সমুদ্রে মৃত্যুর ঘ্রাণ – ৩

০৩.

 এ যাবৎ কর্নেলের সঙ্গী হয়ে অনেক খুন-খারাপি দেখেছি। তা ছাড়া সাংবাদিকদের তো কত বিচিত্র বা বীভৎস দৃশ্য দেখতে হয়। তাই শ্রাবন্তীর মৃতদেহ দেখে তৎক্ষণাৎ আমার মনে কোনো বিকার জাগেনি। পুলিশের সঙ্গে ফোটোগ্রাফার এবং ডাক্তার এসেছিলেন। ফোটোগ্রাফার যথারীতি বাথরুমে ঢুকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ক্যামেরার শাটার টিপছিলেন। ফ্ল্যাশবালব ঝিলিক দিচ্ছিল। তারপর ডাক্তার লাশ পরীক্ষা করে শ্রাবন্তীকে মৃত ঘোষণা করেছিলেন। ডঃ হাজরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি লাশ শনাক্ত করেছিলেন। কৌশল্যাদিও পুলিশের কাছে কর্নেলের কথামতো বিবৃতি দিয়েছিলেন। তারপর ও সি মিঃ জেনা এবং ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পট্টনায়ক স্যুইটের ভেতরটা তন্নতন্ন খুঁজে কোনো ক্লু বের করার চেষ্টা করেছিলেন। জানি না তারা কিছু পেয়েছিলেন কি না। ব্যালকনিতে গিয়ে দুই পুলিশ অফিসার কর্নেলের সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলার পর ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, কাল সকাল নটা পর্যন্ত হোটেলের কোনো বোর্ডার যেন চেক-আউট না করেন তা তিনি যে-ই হোন বা তার ট্রেন-বাস ফেল হোক। রাতভর হোটেল ঘিরে পাহারা দেবে পুলিশবাহিনী।

ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সে শ্রাবন্তীর লাশ চালান দেওয়া হয়েছিল। কৌশল্যাদি ওই স্যুইটে থাকতে পারবেন না বলায় ম্যানেজার দোতলায় একটা খালি সিঙ্গল স্যুইটের ব্যবস্থা করেছিলেন। নীচের লাউঞ্জে পুলিশ অফিসারদ্বয় ডঃ হাজরাকে একান্তে ডেকে তার বিবৃতি নেওয়ার পর তিনি তিনতলায় তার ১৯ নম্বর স্যুইটে চলে যান। শ্রাবন্তীর বাড়ির ঠিকানা তার কাছে জেনে পুলিশের পক্ষে থেকে কলকাতায় খবর যাবে।

শ্রাবন্তীর বিছানায় বালিশের তলায় তার পার্স ছিল। কিন্তু সুইটের ডুপ্লিকেট চাবি পাওয়া যায়নি। স্যুইটের দরজায় ইন্টার লকিং সিস্টেম। তাই চাবি ঢোকানোর ছিদ্র ও সি মিঃ জেনা গালা দিয়ে বন্ধ করে সিল করে দিয়েছিলেন। দরজার সামনে দুজন কনস্টেবল দুটো চেয়ারে বসে বাকি রাতের জন্য পাহারা দিচ্ছিল। অত রাতে শ্রাবন্তীর ব্যাগেজ পরীক্ষার মেজাজ ছিল না পুলিশের।

রাত সাড়ে বারোটায় কর্নেল আর আমি নিজেদের স্যুইটে ফিরে শুয়ে পড়েছিলুম। আমার ঘুম আসতে চাইছিল না। বারবার জীবিত শ্রাবন্তীকে মনে পড়ছিল। তাকে তত খুঁটিয়ে লক্ষ্য না করেও এটুকু বুঝতে পেরেছিলুম ওই ছিপছিপে গড়নের মোটামুটি সুন্দরী মেয়েটি মেধাবী এবং নিশ্চয় আণবিক জীববিজ্ঞানে তার উচ্চস্তরের ডিগ্রি আছে। হয়তো নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। অনেক লড়াই করে তাকে মাথা তুলতে হয়েছিল। ডঃ হাজরা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। তার সহকারী হওয়ার যোগ্যতা তো তার থাকার কথা। হা-ডঃ হাজরার চরিত্রদোষ আছে। প্রায় বাবার বয়সী এই বিজ্ঞানীর পাল্লায় পড়ে হতভাগিনী শ্রাবন্তীকে অনেক বজ্জাতি হাসিমুখে সহ্য করতে হয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, সে কেরিয়ারের স্বার্থেই ডঃ হাজরার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কিংবা চাকরি ছেড়ে দিতে পারেনি।

হঠাৎ কর্নেলের একটা কথা মনে পড়েছিল। পাগলাবাবুকে কফি খাইয়ে এসে কথাপ্রসঙ্গে কর্নেল বলছিলেন যে, কারো ব্যাপারে তার নাক গলানোর ইচ্ছে নেই। তারপর আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন বিজ্ঞানী কোথায় ঘুরছেন, সেই বিবরণ দিয়ে প্রশ্নটা প্রকারান্তরে চেপে দিয়েছিলেন।

তা হলে দেখা যাচ্ছে, নিশ্চয় তার চোখে অর্থাৎ বাইনোকুলারে কোনো রহস্যজনক ব্যাপার ধরা দিয়েছিল।

তারপর কৌশল্যাদির গুরুত্বপূর্ণ ফাইল উধাও হয়ে গেল এবং বাথরুমে শ্রাবন্তীর লাশ দেখা গেল।

ধুরন্ধর বৃদ্ধকে কাল সকালে উত্ত্যক্ত করতেই হবে। তার চেয়ে বড় অদ্ভুত ব্যাপার, এখানে আসার পর কিংবা হয়তো কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার আগেই তিনি স্থানীয় পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। কেন?

কেউ দরজায় নক করছিল। উঠে বসে দেখি, খোলা ব্যালকনি দিয়ে ঝলমলে রোদ ঢুকছে ঘরে। সাতটা বাজে। কখন ঘুম এসেছিল কে জানে! কর্নেলের বিছানা খালি। দরজা খুললে হোটেল বয় নব বেডটি দিয়ে গেল। বললুম, নীচে কী হচ্ছে নব?

নব বলল, পুলিশ বোর্ডারদের একে-একে ডেকে জেরা করছে। নাম-ঠিকানা জেনে নিচ্ছে। স্যার! এমন ঝামেলা পূর্বাচলে কখনও হয়নি।

কর্নেলকে দেখেছ?

 উনি ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ অফিসাররা ওঁকে বেরুতে বাধা দেয়নি।

অন্যদের বেরুতে দিয়েছে?

না স্যার! আপনাদের দুজনকে দিয়ে মোট এগারোজন বোর্ডার। দোতলা থেকে চারতলায় সিঙ্গল আর ডাবল সুইট মিলে মোট বারোটা। তিনতলার ১৭ নম্বর এখন খালি। দরজায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছে।

বোর্ডাররা কি ক্যান্টিনে এখন?

 কেউ কেউ ক্যান্টিনে, কেউ-কেউ লনে বসে আছেন।

 ঠিক আছে। তুমি এস।

নব পা বাড়াতে গিয়ে ঘুরল। আস্তে বলল, একটা কথা পুলিশকে বলতুম। কিন্তু ম্যানেজার সায়েব বলেছেন, হোটেলের কোনো স্টাফ কোন বেফাঁস কথা পুলিশকে না বলে। তাই বলিনি। কিন্তু আপনি কর্নেল সায়েবের সঙ্গে এসেছেন। আপনাকে বলছি। কর্নেল সায়েবকে বলার হয়তো সুযোগ পাব না। আপনি আমার হয়ে বলবেন। তবে স্যার, আমি সামান্য স্টাফ। কথাটা যে আমিই বলেছি, তা যেন পুলিশের কানে না যায়।

তুমি আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পারো।

নব উঁকি মেরে দরজার বাইরে করিডর দেখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কাল সন্ধ্যার একটু আগে যখন বৃষ্টি পড়ছিল, তখন খুন হয়ে যাওয়া ভদ্রমহিলা ভিজতে ভিজতে লাউঞ্জে এসে ঢুকলেন। তার পেছন-পেছন আপনার বয়সী এক ভদ্রলোক ঢুকল। তারপর দুজনে রিসেপশনে গেল। আমি রিসেপশনে বোর্ডারদের অর্ডার মতো চা-কফি-পাকৌড়ার স্লিপ নিচ্ছিলুম। কানে এল ভদ্রমহিলা বলছেন, আপনাদের একটা সিঙ্গল স্যুইট খালি আছে দোতলায়। সেটা এঁকে দিন। রিসেপশনে কমলাদি আর দাসবাবু ছিল। তারা বলল, ওটা রিজার্ভ আছে। দেওয়া যাবে না। ভদ্রলোক চলে গেল।

জিজ্ঞেস করলুম, সিঙ্গল সুইটটা কি সত্যি রিজার্ভ ছিল? ওখানে তো গতরাত থেকে কৌশল্যাদি আছেন।

নব বলল, সেই কথাটাই তো বলছি স্যার! ওই ভদ্রলোককে নাকি কমলাদি আর দাসবাবু দুজনেই চেনে। দুজনেই বলছিল, লোকাল ছেলে। নিউ চন্দনপুর টাউনশিপে বাড়ি ওর। স্ফুর্তি মারতে চায়। মহিলা ওর পাল্লায় পড়েছে। সাবধান করে দিতে হবে।

নব চলে গেলে শ্রাবন্তীর যে ইমেজ মনের ভেতর গড়ে তুলেছিলুম, তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। শ্রাবন্তী কি তা হলে খারাপ মেয়ে ছিল?

দরজা বন্ধ করে ব্যালকনিতে বসলুম। চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে নীচের লনে উঁকি দিলুম। দেখলুম, ডঃ পাণ্ডে তাঁর বয়সী এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বেঞ্চে বসে কথা বলছেন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও কয়েকজন পুরুষ ও নারী। কেউ পায়চারি করছেন। কেউ গম্ভীর মুখে বসে আছেন।

মেঘ ফুঁড়ে সূর্য নরম রোদ ছড়াচ্ছে। এখন হাওয়া কম। তবু এখানকার সমুদ্র সবসময় বিক্ষুব্ধ। দুরে সমুদ্রের জলে রোদ প্রতিবিম্বিত হয়ে তরল সোনার লাবণ্যে পরিণত। অনেক দূরে একটা সাদা জাহাজ একবার দেখা দিচ্ছে, একবার। ঢেউয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ছে। বিচে এবং ডানদিকের বালিয়াড়িতে যারা আছে। তারা অন্য সব হোটেলের লোক।

একটু পরে বাঁদিকে দুর্গপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের উত্তরপ্রান্তে বৃদ্ধ প্রকৃতিবিজ্ঞানীকে আবিষ্কার করলুম। তিনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে খাড়ির নীচে ব্যাকওয়াটার দেখছেন মনে হল। তারপর চোখে পড়ল কাল বিকেলে দেখা একই দৃশ্য। পাগলাবাবু গাধাটার পেছনে লেগেছেন। গাধাটা উত্ত্যক্ত হয়ে কেয়াঝোপের ভেতর ঢুকে গেল। পাগলাবাবুও ঠুকলেন। তারপর সম্ভবত কালকের মতো গাধাটার লাথি খেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। পিচ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে তিনি আঙুল তুলে হুমকি দেওয়ার পর কর্নেলকে দেখতে পেলেন। অমনি ঝোপঝাড় কাশবনের ভেতর দিয়ে চড়াই ভেঙে তিনি কর্নেলকে সহাস্যে কিছু বলে হাত বাড়ালেন। অবাক হয়ে দেখলুম, কর্নেল তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন।

তাদের ওপর সরাসরি রোদ পড়ায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

পাগলাবাবু কর্নেলকে দুহাত নেড়ে কিছু বোঝাচ্ছিলেন। তারপর কর্নেল সোজা ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে নেমে এলেন। পাগলাবাবু তার পেছনে। একটু পরে ওখানে উঁচু ও ঘন কেয়াবনের ভেতর দুজনেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

খানিক পরে দুজনকে পিচরাস্তায় দেখতে পেলুম। হোটেলের নীচে বাঁদিকে রাস্তার ধারে বিচে যাওয়ার পথের সঙ্গমস্থলে রোডসাইড কাফে। কর্নেল পাগলাবাবুকে এক কাপ কফি দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে হোটেলের গেটে এলেন।

গেটের নীচে পুলিশভ্যান এবং গেটে পুলিশ প্রহরী। কর্নেলকে তারা স্যালুট ঠুকল। তারপর কর্নেল হোটেলের নীচে অদৃশ্য হলেন।

কিন্তু তিনি ওপরে এলেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে কফি পান শেষ করে পাগলাবাবু পেপার কাপটিকে কিক করে দূরে ফেললেন। তারপর শুরু হল তার নাচ-গান :

‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
মাইরি রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।
মাইরি, সকলি ফুটিল
পাখি সব করে রব, মাইরি বলছি–রাতি পোহাইল’—

 রোড-সাইড কাফে এবং পুলিশভ্যানের লোকেরা দৃশ্যটা ভিড় করে উপভোগ করছিল।

কিছুক্ষণ পরে নাচ-গান থামিয়ে পাগলাবাবু ঊধ্বশ্বাসে দৌড়ালেন। কেন দৌড়ালেন বুঝতে পারলুম। গাধাটা কেয়াঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। গাধাটা কি বেওয়ারিশ?

দৃশ্যটা দেখা হল না। দরজায় নক করল কেউ। দুবার নক মানে কর্নেল। দরজা খুলে দেখলুম, তিনিই বটে। অভ্যাসমতো বললেন, মর্নিং জয়ন্ত। আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।

একটু হেসে বললুম, মর্নিং বস্! দুর্গপ্রাসাদের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্যাকওয়াটারে কি আবার কোনো লাশ দেখছিলেন?

কর্নেল ক্যামেরা আর বাইনোকুলার টেবিলে রেখে বসলেন। বললেন, ব্যাকওয়াটারে জেলেদের মাছধরা দেখছিলাম।

আস্তে বললুম, একটু গোয়েন্দাগিরি করার সুযোগ পেয়েছি। অবশ্য এতে আমার কৃতিত্ব নেই। নবচন্দ্রের ভলান্টারি কনফেসন। কাল সন্ধ্যার আগে বৃষ্টির সময় শ্রাবন্তীর সঙ্গে সেই যুবক

আমাকে হতাশ করে ধুরন্ধর রহস্যভেদী বললেন, ম্যানেজার মিঃ মহাপাত্র আমাকে জানিয়েছেন। যুবকটি নিউ চন্দনপুরের বাসিন্দা। তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, সে মাছব্যবসায়ী মহীতোষ বিশ্বাসের ভাগনে অমল রায়। কলেজে নাকি কেমিস্ট্রিতে ভালো রেজাল্ট করেছিল। কিন্তু ফিল্মের নেশায় আর এগোতে পারেনি। সে থাকে ভুবনেশ্বরে। মাঝে মাঝে বাড়ি বেড়াতে আসে। মামার সাহায্যে সে সমুদ্রবিজ্ঞান অফিস থেকে তার ডিগ্রির ডকুমেন্ট দেখিয়ে কনফারেন্সের ডেলিগেট কার্ড জোগাড় করেছিল।

বললুম, ভেবেছিলুম আপনাকে চমকে দেব। আমার দুর্ভাগ্য!

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, এবার তোমাকে একটু চমকে দিই। একটুখানি চমক মাত্র। কৌশল্যার ডাবলবেড সুইট অর্থাৎ ১৭ নম্বরের ব্যালকনির ঠিক নীচে ফুলের ঝোপে ডুপ্লিকেট চাবিটা পড়েছিল। ছটায় বেরিয়ে গিয়ে আমি ওটা আবিষ্কার করেছিলুম! এখন দিয়ে এলুম ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পটনায়ককে।

ওখানে চাবি কেন ছুঁড়ে ফেলেছিল খুনী?

খুনীর চাবি ছুঁড়ে ফেলার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তাই আমার ধারণা, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খেলার ছলে চাবিটা শ্রাবন্তী আঙুলের ডগায় নাচাচ্ছিল। হটাৎ হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল। অনেকের এই চাবি নাচানো অভ্যাস থাকে। তবে এ থেকে সিদ্ধান্ত করা যায়, খুনী তার সঙ্গেই ঢুকেছিল এবং শ্রাবন্তী সদ্য দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে লক্ষ্য করছিল কৌশল্যাকে। কারণ কৌশল্যা দুর্গপ্রাসাদ থেকে নেমে রাস্তার উল্টোদিকে হোটেল দ্য শার্কে ডঃ আচারিয়ার সঙ্গে গল্প করছিলেন। তখন বৃষ্টি পড়ছিল।

হ্যাঁ। কৌশল্যাদি বলছিলেন মনে পড়ছে।

এখন কথা হল, অমল সুইট খালি নেই শুনে তখনই বেরিয়ে যায়। রিসেপশনকর্মী কমলাদেবী আর দণ্ডধর দাস অমলকে চেনেন। অমলকে তারা তাদের রাত নটা পর্যন্ত ডিউটির সময়ে আর দেখতে পাননি। কাজেই অমল খুনী হতে পারে না। বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন।

একটু পরে তিনি বেরিয়ে এসে বললেন, চলো! আটটা দশ বাজে। ক্যান্টিনে গিয়ে কফি খাওয়া যাক। মহীতোষবাবুকে ভোরবেলা রিসেপশন থেকে ফোনে হোটেলের ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে দিয়েছি। আজকের দিনটা হোটেলেই থাকছি। কাল সকালে ওঁকে ফোনে জানাব, ওঁর বাড়ি যাওয়া হচ্ছে কি না।

প্যান্ট-শার্ট পরে নিয়ে বললুম, পুলিশ বোর্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে কোথায়?

বারের কাছে। হ্যাঁ–ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে দাও। ঘরে আমার দামি ক্যামেরা ইত্যাদি আছে।

তা দিচ্ছি। তবে দিনদুপুরে দোতলার ব্যালকনিতে পুলিশের চোখের সামনে চোর ঢুকবে না।

কর্নেল হাসলেন। সমুদ্র থেকে ভূত এসে ঢুকতে পারে। কত চোর এই সমুদ্রে ডুবে মরে যে ভূত হয়নি, তা কে বলতে পারে? সেই ভূত সব লণ্ডভণ্ড করে পালাক, এটা ঠিক নয়।

সিঁড়িতে নামবার সময় আমার বুদ্ধিসুদ্ধি খুলে গেল। বললুম, হ্যাঁ। মাঝে মাঝে এই সমুদ্র সত্যি ভুতুড়ে হয়ে ওঠে। আচমকা প্রচণ্ড হাওয়া এসে ঘরের জিনিসপত্র উল্টে ফেলে। পরশু অ্যাশট্রেটা উল্টে পড়েছিল। অত ভারি পাথরের অ্যাসট্রে!

তুমি বোঝো সবই জয়ন্ত! তবে একটু দেরিতে!

লাউঞ্জের দক্ষিণপ্রান্তে বারের সামনে পুলিশের রীতিমতো অফিস বসেছে। টেবিলের তিনদিকে তিনটে চেয়ার! ও সি এবং ডিটেকটিভ ইন্সপেকটর দুটো চেয়ারে বসেছেন। একটা চেয়ারে বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পরনে টাইট–সম্ভবত কোনো ব্যবসায়ী বোর্ডার।

ক্যান্টিনে ঢুকে দেখলুম, ডঃ হাজরা এবং পাণ্ডে গম্ভীর মুখে চাপা গলায় কথা বলছেন। মিসেস মালবিকা হাজরা অন্য একটা টেবিলে একা বসে চুলের ক্লিপ দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। চোখ বন্ধ। খুব আরাম পাচ্ছেন মনে হল।

কৌশল্যাদি শেষপ্রান্তের টেবিলে জানালার ধারে একা বসে চা বা কফি পান করছেন। আমাদের চোখের ভাষায় কাছে ডাকলেন। কর্নেলকে দেখে ডঃ পাণ্ডে বললেন, কী সর্বনাশ হল দেখুন কর্নেল সরকার! আমি সাড়ে নটার ট্রেন মিস করব।

কর্নেল বললেন, আপনার স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়ে গেছে?

স্টেটমেন্ট কী বলছেন? জেরা। আর উদ্ভট সব প্রশ্ন। আমি থাকি পাটনায়। আমি কস্মিনকালে শ্রাবন্তীকে দেখিনি। ডঃ হাজরার সঙ্গেও এখানে এসে পরিচয় হয়েছে।

জেরা শেষ হলে তো বোর্ডারদের চলে যেতে অসুবিধা নেই! আপনি কি ওঁদের জানিয়েছেন সাড়ে নটার ট্রেনে আপনি ফিরবেন?

বলেছি। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সোজা বললেন, সব বোর্ডারের সঙ্গে কথা বলার পর সকলের বক্তব্য একসঙ্গে মিলিয়ে পরীক্ষা করা হবে। তারপর আমরা যেতে পারব। আমরা দেখছি কয়েদি!

ডঃ হাজরা বললেন, আমার ট্রেন ছিল আজ সাড়ে বারোটায়। কিন্তু মিসেস বায়না ধরেছেন, দুদিন থাকবেন।

কর্নেল বললেন, আসলে মার্ডার কেস। পূর্বাচল হোটেলের মালিকরা সুনামহানির ভয়ে সম্ভবত পুলিশের ওপরমহলে চাপ দিয়েছেন। আমার অবস্থাও তা-ই।

ডঃ পাণ্ডে বললেন, তবু তো আপনাকে বেরুতে দিয়েছিল। আপনি রিটায়ার্ড সামরিক অফিসার। অবশ্য আমার কানে এসেছে, আপনি নাকি সি. বি. আইয়ের সঙ্গে যুক্ত।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, ভুল শুনেছেন ডঃ পাণ্ডে! তবে এটা ঠিক, কোনো রহস্যজনক ঘটনা ঘটলে তাতে আমি নাক গলাই।

ডঃ হাজরা বাঁকা হেসে বললেন, আমি কলকাতার লোক। আমি জানি কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের অন্য পরিচয়। কাজেই আশা করছি, আমার ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের খুনী ধরা পড়বে।

কর্নেল শুধু বললেন, দেখা যাক।

আমরা দুজনে কৌশল্যাদির টেবিলে গেলুম। কর্নেল তার পাশে বসলেন। আমি উল্টোদিকের চেয়ারে বসলুম। কৌশল্যাদি আস্তে বললেন, পুলিশকে সব বোর্ডারের জিনিসপত্র সার্চ করতে বললে আমার ফাইলটা হয়তো পাওয়া যেত।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, খুনী সম্ভবত এত বোকা নয় যে, তোমার ফাইল হোটেলে রেখে দেবে। সে তা বাইরে পাচারের প্রচুর সুযোগ পেয়েছিল। কারণ কাল সন্ধ্যার আগে বৃষ্টির সময় তুমি হোটেল দ্য শার্কে ডঃ আচারিয়ার কাছে গিয়েছিলে।

কৌশল্যাদির মুখে বিষাদের ছাপ পড়ল। আমি বললুম, কৌশল্যাদি। আপনি তো নিজেই রিসার্চ করে ওই ফরমুলা-ফরমুলাই বলছি, উদ্ভাবন করেছেন। কাজেই ফরমুলা আপনার জানা। আপনার ফরমুলা চোর তা নিয়ে মুখ খোলার আগেই আপনি সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে জানিয়ে দিন যে, এই ফরমুলা আপনার উদ্ভাবিত।

কৌশল্যাদি তেমনি চাপাস্বরে বললেন, আমার উদ্ভাবিত প্রক্রিয়া খুব সাংঘাতিক। ভারতের কোনো শত্রুরাষ্ট্রের হাতে তা পড়লে ওই প্রক্রিয়ার সাহায্যে কত ভয়ঙ্কর ভাইরাস ভারতের মাটিতে তারা ছড়িয়ে দেবে। হয়তো রাতারাতি দেখা যাবে দেশের কোথাও কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোটি কোটি বিষাক্ত পোকামাকড়। তাদের বিষ দ্রুত সংক্রামিত হবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

শিউরে উঠে বললুম, কী সর্বনাশ! এ ধরনের গবেষণা করা উচিত হয়নি। কৌশল্যাদি।

আমি তো ভাবিনি আমার গবেষণা কোথায় পৌঁছবে। জিনোমতত্ত্ব অনুসারে খুদে প্রাণীর কোষের মধ্যে জিন নামক জিনিসে থাকে ডি এন এ অপু। জিনগুচ্ছ কোষে মালার মত সাজানো থাকে। তা থেকে ডি এন এ নিষ্কাশন  করে তার আণবিক গঠন ওলটপালট করে দেখতে চেয়েছিলাম কী দাঁড়ায়। বহু উদ্ভাবন বিজ্ঞানের ইতিহাসে দেখা যাবে দৈবাৎ হয়ে গেছে। আমি অসহায় জয়ন্ত!

কর্নেলের ইশারায় নব এল। তাকে তিনি একপট কফি আর বিস্কুট আনতে বললেন। তারপর কৌশল্যাদিকে বললেন, সম্মেলনে আরেকজন জিনোমবিজ্ঞানী এসেছিলেন। ডঃ অশোক সাঠে। তিনি তো পরশু বিকেলে চলে গেছেন। ডঃ সাঠে তোমার পেপার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের মতো অনুন্নত দেশে ডি এন এ-র গঠন পরীক্ষার মতো সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি নেই। ল্যাবরেটরিও নেই। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ওয়াটসনের কাজকর্মের স্তরে পৌঁছতে আমাদের দুশো বছর অপেক্ষা করতে হবে।

কৌশল্যা বললেন, অশোক ব্যঙ্গ করেছিল। সে থাকে বাঙ্গালোরে। আমি দিল্লিতে। কাজেই আমি অনেক বেশি সুবিধা পাই তার চেয়ে। তাছাড়া আমার বাড়িতে নিজস্ব ল্যাব আছে। মামী যখনই তাঁর দেশে যান, আমার কথামতো কিছু কিছু ল্যাব সরঞ্জাম কিনে আনেন। একটু-একটু করে কোনো সরঞ্জামের খুদে টুকরো আনলে কাস্টমস কিছু টের পাবে না।

অশোক সাঠে তোমার পরিচিত মনে হচ্ছিল?

খুবই পরিচিত। একসময় সে দিল্লিতে আমার সঙ্গে কাজ করত।

নব কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, অশোক সাঠে ছিলেন হোটেল দ্য শার্কে। ডঃ আচারিয়া এখনও সেখানে আছেন। তুমি রিসেপশনে গিয়ে তাকে ফোন করে জেনে নিতে পারো, অশোক সাঠের স্যুইটে যিনি ছিলেন, তিনি চলে গেছেন কি না। অথবা তিনি সিঙ্গল স্যুইটে থাকলে কার সঙ্গে তার বেশি ঘনিষ্ঠতা লক্ষ্য করেছেন ডঃ আচারিয়া এবং সেই লোকটি এখনও আছে কি না। আমার কথা বুঝতে পারছ?

কৌশল্যাদি তখনই উঠে গেলেন। আমি বললুম, ডঃ আচারিয়ার অন্তত একবার এখানে এসে কৌশল্যাদির খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত ভদ্রলোক একবারও সময় পেলেন না এখানে আসার?

ফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন। কৌশল্যা ভোরে বলছিল।

কিন্তু সশরীরে আবির্ভূত হচ্ছেন না কেন?

কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, ছা! ছ্যা! তুমি না সাংবাদিক? লক্ষ্য করোনি তাঁকে? দুদিন ধরে সম্মেলনে ছিলে তুমি। ফ্যাক্সে কলকাতায় সম্মেলনের খবর পাঠিয়েছ। অথচ সম্মেলনের প্রধান বক্তা পরিবেশবিজ্ঞানী ডঃ রঘুবীর আচারিয়াকে দেখনি?

কেন দেখব না? বসে পেপার পড়ছিলেন। বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।

 সবাই দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আর উনি বসে কেন, মাথায় এল না?

অসুস্থ বুঝি?

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, ডঃ আচারিয়ার একটা পা নেই। ক্রাচে ভর করে চলাফেরা করেন। হিমালয়ে প্রকৃতি পরিবেশের রূপান্তর দেখতে গিয়ে হঠাৎ খাদে পড়ে যান।

আমি ওইসব পেপার তত বুঝিনি বলে কারো দিকে তত লক্ষ্য রাখিনি।

কর্নেল হেসে ফেললেন। হায় জয়ন্ত! তুমি যদি শ্রাবন্তীর সঙ্গে ভাব জমাতে পারতে, তাহলে মেয়েটা বেঘোরে প্রাণ হারাত না।

আমার তো ফিল্মহিরোর মতো চেহারা নেই। তত স্মার্টও নই।

এই সময় নীচের রাস্তা থেকে পাগলাবাবুর জোরালো গলার গান শোনা গেল।

‘সকলই ফুটিল, ভাই! সকলি ফুটিল
কাননে কুসুমকলি।
মাইরি, সকলি ফুটিল…’

 বললুম, এ কী গান! পাগলাবাবুটি আর গান খুঁজে পেল না?

কর্নেল আস্তে বললেন, গান বা নিছক পদ্য নয় জয়ন্ত! এটা একটা কূটাভাষ। এর নিশ্চয় অর্থ আছে।

চমকে উঠে তার দিকে তাকালুম। কর্নেল আর মুখ খুললেন না।

.