কালো নেকড়ে – ৩

০৩.

 সেহরাগড় রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে যখন পা দিলুম, তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। মাঝারি ধরনের স্টেশন। কিন্তু প্লাটফর্ম জনশূন্য বললেই চলে। কয়েকজন যাত্রী নেমেছিল। তারা দ্রুত যেন মিলিয়ে গেল কাথায়। পরে বুঝলুম, ট্যাক্সি বা অটোরিকশায় চেপে তারা চলে গেছে। স্টেশনের নিচের চত্বরে ছোট বাজার। সব দোকানপাটই বন্ধ। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বয়ং ছোটনবাব মির্জা হায়দার আলি বেগ। তার পিঠে বন্দুক দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। গম্ভীরমুখে প্রথমে কর্নেল, তারপর আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আসুন।

হালদারমশাই কর্নেলের পরামর্শ মতো আমাদের সঙ্গে আসেননি। তিনি ট্রাঙ্ককল করে কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। মির্জা সাহেবে নেমকার্ড তাঁকে দিয়ে এসেছেন কর্নেল।

গাড়িটা অ্যাম্বাসাডার। কর্নেল মির্জা সাহেবের পাশে বসলেন। আমি বসলুম পেছনে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মির্জা সাহেব বললেন, গাড়ি আমি কদাচিৎ ব্যবহার করি। ঘোড়াই আমার পছন্দ। তবে এই গাড়িটা পুরনো মডেলের আর মজবুত। কিছু পার্ট বদলে গাড়িটাকে পাহাড়ি এলাকায় চলার উপযুক্ত করে নিয়েছি।

কর্নেল বললেন, রাস্তাঘাট একেবারে খাঁ-খাঁ করছে দেখছি। সম্ভবত কালো নেকড়ের ভয়ে।

মির্জা সাহেব বললেন, হ্যাঁ। তবে এদিকটায় ভয়ের কারণ নেই। সেহরা নদীর ব্রিজ পর্যন্ত ঘনবসতি এলাকা। বনজঙ্গল সবই ওপারে। এই মোড় পেরিয়ে হাইওয়ে দিয়ে আপনি রিজার্ভ ফরেস্টে গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি।

নদীর ব্রিজ পেরিয়ে হাইওয়ে ডাইনে চলে গেল। এবার আমরা সংকীর্ণ একটা পাহাড়ি রাস্তায় পৌঁছলাম। রাস্তাটার দুধারে গাছ, ঝোপঝাড় আর প্রকাণ্ড সব পাথর হেডলাইটের আলোয় ঝলসে যাচ্ছিল। মির্জা সাহেব বললেন, আমাদের কেল্লাবাড়িটা একটা টিলার মাথা কেটে তৈরি করা হয়েছিল। কাছাকাছি স্থানীয় এবং বাইরের কিছু বড়লোকের রেস্টহাউস আছে।

কালামহল তো নদীর ধারেই?

হ্যাঁ। নদী ওখানে বাঁক নিয়েছে। কালামহল কোন যুগে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ঠাকুর্দার আমলে তৈরি বাড়িটাও ভেঙেচুরে গেছে। পাঁচ একর জায়গার মাঝামাঝি জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল তুলে আমার চাচা একদিকে আর আমার মা একদিকে থাকতেন। চাচার বাড়িটা বিশাল। আমাদেরটা ছোট এবং দোতলা। মায়ের মৃত্যুর পর আমেরিকা থেকে ফিরে আমি সেই বাড়িটা ওয়েস্টার্ন মডেলে নতুন করে তৈরি করেছিলুম। ওপরে টালির চাল। জিওমেট্রিক প্যাটার্ন।

আমার আবাক লাগছিল, ওঁরা কাদের বখশের মৃত্যু সম্পর্কে কোনো কথাই বলছেন না। আবার চড়াইয়ের পর উত্রাইয়ে নেমে গাড়ি বাঁদিকে ঘুরল। তখন একটা অর্ধবৃত্তাকার কালো পাঁচিল এবং গেট দেখতে পেলুম। গেটের মাথায় এবং ভেতর দিকে আলো জ্বলছে। এতক্ষণ ভুতুড়ে ধরনের জ্যোৎস্নার পর আলো দেখে ভালো লাগল।

গেটের কাছে দুজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দুজরেনই হাতে লম্বা টর্চ। একজনের পিঠে বন্দুক। অন্যজনের হাতে বল্লম। তারা গেট খুলে দিয়ে একটু ঝুঁকে কপালে হাত ঠেকাল। মির্জা সাহেব বললেন, খুদা বখশ! কুমারসাব কুছ খবর ভেজা?

শক্তসমর্থ গড়নের বন্দুকধারী লোকটি বলল, জি নেহি! লেকিন ডাগরদারসাব টেলিফোন কিয়া। রহিমসাবকো টেলিফোনমে কুছ বোলা, মালুম হ্যায়! রহিমসাব তুরন্ত মোটরবাইক লেকে চলা গেয়া। আভি লোটা নেহি।

ঠিক হ্যায়। রহমত! তুম যাও। খুদা বখশ! তুম ডিউটি করো।

ভেতরে একটা ঝোপঝাড়ে ভরা ধ্বংসাবশেষের পাশে সারবন্দি একতলা কয়েকটা ঘর। কানে এল, কোনো মেয়ে চাপা গলায় সুর ধরে কাঁদছে। মনে হলো ইতিহাসের অভ্যন্তর থেকে শোকাচ্ছন্ন কোনো আত্মার দীর্ণ বিলাপ।

ধ্বংসাবশেষের ডানদিক দিয়ে মুড়িবিছানো রাস্তায় খড় খড় শব্দ করতে করতে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল। মির্জাসাহেব বললেন, এটা একসময় মসজিদ ছিল। এখন জঙ্গল গজিয়ে গেছে।

এবার ফুলবাগান, কেয়ারি করা পায়ে চলা রাস্তা এবং খোলামেলা জায়গা পেরিয়ে বিলিতি কান্ট্রি হাউসের মতো একটা বাড়ির পোর্টিকোর তলায় গাড়ি থামল।

চাওড়া বারান্দায় এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমাদের অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে আদাব দিলেন। মির্জাসাহেব বললেন, শাকিল মিয়াঁ! আপ মেহমান লোগোঁকো দেখিয়ে। হাম আভি আতা হ্যায়।

কর্নেল বারান্দায় বেতের টেবিল-চেয়ার দেখিয়ে বললেন, শাকিল মিয়াঁ। হামলোগ ইহা পর আভি বইঠেগা। ইহা আচ্ছা জাগাহ্ হ্যায়।

শাকিল মিয়াঁ আবার কুর্নিশ করে বললেন, আপলোগোঁকা মর্জি! তো স্যার! আপলোগোঁনে কালকাত্তাসে আয়া। হামি থোড়া থোড়া বাংলা ভি জানি। হামি ছোটা নবাবসাবকা প্রাইভেট সেক্রেটারি আছি। কোনো অসুবিধা হোবে না।

ভদ্রলোক ভেতরে গিয়ে চাপা গলায় ডাকলেন, মুন্নিজান! মুন্নিজান!

বাড়িটার মাথায় উজ্জ্বল আলো। সেই আলোয় দেখলুম, ডানদিকের একটা গ্যারাজে মিজাসাহেব গাড়ি ঢোকাচ্ছেন। তার ওপাশে আর একটা গ্যারাজ। মৃদু আলোয় সেই ঘরে একটা প্রকাণ্ড চেহারার লাল রঙের ঘোড়া দেখা গেল। ওটা তাহলে ঘোড়াশালা। লোহার গরাদ ঘেরা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা।

মির্জা সাহেব গাড়ির গ্যারাজে তালা এঁটে আমাদের কাছে এলেন। পিঠের বন্দুকটা এতক্ষণে স্পষ্ট দেখতে পেলুম। ওটা একটা রাইফেল।

রাইফেলটা একটা চেয়ারের পাশে কাত করে রেখে তিনি বললেন, কর্নেল সরকার যে এখানেই বসবেন, আমি জানতুম। জ্যোৎস্নাও চমৎকার ছিল আজ। কিন্তু বাড়ির লোকেরা ভয় পেয়েছে। তাই আলো জ্বেলে রাখা হয়েছে।

শাকিল মিয়াঁ এবং তার সঙ্গে একজন সালোয়ার-কামিজ পরা কিশোরী ট্রে নিয়ে এল। টেবিলে ট্রে রেখে কুর্নিশ করে মেয়েটি চলে গেল। বুঝলুম, এর নামই মুন্নিজান।

শাকিল মিয়াঁ মৃদুস্বরে বললেন, কফি স্যার। থোড়াসা স্ন্যাক্স। আধাঘণ্টা বাদ ডিনারকি বন্দোবস্ত কিয়া যায়েগা।

মির্জাসাহেব একটু হেসে বললেন, আরে মিয়াঁ! আপ তো কলকাত্তামে থে। বাংলা বোলিয়ে!

জি হাঁ সাব! থোড়াসা জানতা। জরুর ম্যায় কোশিস করেঙ্গে।

ঠিক হ্যায়! ডিনারকি ইন্তেজাম কিজিয়ে।

প্রাইভেট সেক্রেটারি আবার কুর্নিশ করে চলে গেলেন। মির্জাসাহেব বললেন, কফি খেয়ে ক্লান্তি দূর করুন। তারপর গেস্টরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেবেন। পোশাক বদলে ফেলবেন।

কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল এতক্ষণে বললেন, মর্গের রিপোর্টে কী বলা হয়েছে?

মির্জাসাহেব পোর্টিকোর দিকে তাকিয়ে বললেন, রহমত! তুম অন্দর যাও। মুন্নিবেটিকি সাথ হাত লাগাও।

লোকটার চেহারায় কেমন যেন হিংস্রতা আছে। সে বল্লমটা বারান্দার একপাশে শুইয়ে রেখে ভেতরে চলে গেল।

মির্জাসাহেব চাপা স্বরে বললেন, কাদের বখশ জানোয়ারের হামলায় মারা পড়েছে বলা হয়েছে। জানোয়ারটার দাঁতের দাগ আছে গলায়। যাই হোক, ডাক্তারবাবু টেলিফোন করেছিলেন শুনলুম। আমার দূরসম্পর্কের ভাগ্নে রহিম খান তার কাছে গেছে। ছেলেটা বড় ডানপিটে। এত রাতে না গেলেই চলত না?

কর্নেল বললেন, আপনাদের পারিবারিক কবরখানা কোথায়?

মির্জাসাহেব বললেন, কাছেই। ঘটনা হলো, কাদের বখশ রোজ সন্ধ্যায় কবরখানার লাগোয়া পীরের মাজারে সাঁঝবাতি জ্বেলে দিয়ে আসে। আমার ধর্মে মত নেই। সীরবুজুর্গ লোকেদের প্রতি ভক্তি নেই। শুনেছি, আমার পূর্বপুরুষেরা পীরভক্ত ছিলেন। ওই মাজার–মানে পীরের সমাধি ভবন নাকি পাঁচশো বছর আগে তৈরি হয়েছিল। তো আমি কলকাতা যাওয়ার পরদিন সন্ধ্যায়—গত পরশু রোজকার মতো কাদের বখশ সাঁঝবাতি জ্বালতে গিয়েছিল। অনেক রাতেও সে ফিরছে না দেখে তার জামাই রহমত–যাকে আপনারা দেখলেন, সে শ্বশুরের খোঁজে যায়। কিন্তু খুঁজে পায়নি। কাল সকালেও যখন কাদের বখশ বাড়ি ফিরল, তখন এ বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। সেই সময় একটি আদিবাসী মেয়ে এসে খবর দেয়, কবরখানায় একটা লাশ পড়ে আছে। মেয়েটি পাশের জঙ্গলে মহুয়া গাছে উঠে মহুয়া ফল পাড়ছিল। হঠাৎ লাশটা তার চোখে পড়ে।

কাদের বখশের লাশ কি মর্গ থেকে আনা হয়েছে?

মির্জাসাহেব শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। আজ বিকেলে লাশ এলে ওই কবরখানায় কবর দেওয়া হয়েছে। কবরখানার একপাশে আমাদের পরিবারের কর্মচারীদের কবর দেওয়ার রীতি আছে। তবে তাদের কবর পাকা নয়। স্রেফ মাটির কবর।

কর্নেল এবার চুরুট ধরালেন। একটু পরে বললেন, বাই এনি চান্স আপনি নাসিমা নামে কোনো মহিলাকে চেনেন?

মির্জাসাহেব যেন একটু অবাক হলেন। নাসিমা? না তো! কে সে?

পরে বলব। আপনি চাঁদ মিয়া নামে কাউকে চেনেন?

চাঁদ মিয়া? মির্জাসাহেব মাথা নাড়লেন।

 কর্নেল একটু হেসে বললেন, বিট্টু পাহলোয়ান? ওরফে সেকেন্দার আলি?

মির্জাসাহেব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর হেসে ফেললেন। ফরেস্ট কনজারভেটর মাধব পাণ্ডে আপনার সম্পর্কে যা সব বলেছিলেন, কাঁটায়-কাঁটায় মিলে যাচ্ছে দেখছি! তবে আশা করি, যাদের কথা বললেন, তারা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত নয়? নাকি তারাই

কর্নেল দ্রুত বললেন, এখনও জানি না। তো আর একজনের কথা জিজ্ঞেস করি। হোসেন আলি নামটা কি আপনার চেনা মনে হচ্ছে?

হোসেন আলি–মির্জাসাহেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ। এ নামটা যেন শুনেছি।

হোসেন আলি আপনার চাচা মির্জা আব্বাস আলি বেগের ঘোড়ার সহিস ছিল।

মির্জাসাহেব নড়ে বসলেন। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আমার চাচা শত্রুতা করলেও এই লোকটা মায়ের অনুগত ছিল। এমন কি কলকাতায় গিয়ে গোপনে আমার চাচার ক্রিয়াকলাপের খবর দিয়ে আসত।

বিট্টু পাহলোয়ান তারই ছেলে যার আসল নাম সেকেন্দার আলি।

ঘরের দরজায় শাকিল মিয়াঁকে দেখতে পেয়ে মির্জাসাহেব বললেন, ওসব কথা পরে হবে। আপনারা শাকিল মিয়াঁর সঙ্গে গেস্টরুমে যান। প্রায় এগারোটা বাজতে চলল।

মির্জাসাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি আমাদের বারান্দা দিয়ে নিয়ে গেলেন। পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একতলায় একটা বড় ঘর। সুন্দর বিলিতি কেতায় সাজানো। দুধারে দুটো খাট। সোফা, ডিভান, কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিলও আছে। শাকিল মিয়াঁ আমাদের ডিনারের জন্য তৈরি হতে বলে চলে গেলেন।

পেছনে দক্ষিণ দিকের দরজা খুলে কর্নেল বললেন, এদিকেও ফুলবাগান আছে। তবে ওই উঁচু পাঁচিলটা সব সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। তা ছাড়া এত উজ্জ্বল আলো! চাঁদটাকে কোতল করেছে যেন।

উঁকি মেরে দেখে বললুম, নেকড়েটা অত উঁচু পাঁচিল ডিঙোতে পারবে না।

কর্নেল দরজা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকলেন …

নবীন ঐতিহ্যের সঙ্গে বিলিতি রীতিমেশানো ডিনার খেয়ে আমার ভয় করছিল, পেটে গণ্ডগোল বাধবে না তো? খাবার ঘর দোতলায়। সিঁড়িতে নামবার সময় বলেছিলুম, মির্জাসাহেব! সঙ্গে হজমি ট্যাবলেট আনিনি কিন্তু!

মির্জাসাহেব শুধু হেসেছিলেন। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি শাকিল মিয়াঁ বলেছিলেন, কুছ হবে না স্যার। মাত্ ঘাবড়াইয়ে। ওহি যো শরবত পিয়েছেন, উয়ো হজমি আরক আছে।

মির্জাসাহেব গেস্টরুমে এসে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন। শাকিল মিয়াঁ পরামর্শ দিয়েছিলেন, অ্যাটাচড় বাথরুম আছে স্যার! জেরা হোশিয়ারিসে রহৃনা পড়ে। কভি বাহার মাত্ যাইয়ে। দরকার হেনেসে উয়ো কলিং বেলকি সুইচ হ্যায়।

বরাবর আমার অভ্যাস, অচেনা জায়গায় প্রথম রাত্রিটা ভালো ঘুম হয় না এবং ঘুম খুব দেরিতে আসে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। তাই ফ্যান আস্তে ঘুরছিল। মশারির ভেতর শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলুম। কর্নেলের যথারীতি নাকডাকা শুরু হয়েছিল।

তারপর কখন সবে ঘুমের টান এসেছে, হঠাৎ বাইরে দুরে কোথাও একটা অদ্ভুত জান্তব চিৎকার কানে এল। কতকটা এইরকম : অ-উ-উ-উ-উ! অ-উ উ-উ-উ! অ-উ-উ-উ-উ!

ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ও কিসের চিৎকার? চিৎকার না অর্তনাদ? সারা শরীর অজ্ঞান আশঙ্কায় শিউরে উঠল। ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল!

কর্নেলের নাকডাকা থেমে গেল।

 বললুম, একটা সাংঘাতিক চিৎকার শুনলুম।

 হু। বলেই কর্নেল ঘুমে তলিয়ে গেলেন। নাকডাকা শুরু হলো আবার।

অদ্ভুত মানুষ। কিন্তু ওঁকে জাগাতে হলে আবার একটা হুঁ শুনব। বরাবর দেখে আসছি, ওঁর এই অদ্ভুত অভ্যাস। আমার ঘুমটা পণ্ড হলো। কান খাড়া করে থাকলুম। বাইরে জোরে বাতাস বইছে। গাছপালার পাতায় সর সর শো শোঁ শব্দ। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ মনে হলো, আমি কি সেই কালো নেকড়ের চিৎকার শুনলুম? কিন্তু চিৎকারটা যেন আর্তনাদের মতো।

তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঘুম ভাঙল কারও ডাকে–স্যার! স্যার! চায় লায়া।

মশারি থেকে বেরিয়ে দেখি, রহমত বেড-টি এনেছে। সে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে যত্ন করে মশারি গুটিয়ে দিল। কর্নেলের মশারি কখন গুটানো হয়েছে। তার বিছানা খালি। জানালা দিয়ে বসন্তকালের ঝলমলে রোজ দেখা যাচ্ছে।

রহমত বলল, কর্নিলসাব ছোটে নবাবসাবকা সাথ বাহার ঘুমনে গেয়া।

ঠিক আছে। বলে বিছানায় বসে অভ্যাসমতো বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিলুম। রহমত সেলাম ঠুকে চলে গেল। কাল রাতে এই লোকটাকে কেন যেন হিংস্র দেখাচ্ছিল। আজ সকালে তার মুখে বেশ নরম আর ভদ্র ভাব।

পরে মনে হলো গোঁফ আর গালপাট্টার জন্য ওর চেহারায় আমি হিংস্রতা আরোপ করেছিলুম। এ বাড়িতে গত রাতে যে তিনজনকে দেখেছি, তাদের মধ্যে শুধু শাকিল মিয়াঁর মুখেই দাড়ি আছে। তবে দাড়িটা ফ্রেঞ্চকাট। লোকটাকেও শিক্ষিত মনে হচ্ছিল।

হ্যাঁ। শিক্ষিত না হলে সে মির্জাসাহেবের প্রাইভেটে সেক্রেটারি হবে কেমন করে?

চা খেয়ে বাথরুম সেরে ধোপদুরস্ত পোশাক পরে বারান্দায় সেই বেতের চেয়ারে বসলুম। দিনের আলোয় বাড়িটাকে বেশ সাজানো-গোছানো মনে হলো। বাঁদিকে পশ্চিমে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। ডানদিকে গ্যারেজের ওপাশে টেনিস লন। উত্তরে টানা কালো পাথরের পাঁচিলে আগাছা গজিয়ে আছে। উত্তর-পূর্ব কোণে কালো পাথরের বিশাল ধ্বংসপ চোখে পড়ল। ওটাই কি সেই কালামহল?

টেনিস লনটা দেখে মনে হলো, ওখানে মির্জাসাহেব আর তার মার্কিন স্ত্রী এমিলি একমসয় টেনিস খেলতেন। জায়গাটা এখন শূন্য দেখাচ্ছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ওদিকে উঠে যাবার জন্য দাঁড়িয়েছি, শাকিল মিয়াঁ এসে আদাব দিলেন। বললেন, রহমত আছে। চায়-কফি কুছুর দরকার হলে তাকে ডাকবেন স্যর! হামি এমন বাহার যাচ্ছে।

জিজ্ঞেস করলুম, ছোট নবাব সাহেবের ভাগ্নে রহিম খান ফিরেছেন?

শাকিল মিয়াঁ একটি হেসে বললেন, জি হাঁ। রাত এক বাজনেকা বাদ উনহি এলেন। মোটরবাইক বিগড়ে গিছলো। বহত ডেয়ারডেভিল ইয়ং ম্যান–উয়ো। লড়কা। ছোটেনবাবসাব বহত্ রাগ করলেন।

রহিমসাব কি উঠেছেন?

আভি সাড়ে আট বাজা। উনহি উঠবে, দশ-সাড়ে দশ বাজবে তখন। বলে শাকিল মিয়াঁ কণ্ঠস্বর চাপা করলেন। ছোটানবাবসাবের কৈ লড়কা-লড়কি না আছে? ইস লিয়ে রহিমবাবা আপনা খেয়ালসে কাম করে।

রহিমবাবা মানে?

সব উনহিকো খাতিরসে বাবা বোলতা। উর্দুমে বাবা বহত্ অনারেবল ওয়ার্ড স্যার।

শাকিল মিয়াঁ বারান্দার অন্যপ্রান্তে দাঁড় করানো একটা সাইকেল আর কেরিয়ারে ব্যাগ এঁটে চলে গেলেন। সম্ভবত বাজারে যাচ্ছেন।

একটু পরে দেখি, একটা চৌদ্দ-পনের বছরের ছেলে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওদিক থেকে একটা লাল রঙের ঘোড়ার রাশ টানতে টানতে সামনের প্রাঙ্গণ দিয়ে ঘোড়াশালায় গেল। যাবার সময় সে আমাকে দেখতে দেখতেই গেল। সে ঘোড়াটা বেঁধে একটা জাবনায় তার খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত হলো।

রহমত এসে আদাব নিয়ে জানতে চাইল আর চা বা কফি খাব কি না। আমি মাথা নাড়লে সে ঘোড়াশালের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ছেলেটিকে বলল, আ বে ডিব্ব! তু আস্তাবলমে কেয়া করতা? তু ঘোড়া হো যাবে, ঘোড়া বন যা! হাম তেরা সওয়ার হোগা।

ছেলেটি রাগ করে বলল, দিললাগি মাত্ করো রমহতভাই!

মির্জাসাহেবের বাড়ির চালচিত্র এমনি করে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ভাবছিলুম, ওঁর আয়ের উৎস কী। এতগুলো লোক পুষছেন। তাদের মাইনেও দিতে হয়।

একটু পরে কর্নেল এবং মির্জাসাহেবকে দেখতে পেলুম। কর্নেলের পিঠে কিটব্যাগে প্রজাপতিধরা জালের স্টিক উঁচু হয়ে আছে। বুকের ওপর ঝুলছে বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা। মাথায় টুপি। আর মির্জাসাহেবের কাঁধে সেই রাইফেল।

কাছে এসে মির্জাসাহেব আমাকে মর্নিং সম্ভাষণ করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কর্নেল এসে চেয়ারে বসেই বললেন, কাল রাত্রে তুমি কী যেন বলছিলে?

বললুম, আপনি গ্রাহ্য করলেন না। একটা অদ্ভুত চিৎকার শুনছিলুম। জানোয়ারের ডাক কিংবা কারও আর্তনাদ!

কর্নেল একটু হেসে কিটব্যাগটা পাশে রাখলেন। তারপর আস্তে বললেন, কাদের বখশ কবরখানায় মারা পড়েনি। তাকে পীরের কবরের কাছে মেরে টানতে টানতে নবাবী কবরখানায় আনা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য জয়ন্ত! পীরের কবরের কাছে এক জায়গায় টাটকা গর্ত খোঁড়া হয়েছে। লাশটা পুঁতে ফেলার জন্য ওভাবে গর্ত খোঁড়ার মানে হয় না। তাছাড়া গর্ত খোঁড়া হয়েছে শাবল দিয়ে। ওখানে কি কিছু লুকানো ছিল? মির্জাসাহেবের ব্যাখ্যা আমার মনঃপূত হয়নি।…

.