সমুদ্রে মৃত্যুর ঘ্রাণ – ৬

০৬.

আমার কফি খাওয়া শেষ হলে কর্নেল বললেন, চলো জয়ন্ত! সমুদ্র দর্শন করে আসি। আজ আকাশ বেশ পরিষ্কার। আশা করি বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না।

আমরা লাউঞ্জে যেতেই ডঃ হাজরা উঠে এসে বললেন, কর্নেল সায়েব! আমার পেপারগুলো পুলিশ শিগগির পাঠাবে তো?

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। সন্ধ্যা ছটার আগেই পেয়ে যাবেন।

পরিমল হাজরা বললেন, ডঃ পাণ্ডে সি-বিচে বেড়াতে গেছেন। যাই! ওঁর সঙ্গে একটু আগাম আলোচনা সেরে নিই।

কর্নেল লনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ডঃ হাজরা রাস্তা পেরিয়ে নিচু বালিয়াড়ির মধ্যে দিয়ে বিচে নেমে গেলেন। তারপর কর্নেল পা বাড়ালেন। আস্তে বললেন, চলো! দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে গিয়ে উঁচু থেকে সমুদ্র দর্শন করব।

বাঁদিকে রাস্তার পূর্বে ত্রিভুজ ভূমির নীচে ঘাসজমিতে গাধাটা চরছে। কিন্তু পাগলাবাবুকে দেখতে পেলুম না। ঝোপ-জঙ্গল আর পাথরের মধ্যে দিয়ে আমরা কাশবনটা ডানদিকে রেখে ধ্বংসস্তূপের কাছে পৌঁছলুম। কর্নেল বললেন, এটা একটা ক্যাসল। আমরা দুর্গপ্রাসাদ বলছি। ওড়িশার কোনো সামন্তরাজা এখানে থাকতেন শুনেছি। তবে স্থাপত্যটা মোগল-ধাঁচের। এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রে সূর্যোদয় দেখলে অবাক হয়ে যাবে।

এই সময় হঠাৎ একটা স্কুপের আড়াল থেকে একজন শিখ ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। থমকে দাঁড়িয়ে গেলুম। কর্নেলও প্যান্টের পকেট থেকে দ্রুত তার সিক্স রাউন্ডার রিভলভার বের করেছিলেন। পরক্ষণে অস্ত্রটা পকেটস্থ করে তিনি তার বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন।

এবার দেখলুম, শিখের পাগড়ি আর নকল গোঁফদাড়ি খুলে পাগলাবাবু আর্তস্বরে বলে উঠলেন, মাইরি মরে যাব! ওরে বাবা! এ কি বিপদ হল?

কর্নেল হাসি থামিয়ে বললেন, এই পাগড়ি আর গোঁফদাড়ি কোথায় পেলেন আপনি?

পাগলাবাবু ভয়ার্তমুখে বললেন, এখানে বালিতে পোঁতা ছিল। ভিজে বালি দেখে ভেবে ছিলুম যখের ধন পুঁতে রেখে গেছে কেউ। মাইরি স্যার! কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল কি না? পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল কি না? বলুন?

হ্যাঁ। রহস্যের অন্ধকার রাত আর নেই। সকাল হয়েছে।

পাগলাবাবু হাসলেন খিটখিট করে। হয়েছে তো? বলুন স্যার? রাতি পোহাইল তো?

অবশ্যই। এবার দিন ওগুলো। হ্যাঁ–কঙ্গন আর কৃপাণটাও দিন।

 কফি খাওয়াবেন বলুন?

 নিশ্চয় খাওয়াব।

তা হলে চুপিচুপি দিই। চুপিচুপি নিন!

কর্নেল জিনিসগুলো নিয়ে বললেন, রাত্রি অনেক আগেই পুইয়ে সকাল হয়েছিল। আমি বুঝতে পারিনি এই যা!

পাগলাবাবু হাত পেতে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন। কর্নেল তার হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিলেন। পাগলাবাবু নোটটা পেয়েই ছিটকে কেয়াঝোপের ধারে গেলেন। তারপর বুড়ো আঙুল নেড়ে বললেন, ব্লা দিয়েছি। মাইরি কেমন ব্লা দিয়েছি! রাতি এখনও মোটেও পোহায়নি! পাখি সব রব করলে তবে। তো?

কর্নেল বললেন, আরো পাঁচ টাকা দেব যদি রাতি পোহায়।

পাগলাবাবু খিটখিট করে হাসতে হাসতে বললেন, তোমার কাছে রিভলভার আছে। ওরে বাবা! তুমি ডেঞ্জারাস লোক। তোমার কাছে আর যাচ্ছি না! বলে তিনি আমার দিকে আঙুল তুললেন, এই যে ভাই! তুমি ওই নোটটা আমাকে দিয়ে যাও না। তোমাকে ব্লাফ দেব না। মাইরি মাকালীর দিব্যি! কাম অন মাই সান! কাম অন!

আমি কর্নেলের হাত থেকে আর একটা পাঁচ টাকার নোট নিয়ে তাঁর কাছে। গেলুম। পাগলাবাবু ফিসফিস করে বললেন, আবার যকের ধন। লেখক হেমেন্দ্রকুমার রায়।

বললুম, যখের ধনটা কোথায় বলুন আগে!

পাগলাবাবু খিটখিট করে হেসে আবার ফিসফিস করে বললেন, গাধার গলায় বেঁধে রেখেছি। মাইরি বলছি! গাধাটাকে আমি তাড়া করে এই জঙ্গলে ঢোকাচ্ছি। ওই বুড়োকে বলো! ওই যে পাগড়ি দিলুম, ওটা খুলে লম্বা করে ব্যাটাচ্ছেলের চারঠ্যাঙে জড়িয়ে কুপোকাত করলেই চিতিং ফক! মাইরি! কী করছ? দাও না টাকাটা। আজ পেটভরে ভাত খাব।

টাকাটা পাগলাবাবুর হাতে দিলুম। উনি তক্ষুনি কেয়াঝোপের ভেতর দিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। কর্নেলকে ওঁর কথাটা বললুম। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আমাকে কেয়াঝোপে ঢুকিয়ে উনি বলেছিলেন, ব্লাফ দিয়েছি! এ-ও হয়তো তা-ই। তবু চলো! গাধাটাকে দেখি।

কেয়াঝোপগুলো ঢালু হয়ে নেমে গেছে। দুজনে তার ভেতর দিয়ে এগিয়ে বুনোফুলের জঙ্গলের ওধারে গাধাটাকে দেখতে পেলুম। কর্নেল চমকে উঠে বললেন, সত্যি তো গাধাটার গলায় ন্যাকড়ায় বাঁধা কী একটা ঝুলছে! পাগলাবাবু গাধাটাকে কাতুকুতু দিয়ে লেজ টেনে উত্ত্যক্ত করছিলেন। বিরক্ত হয়ে গাধাটা বুনোফুলের ঝোপে ঢুকল। কর্নেল পাগড়িটার ক্লিপ খুলে লম্বা করে একটা প্রান্ত আমাকে ধরতে বললেন। অন্য প্রান্তটা তিনি ধরলেন। দশ-বারো হাত লম্বা পাগড়ি। কর্নেলের নির্দেশমতো সাবধানে গাধাটার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালুম। তারপর কর্নেল গাধাটার উল্টো দিক ঘুরে এসে আমার হাত থেকে পাগড়ির একটা প্রান্ত নিলেন এবং দুটো প্রান্ত ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই গাধাটা ঝোপের ভেতর কুপোকাত হল। নিমেষে কর্নেল তার ওপর গিয়ে চেপে বসলেন। তার ওজনদার দেহের ভারে গাধাটা শুধু ঠ্যাং ছুঁড়তে থাকল। কর্নেল তার গলা থেকে ন্যাকড়ার পোঁটলা খুলে নিলেন। গাধার পিঠেনা, পেটে বসেই উনি ছিঁড়ে ফেললেন ন্যাকড়াটা। পলিথিনের একটা প্যাকেট বেরিয়ে পড়ল। প্যাকেটটার মুখ বাঁধা ছিল শক্ত কালো সুতোয়। একটু জায়গা চিরে ফেলে কর্নেল দেখলেন। তারপর বললেন, আবার যকের ধন!

জিজ্ঞেস করলুম, কী ওটা?

 একটা চেন আঁটা ফাইল।

 কৌশল্যাদির সেই–

আবার কী? খুনী এটা এখানেই কোথাও বালিতে পুঁতে রেখে গিয়েছিল। পাগলাবাবু দু-দুবার চোরের ওপর বাটপাড়ি করেছেন।

গাধাটাকে মুক্তি দিয়ে কর্নেল ঝোপের ভেতর দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখে নিলেন। পাগলাবাবু ততক্ষণে কেটে পড়েছেন। তাকে কোথাও দেখতে পেলুম না।

গাধাটা নড়বড় করে পা ফেলে ঘাসজমির দিকে চলে গেল। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! আমি জিনিসগুলো নিয়ে ব্যাকওয়াটারের ধারে গিয়ে বসছি। দুই পায়ের ফাঁকে রাখব। তুমি হোটেলে গিয়ে আমার কিটব্যাগটা নিয়ে এস। ব্যাকওয়াটারের ব্রিজের কাছে নেমে আমাকে দেখতে পাবে। কুইক।

তখনই ঘাসজমি পেরিয়ে রাস্তায় গেলুম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে হোটেলে পৌঁছুলাম। পূর্বাচল হোটেলের লাউঞ্জ তখন প্রায় জনশূন্য। বারের সামনে দুজন প্রৌঢ় টুলে বসে বিয়ার পান করছেন। বিয়ার জগ দেখা যাচ্ছিল ওঁদের হাতে। ক্যান্টিনে একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। চা বা কফি খাচ্ছেন। বুঝলুম আর সব বোর্ডার এখনও সি-বিচে ঘুরছে। বৃষ্টিহীন সুন্দর বিকেলটা ক্রমে ধূসর হয়ে পড়ছে।

স্যুইটের দরজা খুলে কর্নেলের কিটব্যাগ এবং আমার বালিশের তলা থেকে হ্যান্ডব্যাগে রাখা লোডেড ফায়ার আর্মস প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। ক বছর আগে চিৎপুরে একটা স্মাগলিং র‍্যাকেটের খবর দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় ফাঁস করার পর ক্রমাগত ফোনে আমাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। সেই সময় কর্নেলের পরামর্শ ও সুপারিশে এই অস্ত্রটার লাইসেন্স পেয়েছিলুম। কর্নেলের সঙ্গে বাইরে কোথাও গেলে এটা সঙ্গে নিয়ে যাই।

ব্যাকওয়াটারের ধারে কর্নেলকে খুঁজে বের করতে একটু দেরি হয়েছিল। কারণ উনি একটা ঝোপের আড়ালে বসেছিলেন। কয়েকটা জেলে নৌকো ভেসে ছিল। কিন্তু জেলেরা মাছ ধরতে ব্যস্ত।

জিনিসগুলো কিটব্যাগে ভরে কর্নেল ব্যাগটা যথারীতি পিঠে আঁটলেন। তারপর বললেন, চলো! ফিরে গিয়ে পকৌড়া আর কফি খাব। তারপর অন্য কিছু।

হোটেলে ফিরে নবকে পকৌড়া-কফির কথা বলে কর্নেল সিঁড়িতে উঠছিলেন। সেই সময় কৌশল্যাদি নেমে আসছিলেন। বললেন, আপনাদের দুজনকে দুর্গপ্রাসাদের ওখানে দেখছিলুম।

কর্নেল হাসলেন। পাগলাবাবুকে দেখতে পাওনি?

 হ্যাঁ। কিন্তু আমার কৌতুকের মেজাজ নেই। সত্যি বলছি একটু বিরক্ত হচ্ছিলুম। আপনি যেন সিরিয়াসলি আমার প্রব্লেমটা নেননি মনে হচ্ছিল।

পাগলাবাবুর সঙ্গে আলাপ করতে দেখে?

হ্যাঁ। তারপর চোখে পড়ল, আপনারা পাগলাবাবুর সঙ্গে গাধাটাকে জঙ্গলে ঢুকিয়ে জোক করছেন।

এস কৌশল্যা! পকৌড়া-কফি খাবে এবং আমাদের সঙ্গে জোক করবে!

কৌশল্যাদি কষ্টে হাসলেন, না কর্নেল। আমার কেন যেন বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। সন্ধ্যা যত এগিয়ে আসছে, তত ঘরে একা থাকতে ভয় পাচ্ছি।

সেই জন্যই তো ডাকছি তোমাকে। এস।

সুইটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কর্নেল বাতি জ্বাললেন এবং ফ্যান চালিয়ে দিলেন। আমি ব্যালকনির দরজা খুলে দিলুম। কৌশল্যাদি বিষণ্ণ মুখে বসলেন। কর্নেল কিটব্যাগের চেন টেনে বললেন, ম্যাজিক দেখাব কৌশল্যা! চোখ বন্ধ করো।

কৌশল্যাদি বললেন, চোখ বন্ধ করছি না। মুখ ঘোরাচ্ছি।

কর্নেল পলিথিনের মোড়ক চিরে চেন আঁটা লালরঙের ফাইলটা বের করে বললেন, এবার দেখ এটা কী?

কৌশল্যাদি ফাইলটা তক্ষুণি তুলে নিয়ে চেন খুলে দেখার পর বালিকার মতো কেঁদে ফেললেন। আপনি সত্যি আমার পূর্বজন্মের বাবা! কর্নেলের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে তিনি ফাইলটা বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখ থেকে জলের ধারা নামছিল।

কর্নেল বললেন, কচি মেয়ের মতো কান্নাকাটির কী আছে? এবার যা বলছি, মন দিয়ে শোনো! ফাইলের কথা পুলিশকে বলে ফেলে টেনশন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলে। কিন্তু তুমি পুলিশকে জানিয়ে দিও না যে ফাইল ফিরে পেয়েছ। কারণ পুলিশ জানতে পারলে আইনত ফাইলটা ওরা কাস্টডিতে নিয়ে যাবে। তারপর তুমি সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তবে এটা ফেরত পাবে। কাজেই চেপে যাও। ওটা আমার কাছেই নিরাপদে থাকবে। তুমি কবে যাচ্ছ?

আমার তো আজ দুপুরে ডঃ আচারিয়ার সঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল।

পুলিশ তোমার স্টেটমেন্ট নিয়েছে। ঠিকানা নিয়েছে। শ্রাবন্তী মার্ডার মামলায় তোমাকে ভবিষ্যতে কোর্টে আসতে হবে। তুমি কখন গেলে সুবিধে হবে, আমি আজ রাতেই জানিয়ে দেব। যাবার সময় তোমাকে ফাইল ফেরত দেব। তোমাকে স্টেশনে তুলে দিয়ে আসব। চিন্তা কোরো না।

শ্রাবন্তী বেচারির জন্য কষ্ট হচ্ছে। কে তাকে অমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল, তাকে এখনও ধরতে পারল না পুলিশ। আপনি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছেন?

কর্নেল তাঁর হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে তাঁর প্রকাণ্ড ব্যাগে ঢোকালেন। তালা এঁটে দিলেন। তারপর বললেন, এখনও তার চেহারা স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে। দেখা যাক।

দরজা নক করল কেউ। খুলে দেখি, নব পকৌড়া-কফি এনেছে। বললুম, আর একটা কাপ চাই নব!

নব বলল, আনছি স্যার! থানা থেকে এক ভদ্রলোক এসে রিসেপশনে কর্নেল সায়েবের খোঁজ করছেন। বলে সে ঘুরল। এই যে উনি এসে গেছেন!

কর্নেল বললেন, মিঃ সাক্সেনা যে! পটনায়ক সায়েব জিনিসটা পাঠিয়েছেন?

 হ্যাঁ স্যার। এই প্যাকেটে ভরা আছে। প্লিজ, এই রিসিটে সই করে দিন।

কর্নেল সই করে দিয়ে মোড়কটা টেবিলে রাখলেন। মিঃ সাক্সেনা চলে গেলেন কপালে হাত ঠেকিয়ে। কৌশল্যাদি জিজ্ঞেস করলেন, কী ওটা?

কর্নেল বললেন, ডঃ হাজরার কিছু রিসার্চ পেপার শ্রাবন্তীর জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল। উনি ফেরত পাওয়ার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। যাক গে, পকৌড়া আর কফি খাওয়া যাক। জয়ন্ত একটু পরে খাবে। নব কাপ-প্লেট আনুক।

দরজা খোলাই ছিল। নব এল কাপ-প্লেট নিয়ে। তার পেছনে ডঃ হাজরাকে দেখা গেল। উঁকি মেরে বললেন, কর্নেল সায়েব! পুলিশ আমার পেপার পাঠিয়েছে?

পাঠিয়েছে। একটু আইনের ফ্যাকড়া আছে মিঃ হাজরা! আপনি মিনিট পনের পরে ঘরে বসে আপনার পেপার ফেরত পাবেন।

 ডঃ পাণ্ডে রাত সাড়ে আটটায় চেক-আউট করবেন।

 এখনও সময় আছে। প্লিজ! একটু অপেক্ষা করুন গিয়ে।

ডঃ হাজরা রুষ্ট মুখে চলে গেলেন। আমি উঠে গিয়ে দরজা আটকে দিলুম। কর্নেল কফি খেতে খেতে ডঃ হাজরার রিসার্চ পেপারের প্যাকেটটা খুললেন। কোনো ফাইল নেই। একগাদা ফুলস্ক্যাপ সাইজের কাগজে ডটপেনে কী সব লেখা আছে এবং মাঝে মাঝে কিছু স্কেচ আঁকা–আমার পক্ষে তা দুর্বোধ্য।

কৌশল্যাদি মুখ বাড়িয়ে দেখে নিয়ে বললেন, বস্তাপচা তত্ত্ব। বহুবছর আগে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত আণবিক জীববিজ্ঞানী জাক মোদ বলেছিলেন, এবার তিনি গবেষণাগারে মানুষ তৈরি করে ফেলবেন। তাই নিয়ে খুব হইচই পড়ে গিয়েছিল। তারপর অবশ্য জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং চর্চার সূত্রপাত হয়। কিন্তু এখন জিনোম প্রকল্প সেই চর্চার একটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডঃ হাজরার রিসার্চ অবশ্য উদ্ভিদ নিয়ে। এটা আজকাল অনেক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর কাজে লাগতে পারে। জানি না ডঃ হাজরার উদ্ভিদবিদ্যার ডিগ্রি আছে কি না।

কর্নেল কাগজগুলো আগের মতো সাজিয়ে প্যাকেট করলেন। তারপর বললেন, আমি আসছি! তোমরা বসো। আর জয়ন্ত! একটু সাবধানে থেকো।

তিনি ডঃ হাজরার প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বললম, চলুন দিদি, ব্যালকনিতে গিয়ে বসি।

কৌশল্যাদি ব্যালকনিতে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ফাইল তোমরা কোথায় উদ্ধার করলে জয়ন্ত?

বললুম, কর্নেলের মুখে সব শুনবেন। আমার কিছু বলতে মানা।

কৌশল্যাদি শ্বাস ছেড়ে বললেন, কর্নেল সরকার আমার মামা জগদীপ সিনহার বন্ধু। কর্নেলের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল আমেরিকার হিউস্টনে। মামা ওখানে একটা বড় তেল কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আরব গেরিলাদের একটা গুপ্ত সংগঠন সেই অয়েল কোম্পানির শোধনাগারে অন্তর্ঘাতের চক্রান্ত করেছিল। মামা কোন সূত্রে তা জানতে পেরেছিলেন। সেই সময় একটা বাঙালি ক্লাবে দৈবাৎ মামার সঙ্গে কর্নেলের আলাপ হয়। মামা প্রাণভয়ে কোম্পানিকে চক্রান্তের কথা জানাতে পারছিলেন না। কিন্তু তিনি কথায়-কথায় কর্নেলকে জানান। কর্নেলের সামরিক জীবনের এক মার্কিন বন্ধু তখন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পদস্থ অফিসার। কর্নেল তার সাহায্যে গুপ্ত সংগঠনের সব লোককে পাকড়াও করেন। এবার আমি যখন চন্দনপুর-অন-সিতে প্রকৃতি পরিবেশ সম্মেলনে যোগ দিতে আসছি, তখন মামা কলকাতায় কর্নেলকে ফোন করে তাকে আমার কথা বলেন। কারণ আমার রিসার্চের ব্যাপারটা মামা জানতেন। মামা আমাকে পই পই করে নিষেধ করেছিলেন, যেন ঘৃণাক্ষরে আমার গবেষণার ফলাফলের কথা কাউকেও না বলি। আমি আমার পেপার পড়ার সময় মাঝে মাঝে যে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলুম, তাতেই সম্ভবত কেউ জেনে ফেলেছিল আমি কোথায় পৌঁছে গেছি।

বললুম, এতক্ষণে বুঝতে পারলুম কর্নেল কেন সম্মেলনে আসবার আগে এখানকার স্থানীয় পুলিশকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলেন।

এই সময় নীচের রাস্তায় পাগলাবাবুর চিৎকার শোনা গেল। চিচিং ফাঁক! চিচিং ফাঁক-। এই দরজা খুলল। আলিবাবা ঢুকল। তারপর মাথায় এক হাত কোমরে এক হাত রেখে তিনি সেই বিদঘুটে সুরে পদ্যটা গাইতে শুরু করলেন,

‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
মাইরি রাতি পোহাইল
 কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল
মাইরি সকলি ফুটিল
 মাইরি মা কালীর দিব্যি
রাতি পোহাইল..।

তারপর হঠাৎ নাচ-গান বন্ধ করে পাগলাবাবু এই পূর্বাচল হোটেলের দিকে তর্জনী তুলে চেরা গলায় আবার চিৎকার করলেন, চিচিং ফাঁক! চি-ই-ই-চি-ই ই-ইং-ফ-আঁ-আক্‌!

দরজায় কেউ জোরে নক করছিল। দরজা খুলতে গিয়ে মনে পড়ে গেল কনলেন। কর্নেলের কথা। সাবধানে থেকো। তাই আমার প্যান্টের ডান পকেটে পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের রিভলবারের বাঁট ডানহাতে ধরে বাঁহাতে দরজা খুলে দিলুম।

কিন্তু কোনো আততায়ী নয়, হোটেলের ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্র। বললুম, কী ব্যাপার মিঃ মহাপাত্র?

তিনি বললেন, কর্নেল সায়েব আছেন?

না। উনি সম্ভবত তিনতলায় ডঃ হাজরার স্যুইটে গেছেন। কিছু বলতে হবে?

ম্যানেজার আস্তে বললেন, ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ক আমাকে ফোন করে জানালেন, প্লেন ড্রেসে কয়েকজন পুলিশ এখনই হোটেলে আসছে। একজন এস আই তাদের নিয়ে যাচ্ছেন। গাড়ি দূরে রেখে তারা হেঁটে এখানে আসবেন। আইডেনটিটি কার্ড দেখাবেন এস আই। আমি যেন তাদের লাউঞ্জে ঢুকতে দিই। কর্নেল সায়েবকে ওঁর বলা আছে। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি। আবার কী হাঙ্গামা বাধাবে পুলিশ। হোটেলের সুনাম নষ্ট হবে।

কথাগুলো শুনে চাপা উত্তেজনা জেগেছিল মনে। মুখে নির্বিকারভাব ফুটিয়ে বললুম, কী আর করবেন মিঃ মহাপাত্র? হোটেলে একটা মার্ডার হয়েছে। একটু হাঙ্গামা সহ্য করতেই হবে।

ম্যানেজার ভদ্রলোক জোরে শ্বাস ফেলে নীচে নেমে গেলেন। দরজা বন্ধ করে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলুন। কৌশল্যাদি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে জয়ন্ত?

বললুম, আবার পুলিশ আসছে শুনে ম্যানেজার বিব্রত বোধ করছেন।

 পুলিশ আসছে। তার মানে তদন্ত করে কোনো নতুন তথ্য পেয়েছে ওরা।

 সম্ভবত।

কৌশল্যাদি একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, খুনী ফাইলচোর হয়তো এখনও এই হোটেলে আছে।

থাকতেই পারে। আমরা দুজন, আপনি, তারপর হাজরা দাম্পতি এবং ডঃ পাণ্ডে এই ছজন বাদে আর পাঁচজন বোর্ডার এখন হোটেলে আছেন। সেই পাঁচজনের মধ্যে কেউ বলেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আচ্ছা কৌশল্যাদি, আপনি আজ সকাল বা দুপুরে হোটেলের আশেপাশে কোনো শিখ ভদ্রলোককে দেখেছিলেন?

কৌশল্যাদি একটু চমকে উঠে বললেন, শিখ ভদ্রলোক?

হ্যাঁ। মাথায় পাগড়ি, মুখে গোঁফ-দাড়ি, হাতে বালা আর কোমরে কৃপাণ। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন।

হা, হ্যাঁ। ব্যালকনি থেকে দেখেছিলুম, এই হোটেলের দক্ষিণে যে ঢিবিটা আছে, সেখানে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা একটা পথ আছে দেখেছি। সেই পথ ধরে একজন শিখ ভদ্রলোক নেমে আসছিলেন। তারপর নীচের রাস্তায় একটা অটোরিকশা ভাড়া করে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তখন দশটা বা সওয়া দশটা হবে। কিন্তু কেন একথা জিজ্ঞেস করছ তুমি?

একটু হেসে বললুম, যথাসময়ে জানতে পারবেন। কিন্তু কথাটা আগে যদি—

কী বলছ বুঝি না! আগে বলার কী কারণ ছিল? তোমরা তো জিজ্ঞেস করনি। তা হলে বলতুম।

দরজায় কেউ নক করল আবার। দুবার। তবু সতর্কভাবে দরজা ফাঁক করে দেখলুম, কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন। সরে এলুম।

কর্নেল দরজা বন্ধ করে বললেন, ডঃ হাজরা তার রিসার্চ পেপার পেয়ে খুব খুশি। আমাকে সঙ্গে নিয়ে পাশেই ডঃ পাণ্ডের স্যুইটে গেলেন। তারপর ডঃ পাণ্ডে রিসার্চ পেপার দেখতে দেখতে হঠাৎ বললেন, ওই পাগলাবাবুটি সাংঘাতিক লোক। বিকেলে দুর্গপ্রাসাদের ওখানে তিনি সমুদ্র দর্শনে গিয়েছিলেন। হঠাৎ পাগলাবাবু একটা পাথরের আড়াল থেকে উঠে একটা বাঁকা ছুরি বের করে হুমকি দিল, পকেটের টাকা আর রিস্টওয়াচ খুলে দাও। নইলে প্রাণে মারা যাবে। ডঃ পাণ্ডে মাথা ঠাণ্ডা রেখে তাকে ঘড়ি খুলে দেবার ছল করে আচমকা একটা পাথর তুলে মারতে যান। তখন বজ্জতটা পালিয়ে যায়।

বললুম, হা, হা দৃশ্যটা আমি ব্যালকনি থেকে দেখেছি।

কর্নেল বললেন, কিন্তু ডঃ পাণ্ডে একটা আশ্চর্য কথা বললেন। সেই বাঁকা ছুরিটা নাকি একটা কৃপাণ। একমাত্র শিখরাই ওই কৃপাণ ব্যবহার করেন। কৃপাণের খাপটা একটা কাপড়ের ফিতের সঙ্গে বাঁধা ছিল। কথাটা শুনে আমি বললুম, ডঃ পাণ্ডে কি এলাকায় কোনো শিখ ভদ্রলোককে দেখেছেন? ডঃ পাণ্ডে চমকে উঠে বললেন, পার্বতীর মন্দিরে যাবার সময় তিনি হোটেলের দক্ষিণ দিকের জঙ্গলের পথে একজন শিখকে আসতে দেখেছিলেন।

কৌশল্যাদি বলে উঠলেন, আমিও দেখেছি। ওই জঙ্গলের পথে সে। আসছিল। জয়ন্তকে বলছিলুম।

.