সমুদ্রে মৃত্যুর ঘ্রাণ – ১

০১.

 পূর্বাচল হোটেলের ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে সমুদ্র দেখছিলাম। অক্টোবর মাসের বিকেল। দুপুরে কিছুক্ষণ ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়েছিল। এখন উজ্জ্বল সোনালি রোদ। যদিও পূর্বের সমুদ্র দিগন্ত ঘন ধূসর মেঘে ঢাকা। আমার ডানদিকে বালিয়াড়ির ওপর ঝাউবন। বালিয়াড়ি আর ঝাউবনের ভেতর বড়-বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে। সেই সব পাথরে প্রেমিক-প্রেমিকারা বসে আছে। এখানে সি-বিচ সংকীর্ণ এবং কিছুটা ঢালু। পূর্বাচলের নীচে পিচের রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কম। কারণ এই এলাকায় খুব খরুচে হোটেল আর ধনবানদের বাড়ি। এখানকার নাম নিউ চন্দনপুর। পিচের রাস্তাটা আমার বাঁদিকে সোজা উত্তরে এগিয়ে সমুদ্রের ব্যাকওয়াটারের ওপর ব্রিজে মিশেছে। ব্রিজের ওধারে ওল্ড চন্দনপুর। সবমিলিয়ে ‘চন্দনপুর-অন-সি’ নামেই পরিচিত।

বাঁদিকে তাকিয়ে দেখলুম আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটা পাথরে বসে বাইনোকুলারে সমুদ্র দর্শন করছেন। উত্তরের ব্যাকওয়াটার পর্যন্ত এই অংশটা ত্রিভুজের মতো। পিচ রাস্তার ডাইনে ঘাসে ঢাকা মাটি। তারপর মাটিটা উঁচু হয়েছে এবং সেই উঁচু অংশে বুনো কুলের ঝোপঝাড়, কেয়াবন, শীর্ষে ঘন কাশবন। এদিকটাতেও নানা ধরনের কালো পাথর পড়ে আছে। পাথর সমুদ্রেও ছড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখে মনে হয়, পালে পালে হাতি সমুদ্রস্নানে নেমেছে। জোরালো হাওয়ার জন্য সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ এসে ফেনায় ফেনায় ঢেকে ফেলছে পাথরগুলো এবং তারপর আছড়ে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিচে। আর সে কী ভয়াল গর্জন। মনে হচ্ছিল, সমুদ্র থেকে যেন মৃত্যুর গন্ধ ভেসে আসছে।

ত্রিভুজাকৃতি জমিটার শেষপ্রান্তে ব্যাকওয়াটারের মাথায় কোন যুগের পাথরের একটা দুর্গ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। সেখানেও প্রেমিক-প্রেমিকার মূর্তি চোখে পড়ল। বিকেলের সোনালি রোদ ক্ৰমে রক্তিম হচ্ছিল। মনে হল সর্বত্র যেন অপরূপ প্রাকৃতিক ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে।

একটু পরে দেখলুম, কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঢালু বালিয়াড়ি দিয়ে নেমে পিচ রাস্তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে ডাইনে ঘাসজমির দিকে ঘুরলেন এবং হঠাৎ গুঁড়ি মেরে ফুলের ঝোপ-ঝাড়ের কাছে গিয়ে ক্যামেরা তাক করলেন। নিশ্চয় কোনো বিরল প্রজাতির প্রজাপতির দর্শন পেয়েছেন এবং তাকে উনি ক্যামেরাবন্দি করতে চান।

কিন্তু যা বুঝলুম, প্রজাপতিটা মহা ধূর্ত। কর্নেল আবার গুঁড়ি মেরে মুখ তুলতেই ওঁর টুপিটা ঘাসে পড়ে গেল এবং চওড়া টাক ঝলমলিয়ে উঠল।

প্রজাপতির ছবি তুলতে পারলেন কি না জানি না, এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ঘাস থেকে টুপিটা কুড়িয়ে মাথায় পরলেন। তারপর কেন যেন স্থির হয়ে দাঁড়ালেন।

এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দৃশ্যটা আমার চোখে পড়ল। কিছুটা দূরে ঘাসজমিতে একটা গাধা চরছে এবং নোংরা জীর্ণ স্যুট-টাই পরা সেই পাগল ভদ্রলোক হেসে ঝুঁকে পড়ছেন। বারকতক লেজে টান পড়ার পর গাধাটা এবার জোরে পা ছুঁড়েছিল নিশ্চয়! তা না হলে ভদ্রলোক পড়ে যাবেন কেন? উনি উঠে গাধাটার দিকে আঙুল তুলে হুমকি দিতে থাকলেন। গাধাটা সম্ভবত হুমকির চোটে ঝোপের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল।

কর্নেল এতক্ষণে হোটেলের দিকে আসছিলেন। রাস্তা পেরিয়ে তিনি একটুখানি চড়াইপথে এই হোটেলের গেটে পৌঁছেছেন, এমন সময় সেই পাগলাবাবু এসে গেলেন। তারপর কর্নেলকে বললেন, এই যে স্যার! এক কাপ কফি হবে নাকি? তার বদলে গান শোনাব। মাইরি! মা কালীর দিব্যি। শুনুন না একটুখানি জাস্ট স্যাম্পল।

বলে তিনি বিদঘুটে সুরে আমার ছেলেবেলায় পড়া এই পদ্যটা গানের মতো গাইতে শুরু করলেন–

‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
 কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল
ও ভাই, সকলি ফুটিল
মাইরি, সকলি ফুটিল..’

 তার সঙ্গে মাথায় এক হাত আর কোমরে এক হাত রেখে তিনি নাচ জুড়ে দিলেন। কর্নেল তুম্বো মুখে দাঁড়িয়ে গেছেন। পাগলাবাবু তেমনি সুর ধরে গাইছেন :

‘রাতি পোহাইল, মাইরি রাতি পোহাইল
ও ভাই রাতি পোহাইল…’

হোটেলের দারোয়ান গেটে গিয়ে পাগলাবাবুকে ধমক দিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, কর্নেল ওঁকে ইসারায় ডেকে রাস্তার ধারে অর্থাৎ একটা রোডসাইড কাফেতে নিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম, কর্নেল একটা পেপার কাপে ভর্তি কফি ওঁকে দিয়ে নিজেও একটা পেপারকাপে কফি নিলেন। তারপর পাগলাবাবুর সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলতে থাকলেন। পাগলাবাবু এক হাত নেড়ে ফুঁ দিয়ে কফি পান করতে করতে কথা বলছিলেন।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আচমকা ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি এসে গেল। অমনি পাগলাবাবু দৌড়ে হোটেলের নীচের রাস্তা দিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেল হন্তদন্ত হোটেলে ফিরে এলেন। একটা হিড়িক ফেলে দিয়েছিল আকস্মিক বেসুরো বৃষ্টিটা। সর্বত্র প্রেমিক-প্রেমিকারা মাথা বাঁচাতে ছত্রভঙ্গ হচ্ছিল।

দোতলায় কর্নেল ওঠার আগেই স্যুইটের দরজা খুলে দিলুম। বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানী একটু হেসে বললেন, জয়ন্তের ভাতঘুমটা আশা করি ভালোই হয়েছে।

বললুম, হয়েছে। কিন্তু পাগলাবাবুর গানে মুগ্ধ হয়ে তাকে আপনি কফি খাইয়ে দিলেন দেখে মুগ্ধ হয়েছি।

কর্নেল ব্যালকনিতে বসতে গিয়ে পিছিয়ে এলেন। বৃষ্টির ছাঁট আসছিল। সুইচ টিপে আলো জ্বেলে, ঘরেই বসলেন। বললেন, এককাপ কফির জন্য ভদ্রলোক অত পরিশ্রম করলেন! কী আর করা যাবে। তারপর তিনি চুরুট ধরালেন। তোমার সাংবাদিক বন্ধুরা কি সবাই চলে গেছে?

হাঁ। গতকাল আপনাদের প্রকৃতি-পরিবেশ সম্মেলন শেষ। আজ থাকতে হলে নিজের পয়সা খরচ হত। আমি থেকে গেলুম আপনার গেস্ট হিসেবে।

কর্নেল চুপচাপ কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন, বিজ্ঞানী ভদ্রলোকরাও অনেকে চলে গেছেন। অনেকে আছেন। বিশেষ করে জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডে আছেন। উনি চলে যাবেন আগামীকাল। আর দেখলুম ডঃ কৌশল্যা বর্মন আছেন। উনি ডি এন এ নিয়ে রিসার্চ করেন। আর আণবিক জীববিজ্ঞানী ডঃ পরিমল হাজরাকে দেখলুম।

ডঃ কৌশল্যা বর্মন জিনোম-তত্ত্ব নিয়ে কী পেপার পড়লেন একবর্ণ মাথায় ঢোকেনি।

কর্নেল হাসলেন। ও সব তো তোমার দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পাঠকরা খাবে না। যা খাবে–

ওঁর কথার ওপর বললুম, তা হল রহস্য-রোমাঞ্চ। ধরুন, সমুদ্রতীরে হত্যাকাণ্ড! অথবা বিজ্ঞানীর রহস্যময় অন্তর্ধান। বিশেষ করে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার যদি সেখানে থাকেন!

কর্নেল সাদা দাড়ি থেকে কী একটা পোকা বের করে ব্যালকনির দিকে ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, নাহ্। আর রহস্য-টহস্য নয়। কারো ব্যাপারে নাক গলানোর ইচ্ছে নেই।

একটু নড়ে বসলুম। তার মানে কারো কোনো ব্যাপার আপনার চোখে পড়েছে?

 কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, জয়ন্ত! তুমি যেখানেই যাবে, কোনো-না কোনো ব্যাপার তোমার চোখে পড়বেই। চন্দনপুর-অন-সিতে আমি আগেও এসেছি। পুরো এলাকা আমার চেনা। আর আমার এই বাইনোকুলার দিয়ে উঁচু জায়গা থেকে চারদিক লক্ষ্য করলে–হ্যাঁ, কিছু কিছু দৃশ্য আপাতদৃষ্টে রহস্যময় মনে হতেই পারে। কিন্তু খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে ওতে কোনো রহস্যই নেই। যেমন ধরো, জিনোম বা ডি এন এ বিজ্ঞানী ডঃ কৌশল্য দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর কেন যেন তক্ষুণি পা চালিয়ে চলে এলেন। তারপর দেখলুম, ডঃ পরিমল হাজরা ওখানে এক মহিলার পাশে বসে আছেন। কিন্তু সেই মহিলা তার স্ত্রী নন। তাঁরই ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্টান্ট শ্রাবন্তী সেন! কাজেই

হাসতে হাসতে বললুম, পরকীয়া প্রেম বা অবৈধ প্রণয়?

দাড়িতে হাত বুলিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞানী বললেন, না জেনে দুম করে সিদ্ধান্তে পৌঁছুনো ঠিক নয়, জয়ন্ত!

ডঃ হাজরার স্ত্রীকে দেখতে পাননি কোথাও?

মিসেস মালবিকা হাজরা সি-বিচে বিকেলে ডঃ বিক্রমজিৎ পাণ্ডের সঙ্গে, হাঁটছিলেন। বলেই কর্নেল মাথা নাড়লেন। নাহ্। এ থেকেও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না। জযন্ত! সমুদ্রই একমাত্র প্রাকৃতিক পটভূমি, যেখানে এলে মানুষের মন স্বাধীন হয়ে ওঠে। তবে মাত্র কিছুক্ষণের জন্য। কারণ প্রত্যেকের নিজস্ব কাজকর্ম আছে। যেমন, ডঃ পাণ্ডে। উনি হঠাৎ মিসেস হাজরাকে নিঃসঙ্গ করে চলে আসছিলেন। মিসেস হাজরারও সম্ভবত স্বামীকে মনে পড়ায় তার খোঁজে চলে এলেন।

বৃষ্টিটা হঠাৎ থেমে গেছে কখন। নিউ চন্দনপুরে সি-ব্রিচ কিছুটা বিপজ্জনক বলে বিচের মাথায় ইতস্তত লাইটপোস্ট। এখন বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। ডানদিকের বালিয়াড়িতে ঝাউবনের ভেতর বাতিগুলো লুকোচুরি খেলছে যেন। হাওয়া এখন আরো জোরালো। সন্ধ্যার সমুদ্র আরো ভয়াল এবং হিংস্র। মনে

কর্নেল বললেন, রোডসাইড কাফেতে কফি খেয়ে তৃপ্তি পাইনি। তুমি সুইচ টিপে হোটেল বয়দের ডাকো। এক প্লেট গরম পকৌড়া আর এক পট কফি আনতে বলো!

আমি সুইচ টিপতে যাচ্ছি, দরজায় কেউ নক করল। দরজা খুলে দেখি মহীতোষ বিশ্বাস। তিনি বললেন, একটু বিরক্ত করতে এলুম জয়ন্তবাবু! কর্নেল সায়েব ফিরেছেন?

কর্নেল ডাকলেন, আরে মহীতোষবাবু যে। আসুন, আসুন! জয়ন্ত তুমি তিনটে কাপ আনতে বলবে।

সুইচ টেপার মিনিট দুয়েকের মধ্যে মধ্যবয়স্ক হোটেলবয় নব এসে সেলাম দিল। তাকে শিগগির কফি পকৌড়া আনতে বলে দরজা খোলা রাখলুম। মহীতোষবাবু ধনবান বাঙালি ব্যবসায়ী। তার মাছের আড়ত আছে ওল্ড চন্দনপুরে। কিন্তু বাস করেন নিউ চন্দনপুরে। কর্নেলের তিনি পূর্বপরিচিত। সেই সূত্রে আমার সঙ্গেও তার আলাপ হয়েছে।

মহীতোষবাবু কর্নেলের পাশে চেয়ার টেনে বসে বললেন, কর্নেল সায়েবের কনফারেন্স তো শেষ। আমি এলুম আপনাদের নেমন্তন্ন করতে। হোটেলে খামোকা পয়সা খরচ না করে–

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, আজকের দিন-রাতের খরচও সরকারি পরিবেশ দফতর দেবে।

মহীতোষবাবু বললেন, ঠিক আছে। কাল সকালে আমার গেস্ট হোন আপনারা। আমি নিজে এসে গাড়িতে আপনাদের তুলে নিয়ে যাব। কটা নাগাদ আসব বলুন?

কর্নেল তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন, সেবার আপনার গেস্ট হয়ে এসেছিলুম একটা বিশেষ কারণে। এবারও কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?

 মহীতোষবাবু হাসি মুখে বললেন, না, না কর্নেল সায়েব! আপনি কি ভাবছেন নিজের স্বার্থের জন্য আপনাকে নেমন্তন্ন করতে এসেছি? আপনি আমাকে সেবার কী বাঁচা না বাঁচিয়েছিলেন! আমার শত্রুদের চিরদিনের জন্য ঢিট করে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞতাবোধ কি আমার থাকতে নেই? তবে আপনারও ভালো লাগবে। আমার বাগানে কয়েকটা বিদেশি ক্যাক্টাস এনে রেখেছি। পছন্দ হলে আপনি দু-একটা নিয়ে কলকাতা ফিরবেন। আর আমার মালী চরণদাস কথায়-কথায় বলছিল, মাসান্ডার পাহাড়ি জঙ্গলে সে কী সব অদ্ভুত অর্কিড দেখে এসেছে। সেগুলোতে নানা রঙের ফুল!

কর্নেল বললেন, আপনি লোভ না দেখালেও কাল ভোরে মাসান্ডা ফরেস্টে আমি যেতুম। এই হোটেলের মালিক ট্যুরিস্টদের জন্য জিপ বা কার ভাড়ার ব্যবস্থা রেখেছেন।

নব ট্রেতে পকৌড়ো-কফি রেখে গেলে দরজা এঁটে দিলুম। মহীতোষবাবু অভিমানী মুখে বললেন, তা আপনি যদি এ গরিবের পর্ণকুটিরে পায়ের ধুলো না দেন, জোর করতে তো পারি না!

কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে একটু হেসে বললেন, ঠিক আছে মহীতোষবাবু! আপনার গেস্ট হওয়া নিশ্চয় আমার কাছে আনন্দের ব্যাপার। সকাল আটটা নাগাদ বরং আসবেন।..

কিছুক্ষণ পরে মৎস্যব্যবসায়ী ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমি কর্নেলকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি, কেন ওঁর বাড়ি যেতে আপনার আপত্তি ছিল, এমন সময় দরজায় কেউ জোরে কয়েকবার নক করল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলুম। আমার পাশ কাটিয়ে মহিলাবিজ্ঞানী কৌশল্যা বর্মন ঘরে ঢুকে কর্নেলের পাশে গিয়ে বসলেন। তাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। কর্নেল বললেন, কী হয়েছে কৌশল্যাদেবী?

কৌশল্যা বর্মন চাপা স্বরে বললেন, আশ্চর্য ঘটনা কর্নেল সরকার! আমার ঘরে একটা ব্রিফকেসে খুব ইমপর্ট্যান্ট রিসার্চ ডকুমেন্ট ছিল। ব্রিফকেসের তালা ভেঙে ফাইলটা কেউ চুরি করেছে। এইমাত্র ডঃ আচারিয়ার কাছ থেকে স্যুইটে ফিরে দেখি, দরজা ঠিকই লক করা আছে। অথচ টেবিলে ব্রিফকেসের তালা ভাঙা।

আপনি তো তিনতলায় সতের নাম্বার স্যুইটে আছেন?

হ্যাঁ। ডাবলবেড সুইট। আমার স্যুইটে ডঃ পরিমল হাজরার অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়েটিকে থাকতে দিয়েছিলুম। ডঃ হাজরার অনুরোধে।

শ্রাবন্তী সেনের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিল কি?

ছিল। দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম। ভেতর থেকে চাবি ছাড়াই দরজা খোলা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে দরজা খুলতে চাবির দরকার হয়।

শ্রাবন্তীর খোঁজ নিয়েছেন?

কৌশল্যা আরও চাপা স্বরে বললেন, বিকেলে দুর্গপ্রাসাদের ওখানে ডঃ হাজরার পাশে শ্রাবন্তী বসে ছিল। বসে থাকার ভঙ্গিটা অশালীন। তাই আমি ওখান থেকে তক্ষুণি সরে এসেছিলুম।

হুঁ। আমি তা লক্ষ্য করেছিলুম। কিন্তু শ্রাবন্তীর খোঁজ নিয়েছেন কি?

সে নাকি এখনও হোটেলে ফেরেনি। ডঃ হাজরা আর তার স্ত্রী মালবিকা ক্যান্টিনে বসেছিলেন। তাদের জিজ্ঞেস করেছি। মিসেস হাজরা শ্রাবন্তীকে দেখেননি। ডঃ হাজরা আমার মুখের ওপর মিথ্যা বললেন। তিনিও নাকি তাকে দেখেননি। আমার রাগ হয়েছিল। তবু মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হল। আমি চাই না ওঁদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হোক। তো হোটেলবয়রা কিংবা রিসেপশনের কেউ-ই বলতে পারল না শ্রাবন্তী কোথায়! এখন আমি কী করব, তা নিয়ে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এলুম। আমি কি ঘটনাটা পুলিশকে জানাব?

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, আর আধঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখুন শ্রাবন্তী ফিরছে কি না। তবে আমি এখনই আপনার স্যুইটে যেতে চাই।

কথা অবশ্য ইংরেজিতে হচ্ছিল। কৌশল্যার মুখে উত্তেজনার পর বিষণ্ণতার ছাপ পড়েছে এবার। তিনি বললেন, আমি আপনার অন্য পরিচয় জানি কর্নেল সরকার। তাই আপনার কাছেই প্রথমে ছুটে এসেছি। পুলিশের ওপর আমার আস্থা নেই। ওই ফাইলটা কোনো জিনোমবিজ্ঞানীর হাতে গেলে তিনিই আমার আবিষ্কারের কৃতিত্ব কেড়ে নেবেন। তাছাড়া আমার ফরমুলাটাও যেমন খুব ভালো, তেমনি সাংঘাতিক খারাপ।

কর্নেল আমার দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে বললুম, প্লিজ কর্নেল! আমিও যেতে চাই!

কৌশল্যা বললেন, আসুন! আপনি সাংবাদিক। আপনারও পর্যবেক্ষণ শক্তি থাকা উচিত। কিন্তু দয়া করে ঘটনাটা যেন আপনার পত্রিকায় প্রকাশ করবেন না। আমি সরকারের বেতনভোগী বিজ্ঞানী। ঝামেলায় পড়ব।

তাকে আশ্বস্ত করে ব্যালকনির দিকের দরজা এবং বাইরে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলুম। তিনতলায় সতের নম্বর সুইট সিঁড়ির মাথায় বাঁদিকে। কৌশল্যা চাবি দিয়ে দরজা খুললেন। ঘরে আলো জ্বলছিল। আমরা ঘরে ঢুকলে কৌশল্যা দরজা এঁটে দিলেন।

কর্নেল মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মেঝেয় নারকেল ছোবড়ার রঙিন কার্পেট। হঠাৎ তিনি ঝুঁকে একটা খুদে লাল ফুল তুলে নিলেন। ফুলটা দেখতে কতকটা সন্ধ্যামণি ফুলের মতো। কিন্তু বেঁটে। কৌশল্যা বললেন, কী ওটা?

এগুলো বুনো ফুল। দুর্গপ্রাসাদ পর্যন্ত এই বুনো ফুলের ঝোপ আছে।

হ্যাঁ। দেখেছি।

 আপনি কি খোঁপায় এই ফুলের একটা গুচ্ছ তুলে গুঁজেছিলেন?

নাহ্। ফুল আমি ভালবাসি। কিন্তু বুনোফুল খোঁপায় গুঁজে রাখার মতো রোম্যান্টিক মন তখন ছিল না।

কোন খাটে শ্রাবন্তী শোয়?

এই বাঁদিকের খাটে। ওই দেখুন ওর স্যুটকেস আর ব্যাগ।

 তাহলে শ্রাবন্তী পালিয়ে যায়নি।

গেলেই বা কী? ওই ফাইলটা কোনো জিনোমবিজ্ঞানীকে বেচলে সে প্রচুর টাকা পাবে। বলে কৌশল্যা তাঁর খাটের মাথার দিকে টেবিলের ওপর খোলা ব্রিফকেসটার ডালা তুললেন। ভেতরে একগাদা কাগজ আছে। কৌশল্যা কাগজের শিটগুলো তুলে বললেন, এগুলোর তলায় লাল রঙের ফাইলটা ছিল। আট ইঞ্চি লম্বা, চার ইঞ্চি চওড়া। চেন আঁটা যায়।

কর্নেল পকেট থেকে খুদে টর্চ বের করে কৌশল্যার খাটের তলা দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ব্রিফকেসটার তালা পরীক্ষা করে বললেন, শক্ত কিছু দিয়ে সম্ভবত ছোট ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে জোরে টানার ফলে তালাটা উপড়ে গেছে ব্রিফকেসের নীচের অংশ থেকে। অত গুরুত্বপূর্ণ ফাইল এখানে রাখা উচিত হয়নি কৌশল্যাদেবী।

কৌশল্যা বললেন, আসলে ভেবেছিলুম, অমন একটা জিনিস এই সাধারণ ব্রিফকেসে রাখার কথা কেউ ভাবতে পারবে না।

আপনি কি কথাপ্রসঙ্গে কারও কাছে আপনার আবিষ্কার সম্পর্কে আভাসে কিছু বলেছিলেন?

যেটুকু বলার, তা তো সম্মেলনে পেপার পড়ার সময় বলেছি। আপনার মনে থাকতে পারে।

হ্যাঁ। আপনি বলেছিলেন, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী ওয়াটসন ডি এন এ-র গঠন আবিষ্কার করেছিলেন। আপনি সেই প্রাকৃতিক গঠনকে অদলবদল করার সম্ভাবনা সম্পর্কে আভাস দিয়েছিলেন। ডি. এন. এ-র স্ট্রাকচার বদলে দিয়ে কিম্ভুতকিমাকার উদ্ভিদ বা প্রাণী সৃষ্টি হতে পারে।

হ্যাঁ। আমার আবিষ্কারটা ফরমুলার আকারে লেখা ছিল ফাইলে।

আপনার দিল্লির ল্যাবরেটরিতে কি থিয়োরিটা প্রয়োগ করে ফল পেয়েছেন?

পেয়েছি। খুদে কয়েকটা পিঁপড়ের ডিম থেকে ভীমরুলের মতো মোটা পিঁপড়ের জন্ম হয়েছে। সাংঘাতিক বিষাক্ত সেগুলো।

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, যাই হোক, আমি বিকেলে বাইনোকুলারে দূর থেকে দেখেছিলুম, ডঃ হাজরা তার ল্যাব-অ্যাসিস্ট্যান্টের খোঁপায় এই বুনো ফুলের গুচ্ছ গুঁজে দিচ্ছেন। অতএব এটা ঠিক, শ্রাবন্তী ফিরে এসে এই ঘরে যখন ঢুকেছিল তখন আপনি ঘরে ছিলেন না। বৃষ্টির সময় কোথায় ছিলেন। আপনি?

কৌশল্যা বললেন, আমি হোটেল দ্য শার্কে পরিবেশবিজ্ঞানী ডঃ রঘুবীর আচারিয়ার সঙ্গে গল্প করছিলাম। উনি আজ রাতেই দিল্লি যাবেন। আমার যাবার কথা কাল দুপুরের ট্রেনে। এখন দেখুন, কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল!

কর্নেল আবার ঘরের ভেতর চোখ বুলিয়ে ব্যালকনির দিকের দরজার কাছে গেলেন। তারপর বললেন, এই দরজাটা বন্ধ নেই দেখছি!

কৌশল্যা চমকে উঠে বললেন, সে কী! শ্রাবন্তী বেরিয়ে যাওয়ার পরে আমি বেরিয়েছিলুম। তখন ওই দরজার ছিটকিনি এঁটে দিয়েছিলুম!

কর্নেল ভেজানো দরজা খুলে বললেন, ব্যালকনির আলোটা জ্বেলে দিন!

 কৌশল্যা সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন। তারপর তার কাছে গেলেন।

কর্নেল ব্যালকনি থেকে আর একটা খুদে লাল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, শ্রাবন্তী এই ব্যালকনিতে এসেছিল। তারপর তিনি গুঁড়ি মেরে নীচেটা দেখে বললেন, নীচের লনে ফুলের ঝোপঝাড় আছে। ফাইলটা সে প্রকাশ্যে নিয়ে যেতে পারেনি সম্ভবত–যদি অবশ্য শ্রাবন্তীই ফাইলচোর হয়!

কৌশল্যা একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, যদি কী বলছেন কর্নেল সরকার? আমার অনুপস্থিতিতে সে দুর্গপ্রাসাদ থেকে সুইটে ফিরেছিল, এর প্রমাণ তো বুনো ফুল!

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, হ্যাঁ। তো ফাইলচোর ফাইলটা এখান থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলেছিল কি না বলা কঠিন। কারণ তাতেও ঝুঁকি আছে। দোতলার ব্যালকনি এবং নীচে ক্যান্টিনের জানালা দিয়ে কারও-না-কারও ব্যাপারটা চোখে পড়ার কথা। তবে শুধু এটা স্পষ্ট, শ্রাবন্তী এই ব্যালকনিতে এসেছিল। তারপর বোঝাই যাচ্ছে, ব্যালকনির দরজা বন্ধ না করে শুধু ভেজিয়ে রেখে সে বেরিয়ে যায়। তা থেকে আমার সিদ্ধান্ত, সে শিগগির ফিরে আসবে ভেবেছিল। কিন্তু কোনো কারণে সে এখনও ফিরছে না। এটা সরল পাটিগণিত কৌশল্যাদেবী!

কৌশল্যা ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভাবছিলেন। বললেন, এবার বলুন আমার কী করা উচিত!

কর্নেল বললেন, আপনি বরং আপাতত একটা কাজ করতে পারেন। অবশ্য সেটা আপনার স্বাধীন ইচ্ছা। আমার মতে, আপনি ডঃ হাজরার সঙ্গে দেখা করে শুধু তাকে জানিয়ে দিন, তার ল্যাব-অ্যাসিস্টান্ট শ্রাবন্তী সেন এখনও স্যুইটে ফেরেনি। তাই আপনি উদ্বিগ্ন। এ কথা শুনে তিনি কী বলেন, সেটা আমার মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ডঃ হাজরার প্রতিক্রিয়া আমাকে টেলিফোনে জানান। পি বি এক্স অপারেটরের সাহায্য নেওয়ার দরকার নেই। এই হোটেলে প্রত্যেক স্যুইটে সরাসরি ফোন করা যায়। আমার স্যুইটের ইন্টারলিংক ফোন নাম্বার ২১। আপনার?

বত্রিশ।

 হাঁ। আগে জিরো ডায়াল করে ডায়ালটোন পেলে তবে সরাসরি ফোন করা যাবে।

জানি।…

আমরা দোতলায় আমাদের স্যুইটে ফিরে এলুম। কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, মোটে ৭টা ১৫ মিনিট। জয়ন্ত! তাহলে তোমার ইচ্ছে পূর্ণ হল। একটা রোমাঞ্চকর স্টোরির লেজ দেখতে পেলে। তবে আমার দুর্ভাগ্য, যেখানে যাই, সেখানেই একটা ঝামেলায় পড়ি।

বললুম শ্রাবন্তী এত বোকামি করবে বিশ্বাস হয় না। একই ঘরে থেকে এমন সাংঘাতিক চুরি করে বসবে? ধরুন, নিজের জিনিসপত্র ফেলে পালালেও তো তার জানা উচিত, পুলিশ তার নামে হুলিয়া জারি করবে!

কর্নেল চুপচাপ বসে চুরুট ধরালেন। চোখ দুটি বন্ধ করে হেলান দিলেন।

ব্যালকনির দরজা খুলেই কানে এল পাগলাবাবুর গান। নীচের রাস্তায় নেচে নেচে গাইছেন :

‘রাতি পোহাইল–মাইরি! রাতি পোহাইল…’

পাগলাবাবুর নাচগান কিছুক্ষণ শুনে ঘরে এলুম। এই সময় ফোন বাজল। কর্নেল ফোন তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, বলুন কৌশল্যাদেবী!…অ্যাঁ? বলেন কী?…ঠিক আছে। অপেক্ষা করুন!..হ্যাঁ। চুপচাপ অপেক্ষা করুন। ফোন রেখে কর্নেল আমার দিকে ঘুরে বললেন, ডঃ হাজরা কৌশল্যাদেবীর কথা শুনেই এবার সর্বনাশ বলে সবেগে বেরিয়ে গেছেন।..

.