার! ওই মহিলা যদি আবার আমার অফিসে ফোন করে?

তাকে নির্ভয়ে আপনার অফিসে যেতে বললেন। যদি সে যায়, সব কথা শুনে নোট করবেন। তারপর তাকে কোনো ছলে বসিয়ে রেখে আমাকে রিং করবেন।

তার জন্য আমার ব্রাতে আইজ যা ঘটছে, তারে বলব না?

কক্ষনো না। শুধু বলবেন, লোকটা আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আর আসেনি। ব্যস!

হালদারমশাই বেরিয়ে গেলেন।

আমি বললুম, রহস্য এত শিগগির জটিল হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি।

কর্নেল টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, যত জটিল হোক, এর চাবি আছে নাসিমা নামে একটি মধ্যবয়সী মেয়ের কাছে। তার পরিচয় পেলে আমার পা ফেলতে সুবিধে হবে। কারণ মির্জাসাহেব আমাকে শুধু আভাস দিয়েছেন, তাকে কেন্দ্র করে কিছু রহস্যময় ব্যাপার ঘটছে। কিন্তু সেগুলো যে কী, তা তিনি খুলে বলেননি। ওঁর বাড়ি গেলে নাকি আমি নিজেই টের পায়। এদিকে এই নাসিমা সেহরাগড় জঙ্গলের কালো নেকড়ের রহস্যটা ফাস করতে চায়। কিন্তু তার পক্ষে সেটা সম্ভব নয় বলেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য দরকার। অথচ সে অমন করে হঠাৎ পালিয়ে গেল খুশবুমহল থেকে। এটাই ভারি অদ্ভুত!

বার বার ডায়াল করে কিছুক্ষণ পরে সাড়া পেলেন কর্নেল। বললেন, আমি কর্নেল সরকার বলছি!…না, না! ডিসি ডিডি সায়েবকে নয়! আপনি এস. আই নরেশবাবুকে দিন।….নরেশবাবু! শুনুন। আপনি তো কাল সকালে মিঃ হালদারের বাড়ি যাবেন। যাবার পথে আমার এখানে হয়ে যেতে অসুবিধে হবে?… ঠিক, আছে। একটা জরুরি কথা বলতে চাই আপনাকে।…বলেন কী! বিট্টু পাহলোয়ান। তা-ই বলেছে? …ও কে। রাখছি। মর্নিংয়ে কফি খেতে খেতে কথা হবে। ছাড়ছি।

টেলিফোন রেখে কর্নেল একটু হেসে বললেন, বিট্টু পাহলোয়ান বলেছে, তার বাড়ি ছিল বিহারের সেহরাগড়ে। তার বাবা হোসেন আলি ছিল বড় নবাব সাহেবের সহিস। বিচিত্র যোগাযোগ!

অবাক হয়ে বললুম, নাসিমার বাড়িও যে সেহরাগড়, তা নিশ্চিত। তাই না?

কর্নেল চোখ বুজলেন, হুঁ।

অথচ বিট্টু ব্যাটাচ্ছেলে তাকে চেনে না এ কি বিশ্বাসযোগ্য?

 তুমি ঠিক বলেছ জয়ন্ত।

বিট্টু তার চেনাজানা বলেই হালদারমশাইকে সে ডাকতে পাঠিয়েছিল। নিজে। কোনো কারণ যেতে পারেনি।

ঠিক, ঠিক।

কর্নেল চোখ বুজে সায় দিচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন এবং শার্টের বুকপকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে দেখে নিয়ে আবার টেলিফোন ডায়াল করতে থাকলেন।

একটু করে টেলিফোন রেখে দিয়ে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। এই নিয়ে তিনবার চেষ্টা করলুম। নাম্বারটা পুলিশ ঠিক দিয়েছে তো?

জিজ্ঞেস করলুম, কার নাম্বার?

খুশবুমহলের মালিক সুরেশ সিংহের। বলে কর্নেল টেলিফোন গাইডের দিকে হাত বাড়ালেন।

বললুম, সুরেশ সিংহের বাড়ির ঠিকানা পেয়েছেন কি?

হ্যাঁ।

কিন্তু টেলিফোন গাইডের খুদে হরফ পড়তে পারবেন না। আমাকে দিন।

কর্নেল হাসলেন। এ বয়সে আমার সত্যি অত দৃষ্টিশক্তি নেই। তবে তুমি আমার শক্তিমান আতস কাঁচটির কথা ভুলে গেছ।

আতস কাচের সাহায্যে সুরেশ সিংহকে টেলেফোন গাইডের পাতা থেকে খুঁজে বের করতে দেরি হলো না কর্নেলের। বললেন, হ্যাঁ। ফোন নাম্বার আর ক্যামাক স্ট্রিটের ঠিকানা ঠিক আছে। তবে আর ফোনে নয়। বরং কাল দিনের বেলায় সুরেশ সিংহের বাড়ি যাব। রাতবিরেতে এ সব লোকের মেজাজ ঠিক থাকে না।

বলে কর্নেল হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! আবার কফি খাব। আর তোর দাদাবাবুর জন্য কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে আয়।….

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছি, সেই সময় কর্নেলের টেলিফোন এল। জয়ন্ত! এইমাত্র সেহরাগড় থেকে মির্জাসাহেবের ট্রাঙ্ককল পেলুম। ওঁর ওলড সারভ্যান্ট কাদের বখশের লাশ পাওয়া গেছে। ক্ষতবিক্ষত লাশ। সরকারি ডাক্তারের মতে, আপাতদৃষ্টে কোনো হিংস্র জন্তুর আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে লোকটার। যাই হোক, আমরা আজই দুটো পঁয়ত্রিশের ট্রেনে ভায়া আসানসোল সেহরাগড় যাচ্ছি। ট্যাক্সি করে চলে এস। একটা কথা। তোমার লাইসেন্স ফায়ার আর্মস সঙ্গে রেখো।

উত্তেজিতভাবে বললুম, হালদারমশাই যাচ্ছেন তো?

ওঁর যাওয়ার ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখছি।

হঠাৎ মত বদলালেন কেন?

সেই মেয়েটি যদি আবার ওঁর অফিসে যোগাযোগ করে? এ কারণে আমার মনে হচ্ছে ওঁর কলকাতায় থাকা দরকার। প্রয়োজন হলে বরং উনি পরে যাবেন। ছাড়ছি।

এক মিনিট! কাদের বখশের লাশ কোথায় পাওয়া গেছে?

 নবাববদের পারিবারিক কবরখানায়।

টেলিফোন রেখে ব্রেকফাস্টে মন দিলুম। কিন্তু খাওয়া জমল না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল একটা ভয়ঙ্কর হিংস্র কালো রঙের নেকড়ে আর তার লকলকে রক্তাক্ত জিভ।….

.