৬. ভূতের পাহাড়ে সাইরেন

০৬.

ভূতের পাহাড়ে সাইরেন

 সেদিন বিকেল নাগাদে আমার সব অভিমান জল করে দিয়ে কর্নেল বিছানার পাশে বসে আমার হাত ধরলেন এবং বললেন–জয়ন্ত ডার্লিং! এবার আমরা যথারীতি বেড়াতে বেরবো। আশা করি, একপ্রস্থ চমৎকার স্যুট তুমি পরবে। বাইরে কী চমৎকার দৃশ্যরাজি! এ বুড়োর মনেও আজ রঙ ধরেছে।

ভাল করে তাকিয়ে দেখি, কর্নেল যেন কোন উৎকৃষ্ট হোটেলে জাঁকালো পার্টিতে চলেছেন! বাটনহোলে একটি লাল গোলাপও খুঁজেছেন। সবিস্ময়ে বললুম-অস্যার্থ?

ডার্লিং! প্রকৃতির কাছ থেকেই তো মানুষ সবকিছু শিখেছে। এমন কিছু দেখাতে পারবে না, যার মূল আইডিয়ার জন্য প্রকৃতির কাছে মানুষ ঋণী নয়। সুতরাং, যদি তোমার চোখ থাকে এবং মাথার ধূসর পদার্থবিশেযে কোন সৌন্দর্যবোধ থাকে, তাহলে দেখবে এই ডিসকমিউনিকেটেড বাণেশ্বরের প্রকৃতি সমস্ত ধ্বংসযজ্ঞের পর আবার কী নতুন সাজে সেজেছেন। লুক জাস্ট লুক!

জানলা দিয়ে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে গেলুম। রাতের ঝড়বৃষ্টির পর অনেকদিনের মালিন্য ধুয়েমুছে চারপাশে এক উজ্জ্বল বর্ণসমারোহ জেগে উঠেছে। দুপুর অবধি অতটা লক্ষ্য করিনি। কারণ, জয়সোয়ালজির যুক্তি এবং অধ্যাপকের কাণ্ড নিয়ে যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিলুম। এখন উঠে কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি সেজে নিলুম।

কর্নেল সেই অবসরে পাশের ঘরে গেলেন–অবশ্যই জয়ন্তীর খোঁজে। আমি যখন কর্নেলের দেখাদেখি বাটনহোলে ফুলদানি থেকে একটা গোলাপ তুলে নিয়ে গুঁজছি, উনি ফিরে এসে বললেন–চমৎকার জয়ন্ত! অপূর্ব দেখাচ্ছে তোমাকে!

জয়ন্তী যাচ্ছেন তো?

কর্নেল হাসলেন। জয়ন্তীর কথা তুমি জিগ্যেস করবে, জানি। কিন্তু খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি বন্ধু শ্ৰীমতী জয়ন্তী তার ঘরে নেই।

–মেয়েটার সাহস তো বড্ড! একা কোথায় বেরলো?

–স্ত্রীলোকের গতিবিধির খবর দেবদূতেরাও টের পান না। যাকগে জয়ন্ত, এ নিয়ে দুঃখ করো না! চলো, এই বুড়োই আজ তোমাকে চাঙ্গা রাখবে।

কপট রাগ দেখিয়ে বললুম–জয়ন্তীর জন্যে আমার বয়ে গেছে! ওর ঘরে আজ কে কীসব খোঁজাখুঁজি করেছিল, সেইজন্যেই আমার মাথাব্যথা।

কর্নেল মৃদু হেসে বললেন–মাথাব্যথায় কোন লাভে নেই। চলো, আমরা রওনা দিই!

সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় ম্যানজার শিবপ্রসাদের সঙ্গে দেখা হল। কর্নেল বাও করে বললেন–গুড আফটারনুন প্রসাজি!

–গুড আফটারনুন, স্যার! আপনার কাছেই যাচ্ছিলুম।

বলুন।

–মিস রায়ের ঘরে আজ যে ঢুকেছিল বা জিনিসপত্র হাতড়েছে, তাকে। আমাদের বেয়ারা হরিয়া দেখেছে স্যার! কিন্তু ওর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না।

-তাই বুঝি? কে সে?

প্রফেসর দ্বিবেদী।

কর্নেল হো-হো করে হেসে উঠলেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলুম। বললুম প্রফেসর দ্বিবেদী জয়ন্তীর ঘরে ঢুকেছিলেন? সে কী!

শিবপ্রসাদ কী বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল আমার হাত ধরে টানলেন–ও-কে মিঃ প্রসাদ! আপনাকে যথেষ্ট ধন্যবাদ!

-স্যার, যাই বলুন, এটা তো হোটেলের সুনামের পক্ষে ক্ষতিকর। কাজেই আমি ভাবছি, ভদ্রলোককে ডিরেক্ট চার্জ করব। কী জবাব দেন, শোনা দরকার।

প্লিজ মিঃ প্রসাদ! ছেড়ে দিন। আমি অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলে দেখব। খন। এ নিয়ে আর উত্তেজিত হবেন না! ব্যাপারটা চেপে যান।

বলে কর্নেল, ম্যানেজার আর আমি নীচে এলুন। লাউঞ্জের শেষপ্রান্ত অবধি আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন ম্যানেজার। পথে নেমে বললুম–এ তো ভারী অদ্ভুত ব্যাপার, কর্নেল! অধ্যাপক দ্বিবেদী আরেক কাণ্ড করছিলেন। শুনুন–

আমাকে বাধা দিয়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দা বলে উঠলেন–জয়ন্ত, জয়ন্ত! ব্রিলিয়ান্ট! আজকের পশ্চিম আকাশটা লক্ষ্য করছ? চলো, আজও আমরা ওই ভূতের পাহাড়ে গিয়ে সূর্যাস্ত দেখব। পা চালিয়ে চলো! কুইক!

এই বলে আমার হাত ধরে সত্যিসত্যি কুইক মার্চ করে চলতে থাকলেন কর্নেল। চড়াই-উতরাইয়ের রাস্তা। হাঁফ ধরে যাচ্ছিল আমার। অথচ ওঁর যেন এতটুকু পরিশ্রম হচ্ছে না। একসময় বললুম–এত তাড়া তো একটা টাঙ্গা করে নিলেই হত!

কোন জবাব পেলুম না। ভূতের পাহাড় সামনে দেখা যাচ্ছিল। এত ছোটাছুটির পর ওই পাহাড়ে উঠতে পারব কি না আমার সন্দেহ হচ্ছিল। বড় রাস্তা ছেড়ে আগের দিন যেখানে উঠতে শুরু করেছিলুম, সেখানে এসে কর্নেল এতক্ষণে মুখ খুললেন। জয়ন্ত, এবার তোমায় আমায় কিছুক্ষণের জন্যে ছাড়াছাড়ি হবে।

অবাক হয়ে বললুম–তার মানে?

তুমি কালকের চেনা পথ ধরে চুড়োয় উঠবে। আমি উত্তরদিকটা ঘুরে উঠতে চাই। কোন ভয় নেই। সূর্যের আলো থাকতে ভূতরা আক্রমণ করবে না। নেহাত যদি করে বসে, আশা করি আত্মরক্ষা করতে বারবে। ওক্কে?

–কিন্তু ব্যাপারটা কী?

–কিছু না। জাস্ট এ গেম। চিলড্রেনস গেম! দেখ জয়ন্ত, মাঝেমাঝে শিশু হয়ে যাওয়ার মতো নির্মল আনন্দ আর কিছুতে নেই! ওতে বয়স কমে যায়। আচ্ছা, অ রিভোয়া!

অর্থাৎ আবার দেখা হবে, বিদায়! কর্নেল ধীরেসুস্থে পাহাড়ের ঢালু গা বেয়ে উত্তর দিকে এগোলেন। আমি সেই চেনা জায়গাগুলো পেরিয়ে পাহাড়ে পুবগায়ে চড়া শুরু করলুম। ঝরণা ডাইনে রেখে বড় বড় গাছগুলোর ভিতর দিয়ে একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটা পাথরের আড়ালে কী যেন নড়ে উঠল। অমনি গা শিরশির করে উঠল। হৃৎপিণ্ডে একটা অস্থিরতা জাগল। এ পাহাড়ের নাম ভূতের পাহাড় যখন, তখন নিশ্চয় কিছু অদ্ভুত ঘটনা লোকে এখানে ঘটতে দেখেছে। এখন কথা হচ্ছে, পাথরের আড়ালে একটা কিছু নড়তে আমি দেখেছি। কী হতে পারে সেটা? জন্তুজানোয়ার নয় তো? সূর্য পাহাড়ের ওপাশে নেমে গেছে। এপাশটা তাই ইতিমধ্যে বেশ ছায়াছায়া হয়ে পড়েছে। তাতে ঘন গাছপালা থাকায় দৃষ্টি বাধা পাচ্ছে এবং গাছের তলায় আবছা অন্ধকারও জমে রয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করলুম। মিনিটখানেক পরে বুঝলুম, পাথরের ওপাশে একটা জ্যান্ত কিছু অবশ্যই আছে এবং সেটা আবার নড়ল।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করে পকেট থেকে বিপদআপদের সঙ্গী রিভলভারটা বের করলুম। গুলি পোরা ছিল না। সুতরাং অস্ত্রটা আঘাত হানার জন্য তৈরি করে নিতে বেশ সময় লাগল। অবশ্য, অটোমেটিক রিভলবার। পর পর ছবার গুলি ছোঁড়া যায়। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার পক্ষ থেকে সেবার এক দুর্দান্ত আন্তর্জাতিক স্মাগলিং চক্র ধরে দেওয়ায় পুরস্কারস্বরূপ সরকার আমাকে এই অস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছিলেন।

এবার পা টিপে টিপে এগোলুম সেদিকে। জায়গায় জায়গায় পাথর থাকায় বাধা পাচ্ছিলুম। তবে ঢালু বলে উঠতে অসুবিধা হচ্ছিল না। হাত দশেক ডাইনে ঘুরে এবার পাথরটার সোজাসুজি পৌঁছুলুম। পরক্ষণে অবাক হয়ে গেলুম। জয়ন্তী!! এ যে জয়ন্তী!!

এত অবাক যে অন্তত এক মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম ওর দিকে কিন্তু ও কী করছে সে? হেঁট হয়ে একটা কিছু করছে, তার ফলে ওর শরীরটা ঝাঁকুনি খাচ্ছে। হ্যাঁ, এই নড়াচড়াটিই আমার চোখে পড়েছিল বটে!

পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দেখি, সে একরাশ নুড়িপাথর নিয়ে যেন খেলা করছে। এই পাহাড়ের খাঁজ মতো জায়গায় ওইরকম অজস্র নুড়িপাথর জমে থাকতে দেখেছি। সম্ভবত বৃষ্টির সময় যখন পাহাড়ের গা বেয়ে জল গড়ায়, তখন মাটি ধুয়ে যাবার ফলে ছোট ছোট পাথরের টুকরো নেমে এসে খাজগুলোতে আটকে থাকে। যুগ যুগ ধরে এইরকমটি ঘটে এসেছে এবং বৃষ্টিধারা ও বাতাসের আঘাতে পাথরগুলো মসৃণ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এই জনমানুষহীন ভুতুড়ে পাহাড়ে একা জয়ন্তী কি ওই ছেলেখেলা করতেই এসেছে? বিশেষ করে প্রেতশক্তিতে তার বদ্ধমূল বিশ্বাস আছে। তাছাড়া তার একমাত্র অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সাথী এই দূর প্রবাসে ওইভাবে ভয়ঙ্কর মৃত্যুবরণ করেছে। এত কাণ্ডের পরও কী সাহসে সে এখানে একা এল?

ওকে চমকে দেবার ইচ্ছে ছিল না। তাই জুতোয় সামান্য শব্দ করলুম। কিন্তু সে এত তন্ময় যে তা টেরও পেল না। তখন একটু কেশে উঠলুম।

এবার সে সাঁৎ করে ঘুরল এবং উঠে দাঁড়াল। পরক্ষণে তার মুখে অপ্রস্তুত হাসি ফুটে উঠল। সে হাতে দুটো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল–বাব্বা! আমি ভাবলুম বুঝি অধ্যাপক দ্বিবেদী।

এ কথায় আরো অবাক হয়ে বললুম–ওঁর বদলে শ্রীমান জয়ন্ত চৌধুরী! কিন্তু হঠাৎ ওই নিরীহ ভদ্রলোকের কথাই বা ভাবলেন কেন বলুন তো?

জয়ন্তীকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল–আমি আসার একটু আগে দূর থেকে ওঁকে উঠতে দেখেছিলুম! আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?

না তো!

জয়ন্তী পা বাড়িয়ে বলল–চলুন, ওপরে যাই। আজও সূর্যাস্ত দেখা যাক।

–চলুন।

একটু পরেই জয়ন্তী অদ্ভুত কৌশলে আমাকে ছাড়িয়ে কত সহজে অনেকটা ওপরে উঠে গেল। ওর পক্ষে এ অবশ্য স্বাভাবিক। পাহাড়ে চড়ায় ওর দক্ষতা আছে। ওপর থেকে সে ঘুরে ডাকল আমাকে। তাড়াতাড়ি আসুন! সূর্য ডুবে যাবে যে!

চুড়োয় যখন উঠলুম, তখন যথারীতি হাঁফাচ্ছি। হাঁফ সামলানোর পর জয়ন্তীর কাছাকাছি এগিয়ে বসে পড়লুম। তারপর বললুম-ওখানে কী করছিলেন জয়ন্তী দেবী?

জয়ন্তী পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল। একটু চমক লক্ষ্য করলুম ওর মুখে। কিন্তু নিস্পৃহ কণ্ঠস্বরে বলল–ওঠার পথে এমন সুন্দর নুড়িগুলো দেখলুম। অমনি বালিকাসুলভ খেয়াল জেগে উঠল।

–তাহলে বলব, আপনি নিশ্চয় বাল্যজীবনটা গ্রামেই কাটিয়েছেন?

–ঠিক তাই। একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ে। কিন্তু এ প্রশ্ন কেন?

 –শহরের মেয়েদের বাল্যজীবনে ধুলোপাথর নিয়ে খেলা সম্ভব নয়, তাই!

–আপনি গোয়েন্দার উপযুক্ত শিষ্য জয়ন্তবাবু।…বলে জয়ন্তী এবার হালকা ভঙ্গিতে হেসে উঠল।

সিগারেট ধরিয়ে বললুম–তা হঠাৎ একা-একা বেরিয়ে পড়লেন যে! কর্নেল আসবার সময় আপনার ঘরে গিয়ে খুঁজেছিলেন আপনাকে।

কর্নেলসায়েব এসেছেন নাকি? কোথায় তিনি?

–এই পাহাড়ের নীচে দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। তারপর তার খবর এ পর্যন্ত পাইনি।

হঠাৎ জয়ন্তী পশ্চিমে একটু ঝুঁকে নীচের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চাপা গলায় বলল–দেখনু তো জয়ন্তবাবু, ওই যে নীচের খাড়াই পাথরের মাথায় ছোট্ট চাতালে, ওই লোকটা কে?

ওর নির্দেশমতো ঝুঁকে দেখি পাহাড়ের পশ্চিম ঢালে খাড়া দেয়ালের নীচে অন্তত তিনশো ফুট দূরত্বে জয়সোয়ালজি দাঁড়িয়ে আছেন একা। অবাক হয়ে বললুম–সর্বনাশ! ওখানে পৌঁছলেন কীভাবে ভদ্রলোক?

জয়ন্তী বলল–জানেন? ওখানেই মোহন পারেখকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আরো একটু ঝুঁকলে ব্যাপারটা টের পাবেন। কিন্তু সাবধান, মাথা ঘুরে যাবার চান্স আছে।

বাপস! সেই অতল খাদের শূন্যতার কোন তুলনা হয় না! সত্যি মাথা ঘুরে যাবার দশা হল। সামলে নিয়ে সরে এলুম। বললুম–ওই খাদে পারেখজিকে ফেলে দিয়েছিল তা আপনি কীভাবে জানলেন?

জয়ন্তী চোখ নামিয়ে একটু হাসল-গোয়েন্দা সায়েবের শিষ্য- তাহলে আমার দিকে সবসময় কড়া নজর রেখেছেন, বলুন?

ওর ওই কটাক্ষ আর হাসিতে যৌবনের উগ্র আঁজ ছিল। পলকে আড়ষ্ট হয়ে বললুম-ছি, ছি! কী যে বলেন! জাস্ট একটা কৌতূহল। কারণ আমিও

জানি না, কোন খাদে পারেখজির বড়ি পাওয়া গেছে।

জয়ন্তী হয়তো বিশ্বাস করল আমার কথা। বলল–আজ সকালে যখন আপনি ঘুমোচ্ছিলেন, কর্নেলসায়েবের সঙ্গে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি, তা জানেন কি?

–তাই বলুন। আমি ভাবলুম

জয়ন্তী চাপা দুষ্টুমি করে ব্যস্তভাবে বললবলুন, বলুন। ভাবলেন যে আমিই পারেখজিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলুম!

ওর চোখে চোখ রেখে বললুম–আপনি তা পারেন জয়ন্তী!

 জয়ন্তীর চোখ দুটো জ্বলে উঠল।–পারি মানে?

প্রেমিকের আবেগ এসে গেল আমার কণ্ঠস্বরে। –পারেন! যেমন–এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমাকেও কোন অতল খাদে ফেলে দিয়েছেন এবং আমি রক্তাক্ত হয়ে ধুকছি!

জয়ন্তী কথাটা বুঝল। কিন্তু অভিনয়টা ধরতে পারল না। তাই অমনি মুখটা লাল হয়ে উঠল। সে একটু ঘুরে গিয়ে বলল–আমার কি অত সাহস বা শক্তি আছে? সামান্য মেয়ে আমি।

–আমি অসামান্যা জয়ন্তী, যত দেখছি আপনাকে, অবাক হচ্ছি।

–কেন শুনি?

–কোন কৈফিয়ত দিতে পারব না। তবে আমার এই অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ আমার বৃদ্ধ বন্ধুটির চোখ এড়ায়নি। আজ শ্ৰীমতী মালহোত্রার ঘরে উনি আমাদের কী বলে সম্ভাষণ করেছিলেন, মনে পড়ছে?

জয়ন্তী সুন্দর হেসে অস্ফুটস্বরে বলল–জয়জয়ন্তী!

 আমার সংকল্প ছিল যে সুযোগ পেলে হাতের চেটো নিতে কার্পণ্য করব না। বিশেষ করে এই নির্জন পাহাড়ের চূড়া, পশ্চিমে চমৎকার একটা অস্তরাগ, এবং এই যুবতী মেয়েটি মিলে আমার মধ্যে একটা হঠকারিতার উপদ্রবও সৃষ্টি করছিল। তাই খেলার ছলে ওর হাতের চেটো নিলুম, কী প্রতিক্রিয়া হবে জানতুম না, একটা রিস্ক নিতে হল বৈকি কিন্তু আশ্চর্য, জয়ন্তী চুপ করে থাকল। এবার ওকে চাপা স্বরে ডাকলুম–জয়ন্তী?

–উঁ?

–আপনি আমাকে গোয়েন্দার শিষ্যটিষ্য বলবেন না, প্লিজ।

জয়ন্তী ঘুরে সুন্দর হাসল আবার। তবে কী বলব?

–মিতা!

–কারণ?

–কারণ দুজনের একই নাম।

এই সময় সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। সেই রাঙা আলোয় জয়ন্তীকে বড় সুন্দর দেখাল। আরো একটু হঠকারিতায় আমি তাকে মৃদু আকর্ষণ করলুম, জয়ন্তী বাধা দিল না। এবার ওর মুখের দিকে ঝুঁকে চুমু খাবার জন্যে যেই মুখ নামিয়েছি, পেছনে, কোথায় কর্নেলের কাশির শব্দ আর সম্ভাষণ শুনতে পেলুম। গুড ইভনিং জয়ন্ত, গুড ইভনিং জয়ন্তী!

দুজনে ছিটকে দুপাশে সরে গেলুম তক্ষুনি জয়ন্তী আমার দিকে কপট ক্রোধে একটু কটাক্ষ করল। ঘুরে দেখি, উত্তরের ঝোপের ডগায় কর্নেলের টুপি যেখা যাচ্ছে। বাহাত্তুরে বুড়ো! মনে মনে ওঁর মুণ্ডুপাত করতে করতে উনি এসে, গেলেন।

বেরোবার সময় শরীরের কোথায় বাইনাকুলার আর ক্যামেরা লুকিয়েছেন জানি না, এখন দেখি সুদৃশ্য ইভনিং স্যুটের ওপর বেখাপ্পা হয়ে ওই জিনিস দুটো ঝুলছে। বোঝা গেল, চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানতে ছাড়ে না!

–যাকগে, জয়জয়ন্তী তাহলে পর্বতশীর্ষে! ব্র্যাভো! ওয়ান্ডারফুল!…বলে কর্নেল কাঠেই একটা পাথরের চাতালে পা ঝুলিয়ে বসলেন।

জয়ন্তী অপ্রস্তুত অবস্থায় ছিল। এবার বলল–আপনি কি উত্তর দিক হয়ে উঠলেন?

–হ্যাঁ।

–কিন্তু ওদিকটা যে ভীষণ খাড়া।

–তাতে কী? ওঠার একটা গোপন পথ আমি আবিষ্কার করেছি। ওই পথে মোড় নিয়ে ওই নীচের খাদের চাতালে যাওয়া যায়, যেখানে এখন মিঃ রঘুবীর জয়সোয়াল রয়েছেন!

বলে কর্নেল বাইনাকুলারটা চোখে নিয়ে কিছুক্ষণ জয়সোয়ালকে দেখলেন।

জয়ন্তী বলল–আমরা অনেক আগেই দেখেছি ভদ্রলোককে। ওখানে কী করছেন উনি?

আমি বললুম-রিটায়ার্ড পুলিস সাহেব তদন্ত করতে গেছেন।

কর্নেল হেসে উঠলেন। তবে তদন্ত করতে আরো অনেকে এখন এই ভূতের পাহাড়ে চড়েছেন মনে হচ্ছে।

জয়ন্তী চমকে উঠে বলল–আর কে?

–মিসেস মালহোত্রা আর অধ্যপক অরিন্দম দ্বিবেদী। ভদ্রমহিলা আছেন একেবারে খাদের তলায়। তাই খালি চোখে ওঁকে দেখা কঠিন। অধ্যাপক আছেন, জয়সোয়ালজির অন্তত একশো ফুট নীচে একটা খোঁদলে।

বললুম–মিসেস মালহোত্রা খাদে কী করছেন? সর্বনাশ! অবসেসনের অবস্থায় ওখানে চলে যাননি তো?

জয়ন্তী বলল–অধ্যাপকমশায়ই বা খোঁদলে কী করছেন?

কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন-মনে হচ্ছে, প্রত্যেকেই ব্যস্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি করছেন যে পর পর এই দুটো হত্যাকাণ্ডের পিছনে সত্যিসত্যি কী ব্যাপার আছে।

বললুম–তার মানে, মিসেস মালহোত্রাও প্রেতের হাতে মৃত্যু সম্পর্কে নিঃসন্দিগ্ধ নন?

কর্নেল বললেন–এ ছাড়া আর কিছু ব্যাখ্যা দিতে পারছিনে, জয়ন্ত। যাকগে, এখন সূর্যাস্তের প্রতি আমাদের দৃষ্টি ফেরানো উচিত নয় কি? দেখ তো, কত পবিত্র কত মহান এক ঐশ্বরিক প্রকাশ ওই প্রকৃতির রূপ। জয়ন্ত, জয়ন্তী, এখন আমরা কিছুক্ষণের জন্যে সবরকম পার্থিব কলুষতা ভুলে যাই এসো। ওইদিব্য আলোর মধ্যে জীবনের গভীর আনন্দ খুঁজে নিই।

.

বসে থাকতে থাকতে শিগগির সন্ধ্যার অন্ধকার এসে গেল। ভারতের সমতলে আমরা সূর্যাস্তের পরও বেশ কিছুক্ষণ যে অপূর্ব শান্ত আলো দেখি অর্থাৎ যাকে বলা হয় গোধূলিকাল, এইসব উঁচু পাহাড়ী এলাকায় তার নামমাত্র নেই। খুব শিগগির রাত্রি এখানে হানা দেয়। তবে আমরা একটা পাহাড়ের মাথায় বসে আছি বলে নীচের দিকটা যখন ঘোর কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে, এখানে তখনও সামান্য আবছা ধরনের আলো ছিল। জয়ন্তী এবার বলে উঠল– নামতে অসুবিধে হতে পারে। এখন ফেরা যাক, কী বলেন কর্নেল?

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন হঠাৎ। তারপর বললেন–প্লিজ জয়ন্তী, আর একটুখানি তোমাদের আটতে রাখতে চাই। আমি ফেরা না অবধি তোমরা দুজনে অপেক্ষা করো, এই আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ।

কর্নেলের কথা বলার ধরনই ওইরকম। বললুম, আবার কোথায় যাবেন?

–একটুখানি দরকার আছে। কোন প্রশ্ন করো না, জয়ন্ত।

জয়ন্তী বলল–আপনি কি ওঁদের কারো সঙ্গে আলাপ করতে যাচ্ছেন?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তুমি বুদ্ধিমতী জয়ন্তী। আমি জয়সোয়ালজির কাছেই যাচ্ছি। আর জয়ন্ত, তোমাকে আরেকটা কথা বলতে চাই। মন দিয়ে শোন।

বলুন।

–আমি চলে যাবার পর প্লিজ, একটুখানি কান তৈরি রাখো। যদি আমার কোন ডাক শোন, তক্ষুণি চেঁচিয়ে সাড়া দেবে এবং শব্দ লক্ষ্য করে দৌড়ে যাবে। কেমন?

আমরা গা শিউরে উঠল। ব্যাপার কী? কিন্তু জানি, খুঁটিয়ে কোন জবাব এখন উনি দেবেন না। তাই বললুম-ঠিক আছে।

–আশা করি তোমার দুটো কানই সম্পূর্ণ সুস্থ, জয়ন্ত?

–নিশ্চয় সুস্থ!

–তবু বলছি, অতিরিক্ত আত্মপ্রত্যয় মানুষকে অনেক সময় ঠকায়। তাই দরকার হলে এই যুবতীটির কানের প্রতি নির্ভর করবে। জয়ন্তী, তুমি কী বলে?

জয়ন্তীও এই দায়িত্ব পেয়ে খুশি হল যেন। বলল–দেখুন কর্নেল, পর্বতাভিযানে আমাদের কানই সবসময় বড় সহায়। সামান্য শব্দ থেকে আঁচ করতে হয়, কোথাও ধস ছাড়তে যাচ্ছে কি না, কিংবা তুষারঝড় আসছে কি না!

কর্নেল খুব উৎসাহী হয়ে বললেন–এক্সেলেন্ট! এটা আমি ভাবিইনি। ও কে, অ রিভোয়া!

উনি যেপথে উঠে এসেছিলেন, অর্থাৎ উত্তরদিকে সেদিকেই ঝোপঝাড় ঠেলে দ্রুত অদৃশ্য হলেন। তারপর আমার অস্বস্তি হতে থাকল। কেন অতক্ষণ। ধরে কান নিয়ে অত কথা বলেন কর্নেল? এখন মুশকিল হচ্ছে, এখানে প্রচণ্ড জোরে দক্ষিণের বাতাস বইছে। ক্রমশ বাতাসটা বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় উত্তরের কোন শব্দ শুনতে পাওয়া অসম্ভব নয় কি? কথাটা এতক্ষণে মাথায় এল। তাছাড়া উনি গেলেন উত্তরের খাড়াইয়ের নীচের দিকে। ওখান থেকে কোন চিৎকার শোনা যাবে কি না সন্দেহ আছে।

কথাটা জয়ন্তীকে বলতেই সে বলে উঠল–তাই তো! চলুন, আমরা আরো এগিয়ে উত্তরের খাড়াইয়ের মাথায় কোথাও বসি।

দুজনে এগিয়ে গেলুম। এই সময় টের পেলুম, বাতাসটা জোর বেড়ে গেছে। সোজা দাঁড়িয়ে থাকা যেমন কঠিন, পা বাড়ানোও তাই। তাতে ঘন রিঙ্গেল ঝোপে ভর্তি জায়গাটা। ঝোপে ঢুকতে গিয়ে জয়ন্তী বলল–কী কাণ্ড! আমরা নিশ্চয় কেউ টর্চ আনিনি?

অস্বস্তি বেড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। টর্চ আনার কথা মাথায় আসেনি! কিন্তু কর্নেলের কাছেও তো টর্চ আছে বলে মনে হল না। ঘাড় নেড়ে জবাব দিলুম নাঃ!

অবশ্য কর্নেলের কথা আলাদা। উনি এক অলৌকিক প্রাণী বলা চলে। এই সময় আরো মনে হল, এসব পাহাড়ে নাকি অজগর, শঙ্খচূড় বা চন্দ্রবোড়া সাপের খুব উৎপাত আছে। এ কী মুশকিলে ফেলে গেলেন কর্নেল! পাছে সাপের কথায় জয়ন্তী আঁতকে ওঠে, ওকে কিছু বললুম না।

কিন্তু ওর সাহসের পরিচয় পেয়ে ততক্ষণে অবাক আমি। দিব্যি রিঙ্গেল ঝোপের ভিতরে ঢুকে গেল জয়ন্তী। তারপর ডাকল–চলে আসুন শিগগির।

পুরুষমানুষের আঁতে লাগল নিশ্চয়। লম্বা পা ফেলে এগিয়ে ওকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলুম। তখন জয়ন্তী খপ করে আমার হাত ধরল।আস্তে, মশাই, আস্তে! কখনও পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিয়েছেন কি? আমাকে ফলো করুন তাহলে। নয়তো পড়ে গিয়ে ঘাড় ভাঙবেন।

অন্ধকারে ওর চাপা খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছিল। প্রকৃতির সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি যে নারী, তা এমন করে কখনও টের পাইনি! ওকে মনে হচ্ছিল রহস্যময় এক শক্তি–যা আমাকে কোন ভয়ঙ্কর বিনাশ অথবা আনন্দময় এক। পূর্ণতায় পৌঁছে দিতে চলেছে।

অবশ্য এই আবেগ সামলে নিতে হচ্ছিল। কারণ, সময় ও পরিবেশ প্রেমের অনুকূল নয় এখন। একটু পরেই জয়ন্তী দাঁড়াল। বলল–এই পাথরটায় বসা যেতে পারে। কিন্তু সাবধান, সামনে ঝুঁকবেন না।

অন্ধকারে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে টের পেলুম, একটা চ্যাটালো দশ বর্গফুট আন্দাজ পাথর ঝোপের শেষ প্রান্তে উঁচু হয়ে রয়েছে। জয়ন্তীর দৃষ্টিশক্তি যে বিস্ময়কর, তাতে আর সন্দেহ রইল না। আমার হাতটা ছেড়ে দেয়নি সে। টেনে বসিয়ে দিল পাশে। তারপর আমার দিকে ঘুরে কিছু বলতে চেষ্টা করল। সেই সময় ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ এসে লাগল–আমার সারা মুখে সেই বিচিত্র গন্ধটার ঝাপটানিতে একটা প্রচণ্ড তোলপাড় সৃষ্টি করল। এবার স্থানকাল ভুলে ঝটপট ওকে চুমু খেয়ে ফেললুম। জয়ন্তী আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল যাঃ, এখন অসভ্যতা করে না!

বুঝতে পারছিলুম, অন্ধকারে ও কতখানি রাঙা হয়ে উঠেছে। আমি প্রেমিকের গলায় ডাকলুম–জয়া!

জয়ন্তী হাসল।–আমার ডাকনামটা কীভাবে জানতে পারলে, শুনি?

–গতকাল বিকেলে এখানে শ্যামলী ওই নামে তোমাকে ডেকেছিল।

জয়ন্তী অমনি আমার মুখে হাত চাপা দিল।–চুপ! এখন শ্যামলীর কথা বলো না।

না–শ্যামলী মানেই এক বীভৎস মৃত্যু। এখন ওর স্মৃতি সহ্য করা যাবে না। এই বিচিত্র সন্ধ্যা বিস্বাদ হয়ে পড়বে। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললুম–দেখ জয়া, তোমার হাতে আমার কান দুটোরও জিম্মা দিলুম। কারণ আমি এখন কিছুক্ষণ অন্যজগতে ঢুকে পড়তে চাই। তুমি কিন্তু শুনতে পেলেই আমাকে বলবে!

জয়ন্তী হয়তো হাসল। –উঁহু। আমি তো গোয়েন্দামশায়ের শিষ্য নই। সে দায় তোমার!

ঠিক সেই সময় বাতাসটা ঘুরে গেল এবং এলোমেলো বইতে থাকল। তারপই আমার চোখ গেল পশ্চিমের আকাশে। ওদিকের কয়েক হাজার ফুট উঁচু পাহাড়গুলোর ওপর কিছু আগেও অনেক নক্ষত্র দেখেছি, এখন তাদের একটাও নেই এবং খুবই কালো মেঘের ব্যাপকতা ঘনিয়ে উঠেছে। তারপর আচমকা বিদ্যুৎ ঝিলিক দিতে দেখলুম। সর্বনাশ। কালকের মতো ঝড় উঠবে নির্ঘাত! জয়ন্তীও বলে উঠল–এই রে! কী হবে।

জয়ন্তীর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল মেঘ। বাতাস একেবারে উল্টোদিকে ঘুরল। দেখতে দেখতে চারপাশের পাহাড় ও জঙ্গলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। মনে হল লক্ষ লক্ষ হাতি হঠাৎ খেপে গিয়ে দৌড়ে আসছে। আবার ভয়ঙ্কর শব্দে মেঘ ডাকল। থরথর করে কাঁপতে থাকল এই পাহাড়টা। তারপরই এসে পড়ল ঝড়।

সেই ভয়াবহ তাণ্ডবের বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। দুজনে দুজনকে শক্ত করে ধরে বসে আছি, তা না হলে ছিটকে পড়ব মনে হচ্ছে। জয়ন্তী ভয়ার্ত স্বরে বলল–জয়ন্ত, আমাদের এখনই এখান থেকে নেমে যাওয়া দরকার। বৃষ্টি শুরু হলেই কিন্তু ধস ছাড়ার সম্ভাবনা।

কর্নেলের জন্যে রাগ হল। বললুম–বুড়োর পাল্লায় পড়ে বেঘোরে প্রাণটা যাবে দেখছি। এখন কী করা যায়, বুঝতেও তো পারছিনে! ওঁকে বরং চেঁচিয়ে ডাকি, কী বলো?

জয়ন্তী বলল–হ্যাঁ। তাছাড়া কোন উপায় নেই! সাড়া যদি পাও, বলে দাও, আমরা নেমে যাচ্ছি।

ডাকবার জন্যে মুখের কাছে হাত তুলে চোঙ বানিয়েছে, অমনি সে এক অদ্ভুত আর অমানুষিক আওয়াজ শুনতে পেলুম। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্ত হিম হয়ে পড়ল। জয়ন্তী রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল–ও কিসের শব্দ? কিসের শব্দ জয়ন্ত?

অ-উ-উ-উ! অ-উ-উ-ই! কতকটা সাইরেরেন মতো– বিপদজ্ঞাপক কাঁপা কাঁপা সুর, কিংবা কোন গুহার ভেতরে কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী যেন ওই দানবীয় ডাক ছাড়ছে।

এদিকে মুহুর্মুহু বাজ পড়ার বিরাম নেই। দূরে একটা দাবানল দেখা গেল পাহাড়ের মাথায়। ঝড়ের ভয়ঙ্কর শব্দে এই পাহাড়টা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে, এই কুখ্যাত পাহাড়ের যুগযুগান্তকালের ভূতপ্রেতের দল যেন জেগে উঠেছে। তারা দল বেঁধে অমানুষিক কণ্ঠে গর্জন করছে অ-উ-উ-উ! আঁ-উ-উ-উ!

আর এক মুহূর্তও এখানে নয়। বললুম–গোল্লায় যাক বুড়ো। জয়ন্তী, ওঠ কুইক!

জয়ন্তী উঠে পড়ল। আমরা দুজনে সামনে ঝুঁকে হাত ধরাধরি করে সেই ওঠার পথটা অনুমান করে এগিয়ে গেলুম। একখানে ঢালু পেতেই নামতে শুরু করলুম। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল। পথ আন্দাজ করতে অসুবিধে হচ্ছিল না। পিছনে ভুতুড়ে আওয়াজটা সমনে শোনা যাচ্ছিল। এবার সেই উঁচু গাছের জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই জয়ন্তী হঠাৎ বলে উঠল-জয়ন্ত, এক মিনিট!

আমার হাত ছেড়ে দিয়ে সে যেন একটা লাফ দিল সামনে। তারপর তাকে অদৃশ্য হতে দেখলুম। অমনি আরো ভয় পেয়ে ডেকে উঠলুম–জয়া, জয়া!

বিদ্যুৎ ঝলক দিল। তখন দেখতে পেলুম, জয়ন্তী সেই নুড়িগুলোর কাছে হাঁটু দুমড়ে বসে রয়েছে। আমি আন্দাজে সেদিকে এগোতেই ওর সঙ্গে ধাক্কা লাগল। সে আমার হাত ধরে টানল। আর নয়! চলে এসো!

তারপর সে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় প্রায় দৌড়তে শুরু করল জঙ্গলটায় মধ্যে। এখানে জমি কিছুটা সমতল। তারপর ঘাসেভরা ঢালু জমিটা পেরিয়ে একেবারে নীচে গিয়ে পৌঁছলুম আমরা। সেখান থেকে আবার এক দৌড়ে সোজা পাকা রাস্তায় ওঠা গেল।

এবার জয়ন্তী দাঁড়াল। নীচে ঝড়ের প্রকোপ কিছু কম। একটা বড় প্রশ্বাস পড়ল দুজনের। জয়ন্তী বলল–সেই ভুতুড়ে আওয়াজটা আর কিন্তু শোনা যাচ্ছে না।

কান পাতলুম ঠিক তাই বটে। কিন্তু এবার বাতাসে কিছু ঠাণ্ডা ভাব টের পাওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টি আসবে নির্ঘাত! বললুম-কর্নেলের জন্যে অপেক্ষা করে লাভ নেই, জায়া। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুকুরের মতো ভেজার চেয়ে চলো আমরা হোটেলে ফিরে যাই।

জয়ন্তী বলল–কিন্তু কী ভাববেন উনি?

–যা খুশি ভাবুন! আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই।

–যাব?

ওর হাত ধরে টানলুম। –পাগল! কর্নেলকে তুমি চেনো না। উনি একাই একশো।

অগত্যা জয়ন্তী পা বাড়াল। কিছুটা যাবার পর সে বলল–ওই বিকট আওয়াজটা কিসের বলে মনে হল তোমার?

–সম্ভবত ওদিকের সামরিক ছাউনিতে সাইরেন বাজাচ্ছিল। ঝড়ের জন্যে হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল।

–ভ্যাট! সে ছাউনি কমপক্ষে সাত মাইল দূরে। আওয়াজটা কিন্তু ভূতের পাহাড়ের পশ্চিম গায়ে উঠছে মনে হল আমার।

–বেশ, তুমিই বলো ও কিসের আওয়াজ?

–তুমি তো অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করো না। বলে কী হবে?

বিশ্বাস করছি, অন্তত তোমার খাতিরে।

জয়ন্তী আমার গালে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল–এই দুঃসময়ে অত প্রেমের বাতিক কেন তোমার? এবার বুঝলুম, কেন ওটাকে সবাই ভূতের পাহাড় বলে।

–হুঁ। ঝড়ের সময় সম্ভবত ওই আওয়াজ শোনা যায় তাই। তো ইয়ে, জয়া বলো তো, ওই নুড়িগুলোর রহস্য কী? কেন ওখানে তুমি হঠাৎ ঝাঁপ দিলে?

জয়ন্তী একটু চুপ করে থাকার পর বলল বলব। চলো, আগে হোটেল পৌঁছই ভালোয় ভালোয়।

–ভালোয় ভালোয় কেন?

সাবধানে চারিদিকে লক্ষ্য রেখে এগোচ্ছ তো? আমার ক্রমশ একটা অন্যরকম অস্বস্তি হচ্ছে।

ভয় নেই, আমার কাছে আত্মরক্ষার ভাল ব্যবস্থা আছে। এই দেখ।

 জয়ন্তীর একটা হাত আমার প্যান্টের পকেটে এগিয়ে দিলুম। অস্ত্রটা পরখ করে দেখে সে বলল-ব্যাপারটা তোমাকে বলা যেতে পারে। কর্নেল আমাকে অধ্যাপক দ্বিবেদীর দিকে নজর রাখতে বলেছিলেন। আজ বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ওঁকে বেরোতে দেখে আমি পিছু নিলুম। দেখি, উনি ভূতের পাহাড়ের দিকে চলেছেন। আমি নীচের একটা বাঁকে গাছের আড়াল থেকে দেখলুম, পাহাড়ের গায়ে বড় গাছের জঙ্গলটার ভেতর থেকে বেরিয়ে উনি সেই খাঁজটার কাছে গেলেন। তখন আমিও পাহাড়ে চড়া শুরু করলুম। এসব পাহাড় আমার কাছে হাতের চেটোর মতো। দু-তিন মিনিটে জঙ্গলের শেষ দিকটায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখি, অধ্যাপক নুড়িগুলো ঘাঁটছেন। একটু পরে উনি হাত ঝাড়তে ঝাড়তে চলে এলেন। পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লুম। দেখলুম, উনি ঝরনার দিকে চলে গেলেন–উত্তর দিকে। তখন আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা। করার পর নুড়িগুলোর কাছে গেলুম। খাঁজের গর্তে একগাদা নুড়ি জমে। রয়েছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারলুম না। আমি ওগুলোর তলা অবধি সাফ করেছি, তুমি গিয়ে হাজির হলে। যাই হোক, ততক্ষণে রহস্যটা ধরা পড়েছে। অধ্যাপক একটা খাম লুকিয়ে রেখে গেলেন। তুমি এসে পড়ায় খামটা নেওয়া হল না।

অভিমানী স্বরে বললুম–তুমি তো অদ্ভুত জয়া। আমাকে অবিশ্বাস করলে। আশ্চর্য তো! আমি…

কথা আটকে গেল ক্ষোভে। জয়ন্তী আমার কাঁধে হাত রেখে বলল–বিশ্বাস করো, এত ভেবে কিছু করিনি। আমি এমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলুম যে কর্নেলকে জানানোর আগে কাকেও বলা উচিত হবে কি না ভেবে পাইনি। বেশ তো, এখন বললুম।

–খামটা ফেরার পথে নিয়ে এলে তাহলে?

–হুঁউ।

–কই, দেখি।

–এখানে নয়, হোটেলে ফিরে দেখাব।

–না, জাস্ট একবার ছুঁয়ে আঁচ করে দেখি না, কী আছে?

–একটা হালকা খাম। চিঠিফিটি আছে হয়তো।

–জয়া, একবার প্লিজ ছুঁতে দাও! কই, কোথায় রেখেছ?

—ভ্যাট! কুতুকুতু লাগছে।

-কোথায় রেখেছে, বলোই না বাবা!

বুকে। মেয়েরা যেখানে গোপনীয় জিনিস রাখে!

–জেদের বশে ওর ব্লাউজের ভেতর হাত ঢোকাতে যাচ্ছি, আচমকা পিছনে কর্নেলের গম্ভীর আওয়াজ–জয়ন্ত, অসভ্যতা করে না।

আচমকা ওই আওয়াজ শুনেই ছিটকে সরে দাঁড়িয়েছিলুম। কর্নেল এগিয়ে এসে বললেন জয়ন্তী, শীগগির খামটা দাও। তুমি বড্ড অসাবধানী।

জয়ন্তীও চমকে উঠেছিল। –কর্নেল।

–হ্যাঁ, খামটা দাও। আর দেখ বৃষ্টি আসছে। তিনজনেই এবার দৌড়তে শুরু করি।

জয়ন্তী বুকের ভিতর থেকে বের করে জিনিসটা দিল। পকেটে পুরেই কর্নেল বললেন কুইক মার্চ!

হ্যাঁ, ঝড়টা কমে এসেছে। কালকের মতো ভয়ঙ্কর ঝড় আজ আর হল না। কিন্তু বৃষ্টির গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। আমরা তিনজনে জোর কদমে হোটেলের দিকে এগিয়ে গেলুম।

লাউঞ্জে ডঃ সীতানাথ পট্টনায়ক আর মিঃ খান্না বসেছিলেন। কর্নেলকে দেখে খান্না বললেন–কতক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছি আপনার।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তাই বুঝি! এক মিনিট–আমি এই তরুণ বন্ধুদুটিকে বিদায় দিয়ে এক্ষুণি আসছি।

ঘরে এসে আমি ও জয়ন্তী ক্লান্তভাবে বসে পড়লুম। বাইরে তখন জোর বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কর্নেল বললেন-আবার আমি কিছুক্ষণের জন্যে বিদায় নিচ্ছি। অ রিভোয়া! তোমাদের সময় আনন্দময় হোক।

উনি বেরিয়ে গেলে জয়ন্তী আমার দিকে তাকাল। আমিও তাকালুম ওর দিকে। দুজনেই খামটার কথা ভাবছি, তাতে কোন ভুল নেই।

একটু পরে দুজনেরই একসঙ্গে ফোঁস করে দুটি দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তারপর জয়ন্তী আমার বিছানায় গড়িয়ে পড়ে বলল–কফি বলে দাও জয়ন্ত। বড্ড ক্লান্ত।

ফোনটা তুলে রুম সার্ভিসের নম্বর ডায়াল করতে থাকলুম। বৃষ্টির সুন্দর শব্দে এখন বাণেশ্বরের আরেকটি রাত মুখর হয়ে উঠেছে।