কালো নেকড়ে – ৬

০৬.

এবার আমরা প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসছিলুম। কর্নেল বললেন, একটা পয়েন্ট এতক্ষণে স্পষ্ট হলো। কালো নেকড়ে হোক কিংবা যা-ই হোক, ওটা কোনো লোকের পোষা জন্তু।

মির্জাসাহেব বললেন, আরও একটা পয়েন্ট আমার মাথায় এসেছে। সেই লোকটা জানত, আজ কেউ পীরের মাজারে যাবে। তখন জন্তুটাকে সে ছেড়ে দেবে এবং জন্তুটা তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু আজ পীরের মাজারে প্রথমে আমি আর আপনি গিয়েছিলুম। তারপর আপনি আর মিঃ চৌধুরি গিয়েছিলেন। তাছাড়া পাগলটা ওই এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শেষে রহিম ঘোড়ায় চড়ে ছোটাছুটি করে গেল। তাই জন্তুটার মালিক সাবধান হয়ে গেছে। কারণ ওখানে সে কারও না কারও চোখে পড়ে যাবে। বিশেষ করে আপনার বাইনোকুলার আছে।

আমি বললুম, যে লোকটা এবার ভিকটিম হতো, সে-ও সম্ভবত যায়নি।

কর্নেল বললেন, ধরে নেওয়া যায়, তার যখন ওখানে যাওয়ার কথা, তখন তুমি আর আমি ওখানে ছিলুম। তার মানে, প্রায় সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে তার যাওয়ার কথা ছিল। আমরা থাকায় সে যেতে পারেনি।

মির্জাসাহেব বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কাদের বখশের মতো একটা নিরীহ ভালমানুষকে মেরে ফেলে কার কী লাভ হলো? তা ছাড়া আরো একজন লোককে একই জায়গায় মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল। একই জায়গায় দুদুটো মৃত্যু ঘটিয়ে কার কী লাভ হতে পারে?

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল মাঝে মাঝে অভ্যাসমতো বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। মির্জাসাহেবের কথার উত্তরে তিনি একটু হেসে বললেন, আপনি বলছিলেন ওখানে নাকি গুপ্তধনের গুজব আছে?

মির্জাসাহেব ক্ষুব্ধভাবে বললেন, আছে। কিন্তু কাদের বখশ গুপ্তধনের খোঁজে এখানে আসত না। এসব ব্যাপারে তার বিশ্বাস ছিল না। তার বিশ্বাস ছিল শুধু পীরের ওপর। কতবার সে আমাকে বলেছে, পীরের মাজারে যদি খাজানা লুকোনো সত্যিই থাকে, তাহলে তাতে হাত দিলে পীরবাবার অভিশাপ লাগবে। কর্নেল সরকার! আমি জোর দিয়ে বলছি, কাদের বখশ ছিল পীরভক্ত মানুষ। তাই আজীবন সে মাজারে সাঁঝবাতি দিতে আসত।

কর্নেল বললেন, এ সব কথা থাক। আপনার বন্ধু নরেশ সিং কোথায় থাকেন? তার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই।

নরেশ কাছাকাছি একটা বাগানবাড়ি করেছে। আমিই ওকে জমিটা পাইয়ে দিয়েছিলুম। ওর পৈতৃক বাড়ি সেহরাগড় বাজার এলাকায়। বিকেলে সে এই বাড়িতে চলে আসে। মির্জাসাহেব একটু হেসে ফের বললেন, রাতে মদের আসর বসে ওর বাড়িতে। বিশেষ করে প্রতি রবিবার এই এলাকার সব বড়লোক এবং বড়-বড় অফিসাররা আসেন। পার্টি দেয় নরেশ।

আজ রবিবার নয়। কর্নেল বললেন। কাজেই আজ পার্টির ধুমধাম নেই।

হ্যাঁ। তা ছাড়া এখনও তার মদ্যপানের সময় হয়নি। চলুন। ওই যে লালরঙের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটাই নরেশের বাড়ি।

কয়েকটা বাড়ির পর বাঁদিকে উঁচু জমিতে একটা বাংলো ধাঁচের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। গেটে ঝলমলে লাল বুগেনভিলিয়া। ভেতরে সুদৃশ্য লন। গেটের সামনে যেতেই কুকুরের গর্জন ভেসে এল। বন্দুকধারী দারোয়ান চুলে বসে খৈনি ডলছিল। মির্জাসাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল।

বললুম, সব বাড়িতেই কি বন্দুকধারী দারোয়ান আছে?

মির্জাসাহেব বললেন, হ্যাঁ। বিহার মুলুকে এটাই ট্রাডিশন। পথেঘাটে যানবাহনে সবখানে বন্দুকধারী লোক দেখতে পাবেন। তা ছাড়া এলাকায় মানুষখেকো নেকড়ের উৎপাত শুরু হবার পর থেকে সবাই সতর্ক।

গাব্দাগোব্দা চেহারা এক ভদ্রলোক ছড়ি হাতে বারান্দা থেকে নেমে আসছিলেন। পরেনে প্যান্ট, গায়ে স্পোর্টিং গেঞ্জি। মির্জাসাহেবের চেয়ে ঝাপালো গোঁফ আছে মুখে। মাথায় টাক। সহাস্যে একটু ঝুঁকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, আদাবারজ ছোটনবাবসাব। আইয়ে। অন্দর আইয়ে!

লনে কয়েকটা চেয়ার পাতা ছিল। বারান্দায় চেনে বাঁধা একটা প্রকাণ্ড কুকুর প্রচণ্ড হাঁকডাক করছিল। নরেশ সিং ধমক দিয়ে তাকে চুপ করালেন। মির্জাসাহেব আমাদের সঙ্গে নরেশ সিংয়ের আলাপ করিয়ে দিয়ে বারান্দায় কুকুরটাকে আদর করতে গেলেন। বুঝলুম, নরেশ সিংকে তিনি ওই অ্যালসেশিয়ানটাই উপহার দিয়েছিলেন।

নরেশ সিং বললেন, বৈঠিয়ে। বৈঠিয়ে।

আমরা বসলুম। মির্জাসাহেব ফিরে এলেন। তারপর ইংরেজিতে আলাপ শুরু হলো। কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব বলছিলেন, আপনার ছোটভাইয়ের নাম সুরেশ সিং। তিনি কি এখন কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিট থাকেন?

নরেশ সিং বললেন, তা জানি না। দশ বছর আগে সুরেশ আমার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছে। আজ সকালে হঠাৎ তার ট্রাঙ্ককল পেয়ে আমি যত অবাক, তত উদ্বিগ্ন। সে আজ রাতের ট্রেনে আসছে। স্টেশনে যেন গাড়ি পাঠাই।

মির্জাসাহেব বললেন, সঙ্গত অনুরোধ। আপনি তার দাদা। সে আপনার সহোদর ভাই।

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তো জানেন সুরেশ আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছিল।

ভুলে যান ওসব কথা। মির্জাসাহেব বললেন। আমার মাননীয় অতিথিরা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।

আমি দুঃখিত। বলে নরেশ সিং কর্নেলের দিকে ঘুরে বসলেন। আপনি একজা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। আগ্নেয়াস্ত্র ধরার অভ্যাস আছে। একটা মানুষখেকো কালো নেকড়েকে গুলি করে মারতে পারবেন না?

কর্নেল হাসলেন। এ বয়সে আমার আর তত দক্ষতা নেই। কেন? সরকারি বেসরকারি শিকারীরা তো চেষ্টা করছেন?

নাহ্। এক বছর ধরে চেষ্টা করে সব শিকারী হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মির্জাসাহেব নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন, কালো নেকড়ে হোক বা স্বাভাবিক ধূসর রঙের নেকড়ে হোক, জন্তুটা খুবই ধূর্ত। দিনে দিনে তার সাহস এত বেড়েছে যে এখন বয়স্ক মানুষের ওপর হামলা করছে। হতভাগ্য কাদের বখশের প্রাণ গেল। জানেন? কাদের বখশকে কদিন আগেই জঙ্গলের ভেতর পীরের সমাধিতে ওভাবে একা যেতে নিষেধ করেছিলুম। কাদের বখশ বলেছিল, পীরবাবা আমাকে বাঁচাবেন!

এই সময় একটি লোক কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল। মির্জাসাহেব বললেন, গরম পানীয় খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক।

নরেশ সিং লোকটিকে বললেন, যাও! অভি সব বাত্তি জ্বালা দো।

সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি এসে গিয়েছিল। আলো জ্বলে উঠল। কফি খেতে খেতে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ সিং কি ব্যবসাবাণিজ্য করেন?

করি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাধরনের জিনিসের অর্ডার সংগ্রহ করে সেগুলো সরবরাহ করি। অর্ডার সাপ্লায়ারিং এজেন্সি। নরেশ সিং একমুঠো বাদাম চিবুতে চিবুতে ফের বললেন, বাবার আমলের কারবার। সুনামের জোরে ভালই চলে।

আরও কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথাবার্তার পর মির্জাসাহেব বললেন, এবার ওঠা যাক্।

নরেশ সিং চোখ নাচিয়ে বললেন, আপনার অতিথিরা আমারও অতিথি। তা ছাড়া আপনিও অনেকদিন পরে এলেন। একটু ভাল রকমের আপ্যায়নের লোভ হচ্ছে।

মির্জাসাহেব হাসলেন। আজ নরেশজির আসরে আর কোন অতিথি নেই বুঝি?

নাহ্। আজ আমি একেবারে নিঃসঙ্গ। তেমন কাকেও আজ খুঁজে পাইনি।

কর্নেলসাহেব এবং জয়ন্তবাবু, দুজনকেই বলছি, আপনারা ইচ্ছা করলে নরেশজির সঙ্গ দিতে পারেন। নরেশজির খাঁটি স্কচ ছাড়া চালে না।

কর্নেল হাসলেন, ধন্যবাদ নরেশজি! কড়া পানীয় আর আমার শরীর নেয় না। আর জয়ন্ত তো এক পেগেই মাতাল হয়ে যায়। তখন ওকে সামলানোর সমস্যা হয়। কাজেই ক্ষমা করবেন।

ঠিক আছে। নরেশ সিং করুণ মুখভঙ্গি করে বললেন, এসব ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করাটা অভদ্রতা…

অন্ধকার রাস্তায় জোরালো টর্চের আলো ফেলে হাঁটতে হাঁটতে মির্জাসাহেব বললেন, আমার মনমেজাজ আর আগের মতো নয়। আগে নরেশজির বাড়িতে আমিও রাতদুপুর অব্দি কাটিয়েছি। লোকটা আর যা-ই হোক, প্যাঁচালো ধরনের মানুষ নয়।

কর্নেল বললেন, সুরেশ সিং ওঁর মুখে চুনকালি মাখিয়েছিলেন–সেটা কী  ব্যাপার?

সুরেশ নিষিদ্ধ মাদকের কারবার করত। মির্জাসাহেব সাবধানে আলো ফেলে চারদিক দেখে নিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, তখন আমি অ্যামেরিকায় ছিলাম। ফিরে এসে ঘটনাটা শুনেছিলুম। নরেশজি ভাইকে শাসনে রাখতে পারেননি। কোনো গোপনসূত্রে খবর পেয়ে আবগারি দফতরের লোকেরা পুলিশ নিয়ে একরাতে নরেশজির গুদামে হানা দিয়েছিল। শুনেছি প্রায় দশ লাখ টাকার গাঁজা আর আফিম লুকোনো ছিল গুদামে। সুরেশ পালিয়ে যায়। নরেশজি অনেক হয়রানির পরে বেঁচে যান। ওঁর সঙ্গে অনেক বড় বড় অফিসার আর রাজনীতিকদের চেনাজানা আছে। তো আপনার চেনা সুরেশ সিংয়ের চেহারার সঙ্গে কি নরেশজির চেহারা মিল লক্ষ্য করলেন?

কর্নেল বললেন, চেনা-মানে, নিছক নামেই চেনা। কলকাতার সদর স্ট্রিট এলাকায় একটা গলির মধ্যে খুশবুমহল নামে একটা বাড়ির মালিকের নাম সুরেশ সিং। বাড়িটা আসলে একটা পতিতালয়। ওই বাড়িতে একটি মেয়ে খুন হয়েছিল। বাড়ির মালিকের জেল হয়। তারপর কীভাবে জনৈক সুরেশ সিং বাড়িটা হাতিয়ে নেয়।

মির্জাসাহেব বললেন, আজ রাতের ট্রেনে সুরেশ আসছে। আপনি ইচ্ছা করলে আমি তার সঙ্গে আপনার আলাপের সুযোগ করে দিতে পারি।

কর্নেল বললেন, নাহ্। সুরেশ সিং সম্পর্কে আমার তত আগ্রহ নেই।

মির্জাসাহেব হাসলেন। আমার আগ্রহ আপনিই জাগিয়ে দিলেন। কাজেই কোনো কৌশলে জেনে নেব সে কলকাতার খুশবুমহল নামে একটা বাড়ির মালিক কি না। তবে এটা সত্যি হতেও পারে। কারণ সুরেশ সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা এখানে অনেকের কাছে শোনা যায়।

কর্নেল তার ছোট্ট কিন্তু জোরালো টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে হাঁটছিলেন। একটু দূরে নবাববাড়ির আলো গাছপালার ফাঁকে ঝিলমিল করছিল। আমাদের ডানদিকে রাস্তার কিনারায় বিশাল একটা পাথর দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, পাথরটার আড়ালে কেউ বা কিছু আছে।

অমনি মির্জাসাহেব টর্চের আলো ফেললেন পাথরটার দিকে। আমিও টর্চ জ্বেলে সেদিকে আলো ফেললুম। কর্নেলকে এগিয়ে যেতে দেখলুম। তিনটি টর্চের আলোয় পাথরটা যেন ঝলসে উঠল। তারপর দেখতে পেলুম সেই পাগলটাকে।

হঠাৎ আলোর মধ্যে পড়ে সে প্রথমে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। হাতের শাবলটা কিন্তু সে ছাড়েনি। তাকে ধরে ফেলার আগেই সে শাবলটা কর্নেলের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় কর্নেল পাশ কাটিয়ে গিয়ে তার চুল ধরে ফেললেন। শাবলটা রাস্তায় গিয়ে পড়েছিল। আমি তখনই সেটা কুড়িয়ে নিলুম। কর্নেল তার লম্বা চুল ধরে তাকে জব্দ করে ফেলেছিলেন। তার গলা দিয়ে শুধু আঁ-আঁ শব্দ বেরুচ্ছিল। মির্জাসাহেব গিয়ে তার বুকে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে বললেন, চুপসে আও মেরা সাথ। নেহি তো গোলি মার দেগা।

তার এক হাতে রাইফেল, অন্য হাতে টর্চ। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! হাঁ করে কী দেখছ? আমার পিঠে আঁটা কিটব্যাগের ভেতর দড়ি আছে। সেটা বের করে দাও। কুইক!

দড়িটা খুঁজে বের করার পর কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব! এর হাত দুটো পেছনে টেনে বেঁধে ফেলুন।

পাগলাটার গায়ে বেজায় দুর্গন্ধ। তাকে মির্জাসাহেব ও কর্নেল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন। তারপর দুজনে ঠেলতে ঠেলতে রাস্তায় নিয়ে এলেন। কিন্তু এবার সে শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখে শুধু অদ্ভুত আঁ-আঁ শব্দ!

কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর তাকে দাঁড় করানো গেল না। তখন কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব! আপনি বরং বাড়ি চলে যান। রহমত আর ডিব্বুকে নিয়ে আসুন। ওরা একে বয়ে নিয়ে যাবে।

মির্জাসাহেব হন্তদন্ত চলে গেলেন।

এবার ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগচ্ছিল। এই পাগল লোকটার ওপর বড় বেশি অত্যাচার করা হচ্ছে। বললুম, কর্নেল! বেচারাকে এত টানাটানি করে কোনো লাভ হবে না মনে হচ্ছে। এ তো দেখছি কথা বলতে পারে না। বোবা!

কর্নেল আমার কথায় কান না করে বললেন, শাবলটা হাতছাড়া কোরো না।

শাবলটা ছোট্ট এবং ওজনে কম। সেটা পাথরটার কাছে রেখে কর্নেলের কিটব্যাগ থেকে দড়ি বের করতে গিয়েছিলুম। টর্চের আলো ফেলে শাবলটা কুড়িয়ে আনলুম। এবার দেখলুম, কর্নেল পাগলটার মুখে চকোলেট গুঁজে দিচ্ছেন। একটু পরেই আমাকে অবাক করে বন্দী পাগল শিশুর মতো হাসতে শুরু করল।

কর্নেল তার পাশে বসে চাপাস্বরে বললেন, আজ রাতমে তুম ছোটে নবাবসাবকা মেহমান বন যায়েগা। আচ্ছা-আচ্ছা খানা মিলেগা! কাপড়াভি মিলেগা। সমঝা?

বলে তিনি আর একটা চকোলেট তার মুখে গুঁজে দিলেন। পাগলটা চকোলেট চুষতে থাকল। মুখে নিষ্পাপ হাসি। যখনই কর্নেল টর্চের আলো জ্বালছেন, তখনই দেখতে পাচ্ছি পাগল নিঃশব্দে হাসছে। তার চোখে একবার যেন জলও চিকচিক করতে দেখলুম। কে এই পাগল?

কিছুক্ষণের মধ্যেই মির্জাসাহেবের টর্চের আলো দেখা গেল। রহমত আর ডিব্বু এসে পড়ল তার আসার আগেই। রহমত কপাল চাপড়ে বলল, ইয়া আল্লা! ইয়ে বুজুর্গ আউলিয়াকো আপলোগ কাহে জুলুম-জবরদস্তি কর রহা স্যার? ইয়ে ঠিক কাম নেহি।

পিছন থেকে মির্জাসাহেব চাপাস্বরে ধমক দিলেন, কাঁধপর উঠাকে লে চলো! জলদি!

ধমক খেয়ে কাচুমাচু মুখে রহমত আর ডিব্বু পাগলকে মড়ার মতো বয়ে নিয়ে চলল।

মির্জাসাহেবের বাড়ি পৌঁছে পাগলাকে পোর্টিকোর সামনে বারান্দায় শুইয়ে রেখে রহমত তার পা ধরে বলল, হাম মাফি মাঙ্গতা হুজুর!

মির্জাসাহেব রমহতকে কড়া ধমক দিয়ে পাগলের পাহারায় থাকতে হুকুম দিলেন। তারপর আমাদের উদ্দেশে বললেন, লোকটা বেজায় নোংরা। আমি হাত ধুয়ে পোশাক বদলে আসি। আপনারাও হাত ধুয়ে পোশাক বদলে আসুন। এখানে বসে আরেক দফা কফি খেয়ে পাগল সম্পর্কে আলোচনা করা যাবে।

গেস্টরুমে গিয়ে কর্নেল বললেন, সমস্যা হচ্ছে লোকটা বোবা।

বললুম, ওর কাঁধের নিচে পিঠের একটু অংশ দেখে মনে হলো, লোকটা ফর্সা। মুখের চেহারাও মোটামুটি সুশ্রী।

হ্যাঁ। আজ সকালেই তা লক্ষ্য করেছিলুম। এই পাগল কে, সেটা জানা গেলে আমার পা বাড়াতে সুবিধে হয়। বলে কর্নেল কিটব্যাগ, বাইনোকুলার আর ক্যামেরা রেখে বাথরুমে ঢুকলেন।…

কয়েক মিনিটের মধ্যে পোশাক বদলে আমরা বারান্দায় পোর্টিকোর কাছে গেলুম। মির্জাসাহেব তখনও আসেননি। রহমত তখনও পাগলের পায়ের কাছে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। ডিব্বু কাছাকাছি থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাগল চোখ বুজে পা নাচাচ্ছে। শাবলটা আমি চেয়ারের পাশে নিরাপদ দূরত্বে রেখে গিয়েছিলুম। কর্নেল বসে শাবলটা পরীক্ষা করে দেখে বললেন, রহমত! এই শাবলটা তোমার কি চেনা মনে হচ্ছে?

ডিব্বু ঝটপট বলে উঠল, ইয়ে তো ওহি শাবল হ্যায়!

রহমত তার দিকে তাকাল।

এক মাহিনা আগে খুদা বখশ চাচাকো ঘরসে খোয় গেয়া! চাচা তুমকো সাথ ইস লিয়ে বহত্ ঝামেলা কিয়া না? ভুল গেয়া তুম?

রহমত বেজার মুখে আস্তে বলল হামকো কুছ মালুম নেহি থা! হাম কেয়া করেগা?

মির্জাসাহেব এলে ডিব্রু শাবলের ঘটনাটা জানিয়ে দিল। তিনি রহমতের দিকে একবার ক্রুদ্ধদৃষ্টে তাকালেন শুধু। কিছু বললেন না।

মুন্নি কফির ট্রে এনে টেবিলে রেখে পাগলকে দেখতে দেখতে ঘরে ঢুকল। কর্নেল বললেন, শাকিল মিয়াঁকে দেখছি না তো?

মির্জাসাহেব বললনে, ডিব্বু! মিয়াঁসাব কঁহা?

ডিব্বু বলল, বাহার গেয়া সাইকিল লেকে। বোলকে গেয়া, সাত বাজকে লোটেঙ্গে।

মির্জাসাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, সাতটা বাজতে চলল। মিয়াকে বলেছি, যেখানেই যান, সন্ধ্যার আগেই যেন বাড়ি ফেরেন। এই এক অদ্ভুত মানুষ!

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, এই পাগল বোবা। এটাই একটা সমস্যা। ও পীরের সমাধির ওখানে যা কিছু ঘটেছে, সম্ভবত সব দেখেছে। ওর। কাছে সব কথা জানা যেত। কিন্তু–বলে কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলেন।

মির্জাসাহেব বললনে, কিন্তু কী?

 সেহরাগড়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার নিশ্চয় আছেন?

হ্যাঁ। একটা মেন্টাল হসপিটালও আছে। মনোরোগীদের জন্য একটা নার্সিংহোমও আছে।

এখনই ওকে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেন?

পারি ডাক্তার রবীন্দ্র ভার্মার সঙ্গে আগে কথা বলে নিই।

এতক্ষণে উজ্জ্বল আলোয় শাকিল মিয়াঁকে সাইকেলে চেপে আসতে দেখা গেল। তিনি সাইকেল থেকে নেমে সেলাম দিলেন। তারপর পাগলের দিকে চোখ পড়লে হন্তদন্ত বারান্দায় উঠে এলেন। সাইকেল বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। পাগলের দিকে ঝুঁকে কিছুক্ষণ তাকে খুঁটিয়ে দেখার পর শাকিল মিয়াঁ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ইয়া আল্লা কেয়া বদনসিব! ছোটেনবাবসাব! ইয়ে আমি তো তাহির খান! মির তাহির খান। বহত্ আফসোসকি বাত।…

.